ভিক্টর মাথা নিচু করে চুপ হয়ে বসে থাকল। তাকে নীরব থাকতে দেখে রাশেদ বললো, ‘তুমি কি মনে করছে, আমি ভুল করেছি?’
‘জানি না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, মেয়েটা তাদেরই গোয়েন্দা।’
‘তার মানে তুমি বলতে চাও, আমি এক অবুঝ ও আনাড়ী গোয়েন্দা! তার কাছে পরিচয় দিয়ে আমি ভুল করেছি?’
‘তুমি ভালো শুধু এটাই করেছে যে, আমার নামটা তার কাছে বলোনি।’ ভিক্টর বললো, ‘এখন তুমি নিজেই ঠিক করো, তুমি আনাড়ী ও অবুঝ কি না।’
‘আমি কি তাহলে সত্যি ভুল করে ফেলেছি!’ চেঙ্গিস আপন মনেই বললো কথাটা।
‘হয়ত হতেও পারে, তুমি বিরাট একটা ভাল কাজ করে ফেলেছো।’ ভিক্টর বললো, ‘আর যদি ভুলই করে থাকো তবে সেটাও কোন ছোটখাটো ভুল নয়। তুমি হয়তো ভুলেই গেছো, শুধুমাত্র একটি গোয়েন্দাই একটি সেনাদলের বিজয়ের কারণ হতে পারে। আর যদি ভুল হয়, তবে সে একাই তার দলকে ডুবিয়েও দিতে পারে। তুমি তো জানোই, সুলতান আইয়ুবী ক্রুসেড বাহিনীর এই বিরাট রণপ্রস্তুতি ও যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর। যদি আমরা ধরা পড়ে যাই, আর আমাদের সাথে এ গোপন সংবাদও কারাগারে বন্দী হয়ে যায়, অথবা আমরা যদি জল্লাদের হাতে পড়ে যাই, তবে যে সুলতান আইয়ুবী প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রে আজও বিজয়ী বীর হিসেবে পরিচিতি হয়ে আসছেন, তিনিই একজন পরাজিত সেনানায়ক হয়ে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করবেন।’
‘না!’ চেঙ্গিস আত্মবিশ্বাস নিয়ে দৃঢ়তার সাথে বললো, ‘সে আমাকে ধোঁকা দেবে না, দিতে পারে না। সে এক মুসলিম মেয়ে। আমি কথা মত আজ রাতেও তার কাছে যাবো। সে আরও গোপন খবর নিয়ে আমার সঙ্গে যাবে। এখন আর আমার ইমাম সাহেবের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই তথ্য এখন আমরা নিজেরাই কায়রোতে নিয়ে যাবো। আমার সাথে থাকবে আমার হৃদয়ের রাণী। সে-ই আমাকে শহর থেকে বেরোনোর পথ পরিষ্কার করে দেবে। আমরা এমনভাবে শহর ছাড়বো, যেন কারো মনে কোন সন্দেহ না জাগে। আমার অনুপস্থিতিতে কেউ যেন একথা না ভাবে, আমিই এখানকার ক্রুসেড বাহিনীর গোপন খবর নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি। তুমি বরং প্রচার করে দিও, আমাদের দু’জনকে গোপনে মেলামেশা করতে দেখেছো। সম্ভবত মেয়েটি ছেলেটিকে নিয়ে জেরুজালেম পালিয়ে গেছে।’
ভিক্টর গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। রাশেদ চেঙ্গিস ঢুলুঢুলু চোখে শুতে গেল তার কামরায়।
যে সময় চেঙ্গিস ভিক্টরের কামরায় প্রবেশ করছিল, ঠিক সেই সময় তার থেকে একটু দূরে ক্রুসেড বাহিনীর অফিসারদের আশ্রয় ক্যাম্পে গিয়ে প্রবেশ করলো মেয়েটি! সে ক্যাম্পের এক তাঁবুতে ঘুমিয়ে থাকা একটি লোককে জাগিয়ে তুলল। লোকটির ঘুম ভাঙছিল না দেখে মেয়েটি লোকটির পা ধরে জোরে টান দিল। অবশেষে লোকটি হতচকিত হয়ে উঠে বসলো।
মেয়েটি হেসে বললো, ‘আমি শিকার ধরে ফেলেছি।’
সে লোক মেয়েটিকে তার বাহুতে জড়িয়ে নিয়ে বললো, ‘বলো, কি সংবাদ এনেছো।’
‘সে সত্যিই গোয়েন্দা।’ মেয়েটি বললো, ‘এবং সে মুসলমান।’
‘হরমনের সন্দেহটা তাহলে সত্যে প্রমাণিত হলো?’
‘সম্পূর্ণ সত্য।’ মেয়েটি বললো, ‘মদের নেশা ও আমার রূপের যাদুর কেরামতি দেখো। যাকে হরমনের মত উস্তাদ গোয়েন্দাও সনাক্ত করতে পারেনি, আমি সেই অসাধ্য সাধন করেছি।’
‘সত্যি, তোমার কোন তুলনা হয় না সুন্দরী। তার নকল দাড়িটা আমার হাতে না পড়লে আমিও হয়তো নাকাল হতাম। অবশ্য তাকে আমি সেদিনই সন্দেহ করেছিলাম, যেদিন প্রথম সে মদ পান করতে অস্বীকার করলো। তখনি আমার সন্দেহ হলো, সে মুসলমান। আমি যখন তাকে বললাম, আমি পবিত্র ভালবাসার পিয়াসী, তখন সে আমাকে ভোগ না করে পবিত্র ভালবাসাই দিল। কোন খৃস্টান এটা করতো না। আমাদের লোক হলে প্রথমেই সে আমাকে উলঙ্গ করার চেষ্টা করতো।’
‘ভালবাসা পবিত্র হোক বা অপবিত্র, মেয়েদের দেহটাই এমন কোমল যে, তা পাহাড়কেও গলিয়ে পানি করে দেয়।’ লোকটি বললো, ‘এই দুর্বলতা প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে। আমি তোমাকে বলেছিলাম না, তোমার অনুপম দেহ সে লোকের মুখোশ খোলার জন্য যথেষ্ট। দেখলে তো, সে লোক ফেরেশতা হলেও তোমার জালে ধরা পড়তো।’
কথা বলছিল খৃস্টান গোয়েন্দা সংস্থার এক অফিসার, যে হরমনের সহকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিল। হরমনের কোন কারণে সন্দেহ হয়েছিল, রাশেদ চেঙ্গিস বোধ হয় গোয়েন্দা। এমনিতেই এ লোক ছিল বিচক্ষণ, তার ওপর তাকে আদেশ দেয়া হয়েছে, যার ওপর সামান্য সন্দেহ হয় তাকেই গ্রেফতার করার। সুতরাং এ ব্যাপারে তিনি কড়া ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছিলেন।
রাশেদ চেঙ্গিস যে রাতে মসজিদে যায় সে রাতেই হরমন তার সহকারীকে বলেছিল, ‘চেঙ্গিসের পিছনে মেয়ে লাগাও। দেখো, সে আসল না নকল! ভেজাল না খাঁটি।’
ক্রুসেডের গোয়েন্দা বাহিনীতে এ কাজের জন্য অনেক সুন্দরী মেয়েই ছিল। হরমনের সহকারী এ মেয়েটিকেই বেছে নিল তাদের মধ্য থেকে এবং চেঙ্গিসের পিছনে তাকে লেলিয়ে দিল।
মেয়েটা ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথেই সে তার এতদিনের ট্রেনিং কাজে লাগাতে শুরু করে দিল। নারীর সহজাত ছলাকলায়ও সে ছিল খুবই পারদর্শী। সে চেঙ্গিসকে তার রূপের ফাঁদে আটকানোর নাটক শুরু করে দিল।
চেঙ্গিস কোনদিন সামান্য চিন্তাও করেনি, এমন ভয়াবহ ফাঁদে তাকে পড়তে হবে। সে যথারীতি ইমাম সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য কামরা থেকে বেরিয়েছিল। অমনি মেয়েটা তাকে অনুসরণ শুরু করে এবং বাগানের নিরিবিলিতে তার পথ আটকে দাঁড়ায়।
এই মেয়েটা কোথায় থাকে, কেমন করে সে তার পথে বের হওয়ার খবর পায়, এসব চিন্তা একবারও চেঙ্গিসের মনে পড়েনি। সে সহজেই মেয়েটিকে বিশ্বাস করে এবং তার খপ্পড়ে পড়ে যায়।
‘আমি তাকে তোমার শেখানো হৃদয় বিদারক কাহিনীটি এমনভাবে শুনালাম যে, তাতেই সে বুদ্ধ কাঁবু হয়ে গেল।’ মেয়েটি হরমনের সহকর্মীকে বললো, “সে অবলীলায় বিশ্বাস করে নিল, আমি সত্যিই মুসলমান এবং সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা।’
‘মুসলমান জাতিটাই আবেগপ্রবণ!’ হরমনের সহকর্মী বললো, ‘এই জাতিটা এক অদ্ভূত ও বিস্ময়কর জাতি। এই জাতি ধর্মের নামে এমন এমন কোরবানী দিয়ে থাকে, যা অন্য জাতি দিতে পারে না। যুদ্ধের ময়দানে এক মুসলমান দশ, কখনও পনেরো বিশ সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করে জয় লাভ করে। কখনো জয় লাভ করতে না পারলে শহীদ হয়ে যায়, কিন্তু পিছু হটে না। একেই তারা বলে ঈমানের শক্তি। আমি মুসলমানদের এই রূহানী শক্তিকে অস্বীকার করতে পারি না। মাত্র আট দশ জনের একটি কমান্ডো গ্রুপ অতর্কিতে আমাদের বিশাল বাহিনীতে ঢুকে পড়ে, রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়, আমাদের রসদপত্র, খাদ্যশস্যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়, আমাদের ঘেরাওয়ের মধ্য থেকে চোখে ধাঁ ধাঁ লাগিয়ে বেরিয়ে যায়, নিজেদের লাগানো আগুনে জ্বলেপুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়- এটা কোন সহজ কথা নয়। এটা অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের ব্যাপার। এই সাহস ও শক্তি আসে আধ্যাত্মিক প্রেরণা থেকে। এই আধ্যাত্মিক প্রেরণাকেই বলে মোজেযা।
মুসলমানদের এই শক্তি দুর্বল করার জন্য আমাদের বুদ্ধিজীবীরা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিভিন্ন উপায় বের করছে মুসলমানদের ধর্মীয় উন্মাদনাকে দুর্বল করার জন্য। এ ক্ষেত্রে ইহুদীরা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। আমরা সম্মিলিত ভাবে চেষ্টা করে এ ক্ষেত্রে কিছুটা সফলতাও লাভ করেছি।
আমরা কয়েকজন ইহুদী ও খৃষ্টানকে মুসলমান আলেম ও ইমামের ছদ্মবেশে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পাঠিয়ে দিয়েছি। মুসলিম এলাকার বেশ কিছু মসজিদের ইমাম এখন ইহুদী ও খৃস্টান। তারা কোরআন ও হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা ও তাফসীর পেশ করে। আর এ কাজটা এমন ভাবে করে, যা জনমনে গভীর রেখাপাত করে। এভাবে মুসলমানরা ভুল বিশ্বাসের শিকার হয়ে যাচ্ছে। জিহাদকে তারা এখন ধর্মীয় গোড়ামী বলে বুঝতে শিখছে। তাদের নৈতিকতার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাচ্ছে। আঞ্চলিকতা ও ধর্মীয় ফেরকাগত পার্থক্যকে অবলম্বন করে এখন তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার দৃষ্টান্তও তুলে ধরছে।’ থামল সহকারী।
মেয়েটি বলল, ‘আর আমরা বুঝি বসে আছি? আমাদের সাফল্যের দিকটাও বুঝতে চেষ্টা করো। আমরাই তো মুসলমানদের মধ্যে যৌন উন্মাদনা সৃষ্টি করেছি। এখন যে সকল মুসলমান ধনসম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী হয়, তাদের প্রথম কাজ হয় সুরক্ষিত অন্দর মহল বা হেরেম তৈরি করা। সেখানে সুন্দরী মেয়েরা তাদের হেরেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।’
‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছে। এই নারী পূজা এখন মুসলিম সমাজের সর্বস্তরে প্রবেশ করে গেছে। তোমরা মুসলমান মেয়েদের মধ্যে প্রসাধনী ও বিলাসিতার রোগ ছড়িয় দিতে যথার্থই সক্ষম হয়েছে। তাদের সময় ও অর্থ এখন এতেই অপচয় হয়।’
‘মুসলমানরা তো এমনিতেই আবেগময়।’ বললো মেয়েটি। ‘তাদের চেতনায় একটু আবেগের ঝড় তুলতে পারলেই তাদের জালে ফেলা যায়। তাদের এই আবেগপ্রবণতা ও তোষামোদপ্রিয়তাকে এখন কাজে লাগাতে হবে।’
হরমন সাহেব বলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে এ জাতি কল্পনাবিলাসী, ও গোলাম জাতিতে পরিণত হয়ে যাবে।’ বললো, হরমনের সহকারী। ‘তারা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে সরে যাবে। তখন আর আমাদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ কিংবা মহাসমরের প্রয়োজন পড়বে না। মুসলমানরা মানসিক দিক থেকেই আমাদের দাস হয়ে যাবে। তারা তাদের ঐতিহ্য ভুলে আমাদের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে তাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে থাকবে। এমনকি আমাদের কালচারকে ধারণ করতে পেরে নিজেরা গর্ববোধ করবে।’
‘আমার ঘুম পাচ্ছে।’ মেয়েটি বললো, ‘আমি তো তোমাকে মস্তবড় একটা শিকার ধরে দিলাম। এবার তাকে গ্রেফতার ক র ব্যবস্থা করো, আমি যাই।’
‘না!’ গোয়েন্দা সংস্থার সহকারী প্রধান বললো, ‘এখনও তোমার কাজ শেষ হয়নি। তাকে গ্রেফতার করার ইচ্ছা থাকলে এই নাটক করার কি প্রয়োজন ছিল? তোমাকে এত কষ্ট দেয়ারই বা কি দরকার ছিল! আমি তো যে কোন লোককে সন্দেহ মাত্র গ্রেফতার করতে পারি।’
‘তাহলে আর এত কষ্ট দিলে কেন?”
‘নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। শোন, তাকে এখন গ্রেফতার করবো না। তার কাছ থেকে তার সমস্ত সঙ্গীদের সন্ধান নিতে হবে। যারা, তাদের হয়ে ত্রিপলীতে গোয়েন্দাগীরি করছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমার বিশ্বাস, এখানে তাদের ধ্বংসাত্মক কমান্ডো বাহিনীও আছে। তুমি এদের সন্ধান বের করতে পারলে দেখা যাবে, হয়তো অন্যান্য শহরের গোয়েন্দাদের তালিকাও পেয়ে যাবো তাদের কাছে।
তুমি তো তার সাথে আবার সাক্ষাতের সময় ঠিক করেই এসেছে। তখন তাকে বলবে, তুমি গোপন তথ্য সবই জেনে নিয়েছ। এখন তোমার কয়েকজন কমান্ডো প্রয়োজন। কারণ, একস্থানে ক্রুসেড বাহিনীর অপরিমেয় আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও পেট্রোল জমা আছে। এগুলো জমা করা হয়েছে অভিযানের সময় সঙ্গে নেয়ার জন্য। পালাবার আগে এগুলো ধ্বংস করে যেতে পারলে ক্রুসেড বাহিনীর কোমর ভেঙে যাবে। তাই জীবন গেলেও এ কাজ সমাধা না করে তুমি কোথাও যেতে পারো না।’
‘বুঝতে পেরেছি।’ মেয়েটি বললো, ‘কিন্তু এ ব্যাপারে একটি অসুবিধা আছে। সে তার সাথীদেরকে আড়াল করার চেষ্টা করতে পারে।’
হরমনের সহকর্মী মেয়েটির নরম চুলে হাত বুলিয়ে বললো, ‘তোমার দেহের অস্ত্রগুলো কি অকেজো হয়ে গেছে? সে তো তোমার কাছে তার সব কিছু উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তোমাকে এখন আরও ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। তার অন্তরের প্রতিটি কোণে তল্লাশী চালাতে হবে। একবার যখন তুমি তার ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছে, তখন এ কাজটিও পারবে। আমি সকালেই হরমনকে তোমার সাফল্যের বিস্তারিত কাহিনী জানাবো। বলবো, তুমি এক অসামান্য কাজ সম্পন্ন করে এসেছে।’
ঐ দিনই সন্ধ্যার পর। ভোজ সভায় চেঙ্গিস ও ভিক্টর ডিউটি করছে, এমন সময় সেখানে এসে হাজির হলেন হরমন। তিনি চেঙ্গিসকে কাছে পেয়ে অন্তরঙ্গ স্বরে বললেন, তুমি কি জানো, আমাদের বিশাল সম্মিলিত বাহিনী ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুদ্ধে যাত্রা করছে? অনেক দূরের পথ, দীর্ঘ লম্বা সফর। এই সফরে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন কয়েকজন সম্রাট। তাই আমি মনে করছি, তোমাকেও আমরা সঙ্গে নিয়ে যাবো। ভিক্টরও যাবে তোমার সাথে।’
‘আমি অবশ্যই যাবো!’ চেঙ্গিস উৎসাহের সাথে বললো।
হরমনের কাছে এরই মধ্যে রিপোর্ট পৌঁছে গেছে যে, রাশেদ চেঙ্গিস একজন শত্ৰু গোয়েন্দা। গত রাতেই তাদের এক যুবতী গুপ্তচর তার মুখোশ উন্মোচন করেছে। আজও মেয়েটি তার সাথে মিলিত হবে এবং তার কাছ থেকে দলের অন্যান্য সঙ্গী সাথীর নাম উদ্ধারের চেষ্টা করবে।
হরমন এ সংবাদে খুবই উৎফুল্ল হলেন। সহকর্মীকে বললেন, ‘চেঙ্গিসের দলের পূর্ণ সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত মেয়েটি যেন এ অভিনয় অব্যাহত রাখে। ওকে এমন ভাবে মেলামেশা করতে বলবে, চেঙ্গিস যেন ওকে সন্দেহ করতে না পারে।’
আজ চেঙ্গিসের মন ছিল বিক্ষিপ্ত। সে ডিউটি করছিল ঠিকই, কিন্তু ডিউটির দিকে আর কোন খেয়াল ছিল না। বার বার তার মনে পড়ে যাচ্ছিল মেয়েটির কথা। সন্ধ্যার পর থেকে তার হৃদয় রাণী হয়তো তারই অপেক্ষায় বাগানে বসে ছটফট করছে। আজ সে তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পরই এ শহর তার পর হয়ে যাবে। উত্তেজনায় প্রতিটি মুর্তে তার কাটছিল ভয়ংকর অস্থিরতার মধ্যে।
তার জীবনে এত বড় সফলতা আর কখনো আসেনি। তার কাছে এত গোপন তথ্য এসেছে এবং এমন সুন্দরী যুবতী তার জন্য জীবনের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়েছে; যা সে কখনো কল্পনাও করেনি।
সে ভাবছিল, সত্যি কি আজকের রাতই ত্রিপলীতে তার জীবনের শেষ রাত! সে কি পারবে এই অমূল্য তথ্যরাজি নিয়ে কায়রো ফিরে যেতে! আল্লাহর কি অপূর্ব মহিমা! একেই বলে রাজ্য ও রাজকন্যা একত্রে পাওয়া।
মেয়েটিকে সঙ্গে করে ত্রিপলী থেকে বের হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সে দ্রুত তার ডিউটি শেষ করে কামরায় এলো। ভিক্টরও সঙ্গে এলো তার। সে তাড়াতাড়ি তার পোষাক পরিবর্তন করে প্রস্তুত হয়ে নিল। আজ আর কৃত্রিম দাড়ি সঙ্গে নিল না, তার পরিবর্তে একটা খঞ্জর জোব্বার মধ্যে লুকিয়ে নিল।
‘আমি তোমাকে আগেও বলেছি এখনও শেষ বারের মত বলছি, এই নারী ও মদের নেশা থেকে তুমি সাবধান হও।’ ভিক্টর তাকে বললো, ‘আমার কিন্তু তোমার ব্যাপারে ভীষণ ভয় হচ্ছে। তুমি মেয়েটাকে না চিনে কোন যাচাই-বাছাই না করে তোমার সমস্ত গোপন তথ্য তাকে দিয়ে দিয়েছ, এখন আবারও যাচ্ছ। কিন্তু সে তোমাকে জান্নাতে না জাহান্নামে নেবে তার কিছুই তুমি জানো না।’
‘শোন ভিক্টর!’ চেঙ্গিস গম্ভীর স্বরে বললো, ‘আমি এই মেয়ের বিরুদ্ধে কোন কথাই শুনতে রাজী নই। আমি তার সাথে নতুন ও হঠাৎ সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি না। এর আগেও বহু বার মেয়েটির সাথে আমার দীর্ঘ সাক্ষাৎ হয়েছে। তার বেদনাময় জীবনের পূর্ণ কাহিনী আমি শুনেছি। তুমি তাকে দেখোনি, তার সাথে কথাও বলেনি, তাই ওই মেয়েকে তুমি চিনতে বা বুঝতে পারবে না। আমাকে তুমি পাগল ভেবো না। আমার জীবনের এটাই প্রথম ও শেষ ভালবাসা।’
এরপর আর কথা বলা বৃথা ভাবলো ভিক্টর। তার কথায় বুঝা যাচ্ছে, সে আর স্বাভাবিক ও সুস্থ জ্ঞানে নেই। পতঙ্গ যদি দিওয়ানা হয়ে আগুনে ঝাঁপ দিতেই চায়, তাকে ফেরায় সাধ্য কার! ভিক্টর চিন্তা করে দেখলো, চেঙ্গিসের মত এমন অনুপম সুন্দর যুবক যে কোন নারীর মন সহজেই আকর্ষণ করতে পারে। কেবল সুঠাম দেহই নয়, নারীর মন ভুলানোর জন্য পুরুষের মধ্যে আর যেসব গুণ থাকা দরকার, তার সবই আছে চেঙ্গিসের মধ্যে। তার চোখের চাহনীতে আছে সম্মোহনী শক্তি, কণ্ঠে আছে মাধুর্য ও গভীরতা। ফলে এই মেয়ে কেন, এরচেয়ে আরও সুন্দরী ও অভিজাত ঘরের নারীও তাকে দেখে মজে যেতে পারে।
কিন্তু এই মেয়ে কি সত্যি তাকে দেখে প্রেমে পড়েছে, নাকি তার পেছনে এই মেয়েকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে? মেয়েটি নিঃসন্দেহে কোন সাধারণ মেয়ে নয়। যদি সে প্রেমেই পড়তে তবে সে চেঙ্গিসকে দেখেই নয়ন সার্থক করতো, তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সে যে এক গোয়েন্দা, এ তথ্য আদায় করতে যেতো না। ভিক্টরের দৃঢ় বিশ্বাস, মেয়েটি চেঙ্গিসকে ধোঁকা দিয়ে চলেছে। আর যদি ধোঁকা না দেয় তবু চেঙ্গিস যা করছে তা ঠিক নয়। সে নির্বোধের মত তার গোপন পরিচয় মেয়েটির কাছে উন্মুক্ত করে দিয়ে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কেবল সে একা নয়, সে আমাদের সকলকেই বিপদের মুখে নিয়ে যাচ্ছে।
যদি এই মেয়ে মুসলিম গোয়েন্দাও হয়, তবুও তাকে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। কারণ, এই মেয়ে সে রকম কোন পরিচয় নিয়ে আমাদের কাছে আসেনি। ভিক্টর এই সাক্ষাতের মধ্যে কোন শান্তির লক্ষণ দেখতে পাচ্ছে না।
চেঙ্গিস চলে গেল। ভিক্টর গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। প্রতিদিন চেঙ্গিসের যাওয়ার পর সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেত কিন্তু আজ রাতে সে শুতেও পারছে না, ঘুমও আসছে না। সে তার কামরায় গিয়ে শোয়ার পরিবর্তে অশান্ত ভাবে পায়চারী করতে লাগল।
মেয়েটি ঠিক সেই স্থানেই চেঙ্গিসের জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। তার পাশে মাটিতে মদের সুরাহী ও পেয়ালা। অন্ধকারে সে চেঙ্গিসকে আসতে দেখে দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
সে এমন ভাবে নিজেকে তার কাছে সঁপে দিল, তাতেই চেঙ্গিসের বুদ্ধি লোপ পাওয়ার উপায় হলো। ভিক্টরের কথায় তার মনে যদিও সামান্য সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সন্দেহ এতেই ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল।
মেয়েটি তার যৌবনের যাবতীয় অস্ত্র ব্যবহার করলো চেঙ্গিসকে বিভ্রান্ত করতে। কিন্তু চেঙ্গিস পথে আসতে আসতে চিন্তা করছিল, সে মেয়েটিকে আবারও জিজ্ঞেস করবে, সে তাকে প্রতারণা করছে কিনা। সেই প্রশ্নটিই তাঁর মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, ‘তুমি তো আমাকে ধোঁকা দিচ্ছ না?’
মেয়েটি অভিমানী সুরে বললো, ‘এমন প্রশ্ন তুমি করতে পারলে! তোমার ভালবাসা আমাকে অসহায় ও নিরূপায় করে ফেলেছে। তোমাকে এত গোপন তথ্য দেয়ার পরও তুমি কি করে ভাবতে পারলে আমি তোমাকে ধোঁকা দেবো?”
‘দুঃখিত, আমি তোমার মনে কষ্ট দিতে চাইনি।’ আমার এক বন্ধু বললো, “খবরদার, মেয়েদের বিশ্বাস করবি না। ওরা প্রেমের নামে এত ছলনা করতে জানে যে, ফেরাউনের গদিও তাতে উল্টে যায়। তাই কথাটা তোমাকে বললাম।’
‘বামুনের কাছে আঙুর ফল সব সময়ই টক। কারণ, সে তো আর কোনদিন তার নাগাল পাবে না!’ মেয়েটি বললো, “কি নাম তোমার সে বন্ধুর?’
‘আরে রাখো তো! তার কথা বাদ দাও।’
মেয়েটি বন্ধুর নাম জানার জন্য আর পীড়াপীড়ি করলো না। তার কোমরে একটি বাহু জড়িয়ে তাকে সেখান থেকে মদের পাত্র ও পিয়ালার কাছে নিয়ে এলো। বললো, ‘আমি কি আর জানি না, তুমি আমাকে অবিশ্বাস করতে পারো না। আমি মন খারাপ করিনি, এসো বসি, গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’
ওরা ঘাসের ওপর বসে পড়লো। মেয়েটি পিয়ালায় মদ ঢেলে তার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, ‘তোমার বিজয়ের আনন্দে এক পিয়ালা।’
চেঙ্গিস এতই খুশী ছিল যে, বলার সাথে সাথেই পিয়ালা তুলে নিল ও মুখে নিয়ে পান করতে লাগলো। মেয়েটা তার পিয়ালায় আরও মদ ঢেলে দিল। চেঙ্গিস সেটুকুও পান করে নিল।
তারা যেখানে বসেছিল তার থেকে আট দশ গজ দূরে ফুলের একটা ঝাকড়া ঝোপ ছিল। কেউ একজন হামাগুড়ি দিয়ে সেই ঝোপের কাছে চলে এলো এবং তার আড়ালে বসে পড়ল।
রাত বাড়তে লাগল। চারদিক নীরব ও নিঝুম হয়ে গেল। বাগানের আঁধো আলো-আঁধারীতে বসে গল্প করছে ওরা। ঝোপের পেছনে বসা লোকটি কান লাগিয়ে শুনছিল চেঙ্গিস ও মেয়েটির কথা। তারা দু’জন জানে, আশেপাশে কেউ নেই। তাই কোন লুকোচুরি না করে স্পষ্ট স্বরেই তারা কথা বলছিল।
‘এখন বলো, কি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের কথা বলছিলে?’ চেঙ্গিস মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো।
‘এমন গোপন তথ্য নিয়ে এসেছি, সুলতান আইয়ুবী কখনও স্বপ্নেও এমন সংবাদ শুনেননি।’ মেয়েটি বললো, ‘আমি খৃস্টানদের মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে এসেছি।’
সে চেঙ্গিসকে ক্রুসেডদের আক্রমণের প্ল্যান ও অভিযানের রাস্তা বলে দিল। আরও বললো তারা কোথায় কোথায় আক্রমণ চালাবে। সে ক্রুসেড বাহিনীর রসদপত্র পাঠানোর রাস্তাও বলে দিল এবং কত তারিখে সমরাভিযান শুরু হচ্ছে তাও বলে দিল।
‘আমি এখান থেকে জলদি বের হয়ে যেতে চাই।’ চেঙ্গিস বললো, “চলো আজ রাতেই আমরা বের হয়ে যাই?
‘না!’ মেয়েটি বললো, ‘আমার কাছে আরো কিছু গোপন খবর আছে। সেটুকুও শুনে নাও, তারপর সিদ্ধান্ত নাও কি করবে?’
“কি সেই খবর, জলদি বলো!’
‘আরে, এত উতলা হচ্ছো কেন? অস্থিরতা আমাদের শত্রু। যা করতে হবে সব ভেবে-চিন্তে করতে হবে, এত উতলা হলে চলবে না।’ মেয়েটি বললো, ‘তুমি তো জানোই, খৃস্টানদের ব্যাপারে আমার মনে প্রতিশোধের কি আগুন জ্বলছে। সে আগুন ঠাণ্ডা করার একটা উপায় পেয়ে গেছি। আমি ভাবছি, যাওয়ার আগে তাদের পায়ে একটা মরণ কামড় দিয়ে গেলে কেমন হয়?’
মেয়েটি চেঙ্গিসের মনযোগ আকর্ষণ করে বললো, ‘ক্রুসেড বাহিনী তাদের সৈন্যদের জন্য অপরিমেয় খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে একখানে গুদামজাত করে রেখেছে। শুধু খাদ্যশস্য নয়, যুদ্ধের যাবতীয় তাঁবু এবং অস্ত্রশস্ত্রও সব সেখানে জড়ো করা। সেখানে তীর ধনুক ছাড়াও আছে অঢেল আগ্নেয়াস্ত্র। আছে পেট্রোলের ড্রাম। বলতে গেলে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যে বিশাল বাহিনী রওনা হচ্ছে, তাদের সমুদয় মাল-সামান ও অস্ত্র জমা করা হয়েছে সেখানে। এগুলো ধ্বংস করা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। সেখানে মাত্র সাত-আট জন সিপাহী রাতে পাহারায় থাকে।
আমি যতদূর জানতে পেরেছি, তা হলো, প্রায় তিন-চার মাস ধরে খৃস্টানরা এগুলো জমা করছে। যদি আমরা এগুলো আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতে পারি তবে ক্রুসেড বাহিনীর আক্রমণ অন্তত ছয় মাস পিছিয়ে যাবে। কারণ পূর্ণ প্রস্তুতি না নিয়ে এবার খৃষ্টানরা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মুখোমুখি হবে না। আর যুদ্ধ ছয় মাস পিছানো মানে, সুলতান আইয়ুবী আরো ছয় মাস সময় পেয়ে যাবেন তাঁর বাহিনী ভাল ভাবে গুছিয়ে নেয়ার জন্য। কি বলো, আমি ঠিক চিন্তা করিনি?’
‘কিন্তু…’ ভাবনায় পড়ে গেল চেঙ্গিস। মেয়েটিই আবার মুখ খুলল। বলল, ‘তুমি তো হরমনকে ভাল করেই জানো। ক্রুসেড গোয়েন্দা বাহিনীর তিনি প্রধান। আমি তার অন্তর থেকেও গোপন তথ্য বের করে নিয়েছি। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, সুলতান আইয়ুবী নতুন সেনা ভর্তি শুরু করেছেন। কারণ তার আগের সৈন্যরা গৃহযুদ্ধে লড়েই প্রায় শেষ হয়ে গেছে। অনেকে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। এখন তার যুদ্ধ করার কোন শক্তি নেই।
অভিশপ্ত ক্রুসেড বাহিনী এই সুযোগটাই গ্রহণ করতে চায়। নইলে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়ার সাহসই হতো না ওদের। এখন যদি আমরা ক্রুসেড বাহিনীর আক্রমণকে পিছিয়ে দিতে পারি, তবে আমাদের বিজয় অর্জন আরো সহজ হবে। আর এর একমাত্র উপায় তাদের অস্ত্র ও রসদ জ্বালিয়ে দেয়া। তাদের যে হাজার হাজার ঘোড়া এখানে জড়ো করেছে, সেগুলোকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা করা।’
‘তাদের রসদপত্রে আগুন কে লাগাবে?’ চেঙ্গিস জিজ্ঞেস করলো।
‘কেন, আমরাই লাগাবো। এখানে কি আমাদের লোকজন নেই? কোন কমাণ্ডো গ্রুপ নেই? মেয়েটি বললো, “নিশ্চয়ই এখানে আমাদের কমাণ্ডো বাহিনী আছে। এ কাজ তাদের উপরই ন্যস্ত করা যায়। আর যদি তা না থাকে তবে আমাদেরকেই এ ঝুঁকি নিতে হবে। তুমি ভয় পাচ্ছো? আরে জীবনের কি দাম আছে, যদি তা জাতির প্রয়োজনেই না লাগলো!”
‘না, এটা ভয়ের কথা নয়। সুলতান আইয়ুবীর নিষেধ আছে, শত্রু কবলিত এলাকায় কোন ধ্বংসাত্মক কাজ করা যাবে না। কারণ কমাণ্ডোরা ধ্বংসাত্মক কাজ করে এদিক-ওদিক পালিয়ে যেতে পারবে কিন্তু সাধারণ নিরীহ মুসলমানদের ভোগ করতে হবে তার শাস্তি।’ চেঙ্গিস বললো, ‘খৃস্টান বাহিনী মুসলমানদের বাড়ীতে ঢুকে পর্দানসীন মেয়েদের ওপর অত্যাচার করবে। অযথা মুসলিম ছেলে-বুড়োকে ধরে নির্যাতন করবে। তাই আমরা কমাণ্ডোদের ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি। এখানে শুধু গোয়েন্দা আছে। তারা ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারবে ঠিকই, তবে তাদের সংগঠিত করার জন্য কিছু সময়ের দরকার।’
‘কিন্তু বেশী সময় নেয়া ঠিক হবে না। যা করার আমাদের তাড়াতাড়িই করতে হবে। মেয়েটি বললো, আমাদের লোকজনকে কি কোথাও একত্রিত করা যায় না? সবাই মিলে বসে পরামর্শ করলে একটা না একটা রাস্তা বেরিয়ে আসবেই।’
‘আমরা একটি মসজিদকে গোপন আড্ডাখানা বানিয়ে নিয়েছি।’ চেঙ্গিস মদের পাত্রে চুমুক দিয়ে বললো, ‘সেই মসজিদের ইমাম আমাদের এখানকার দল নেতা। তিনি খুবই যোগ্য ও সাহসী ব্যক্তি! আমি আজ রাতেই তার সাথে দেখা করবো। তাকে সব কথা খুলে বললে তিনিই এ অভিযানের ব্যবস্থা করতে পারবেন। দলের আর যে সব যুবক আছে, তারা নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে মসজিদে চলে আসবে। নামাজের পর সাধারণ মুসল্লীরা চলে গেলে আমরা সেখানেই অথবা ইমাম সাহেব যদি কোন গোপন জায়গা বের করতে পারেন সেখানে এই পরামর্শ সভা করতে পারি।’
‘হ্যাঁ, এটা তুমি ঠিক বুদ্ধি বের করেছে। তবে আমি ভাবছি, যদি দলে তেমন যোগ্য লোক থাকে তবে এ অপারেশনের আগেই আমাদের শহর ছাড়তে হবে। নইলে ক্রুসেড বাহিনীর বেপরোয়া তল্লাশীর ঝামেলায় পড়ে যেতে হবে। আর যদি না থাকে তবে প্রয়োজন হলে এ অভিযানের নেতৃত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। খুব সাবধানতার সাথে সুপরিকল্পিত উপায়ে এগুতে হবে আমাদের। তুমি কি মনে করো তোমাকে ছাড়া এ অভিযান সফল করার মত যোগ্য লোক এখানে আছে?” বলল, মেয়েটি।
“ইমাম সাহেব নিজেই একজন যোগ্য লোক।’ চেঙ্গিস বললো, ‘এ ছাড়া এখানে আরও এমন কয়েকজন সাহসী ও বীর গুপ্তচর রয়েছে, যাদের কমান্ডো ট্রেনিং রয়েছে। সে কয়েক জনের নাম উল্লেখ করে বললো, ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য এ কয়জনই যথেষ্ট।’
‘তাহলে এদের সবাইকে মসজিদের পরামর্শ সভায় ডাকো। শত্রু এলাকায় বার বার সভা করার ঝুঁকি নেয়া ঠিক নয়।’
মেয়েটি চেঙ্গিসের কাছ থেকে যে সব তথ্য সংগ্রহ করতে চাচ্ছিল, সে সব তথ্য তার মুঠোয় এসে গেল। মনে মনে নিজের কৃতিত্বে নিজেই মুগ্ধ হচ্ছিল সে। সে আরো খুশী হয়ে উঠল এ জন্য যে, পুরো দলটিকে ফাঁদে ফেলার জন্য জাল পাতার কাজটিও সে করে নিল একই সাথে। সে আরো কোন তথ্য পাওয়া যায় কিনা সেই আশায় নতুন প্রশ্ন ছুঁড়ে মারল। বলল, ‘চেঙ্গিস, তুমি কিন্তু খুব হুশিয়ার থেকো। তোমাকে নিয়ে আমার খুব ভয় হয়। কারণ তুমি তো থাকো একেবারে বাঘের ঘরে। স্বয়ং খৃস্টান সম্রাটের নিরাপত্তা বাহিনীর পেটের মধ্যে। সত্যি, তোমার কোন তুলনা হয় না। সম্পূর্ণ একা এই শক্রপুরীতে তোমার ভয় করে না?”
‘ভয় করলে কি আর গুপ্তচর হওয়া যায়!’ বলল চেঙ্গিস, ‘তবে আমি একা নই, রাজ দরবারের চৌহদ্দীতেই আমার আরো বন্ধু আছে। তুমি ভিক্টরকে চেনো না, সেও আমাদের দলের একজন।’
‘কি! ভিক্টরও?’ মেয়েটি প্রচণ্ডভাবে চমকে উঠে বললো, ‘সে তো খৃস্টান!’
‘হ্যাঁ!’ চেঙ্গিস বললো, “কেন তুমি কি আমাদের এ কৌশলের জন্য প্রশংসা করবে না? একজন খৃস্টান যে আমাদের দলের গোয়েন্দা হতে পারে, তা স্বপ্নেও ভাববে না ক্রুসেড গোয়েন্দা বাহিনী, কি বলো?’
মেয়েটি কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে রইল। এই অস্বাভাবিক খবরটি হজম করতে সময় লাগলো তার। শেষে মাথা তুলে বলল, “এতক্ষণে একটি ভাল খবর দিলে। ওরকম একজন বন্ধু থাকলে আমি তো দিনের বেলায়ও তোমার সাথে দেখা করতে পারি! কাল আমি তোমার কামরায় যাবো। তুমি ঠিকই বলেছো, ভিক্টর যথেষ্ট যোগ্য ও চালাক লোক। সে যদি এ অভিযানের নেতৃত্ব নেয় তবে আমরা নিশ্চিন্তে শহর ছেড়ে রওনা দিতে পারবো। আমি কালই তোমার কামরায় তার সাথে কথা বলতে চাই। আমি তোমার কামরায় গেলে সে আবার কিছু মনে করবে নাতো?’
‘আরে না! ও আমার খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু।’ বলল চেঙ্গিস।
মেয়েটি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। ঝোপের পেছনে লুকানো মানুষটি নড়ে উঠলো। সে বসা অবস্থায়ই কোমরের খাপ থেকে খঞ্জর বের করে নিল। ওরা দু’জন বিদায় নিয়ে দু’দিকে হাঁটা ধরল। আট-দশ কদম এগিয়েছে মেয়েটি, পেছন থেকে একটি বাহু তাকে জড়িয়ে ধরল এবং চোখের নিমেষে তার হাতের খঞ্জরটি তার বুকে বসিয়ে দিল। মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠল। বলে উঠল, ‘হায়! আমার বুকে কে যেন খঞ্জর ঢুকিয়ে দিয়েছে।’
চিৎকার শুনে ঘুরে দাঁড়াল চেঙ্গিস। দেখতে পেলো একটি লোক মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে আছে। সে দ্রুত হাতে তার খঞ্জর বের করে ছুটল আগন্তুককে আঘাত করতে। কাছে যেতেই লোকটি ঘুরে সেই মেয়েকে সামনে রাখলো আর বলে উঠলো, ‘চেঙ্গিস! আমি ভিক্টর, তোমার সঙ্গী! এই হতভাগী কালনাগিনী এমন সব তথ্য পেয়ে গেছে যে, এর আর বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’
মেয়েটির প্রাণ তখনো বের হয়নি। ভিক্টর বুক থেকে তার খঞ্জরটি টেনে বের করে আনতেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। সেই রক্ত গিয়ে আঘাত করল চেঙ্গিসের চোখে মুখে। ভিক্টর শক্ত করে মেয়েটিকে পেছন থেকে ধরে রেখেছিল।
‘খৃস্টানের বাচ্চা খৃস্টান!’ চেঙ্গিস হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চিৎকার করে বকছিল, “তুই শেষে কাল সাপ হয়ে আমার ভালবাসাকে দংশন করলি?’
সে ঘুরে ভিক্টরের ওপর আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করল। ভিক্টর মেয়েটিকে ঢাল হিসেবে সামনে রেখে বললো, ‘স্বাভাবিক হও চেঙ্গিস! নেশার কবল থেকে ফিরে এসো। স্বপ্ন ও কল্পনার জগত থেকে বাস্তব জগতে আসো। বুঝতে চেষ্টা করো কি ভয়ংকর ফাঁদে তুমি পড়েছিলে! তুমি এই মেয়েটার কাছে আমাদের সবার পরিচয় ফাঁস করে দিয়েছো। তুমি আমাদের সবার জন্য মহা বিপদ চাপিয়ে দিয়েছ। এই ডাইনী বেঁচে থাকলে আগামী কালই আমরা সদলবলে গ্রেফতার হয়ে যেতাম। কেবল তুমি বা আমি নই, তার ষড়যন্ত্র সফল হলে এই ত্রিপলীতে আমাদের যত সদস্য কাজ করছে সবার ভাগ্যে কি অবর্ণনীয় বিপর্যয় নেমে আসতো তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তোমার সৌভাগ্য যে, আমি এসে পড়েছিলাম এবং তোমাকে কারাগারের নির্যাতন সেল ও অন্ধ প্রকোষ্ঠ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি।’
চেঙ্গিস আহত চিতার মত তার চারদিক ঘুরে ঘুরে হুংকার দিচ্ছিল আর তাকে আঘাত করার চেষ্টা করছিল।
মেয়েটি তখনও জীবিত ছিল। সে কাতরাতে কাতরাতে বললো, ‘চেঙ্গিস! আমার জান! আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমাকে সেবা করার সৌভাগ্য আমার হলো না। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। আমার কথা শোন, মনে রেখো, খৃস্টানরা কখনও আমাদের বন্ধু হতে পারে না! এ লোক আমাদের গোয়েন্দা নয়, এ নিশ্চয়ই ক্রুসেডদের গোয়েন্দা। যদি পারো আমার খুনের প্রতিশোধ নিও। বিদায় চেঙ্গিস!’
চেঙ্গিস সর্বশক্তি দিয়ে ভিক্টরকে আক্রমণ করলো। ভিক্টর বার বার তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলো, ‘চেঙ্গিস, তুমি মহা ভুল করছো। তুমি এক ছলনাময়ী নারীর ধোঁকায় পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছো। একজন গোয়েন্দা হিসাবে এর জালে পড়া কোন মতেই ঠিক হয়নি তোমার। তুমি জানো না, সুলতান আইয়ুবীর কড়া নির্দেশ আছে গুপ্তচরবৃত্তিতে মেয়ে ব্যবহার না করার? তাহলে এই মেয়ে কি করে আমাদের গোয়েন্দা হয়? এখনো সময় আছে, এসো এই কালনাগিনীকে হত্যা করে লাশটি দূরে কোথাও ফেলে আসি।
কিন্তু চেঙ্গিস তখন আর গোয়েন্দা ছিল না, সে ছিল এক দেওয়ানা প্রেমিক, যার প্রেয়সীকে অন্য এক পুরুষ ধরে রেখেছে। সে ছিল এক বীর পুরুষ ও যোদ্ধা, যার প্রেয়সীর বুকে খঞ্জর বিদ্ধ হওয়ায় সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে।
মেয়েটির জন্য সে ভিক্টরকে আঘাত করতে পারছিল না। যত বারই সে আঘাত করতে যাচ্ছিল ততবারই ভিক্টর মেয়েটিকে ঢাল বানিয়ে আত্মরক্ষা করছিল। সে আত্মরক্ষা করছিল আর চেঙ্গিসকে বুঝানোর চেষ্টা করছিল।
ভিক্টরকে আঘাত করতে না পেরে পাগলা কুকুরের মত ক্ষেপে উঠল চেঙ্গিস। সে সামনে থেকে মেয়েটাকে এত জোরে ধাক্কা দিল যে, ভিক্টর পিছন দিকে পড়ে গেল। পড়ে গেলেও ভিক্টর মেয়েটিকে ছাড়েনি, মেয়েটিও তার বুকের ওপর দড়াম করে পড়ে গেল।