বিষাক্ত ছোবল
আন নাসের ও তার সাথীরা মরুভূমিতে ঘুরতে ঘুরতে প্রখর সূর্যতাপ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও ক্লান্তিতে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিল। মরুভূমির সেই জাহান্নাম থেকে তাদের উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো দুই নারী। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, এটা মরুভূমির তামাশা, এই দুর্গম প্রান্তরে মেয়ে আসবে কোথেকে। পরে মেয়েরা যখন ওদের পানি ও খাবার দিয়ে জীবন্ত করে তুললো, তখন ওরা ভাবলো, এরা মেয়ে নয়, জ্বীন বা পরী হবে।
ছোটবেলা থেকে জ্বীন-পরীদের গল্প শুনতে শুনতে জ্বীন ও পরীর ভয় আন নাসেরের মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। যদিও জীবনে কোনদিন জ্বীনপরী দেখেনি, তবু গল্প শুনতে শুনতে কল্পনায় তাদের যে ছবি খোদাই করা ছিল, এ মেয়েদের দেখে সে কল্পনা যেন বাস্তব হয়ে ধরা দিল। মরুভূমির জাহান্নামে দুই অনিন্দ্যসুন্দর মেয়েকে দেখে সে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, এরাই সে কল্পনার জ্বীন।
মরুভূমিতে ঘুরতে ঘুরতে সে তার সাথীদের নিয়ে শেষ পর্যন্ত জ্বীনের খপ্পরে এসে পড়লো? ভাবনাটা মনে আসতেই এক অজানা ভয় ও শিহরণ ঘিরে ধরলো তাকে।
সেই মেয়েরা পানির সাথে বিশেষ ধরনের নেশা জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে সম্মোহিত করে ওদেরকে এনে তুললো এক দুর্গে। দুর্গে আসার পর এক সময় তাদের নেশার ঘোরে কেটে গেল। আন নাসেরের কাছে এগিয়ে এলো এক মেয়ে। তার প্রশ্নের জবাবে বললো, ‘আমরা জ্বীন-পরী কিছু নই, তোমাদের মতই রক্ত-মাংসের মানুষ।’
আন নাসের চারদিকে তাকিয়ে দেখলো। তার অভিজ্ঞ চোখ বললো, এটা একটা দুর্গ। জ্বীন-পরীদের এমন দুর্গের প্রয়োজন হয় না। মেয়েটি তাহলে সত্যি কথাই বলেছে! এরা জ্বীন-পরী কিছু নয়! তাহলে কি ওরা মেয়েদের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেরাই পায়ে হেঁটে এসে ঢুকে পড়েছে দুশমনের দুর্গে? এতক্ষণে আন নাসের বুঝতে পারলো, সে এবং তার সাথীরা কি ভয়ংকর জালে আটকা পড়েছে।
কি করে এ জাল কেটে বেরিয়ে যাওয়া যায় এ নিয়েই ভাবছিল আন নাসের। তার সাথীরা তখনও ঘুমিয়ে, মেয়েটি আবার ফিরে এলো। বললো, ‘তুমি জানতে চাচ্ছিলে তোমরা এখন কোথায় এবং কেন তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছি। কেন এনেছি এ প্রশ্নের জবাব এখন দেয়া সম্ভব নয়, তবে তোমরা এখন কোথায় তা বলে দিতে পারি।’
আন নাসের উদগ্রীব হয়ে বললো, ‘কোথায়?’
‘এটা একটা কেল্লা।’
‘এটা যে কেল্লা তা তুমি না বললেও জানি। কিন্তু কেল্লাটি কোথায় অবস্থিত, কি এর নাম, এখানে কারা থাকে।’
‘এ কেল্লার নাম আছিয়াত। এটা ফেদাইনদের কেল্লা। এখানে ফেদাইন নেতা শেখ মান্নান বাস করেন। ফেদাইনদের সম্পর্কে তুমি কিছু জানো?’
‘হ্যাঁ জানি!’ আন নাসের উত্তর দিল, ‘খুব ভাল করেই জানি। আর এখন এটাও জানতে পারলাম, তুমি আসলে কে? আমি শুনেছিলাম, ফেদাইনদের দলে সুন্দরী মেয়েরাও কাজ করে। তুমি তাহলে সেই সুন্দরীদের একজন?’
‘আমার সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই।’ মেয়েটি উত্তর দিল, ‘আমার নাম লিজা!’
‘তাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক না থাকলে তোমরা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে কেন? তোমার সাথে তো আরও একটি মেয়ে ছিল, সে কোথায়?’
‘হ্যাঁ! আমার সাথে অন্য যে মেয়েটি ছিল তার নাম কারিশমা। সেও এখানেই আছে।’ লিজা বললো, কেন তোমাদের এখানে এনেছি, সে কথা বলা যাবে না। তবে কেমন করে এনেছি, সেটা বলতে পারি। তোমাদেরকে নেশা খাইয়ে সম্মোহিত করে এখানে এনেছি।’
সে এই পর্যন্ত বলে শেষ করেছে, এমন সময় কামরার দরোজায় এসে দাঁড়ালো কারিশমা। কারিশমা চোখের ইশারায় লিজাকে বাইরে ডাকলো, লিজা বাইরে চলে গেল। আন নাসের খাটে বসে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলো।
তার কাছে এখন অনেক কিছুই পরিষ্কার। মরুভূমির মহা বিস্তারে হারিয়ে যাওয়ার পর যে মেয়েরা তাদের পানি ও খাবার দিয়েছিল, ওরা আসলে জ্বীন নয়, মানুষ। ওরা তাদেরকে নেশাগ্রস্ত করে নিয়ে এসেছে চরম এক সন্ত্রাসী গ্রুপ ফেদাইনদের কেল্লায়। ফেদাইনরা বেশ সুসংগঠিত এবং তাদের সংগঠন আরবের সব কয়টি দেশে বিস্তৃত। ওদের মূল পরিচয় ওরা প্রফেশনাল গুপ্তঘাতক। পয়সার বিনিময়ে ওরা যে কাউকে যে কোন সুরক্ষিত স্থানেও অবলীলায় খুন করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পারে। কে বা কারা লোকটির হত্যাকারী সে হদিস কেউ কোনদিন বের করতে পারে না। এ ধরনের ভয়ংকর খুনীদের আস্তানা বা কেল্লা থেকে বের হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
‘এখানে কি করছো?’ কারিশমা জিজ্ঞেস করলো, ‘লোকটির সাথে এমন ঘনিষ্ট হয়ে বসার সময় তোমার কি একবারও মনে হয়নি, মুসলমানরা ঘৃণার পাত্র! তুমি কি শেষে গাদ্দারী করবে নাকি?’
লিজার মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। চেহারা ভাবলেশহীন, নির্বিকার। মুখে কোন কথা নেই। একদিন আবেগের বশে এবং অন্যের প্ররোচনায় পড়ে মুসলমান নেতাদের চরিত্র হননের যে পেশা গ্রহণ করেছিল, এখন সে কথা মনে হতেই নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মাল।
দিনে দিনে এই জঘন্য পেশার প্রতি তার ঘৃণা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেলো, নিজেকে এই পেশা থেকে সরিয়ে নেয়ার কথা ভাবলো সে। কিন্তু যখন মনে হলো, এ পথে আসা যায়, কিন্তু যাওয়া যায় না, তখন ঘৃণা রূপ নিল প্রতিশোধ স্পৃহায়। কিভাবে নিজের ওপর প্রতিশোধ নেবে, কোন কূল না পেয়ে সে এ পরিবেশ থেকে পালানোর পথ খুঁজতে লাগলো। এ সময়ই ওদের হাতে এসে পড়ে আন নাসেররা।
‘আমিও যুবতী মেয়ে!’ কারিশমা তাকে বললো, ‘আন নাসেরের মত সুদর্শন যুবক, যে কোন যুবতীর হৃদয় দখল করতে পারে। তাকে আমারও ভাল লাগে। সত্যি বলছি, এমন আকর্ষণীয় যুবককে ভাল না বেসে পারা যায় না। যদি তুমি বলো, তাকে তুমি ভালবেসে ফেলেছে, তাতে আমি আশ্চর্য হবে না। আমি বুঝতে পারছি, বুড়ো মুসলিম আমীর ও সেনাপতিদের বিরুদ্ধে তোমার মনে ঘৃণা জমে উঠেছে। কিন্তু তোমার দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা মনে করো, স্মরণ করো তোমার শপথের কথা, এই মুসলমানরা তোমার শত্রু। এদের অনিষ্ট করার শপথ নিয়েছে তুমি।’
‘না! তা নয় কারিশমা!’ লিজা অধীর হয়ে বললো, ‘আমার সঙ্গে তার তেমন কোন ভাব হয়নি, যে জন্য তুমি আমাকে তিরস্কার করতে পারো।’
‘তবে তার কাছে কেন এসেছে, কেন তার সাথে ঘনিষ্টভাবে মিশছো?’
‘আমি এখন সে বর্ণনা দিতে পারবো না।’ লিজা বিরক্ত কঠে বললো, ‘জানি না আমার মাথায় হঠাৎ এমন খেয়াল কেন এলো, কেন তার পাশে গিয়ে বসতে ইচ্ছে জাগলো মনে।’
‘তার সাথে কি কি কথা হয়েছে তোমার?’
‘তেমন কোন বিশেষ কথা হয়নি।’ লিজা বললো।
‘তুমি তোমার দায়িত্ব পালনে খুব অবহেলা করছে। কারিশমা বিরক্তি প্রকাশ করে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো, ‘এটা বিশ্বাসঘাতকতা। তুমি জাননা বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কি?‘
‘জানি। মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু কারিশমা, তুমি শুনে রাখো!’ লিজা বললো, “আমি ঐ বুড়োর খায়েশের খেলনা হবো না। ফেদাইনদের নেতা বলে শেখ মান্নান তোমার কাছে যত গুরুত্বপূর্ণই হোক, আমার কাছে সে একজন খুনী ও সন্ত্রাসী মাত্র। যদি সে আমার ওপর শক্তি প্রয়োগ করে তবে আমি তাকে খুন করবো। নয়তো নিজেই শেষ হয়ে যাবো।’
কারিশমা এ কথা শুনে একদম পাথর হয়ে গেল। আসলে সে উজ্জ্বল পাথরই ছিল, যার রং ও উজ্জ্বলতা সবাইকে আকৃষ্ট করে। সবাই তাকে আপন করে পেতে চায়। কিন্তু পাথরের তো কোন পছন্দ অপছন্দ নেই। কিন্তু লিজা ততদূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারেনি। নারীর সহজাত কামনা-বাসনা, ভাললাগা-ভালবাসা থেকে এখনো নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারেনি।
কারিশমা তাকে বললো, ‘আমি কল্পনাও করতে পারিনি, তুমি এত বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে উঠবে। বুঝলে তোমাকে আমি এখানে আনতাম না।’
“আমি কি তোমার পায়ে পড়েছিলাম যে, আমাকে ওখানে নিয়ে চলো!’ শ্লেষ মেশানো কণ্ঠে বললো লিজা।
রাগ করলো না কারিশমা। বললো, ‘এ কোল্লাটাই সবচে কাছে ছিল, তাই প্রথম মঞ্জিল হিসাবে এখানে এসেছি। নয়তো এক টানে ত্রিপলী পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব ছিল না আমাদের পক্ষে। তা ছাড়া আমাদের মত দুই নারীর পক্ষে চারজন কমান্ডোকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সামাল দেয়ার ঝুঁকিও আমি নিতে চাচ্ছিলাম না।’
‘ কিন্তু আমাকে এক হিংস্র পশুর হাতে তুলে দেয়ার ঝুঁকি তো ঠিকই নিতে পারলে।’ লিজার ক্ষুদ্ধ কণ্ঠ।
কারিশমা দরদভরা কণ্ঠে বললো, ‘তোমার কাছে অঙ্গীকার করছি, শেখ মান্নানের কবল থেকে তোমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করবো।’
‘তাহলে এখান থেকে জলদি পালিয়ে যাওয়ার একটা উপায় বের করে।’
‘সে চেষ্টা আমি করছি, কিন্তু মহাপ্রভুর দোহাই, তুমি আমাকে কথা দাও, বন্দীদের সাথে তুমি আর কোন রকম দহরম মহরম করবে না।’
‘সত্যি কথা বলবো কারিশমা!’ লিজা বললো, ‘আমি এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই কমাণ্ডোদের সাহায্য নেবো। কারণ শেখ মানের সাথে আমি যে ব্যবহার করেছি, তাতে আমি নিশ্চিত, সে আমাদের এখান থেকে বেরোতে দেবে না। না তুমি নিজে বের হতে পারবে, না আমাকে বের করতে পারবে। কিন্তু এরা দক্ষ কমাণ্ডো, এদের বীরত্বের অনেক বিশ্বয়কর গল্প-কাহিনী লোক মুখে প্রচলিত। এদের সামান্য সুযোগ দিলেই এরা পালিয়ে যেতে পারবে। চাই কি সে সহযোগিতার বিনিময়ে তোমাকে-আমাকেও সঙ্গে নিতে রাজি হবে। এ ছাড়া আর কোন পথ নেই।’
‘আমি এদের বীরত্ব ও সাহসের প্রশংসা করি। স্বীকার করি এরা কুশলীও। তোমার কথাই ঠিক, সুযোগ পেলে ওরা পালিয়ে যেতে পারবে।’ কারিশমা বললো, ‘কিন্তু তুমি কি চিন্তা করে দেখেছো, এরা আমাদের দু’জনকে বের করে নিয়ে যেতে পারলে আমাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করবে? তুমি কি মনে করে তারা আমাদেরকে আমাদের ঠিকানায় পৌঁছে দেবে নিশ্চয়ই তারা তা করবে না, তারা আমাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। আমার কথা শোনো! মিথ্যা আশ্রয় খুঁজতে চেষ্টা করো না।
কারিশমা থামলো। লিজাও চুপ। কারো মুখে কোন কথা নেই। কারিশমার কথাগুলো নিয়ে ভাবছে লিজা। এক সময় কারিশমাই পূনরায় মুখ খুললো। বললো, গোসল করে পোশাক পাল্টে নাও। আজ রাতে শেখ মান্নানের খাস কামরায় খাওয়ার দাওয়াত রয়েছে। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, তার সাথে তোমার ব্যবহার ও আদব-কায়দা কেমন হবে। তুমি তাকে অপছন্দ করো এমন মনোভাব যেন তার সামনে বিন্দুমাত্র প্রকাশ না পায়। এটাও যেন প্রকাশ না পায়, তুমি তার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি এইমাত্র খবর পেলাম, হারানের গভর্ণর গুমাস্তগীন এখানে এসেছে।
তুমি তো ভাল করেই জানো, গুমাস্তগীন সুলতান আইয়ুবীয় ঘোরতর দুশমন। ফলে তাকেও আমরা আমাদের উৎকৃষ্ট বন্ধু মনে করি। আমরা খুব কষ্ট করে এই মুসলমান শাসকদের হাত করেছি, তাদেরকে বন্ধু বানিয়েছি। এরা সবাই আমাদের অগ্রযাত্রার একমাত্র প্রতিবন্ধক সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়ছে। ফলে এমন কোন আচরণ করো না, যাতে তারা অসন্তুষ্ট হতে পারে।
❀ ❀ ❀
কারিশমার ডাকে লিজা বেরিয়ে যেতেই আন নাসের গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। তার মনের সন্দেহ দূর হয়ে গেছে। এরা যে জ্বীন-পরী কিছু নয়, আসলেই রক্ত মাংসের মানুষ, এ কথাটা বুঝতে এতো দেরী হলো কেন, তাই ভেবে আফসোস হলো তার।
এদিকে লিজার আচরণও তাকে অধীর করে তুললো। লিজা বলেছে, নেশাগ্রস্ত করে তাদেরকে এখানে আনা হয়েছে। আন নাসের অনুভব করলো, তার এ কথায় সত্যতা আছে। কারণ মরুভূমির সব কথাই তার মনে আছে, কিন্তু ওদের সাথে সাক্ষাতের পর থেকে যা ঘটেছে তার সব স্মৃতি স্পষ্ট নয়। যদি তাই হয় তাহলে ওরা তার দুশমন। কিন্তু দুশমন হলে মেয়েটি তার প্রতি সদয় হবে কেন?
অনেক ভেবেও এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর পেলো না আন নাসের। লিজা তাকে আরও বলেছে, আন নাসের ও তার সাথীরা এখন ফেদাইন গ্রুপের হাতে। অথচ মেয়েটি নিজে ফেদাইন নয়, তাহলে সে কে? ফেদাইন না হয়েও কেন তবে তারা ফেদাইনদের আস্তানায় এসে উঠেছে।
সে ভাবলো, অস্বীকার করলেও এই মেয়ে দুটি কি ফেদাইন দলেরই কর্মী হতে পারে না। কারণ ফেদাইনরাই মেয়ে ও নেশা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চেষ্টা করে। ফেদাইনদের হাতে আছে হরেক রকম নেশা জাতীয় দ্রব। এত বিচিত্র নেশার দ্রব্য আর কারো কাছে নেই। কমাণ্ডো ট্রেনিংয়ের সময় ফেদাইনদের নেশা জাতীয় দ্রব্য সম্পর্কে তাদেরকে বিস্তারিত জানানো হয়েছে এবং এই নেশা থেকে বেঁচে থাকার জন্য তাদেরকে বিশেষ ভাবে সাবধান করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কি লাভ হলো সেই সাবধান বাণীতে এই সুন্দরী মেয়েরা তো সেই নেশার অস্ত্র দিয়েই তাদের ঘায়েল করে এখানে নিয়ে এর সে তার সঙ্গীদেরকে জাগালো। তারাও জেগে উঠে দুর্গের এক কামরায় নিজেদের আবিষ্কার করে আন নাসেরের মতই বিস্মিত হলো। বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে ওরা আন নাসেরের মুখের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো।
‘বন্ধুগণ!’ আন নাসের তাদের বললো, ‘আমরা ফেদাইনদের জালে আটকা পড়ে গেছি। এই কেল্লার নাম আছিয়াত কেল্লা। এটা ফেদাইনদের হেডকোয়ার্টার। ফেদাইন নেতা শেখ মান্নানও এখানেই থাকেন।
যে মেয়ে দুটি আমাদের ধরে এনেছে তারা জ্বীন-পরী নয়, আমাদের মতই মানুষ। আমি এখনও বলতে পারছি না, এরা আমাদের সাথে কি ব্যবহার করবে। তবে আমরা সাবধান ও সতর্ক না হলে আমাদের পরিণতি হবে ভয়ংকর।’
আন নাসের সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে আরো বললো, ‘তোমরা সবাই জানো, ফেদাইনরা গুপ্তঘাতক। এ জন্য তারা সুহেকসহ নানা রকম বিদ্যা প্রয়োগ করে থাকে। তাদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে যাওয়া সোজা ব্যাপার নয়। যদি আমরা কখনো এই কামরা থেকে বাইরে যাওয়ার সুযোগ পাই, তবে আমাদের প্রথম কাজ হবে এ কেল্লা থেকে পালানোর কৌশল বের করা। আপাতত তোমরা এ নিয়ে কোন কথা বলবে না, সবাই নীরব থাকবে। যদি এরা কিছু জিজ্ঞেস করে তবে সংক্ষেপে উত্তর দেবে। মনে রেখো, এই শয়তানদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়।’
‘এরা কি আমাদের কারাগারে পাঠাবে?’ আন নাসেরের এক সাথী প্রশ্ন করলো।
‘যদি কারাগারে পাঠায় তবে আমাদের খুশী হওয়ারই কথা।’ আন নাসের বললো, ‘কিন্তু এরা আমাদের মন-মগজে নতুন চিন্তা ঢুকাতে চায়। হাশিশ ও নেশা জাতীয় দ্রব্য দিয়ে আমাদের বিবেক ও বুদ্ধি গুলিয়ে দিতে চায়। সুন্দরী মেয়ে দিয়ে আমাদের চিন্তা-চেতনায় ভোগের স্পৃহা জাগাতে চায়। ভুলিয়ে দিতে চায় আমাদের ধর্ম ও ঈমান।
‘পালানো ছাড়া আমাদের মুক্তির আর কোন পথ নেই।’ আন নাসেরের এক সাথী বললো।
‘পালাতে না পারলে আমরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবো, কিন্তু ঈমান হারাতে পারবো না।’ অন্য একজন বললো।
‘হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমাদের খুবই সাবধান থাকতে হবে।’ আন নাসের বললো, “ওদেরকে আর নেশা খাওয়ানোর সুযোগ দেয়া যাবে না। আল্লাহর ওপর ভরসা করে পালানো, লড়াই অথবা মৃত্যু- এর যে কোন একটা বেছে নেবো আমরা, কিন্তু কিছুতেই তাদের মুঠোর ভিতর ঢুকবো না।’
সারাদিন কেটে গেল। উল্লেখযোগ্য তেমন আর কিছু ঘটলো না সারাদিন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। পশ্চিম দিগন্তে হারিয়ে গেল সূর্য।
সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসতেই এক লোক কামরার মধ্যে বাতি দিয়ে গেল। সে কারো সঙ্গে কোন কথা বলল না। প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছিল তাদের। সারাদিন তাদের কিছুই খেতে দেয়নি। তারা ভেবেছিল, বাতি যখন দিয়েছে, আবারও পাঠাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হলো না। বাইরে থেকে সেই যে কামরা বন্ধ করে চলে গেলো লোকটি, তারপর থেকে আর কোন লোকের দেখা নেই।
একটু দূরে কেল্লার মধ্যে শেখ মান্নানের মহল সাজানো হয়েছে। গুমাস্তগীনের সম্মানে বাড়তি আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরা কামরার মধ্যে বসে শুনতে পাচ্ছিল নারী ও পুরুষের সম্মিলিত কলকাকলি। সেখানে উৎসব চলছিল। সমবেত অফিসারদের মধ্যে পরিবেশন করা হচ্ছিল খাবার ও মদ। উৎসব হলের পাশেই শেখ মান্নানের খাস কামরা। ওখানেও খাবার পরিবেশন করা হলো। দামী মদের বোতল সাজিয়ে রাখা হলো টেবিলে। বিভিন্ন ধরনের খাবারের সুগন্ধে কামরার পরিবেশ মাতোয়ারা।
আহার্য সামগ্রী সামনে নিয়ে বসে আছে শেখ মান্নান। তার ডাইনে কারিশমা ও বামে লিজা। সামনে গুমাস্তগীন। শেখ মান্নান গুমাস্তগীনকে বললো, “নিন, খাওয়া শুরু করুন।’
ওরা খাওয়া শুরু করলো। চার কমাণ্ডো তাদের কামরায় বসে সুস্বাদু খাবারের সুবাস পাচ্ছিল। এতে তাদের ক্ষুধা আরো বেড়ে গেল।
হারান দুর্গের অধিপতি গুমাস্তগীন সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর ওফাতের পর নিজেকে স্বাধীন শাসক রূপে ঘোষণা করে আশপাশের অঞ্চল নিয়ে একটি রাজ্য গঠন করেছিল। সেই সুবাদে সে বিশেষ সম্মানিত মেহমান ছিল শেখ মান্নানের।
খেতে খেতে গুমাস্তগীন শেখ মান্নানকে বললো, ‘তুমি জানো সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে আল মালেকুস সালেহ ও সাইফুদ্দিনের যে সম্মিলিত বাহিনী তুর্কমান অভিমুখে যাত্রা করেছিল, সে বাহিনীতে আমার সৈন্যও শামিল ছিল। এই সম্মিলিত বাহিনী সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছে। আমি নিজে আমার সৈন্যদের সাথে ময়দানে যেতে পারিনি।’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘সম্মিলিত বাহিনীর কমাণ্ড একক হাতে না থাকলে যুদ্ধে বিশৃংখলা দেখা দেবে, তাই আমি যাইনি। ভেবেছিলাম সাইফুদ্দিন এ যুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিতে পারবে। কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল তো জানো। এ যুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হয়েছে।’
‘হ্যাঁ, বড়ই আফসোসের কথা। এমনটি আমরা আশা করিনি। যুদ্ধের কমান্ড আপনার হাতে থাকলে হয়তো এমনটি হতো না।’ গুমাস্তগীন বললো, আমি নিজেদের মধ্যে ফাটল ধরানোর জন্য তার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে চাই না। কিন্তু যুদ্ধ জয়ের জন্য যেসব কৌশল ও টেকনিক ব্যবহার করা দরকার ছিল, তা তিনি করতে পারেননি। এ যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রথম যে কাজটি করা দরকার ছিল, তা হলো খৃস্টানদেরকে ময়দানে টেনে আনা। তিনি খৃষ্টানদের সাথে বন্ধুত্ব অটুট রাখার দাবী করলেও তাদের কাছ থেকে কোন রকম সামরিক সাহায্য আদায় করতে পারেননি।’
‘হ্যাঁ, এটা তার বড় ব্যর্থতা।’
“সে তাদের উপদেষ্টা ও গোয়েন্দাদের সাহায্য নেয়ার পরিবর্তে উন্নত মানের মদ, সুন্দরী মেয়ে ও নগদ মূল্য নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু যুদ্ধ করার জন্য দরকার অস্ত্র ও সেনা, এ দুটোই সে চায়নি ওদের কাছে।’
গুমাস্তগীন ছিল কূটবুদ্ধিসম্পন্ন ও ষড়যন্ত্রে ওস্তাদ। শত্রুরা মাটির নিচে লুকিয়েও রেহাই পেতো না তার হাত থেকে। বন্ধুদেরকেও সে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিত না। সে ছিল চরম ক্ষমতালিপ্সু। ছলে বলে কৌশলে রাজ্যের পরিধি বাড়ানোই ছিল তার একমাত্র স্বপ্ন।
আইয়ুবীকে সম্মুখ সমরে হারানো যাবে না জানতো বলেই সে নিজে এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। আবার সম্মিলিত শক্তি যাতে বুঝে সে তাদেরই একজন, এ জন্য পরাজিত হবে জেনেও নিজের বাহিনী পাঠিয়েছিল সে অভিযানে।
গুমাস্তগীন তার ক্ষমতার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক মনে করতো সুলতান আইয়ুবীকে। ফলে সে ছিল সুলতান আইয়ুবীর সবচে কঠিন দুশমন। সম্মুখ যুদ্ধ নয়, গুমাস্তগীন বিশ্বাস করতো আইয়ুবীকে ধ্বংস করতে হবে ষড়যন্ত্রের পিচ্ছিল পথে। গোপনে তাকে হত্যা করতে হবে। আর এ কাজে ওস্তাদ শেখ মান্নানের ফেদাইন গুপ্তঘাতক দল। তাই যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে সে এসেছিল শেখ মান্নানকে ভাড়া করতে, তাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করতে।
শেখ মান্নানও সুলতান আইয়ুবীর হত্যার ষড়যন্ত্রে খুবই উৎসাহী ছিল। তার ভাল মতোই জানা ছিল, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীই একমাত্র ব্যক্তি, যার সামরিক শক্তি ঈমানী চেতনায় পরিপূর্ণ। সমরনায়ক হিসাবে যেমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী আইয়ুবী, ঈমানী বলেও তেমনি অতুলনীয়। এ ধরনের লোকের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে যাওয়া যেমন বিপদজনক, তেমনি এমন লোককে বাঁচিয়ে রাখাও ভয়ের। কারণ অন্যায় আধিপত্য বিস্তার আইয়ুবী কিছুতেই মেনে নেবে না।
ফলে তুমানের সমর শেষ হওয়ার আগেই মুসলিম মিল্লাতের দুই গাদ্দার এসে মিলিত হলো একত্রে। আইয়ুবী যখন তলোয়ার দিয়ে লিখছিল নিজের ভাগ্যের ফয়সালা, তখন শেখ মান্নান ও গুমাস্তগীন আছিয়াত কেল্লায় বসে তার ভাগ্য নির্ধারণের জল্পনা কল্পনা করছিল।
সুলতান আইয়ুবীকে হত্যার এমন কৌশল আবিষ্কার করাই তাদের এ বৈঠকের উদ্দেশ্য, যেন অন্যান্য বারের মত এবারের হত্যা প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়।
গুমাস্তগীন আছিয়াত দুর্গে পৌঁছে ছিল কারিশমা ও আন নাসেররা পৌঁছার একদিন আগে। তখনো সে জানতো না, সাইফুদ্দিনের নেতৃত্বে সম্মিলিত বাহিনী সুলতান আইয়ুবীর কাছে কেমন মার খেয়েছে। সৈন্যবাহিনীকে সমরাঙ্গণে পাঠিয়ে দিয়েই সে নেমে পড়েছিল ষড়যন্ত্রমূলক কাজে। আর এ কাজ শেখ মান্নানকে ছাড়া অসম্ভব ভেবেই ছুটে এসেছিল আছিয়াত দুর্গে।
❀ ❀ ❀
‘ভাই গুমাস্তগীন!’ শেখ মান্নান খাওয়া বন্ধ করে বললো, ‘তোমার বাহিনীও তো তুর্কমান সমরাঙ্গণ থেকে পালিয়েছে। তুমি শুধু শুনেছ সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয়েছে, কিন্তু তাদের কি হাল হয়েছে বিস্তারিত জানো না। এ জন্যই এদেরকে এখানে ডেকেছি। সে কারিশমা ও লিজাকে দেখিয়ে বললো, এরা যুদ্ধের সময় ময়দানে ছিল। সব কিছু নিজ চোখে দেখেছে। আগে ওদের কাছ থেকে যুদ্ধের বিস্তারিত খবর শোন।’
গুমাস্তগীন তাকালো কারিশমাদের দিকে। কারিশমা গুমাস্তগীনের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো যুদ্ধের কাহিনী। কি করে সুলতান আইয়ুবী অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সম্মিলিত সৈন্যদলকে পরাজিত করে তাক লাগিয়ে দিল। কি করে সাইফুদ্দিন নিজের সৈন্যদেরকে ময়দানে রেখেই গোপনে পালিয়ে গেল, সবিস্তারে বললো সে।
গুমাস্তগীন নীরবে শুনলে তার কাহিনী। ‘আমাকে আমার বন্ধুরাই লাঞ্ছিত ও অপমানিত করলো।’ গুমাস্তগীন লজ্জায় ও রাগে বলতে লাগলো, “আমি সাইফুদ্দিনকে তিন বাহিনীর হেড অব দ্যা কমাণ্ড করতে মোটেই রাজি ছিলাম। কিন্তু আমার কথা কেউ শুনলো না, জানি না আমার সৈন্যরা কি অবস্থায় আছে।’
‘খুবই শোচনীয় অবস্থায় আছে।’ কারিশমা বললো, ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কমাণ্ডো বাহিনী পলাতক সৈন্যদের নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরতে দিচ্ছে না। ধাওয়া করে পাকড়াও করছে তাদের।’
‘ ভাই মান্নান! তুমি জানো আমি এখানে কেন এসেছি।’ গুমাস্তগীন বললো।
‘হ্যাঁ, জানি আপনি সুলতান সালাহউদ্দিনের হত্যার পরিকল্পনা করতে এসেছেন।’ শেখ মান্নান বললো।
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো।’ গুমাস্তগীন বললো, ‘এর বিনিময়ে তুমি যা চাইবে তাই আমি দিতে রাজি! সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করো ভাই!’
‘আমি খৃষ্টান ও সাইফুদ্দিনের অনুরোধে চারজন ফেদাইন খুনীকে আপনি আসার আগেই এ কাজে পাঠিয়ে দিয়েছি।’ শেখ মান্নান বললো, ‘কিন্তু তাকে হত্যা করা খুবই কঠিন। বার বার চেষ্টা করেও আমরা সফল হতে পারিনি। এবারও যে পারবো তার কোন নিশ্চয়তা এ মুহূর্তে আমি আপনাকে দিতে পারবো না।’
‘আমার কাছ থেকে পৃথক ভাবে বখশিশ নাও।’ শুমাস্তগীন বললো, ‘নতুন লোক দাও, যারা এ কাজে দক্ষ। আর তাদেরকে আমার অধীনে দাও, যেন আমি সরাসরি তাদের পরিচালনা কতে পারি।’
‘আমি যে চারজন খুনী পাঠিয়েছি, তারা আমার বাছাই করা চার খুনী।’ শেখ মান্নান বললো, ‘আমার কাছে খুনী গ্রুপের অভাব নেই। কিন্তু আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে হত্যার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে উঠেছি অন্য কারণে।’
‘কেন?’ গুমাস্তগীন বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আইয়ুবী কি তোমাকে কোন কেল্লা টেক্কা দিয়ে দিল নাকি?’
‘না!’ শেখ মান্নান উত্তর দিল, ‘কিন্তু ঐ ব্যক্তিকে খুন করার জন্য আমি আমার বহু মূল্যবান ফেদাইন খুনী শেষ করে ফেলেছি। আমার পাঠানো ঘাতকরা তাকে ঘুমন্ত অবস্থায়, খঞ্জরের আক্রমণ চালিয়েছে, কিন্তু দেখা গেছে, আইয়ুবী নয়, সে নিজেই নিহত হয়ে গেছে। তার ওপর আমার দক্ষ তীরন্দাজরা তীর বর্ষণ করেছে, কিন্তু সে তীর তাকে স্পর্শও করতে পারেনি। আমার কেন যেন মনে হয়, সুলতান আইয়ুবীর ওপর আল্লাহর রহমতের ছায়া আছে। তার মধ্যে এমন কিছু আছে, যে শক্তির বলে তিনি খঞ্জর ও তীরের আঘাত থেকে রক্ষা পেয়ে যান। আমার গোয়েন্দারা বলেছে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ওপর যতবার আক্রমণ চালানো হয়েছে, ততবারই তিনি সে আক্রমণ ব্যর্থ করে দিয়েছেন অলৌকিকভাবে। আক্রমণ হলে তিনি ভীত বা রাগান্বিত হতেন না। আক্রমণ প্রতিহত করে এমনভাবে হাসতেন, যেন কিছুই হয়নি।’
‘ভাই মান্নান, রাখো তো এসব প্যাঁচাল। আগে বলল, কতো চাও?’ গুমাস্তগীন বিরক্ত হয়ে বললো, ‘আমি সুলতান আইয়ুবীকে আর জীবিত দেখতে চাই না। আনাড়ী খুনীদের ব্যর্থতার কাহিনী বাদ দিয়ে কাজের কথায় আসো।’
‘আনাড়ী নয়, আমি যাদের পাঠিয়েছিলাম, তারা প্রত্যেকেই এ কাজে ওস্তাদ ছিল।’ শেখ মান্নান বললো, ‘আইয়ুবী ছাড়া তাদের হাত থেকে কেউ কোনদিন বাঁচতে পারেনি। তারা মৃত্যুকে ভয় করার মত লোক ছিল না। আমার কাছে এখনও এমন ওস্তাদ লোক রয়েছে, যারা বহু গুপ্তহত্যার নায়ক। তারা এমন কৌশলে হত্যাকাণ্ড চালায় যে, কাকপক্ষীও টের পায় না। কিন্তু ভাই গুমাস্তগীন, আমি আমার এত মূল্যবান ফেদাইনদের আর এমনভাবে বৃথা নষ্ট করতে পারবো না। তোমরা তিন বাহিনীর সম্মিলিত শক্তি নিয়েও তার কিছু করতে পারলে না, আর আমার মাত্র তিন-চারজন ফেদাইনকে দিয়ে কেমন করে তাকে হত্যা করাতে চাও?’
‘বুঝেছি, তুমি আইয়ুবীর শক্তি দেখে ভয় পেয়ে গেছ।’
‘না! আমি ভয় পাইনি। সুলতান আইয়ুবীর সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই।’ শেখ মান্নান বললো, ‘হাসান বিন সাব্বাহ পয়গাম্বর হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর আমাদের এই দল পেশাদার খুনী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। বুঝলে ভাই গুমাস্তগীন! আমি এখন একটি পেশাদার খুনীচক্রের নেতা! প্রশ্নটা ভয়ের নয়, প্রশ্নটা পেশার। এখন যদি সুলতান আইয়ুবী আমাকে টাকা দিয়ে বলে তোমাকে হত্যা করতে, তবে আমি তোমাকেও হত্যা করতে পারবো।’
‘কিন্তু সালাহউদ্দিন আইবী কাউকে কাপুরুষের মত টাকা দিয়ে হত্যা করান না।’ লিজা বললো, ‘সেই কারণেই তিনি কাপুরুষদের আঘাতে ও ষড়যন্ত্রে মৃত্যবরণ করছেন না।’
‘বাহ! তুমি এই বয়সেই বুঝতে শিখেছো যে, যে কাপুরুষ নয়, তাকে কাপুরুষরা হত্যা করতে পারে না!’ শেখ মান্নান তাকে কাছে টেনে নিয়ে আদরের ছলে বললো।
গুমাস্তগীন আশাহত হয়ে শুম মেরে বসে রইলো। শেষ মান্নান তাকে বললো, ‘ভাই গুমাস্তগীন, তুমি, সাইফুদ্দিন ও আল মালেকুস সালেহ এবং খৃষ্টানরা শুধু এই কারণে পরস্পর বন্ধু সেজে রয়েছে যে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তোমাদের সবারই শত্রু! নতুবা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে কোন বন্ধুত্বের বন্ধন নেই। আহা, আমাকে বলো তো, আইয়ুবীকে হত্যা করে তোমরা কি লাভ করতে চাও? তিনি মারা গেলে তখন তো তোমরা নিজেরাই মারামারি করে মরবে।’
গুমাস্তগীন চুপ। সে এসব প্রশ্নের কোনই জবাব দিল না। শেখ মান্নান আবার বললো, “ভাই গুমাস্তগীন! খুব মনোযোগ সহকারে আমার কথা শুনে নাও! আইয়ুবীকে হত্যা করতে পারলেও তোমরা নতুন করে এই সাম্রাজ্যের এক ইঞ্চি জায়গাও দখলে নিতে পারবে না। এ সাম্রাজ্য এখনো আইয়ুবীই ধরে রেখেছেন। তিনি তার সৈনিকদের মধ্যে যে জাতীয় চেতনা ও জেহাদী জযবা সৃষ্টি করে রেখেছেন, সে কারণেই এখনো খৃস্টানরা এখানে দাঁত বসাতে পারছে না। তুমি যদি কাউকে হত্যা করতেই চাও, তবে সাইফুদ্দিনকে টার্গেট নাও। সাইফুদ্দিনকে হত্যা করে মুশেলের ওপর তোমার আধিপত্য কায়েম করো। অবশ্য তাকে তুমি নিজেই হত্যা করতে পারবে, এ জন্য আমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই। সে তোমাকে বন্ধু হিসেবে জানে এবং তোমরা উভয়েই মিত্র বাহিনীর সদস্য। তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে পারো অথবা সুযোগমত আক্রমণ করেও হত্যা করতে পারো।’
শেখ মান্নানের দীর্ঘ বক্তব্য শেষ হলো। গুমাস্তগীন গভীর চিন্তায় ডুবে রইলো এ বক্তব্য শুনে। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বললো, ‘হ্যাঁ, তুমি সাইফুদ্দিনকেই হত্যা করার ব্যবস্থা করো। বলো, এর বিনিময়ে তুমি কি চাও?’
‘তোমার সখের হারান দুর্গ!’ শেখ মান্নান বললো।
‘তোমার মাথাটা তো ঠিক আছে, মান্নান!’ গুমাস্তগীন বললো, ‘ইয়ার্কী রাখো। হীরা, জহরত, অর্থ, সম্পদ ও বিত্ত দিয়ে তোমার মূল্য চাও।’
‘ধন-রত্নের বিনিময়ে তোমাকে চারজন লোক দিতে পারি।’ শেখ মান্নান বললো, ‘কিন্তু এরা আমার গুপ্ত বাহিনীর সদস্য নয়। ওরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর স্পেশাল কমাতো। তাদেরকে এই দুই মেয়ে হাশিশ পান করিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। আমার কাছে এরা খুবই মূল্যবান সম্পদ। আমি এদেরকে অন্য কারো হাতে ছেড়ে দেয়ার কথা কখনো চিন্তাও করিনি, কারণ এমন যোগ্য ও দক্ষ কমাণ্ডো কোথাও পাওয়া যায় না। কপাল গুণে ওদের পেয়ে গেছি আমি। তুমি তো জানো, ফেদাইনদের হরেক রকম নেশার দ্রব্য ও সম্মোহন বিদ্যা যে কোন মানুষকে আমূল বদলে দিতে পারে। এই পরীরা তাদেরকে হাশিশের নেশায়; তাদের রূপ-যৌবনের নেশায়, এমন যোগ্য বানিয়ে নিবে যে, এরা শেষ পর্যন্ত আপন বাবা-মাকেও হত্যা করতে পিছপা হবে না।
এই সম্পদ আমি হাত ছাড়া করতাম না, কিন্তু আমি তোমাকে নিরাশ করতে চাই না। তুমি কষ্ট করে এবং বড় আশা নিয়ে আমার কাছে এসেছে, এ জন্যই আমি এদেরকে তোমার হাতে তুলে দিতে রাজি হলাম। তুমি ওদের নিয়ে যাও, কিছু দিন এদেরকে আমার পরীদের দিয়ে স্বপ্নের জান্নাত দেখাও। তাদেরকে তোমার মহলের রাজকুমার বানিয়ে নাও। গোপনে মাত্রানুযায়ী হাশিশ পান করাও এবং কায়দা করে মদের মধ্যে ডুবিয়ে দাও, দেখবে তোমার ইশারায় ওরা নাচবে।’
‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কমাণ্ডোরা এত কচি খোকা নয়, যেমন তুমি বুঝাতে চাচ্ছে।’ গুমাস্তগীন বললো।
‘তুমি তো জানো গুমাস্তগীন, আমাদেরকে ফেদাইন বলা হয়। আমরা মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে খেলা করি।’ শেখ মান্নান বললো, ‘আমরা আমাদের শিকারকে মনভোলানো স্বপ্নের রাজ্যে নিয়ে যাই। সম্মোহিত করে তাদেরকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাই যে, তার সামনে যা বলা হয় তাকেই সে বাস্তব মনে করে নেয়। তার সামনে নারীর সুন্দর ছবি একে বলো, এ হচ্ছে বেহেশতের হুর, সে তাই বিশ্বাস করবে। হাতে পাথর দিয়ে বলো, এ হচ্ছে স্বর্ণের টুকরো, সে তার হাতে স্বর্ণের টুকরোই দেখতে পাবে। তাকে নারীর বাহুলগ্ন করে দাও, খুব কম মূল্যে তার ঈমান ও বিশ্বাস কিনতে পারবে।’
শেখ মান্নান তাকে আরো বললো, ‘তুমি এই চারজনকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। একথা মনে করার কোন কারণ নেই যে, এরা তোমার উদ্দেশ্য সফল করতে পারবে না।’ শেখ মান্নান একটু হেসে বললো, ‘তুমি তোমার নিজেকে নিয়েই চিন্তা করো। নারী, মদ ও বিলাসিতা তোমাকে কোথা থেকে কোথায় নামিয়ে নিয়ে এসেছে তুমি মুসলমান হয়েও মুসলমানের শত্রু হয়ে গিয়েছে।’
দরদাম ঠিক করে শেখ মান্নান, আন নাসের ও তার সঙ্গীদেরকে তুলে দিল শুমাস্তগীনের হাতে। বললো, ‘এদেরকে কারাগারে রেখে না বরং রাজপুত্রের মত রাখবে।’
গুমাস্তগীন তার পরামর্শ মেনে নিল। খাওয়া দাওয়ার পর এই বলে বিদায় নিল, দু’একদিনের মধ্যেই কমাণ্ডোদের নিয়ে আমি রওনা করতে চাই।’
‘আপনি আমার মেহমান। যতক্ষণ খুশী থাকবেন, যখন ইচ্ছে বললেন, আমি আপনার যাত্রার ব্যবস্থা করবো।’ বললো শেখ মান্নান।
❀ ❀ ❀