খুনী চক্রের আস্তানায়
গুমাস্তগীন তাকে ধোঁকা দিয়ে গেছে, এই রাগে জ্বলছে শেখ মান্নানের সারা শরীর। গুমাস্তগীনের পিছু নেয়ার জন্য সে যে সৈন্য পাঠিয়েছিল, তার মধ্যে মাত্র দু’জন ফিরে আসতে পেরেছে। বাকীরা লিজাকে ছিনিয়ে আনা তো দূরের কথা, নিজেদের জীবনটা পর্যন্ত বাঁচাতে পারেনি। তার সৈন্যরা এমন অথর্ব, ভাবতেই রাগ তার মাথায় উঠে যাচ্ছে। কোথায় গুমাস্তগীন, লিজা ও কারিশমাকে চিলের মত ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে আসবে উন্মুক্ত মরুভূমি থেকে, তা নয়, একজন মাথামোটা ভীতুর ডিম, যে তার কাছে এসেছিল যুদ্ধ না করে আইয়ুবীর হাত থেকে বাঁচার জন্য গুপ্তঘাতক ভাড়া করতে, তার হাতে মার খেয়ে মরে গেছে তার সৈন্যরা, এটা কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না। এ নিশ্চয়ই আইয়ুবীর সেই কমাণ্ডোদের কাজ, কারিশমা ও লিজা যাদেরকে পাকড়াও করে তুলে দিয়েছিল আমার হাতে, ভাবছে শেখ মান্নান। নিজের মনেই সে স্বীকার করল, সময়ের আগে এভাবে ওদের বাইরে বের করা ঠিক হয়নি। সন্ত্রাসী দলের নেতৃত্বে আসার পর এমন ভুল সে আর করেনি। এ ভুলের খেসারত দিতে হলো তাকে একদল জানবাজ অনুচর হারিয়ে।
ফেদাইন সন্ত্রাসীদের একটা খ্যাতি আছে, তারা সাধারণত কোন কাজে হাত দিলে ব্যর্থ হয় না। অপারেশন সফল করার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেই তারা কাজে নামে। ফেদাইন খুনীদের এমন পর্যাপ্ত ট্রেনিং দেয়া হয়, যার সাথে অন্য কারো তুলনা, হতে পারে না। মৃত্যুকে তারা ভয় পায় না। তাদেরকে ভাল করেই বুঝিয়ে দেয়া হয়, মরণ সাগরে যারা ঝাঁপ দিতে পারে, মরণকে কেবল তারাই জয় করতে পারে। তাই তারা সহজে পরাজিত হয় না।
লিজাকে উঠিয়ে আনার জন্য ওদের পাঠিয়েছিল সে। তারা লিজাকে ধরে আনতে পারেনি ঠিক, কিন্তু কারিশমাকে উঠিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে। লিজাকে হারানোর বেদনা কারিশমাকে দিয়ে দূর করা কি সম্ভব? না কিছুতেই তা নয়, অনুভব করলো শেখ মান্নান। যদিও কারিশমা সুন্দরী, রূপসী কিন্তু লিজার চোখে যে নিবেদনের আর্তি আছে, মায়াময় মোহনীয়তা আছে, জৌলুসহীন অন্তরঙ্গতা আছে, তা কোথায় পাবে কারিশমা! তার চোখে যে মাদকতা আছে সেখানে আছে জৌলুসের সমারোহ, আছে অভিজ্ঞতার প্রলেপ ও চাতুর্যের সজীবতা। কিন্তু লিজার সহজ সরল নমনীয়তা ও ভীতিময় নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে যে নিবেদনের আর্তি ও বিহবলতা আছে তার কিছুই নেই সেখানে। দু’জনই সুন্দরী, কিন্তু সেই সুন্দরের মধ্যে কি যোজন যোজন দূরত্ব! কল্পনায় লিজার সেই বিমুগ্ধ রূপের কথা স্মরণ করে অস্থির চিত্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শেখ মান্নান।
লিজাকে মুঠোর মধ্যে পেয়েও ভোগ করতে পারেনি এর জন্য শেখ মান্নান দায়ী করল কারিশমাকে। কারিশমা বাঁধা না দিলে তার অন্তরের চাহিদা এতক্ষণ অপূর্ণ থাকতো না। লিজা নেই, লিজাকে না পাওয়ার প্রতিশোধ এখন কারিশমার কাছ থেকেই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু কিভাবে? কি শাস্তি দিলে তার অন্তরের জ্বালা দূর হবে?
বারান্দায় দীর্ঘক্ষণ পায়চারী করেও এর কোন ফায়সালা করতে পারল না শেখ মান্নান। তখন প্রহরীকে ডেকে বললো, ‘কারিশমাকে কারাগারে পাঠিয়ে দাও।’
পড়ন্ত বেলা। আছিয়াত দূর্গের প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে প্রহরীরা বিকেলের মিঠে রোদের কোমল উত্তাপ উপভোগ করছে। কোন রকম ভয়ভীতি বা শঙ্কার লেশও নেই কারো চোখে। হঠাৎ তাদের নজরে পড়লো দূর দিগন্তে এক খণ্ড ধূলিঝড়, এ রকম ধূলিঝড় একাধিক কারণে সৃষ্টি হয়, কিন্তু কোন টাই সুখকর নয়। সব কারণের মধ্যেই ভয় ও আশঙ্কার বার্তা থাকে। ওরা লক্ষ্য করলো, ধূলিঝড়টি আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে এবং এদিকেই এগিয়ে আসছে। ওরা অজানা আশঙ্কা নিয়ে তাকিয়ে রইল সেই ধূলিঝড়ের দিকে।
সময় গড়িয়ে চলল। ওরা অনুভব করল, এটা মরু সাইমুম নয়, কোন কাফেলার দূরন্ত অশ্বখুরের আঘাতে সৃষ্ট বালির সমুদ্র যেন উড়ে আসছে ওদের দিকে। প্রহরীরা এই নিয়েই কথা বলছিল। এত বড় কাফেলা এদিকে কেন আসছে? ওরা কি শত্রু, না মিত্র? ওরা এসব বলাবলি করছে আর তাকিয়ে দেখছে ঝড়ের গতি।
তখনো ধূলিঝড় অনেক দূরে। দূর থেকেই ওরা দেখতে পেল শত শত অশ্বারোহী ছুটে আসছে কেল্লার দিকে। প্রহরীরা বিলম্ব না করে নাকারা বাজিয়ে দিল। নাকারার আওয়াজ কানে যেতেই কেল্লার কমাণ্ডাররা ছুটল উপরে। প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে ওরাও দেখলো সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য। সঙ্গে সঙ্গে ওরা আবার নিচে নেমে গেল এবং নিজ নিজ বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হুকুম দিল।
হুকুম দিয়েই ওরা আবার ছুটল প্রাচীরের ওপরে। ততক্ষণে ধূলিঝড় আরো অনেক কাছে চলে এসেছে। ওরা নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে কেল্লার ভেতরে ও প্রাচীরের ওপর পজিশন নিল। ছুটে আসা সৈন্য বাহিনী কেল্লার কাছে এসেই কেল্লার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং কেল্লা অবরোধ করে দাঁড়িয়ে গেল।
শেখ মান্নান মোকাবেলার আদেশ দিয়ে বলল, ‘বড় তাজ্জব ব্যাপার। ফেদাইন বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে এসে আবার কার মরার শখ হল!’
তার হুকুমে কেল্লার প্রাচীরের ওপর তীরন্দাজ বাহিনী পজিশন নিয়ে বসে গেল। শেখ মান্নান বলল, “এখনি তীর বর্ষণের দরকার নেই। আগে দেখে নিই কাদের এ দুঃসাহস হলো।’
প্রাচীরের ওপর পজিশন নেয়া তীরন্দাজরা তীর বর্ষণ না করে চুপচাপ বসে রইল। তারা লক্ষ্য করতে লাগলো, আক্রমণকারীদের গতিবিধি।
সুলতান আইয়ুবী কেল্লার ভেতরের সব রকম তথ্যই পেয়ে গিয়েছিলেন আন নাসেরের কাছ থেকে। আন নাসের নিজেও সৈন্য দলের সাথে ছিল, সে সুলতানকে জানাচ্ছিল কেল্লার কোথায় কি আছে।
সুলতানের নির্দেশে দুটি মিনজানিক কামান সেট করা হলো। আন নাসের শেখ মান্নানের মহলটি কোথায় ও কতটা দূরত্বে দেখিয়ে দিল কামান চালকদের।
তাঁর নির্দেশিত স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে একটা পাথর নিক্ষিপ্ত হলো মিনজানিকের সাহায্যে। পাথরটি যথাস্থানেই আঘাত হানলো, মান্নানের মহলের দেয়াল ফুটো হয়ে গেল সে আঘাতে। আর অপেক্ষা করার উপায় নেই। কারা আক্রমণ করেছে বুঝে নিয়েছে শেখ মান্নান।
আইয়ুবীর কমাণ্ডোদেরকে গুমাস্তগীনের কাছে বিক্রি করে যে ভুল আমি করেছিলাম তার প্রায়শ্চিত্ত করার সময় হয়ে গেছে, ভাবলো শেখ মান্নান। সে তার সৈন্যদের এ হামলার জবাব দেয়ার নির্দেশ দিল।
কেল্লার উপর থেকে শুরু হলো তীর বর্ষণ। কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা তখনো তীরের আওতার বাইরে। শেখ মান্নানের ফেদাইন বাহিনীর তীর বর্ষণ কোনই কাজে এল না, আইয়ুবীর একজন সৈন্যও আহত হলো না তাতে।
আইয়ুবীর নির্দেশে এবার কেল্লার মধ্যে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করলো মিনজানিকের কমাণ্ডার। বোমা শেখ মান্নানের মহলের অনতিদূরে গিয়ে ফাটলো। বোমা ফেটে চারদিকে ছড়িয়ে গেল পেট্রোল। কিন্তু তাতে কেল্লার কোন ক্ষতি হলো না। শেখ মান্নান বা ফেদাইনরা বুঝতে পারল না, এ বোমা হামলার মাধ্যমে তাদের জন্য কত বড় বিপদ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে কেল্লার ভেতর।
আইয়ুবী এবার সেখানে আগুন লাগানো তীর নিক্ষেপের হুকুম দিলেন। তীরন্দাজ মুজাহিদরা তীর ছুঁড়লো, কিন্তু পেট্রোলের কাছে নিতে পারলো না কোন তীর। তীর সেখানে নিতে হলে তাদেরকে কেল্লার আরো কাছাকাছি যেতে হবে। যেখানে এখন তারা পজিশন নিয়ে আছে সেখানে থেকে লক্ষ্যস্থলে তীর কিছুতেই পৌঁছানো সম্ভব নয়।
আইয়ুবী পুরো বিষয়টি গভীরভাবে লক্ষ্য করলেন। তিনি তীরন্দাজদের বললেন, ‚শাহাদাতের পেয়ালা পান করতে আগ্রহী এমন তিনজনকে এ মুহূর্তে আমার দরকার। কারা এ দায়িত্ব নিতে চাও?’
সঙ্গে সঙ্গে পাশের সব ক’জন তীরন্দাজ, যারা আইয়ুবীর আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল, উঠে দাঁড়িয়ে গেল। তিনি ওদের মধ্য থেকে তিনজনকে বেছে নিলেন।
তিনি তাদের বললেন, ‘পেট্রোল ভেজা জায়গায় তীর পৌঁছতে পারে এমন দূরত্বে এগিয়ে তীর ছুঁড়বে তোমরা। আমি আবার তীর ছোঁড়ার হুকুম দেয়ার সাথে সাথে তোমরা ছুটে যাবে পাঁচিলের দিকে। আমাদের তীর তোমাদের কাভার দেয়ার চেষ্টা করবে। দুশমনের তীর আঘাত হানলেও আশা করি তোমরা তোমাদের দায়িত্ব সফলতার সাথেই সমাধা করতে পারবে।’
সুলতান আবার তীর ছোড়ার হুকুম দিতেই ওই তিন তীরন্দাজ ছুটল পাঁচিলের দিকে। বেশী দূর যেতে পারেনি, তার আগেই দুশমনের তীর ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের ওপর। হুমড়ি খেয়ে পড়ার আগে এক তীরন্দাজ তার তীরে আগুন জ্বেলে ফোন মতে ছুঁড়ে মারল। সৌভাগ্যক্রমে তাতেই কাজ হল। তীরটি দেয়াল অতিক্রম করে গিয়ে পড়ল পেট্রোলের ছিটকে পড়া কোন অংশে, তাতেই আগুন ধরে গেল সেখানে।
সহসা সে আগুন নিকটেই পেট্রোলের মূল অংশ স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। মুহূর্তে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। শেখ মান্নানের মহল ভরে গেল সে অগ্নিশিখায়। আইয়ুবী আরও কয়েকটি মিঞ্জানিক বোমা নিক্ষেপ করার হুকুম দিল। সাথে সাথে পালিত হলো সে হুকুম। বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল প্রজ্জ্বলিত আগুনের শিখা।
আছিয়াত দূর্গে তখন চরম এক অবস্থা। শেখ মান্নানের লোকেরা গুপ্তঘাতক হিসাবে খ্যাতিমান ছিল। তাদের যত বীরত্ব সব ছিল নিঃসঙ্গ মানুষের ওপর। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে দক্ষ হলেও সম্মুখ যুদ্ধের ট্রেনিং তাদের ছিল না। তার ওপর এই অতর্কিত অগ্নির ছোবল ছিল তাঁদের ধারনার বাইরে। ফলে অচিরেই তারা অনুভব করল, কেয়ামতের বিভীষিকা শুরু হয়ে গেছে তাদের উপর দিয়ে।
শেখ মান্নানের অবস্থা আরও করুণ। তার মনে হলো, হাবিয়া দোযখের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে। চারদিকে দাউ দাউ আগুন। সে আগুন সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে। হয়তো কিছুক্ষণ পর তাকে গ্রাস করে ফেলবে।
তার সৈন্যদের কারো অবস্থায়ই এমন নয় যে, তারা আইয়ুবীর বাহিনীর মোকাবেলা করে। যারা পাঁচিলের ওপর ছিল তারা নেশাগ্রস্ত মানুষের মত ঘোরের মধ্যে তখনো তীর চালিয়ে যাচ্ছিল। নিচের সৈন্যরা আচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল অগ্নিশিখার তাণ্ডব। আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছিল এখান থেকে ওখানে।
শেখ মান্নান যুদ্ধের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিল। কেল্লার উপরে সাদা পতাকা উড়িয়ে দিল সে। সুলতান আইয়ুবী যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। থেমে গেল দু’পক্ষের তীরবৃষ্টি।
তীরবৃষ্টি থামতেই চারদিক নীরব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। রোদের উত্তাপ আগেই কমে গিয়েছিল, এখন এই নীরবতার মধ্যে চুপিসারে এসে হানা দিল সন্ধ্যার অন্ধকার।
সুলতান আইয়ুবীর নির্দেশে এক সালার সেই নীরবতা ভঙ্গ করে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করল, ‘শেখ মান্নান, সুলতান তোমাকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দিচ্ছেন। কেল্লা থেকে বেরিয়ে এসে তোমাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।’
কিছুক্ষণ পর। কেল্লার দরজা খুলে গেল। শেখ মান্নান দু’তিনজন সেনাপতি ও কমাণ্ডারকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল। সুলতান আইয়ুবী অত্যন্ত নিরাসক্তভাবে তাদের স্বাগত জানালেন। সাধারণত কোন কেল্লাধিপতিকে যেভাবে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে বরণ করা হয়, তেমন কোন উৎসাহ বা ঘটা দেখালেন না সুলতান। কারণ সুলতানের কাছে মান্নান কোন যোদ্ধা বা বীর ছিল না, ছিল এক জঘন্য পাপী ও খুনী।
তারা যখন সুলতান আইয়ুবীর কাছে এল, তিনি তাদের বসতেও বললেন না। সুলতান তার তাঁবুর সামনে এক আসনে বসেছিলেন। আইয়ুবীর দুই সেনাপতি শেখ মান্নান ও তার সঙ্গীদেরকে হাজির করলো সুলতানের সামনে।
‘মান্নান!’ সুলতান আইয়ুবী গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘এখন তুমি কি চাও?’
‘প্রাণ ভিক্ষা চাই!’ শেখ মান্নান পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বললো।
“আর তোমার দূর্গ?’ সুলতান আইয়ুবী জিজ্ঞেস করলেন।
‘আপনার যে সিদ্ধান্ত তাই মেনে নেবো।’
“তোমার সৈন্যসামন্ত নিয়ে এক্ষুণি বেরিয়ে যাও।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, “তোমরা কোন জিনিস সঙ্গে নিতে পারবে না। তোমার বাহিনীকে গুছিয়ে নাও, কোন সেনা কমাণ্ডার ও সৈন্যের কাছে অস্ত্রশস্ত্র থাকতে পারবে না। এখান থেকে সম্পূর্ণ খালি হাতে বের হয়ে যাবে তোমরা। তোমার কয়েদখানায় যেসব কয়েদী আছে, তাদের সেখানেই থাকতে দাও। আর স্মরণ রেখো, ইসলামী সাম্রাজ্যের কোন সীমানাতেই যেন তোমাকে না দেখি। সোজা খৃস্টানদের সীমানায় গিয়ে থামবে। তোমাকে এ যাত্রা মৃত্যুদণ্ড দিলাম না, কিন্তু ইসলামী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আর কোন চক্রান্ত বা অপকর্ম করলে তার যথাযথ সাজা তোমাকে ভোগ করতে হবে।’
তিনি আরো বললেন, ‘তুমি যে চারজন ফেদাইনকে পাঠিয়ে ছিলে আমাকে হত্যা করার জন্য, তারা সবাই নিহত হয়েছে। তুমি সাদা পতাকা উড়িয়েছে বলে এবারকার মত তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। আমি কুরআনের নির্দেশের অনুসারী। আমি বলতে পারি না, খোদা তোমাকে ক্ষমা করবেন কি না। কিন্তু আমি বলছি, তুমি এবং তোমার ফোইন খুনীরা যদি নিজেদের মুসলমান হিসাবে দাবী করা ত্যাগ না করে তবে তোমাকে ও তোমার দলকে আমি ভূমধ্যসাগরে ডুবিয়ে দিতে বাধ্য হবো।’
সূর্য ডুবতে বসেছে। সন্ধ্যার লালিমায় বিষন্নতার ছোঁয়া। মানুষের আবছা সুদীর্ঘ ছায়া মাথা নত করে দিগন্তের পাড়ে চলে যাচ্ছে। সেই ছায়া শেখ মান্নানের। মান্নান একা নয়, তার সাথে আছে তার এতদিনের সহচরবৃন্দ। নতমুখী, মানুষের দীর্ঘ মিছিল হারিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টির অন্তরালে। সেই মিছিলের পুরোভাগে নেতৃত্ব দিচ্ছে শেখ মান্নান। পরাজিত মানুষের অভিনব এক কাফেলা। কাফেলায় শরীক হয়েছে নানা বিচিত্র অপরাধী। কেউ খুনী, কেউ মাদক ও নারীর দালাল, কেউ ছিনতাইকারীদের সর্দার, কেউ প্রতারক ও ফেরেববাজ, কেউ লুটেরাদের নেতা, কেউ সম্মোহন বিদ্যায় পারদর্শী গণক ও ভাগ্য গণনাকারী। এদেরই কেউ গুপ্তঘাতক দলের সেনাপতি, কেউ কমাণ্ডার ও সৈন্য।
পেশাদার খুনীরা মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে অপরাধ জগতের রথী মহারথীরা। এটা স্বপ্ন না বাস্তব এই দ্বিধায় ভুগছে এখনো কেউ কেউ। তাদের এই দ্বিধার কারণ তাদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা অপকর্মের দীর্ঘ ফিরিস্তি। কারণ তারা জানে, তারা এমন সব অপরাধ করেছে, যার কোন ক্ষমা নেই। যদি সেই অপরাধের শাস্তি দেয়ার জন্যই তাইয়বী এসে থাকে তাহলে তো তার উচিত ছিল আমাদেরকে হত্যা করা। অথচ সে আমাদের গায়ে ফুলের টোকাটি পর্যন্ত দেয়নি। আবার ভাবছিল, আমরা কি তারা, যাদের ভয়ে রাজা উজির আমীরদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়।
এসব ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যার অন্ধকারে হারিয়ে গেল দুর্ধর্ষ ফেদাইন সন্ত্রাসীরা। দুর্ভাগ্য তাদের, যাওয়ার সময় তারা কিছুই সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। তাদের উট, ঘোড়া, অস্ত্র, মানুষকে মোহগ্রস্ত করার নানা সরঞ্জাম, আসবাবাদি সব কিছু কেল্লার মধ্যে ফেলেই তাদের পথে নামতে হয়েছে।
সূর্য পরিপূর্ণভাবে অস্ত যাওয়ার আগেই সুলতান আইয়ুবীর সেনাবাহিনী দূর্গের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে নিল। কারাগার থেকে বের করে আনা হল কয়েদীদের। শেখ মান্নানের মহল ও কেল্লার গুপ্ত কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হল বেশুমার সোনা, রূপা, হীরা, জহরত ও অফুরন্ত মণিমাণিক্য।
❀ ❀ ❀
সুলতান আইয়ুবী এই কেল্লাকে একজন সেনাপতির দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে সেই রাতেই কোহে সুলতানে যাত্রা করলেন। তিনি এখন আর বেশী দেরী করতে চান না। পরিকল্পিত অবশিষ্ট কাজগুলো যত দ্রুত সম্ভব সমাধা করে ফেলতে চান। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি নতুন অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন। অভিযানের শুরুতেই আচমকা এক রাতে তিনি এজাজ দুর্গ অবরোধ করে বসলেন। হলবের আমীর এজাজ দুর্গকে শক্তিশালী ঘাঁটি হিসাবে গড়ে তুলেছিল। কারণ এই ঘাঁটিই হলব শহর ও প্রদেশের প্রধান প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
হলবের আমীর তার সেনাবাহিনীর মূল শক্তিকেন্দ্র হিসাবে এজাজ দূর্গকে গড়ে তোলার ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। এই ঘাটির সব সৈন্য ছিল তারুণ্যে উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। সবাই ছিল ক্লান্তিহীন, সতেজ ও সবল। তিনি এই বাহিনীকে আইয়ুবীর মোকাবেলা করার জন্য উপযুক্ত ট্রেনিং ও পর্যাপ্ত রসদ সরবরাহ করে রেখেছিলেন। কিন্তু এই সৈনিকদের অধিকাংশই ছিল এমন, পর্যাপ্ত ট্রেনিং পেলেও যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি লড়াই করার অভিজ্ঞতা যাদের ছিল না।
সুলতান আইয়ুবী জানতেন তাদের রণপ্রস্তুতির কথা। বিশেষ করে সুলতানের দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়ে তারা যে দুঃসাহস দেখিয়েছিল, তাতে তাদের সাহস ও শক্তির অহংকারই মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তাই এ কেল্লা খুব সহজেই দখল করতে পারবেন, তেমনটি সুলতান আশাও করেননি। তিনি জানতেন, এজাজ দূর্গে তিনি তুমূল প্রতিরোধের সম্মুখীন হবেন। তাই কেল্লাটি দখল করার মত পর্যাপ্ত রণপ্রস্তুতি নিয়েই তিনি এখানে এসেছিলেন।
এ কেল্লা অবরোধ করার মধ্যে একটি সামরিক ঝুঁকি বিদ্যমান ছিল, সুলতান সে বিষয়টিও নজরে রেখেছিলেন। এই ঝুঁকি হচ্ছে, হলবের সেনাবাহিনী। তিনি কেল্লা অবরোধ করে বসে থাকলে আত্মসমর্পণ না করে কেল্লার কোন সৈনিক বাইরে আসতে পারবে না ঠিক, কিন্তু পিছন থেকে হলবের সেনাবাহিনী আক্রমণ করে বসতে পারে। তাই তিনি এমন একটি ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, যাতে হল থেকে কোন বাহিনী এলে তাদেরও উপযুক্ত আদর-আপ্যায়নে কোন ক্রটি না ঘটে।
সুলতান আইয়ুবীর একটা সুবিধা ছিল এই, তুর্কমান রণাঙ্গণ থেকে সম্মিলিত বাহিনীর সাথে হলবের বাহিনীও চরম পরাজয় স্বীকার করে হতোদ্যম ও ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসেছিল। তাদের এখন যুদ্ধ করার সাহস, শক্তি ও মনোবল কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এজাজ দুর্গ। হলবের অনুগত বাহিনী জীবন বাজি রেখে লড়াই করে চলেছে। এজাজ দূর্গ রক্ষার সাথে জড়িয়ে পড়েছে তাদের জীবন-মরণ। পুরো একটা দিন ও রাত তারা সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদেরকে কেল্লার কাছে আসতে দেয়নি। প্রাচীর ভাঙার জন্য যে দলটিকে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন সুলতান, অনেক চেষ্টা করেও দেয়ালের কাছে যেতে পারেনি তারা। কারণ প্রাচীরের ওপর থেকে এমন প্রবল বেগে তীর বর্ষিত হচ্ছিল, জীবন বাজি রেখে চেষ্টা করেও দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব নয় কারো পক্ষে, তার আগেই তীরের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে তার বুক। তাই নিশ্চল ঝুঁকি নেয়ার মধ্যে কোন কল্যাণ খুঁজে পায়নি দলটি।
পরের দিন। সুলতান আইয়ুবী অবরোধ তীব্রতর করার কথা ভাবলেন। তিনি তাঁর বাহিনীর অফিসার ও কমাণ্ডারদের ডেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে বললেন, কালকের চেয়ে আজকের আক্রমণ আরেকটু জোরালো করো, যাতে ওরা উপলব্ধি করতে পারে, সময় যত যাবে ততই কঠিন হবে ওদের বেঁচে থাকা। আমি ওদের হত্যা করার পরিবর্তে আত্মসমর্পণ করাতে চাই। তোমাদের টার্গেট হবে ওদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলা। সেনাবাহিনী সুলতানের নির্দেশ মোতাবেক কাজে নেমে পড়ল। শক্তিশালী মিঞ্জানিক দ্বারা ভারী ভারী পাথর নিক্ষেপ করে, পেট্রোল ভর্তি হাঁড়ি নিক্ষেপ করে এবং সেই পেট্রোলে অগ্নি তীর বর্ষণ করে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আইয়ুবীর সৈন্যরা দুর্গ এবং দুর্গ-প্রাচীরে এক ভয়াবহ ত্রাসের পরিবেশ তৈরী করে ফেলল।
প্রাচীরের উপরের তীরন্দাজরা অনেকেই আগুনে ঝলসে গেল। কেউ কেউ কেল্লার ভেতর লাফিয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করল। কেল্লার ভেতর অগ্নিশিখা কতটা বিস্তৃত হলো দেখার উপায় না থাকলেও প্রাচীরের অবস্থা আইয়ুবীর সৈন্যরা সচক্ষে দেখতে পাচ্ছিল। প্রাচীরের ওপর জায়গায় জায়গায় যেসব সেন্ট্রিবক্স ছিল সেখানে থেকে তখনো কিছু তীরন্দাজ প্রাণপণে তীর ছুঁড়ে যাচ্ছিল।
এমন সময় পেট্রোল বোঝাই একটি হাঁড়ি গিয়ে পড়ল কেল্লার একদম গেটের কাছাকাছি। কিছু পেট্রোল পড়লো পাঁচিলে, কিছু ছিটকে গিয়ে পড়ল গেটে। আইয়ুবীর তীরন্দাজরা সেই পেট্রোলে অগ্নি-তীর ছুঁড়ে মারল। সাথে সাথে সেখানে জ্বলে উঠল দাউ দাউ আগুন। পাঁচিল থেকে সে আগুন লাফিয়ে পড়ল কেল্লার গেটে; জ্বলতে শুরু করলো কেল্লার প্রধান ফটক। এই সুযোগে প্রাচীর ভাঙা বাহিনী ছুটল পাঁচিল ভাঙতে। কিন্তু সেন্ট্রিবক্স থেকে বেপরোয়া তীর বর্ষণ করে তাদের অনেককেই শহীদ করে দিল এজাজের দূর্গ রক্ষীরা।
কেল্লার ভেতর অগ্নিগোলা নিক্ষেপের জন্য মিঞ্জানিক চালকদের কয়েকজন মিঞ্জানিক পাঁচিলের আরো কাছাকাছি নিয়ে গেল। এদের উপরও বেপরোয়া তীর চালাল পাঁচিলের ওপর থেকে কয়েকজন তীরন্দাজ। এতে বেশ কিছু মিঞ্জানিক চালক ও সৈন্য আহত এবং শহীদ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে ওরা আবার মিঞানিক পিছনে সরিয়ে নিয়ে এল।
সুলতান আইয়ুবী সবকিছু তদারক করছিলেন। তিনি মিঞানিক চালকদেরকে খুব সতর্কতার সাথে সেন্ট্রিবক্স টার্গেট করতে বললেন। তাই করা হলো। দেখা গেল দুটি সেন্ট্রিবক্স ভারী পাথরের আঘাতে গুড়িয়ে গেল। সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল ওখান থেকে তীর আসা।
এবার আরেকদল পাঁচিল-ভাঙা সৈনিক ছুটল গেটের দিকে। শন শন করে অন্য সেন্ট্রিবক্স থেকে ছুটে এল কয়েকটি তীর। কয়েকজন মুজাহিদ লুটিয়ে পড়ল ময়দানে। বাকীরা সঙ্গীদের লাশ পেছনে ফেলেই এগিয়ে গেল সামনে। কারণ তারা বুঝে গিয়েছিল, এমন কিছু কুরবানী ছাড়া কেল্লা দখল করা সম্ভব নয়। একজন শহীদ হলে সেখানে ছুটে যেতো আরো কয়েকজন জিন্দাদীল মুজাহিদ।
আইয়ুবী বুঝতে পারলেন, লড়াই একটি পরিণতির দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। আক্রমণ আরেকটু তীব্রতর করতে পারলে লড়াই আগামী কালের জন্য মূলতবী করার প্রয়োজন পড়বে না।
কেল্লার গেট তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে। লোহার ফ্রেম থেকে খসে খসে পড়ে যাচ্ছে কাঠের জ্বলন্ত টুকরা। ওদিকে সুলতানের আদেশ পেয়ে সমানে পাথর নিক্ষেপ করতে লাগল মিঞ্জানিক চালকরা। তীরন্দাজরা এগিয়ে টার্গেট স্থির করে তীর বর্ষণ শুরু করে দিল। তারপরও কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়।
একটু পর। আইয়ুবীর একদল জানবাজ গেটের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। তারা বন্ধুদের লাশ এবং জ্বলন্ত আগুনকে অগ্রাহ্য করে গেটের কাঠ খুলতে শুরু করে দিল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গেটের লোহার ফ্রেম ছাড়া উধাও হয়ে গেল সব কাঠ। এখন অনায়াসেই পদাতিক বাহিনীর সদস্যরা দুর্গে প্রবেশ করতে পারবে।
এ সুযোগটুকুর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন সুলতান। তিনি পদাতিক বাহিনীকে এগিয়ে যাওয়ার হুকুম দিলেন। এগিয়ে গেল পদাতিক বাহিনী।
ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে রাতের আঁধার। থেমে গেছে পাথর ও অগ্নিগোলা নিক্ষেপ। দাউ দাউ আগুনের প্রচণ্ডতা কমে গিয়ে এখানে ওখানে যে টুকরো টুকরো অগ্নিশিখা জ্বলছে তাতে কেল্লার ভেতরের অন্ধকার যেন আরো গাঢ় হয়ে উঠল। কারণ সে আগুন সামান্য এলাকা আলোকিত করে পাশের অন্ধকারকে আরো ঘন অন্ধকারে ডুবিয়ে দিচ্ছিল।
গেটে তখনো লোহার ফ্রেমটুকু রয়ে গিয়েছিল। যে কারণে ওখান দিয়ে অশ্বারোহীদের প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। প্রাচীর ভাঙার যে দলটি ওখানে পৌঁছে গিয়েছিল তারা লোহার ফ্রেম সরানোর চেষ্টা করছিল। এ সময় একদল পদাতিক অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সাঁ করে ভেতরে ঢুকে গেল। তাদের পেছন পেছন ঢুকল আরেকটি দল।
এজাজের দুর্গ রক্ষীরা ছাদের ওপর থেকে তাদের ওপর তীর বর্ষণ করছিল। কেউ কেউ লুটিয়ে পড়ছিল সে তীরের আঘাতে। বাকীরা ঢুকে যাচ্ছিল কেল্লার অভ্যন্তরে।
কেল্লার ভেতরে সৈনিকদের যে ব্যারাক ছিল তার সামনে সঙ্গীণ উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একদল কেল্লা রক্ষী। আইয়ুবীর পদাতিক বাহিনী হামলে পড়লো তাদের ওপর। রক্তক্ষয়ী তলোয়ার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল সেখানে।
পদাতিক বাহিনীর জানবাজ সৈন্যরা প্রাণপণে লড়াই করে চলেছে। ততক্ষণে গেটের লোহার ফ্রেমটি সরিয়ে ফেলতে সমর্থ হলো ওখানকার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনী। সুলতান আইয়ুবী এবার সাঁড়াশী অভিযানের জন্য অশ্বারোহী দলকে এগিয়ে যাবার হুকুম দিলেন।
অশ্বারোহী বাহিনী খোলা গেট দিয়ে ঝড়ের বেগে ঢুকে গেল ভেতরে। এজাজ দুর্গের তীরন্দাজরা ছাদের ওপর থেকে তীরের বন্যা বইয়ে দিল। আইয়ুবীর বাহিনীর পদাতিক ও অশ্বারোহীদের লাশে ভরে গেল সামনের চত্বর। যুদ্ধের এ পর্যায়ে এসে এমন কঠোর প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবে, আইয়ুবীর বাহিনী এতটা ধারনা করেনি। তারা চরম কোরবানী দিয়ে যাচ্ছিল। লড়াই চলছিল তীব্রতর, দু’পক্ষেই হতাহত হচ্ছিল সমান তালে। আইয়ুবীর সৈনারা লাশ ডিঙ্গিয়ে আরো ভেতরে প্রবেশ করলো।
এ যুদ্ধ ছিল বড় রক্ত ঝরা যুদ্ধ। এজাজ দুর্গের সৈন্যরা প্রচণ্ড সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে লড়াই করছিল। গেটের লৌহ কপাট ভেঙে পড়ায় দলে দলে অশ্বারোহী বাহিনী ভেতরে প্রবেশ করলো। প্রাণপণে প্রতিরোধ করেও ওদের অগ্রযাত্রা বন্ধ করতে পারল না এজাজের দুর্গরক্ষীরা।
সুলতান আইয়ুবী ভেতরে প্রবেশ রত অশ্বারোহীদের হুকুম দিলেন কেল্লার মধ্যে স্থানে স্থানে আগুন লাগিয়ে দিতে। তাতে অন্ধকার কিছুটা কমবে। শত্রু-মিত্র চিনতে সুবিধা হবে। আর সবচে বড় ফায়দা যেটি হবে, তা হলো, সর্বত্র আগুন ধরিয়ে দিলে কেল্লার অভ্যন্তরে আতংক বৃদ্ধি পাবে। এখন ওরা ক্ষয়ক্ষতি প্রত্যক্ষ করতে পারছে না বলে যে সাহস ও মনোবল নিয়ে লড়াই করতে পারছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমান দেখলে তাতে, ভাটা পড়বে। কেল্লার সর্বত্র আগুন জ্বলতে শুরু করলে ওরা, বুঝতে পারবে, আইয়ুবীর বাহিনী কেল্লার সবখানে অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। হয়তো এরই মধ্যে তাদের কোন কোন সাথী আত্মসমর্পণও করে ফেলেছে। এই চিন্তা একবার কারো মনে ঢুকে গেলে সে নিজেও আত্মসমর্পণের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবে।
সঙ্গে সঙ্গে সুলতানের নির্দেশ কার্যকর করা হলো। কেল্লার বিভিন্ন স্থাপনার ওপর আগুন লাগিয়ে দিল আইয়ুবীর বাহিনী। এতক্ষণ এজাজ দুর্গের যে সেনাদল বীরত্ব নিয়ে লড়াই করছিল, তারা দেখতে পেল, তাদের অস্ত্রাগারে আগুন জ্বলছে। আগুন জ্বলছে ঘোড়ার আস্তাবলে, খাদ্যগুদামে, তাদের থাকার ব্যারাকে, এমনকি অফিসার্স কোয়ার্টারে। পশুর জন্য রাখা শুকনো ঘাস ও খড়ের গুমাদের আগুন আকাশ, আলোকিত করে ফেলেছে।
এ কেল্লাটি হলব শহর থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। রাতে হলববাসী দেখলো, এজাজ দুর্গের যেখানে সেখানে আগুন আর আগুন। আগুনের সেই লেলিহান শিখায় পাক খাচ্ছে ধোঁয়ার কালী। আকাশ লাল করে সে ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। একটার পর একটা অগ্নিশিখা কেবল বাড়ছেই। মনে হচ্ছে, এজাজ দুর্গে আগুনের রাজত্ব কায়েম হয়েছে।
সুলতান আইয়ুবী এজাজ দুর্গ অবরোধ করেছেন, হলববাসী এ সংবাদ আগেই পেয়েছিল। এই দৃশ্য দেখে হলবের সেনাবাহিনী প্রধান চিন্তায় পড়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেনানায়কদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। বললেন, ‘অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না। আইয়ুবীর বাহিনী নিশ্চয়ই এজাজ দুর্গে ঢুকে পড়েছে। এখন তাদের সাহায্যে আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত। আমরা আইয়ুরীর বাহিনীর পিছন থেকে আঘাত করলে সে উভয় সংকটে পড়ে যাবে। দুদিক থেকে আক্রান্ত হলে তার অবস্থা হবে করুণ চাই কি সে আত্মসমর্পণও করে বসতে পারে।’
কেউ কেউ এ প্রস্তাব সমর্থন করলেও অধিকাংশ সেনাপতি এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করল। তাদের একদল বলল, “এজাজ দুর্গ নয়, এখন আমাদের নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করা উচিত। আইয়ুবী এজাজ দুর্গ দখল করে বসে থাকবে না। সে অবশ্যই হলব আক্রমণ করবে। তার হলব প্রবেশ কি করে রোধ করা যায়, এটিই এখন মন্তু ভাবনার বিষয়।
সেনাপতি বললো, “সে জন্যই তো আমি এই মুহূর্তে তাকে পিছন থেকে চ্যালেঞ্জ করে বসতে চাই। সে এজাজ দুর্গে পরাজিত হলে কখনো হলব আক্রমণ করতে পারবে না।’
‘কিন্তু আমরা শহর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে আরো বড় বিপদ হাত পারে।’ বলল এক সেনাপতি, ‘তাঁর কোন বাহিনী এই মুহুর্তে শহরের বাইরে ওঁৎ পেতে বসে নেই, এমন নিশ্চয়তা আমরা কেউ দিতে পারবো না। সে ক্ষেত্রে আমরা শহর থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে ওরা শহরে ঢুকে পড়বে। বিনা বাধায় ও বিনা যুদ্ধে ওরা এই শহর দখল করে নেবে। এমন সুযোগ আমরা ওদের কিছুতেই দিতে পারি না।’
‘আমি ভাবছি অন্য কথা।’ বলল আরেক সেনাপতি। ‘আমাদের বাহিনী এইমাত্র একটা রক্তাক্ত লড়াই থেকে ফিরল। আইয়ুবীর হাতে চরম মার খেয়ে পরাজিত ও বিপর্যস্ত অবস্থায় ফিরে এসেছে ওরা। তারা আহত, রক্তাক্ত ও ক্লান্ত। তাদের মধ্যে এখনো বিরাজ করছে আইয়ুবী আতঙ্ক। ওরা এখন যুদ্ধ করার যোগ্য নেই। এ অবস্থায় আমরা চাইলেও ওদেরকে এখন আইয়ুবীর বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারবো না। এজাজ দুর্গের তাজাদম সৈন্যরাই যদি নিজেদের ভাগ্যের বিপর্যয় রোধ করতে না পারে তবে আমাদের এ হতোদ্যম বাহিনী কি করে ওদের রক্ষা করার জিম্ম নেবে?”
সুলতান আইয়ুবী যখন এজাজ দুর্গ অবরোধ করেন তখন আল মালেকুস সালেহের বয়স তেরো কি চৌদ্দ। এখন আর সে শিশু নয়। শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ হয়েছে তার বয়স। কিছু কিছু বুঝতে শিখেছে রাজনীতির খেলা।
হলবে নিজের প্রাসাদে বসে সে দেখলো এজাজ দুর্গের লেলিহান আগুনের শিখা। যা বুঝার বুঝে নিল সে।
সে সময় সাইফুদ্দিন এবং গুমাস্তগীনও হলবেই ছিল। গতকালের ঘটনা মনে পড়ে গেল তার। আইয়ুবী এজাজ দুর্গ অবরোধ করেছে এ খবর যখন হলবে পৌঁছে তখন এ দুজনই দরবারে ছিল। এজাজ দুর্গের অবস্থা ও করণীয় নিয়ে দু’জনের মধ্যে তর্ক বেঁধে যায়। এই বিতর্ক এমন তিক্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে, গুমাস্তগীন সাইফুদ্দিনকে হত্যা করার হুমকী পর্যন্ত দেয়।
আল মালেকুস সালেহ ওদের এ বিতর্ক গভীর মনযোগের সাথে লক্ষ্য করে। গুমাস্তগীন এবং সাইফুদ্দিনের হাব-ভাব, আচরণ, চাহনী ও প্রতিটি কথা থেকে সে বুঝতে চেষ্টা করে ওদের দু’জনকে। ঝগড়ার এক পর্যায়ে সাইফুদ্দিন সম্মিলিত বাহিনীর সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয় এবং নিজের অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে হল ত্যাগ করে চলে যাবে বলে জানায়।
আল মালেকুস সালেহ বুঝতে পারে, সম্মিলিত বাহিনীতে থাকলেও এরা আসলে একে অপরের শত্রু। গুমাস্তগীন যে আক্রোশ দেখালো, তাতে সে অনুভব করলো, এ লোকটি সুবিধের নয়, সে আসলে বন্ধুবেশী এক ষড়যন্ত্রকারী। অবশেষে সে এই ঝগড়ায় হস্তক্ষেপ করে এবং সাইফুদ্দিনকে আশ্বস্ত করার জন্য গুমাস্তগীনকে কারাগারে বন্দী করে। বন্দী গুমাস্তগীন আল মালেকুস সালেহের বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র পাকাতে শুরু করলে সে তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। আল মালেকুন্স সালেহ তখন তাকে কারাগারেই হত্যা করতে বাধ্য হয়।
এজাজ দুর্গ। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর শেষ পর্যন্ত দুর্গের সৈন্যরা অসমর্পণ করতে শুরু করল। এই অবরোধ ও যুদ্ধে সুলতান আইয়ুবীর বিজয় হলো বটে, কিন্তু এ বিজয়ের জন্য তাঁকে অনেক বেশী মূল্য দিতে হল। সেনা বাহিনীর যে দলটি প্রথম কেল্লার মধ্যে প্রবেশ করেছিল, এ যুদ্ধে তাদের অধিকাংশই শাহাদাত বরণ করেছিল। এজাজের দুর্গ রক্ষীরা প্রমাণ করে দিয়েছিল, তারা কাপুরুষ বা ভীরু নয়।
এজাজ দুর্গ জয় করার পর সুলতান আইয়ুবী বিলম্ব না করে দ্রুত হলব শহর অবরোধ করে নিলেন। হলব শহর ছিল এজাজ দুর্গের খুবই সন্নিকটে। হলব শহরেব সৈন্যরা রাতভর দেখেছে এজাজ দুর্গের বিভীষিকা। জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা শুধু নয়, আহতদের আর্ত চিৎকারের ক্ষীণ আর্তনাদ তাদের অন্তরে ভয়ের শিহরণ বইয়ে দিয়েছে। অজানা শংকায় কেঁপেছে তাদের হৃদয়গুলো।
যুদ্ধ করার সব প্রেরণা ও সাহস তাতেই উবে গিয়েছিল। ভোরে যখন ওরা দেখতে পেল, কাল রাতে যারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল এজাজ দুর্গে, এখন তাই এ শহর অবরোধ করে বসে আছে, ভয়ের হীমশীতল স্রোত তাদের কণ্ঠতালু পর্যন্ত শুকিয়ে ফেলল। তারা এজ দুর্গের রাতের বিভীষিকাময় দৃশ্যের কথা স্মরণ করে। ভীতসন্ত্রস্ত হরিণীর মত পালাবার পথ তালাশ করতে লাগল।
হলবাসীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল এ ভীতির শিহরণ। তারা আইয়ুবীর সাথে তাদের অতীত আচরণের কথা স্মরণ করে ভাবছিল আইয়ুবী না জানি তাদের জন্য কি কঠিন শাস্তি বরাদ্দ করে।
পালাবার সব পথ বন্ধ। শহরের চারদিক আইয়ুবীর সৈন্যরা ঘেরাও করে রেখেছে। এ অবস্থায় কিছুই করার নেই দেখে জনসাধরণ ঘরের ভেতর দরজা জানালা বন্ধ করে বনে বসে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগল। কারণ শহরের সেনাবাহিনী যে সুলতান আইয়ুবীকে প্রতিরোধ করার শক্তি হারিয়েছে সে কথা বুঝতে কারো কোন কষ্ট হচ্ছিল না। আইয়ুবী তাদের জন্য কি শাস্তি নির্ধারণ করে তাই দেখার জন্য দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগল শহরের প্রতিটি নাগরিক, এমনকি সৈন্যরা পর্যন্ত।
❀ ❀ ❀
অবরোধের দ্বিতীয় দিন। আল মালেকুস সালেহের এক দূত এলো সুলতান আইয়ুবীর কাছে। দূত সুলতানের কাছে একটি চিঠি হস্তান্তর করল। সুলতান ভেবেছিলেন, আল মালেকুস সালেই হয়তো কোন সন্ধি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কিন্তু চিঠি খুলে তিনি তাজ্জব হয়ে গেলেন। এটি কোন সন্ধি প্রস্তাব ছিল না, ছিল এক আবেগময় ছোট্ট চিরকুট, যা পড়ে সুলতান আইয়ুবী হতভম্ব হয়ে গেলেন।
চিঠিটা ছিল এমন: ‘সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী মরহুমের শিশু কন্যা সুলতান আইয়ুবীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়।’
এই মেয়েটির নাম শামসুন নেছা। সে আল মালেকুস সালেহের ছোট বোন। বয়স মাত্র নয় কি দশ। আল মালেকুস সালেহ যখন দামেশক থেকে বিপথগামী আমীরদের প্ররোচনায় হলবে পালিয়ে আসে, তখন সে তার ছোট বোনকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তার মা মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুন দামেশকেই থেকে যান। কারণ তিনি বিপথগামী আমীরদের ষড়যন্ত্র ধরতে পেরেছিলেন। সুলতান আইয়ুবীই যে মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর সত্যিকার অনুসারী এবং ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
সুলতান আইয়ুবী দূতকে নির্দেশ নিলেন, ‘যাও, সেই মেয়েকে নিয়ে এসো।’
মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর কন্যা অনুমতি পেয়ে সুলতানের সামনে এসে হাজির হলো। তার সাথে এল আল মালেকুস সালেহের দুই সেনাপতি।
সুলতান আইয়ুবী তাকে কাছে পেয়েই বুকে টেনে নিলেন। তখন তাঁর হৃদয়ে বইছে আবেগের বন্যা। তিনি নূরুদ্দিন জঙ্গীর শিশু কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবেগে কেঁদে ফেললেন। অনেকক্ষণ মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখার পর কিছুটা শান্ত হয়ে মেয়েটিকে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘তোমরা কেমন আছো মা? তোমার ভাই ভাল আছে?’ মেয়েটি বিহবল কণ্ঠে বলল, ‘আমরা ভাল আছি মামা। ভাইয়া আপনাকে এ চিঠিটা দিতে বলেছে।’ বলে সে ওড়নার ভেতর থেকে একটি চিঠি বের করে দিল।
সুলতান চিঠিটি নিয়ে পড়লেন। তাতে আল মালেকুস সালেহ পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে লিখেছে,
‘আজ থেকে আমি আপনার আনুগত্য স্বীকার করে নিলাম। বিপথগামী আমীরদের প্ররোচনায় এতদিন আপনার বিরোধীতা করে যে অন্যায় করেছি, সে জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী। আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। আমার কারণে ইসলামের অগ্রযাত্রায় যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল আপনার অধীনে বাকী জীবন কাজ করে আমি তার কাফফারা আদায় করতে চাই। আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, ইসলামের দুশমন, গাদ্দার গুমান্তগীনকে হত্যা করা হয়েছে। এখন থেকে হারান কেল্লা ও তার রাজ্য আপনার অধীন। আশা করি আপনি আমাকে আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দেবেন।’
ইতি
আপনার স্নেহের সালেহ।