ভোরের আলো আরো স্পষ্ট হলো। আন নাসের তাকিয়ে দেখলো এক অসহায় নারীর বেদনা মলিন মুখ। সে মুখে দুঃসহ কষ্টের প্রলেপ। সেই অকথিত কষ্ট সইতে না পেরে আন নাসের মুখ ফিরিয়ে নিল। ভোরের আলোয় ভাল করে তাকালো। চারদিকে।
আন নাসের এলাকাটা চিনতে পারলো। এখানেই কোথাও সে একবার তার কমান্ডো বাহিনী নিয়ে রাতে দুশমনের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। এলাকাটা ছিল মাটির টিলা ও পাথরে পরিপূর্ণ। উচ্চ ভূমি পেরিয়ে গেলে সামনে স্রোতস্বিনী নদী আছে।
আরেকটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে সামনের উচ্চ ভূমির দিকে হাঁটা ধরলো। তাকে অনুসরণ করলো লিজা। যেতে যেতে উচ্চ ভূমির পরেই সে দেখতে পেল সেই স্রোতস্বিনী নদী। ওরা নদীর কিনারে গিয়ে উপস্থিত হলো।
আন নাসেরের সমস্ত কাপড় রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। দুজনেই অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে পানি পান করলো। ঘোড়াকেও পানি পান করালো। আন নাসের তার ক্ষত স্থানগুলো দেখলো, ক্ষত তেমন মারাত্মক ও গভীর ছিল না। অনেক আগেই রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে এই ভয়ে ক্ষতস্থানগুলো পরিষ্কার করলো না, কি জানি, যদি ধোয়ার পর আবার রক্ত পড়া শুরু হয়ে যায়!
পানি পান করার পর লিজা তার ব্যক্তিগত কাজে একটু আড়াল খুঁজছিল। সে একদিকে হাঁটা ধরে আন নাসের থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে গেল। এক টিলার আড়ালে গিয়ে বসে পড়লো সে। এদিকে আন নাসের তার কতগুলো পরীক্ষা করে আশপাশে তাকিয়ে দেখলো লিজা নেই। সে নদীর পাড় থেকে উঠে এলো এবং লিজাকে খুঁজতে খুঁজতে টিলার অপর পাশে চলে এলো।
দূর থেকেই সে দেখতে পেলো লিজা সেখানে বসে গভীর মনোনিবেশ সহকারে কি যেন দেখছে। আন নাসের কিছু না বলে নীরবে এসে তার পিছনে দাঁড়ালো। দেখলো, সেখানে মানুষের হাড়-হাড্ডি ছড়ানো। মাথার খুলি, বুকের পাজরা, হাত ও পায়ের আঙ্গুলের হাড় সব ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে আছে।
এসব হাড়-হাড্ডির মাঝে পড়ে আছে তলোয়ার ও বর্শা। লিজা একটি মাথার খুলির সামনে বসেছিল। এটা কোন মেয়ে মানুষের মাথা বলে মনে হচ্ছিল। কারণ খুলির পাশেই পড়েছিল মাথার লম্বা লম্বা চুল। কিছু ফুল লেগেছিল মাথার খুলির সাথে, কিছু এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিল। বুকের পিঞ্জরায় গোশত, চামড়া কিছুই ছিল না, কিন্তু একটা খঞ্জর তাতে বিদ্ধ ছিল। গলার হাড়ের ওপর পড়ে ছিল সোনার হার। এই দেহ পিঞ্জরের পাশে পাথর চাপা হয়ে পড়ে ছিল উন্নতমানের ছেড়া রেশমী শাড়ী কাপড়।
আন নাসের এগিয়ে লিজার আরো কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। লিজা নারীর সেই কংকালের দিকেই গভীর মনে তাকিয়ে ছিল। আন নাসের আস্তে করে ডাকলো, ‘লিজা!”
লিজা ভয় পাওয়া হরিণীর মত লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল এবং চিৎকার দিয়ে দ্রুত পিছন ফিরলো। আন নাসেরকে দেখে সহসা সে দুই হাত বাড়িয়ে তাকে ভীষণ জোরে জড়িয়ে ধরলো। আন নাসের তাকে তার বুকে আশ্রয় দিল। লিজার দেহ তখন ভয়ে জীষণ ভাবে কাঁপছে।
সে যখন কিছুটা স্বাভাবিক হলো, আন নাসের তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘চিৎকার দিয়েছিলে কেন?’
সে উত্তরে বললো, ‘এই লাশ দেখে আমার জীবনের পরিণামের কথা মনে পড়ে গেল।’ তখনো তার কণ্ঠে ছিল ভয়ার্ত স্বর। সে বললো, ‘তুমি এই কংকালটির দিকে তাকিয়ে দেখো, এটি কোন হতভাগী মেয়ের কংকাল। হয়তো এ মেয়ে আমারই মত পাপিষ্ঠা ছিল। আমার মতই তারও ছিল রূপ ও যৌবনের বাহার। হয়তো এ মেয়ে আমার চাইতেও সুন্দরী ও বিলাসপরায়ণ ছিল। তার রেশমী পোশাক, কণ্ঠের সোনার হার তার সেই বিলাসপ্রিয়তারই সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু দেখো তার পরিণাম! প্রত্যেকের জন্যই তো এই পরিণাম অপেক্ষা করছে। কিসের জন্য এত যুদ্ধ, এত সংঘাত, এত রক্তারক্তি এক সুন্দর ধোকার রাজ্যে পড়ে আছি আমরা। স্বপ্ন দেখছি ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির। কিন্তু এই কংকাল বলছে, এর সবকিছুই মিথ্যে, সবই মিছে মায়া মরিচীকা। এই সুন্দর ও লাবন্যময় দেহ সৌষ্ঠব, এই মাদকতাময় যৌবনের উচ্ছাস, কিছুই স্থায়ী নয়। সবই ক্ষণিকের মোহ।
এই মেয়েও হয়তো আমারই মতোই ভেবেছিল, সে চিরকালই নব যৌবনা হয়ে থাকবে। কিন্তু সামান্য এক টুকরো ধারালো লোহা তার সব স্বপ্ন নিঃশেষ করে দিয়েছে।
তার বুকের ওপর যে ছুরিটি বিধে আছে, তা দেখো। দেখো তার গলার সোনার হার। এই কণ্ঠহার ও শানিত ছুরি যে জীবনের কাহিনী শোনাচ্ছে, সেটাই তো আমার জীবন! আর ওই যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে মাথার খুলি, পড়ে আছে তলোয়ার ও বর্শা, সেখানে কি তুমি তোমার জীবন দেখতে পাও না?
কোনদিন আমি ইতিহাসের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনিনি। আজ এই মেয়ের কংকাল দেখে আমার মনে হচ্ছে, এ লাশ ও এ দেহ পিঞ্জরা আমারই।
এই কংকালে আবার মাংস ও চর্ম লাগিয়ে দিলে সেখানে আমার চেহারাই ফুটে উঠবে। আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম এক শকুনকে, সে আমার চেহারা থেকে টেনে বের করছে চোখ। এক নেকড়েকে দেখলাম, সে আমার উজ্জ্বল গোলাপী গাল ছিড়ে খাচ্ছে। এসব মরাখেকোদের তৃপ্তিকর আহারের জন্যই কি আমার জন্ম হয়েছিল?
এই কংকাল চিৎকার করে বলতে চাইছে, লিজা! এই তোমার শেষ পরিণাম! ভাল করে দেখে নাও।’ কংকালের সে বিকট চিৎকার শুনে এবং তার বিভৎস রূপ দেখে আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলাম।’
আন নাসের নিবিষ্ট মনে শুনলো লিজার কথাগুলো। তার মনে হলো, সে তো সত্য কথাই বলেছে! যেখানে ফেদাইনরা আমাদের আক্রমণ করেছিল, কিছুদিন পর সেখানে পেলে আমরা তো একই দৃশ্য দেখতে পাবো! আন নাসের লিজার কথায় সায় দিয়ে বললো, সত্যি কথাই বলেছে লিজা। যেখানে আমরা আক্রান্ত হয়েছিলাম, কদিন পর সেখানে গেলে আমরা একই দৃশ্য দেখতে পাবো। লাশের কংকাল, মাথার খুলি, তলোয়ার ও বর্শা। হয়তো সেখান থেকে কিছু দূরেই পাওয়া যাবে কারিশমার কংকাল। তার বুকেও দেখতে পাবো এমনি ভাবে বিদ্ধ হয়ে আছে ছুরি।’
‘কিন্তু তুমি কি জানো, এই সব মেয়েরাই নারী জাতির কলংক! সভ্যতার বিনাশ সাধনে এদেরকে ব্যবহার করে মানবতার শত্রুরা। আমিও এই জঘন্য পেশায় নিয়োজিত এক নারী। যদি আমি এ পেশা পরিবর্তন না করি, হয়তো একদিন এমন নির্জন মরুভূমিতে শিয়াল, শকুন ও নেকড়ে আমার মাংস এমনি করে কুরে কুরে খাবে। যে রূপ নিয়ে আমি গর্ব করি, যাকে পাওয়ার জন্য মানুষ অকাতরে অর্থ-সম্পদ বিলিয়ে দিতে কার্পণ্য করে না, যাকে পাওয়ার জন্য এতগুলো মানুষ আত্মাহুতি দিল, এই তো তার পরিণতি!’
আন নাসের বললো, ‘কিন্তু মানুষ এ থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করে না। নিজেদের ধ্বংস ও অধ:পতন লক্ষ্য করে দেখে না। এর আগেও এ পৃথিবীতে এক শ্রেণীর মানুষ ও অহংকারী রাজা বাদশাহ রূপ, যৌবন, সৌন্দর্য ও শক্তির প্রদর্শন করে বেড়িয়েছে, আজও বেড়াচ্ছে। গর্ব, অহংকার ও দম্ভে মদমত্ত মানুষ ভুলে গেছে তার পরিণামের কথা।’
‘মানুষ এ ভুল করে তার উপলব্ধিহীনতার জন্য, যেমন এতদিন আমি করে এসেছি। কিন্তু এখন আমি নিজেকে চিনতে পেরেছি। আমার মৌলিক সত্ত্বাকে জানতে পেরেছি।’ লিজা উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বললো, “আন নাসের, তুমিও শুনে নাও, তোমাকেও খোদা পৌরুষদীপ্ত এক অনুপম সৌন্দর্য ও শক্তি দান করেছেন। তোমাকে যে নারী একবার দেখবে সেই তোমাকে পাওয়ার জন্য পাগল হবে। সাবধান হও, তুমিও দেখে নাও তোমার পরিণতি।’
সে এমন ভঙ্গীতে কথা বলছিল, যেন তার উপর জ্বীনের আছর পড়েছে। তার চঞ্চল হরিণীর চাপল্য ও চেহারা থেকে দুষ্টুমীর ভাব শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে দুনিয়াত্যাগী সন্নাসিনীর মত ভাব গম্ভীর স্বরে কথা বলছিল। আন নাসের অভিভূত হয়ে তাকিয়ে দেখছিল লিজার এ নতুন রূপ। বললো, ‘লিজা, আমি আমার পৌরুষ নিয়ে গর্ব ও অহংকার করি না। আমি এই শক্তি সেই কাজেই লাগাতে চাই, যে কাজ আল্লাহর পছন্দ। এ উদ্দেশ্যেই আমি কমাণ্ডো বাহিনীতে নাম লিখিয়েছি।
এই কংকাল তোমার হুশ ফিরিয়ে দিয়েছে, এটা খুবই আশার কথা। কিন্তু মনে রেখো, জীবন যেমন কেবল ভোগের নাম নয়, তেমনি আশা ও স্বপ্নহীনতার নামও জীবন নয়। এ কংকাল দেখে তুমি মারাত্মক রকম ধাক্কা খেয়েছো, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গেছে তোমার, এই উভয় প্রান্তিকতা থেকেই ফিরে আসতে হবে তোমাকে। চলো উঠা যাক।’
ওরা ওখান থেকে উঠে এলো। ফিরে এলো নদীর পাড়ে। হাঁটতে হাঁটতে লিজা বললো, ‘আন নাসের, তোমাকে আমি এমন কিছু কথা শোনাতে চাই, যা তুমি আমার কাছ থেকে কখনো আশা করোনি। আমিও ভাবতে পারিনি, এসব গোপন কথা কখনো আমি তোমার কাছে প্রকাশ করবো। কিন্তু আজ আমি উপলব্ধির এক নতুন দিগন্তে এসে পড়েছি। লোভ ও স্বার্থের চাইতে সত্যকে প্রকাশ করে দেয়া এখন আমি অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। তুমি কি একটু মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনবে?’
বিস্মিত আন নাসের লিজার দিকে তাকিয়ে বললো, “কি কথা লিজা!”
‘আমি তোমাকে বলে দিতে চাই, আমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনেক গোপন কথা, যা আমি না বললে কোনদিন তুমি জানতে পারতে না।’
সে হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়েই এক পাথরের ওপর বসে পড়লো। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে আন নাসেরও বসলো আরেক পাথরে।
লিজা কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে তাকিয়ে রইলো নদীর দিকে, যেন কি বলবে গুছিয়ে নিচ্ছে। তারপর কিছু না বলেই সে তার হাত দুটো নিয়ে গেল গলায়। নিজের কণ্ঠহারটি আকড়ে ধরলো, যে হারে মূল্যবান হীরা ও জওহর লাগানো ছিল।
সে হারটি মুঠোর মধ্যে নিয়ে জোরে টান দিল। হারটি ছিড়ে চলে এলো তার হাতে। লিজা দেরী না করে সামনের স্রোতস্বিনী নদীতে ছুঁড়ে ফেললো হারটি।
লিজা আঙ্গুল থেকে তার মূল্যবান হীরার আংটিটিও খুলে ফেললো। সেটাও নদীতে ফেলে দিল। বিস্মিত আন নাসের বলে উঠলো, ‘এসব কি হচ্ছে? কি করছো তুমি? গলার হার, হাতের আংটি এসব ফেলে দেয়ার মানে কি?’
‘এসবই সকল বিভ্রান্তির মূল। এই সম্পদ ও সোনার মোহই আমাকে এই পঙ্কিল পথে টেনে নামিয়েছে। এগুলোই আমার জীবনের অনিষ্টের মূল।’ লিজা উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে লাগলো, ‘আন নাসের! তুমি জানো না, আমি কত বড় শঠ, প্রতারক। প্রতারণা করার জন্য আমাদেরকে নানা রকম প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আমরা মানুষের চোখে মায়ার অঞ্জন মেখে তাকে বিভ্রান্ত করি। মরুভূমির মরিচীকার মতই আমরা স্রেফ ধোকা ছাড়া আর কিছু নই। আমার নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আমি তোমাকেও ধোঁকা দিতে গিয়েছিলাম।’
‘ভালবাসার নাম করে তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছিলে!’ প্রশ্ন নয়, বিস্ময় ঝরে পড়লো আন নাসেরের কণ্ঠ থেকেও।
‘না, নাসের, না!’ ব্যাকুল কণ্ঠে বললো লিজা, ‘তোমাকে দেখেই আমার অন্তরে ভালবাসা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ভালবাসার টানেই তোমাকে বলেছিলাম, পালাতে চাইলে আমি তোমাকে সাহায্য করবো। কিন্তু পরে তোমার সাথে ভালবাসার অভিনয় করার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। দায়িত্ব পাওয়ার পর তোমার সাথে মিশতে গিয়ে আমি ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। কখনো মনে হয়েছে, ভালবাসার টানেই তোমার কাছে ছুটে এসেছি, কখনো মনে হয়েছে, ভালই তো অভিনয় চালাচ্ছি!
ফেদাইনরা যদি আমাদের উপর আক্রমণ না চালাতো এবং এই কংকাল আমার চোখ খুলে না দিত, তবে তুমি জানতেও পারতে না, ভালবাসার নাম করে আমি তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলাম।’
লিজার কথা শুনে আন নাসের এতটাই বিস্মিত হয়েছিল যে, সে যেন বোবা হয়ে গেলো। তবু কোন রকমে ঢোক গিলে বললো, ‘কি সব আবোল তাবোল বকছো তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’
‘না, নাসের, মাথা আমার খারাপ হয়নি। আজ যদি এ কংকাল আমার হুশ ফিরিয়ে না দিত তবে তোমাকে আমি এমন জায়গায় নিয়ে যেতাম, যেখানে তোমার আমার ভালবাসারই সমাধি হতো না, তোমার জীবনও ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে ডুবে যেতো! তুমি গুমাস্তগীনের এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের শিকার হতে গিয়ে বেঁচে গেছো। এখন আমি আর কোন মিথ্যা বলবো না। তোমাকে দিয়ে সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করার জন্য এক গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়। পরিকল্পনা সফল হলে ইতিহাসে তুমিই চিহ্নিত হতে আইয়ুবীর খুনী হিসাবে।’
স্তম্ভিত আন নাসের বললো, ‘তা কি করে সম্ভব! আমি আইয়ুবীর জন্য জান দেয়ার সংকল্প করে পথে নেমেছি, আমি তাকে হত্যা করতে যাব কেন?’
‘সে অনেক কথা। তাহলে শোন, আইয়ুবীকে হত্যা করার লোক ভাড়া করার জন্য হারান থেকে গুমাস্তগীন এসেছিল আছিয়াত দুর্গে। শেখ মান্নান তাকে বললো, চারজন ফেদাইন খুনীকে এরই মধ্যে এ উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। যদি এরা সফল হয় ভাল, কিন্তু যদি ব্যর্থ হয়, তবু আমার করার কিছু নেই। আমি আমার শ্রেষ্ঠ খুনীদেরকেই আইয়ুবীর পিছনে লাগিয়েছি, এরা ব্যর্থ হলে বেহুদা অন্য কোন ফেদাইনকে তার পেছনে লাগিয়ে অযথা সময় ও শক্তির অপচয় করতে চাই না।’ গুমাস্তগীন তাকে বললো, তুমি আমাকে নিরাশ করো না। আমি অনেক আশা তা করে তোমার কাছে এসেছি।’ গুমাস্তগীনের কথা শুনে শেখ মান্নানের মাথায় নতুন বুদ্ধি আসে। সে তোমাদেরকে উপযুক্ত মূল্যের বিনিময়ে তার কাছে বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ সময় আমাদের খৃষ্টান অফিসারও সেখানে উপস্থিত হয়। সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করা আমাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। প্রস্তাব শুনে তিনি খুশী হন এবং তোমাদের মগজ ধোলাইয়ের দায়িত্ব তিনি নিজেই নিয়ে নেন। শেষ পর্যন্ত দাম ঠিক করে মূল্য বুঝে পেয়ে তিনি তোমাদেরকে তুলে দেন গুমাস্তগীনের হাতে।
সেই খৃষ্টান অফিসারই আমার ওপর দায়িত্ব দেয় তোমাকে আমার রূপের ফাঁদে আটক করার। ভালবাসার অভিনয় করে তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা আমার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার হুকুম পেয়ে সাথে সাথেই আমি কাজে নেমে পড়ি। আমার কাজ তোমাকে তৈরী করা।’
‘না, এটা কখনও সম্ভব নয়। আমি সুলতান আইয়ুবীর ছায়াকেও সম্মান করি। আমাকে দিয়ে কোনদিনই তুমি এ উদ্দেশ্য সফল করতে পারতে না।’ আন নাসের বললো, ‘দুনিয়ার কোন শক্তিই আমাকে দিয়ে আমাদের নেতা, ক্রুসেডের বিরুদ্ধে অকুতোভয় বীর, মহানায়ক গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কোন ক্ষতি করাতে পারতো না। আমি কখনোই নিজেকে এতটা নির্বোধ মনে করি না।’
লিজা একটু হাসলো। বললো, “তুমি কতটা নির্বোধ আর বুদ্ধিমান সেটা এখন আর বিচার করতে চাই না। তবে আমি চাইলে ইস্পাতকেও গলিয়ে পানি করে দিতে পারি। তুমি আর বুদ্ধির বড়াই করো না। নিজের ওপর তোমার কতটা নিয়ন্ত্রণ আছে ভালই জানা আছে আমার।
তোমার ধর্ম, তোমার এতদিনের শিক্ষা ও আচার কি নিশুতি রাতে অচেনা মেয়ের সাথে গোপনে দেখা করার অনুমতি দেয়? কিন্তু তুমি তা করোনি? যেভাবে এই অনুচিত কাজকে তুমি বাস্তবে করেছে, সেভাবেই তোমার ইচ্ছার বিপরীত আইয়ুবীকে হত্যার কাজও তুমি নির্বিঘ্নে করে দিতে, যদি আমি চাইতাম।’
‘সত্যি আমি বিবেকের ওপর আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে বড় অন্যায় করে ফেলেছি। আমার ঈমানকে তুমি দুর্বল করে দিয়েছিলে। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। আমি চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছি, এ জন্য আমি অনুতপ্ত।’
‘আমার মনের মধ্যে যে অপরাধবোধ ছিল, সত্যকে প্রকাশ করে তা থেকে মুক্তি চাচ্ছিলাম আমি। এখন আমার মনে আর কোন গ্লানি নেই। তোমার কাছে এ সত্যটুকু প্রকাশ করতে না পারলে মরেও আমি শান্তি পেতাম না। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। দোয়া করো, যেন মৃত্যুর আগে আর কখনো এমন জঘন্য পাপ আমাকে করতে না হয়।’
‘ক্ষমার মালিক আল্লাহ। অন্ধকার থেকে যদি আলোর ভুবনে তুমি আসতে চাও, আমি তোমাকে স্বাগতম জানাবো। দোয়া করি, বিবেকের পথ ধরে যেনো চলতে পারো চিরদিন।’
‘তুমি কি জানো, এক সময় আমি সাইফুদ্দিনের কাছেও থেকেছি? আমি এক অপবিত্রা ও পাপিষ্ঠা মেয়ে। এই পাপ নিয়ে আমি কি আলোর পথে আসতে পারব? আমাদের মত পাপী মেয়েদেরও কি অধিকার আছে তোমাদের ধর্ম গ্রহণ করার?’
‘আমাদের ধর্ম তো তাদের জন্যই, যারা এখনো আলোকের সন্ধান পায়নি। মুক্তির রাজপথ থেকে যারা দূরে, তাদেরকে মুক্তি পথের সন্ধান দেয়ার জন্যই পৃথিবীতে এসেছিলেন আমাদের নবী। তিনি রাহমাতুল্লিল আলামীন- সমস্ত বিশ্ব জগতের জন্য রহমত স্বরূপ। কোন বিশেষ গোষ্ঠী, গোত্র বা বর্ণের জন্য তিনি আসেননি। আল্লাহর দেয়া সূর্য যেমন সবাইকে আলো দেয়, আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান তেমনি সবার জন্য।
সে বিধানের নাম ইসলাম। সে বিধানটি যেখানে লিপিবদ্ধ আছে তাকে বলা হয় কোরআন। আর সে বিধান মত যারা জীবন চালায় তাদের বলা হয় মুসলিম। মুসলিম মানে অনুগত, তুমি আল্লাহর আনুগত্য কবুল করে নিলেই মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। তোমার স্রষ্টার দেয়া বিধানের আনুগত্য করবে তুমি, কার সাধ্য আছে তোমাকে সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে?’
লিজা বললো, ‘আমি যদি বিশুদ্ধ মনে ইসলাম গ্রহণ করে নেই, আল্লাহ হয়তো আমাকে গ্রহণ করে নেবেন। কিন্তু জেনে শুনে তুমি কি আমার মত একজন পাপীকে তোমার জীবন সঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করতে পারবে?’
‘তুমি যদি বিশুদ্ধ মনে তওবা করে নিজেকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিতে পারো, আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, তোমার পূর্ববর্তী সকল গুণাহ তিনি মাফ করে দেবেন। যাকে আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়ে নিজের পছন্দনীয় বান্দী করে নেবেন, তাকে অপছন্দ করা এবং গ্রহণ না করা তো আমার জন্য পাপ ও অপরাধ হবে?’
‘আন নাসের!’ লিজা আবেগ মথিত কণ্ঠে বললো, ‘তাহলে আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করে নিজেকে মুসলিম বলে ঘোষণা করছি।’
‘আমিও তোমাকে আমার জাতির এক কন্যা হিসাবে গ্রহণ করে নিচ্ছি। কিন্তু তোমাকে জীবন সঙ্গী করার সিদ্ধান্ত আমি এ মুহুর্তে নিতে পারবো না। আমি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এক কমাণ্ডো সেনা। তাঁর অনুমতি ছাড়া জীবন সঙ্গী বাছাই করার মত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক সিদ্ধান্ত আমি গ্রহণ করতে পারি না।’
‘তেমন সিদ্ধান্ত নিতে আমি তোমাকে কখনোই বাধ্য করবো না। তুমি আমাকে তোমার জাতির এক কন্যা হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে, এতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি যেনো সঠিকভাবে আল্লাহর পথে চলতে পারি, এ ব্যাপারে আমি তোমার সাহায্য ও পরামর্শ চাই।’
‘অন্তর থেকে পাপের বোঝা নামিয়ে দাও! যখন থেকে তুমি ইসলামকে গ্রহণ করে নিয়েছে, তখন থেকেই বিরাট এক দায়িত্ব এসে কাঁধে চেপেছে তোমার। এ বিশ্ব জাহানের একমাত্র স্রষ্টা ও মালিক মহান রাব্বল আলামীনের বিশ্বস্ত গোলাম হিসাবে আল্লাহ তোমাকেই তাঁর খলিফা নিযুক্ত করেছেন। অতএব এখন থেকে আত্মাহর এ দুনিয়ায় শাস্তি শৃংখলা রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার। এ পৃথিবী আল্লাহর বাগান। তুমি এ বাগানের মালি। অতএব সেইভাবে জীবন যাপন করো, যাতে তোমার চেষ্টা ও সাধনায় আল্লাহর এ বাগানের সৌন্দর্য ও শ্রী বৃদ্ধি পায়।’
এ সময় হঠাৎ লিজা উঠে দাঁড়ালো। এক ধরনের ব্যগ্রতা ও ব্যস্ততা ফুটে উঠলো তার চোখে মুখে। আন নাসের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো তার দিকে। বললো,‘ কি হয়েছে লিজা!’
লিজা চেহারায় সেই ব্যগ্রতা ধরে রেখেই বললো, ‘তোমার কি জানা আছে, ফেদাইনরা সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে গেছে তাদের এ হত্যা পরিকল্পনা কেমন করে বাস্তবায়ন করবে, তা কি তুমি জানো?’
‘না, কিছুই জানি না। লিজা, তুমি কি নিশ্চিত যে, চারজন ফেদাইন খুনী সুলতানকে হত্যা করার জন্য সত্যি রওনা হয়ে গেছে?’
লিজা উত্তর দিল, ‘একশো ভাগ। তবে আমাকে শুধু এ পর্যন্তই জানানো হয়েছে, সেখানে চারজন ফেদাইন খুনীকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা কি পোশাকে গেছে, কিভাবে তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে, সে সব আমি কিছুই জানি না।’
‘আমাকে এখন উড়ে গিয়ে তুর্কমান পৌঁছাতে হবে।’ আন নাসের বললো, ‘সবার আগে সুলতানকে এবং তার রক্ষী বাহিনীকে সতর্ক ও সাবধান করতে হবে।’
আল নাসেরের ভাবালুতা কেটে গেল। সে আবার পুরোদস্তুর আইয়ুবীর একজন কমান্ডো ও কমাণ্ডোদের দলনেতা হয়ে উঠলো, যদিও তখন তার আর কোন সাথী বেঁচে ছিল না। সে লিজাকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। ঘোড়ার গতি তীব্র হওয়ায় বার বার তার শরীরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল লিজা। কিন্তু এমন সুন্দরী ও যুবতী নারীর স্পর্শ তার মনে কোনই প্রভাব ফেলতে পারছিল না। তার চোখের সামনে তখন ভাসছিল শুধু সুলতান আইয়ুবীর হাসিমাখা প্রশান্ত ছবি।
আশঙ্কার দাবানল তার পেরেশানী বাড়িয়ে তুলছিল। সে মনে মনে শুধু প্রার্থনা করছিল, ‘হে আল্লাহ, আমাকে তুমি তোমার কাছে তুলে নাও, তার আগে শুধু এই খবরটা একবার সুলতানকে পৌঁছানোর সুযোগ দাও আমায়।’
আন নাসের এখন তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। দায়িত্ব ও কর্তব্যের বাইরে আর কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। যৌবনের চাহিদা, ভালবাসার আবেগ সবকিছুই তার অন্তর থেকে হারিয়ে গেছে। এমনকি তার জৈবিক চাহিদা ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথাও যেন সে ভুলে গেছে।
অন্যদিকে লিজার মধ্যেও ঘটে গেছে এক আশ্চর্য পরিবর্তন। মানুষের মন কত দ্রুত বদলে যেতে তাকে না দেখলে তা বুঝার উপায় নেই। চির চঞ্চলা লিজার মধ্যে এখন আর চাঞ্চল্যের ছিটেফোটাও অবশিষ্ট নেই। ভাবগম্ভীর লিজাকে দেখলে মনে হবে তার আত্মাটাই আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
প্রতিটি নারীর মধ্যে নারীত্বের যে সহজাত বোধ কাজ করে সে উপলব্ধি যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। রেলিং ধরে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা, আর এক সুঠাম ও তেজস্বী যুবককে জড়িয়ে ধরে থাকার মধ্যে যে পার্থক্য আছে, এই বোধটুকুও তার মধ্যে কাজ করছিল না।
এক যুবকের কণ্ঠলগ্ন হয়ে বসে আছে এক যুবতী, এ বোধ তখন ওদের কারো মাঝেই ছিল না। আন নাসের ফিরে গিয়েছিল তার অতীত ভূমিকায় আর লিজা আন নাসেরের কথা ও কাজে এবং সঙ্গীদের পরিণতি ও কংকাল দর্শনে এতটাই বিহবল হয়ে পড়েছিল যে, কোন উপদেশ দাতা সারা জীবন উপদেশ দিয়েও তার মধ্যে যে পরিবর্তন আনতে পারতো না, কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সেই অভাবিত পরিবর্তন এমনিতেই ঘটে গিয়েছিল। আন নাসেরের চোখের জ্যোতি যেন তাকে সতর্ক ও সাবধান করে দিয়ে বলছিল, যদি পবিত্র জীবন-যাপন করতে চাও, তবে সে জীবন একমাত্র ইসলামই তোমাকে উপহার দিতে পারে।
❀ ❀ ❀