খৃষ্টান অফিসার শুমাস্তগীনের পাশে বসে ছিল। গুমাস্তগীন তাকে বলছিল, ‘আন নাসের ও তার সাথীদের নিয়ে দু’এক দিনের মধ্যেই আমি হারান যাত্রা করবো।’
এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলো কারিশমা। সে তাদের দু’জনকে বললো, ‘এই কমাণ্ডার এখন আমাদের জালে বন্দী।’
খৃষ্টান অফিসার বললো, ‘কি বললো আন নাসের সে কি সত্যি লিজার ফাঁদে ধরা দিয়েছে? কি বুঝলে তার সাথে আলাপ করে?’
কারিশমা সব কথা খুলে বললো তাদের। জানালো কেমন করে আন নাসেরের মন লিজার মুঠোর মধ্যে চলে এসেছে। এখন যে সে পরিপূর্ণভাবেই লিজার নিয়ন্ত্রণে আছে, এ কথা জানিয়ে কারিশমা বললো, ‘এই লোকগুলোকে দিয়ে সহজেই সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করানো যাবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে তাদের প্রস্তুত করতে হয়তো কয়েকদিন সময় লাগবে। এদেরকে কত তাড়াতাড়ি তাদের আদর্শ থেকে সরিয়ে আনা যায়, সে চেষ্টাই এখন আমাদের মূল কাজ। আদর্শ থেকে সরে এলেই তারা নির্দ্বিধায় সুলতানকে হত্যা করতে প্রস্তুত হয়ে যাবে।’
‘আমি এই চার কমান্ডোকে দু’একদিনের মধ্যেই হারানে নিয়ে যেতে চাই।’ গুমাস্তগীন বললো, ‘তোমরা কি দুজনই আমার সাথে যাবে, নাকি লিজা একা? ওদেরকে খুনের ব্যাপারে তৈরী করতে হলে তোমাদের সহযোগিতা অবশ্যই লাগবে।’
‘আমি মেয়েদেরকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।’ বললো খৃস্টান অফিসার, ‘আমি আর দেরী করতে পারছি না। বর্তমান যুদ্ধের খবর আমাকে সরকারের কাছে পৌঁছাতে হবে। সরকারকে জানাতে হবে, হলব, মুশেল ও হারানের সম্মিলিত বাহিনীর অবস্থা শোচনীয়। ময়দান ছেড়ে তাদের বীর সেনাপতিরা পালিয়েছে।’
‘কেন, এ খবর কি তোমাদের সরকার এখনো পায়নি?’
‘হয়তো পেয়েছে। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে সরকারের করণীয় কি সে সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দেয়াও আমার দায়িত্ব। আমি সরকারকে এখানকার ক্রুসেডারদের অবস্থা জানিয়ে এ পরামর্শ দিতে চাই যে, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে পরাজিত করার জন্য আমাদের বিকল্প পন্থা অনুসরণ করতে হবে। সম্মিলিত বাহিনীকে দিয়ে আমাদের আশা পূরণের আর কোন সম্ভাবনা নেই। সরকারকে এ পরামর্শ দেয়ার জন্যই আমাকে দ্রুত সেখানে যেতে হবে।’
‘তুমি এ পরামর্শ দিলে তো তোমাদের তরফ থেকে আমরা যে সাহায্য পাচ্ছিলাম তা বন্ধ হয়ে যাবে!’ শঙ্কিত কণ্ঠে বললো গুমাস্তগীন, ‘এমন কথা বলো না ভাই! আমাদের আর একবার সুযোগ দাও, আইয়ুবীকে আমিই হত্যা করবো। তারপর দেখবে কেমন বিজয়ীর বেশে আমি দামেশকে প্রবেশ করি।
তুমি দুই মেয়েকেই সঙ্গে না নিয়ে অন্তত লিজাকে আমার কাছে রেখে যাও। সে এরই মধ্যে কমান্ডোদের নেতার উপর তার কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। এখন সে সহজেই তাকে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে প্রস্তুত করে নিতে পারবে।’
‘কিন্তু ওদের সহযোগিতা যে আমারও দরকার।’ বললে খৃস্টান অফিসার।
গুমাস্তগীনের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়লো অনুনয়। বললো, ‘আন নাসের সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কমাণ্ডো বলে বিনা বাধায় যে কোন সময় তার কাছে যেতে পারবে। কারিশমার কথাই ঠিক, তাকে প্রস্তুত করতে পারলে সে সহজেই সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে পারবে। এখন চিন্তা করে দেখো, তুমি যদি লিজাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও, তবে আন নাসেরকে তৈরী করবে কে? সে ছাড়া এই কমাণ্ডোদের সঙ্গে নিয়ে আমি কি করবো?’
কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটির পর খৃস্টান অফিসার বললো, ‘তবে এক কাজ করি। ওদেরকে হারান পাঠানোর পরিবর্তে আমিই এখানে আরো কিছুদিন থেকে যাই। এই সময়ের মধ্যে মেয়েরা তাদেরকে কাজের উপযোগী করে দেবে। লিজা প্রস্তুত করবে আন নাসেরকে, আর তার সঙ্গী তিনজন কমান্ডোকে ট্রেনিং দেবে কারিশমা। তাদের কাজ তো একটাই, কমান্ডোদের মনে সুলতান আইয়ুবীর প্রতি দারুণ ঘৃণা ও আক্রোশ সৃষ্টি করা।’
‘আন নাসের সম্পর্কে আমার ধারণা, সে নারীর ব্যাপারে খুবই দুর্বল।’ কারিশমা বললো, “লিজা এত অল্প সময়ে তাকে কাবু করতে পারবে, আমার ধারণা ছিল না। মহব্বতের তীরে সে পুরোপুরি ঘায়েল হয়ে গেছে। লিজা এখন তাকে চোখের ইশারায় নাচাতে পারবে।’
খৃষ্টান অফিসার বললো, ‘আজ তাদের চার জনকেই এক সাথে খাওয়ার দাওয়াত দাও। এতে সবাই তোমাদের সাথে আরও ফ্রি হবে। তুমি এমন পরিবেশ তৈরী করো, যাতে ওরা আমাদের শত্রু না ভেবে বন্ধু মনে করে।’
আহারের সময় হলো। আন নাসের ও তার সঙ্গীদের ডাকা হলো খাওয়ার টেবিলে। তারা এলে এক সাথে সবাই খেতে বসলো। বাবুর্চি সবার সামনে প্লেট, গ্লাস দিচ্ছে; এ সময় শেখ মান্নানের এক খাদেম এসে অফিসারের কানে কানে কিছু বললো। অফিসার সবার দিকে ফিরে বললো, ‘তোমরা খাও। আমি আসছি।’
খৃস্টান অফিসার খাবার টেবিল থেকে উঠে শেখ মান্নানের কামরায় প্রবেশ করলো।
‘মেয়েটি সম্পর্কে তুমি কি চিন্তা করেছো?’ অফিসারকে সামনে পেয়েই শেখ মান্নান জিজ্ঞেস করলো।
‘আমি যখন যাবো, তাদের দু’জনকে সাথে করে নিয়ে যাবো।’ খৃষ্টান অফিসার উত্তর দিল।
‘তোমার যাওয়ার আগ পর্যন্ত মেয়েটি আমার কাছে থাকবে।’ শেখ মান্নান বললো।
‘আমি আজই চলে যাবো।’ বললো খৃস্টান অফিসার।
“ঠিক আছে যাও।’ শেখ মান্নান বললো, ‘তবে মেয়েটিকে আমার কাছে রেখে যাবে। একে দুর্গের বাইরে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি তুমি পাবে না।’
‘মান্নান!’ খৃস্টান অফিসার ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো, “সাবধান! আমাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস করলে এই কেল্লার ইটগুলোও গুড়ো হয়ে যাবে।’
‘ও, মনে হচ্ছে তোমার মাথা এখনও ঠিক হয়নি।’ শেখ মান্নান চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, ‘আজ রাতে মেয়েটিকে এখানে আসতেই হবে। তুমি যদি যেতে চাও, একা যাও। আর যদি এখানে থাকো, রাতে মেয়েটিকে আমার কাছে পৌঁছে দেবে। যদি আমার এ হুকুমের অন্যথা করো তবে রাতে তুমি থাকবে কারাগারের গোপন কক্ষে, আর মেয়েটি থাকবে আমার পাশে। যাও, এখনও সময় আছে, ভেবে চিন্তে ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নাও।’ খৃস্টান অফিসার এ কথার কোন জবাব না দিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো।
❀ ❀ ❀
খাবারের কামরায় এসে প্রবেশ করলো অফিসার। সবাই অধীর হয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। উৎসুক প্রশ্ন নিয়ে সবাই তাকালো তার দিকে। বললো, ‘কি খবর? কোথায় গিয়েছিলে?’
‘দেখো বন্ধুগণ! শেখ মান্নান আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। আজ রাতে যদি লিজাকে আমি তার মহলে পোঁছে না দেই, তবে সে আমাকে কারাগারে নিক্ষেপের হুমকি দিয়েছে। বলেছে, আমাকে কারা প্রকোষ্ঠে পাঠিয়ে লিজাকে সে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।’
‘আপনাকে কারাগারের গোপন কক্ষে পাঠাবে আর লিজাকে জোর করে তার মহলে নিয়ে যাবে! কেন, আমরা কি মরে গেছি।’ আন নাসের বললো, ‘লিজাকে সে কোন দিনই পাবে না। তার ইজ্জতের জিম্মা আমি নিয়েছি।’
আন নাসেরের এক সঙ্গী অবাক হয়ে বললো, ‘এই মেয়েটির সাথে তোমার কি সম্পর্ক আন নাসের? যে মেয়ে আমাদের পাকড়াও করে এখানে নিয়ে এসেছে, তার ইজ্জত রক্ষার জিমা তুমি নিতে যাবে কেন?’
‘তোমরা নিজেদেরকে এখন আর কয়েদী ভেবো না।’ গুমাস্তগীন বললো, ‘এ বিপদ তো আমাদের সবার জন্য এসেছে।’
কারিশমা বললো, ‘তোমাদেরকে আমরাই ধরে এনেছি ঠিক, কিন্তু এখন আর তোমরা আমাদের বন্দী নও, শেখ মান্নানের মেহমান।’
খৃস্টান অফিসার বললো, “তোমরা আমাদের সাথে চলো। আমরা এখন সবাই শেখ মান্নানের জালে আটকা পড়ে গেছি। অতএব এখান থেকে বেরোনোর চেষ্টাও আমাদের সম্মিলিতভাবেই করা উচিত।’
‘কিন্তু এখান থেকে কেমন করে বের হবো আমরা? শেখ মান্নান তো আমাদের সবাইকে তার পাহারার মধ্যেই রেখেছে।’ বললো আন নাসের।
‘শেখ মান্নান আমাকে অনুমতি দিয়ে রেখেছে, এই চারজন কমাণ্ডোকে আমি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবো।’ গুমাস্তগীন বললো, ‘আমি এদেরকে নিয়ে আজই রওনা হয়ে যাবো। তোমরা জলদি তৈরী হয়ে নাও। আমরা সন্ধ্যার আগেই রওনা দেবো।’
ওরা খাবার টেবিলে বসেই ওখান থেকে কিভাবে পালাবে তার শলাপরামর্শ করলো। এ ক্ষেত্রে দিশারীর ভূমিকা নিল গুমাস্তগীন। সে তার গোপন পরিকল্পনা সবার সামনে তুলে ধরলো। পরিকল্পনা সমাপ্ত হলে যে যার কামরায় ফিরে গেল। গুমাস্তগীন তার চাকর ও দেহরক্ষীদের ডেকে বললো, ‘জলদি তৈরী হয়ে নাও। সন্ধ্যার আগেই আমরা যাত্রা শুরু করবো।’
গুমাস্তগীনের এ তাৎক্ষণিক ঘোষণায় কিছুটা অবাক হলো তার লোকজন। কিন্তু কেউ কোন প্রশ্ন না করেই যে যার মত আসবাবপত্র গুছাতে লেগে গেল।
কাফেলা তোড়েজোড়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো। তাদের নিজস্ব ঘোড়া ছাড়াও অতিরিক্ত চারটি ঘোড়া প্রস্তুত করা হলো কমাণ্ডোদের জন্য। চারটি উটের পিঠে মাল-সামান বোঝাই করা হলো। সঙ্গে নেয়া হলো প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয়।
আছিয়াত থেকে হারান অনেক দূরের পথ। একাধিক রাত তাদের কাটাতে হবে পথে, মরুভূমির মধ্যে। ফলে সঙ্গে নেয়া হলো তাঁবু এবং তাঁবু খাটানোর অন্যান্য সরঞ্জাম। মাল-সামানে উটগুলোর পিঠ বোঝাই হয়ে গেলো। গুমাস্তগীন নিজে তদারক করলো প্রস্তুতিপর্ব।
প্রস্তুতিপর্ব শেষ হলে গুমাস্তগীন শেখ মান্নানের কাছে বিদায় নিতে গেল। তাকে বললো, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তোমার মেহমানদারীর কথা বহুদিন মনে থাকবে আমার। আমি যাওয়ার জন্য তৈরী। যাওয়ার আগে তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলাম। আশা করি তুমিও সময় করে আমার ওখানে বেড়াতে আসবে।’
শেখ মান্নান তার সাথে করমর্দন করে খুশীর সাথেই বললো, “অবশ্যই, অবশ্যই।’
‘আমি কি তাহলে এখন তোমার দেয়া চার কমান্ডোকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারি?’
‘কেন নয়। আপনার সাথে তো ওদের সম্পর্কে সব লেনদেন শেষ হয়েছে। আপনি যখন সোনা ও মুক্তা দিয়ে ওদের মূল্য পরিশোধ করেছেন, তখন থেকেই তো ওরা আপনার সম্পত্তি হয়ে গেছে।
‘যাওয়ার আগে সালাহউদ্দিন প্রসঙ্গ তোমাকে আরেক বার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আমি আশা করি, ক্রুসেডারদের দাবী অনুসারে যে চারজন ভাড়াটে খুনীকে পাঠিয়েছে সুলতানকে হত্যা করতে, তারা এবার সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে শেষ করেই ফিরবে।
শেখ মান্নান বললো, ‘আইয়ুবীর বিষয়টা আমি দেখছি। তুমি সাইফুদ্দিনকে সামলাও। যে চারজন কমাণ্ডোকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি, ওদের দিয়ে হত্যা করাও সাইফুদ্দিনকে।’ শেখ মান্নান আরও বললো, ‘তোমরা আর যুদ্ধ করতে পারবে না। সে শক্তি এখন নিঃশেষ হয়ে গেছে। এবার ঘরের শত্রুদের চোরের মত গোপনে হত্যা করো।’
‘এ নিয়ে তুমি ভেবো না, সাইফুদ্দিন তো আর আইয়ুবী নয় যে, তাকে হত্যা করা খুব কঠিন কিছু। তুমি ধরে নাও, সাইফুদ্দিন দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেছে।’
‘ভাল কথা! তোমার খৃষ্টান বন্ধু ও তার পরী দুটি কোথায়?’
‘তারা তাদের কামরাতেই আছে।’ গুমাস্তগীন বললো।
‘সে তোমার কাছে ছোট মেয়েটির ব্যাপারে কোন কথা বলেনি তো?’
‘হ্যাঁ, শুনেছি ছোট মেয়েটাকে আজ রাতে তোমার কাছে পাঠাবে। শুনলাম, মেয়েটাকে খৃষ্টান অফিসার বলছে, লিজা, এই বেলা তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। রাতে আজ শেখ মান্নানের ওখানে দাওয়াত আছে আমাদের। ঘুম থেকে উঠে এমন সাজ পোশাক পড়বে, দেখলে যেন ভোরের শিশির ভেজা তরতাজা ফুলের মত মনে হয়।’ গুমাস্তগীন বললো, তার কথায় মনে হলো, সে তোমাকে খুবই ভয় পাচ্ছে।’
‘বুদ্ধিমান অফিসার।’ বললো শেখ মান্নান, এখানে বড় বড় শক্তিধর সম্রাটরা পর্যন্ত ভয় পেয়ে যায়, আর ও তো এক অফিসার মাত্র। হতভাগা আমার কাছ থেকে মেয়েটাকে লুকাতে চেয়েছিল, যেন সে তার কন্যা!’
গুমাস্তগীন তার কাছ থেকে বিদায় নিল। তাকে এগিয়ে দিতে গেট পর্যন্ত সঙ্গে এলো শেখ মান্নান।
গেটের কাছে কাফেলা প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গুমাগীন অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করলো। তার দেহরক্ষীরাও ঘোড়ায় আরোহণ করলো। দেহরক্ষীদের দু’জন সামনে ও দুজন পিছনে চললো গুমাস্তগীনের। তাদের হাতে উদ্যত বর্শা।
গুমাস্তগীনের পিছনেই আন নাসের ও তার সঙ্গীরা। সবার পিছনে মাল বোঝাই উটের বহর।
কেল্লার গেট খুলে দেয়া হলো। কাফেলা ধীরে ধীরে বাইরে চলে গেল কেল্লার। শেষ বারের মত হাত নেড়ে গুমাস্তগীনকে বিদায় জানিয়ে গেট বন্ধ করার হুকুম দিল শেখ মান্নান। সঙ্গে সঙ্গে কেল্লার গেট আবার বন্ধ হয়ে গেল।
❀ ❀ ❀
কেল্লার দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে গেল কাফেলা। দ্রুত পা চালিয়ে ওরা অনেক দূরে সরে এলো। ধীরে ধীরে পশ্চিম দিগন্ত রক্তিম হয়ে উঠলো। সূর্য ডুবতে শুরু করলো। কাফেলা তার চলার গতি তীব্রতর করে ছুটে চললো হারানের দিকে।
প্রতিদিনের মত সন্ধ্যা নেমে এলো কেল্লায়। প্রহরীরা সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিল কেল্লার ঘরে ঘরে। রাস্তার মোড়েও জ্বালানো হলো বাতি। শেখ মান্নানের বিনোদন মহলের ঝাড়বাতিগুলোও জ্বলে উঠলো।
সন্ধ্যা পেরিয়ে নেমে এলো রাত। চারদিক ছেয়ে গেল গভীর আঁধারে। শেখ মান্নান অস্থির হয়ে দারোয়ানকে ডাকলো। বললো, “সেই খৃস্টান অফিসার কি এখনও মেয়েটাকে নিয়ে আসেনি?”
‘জ্বি না, জনাব।’
“ঠিক আছে যাও।’
একটু পর আবার ডাকলো। দারোয়ান একই জবাব দিল। তৃতীয় বার ডাকার পরও যখন দারোয়ান বললো, “জ্বি না, জনাব।’ শেখ মান্নান তার ব্যক্তিগত চাকরকে ডেকে বললো, ‘ঐ খৃস্টান অফিসারকে গিয়ে বলো, মেয়েটাকে নিয়ে যেন অতি সত্তর এখানে চলে আসে।’
চাকর খৃস্টান অফিসারের কামরায় গেল, কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। মেয়ে দু’টির কামরায় গেল চাকর, সেখানেও কেউ নেই। ওখানে দাঁড়িয়ে ওদের নাম ধরে ডাকাডাকি করলো, কিন্তু কেউ সাড়া দিল না সে ডাকে। চারদিকে খুঁজলো, কিন্তু কোন সন্ধান পেল না তাদের। চাকর আশপাশের সবগুলো কামরা একে একে ঘুরে দেখলো, সবগুলোই শূন্য। সে এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে দেখলো, কেল্লার বাগানে গিয়ে তালাশ করলো ওদের। আশপাশের উঠান, আঙ্গিনা সর্বত্র খুঁজলো। শেষে নিরাশ হয়ে সেখান থেকে ফিরে শেখ মান্নানকে বললো, ‘খৃস্টান অফিসার ও তার দুই মেয়েকে কোথাও পাওয়া গেল না।’
শেখ মান্নান বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চেঁচিয়ে বললো, ‘কি বলছিস তুই। কেল্লার ফটকে বলা আছে ওদের যেন বাইরে যেতে দেয়া না হয়। নিশ্চয়ই ওরা কেল্লার ভেতরেই আছে, ভল করে খুঁজে দেখ।’
চাকর বললো, ‘আমি ওদের সবগুলো কামরা খুঁজে দেখেছি। আশপাশ, বাগান, কোথাও খুঁজতে বাদ রাখিনি।’
‘তাহলে?’ বিস্মিত শেখ মান্নান বললো, ‘জলদি সেনা কমাণ্ডারকে ডাকো।’
শেখ মান্নানের তলব পেয়ে ছুটে এলো সেনা কমাণ্ডার। শেখ মান্নান বললো, “খৃস্টান অফিসার ও মেয়েরা কোথায় আছে খুঁজে বের করো।’
হুকুম পেয়ে ছুটলো সেনা কমাণ্ডার। কেল্লার প্রাচীরের পাশের খাদে, ঝোপ-ঝাড়ে সর্বত্র খুঁজলো ওদের। বললো, ‘ওরা কেল্লায় নেই জনাব।’
শেখ মান্নান বললো, ‘এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। যেভাবেই হোক ওদেরকে খুঁজে বের করো।’
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফেদাইন খুনী ও সৈন্যদের মাঝে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। মশাল নিয়ে ওরা হন্যে হয়ে ছুটলো কেল্লার প্রতিটি কোণে। অন্ধকারে সৈন্যদের দেখা যাচ্ছিল না, চারদিকে শুধু দেখা যাচ্ছিল আলোর নাচন। বিশাল কেল্লার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত আলোর ফুলগুলো ছুটে বেড়ালো অনেক রাত পর্যন্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হলো যে, কেল্লার মধ্যে কোথাও খৃস্টান অফিসার ও মেয়ে দুটি নেই।
শেখ মান্নান গেটে ডিউটিরত তার অর্ধ ডজন প্রহরীকে ডাকলো। যারা সে সময় পাহারায় নিযুক্ত ছিল এবং যারা বিশ্রামে ছিল তাদের সকলকে একত্র করে শেখ মান্নান জিজ্ঞেস করলো, ‘গুমাস্তগীনের কাফেলা ছাড়া অন্য কারো জন্য কি আজ গেট খোলা হয়েছিল?’
তারা ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে বললো, ‘আপনার আদেশ ছাড়া কখনো গেট খোলা হয় না। আজ একবারই গেট খোলা হয়েছিল, যখন আপনি গেটে উপস্থিত ছিলেন।’
‘তোমরা কি দুটি মেয়ে ও খৃষ্টান লোকটিকে এ কেল্লা থেকে বের হতে দেখেছো?’
‘আলবত না হুজুর।’ ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বললো প্রহরীরা।
‘গুমাস্তগীনের কাফেলার সাথে কি ওদের দেখেছিলে?’
‘জি না হুজুর। ওনার কাফেলার সাথে খৃস্টান লোকটি বা কোন মেয়ে ছিল না।’
‘তাহলে বলো, একজন খৃষ্টান অফিসার এবং দুটি মেয়ে কেমন করে কেল্লা থেকে গায়েব হয়ে গেল? তাদের কি পাখা আছে যে, তারা হাওয়ায় উড়ে গেল? নাকি তারা জ্বীন-পরী বা যাদু কন্যা ছিল যে, ভোজবাজির মত সবাই হাওয়া হয়ে গেল?’
প্রহরীরা এ কথার কোন জবাব দিতে পারল না। তারা মাথা নিচু করে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইল। কেউ দেখলে মনে করবে, এখুনি এসব অপরাধীদের ফাঁসির আদেশ কার্যকরী করা হবে।
গভীর রাতে শেখ মান্নান তার কামরায় গেল। রাগে ও গোস্বায় তার চেহারা তখনো টগবগ করছিল।
রাতের প্রথম প্রহর শেষ হয়ে গেল, গুমাস্তগীনের কাফেলা তখনো পূর্ণোদ্যমে ছুটছিল। চারদিকে হালকা অন্ধকার। পথ চলতে চলতে এক সময় থেমে গেল গুমাস্তগীন। সঙ্গী দেহরক্ষীদের বললো, ‘এবার থামো।’
কাফেলা থামতেই তিনি উট চালকদের বললেন, ‘উটগুলোকে জলদি বসাও। তাঁবুর বোঝার মধ্য থেকে ওদের বের করে দেখো, ওরা এখনো বেঁচে আছে, নাকি দম বন্ধ হয়ে এরই মধ্যে মারা গেল।’
উট চালকেরা উটকে বসালো। উটের পিঠ থেকে তাঁবুর বোঝা নামিয়ে দ্রুত হাতে তাঁবুর বাঁধন খুললো। বাঁধন খুলতেই তাঁবুর ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো খৃস্টান অফিসার, কারিশমা ও লিজা।
না, কেউ মারা যায়নি। তবে তাদের গায়ের ঘামে তাঁবুগুলো ভিজে গিয়েছিল। গরমে তিনজনেরই জিহ্বা বেরিয়ে এসেছিল চোখ ঘোলাটে এবং রক্তবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তারপরও তারা গুমাস্তগীনের ওপর কৃতজ্ঞ ছিল, এ জন্য যে, গুমাস্তগীন তাদেরকে তাঁবুতে জড়িয়ে আছিয়াত দুর্গ থেকে বের করে নিয়ে এসেছে।