» » খুনী চক্রের আস্তানায়

বর্ণাকার

এবার আওয়াজটা অনেক দূর থেকে এলো। ভাবনায় পড়ে গেল মেহেদী। সে ঘুরে পিছন ফিরে আবার হাঁটা ধরল। কান্নার রেশ আরো জোরালো হল। বেশ কিছুটা পথ মাড়িয়ে এলো মেহেদী, আবারো কান্না থেমে গেল।

মেহেদী আল হাসান উচ্চস্বরে বললো, ‘তুমি কি আমাকে দেখা দিবে নাকি আমাকে শুধু ভয়ই দেখাতে থাকবে?’

তার নিজের শব্দই পাহাড়ে প্রান্তরে আঘাত খেয়ে আবার ফিরে এল, কিন্তু কান্নার আওয়াজ বা এই প্রশ্নের কোন জবাব কেউ দিল না। একবার নয়, কয়েকবার সে এই প্রশ্ন করল, কিন্তু প্রতিবারই তার শব্দ ফিরে এসে তাকেই আঘাত করল। ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হলো তার কণ্ঠের সে আওয়াজ, কিন্তু সব বৃথা চেষ্টা, কেউ তার প্রশ্নের জবাব দিল না।

সেই শব্দ অন্ধকারে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। নিরূপায় হয়ে আবার মটিতে বসে পড়ল মেহেদী। তখন এক মেয়েলি কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেল সে। মেয়েটি বলছে, ‘হে সুন্দর যুবক! তুমি ওখানেই বসে থাকো। আমি প্রাণ ভরে তোমাকে দেখি। আজ দুই হাজার বছর ধরে আমি তোমার পথ পানে চেয়ে আছি। এতদিন পর প্রভু আমার প্রতি সদয় হলেন। আমি তোমাকে দেখতে পেলাম।’

মেহেদী আল হাসান এ শব্দও কয়েকবার শুনতে পেল। তারপরে আবার সব নীরব হয়ে গেল।

মেহেদী আল হাসান কিছুক্ষণ ওখানেই চুপচাপ বসে রইল। পরে আবার চিৎকার করে বলল, ‘তুমি কি একাই আমাকে দেখবে? আমি কি কখনো তোমাকে দেখতে পাবো না?’

‘তুমি কি আমাকে সত্যি দেখতে চাও? বলো, তোমার হৃদয় থেকে বলো, তুমি কি সত্যি দেখতে চাও?

‘হ্যাঁ, চাই।’

‘তাহলে ওঠো। এগিয়ে এসো আমার কাছে।’

এইভাবে দুই দিক থেকে কথার আদান প্রদান হলো। মেয়েটির মিষ্টি আহবান আবার শুনতে পেল মেহেদী, ‘কই, ওঠো, এগিয়ে এসো আমার কাছে!’

মেহেদী আল হাসান সব দ্বিধা ও ভয়ভীতি দূর করে উঠে দাঁড়াল। সে ওই পাহাড়ের দিকে রওনা দিল, যেদিক থেকে মেয়েটির কণ্ঠ ভেসে আসছিল। যেতে যেতে সে সেই গুহার কাছে গিয়ে পৌঁছল। গুহার ভেতর থেকে আলো আসছিল, সে আলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

সে গুহামুখে পৌঁছতেই আলোটি বিজলীর মত চমক দিয়ে ফট করে নিভে গেল। সেই ক্ষণিক আলোয় সে নিজেকে সুড়ংয়ের মুখে আবিস্কার করল। হতভম্ব হয়ে সে সেই গুহামুখে দাঁড়িয়ে রইল। গুহার ভেতর নিকষ কালো অন্ধকার। এই অন্ধকারের ভেতর কোন মানুষ আছে কি নেই বুঝার উপায় নেই।

মাত্র কয়েক মুহূর্ত, তার পরই সুড়ংয়ের অনেক ভেতরে একটি ক্ষুদ্র আলোর শিখা দেখা দিল। আস্তে আস্তে সে আলো বিস্তারিত হতে হতে একদম গুহার মুখ পর্যন্ত চলে এলো। মেহেদী আল হাসান অনেক দূরে সুড়ংয়ের ভেতর একজন মানুষকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেল। মানুষটি যে পুরুষ নয়, নারী তা এই দূর থেকেও বুঝা যাচ্ছে। সেই নারীদেহ তরঙ্গিত ছন্দ তুলে সামনে এগিয়ে আসছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত সেদিকে তাকিয়ে আছে মেহেদী আল হাসান। সেই নারী তার থেকে কম-বেশী পঞ্চাশ গজ দূরে এসে থামল।

সে লক্ষ্য করে দেখলো, মেয়েটি অনিন্দ্য সুন্দরী। তার চেহারা সুরত অতি মনোরম। সমস্ত শরীর কাফনের মত একদম সাদা কাপড়ে জড়ানো। হঠাৎ এ দৃশ্য দেখে মেহেদী আল হাসান ভয় পেয়ে গেল। তার কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গেল। হাত-পা কাঁপতে লাগল।

মেয়েটি হাসানের এ অবস্থা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, ‘ভয় পাচ্ছো কেন যুবক। আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না, আমাকে ভয় পাওয়ারও কিছু নেই! আমি দুই হাজার বছর ধরে তোমার পথ চেয়ে আছি। তোমার তো আজ খুশীর দিন। তাহলে তুমি অমন ভয় পাচ্ছো কেন? এসো, এগিয়ে এসে আমার দিকে।’

মেহেদী আল হাসান তার দিকে আরও একটু অগ্রসর হলো। কয়েক কদম এগিয়েছে, কাফনের মধ্য থেকে একটি হাত বের হয়ে এলো। হাতটি মেহেদী আল হাসানের দিকে বাড়িয়ে এমন ইশারা করলো, যেন সে আর সামনে না যায়। ইশারা পেয়েই মেহেদী আল হাসান আবার দাঁড়িয়ে গেল। আলোও নিভে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মেহেদী অপেক্ষা করতে থাকলো, ভাবলো, আলো হয়তো আবার জ্বলে উঠবে। সে আবার সেই কাফনে ঢাকা মেয়েটাকে দেখতে পাবে। কিন্তু আলো জ্বলার পরিবর্তে এবার ভেসে এল মেয়েটির কণ্ঠস্বর, এ স্বর আগের মত মিষ্টি মধুর নয়। রুক্ষ্ম ও কর্কশ কন্ঠে মেয়েটি বলল, ‘চলে যাও হে অবিশ্বাসী যুবক। তোমাকে বিশ্বাস করা চলে না। তোমার অন্তর ভালবাসাহীন। তুমি চলে যাও, চলে যাও তুমি।’

‘আমাকে তুমি বিশ্বাস করো, আমার উপর ভরসা রাখো!’ মেহেদী আল হাসান অনুনয় করে বললো, ‘আমি অবিশ্বাসী নই। আমার অন্তর ভালবাসা ও মমতাহীন নয়।’ সে কথা বলছিল আর অন্ধকারের মধ্য দিয়েই দ্রুত সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘আমি তোমার জন্যই এখানে এসেছি। তোমাকে দেখার জন্যই নির্জন অন্ধকারের মধ্যে একাকী ছুটে এসেছি। আমাকে বিশ্বাস করো, দেখা দাও আমার কাছে এসে।’

সুড়ংয়ের গহীন থেকে আওয়াজ এলো, ‘এখনো তোমাকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। দুনিয়ার মানুষ সব প্রতারক, তুমিও প্রতারক।’

“না, আমি প্রতারক নই। আমাকে বিশ্বাস করো, আমি সত্যি বলছি।’

‘তাহলে তুমি আগামীকাল এসো। ভয়ভীতি দূরে ফেলে এসো। অন্তরে প্রীতি ও মহব্বত নিয়ে এসো। যদি তুমি প্রতারক না হও তাহলে তুমি আমার দেখা পাবে। কিন্তু মনের মধ্যে ভয় ও সন্দেহ নিয়ে এলে, যেমন আজ এসেছো, তুমি কখনোই আমার দেখা পাবে না। আর যদি তুমি না আসো তবে তুমি ও তোমার ওস্তাদ সেই কবিরাজের কপালে যে দুর্ভোগ আছে তা আমি খণ্ডাতে পারবো না। আজ চলে যাও। মনকে পরিস্কার করে কাল এসো।’

মেহেদী আল হাসান এরপরও অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। বার বার ডাকল, সেই মেয়েকে, কিন্তু মেয়েটির আর কোন সাড়াশব্দ পেল না। সে অন্ধকারের মধ্যেই সুড়ংয়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল এবং একসময় সুড়ংয়ের অপর প্রান্তে চলে এল। সুড়ংয়ের ভিতরের চেয়ে বাইরের অন্ধকার কিছু কম। জমাট অন্ধকারের ভেতর দিয়ে হেঁটে সে সুড়ংয়ের মুখে এসে পৌঁছল। বাইরে আবছা আলোর মাঝে একটি লম্বা ছায়া দেখতে পেল। সাদা কাফনে জড়ানো একটি মেয়ে। সে গুহার বাইরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল। মেহেদী আল হাসান দৌড় দিল। কিন্তু পায়ে বাঁধা পেয়ে পড়ে গেল। উঠে আবার দৌড় দিল। কিন্তু কোথায় কাফন, কোথায় মেয়ে! নিরেট পাহাড় ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই। সে সুড়ংয়ের মুখে গিয়ে শব্দ করে ডাকলো, তার আওয়াজই ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে এলো তার কাছে। তারপর আর কোন আওয়াজ নেই। কান্নার শব্দ নেই, হাসির ঝরণা নেই, নেই কোন কথামালা।

একটু আগে সফেদ কাপড়ে-ঢাকা যে মেয়ের সাথে সে কথা বলেছিল কোথাও সে নেই। নিরাশ হয়ে ফিরে চলল মেহেদী আল হাসান। ফিরে চলল সুড়ং পথেই। সুড়ংয়ের মাঝামাঝি এসেছে এ সময় সুড়ংয়ের মুখে আলো দেখতে পেল, কিন্তু সে আলোতে কোন মানুষের ছায়াও ছিল না।

আলো নিভে গেল। মেহেদী আল হাসান আলোহীন অবস্থাতেই সুড়ং থেকে বেরিয়ে গেল। তার সামনে কিছু দূরে একটু আলো দেখা গেল। সে ওই আলোর কাছে গিয়ে দেখল, কে যেন পাথরের আড়ালে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে।

মেহেদী আল হাসান সেখানে দাঁড়িয়ে অনেক কিছু চিন্তা করলো। শেষে যেদিক দিয়ে এসেছিল, সে দিকে চলে গেল। ধীরে ধীরে পাহাড়ী এলাকা থেকে বের হয়ে এল মেহেদী। তার উট বাইরে এক গাছের সাথে বাঁধা ছিল। সে উটের উপর সওয়ার হলো এবং কায়রোর দিকে যাত্রা করলো।

তার মানসিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। একে ভয় বলা যাবে না কিন্তু তার মন ভরা ছিল উৎকট অস্থিরতা ও পেরেশানী। সে এই আলো দু’টি সম্পর্কে চিন্তা করছিল। একটা সেই আলো, যার সামনে সফেদ কাপড়ে ঢাকা মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল। আরেকটি আলো, যেটি উপরে সে দেখে এসেছে। উপরের আলোটা আগুন ছিল। কিন্তু মেয়েটি যে আলোতে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই আলোতে আগুন ছিল না। কারণ আলো জ্বলা স্থানটি সে দুইবার অতিক্রম করেছে। সেখানে আগুন জ্বালালে তার কিছুটা উত্তাপ তো সে অবশই পেতো! তাহলে সেটা কিসের আলো ছিল? প্রশ্নটার কোন জবাব সে তাৎক্ষণিকভাবে পেলো না।

রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল। নিজের আস্তানায় ফিরে এল মেহেদী আল হাসান। বিছানায় গেল ঘুমোবার জন্য, কিন্তু তার কিছুতেই ঘুম এলো না। বার বার সেই কাফনে জড়ানো মেয়েটির চেহারাই তার সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। বিছানায় শুয়ে সে কেবলই ছটফট করতে লাগলো।

অনেক রাতে শোয়ার পরও অভ্যাস অনুসারে সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠলো সে। তারপর প্রাত্যহিক কাজ সেরে আলী বিন সুফিয়ানের কাছে গেল নতুন নির্দেশ নিতে। আলী বিন সুফিয়ান তার ডিউটির স্থান পরিবর্তন করে তাকে শহর থেকে দূরে অন্য এক জায়গায় ডিউটি করতে বলল।

‘আরও কিছু দিন আমাকে এখানেই ডিউটি করার অনুমতি দিন। এতদিন এখানে কাজ করছি, মনে হয় একটি সূত্রের কাছাকাছি চলে এসেছি প্রায়।’ মেহেদী আল হাসান বললো, ‘আমি আশা করছি, এই পাহাড়ী এলাকায় আমি এমন কিছু পাবো, যা আপনাকে চমৎকৃত করবে। আমাকে আর দু’তিন দিন সময় দিন। এর মধ্যেই ইনশাআল্লাহ আমি আপনাকে নতুন কোন সুসংবাদ শোনাতে পারবো আশা করি।’

আলী বিন সুফিয়ান তার আবেদন উপেক্ষা করলো না। কারণ সে আনাড়ী গোয়েন্দা নয়। সে এক বিশ্বস্ত ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত অফিসার। সে যখন চাইছে তখন তাকে একটু সুযোগ দেয়া দরকার। আলী বিন সুফিয়ান এ নিয়ে তার সাথে কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন। পরে চিন্তা-ভাবনা করে বললেন, ‘তোমার আবেদন মঞ্জুর করা হলো। আশা করি তুমি সাবধানে কদম ফেলবে এবং নতুন সংবাদ নিয়েই ফিরবে।’

মেহেদী আল হাসান প্রেতাত্মার সাথে সাক্ষাৎ করার আগে সে এলাকা ছাড়তে চাচ্ছিল না! এই প্রথম সে তার দায়িত্ব চেয়ে নিল। আলী বিন সুফিয়ানের যদি সামান্যতম সন্দেহও হত যে, সে কোন চক্রে পড়ে তার ডিউটি পরিবর্তন করতে চাচ্ছে, তবে তাকে কখনোই সেখানে যাওয়ার অনুমতি দিত না। এক দক্ষ গোয়েন্দা নিজেকে এমন ভয় ও বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল, যেখানে তার জীবন যাওয়ারও ঝুঁকি ছিল।

মেহেদী আল হাসান হেকিমের কাছে গেল। তার কাছে রাতের ঘটনা সব খুলে বলল। হেকিম তার কাহিনী শুনে চোখ বন্ধ করলো, মুখে বিড় বিড় করে কি যেন বলল। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে মেহেদী আল হাসানের চোখে চোখ রাখলো।

‘আজ রাতে আবার সেখানে যাও।’ হেকিম তাকে বললো, ‘সেই পবিত্র জগতের সৃষ্টি এই অপবিত্র পৃথিবীর মানুষের ধোঁকায় পড়তে চায় না, ভয় পায়। তুমি সেখানে ভয় পাবার মত কিছু করবে না, যাতে আজও সে দেখা দিয়ে সাক্ষাৎ না করে অদৃশ্য হয়ে যায়। তুমি অধৈর্য হয়ো না। সে তোমার সাথে সাক্ষাতের জন্য অধীর হয়ে আছে। অবশ্যই সাক্ষাৎ হবে। যদি এই সাক্ষাতে তোমার কোন উপকার না হয়, তবে আমি কেন সেখানে তোমাকে পাঠাতে যাবো! নিশ্চয়ই এই সাক্ষাত তোমার জীবনের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে থাকবে।’

মেহেদী আল হাসান চলে গেল। রোজকার মত পশুর পাল নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে ছেড়ে দিয়ে সে উঠে গেল পাহাড়ে। সেখানে সে ঘোরাফেরা করতে লাগল। তার চোখে পড়ল সেই গুহা-মুখ। সে সেই গুহার কাছে গেল। তাকাল চারদিকে। তারপর সুড়ংয়ের মধ্যে ঢুকে গেল। সুড়ংয়ের মুখে সে মাটিতে একটি কাপড়ের টুকরো পড়ে থাকতে দেখলো। সে কাপড়ের খণ্ডটি উঠিয়ে নিল। এক ইঞ্জি চওড়া হাতখানেক লম্বা এক টুকরো ফিতা। সে কাপড়ের ফিতাটাকে গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলো। ফিতাটি পকেটে রেখে সে এবার সুড়ংয়ের মধ্য দিয়ে হাঁটা শুরু করলো। এক পাশ দিয়ে ঢুকে সে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলো। সে সেই উঁচু জায়গাটির কাছে গেল, যেখানে পাথরের আড়ালে সে আগুন জ্বলতে দেখেছিল।

এরপর সে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। তখন অদৃশ্য থেকে এক পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো, ‘উপরে যেও না। যার জন্য তুমি এসেছো, সে রাতে আসবে।’ এ শব্দটি গুঞ্জরিত হয়ে বার বার তার কানে বাজতে লাগলো। তখন আবার শব্দ হলো, ‘আমাদের পৃথিবীতে এসে খোঁজাখুঁজি করবে না। যে পথে এসেছে সেই পথে ফিরে যাও।’

মেহেদী আল হাসান থেমে গেল। তার এমন মনে হতে লাগলো, যেন সে শব্দ তার আশেপাশে ঘুরছে। সে আর উপরে গেল না। সে অভিভূত হয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো। সে ভাবলো, তার এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে এখানকার প্রেতাত্মারা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। অসন্তুষ্ট হলে তারা তার ক্ষতি সাধন করে বসতে পারে।

সে আবার গুহার ভেতর ঢুকে গেল এবং সুড়ংয়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে অপর পাশ দিয়ে বাইরে চলে এল। তারপর হেঁটে হেঁটে সে তার পশুগুলোর কাছে চলে এল। সেখানে এক পাথরের ওপর বসে সে চিন্তা করতে লাগলো, এর রহস্যটা কি? কে আমাকে উপরে যেতে নিষেধ করলো? কেন নিষেধ করলো এই দিনের বেলায় যেখানে কোন জনমনিষি নেই সেখান কিভাবে স্পষ্ট আওয়াজে তাকে উপরে যেতে বারণ করবো? লোকটার কথা থেকে বুঝা যায়, সে আমার প্রতিটি কার্যকলাপ দেখছে, তাহলে আমি তাকে দেখলাম না কেন? তাহলে কি এখানে কোন মানুষ নেই? অদৃশ্য আত্মাই আমাকে এভাবে বারণ করলো? কিন্তু কেন? উপরে কি আছে, যা ওরা আমাকে দেখতে দিতে চায় না?

দিনটা তার এই সব চিন্তাতেই কেটে গেল। শেষে রাতে আবার এখানে আসার জন্য বিকেলে তাড়াতাড়ি তার ঠিকানায় ফিরে গেল।

সূর্য অস্ত যাওয়ার পর সে আবার রাখালের পোষাক পরে পাহাড়ী অঞ্চলে রওনা দিল। এভাবেই সে প্রতিদিন যায়। সাধারণ পোষাক পাল্টে মরু রাখালের বেশেই সে বরাবর হেকিমের সাথেও দেখা করেছে। এটাই তার ডিউটির পোষাক। সে যখন ডিউটিতে যায়, তখন সে লম্বা একটা খঞ্জরও সঙ্গে নিয়ে যায়। গতকাল তার সঙ্গে খঞ্জর ছিল বলেই রাতে সেই নারী তার সাথে সাক্ষাত করেনি। হেকিম বিষয়টি লক্ষ্য করে তাকে বলেছিল, ‘তুমি কি এই খঞ্জর নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে?”

মেহেদী আল হাসান হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়লে তিনি কড়া ভাষায় নিষেধ করে বলেছিলেন, “খবরদার, যখন রাতে প্রেতাত্মার সাথে দেখা করতে যাবে তখন সঙ্গে কোন অস্ত্রশস্ত্র রেখো না। অন্ত্রকে ওরা ঘৃণা করে। অস্ত্র মানুষের বুক থেকে প্রেমের শক্তি কেড়ে নেয়। ফেরাউন অন্ত্রের মুখে ওঁদের জোর করে ধরে এনেছিল। তাই ওরা অস্ত্রধারী কারো সাথে সাক্ষাত করে না। আজ রাতে তুমি যখন ওখানে যাবে তখন সঙ্গে কোন অস্ত্র নিও না।’

রাখালের পোষাক পরে সে লম্বা ছোরাটির দিকে তাকাল ছোরাটি দেয়ালের সাথে ঝুলানো। সে ছোরাটি দেখলো হেকিমের সাবধান বাণী মনে পড়ে গেল তার। সে গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। হেকিমের নির্দেশ অনুযায়ী খঞ্জর বা কোন অস্ত্রই সাথে নেয়া যাবে না। কিন্তু নিরস্ত্র অবস্থায় যাওয়াটা কি ঠিক হবে? অনেক চিন্তা-ভাবনার পর জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে সে খঞ্জরটি সঙ্গে নেয়াই যুক্তিযুক্ত মনে করল। সে দেয়াল থেকে খঞ্জরটি পেড়ে কাপড়ের ভেতর কোমরের সাথে সেটি বেঁধে নিয়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

গন্তব্য স্থানে পৌঁছে সে উটকে বসিয়ে দিল। তারপর পায়ে হেঁটে রওনা দিল সুড়ংয়ের মুখের দিকে। সহসা সে পিছনে কারো পদধ্বনি শুনতে পেল। থেমে গেল সে। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল সেই পদধ্বনি। মেহেদী সামনে না এগিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল।

একটু পর উপর থেকে পাথর গড়াননার শব্দ শুনতে পেল। পাথর পতনের সেই ধ্বনি তেমন বিকট ছিল না। কিন্তু এমন নিঝুম ও খাঁড়া পাহাড়ে পাথর পতনের আওয়াজ ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে নিচ পর্যন্ত গড়িয়ে চললো। পাথর পতনের আওয়াজ শেষ হতেই একটি গুঞ্জন ধ্বনি ভেসে আসল গুহার ওদিক থেকে। মনে হল, কেউ যেন ফোপাচ্ছে ও কাঁদছে। আস্তে আস্তে সেই কান্নার ধ্বনি জোরালো হলো। মেহেদী আল হাসানের কানে সেই কান্নার ধ্বনি আঘাত করতেই সে বলে উঠল, “কেঁদো না, আমার সামনে এসো। আমার দুনিয়া অপবিত্র হতে পারে, কিন্তু আমি অপবিত্র নই।’

‘তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।’ কান্না কাতর কণ্ঠেই কথাটা বলল কোন নারী। সে আওয়াজে ছিল বিনয় ও নম্রতা।

হঠাৎ আলো জ্বলে উঠলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই তা আবার নিভেও গেল। আলোটি জ্বলে উঠেছিল সুড়ংয়ের একেবারে মুখে। মেহেদী আল হাসান দ্রুত পদক্ষেপে সুড়ংয়ের দিকে এগিয়ে গেল।

সুড়ংয়ের একদম কাছাকাছি গিয়ে এক বিরাট পাথরের পিছনে বসে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো সে। সেখান থেকে উপরের দিকে তাকালো, যেখানে গত রাতে আগুন জ্বলতে দেখেছিল। একটু পর আজও সেখানে আগুন জ্বলে উঠল। সে নিজেকে মাটির সাথে একদম মিশিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সুড়ংয়ের মুখের কাছে চলে এল। তারপর নিজেকে ছুঁড়ে মারল সুড়ংয়ের ভেতর।

সুড়ংয়ে পৌঁছে যতটা সম্ভব পাথরের আড়ালে নিজেকে গোপন করে চুপচাপ বসে থাকলো। অন্ধকারে তার চোখ সহনীয় হয়ে উঠলে সে এদিক-ওদিক দৃষ্টি মেলে নীরবে দেখতে লাগলো। গুহা থেকে আগুনটা সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল না, তবে আগুনের আভা পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল।

সুড়ংয়ের ভেতর থেকে মেয়েটির কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘হে সুন্দর যুবক, দুই হাজার বছর ধরে তোমার পথ পানে চেয়ে আছি। তুমি আমার সামনে এসো।’ সুড়ংয়ের ভেতর এ কথা বার বার ধ্বনি প্রতিধ্বনি হতে লাগল। মেহেদী আল হাসান সেই কণ্ঠস্বরের উদ্দেশ্যে নিঃশব্দে পা বাড়াল। অন্ধকারে সুড়ংয়ের দেয়াল হাতড়ে ভেতরের দিকে চলতে লাগলো সে। তার মনে পড়লো, হেকিম তাকে বলেছে, সাথে কোন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যেও না। নিলে সে মেয়ের আত্মা তোমার সামনে আসবে না। তার সঙ্গে এখন দেড় ফুট লম্বা খঞ্জর আছে, অথচ মেয়েটি কথা বলছে, ডাকছে তাকে।

সে আরো অগ্রসর হলো এবং সুড়ংয়ের মাঝামাঝি পৌঁছে গেল। সুড়ংটা প্রশস্ত। দেয়াল হাতড়ে সে এগুচ্ছে এমন সময় তার মনে হলো, সামনে থেকে কেউ এগিয়ে আসছে। সে দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে রুদ্ধশ্বাসে আগন্তুকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

সুড়ংয়ের ভেতর গাঢ় অন্ধকার। নিজের হাত-পা পর্যন্ত দেখা যায় না। ফলে আগন্তুক পুরুষ না নারী তা যেমন সে দেখতে পারল না, তেমনি আগন্তুক ঠিক কতটা দূরে তাও নিশ্চিত হতে পারছিল না। সহসা তার মনে হল, কেউ তার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে।

তাকে পেরিয়ে মেয়েটি আরো দু’কদম এগিয়ে গিয়ে থামল। থেমেই আবার কান্না শুরু করে দিল।

এত ঘুটঘুটে অন্ধকারেও সে বুঝতে পারলো, গতকাল যে মেয়েকে সে আলোর সামনে দেখেছিল, এই সে মেয়ে। মেহেদী আল হাসান এ শব্দ আগেও কয়েকবার শুনেছে। এখন মেয়েটি তার এত কাছে যে, হাত বাড়ালেই সে তাকে ধরতে পারবে। টেনশনে তার বুক জোরে জোরে লাফাতে লাগলো।

মেয়েটি আবার সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য পা বাড়লি, ঠিক সেই সময় সুড়ংয়ের মুখে আলো জ্বলে উঠলো।

আলোটা জ্বলেই সঙ্গে সঙ্গে আবার নিভে গেল। মেহেদী আল হাসান দেয়াল থেকে আলগোছে তুলে আনল তার দেহ এবং চোখের পলকে আগন্তুকের পিছন থেকে জোরে তাকে জাপটে ধরলো।

মেয়েটি এতে মোটেও ভীত না হয়ে বলে উঠলো, ‘ওরে হতভাগা, তুই কি এটাকে কৌতুক ভাবতে শুরু করেছিস? ছেড়ে দে আমাকে। আমি তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছি না। আগে শিকার ধর। তোর শিকার এসে গেছে। আগে তাকে ঘায়েল করে নে। ছাড়, জলদি ছাড় বলছি।’

মেহেদী আল হাসান যে সন্দেহে জীবন বাজী রেখে তাকে ধরতে চেয়েছিল, সে সন্দেহ সত্যে পরিণত হলো। সে চিন্তা করেছিল, যদি সত্যিই প্রেতাত্মা হয়, তবে সে কখনও সামনে আসবে না। আর যদি তা না হয়, তবে তো একটা বড় ধরনের শিকার হাতে পাওয়া যাবে।

মেয়েটি ভেবেছিল, তার সঙ্গী ডিউটি ফেলে তার সঙ্গ পাওয়ার জন্য এভাবে জড়িয়ে ধরেছে। তাই সে প্রথমটায় এটাকে তেমন আমল দেয়নি। কিন্তু মেহেদী আল হাসানের কণ্ঠ কানে যেতেই তার সম্বিত ফিরে এল।

মেহেদী আল হাসান তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ‘যদি চিৎকার দাও, তবে খঞ্জরের আঘাতে তোমাকে এফোড় ওফোঁড় করে ফেলবো।’

‘আমি তোমার কলিজা টেনে বের করে খেয়ে ফেলবো।’ মেয়েটি বললো, ‘জানো আমি কি?

মেহেদী আল হাসান তাকে এক হাতে চেপে ধরে অন্য হাতে খঞ্জর বের করে তার ধারালো মাথা মেয়েটির পাঁজড়ে ঠেকাল। বলল, ‘প্রাণের মায়া থাকলে আমি যা বলি মন দিয়ে শোন।’

এ সময় সুড়ংয়ের মুখে আর একবার আলো জ্বলে উঠলো। মেহেদী আল হাসান এ পথে বাইরে বের হওয়া বিপদজনক মনে করল। মেয়েটি ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে, কি ঘটেছে। সে তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য বলে উঠল, “আমি এ জন্যই তোমাকে কাল কাছে আসতে দেইনি। তোমরা দুনিয়ার মানুষরা বড় প্রতারক, বড় ফেরেববাজ। তোমাদেরকে বিশ্বাস করা যায় না। মেয়েটি রাগত স্বরে বললো, দুই হাজার বছর ধরে এ জন্যই কি আমি তোমার পথ চেয়ে অপেক্ষা করছি, তুমি আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করবে?’

‘হ্যাঁ, তোমার অপেক্ষার দিন শেষ হয়ে গেছে।’ মেহেদী আল হাসান বললো, ‘এখন আর তুমি আত্মার পবিত্র জগতে ফিরে যেতে পারবে না। এখন তুমি আমাদের এই অপবিত্র পৃথিবীর অপবিত্র মেয়ে ও নারী।’

‘আমি নারী নই!’ সে বললো, ‘আমি নব-যৌবনা মেয়ে, খুব সুন্দরী মেয়ে।’ সে কণ্ঠ নামিয়ে বলল, ‘আমি জোরে কথা বলবো না, আমার কথা মনোযোগ সহকারে শুনে নাও। আমি জানি তুমি কে, আর কেন এখানে এসেছো। তুমি আমার কাছে এত বেশী পছন্দনীয় যে, তোমাকে পাওয়ার জন্যই আমাকে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়েছে। তবে আর আপত্তি কেন, আমার সঙ্গেই চলো।’ মেহেদী আল হাসান বললো।

‘না!’ মেয়েটি বললো, ‘বরং তুমিই আমার সঙ্গে চলো। যদি আমি তোমার সাথে যাই তবে আমরা দু’জনই না খেয়ে মরবো। যদি তুমি আমার সঙ্গে আসো, তবে ফেরাউনের সমস্ত গুপ্তধন আমাদের হবে। তোমাকে আর জঙ্গল, পাহাড় ও বিরাণ মরুভূমিতে ছুটে বেড়াতে হবে না। সামান্য বেতনের বিনিময়ে আর গোয়েন্দাগিরী করতে হবে না।’

‘তোমরা এখানে কি করছো?’ মেহেদী জিজ্ঞেস করলো।

“আমরা ফেরাউনের ধন-রত্ন বের করছি। মেয়েটি বললো, ‘আমি অনেক লোকের সঙ্গে এখানে আছি।’

‘তারা সব কোথায়?’ মেহেদী জিজ্ঞেস করলো।

“আমার সঙ্গে চলো, দেখতে পাবে। সকলেই তোমাকে খুশিতে বরণ করে নেবে।’ মেয়েটি বললো, ‘তুমি আমাকে যখন আলোতে দেখতে পাবে, তখন তুমি তোমার দুনিয়ার কথা, তোমার বিত্ত বৈভবের কথা সব ভুলে যাবে।’

মেহেদী আল হাসান মেয়েটির শরীর থেকে এক ধরনের সুগন্ধ পাচ্ছিল। তাতে সে নেশার ঘোর অনুভব করল। সে যখন মেয়েটিকে তার বাহুতে চেপে ধরেছিল, তখনই সে বুঝতে পারল, এই দেহ মানুষের ঈমান নষ্ট করার এক লোভনীয় বস্তু। মেয়েটির মিষ্টি মধুর কণ্ঠস্বরে যে সুধা লুকিয়ে আছে তার মোহ যে কোন পুরুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য যথেষ্ট। তার মাদকতাময় দেহ, নেশা জাগানো ঘ্রাণ সবই বিভ্রান্তির হাতিয়ার।

সেই মুহূর্তেই সুড়ংয়ের মুখে আবার আলো জ্বলে উঠলো। মেহেদী আল হাসান এবার সতর্ক হয়ে গেল। সে মেয়েটিকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করলো না। তার লোকেরা যে সুড়ংয়ের মুখে ও আশেপাশে আছে তা এই আলোই প্রমাণ করে দিল। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এদিকের মুখ দিয়ে সে বের হবে না। কারণ এদিকে মেয়েটির লোকজন অপেক্ষা করছে। সে অন্য পাশ দিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ার তাড়া অনুভব করল।

তখনি তার মনে হল, সেখানেও কি মেয়েটির লোকজন থাকতে পারে না? মেয়েটির সঙ্গী সাথী কয়জন ও কারা কিছুই তার জানা নেই। এ অবস্থায় অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া ছাড়া উপায় কি? সে মেয়েটিকে কর্কশ কন্ঠে হুকুম করল, ‘তোমার এ কাফনের পোষাক খুলে ফেলো।’

মেয়েটি হুকুম তামিল করল। সঙ্গে সঙ্গে সে তার গায়ের ওপর জড়িয়ে রাখা সাদা কাপড়ের চাদরটি খুলে ফেললো। মেহেদী আল হাসান চাদরটি এক টানে ছিড়ে তার এক টুকরো দিয়ে মেয়েটির হাত পিছনে নিয়ে বেঁধে ফেললো। অপর টুকরো দিয়ে তার পা দু’টিও বেঁধে ফেললো। তৃতীয় আরেকটি খণ্ড দিয়ে মুখটি বেঁধে দিল। তারপর তাকে কাঁধে উঠিয়ে গুহা থেকে বাইরে বেবিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।

খঞ্জরটি তার হাতেই ছিল। সে সুড়ংয়ের মুখ পিছনে রেখে মেয়েটিকে নিয়ে ছুটতে লাগলো। উদ্দেশ্য, পেছনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে এখান থেকে সরে পড়া। দ্রুত পালাতে না পারলে মেয়েটির সঙ্গী সাথীরা তাকে ধরে ফেলবে। আর তাদের হাতে একবার ধরা পড়ার মানে হচ্ছে, আগে যে দুই কমাণ্ডার এখানে মারা পড়েছে তাদের ভাগ্য বরণ করা। কিন্তু না, এভাবে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার কোন মানে হয় না। সে প্রাণপণে ছুটতে লাগল।

গত রাতে যখন মেহেদী আল হাসান এখানে এসেছিল তখন প্রেতাত্মার সাথেই সাক্ষাৎ করতে এসেছিল। সুড়ংয়ের মাঝে আলোর ঝিলিকের ভেতর পলকের জন্য সে তাকে দেখতেও পেয়েছিল। পরে সেই নারী অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

মেহেদী যখন সুড়ং পথে দাঁড়িয়ে ছিল তখন সুড়ংয়ের বাইরে সে আলো দেখতে পেয়েছিল। সে সুড়ংয়ের ভেতর দিয়ে ওপাশে যাওয়ার সময় পলকের জন্য একটি ছায়াও দেখেছিল। দিনের বেলা সুড়ংয়ের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করার সময় সে এক টুকরা ফিতা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখল। ফিতাটি দেখেই সে বুঝে নিয়েছিল, এটা মৃতের কাফন বাধার ফিতা।

আলী বিন সুফিয়ানের কাছে সে গোয়েন্দাগিরীর ট্রেনিং পেয়েছে। সামান্য জিনিসও যে অনেক সময় বড় রহস্য উদঘাটন করে ফেলে সে শিক্ষা সে আলী বিন সুফিয়ানের কাছেই পেয়েছিল। ফলে এই সামান্য ফিতা তার কাছে অনেক বড় হয়ে দেখা দিল। তার মনে সন্দেহ সৃষ্টি করল এই ফিতা। তাই আজ রাতে প্রেতাত্মার সাথে সাক্ষাতের জন্য আসার সময় হেকিমের নিষেধ সত্ত্বেও সঙ্গে খঞ্জর নিয়ে এসেছিল। এটা পরীক্ষার এক সুন্দর পদ্ধতি। খঞ্জর থাকা সত্ত্বেও প্রেতাত্মা এসে হাজির হয়েছে। অতএব হেকিমের বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

তাই আজ তার সাহসিকতা প্রদর্শনের দিন। আলো দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৌশলে সুড়ংয়ের ভেতর প্রবেশ করার সময়ই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, আজ সে-প্রেতাত্মার মুখোমুখি হবে।

এই আগুন ও প্রেতাত্মার কাহিনী মেহেদী আল হাসানের মনে অতীতের কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিল। তার মনে পড়ে গেল, ক্রুসেডাররা ঠিক এমনিভাবে মিশরের পাহাড়ী এলাকার মূর্খ লোকদের ধোঁকা দেয়ার জন্য চেষ্টা করেছিল। তারা পাহাড়ের ওপর বড় ধরনের মশাল জ্বালিয়ে তার সামনে কাঠের তক্তা রাখতো, যাতে আলোর উৎস গোপন থাকে।

এরপর তারা চমকপ্রদ ধাতুর পাত ব্যবহার করতো। চকমকি ধাতুর চমক ও আলোর কিরণ সামনের পাহাড়ে গিয়ে পড়তো। মশাল ও চকমকি ধাতুর মাঝখানে অন্য আরেকটি কাঠের তক্তা রাখা হতো। সেটি খাঁড়া করলে জ্যোতি নিভে যেত আর শুইয়ে দিলে আলোর চমক সৃষ্টি হতো। এই মশাল ও চকমকি ধাতুর পাত এমন ভাবে রাখা হতো, যা সহজে লোকদের চোখে পড়ত না।

কিন্তু মিশরে আইয়ুবীর গোয়েন্দাদের হাতে ক্রুসেডারদের এই কেরামতি ধরা পড়ে যায়। তখন তারা সেই পাহাড়ী লোকদের কাছে সব ফাঁস করে দেয়। নইলে সহজ সরল পাহাড়ী লোকেরা ব্যাপারটিকে অলৌকিক ব্যাপার বলেই বিশ্বাস করতো। এই রহস্য উদঘাটন অভিযানে সৌভাগ্যক্রমে মেহেদী আল হাসানও জড়িত ছিল। তাই সে বুঝতে পারল, সুড়ংয়ের ভেতর আলোর নাচন কোন অলৌকিক ব্যাপার নয়, এটা মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটি অপকৌশল মাত্র।

এটা যে ক্রুসেডারদের অপকৌশল তা বুঝতে পেরেছিল বলেই সে মেয়েটিকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। জিজ্ঞেস এর মত হাতে সময়ই বা কোথায়? যে কোন সময় মেয়েটির সঙ্গীরা এসে পড়তে পারে। তখন মেয়েটিকে তো তারা ছিনিয়ে নেবেই, তার নিজের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই মেয়েটিকে আর কিছু জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন মনে করেনি সে। জিজ্ঞেস করলে ভুল ব্যাখ্যা ও বুঝ দিয়ে তাকে ভ্রান্ত পথে নিয়ে যাওয়া ছাড়া মেয়েটি আর কিইবা করতে পারতো!

মেহেদী আল হাসান মেয়েটিকে কাঁধে নিয়ে উল্টো পথে প্রাণপণে ছুটছিল। আলো নিক্ষেপকারীরা সুড়ং মুখে আরও কয়েকবার আলো ফেললো। কিন্তু তখন মেহেদী আল হাসান মেয়েটাকে নিয়ে ছুটছে। মেয়েটির কান্নার আওয়াজ থেমে গিয়েছিল। এটা ছিল এক ধরনের সংকেত ধ্বনি। অর্থাৎ শিকার এখনো জালে ধরা পড়েনি। কিন্তু তার কান্নার আওয়াজ থেমে যেতেই মেহেদী আল হাসানকে একটি ভয় এসে তাড়া করল। সে ভেবে দেখল, মেয়েটির কান্না থেমে যাওয়ায় তার লোকজন ভাববে, শিকার জাপড়েছে। তখন তাকে ধরার জন্য তারা ছুটে আসবে। কিন্তু যেখানে মেয়েটিকে পাওয়ার কথা সেখানে না পেলে তারা চারদিক ছড়িয়ে পড়বে তার তালাশে। আবার এমনও হতে পারে, মেয়েটির কোন সাড়া না পেয়ে তার কি হয়েছে দেখার জন্য ওরা সুড়ংয়ের ভেতর নেমে আসতে পারে।

সে মেয়েটাকে কাঁধে নিয়ে গুহার অপর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। সুড়ংয়ের মুখ থেকে কিছু দূরে গিয়ে সে মেয়েটাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে মাটিতে বসিয়ে দিল। তারপর তার মুখের বাঁধন খুলে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি আমাকে বলবে, আমি কোন দিক দিয়ে গেলে তোমাদের লোকদের সামনে পড়বো না?”

‘যদি তুমি একা যাও তবে বলতে পারি।’

‘তুমি আমার সঙ্গেই যাবে।’ মেহেদী আল হাসান বললো, “দেখো, আমাকে যদি ফাসাতে চেষ্টা করো, তবে আমি তো শেষ হবোই, তোমাকেও জীবিত রাখবো না।’

‘আমি তোমাকে সেই গোপন তথ্য বলে দেব, যে গোপন ভেদ জানার জন্য তুমি আগ্রহী, যদি তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।’

‘কোন শর্ত ছাড়াই আমি যা জানতে চাই তা যদি আমাকে না বলো তাহলে আমাকে সেই পথ ধরতে হবে, যা আমার পছন্দ নয়।’

“তুমি আমাকে শুধু একবার আলোতে দেখে নাও।’ মেয়েটি বললো, ‘আর আমাকে তোমার নিজের মনে করে একবার আমার সাথে চলো; আমি তোমার সাথে কোন প্রতারণা করছি না।’

মেয়েটি মেহেদী আল হাসানকে তার রূপ যৌবন দিয়ে প্রলোভিত করার চেষ্টা করল। তাতেও সুবিধা করতে না পেরে ধন-রত্নের লোভ দেখাল। কিন্তু তাকে কাঁবু করতে পারল না। মেহেদী আল হাসান মেয়েটিকে আর কথা বাড়াবার সুযোগ না দিয়ে আবার তার মুখ বেঁধে দিল। তারপর নিজের বুদ্ধিমত একটা নিরাপদ রাস্তা বেছে নিল। রাস্তাটি পাহাড়ের উপর দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেছে।

সে মেয়েটাকে সেখানেই বসিয়ে রেখে উপরে উঠতে লাগলো। পাহাড়ী লতাপাতা, গাছের ডালের ফাঁক-ফোঁকড় গলে সে মাত্র কয়েক কদম এগিয়েছে, মেয়েটিকে ডাকতে ডাকতে একটি লোক নিচে থেকে উপরে উঠতে শুরু করল। মেহেদী আল হাসান উপরে ওঠা বন্ধ করে ধীরে ধীরে নিচে নামলো এবং মেয়েটির কাছাকাছি এসে এক পাথরের আড়ালে লুকাল।

লোকটি সম্ভবত মেয়েটাকে দেখতে পেয়েছিল। কারণ সে ছিল উন্মুক্ত জায়গায়। লোকটি বলে উঠল, ‘তুমি কথা বলছে না কেন?’

লোকটি প্রশ্ন করছে আর উপরে উঠছে। মেয়েটির মুখ বাঁধা ছিল, তাই সে লোকটির কোন প্রশ্নের জবাব দিতে পারছিল না। অবশেষে লোকটি তার একদম কাছে এসে বসে পড়ল আর বললো, ‘তোমার কি হয়েছে? ওদিকে গেলে না?”

মেহেদী আল হাসান তার পিছনেই ছিল। মাত্র দু’তিন গজ দূরে। সে দ্রুতবেগে উঠে লোকটির পিঠে সজোরে খঞ্জর বসিয়ে দিল। লোকটি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতেই সে খঞ্জর টেনে নিয়ে আবার সজোরে আঘাত করল।

এই দুই আঘাতেই লোকটির ভবলীলা সাঙ্গ হল, সে আর কোন শব্দই করতে পারল না।

মেহেদী আল হাসান তাকে টেনে নিয়ে সেই পাথরের আড়ালে ফেলে দিল। এরপর সে মেয়েটাকে আবার কাঁধে উঠিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠতে লাগলো।

পাহাড়টা তেমন উঁচু ছিল না। উপরের দিকটা ছিল বেশ চওড়া। মেহেদী আল হাসান সেই উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছল। মেয়েটিকে নিয়ে এতটা চড়াই মাড়িয়ে সে একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছিল। তার সারা শরীর দিয়ে সমানে ঘাম ঝরছিল। পানির পিপাসায় মুখ শুকিয়ে এসেছিল। উপত্যকায় পৌঁছে সে থামল। মেয়েটিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে লাগল।

তার জন্য সবচে ভাল হতো যদি বাকী রাতটুকু কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারতো। তারপর দিনের আলোয় একদিকে সরে পড়া তেমন সমস্যা হতো না। কিন্তু এ ঝুঁকি নেয়ার সাহস তার হলো না। সে তাড়াতাড়ি কায়রো পৌঁছতে চাচ্ছিল, যাতে হেকিমকে গ্রেফতার করতে পারে এবং ভোর হওয়ার আগেই এই এলাকাও অবরোধ করে নিতে পারে।