কেল্লা থেকে এখন তারা অনেক দূরে, নিরাপদ স্থানে। শেষ মান্নানের ফেদাইন দল পিছু ধাওয়া করে তাদের ধরে ফেলবে, এমন কোন ভয়ও নেই আর। আর এসেই বা কি করবে, তারা তো সম্মুখ যুদ্ধে পটু নয়। সামনাসামনি যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চাইবে না তারা। তাই ক্লান্ত খৃস্টান অফিসার সেখানেই রাতের মত তাঁবু করার প্রস্তাব দিল। কিন্তু গুমাস্তগীন সে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বললো, ‘আমি শেখ মান্নানকে চিনি। কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাই না। এখানে আমরা বিশ্রামের জন্য থামিনি, থেমেছি তোমাদেরকে তাঁবুর বালি থেকে বের করার জন্য।’
আন নাসেরও বললো, ‘উনি ঠিকই বলেছেন। বিশ্রাম না করে আমাদের আরো এগিয়ে যাওয়া দরকার।’
ফলে কাফেলা আবার যাত্রা শুরু করলো। মেয়ে দুটিকে দুই উটের পিঠে তুলে দেয়া হলো। খৃস্টান অফিসার গুমাস্তগীনের এক রক্ষীর ঘোড়া নিয়ে চারজন কমান্ডের সাথে সাথে চললো। চলতে চলতে খৃস্টান অফিসার আন নাসেরের সঙ্গে আলাপ শুরু করে দিল। তার কথার মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালবাসার সুর ধ্বনিত হচ্ছিল। আন নাসেরের মন থেকে ভয়ের ভাব কেটে গিয়েছিল। সেও অফিসারের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলো।
মধ্য রাতের পর কাফেলাকে এক স্থানে বিশ্রামের জন্য থামতে হুকুম দিল গুমাস্তগীন। থেমে গেল কাফেলা। থেমেই তাঁবু খাটানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই। গুমাস্তগীনের জন্য পৃথক তাঁবু টানানো হলো। মেয়েদের জন্যও আলাদা তাঁবুর ব্যবস্থা করা হলো। রক্ষী ও কমান্ডোরা তাঁবু না টানিয়েই খোলা আকাশের নিচে শুয়ে পড়লো।
আন নাসেরের মন-মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন করে রেখেছিল লিজাকে আপন করে পাওয়ার স্বপ্ন। শুয়ে শুয়ে লিজার কথাই ভাবছিল সে। মজার ব্যাপার হলো, সেই রাতেই লিজাকে কাছে পাওয়ার সুযোগও পেয়ে গেল সে।
কাফেলার সবাই ছিল বড় ক্লান্ত। দীর্ঘ পথশ্রমের সাথে যুক্ত হয়েছিল ফেদাইনদের ধাওয়া করার ভয়। এই টেনশন ও ক্লান্তি থেকে তাদের মুক্তি দিল ঘুম। শোয়ার সাথে সাথেই ন্দ্রিা এসে জড়িয়ে ধরলো তাদের।
কিন্তু আন নাসেরের চোখে কোন ঘুম ছিল না। সে তখন শুয়ে শুয়ে সে লিজার কথাই চিন্তা করছিল। একবার ভাবলো, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, এই ফাঁকে লিজার কাছে চলে যাই না কেন কারিশমা তো আমাদের ব্যাপারটা জানেই। পরক্ষণে মনে হলো, না, এভাবে যাওয়াটা ঠিক হবে না। লিজা তাকে অন্য রকম ভাবতে পারে। তারচে, একটু অপেক্ষা করেই দেখি না কেন। লিজাও তো চলে আসতে পারে!
এইসব নানা রকম চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছিল আন নাসের। সে যে একজন কমান্ডো বাহিনীর কমাণ্ডার, এ কথা সে ভুলেই গিয়েছিল! ভুলে গিয়েছিল, তার মত অন্যান্য কমান্ডোরা তখনো সারা দেশে ছড়িয়ে থেকে ইসলামের বিজয়ের জন্য জীবন বাজী রেখে গেরিলা কায়দায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তার মনে এ চিন্তাও কাজ করছিল না যে, তাকে আবার তার বাহিনীতে ফিরে যেতে হবে।
তার অন্যান্য সাথীরাও শুয়ে পড়েছিল। সে ভেবেছিল, তার সাথীরাও সবার মতই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তার তিন সাথীর চোখে তখন ঘুম ছিল না। অন্যান্যদের সাথে তারাও শুয়ে পড়েছিল ঠিক, কিন্তু শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, কি করে এই চক্রের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়।
তারা ভেবে দেখলো, পালিয়ে যাওয়ার এটাই মহা সুযোগ। সবাই গভীর দ্রিায় মগ্ন! পাশেই রয়েছে ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র। রয়েছে খাদ্য ও পানীয়। তারা আশা করছিল, কমান্ডার এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। তাদের এখন প্রয়োজন শুধু কমাণ্ডারের একটু নির্দেশ বা সংকেত। তাদের যে প্রশিক্ষণ আছে তাতে গুমাস্তগীনসহ সবাই মিলে বাঁধা দিলেও তারা সে বাঁধার মোকাবেলা করে টিকে যেতে পারবে। তাই না ঘুমিয়ে ওরা কমাণ্ডারের একটু ইশারার অপেক্ষা করছিল।
তাদের তো আর জানা ছিল না, তাদের কমাণ্ডার ইতোমধ্যেই তার বুদ্ধি-বিবেক, তার ঈমান ও আকিদা এবং তার সৈনিকসুলভ চেতনা এক যুবতীর পায়ের তলে সমর্পণ করে বসে আছে। এক খৃষ্টান মেয়ে তার সমস্ত সৎ গুণাবলী ধ্বংস করে দিয়ে নিজের সারা জীবনের পাপের বোঝা নিয়ে আন নাসেরের পিঠে সওয়ার হয়ে গেছে!
আন নাসের শুয়েছিল লিজাদের তাঁবুর দিকে মুখ করে। অন্ধকারেও সে দেখতে পেল, তাঁবু থেকে একটি কালো ছায়া বেরিয়ে এসেছে। ছায়াটি পা টিপে টিপে তার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। ছায়াটি কোন পুরুষের নয়, একটি মেয়ের।
এ দৃশ্য দেখার সাথে সাথেই সেও উঠে বসলো এবং ঘুমন্ত সাথীদের থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে লাগলো। কিছুটা তফাতে গিয়ে সে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো এবং পা টিপে টিপে ছায়াটির দিকেই অগ্রসর হলো।
অল্প সময় পরেই দুটি ছায়া একাকার হয়ে গেল।
লিজা আন নাসেরকে ঘুমন্ত কাফেলা থেকে সরিয়ে দূরে এক টিলার পাশে নিয়ে গেল।
তার কথা থেকে ঝরে পড়ছিল প্রচণ্ড আবেগ ও উচ্ছাস। শেখ মান্নানের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে এই আনন্দে তার লাফাতে ইচ্ছে করছিল। আন নাসেরকে একান্ত করে কাছে পেয়েছে এই আবেগে সে যেন উন্মাদ হয়ে গেছে।
লিজার এই আবেগ দেখে আন নাসেরও আবেগে উদীপ্ত হয়ে উঠলো। বিশ্ব প্রকৃতি তুলে দুজনই ভেসে চললো আবেগের সাগরে। লিজা তার মনের আবেগ প্রকাশ করছিল হাত-পা নেড়ে। খেলনা পেলে কচি খুকীরা যেমন আনন্দে লাফায় তেমনি লাফাচ্ছিল সে। হঠাৎ তার কি হলো, আন নাসের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সামান্য দূরে সরে গিয়ে বললো, “আন নাসের, তোমাকে একটি কথা বলবো, তোমার জীবনে কি আর কোন নারী এসেছে।’
‘আমার মা ও বোন ছাড়া জীবনে আমি আর কোন নারীর সন্নিধ্য পাইনি!” আন নাসের বললো, ‘তুমিই আমার জীবনে প্রথম নারী, যে ভালবাসার পা নিয়ে আমার জীবনে এসেছে, হৃদয়ের কড়া নেড়ে জাগিয়েছে আমায়।’
‘তুমি সত্যি বলছো তো!’
‘দেখো, আমি মিথ্যে বলি না। যৌবনের প্রারম্ভেই আমি নূরুদ্দিন জঙ্গীর সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করি। তার পরের দিনগুলো কেটেছে আমার যুদ্ধের ময়দানে। মরুভূমির তপ্ত বালুকারাশি, দুর্গম পাহাড়, অরণ্য, সর্বত্র ছুটে বেরিয়েছি আমি। আপনজন থেকে দূরে নির্জন প্রান্তরে শিকারী বাঘের মত খুঁজে ফিরেছি দুশমন। মেতে উঠেছি রক্ত দেয়া-নেয়ার খেলায়। এর বাইরে যে কোন জীবন আছে, সে কথাটাই মনে হয়নি কখনো। তোমাকে দেখার আগে নারীকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজনও পড়েনি, সময়ও হয়নি।
সারাক্ষণ তৎপর থাকতাম অর্পিত দায়িত্ব পালনের কাজে। দায়িত্বশীল কমাণ্ডার হিসাবে আমার যথেষ্ট খ্যাতি আছে। আমি যেখানেই থাকি দায়িত্ব পালনে কখনও ক্রটি করি না। কারণ দায়িত্ব পালনকে আমি কেবল ডিউটি মনে করি না, দায়িত্ব পালন আমার ঈমানেরই অঙ্গ।’
ঈমান শব্দটি উচ্চারণ করতেই তার ভেতরটা হঠাৎ নড়ে উঠলো। চমকে উঠে কথা বন্ধ করে দিল সে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর লিজা তাকে প্রশ্ন করলো, ‘কি ভাবছো?’
‘লিজা! তুমি হয়ত আমার ঈমানকে দুর্বল করে দিয়েছে! আমাকে বলো তো, তোমরা আমাকে ও আমার সঙ্গীদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?’
‘তার আগে তুমি আমাকে বলল, আমার ভালবাসা ও রূপ লাবণ্য দেখে তোমার মনে কুপ্রবৃত্তি জেগে উঠেছে কি না?’ লিজা এমন ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো, যার মধ্যে রসিকতার সামান্যতম লেশও ছিল না।
লিজাকে সিরিয়াস হতে দেখে আন নাসেরও সিরিয়াস হয়ে উঠলো। বললো, ‘তোমার মনে এমন প্রশ্ন জাগলো কেন?’
‘তুমি তো আমাকে বলেছিলে, আমাদের ভালবাসা পবিত্র। এ পবিত্র ভালবাসা কখনো তুমি অপবিত্র করবে না!’
আন নাসের বললো, ‘আমি প্রমাণ করবো, আমি পশু নই।’
‘তাহলে তোমার মনে এ ধারণা কেন এলো যে, আমি তোমার ইমান দুর্বল করে দিয়েছি। আমরা উভয়েই আমাদের ভালবাসার পবিত্রতা রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ। আমি এটাও তোমাকে বলেছি, তুমি যদি চাও, আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করে তোমার ধর্ম কবুল করে নেবো। তাহলে এ কথার মানে কি? আমার ভালবাসা নিয়ে কি করে তোমার মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হলো? তুমি কি জানো, আমাদের খৃষ্টান জাতিতেও তোমার চেয়ে সুদর্শন যুবক আছে। যারা বীর যোদ্ধা, সুন্দর, স্বাস্থ্যবান এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন লোক তারা আমাকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করে। আমাকে পাওয়ার জন্য কত যুবক যে পাগলপারা, কই, আমি তো তাদের কাউকে মন দেইনি!’
আন নাসেরের যে কি হলো সে বলতে পারবে না, লিজাকে শান্তনা দেয়ার পরিবর্তে বলে উঠলো, ‘তাহলে তুমি সেখানেই চলে যাওনা কেন? আমার মধ্যে এত কি গুণ দেখেছে যে, আমাকে আকৃষ্ট করছো?’
লিজা আশা করেনি, এ পর্যায়ে এসে আন নাসের এমন উত্তর দিতে পারে। সে এ উত্তর শুনে প্রচণ্ড আশাহত হলো এবং এ প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে গুম মেরে বসে রইলো।
আন নাসের তার কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘আমার কথার উত্তর দাও লিজা! এভাবে চুপ করে থেকো না, বলো, তুমি আমার মাঝে কি পেয়েছো?’
লিজা কোন কথা বললো না। সে তার মাথাটি হাঁটুর উপর রেখে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলো। আন নাসের তার কান্নার শব্দ শুনতে পেল। সে লিজার কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, ‘কাঁদছে কেন? আহা, কি হয়েছে বলবে তো?’
লিজা এবারও কোন কথা বললো না, কাঁদতেই থাকলো। আন নাসের বার বার তাকে জিজ্ঞেস করলো সে কেন কাঁদছে। কিন্তু কোন জবাব না দিয়ে লিজা ফুলে ফুলে কেঁদেই চললো।
আন নাসের তার এ কান্না সইতে পারলো না। কান্না এক সংক্রামক আবেগের নাম। এ কান্না দেখে তার নিজের ভেতরও ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়ে গেলো। বুঝতে পারলো, এমন প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি তার। সে তাকে বললো, ‘ভুল হয়ে গেছে। লিজা, এমন কথা আর কোনদিন বলবো না।’
তাতেও থামলো না লিজার কান্না। তখন আন নাসের তাকে নিজের বাহুর বেষ্টনীতে নিয়ে নিল। বাঁধা দিল না লিজা, বরং ওর বুকে মাথা রেখে আরও জোরে কাঁদতে লাগলো।
এ কান্নার ক্ষমতা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না আন নাসেরের। কয়েক মিনিটের এ কান্না যে তার সারা জীবনের সংযম ভেঙে দেয়ার জন্য যথেষ্ট, এ কথা বুঝার মত মানসিক শক্তি তার ছিল না। সে তখন বিপর্যয়কর মানবিক দুর্বলতার শিকার। যে দুর্বলতা মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞান ও বুদ্ধিকে প্রায় লুপ্ত করে দেয়। সে তখন লিজার মনে কষ্ট দেয়ার অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিল। সেই অনুতাপ তাকে লিজার প্রতি আরো দুর্বল করে তুলছিল। সেই দুর্বলতার শিকার হয়ে আন নাসের ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছিল লিজার মধ্যে।
এ ছিল সেই দুর্বলতা, যে দুর্বলতা রাণীকে তার গোলামের কাছে নত করে দেয়। যে দুর্বলতার কারণে রাজা তার রাজকীয় ভাণ্ডার ও অর্থ-সম্পদকে পাথরের মত মূল্যহীন ভেবে রাজমহল ত্যাগ করে আশ্রয় নেয় সাধারণ পর্ণকুটিরে। একটু মানসিক শাস্তির আশায় জমিদার পথে নামে মুসাফিরের বেশে।
লিজাও ভালবাসার পিপাসু ছিল। সেই ভালবাসা, যে ভালবাসা আত্মাকে শাস্তি দেয়। সে দৈহিক প্রেম এমন সব পুরুষের কাছ থেকে পেয়েছে, যাদের সে ঘৃণা করে। সে আছিয়াত দুর্গে আসার পথে এবং কেল্লায় পৌছেও কারিশমার কাছে তার এই মনের আবেগ প্রকাশ করে ছিল। আন নাসেরের হৃদয়ের উত্তাপ তাকেও গলিয়ে ফেলেছিল। প্রতারণা করতে এসে সে সত্যিকার অর্থেই ভালবেসে ফেললো।
আবেগ জড়িত কণ্ঠে সে বললো, ‘আমাকে বিশ্বাস করো। নারী জীবনে একজনকেই মন দেয়। সে মন আমি তোমাকে দিয়ে ফেলেছি। এখন আমার নিজস্ব বলতে কিছু নেই। এ দেহ মন। এখন সবই তোমার। তুমি বিশ্বাস করে কাছে টানলেও তোমার, অবিশ্বাস করে দূরে ছুঁড়ে ফেললেও এ তোমারই থাকবে।’
সে যখন এসব বলছিল, তখন তার মনে কোন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের লেশমাত্র ছিল না। সে তার মনের সত্যিকার আবেগই প্রকাশ করছিল। মনের টানেই সে আন নাসেরের কাছে চলে এসেছিল।
যদিও আন নাসেরকে ফাঁসানোর জন্যই তারা লিজাকে নিয়োগ করেছিল এবং লিজা সে ব্যাপারে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছিল, কিন্তু তার মন তাতে সাড়া দেয়নি। সে আন নাসেরকে ভালবেসেই তার কাছে ছুটে আসতো। চাপানো দায়িত্বের কথাও সব সময় স্মরণ থাকতো তার, সে সেই দায়িত্বটুকু পালন করতো নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে।
দায়িত্বের কথা মনে হলেই তার মাঝে দোদুল্যমানতা সৃষ্টি হতো। এক ধরনের দ্বিধা তার পথরোধ করে দাঁড়াতো। কিন্তু সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে সে আন নাসেরের কাছেই ছুটে আসতো। কেবল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেন, আরো যে কত রকম বাঁধা তার পথ রোধ করে দাঁড়াতো তার কি শেষ আছে?
আজকে রাতের কথাই ধরা যাক, কাফেলা এখানে তাঁবু স্থাপন করার সময় গুমাস্তগীন এক ফাঁকে এসে লিজার কানে কানে বললো, ‘সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে, তখন তুমি আমার তাঁবুতে একটু এসো। তোমার জাতি যে উত্তম উপহার পাঠিয়েছে আমাদের জন্য, তাকে একটু সম্মানিত করতে চাই। শেখ মান্নান তোমাদের যে বিপদে জড়িয়ে ফেলেছিল, আমি সাহায্য না করলে তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন হতো তোমাদের। দেখো, আমি তোমাদের কত কৌশলে শেখ মান্নানের কাছ থেকে মুক্ত করে নিয়ে এলাম। আমাকে কি পুরস্কৃত করবে না তোমরা?’
লিজা এ প্রস্তাবের কোন উত্তর দেয়নি।
গুমাস্তগীন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর এসেছিল খৃষ্টান অফিসার। সে তাকে বললো, ‘লিজা, মহাপ্রভুর অসীম কৃপা, শেষ পর্যন্ত বুড়ো শয়তানের কবল থেকে বেঁচে গেছো তুমি। আমি সময় মত না পৌঁছলে তোমার কপালে যে কি ঘটতো! কারিশমা ঘুমিয়ে গেলে তুমি একটু আমার কাছে এসো। সফরটা আমরা আনন্দময় করে তুলবো।’
এসব দেখেশুনে নিজের সৌন্দর্য ও যৌবনের প্রতি ভীষণ ঘৃণা ধরে গেল লিজার। সে তার তাঁবুতে গিয়ে প্রবেশ করলো। কারিশমা ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু ঘুম এলো না লিজার। সে উঠে বসলো, আলতো পায়ে বেরিয়ে এলো তাঁবু থেকে। ওমাস্তগীন বা খৃস্টান অফিসারের পরিবর্তে সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল আন নাসেরের দিকে। আন নাসেরও তারই চিন্তায় ও অপেক্ষায় জেগে ছিল।
দীর্ঘ সময় তারা টিলার আড়ালে বসে এভাবে কথা বললো। হঠাৎ এক অভাবিত ঘটনা না ঘটলে হয়তো তারা ভোর পর্যন্ত এভাবেই কথা চালিয়ে যেতো।
টিলার আড়ালে বসে তখনো কথা বলছিল ওরা, লিজা আন নাসেরকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় আন নাসের চমকে উঠে বললো, ‘লিজা, চুপ! একটু খেয়াল করে শোন তো! তোমার কানে কোন শব্দ আসছে? ঘোড়র পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছো! শব্দটা মনে হয় এদিকেই ছুটে আসছে।’
‘হ্যাঁ! শব্দটা তো স্পষ্টই শোনা যাচ্ছে।’ লিজা বললো, “চলো, জলদি সকলকে জাগিয়ে দেই। শেখ মান্নান আমাদের পিছু ধাওয়া করেছে, অনেক সৈন্য পাঠিয়েছে সে। আন নাসের দৌড়ে এক টিলার উপর উঠে গেলো। টিলায় দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেল অনেক মশাল। মশালের আলোগুলো ঘোড়ার গতির সাথে তাল রেখে উপর নিচে দুলছে। অনেক ঘোড়া। অন্ধকার রাত বলে দূর থেকেও আলোগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এবং রাতের নিরবতা ছিন্ন করে তাদের চলার আওয়াজও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
আন নাসের দৌড়ে নিচে নেমে এলো। লিজাকে সঙ্গে নিয়ে ছুটলো ঘুমন্ত কাফেলার দিকে। দ্রুত সবাইকে জাগিয়ে তুলে বললো, ‘শেখ মান্নানের ধাওয়াকারী বাহিনী ছুটে আসছে।’
ঘুম জাগা লোকগুলো প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও আন নাসেরের চাপা গর্জন শুনেই বুঝে গেলে কি ঘটেছে। দ্রুত প্রস্তুত হয়ে কমান্ডোরা ছুটলো টিলার দিকে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটলো লিজাও।
গুমাস্তগীনের রক্ষীরা কমাণ্ডোদের কাছে দ্রুত হাতে তলোয়ার ও বর্শা সরবরাহ করে নিজেরাও হাতে তুলে নিল হাতিয়ার। সবাই মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। এমনকি উটের চালকরাও উট ফেলে বর্শা ও তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, তাদের কারো কাছে তীর ধনুক নেই। দূর থেকে হামলাকারীদের বাঁধা দেয়ার কোন সুযোগ নেই। মোকাবেলা করতে হবে সামনাসামনি।
ধাওয়াকারীরা ছিল পনেরো-ষোল জন। ছয়-সাতজনের হাতে মশাল। তারা এসে বিনা বাধায় কাফেলাকে ঘিরে ফেললো। একজন গর্জন করে বললো, ‘মেয়ে দুটিকে আমাদের হাতে তুলে দাও। শেখ মান্নান বলেছেন, মেয়ে দু’টিকে দিয়ে দিলে তোমাদেরকে ছেড়ে দিতে। তোমাদের সাথে কোন সংঘাত বাঁধানোর ইচ্ছে নেই তার। মেয়েদেরকে আমাদের হাতে তুলে দিলেই তোমরা নিরাপদে চলে যেতে পারবে।’
আন নাসের ছিল গেরিলা বাহিনীর সুদক্ষ ও চৌকস কমাণ্ডার। গেরিলা যুদ্ধের যেসব কলাকৌশল তার জানা ছিল, সেগুলো জানতো তার বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরাও।
ঘোষণা শুনে প্রথমেই সে বললো, ‘এই মেয়েরাই আমাদের ধরে এনেছে। ফলে মেয়েরাই আমাদের দুর্গতির জন্য দায়ী। আমরা তোমাদের কেল্লায় ছিলাম। ইচ্ছে করলে তোমরা আমাদের সেখানেই বন্দী করে রাখতে পারতে। কিন্তু তোমরা সহৃদয়তার পরিচয় দিয়ে আমাদের মুক্ত দুনিয়ায় আসার সুযোগ দিয়েছে। এ জন্য আমরা তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সেই কতজ্ঞতার দাবী পূরণের স্বার্থে আমরা মেয়েদের হেফাজতের জিম্মা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছি। তোমরা আমাদের চারজনকে তোমাদের ঘেরাওয়ের বাইরে যেতে দাও, তারপর গুমাস্তগীন ও খৃষ্টান অফিসারের সাথে আলাপ করে দেখো, তারা তোমাদের মোকাবেলা করবে, নাকি স্বেচ্ছায় তোমাদের দাবী মেনে নেবে?’
তার কথায় যুক্তি ছিল, শেখ মান্নানের সৈন্যরা তাদেরকে ঘেরাওয়ের বাইরে যাওয়ার জন্য সুযোগ করে দিল। আন নাসের ও তার তিন সঙ্গী ঘেরাওয়ের বাইরে চলে গেলো।
ধাওয়কারীদের কমাণ্ডার আন নাসেরের ভূমিকায় সন্তুষ্ট হলে এই ভেবে যে, প্রতিরোধকারীদের মধ্যে এর ফলে যে ভাঙন সৃষ্টি হলো তাতে সংঘাত ছাড়াই হয়তো মেয়েদের নিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে এই মেয়েদের সাথে ওমাস্তগীনেরও কোন সম্পর্ক নেই। সে সরে দাঁড়ালে একমাত্র খৃষ্টান অফিসার ছাড়া তাদের মোকাবেলায় আর কেউ থাকে না।
তাই সে গুমাস্তগীনকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আপনি শেখ মান্নানের মেহমান ছিলেন। আপনি জানেন, আপনার সাথে তার কোন সংঘাত নেই। বরং তিনি আপনার একজন শুভাকাঙ্খী ও সহযোগী। তার সাথে আপনার সুসম্পর্ক আছে বলেই তিনি আপনার হাতে আইয়ুবীর চার জানবাজ কমান্ডোর মত মূল্যবান বন্দী তুলে দিয়েছেন। আমরা আশা করছি, বন্দীদের মত আপনিও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে এই সংঘাত থেকে সরে দাঁড়াবেন। আমাদেরকে এই খৃস্টান অফিসার ধোঁকা দিয়েছে। প্রতারণা করে মেয়েদের নিয়ে পালিয়ে এসেছে কেল্লা থেকে। কিন্তু তারপরও শেখ মান্নান বলে দিয়েছেন, সংঘাত ছাড়া যদি খৃস্টান অফিসার মেয়েদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেয়, তাহলে নির্বিঘ্নে তাকে চলে যেতে দিও। এবার আপনাদের মতামত চাই, মেয়েদেরকে আমাদের হাতে তুলে দেবেন, নাকি মোকাবেলা করবেন আমাদের?’
গুমাস্তগীন বা খৃষ্টান অফিসার কাউকে এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার সুযোগ দিল না আন নাসের। সে তার তিন সঙ্গীকে ইশারা করলো এবং নিজেও সঙ্গে সঙ্গে ঝাপিয়ে পড়লো ধাওয়াকারী অশ্বারোহীদের ওপর। পিছন থেকে আক্রান্ত হলো অশ্বারোহীরা, চার কমাণ্ডার বর্শা মুহূর্তে বিদ্ধ করলো চার অশ্বারোহীকে। পলকে পাল্টে গেল পরিস্থিতি। বর্শা বিদ্ধ চার অশ্বারোহী পড়ে গেল ঘোড়া থেকে।
পরিস্থিতির সুযোগ নিল গুমাস্তগীনের রক্ষী বাহিনী। তারাও বর্শা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো হামলাকারীদের ওপর। আন নাসের চিৎকার করে লিজাকে বললো, ‘এদিকে এসো, জলদি ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসো!’
ততক্ষণে আন নাসের নিহত এক অশ্বারোহীর ঘোড়া পাকড়াও করে তার ওপর চড়ে বসেছিল। লিজা ছুটে এসে লাফিয়ে পড়লো ঘোড়র ওপর। লিজাকে নিয়ে ছুটলো আন নাসের। প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে বললো, ‘শক্ত করে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে রাখো।’
শেখ মান্নানের ফেদাইন দলের সাথে প্রাণপণ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো গুমাস্তগীনের রক্ষীদলের। খৃষ্টান অফিসার এবং গুমাস্তগীন নিজেও অস্ত্র তুলে নিল হাতে। শেখ মান্নানের বাহিনী হাতের মশাল ফেলে কেউ তলোয়ার, কেউ বর্শা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
মাটিতে পড়েও মশালগুলো জ্বলতেই লাগলো। আন নাসেরের তিন সঙ্গী তখনও প্রাণপণ লড়াই করে চলেছে।
বিশাল মরুভূমির মাঝে ছোট্ট এক টিলার পাশে চলছিল এ লড়াই। এটা কোন মহাসমর নয়, ছোই দুই দলের মাঝে ক্ষুদ্র এক লড়াই। কিন্তু যারা লড়ছিল, তারা উপলব্ধি কছিল, বিশাল সমরের চাইতেও এ লড়াই ভয়াবহ। কারণ বড় লড়াইয়ে পালানোর মওকা পাওয়া যায়, আত্মসমর্পনের সুযোগ থাকে। কিন্তু এখানে সে সবের কোনই বালাই নেই, হয় মারো, নয় মরো।
প্রথম আঘাতের সাথে সাথেই সতর্ক হয়ে গিয়েছিল ফেদাইন বাহিনী। চার অশ্বারোহী ছাড়া কোন পক্ষেই আর কেউ মারা যায়নি। এ সময় একটি ঘোড়া তীরবেগে ছুটে যাওয়ার শব্দ পেল ওরা। ফিরে তাকিয়ে দেখলো, আন নাসের এক মেয়েকে নিয়ে পালাচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে তার পিছনে ছুটলো তিন ফেদাইন সেনা। আন নাসেরের সঙ্গীরা বাঁধা দিল তাদের। যুদ্ধ টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো।
আন নাসের এ সুযোগে বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেল। কমান্ডোদের বাঁধা ডিঙিয়ে অন্য তিন-চার ফেদাইন সেনা তাদের পাশ কেটে ছুটলো আন নাসেরের পিছনে। শেখ মান্নান যাদের পাঠিয়েছিল তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে ধরাশায়ী হয়ে পড়েছিল। তারা বুঝলো, প্রতিপক্ষকে না মারতে পারলে নিজের মৃত্যু ওরা ঠেকাতে পারবে না। ফলে এবার তারাও মরিয়া হয়ে হামলা চালালো।
দু’পক্ষেই আহত নিহতের সংখ্যা বেড়ে চললো। গুমাস্তগীনের দুই বিশ্বস্ত দেহরক্ষীর বুক এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল তার চোখের সামনে। এ দৃশ্য দেখার পর সে আর দেরী করেনি, এক ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে পড়ে গুমাস্তগীন প্রাণ ভয়ে পালিয়ে গেল সেখান থেকে।
ফেদাইনরা আন নাসেরের পিছনের মেয়েটিকে জীবিত ধরে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছিল। তাই তারা চেষ্টা করছিল, মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রেখে কিভাবে আন নাসেরকে ঘায়েল করা যায়। তারা চার অশ্বারোহী মিলে আন নাসেরকে একত্রে আক্রমণ করেছিল এবং চেষ্টা করছিল তাকে ঘেরাও করে ফেলতে।
আন নাসের দক্ষ সৈনিক। সে দুশমনের প্রতিটি চাল ব্যর্থ করে ছুটছিল প্রাণপণে। বার বার তার ঘোড়াকে বাঁচানোর জন্য বিপদজনক মোড় নিচ্ছিল। ফেদাইনরা চাচ্ছিল তাকে আহত বা নিহত করতে, সে রুখে দাঁড়ানোর পরিবর্তে কোন রকমে আত্মরক্ষা করে চলছিল।
বিপদজনকভাবে ঘোড়া চালাচ্ছিল আন নাসের। এমন বেপরোয়া গতির ঘোড়া আর দেখেনি লিজা। আন নাসের যখন চোখের পলকে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিল, লিজার পা তখন ফসকে যাচ্ছিল রেকাব থেকে। আন নাসেরকে জাপটে ধরে লিজা কোন রকমে তার পতন ঠেকিয়ে রাখছিল।
দুই পাশ থেকে দুই ফেদাইন একত্রে আঘাত করলো আন নাসেরকে। আন নাসের চোখের পলকে ঘুরিয়ে নিল ঘোড়ার মুখ। অল্পের জন্য বেঁচে গেল এ যাত্রা। কিন্তু নিজে বাঁচলেও লিজাকে বাঁচাতে পারলো না। সাবধান হওয়ার আগেই অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ছিটকে পড়ে গেল লিজা।
এক ফেদাইন অশ্বপৃষ্ঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে জাপটে ধরলো লিজাকে। লিজা হাত-পা ছুঁড়ে প্রাণপণে চেষ্টা করছিল তার হাত থেকে মুক্ত হয়ে আন নাসেরের কাছে ছুটে যেতে।
আন নাসের ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে এলো তার দিকে এবং বর্শা উচিয়ে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলো। কিন্তু ফেদাইন সেনা লিজাকে সামনে বাড়িয়ে দিল, বর্শা সরিয়ে নিল আন নাসের। একটু আগে যে দুই ফেদাইন সেনা আন নাসেরকে হামলা করেছিল, ফিরে এসে তারা আবার ঝাঁপিয়ে পড়লো আন নাসেরের ওপর। বর্শা ফেলে তলোয়ার বের করলো ওরা। আন নাসেরও তলোয়ার বের করলো। এক ফেদাইন তার তলোয়ার আন নাসেরের ঘোড়ার পেটে সেঁধিয়ে দিল। ঘোড়াটি মুখ থুবরে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ফেদাইনরাও লাফিয়ে নামলো ঘোড়া থেকে।
সঙ্গীদের কথা স্মরণ হলো আন নাসেরের। এখন তারা কি অবস্থায় আছে কোন সংবাদ সে জানে না। তাদের যে কেউ এখন তার পাশে থাকলে এ চারজনকে সামাল দেয়া কোন ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু একা সে চার গুপ্তখুনীর সঙ্গে পারবে কি চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল। এখন দুশমন চার থেকে চারশ’ হলেও তার কিছু যায় আসে না। জীবনের মায়া ত্যাগ করে সে বেপরোয়া হয়ে উঠলো।
তার সঙ্গে লড়াই করছিল দুইজন, দুইজন ধরে রেখেছিল লিজাকে। তলোয়ারের অবিরাম ঠোকাঠুকির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু ঢুকছিল না তার কানে।
লড়াই করতে করতে আহত ও রক্তাক্ত হয়ে উঠলো তার শরীর। আহত হয়েও চিতা বাঘের মত দ্রুত আঘাত হেনে শেষ পর্যন্ত ওদের ঘায়েল করে ফেললো সে। ওই দু’জনকে ঘায়েল করার পর লিজাকে যারা ধরে রেখেছিল ছুটে এসে তাদের ওপর হামলা করলো আন নাসের। আবার শুরু হলো তরবারির ঝনর ঝন।
লিজা চিৎকার করে বললো, ‘আন নাসের, তুমি সরে যাও! আমার জন্য প্রাণ দিও না। দোহাই খোদার, জলদি সরে পড়ো, তুমি একা এবং আহত! ওদের সাথে তুমি কুলিয়ে উঠতে পারবে না।’
কিন্তু এ চিকারের দিকে কান দেয়ার মত সময় ছিল না আন নাসেরের। সে পাগলের মত লড়াই করে চললো। লিজা চিৎকারের পর চিৎকার দিয়ে যাচ্ছিল। আন নাসের ধমকে উঠে বললো, ‘চুপ করো লিজা! ভয় নেই, এরা তোমাকে নিয়ে যেতে পারবে না। সে সুযোগ আমি ওদের দেবো না।’
আন নাসের বাস্তবেও তাই করে দেখালো। ফেদাইনরা লিজাকে নিয়ে যেতে পারলো না। সে দুই ফেদাইন সেনাকে গুরুতর আহত করে মাটিতে ফেলে দিল।
এই যুদ্ধ চলছিল মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে। আন নাসেরের সামনে আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। সে একটি ঘোড়া ধরে এনে প্রথমে নিজে তাতে চড়ে বসলো এবং লিজাকেও তার সঙ্গে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করতে বললো। লিজা উঠে বসতেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিল আন নাসের। লিজা ভেবেছিল, আন নাসের তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। কিন্তু সে পালালো না, ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দিল যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। ক্যাম্পের পাশে যে টিলার আড়ালে বসে রাতে গল্পে মেতে উঠেছিল সে আর লিজা, ঘোড়া এগিয়ে চললো সে টিলার দিকে।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। আন নাসের ও লিজা সেখানে গিয়ে দেখলো, সেখানে পড়ে আছে দু’পক্ষের নিহত সৈন্যদের লাশ। তখনো দু’তিনজন ফেদাইন সৈন্য আহত হয়ে ছটফট করছিল। আন নাসের লাশগুলো দেখলো একে একে। তার তিন সঙ্গীর কেউ পিঠটান দেয়নি। মরার আগ পর্যন্ত তারা যে বীরের মত লড়াই করেছিল তার সাক্ষী পাশে পড়ে থাকা ফেদাইনদের লাশগুলো। খৃষ্টান অফিসারের লাশও পাওয়া গেল। তার লাশটি পড়েছিল গুমাস্তগীনের এক রক্ষীর লাশের ওপর।
কারিশমার লাশ কোথাও পাওয়া গেল না। বুঝতে পারলো না, সে গুমাস্তগীনের সাথে পালিয়েছে, নাকি শেখ মান্নানের লোকেরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে। কারণ যুদ্ধে কোন পক্ষ জিতেছে লাশ দেখে তা বুঝতে পারলো না আন নাসের।
‘কারিশমা নিখোঁজ। জানি না কি গতি হয়েছে তার।’ আন নাসের বললো, ‘এখানে তার লাশ নেই।’
লিজা বিহবল হয়ে তাকিয়ে দেখছিল লাশগুলো। অন্তর তার কাঁদছিল বোবা বেদনায়। সে জানে, এখানকার প্রতিটি লাশের কারণ সে নিজে। একদল মরেছে তাকে ছিনিয়ে নিতে এসে, অন্যরা মরেছে তার জীবন ও সতীত্ব রক্ষার জন্য। এই লাশগুলোর জন্য তার নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছিল।
আন নাসের তার বেদনার্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘লিজা, আল্লাহ যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছে, কেউ তা খন্ডাতে পারবে না। নিয়তির হাতে বন্দী আমাদের জীবন। এদের জন্য দুঃখ করে কিছু করতে পারবো না আমরা।’
লিজা বেদনা বিধুর কণ্ঠে বললো, ‘কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র। একটু আগেও এরা জীবিত ছিল, এখন নেই। এদের পরিবর্তে তোমার আমার লাশও তো এখন এখানে পড়ে থাকতে পারতো!’
আন নাসের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘হ্যাঁ, মানুষের জীবন কচুপাতার পানির মতই ক্ষণস্থায়ী। অথচ এই জীবন নিয়ে আমাদের কত বড়াই! ভোগের কি দুর্মর আকাঙখা! লোভের ও দম্ভের হুড়াহুড়ি!’
‘চলো এবার যাওয়া যাক। এখান থেকে দ্রুত সরে পড়া দরকার আমাদের।’
‘চলো।’
ও আর দেরী করলো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে ধ্রুব তারার সাহায্যে গতিপথ নির্ধারণ করলো আন নাসের। তারপর সঙ্গী সাথী বিহীন ওরা দু’জন আবার নেমে এলো পথে। পিছনে পড়ে রইলো দুঃস্বপ্নের রাত, যে রাতের স্মৃতি ওরা জীবনে কোনদিন ভুলতে পারবে না।
আহত ও রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বাকী রাত এক নাগাড়ে পথ চললো আন নাসের। মাথার ভেতর এলোমেলো চিন্তার ঝড়ো তাণ্ডব। নিয়তি, হ্যাঁ, নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! যাদের নিয়ে সে পথে নেমেছিল সভ্যতা ও মানবতা রক্ষার কঠিন শপথ নিয়ে, আজ তারা কেউ নেই সঙ্গে। অথচ যাদের বিরুদ্ধে তাদের এই জাতিগত লড়াই, সেই খৃষ্টান ক্রুসেডারদেরই এক গোয়েন্দা সদস্যাকে দুশমনের হাত থেকে বাঁচিয়ে সঙ্গী করে নিয়ে যাচ্ছে সাথে। নিঃসঙ্গ মরুভূমিতে দলছুট ঘোড়ার মত ছুটে চলেছে তাদের ঘোড়া। ঘোড়া এগিয়ে যাচ্ছে সামনে আর স্মৃতির পাতা হাতড়ে সে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছিল পিছনের দিকে।
ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূর চলে এসেছে ওরা। রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আরো একটি নতুন দিন আসছে পৃথিবীতে। আকাশ ফর্সা হচ্ছে। পূর্ব দিকের আকাশে লালের আভা দেখা যাচ্ছে। সে আভার ভেতর থেকে একটু পরই উঁকি দেবে রাঙা সুরুজ। শুরু হবে নতুন করে জীবনের পথ চলা।
আন নাসের অশ্ব থামালো। লিজার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এখন বলো, তুমি কোথায় যেতে চাও?’ সে লিজাকে বললো, ‘আমি তোমাকে একা পেয়ে তোমার অসহায়ত্বের সুযোগ নেবে, এমনটি ভেবো না। তুমি নিরূপায় হয়ে আমার সঙ্গ নাও, এটা কখনোই আমার কাম্য নয়।
তুমি যেখানে যেতে চাও, সেখানে পৌঁছে দেয়া আমার দায়িত্ব। আইয়ুবীর কোন কমান্ডো নারীর ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলে না। অতএব তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই। যদিও এখন আমি সঙ্গীহারা, তবু তুমি আমার আমানত। আমরা আমানতের খেয়ানত করি না। যতই কষ্ট হোক, এ আমানতের হেফাজত আমি একাই করবো।
যদি বলো, তবে তোমাকে তোমার দেশে পৌঁছে দিয়ে আসি। আমি এখন একা, অতএব তোমার হেফাজত ছাড়া আমার আর কোন দায়িত্ব নেই, তাই আমার জন্য কোন চিন্তা করবে না!’
ভোরের শীতল বাতাসের চাইতেও আন নাসেরের কণ্ঠ তার কাছে অধিক নির্লিপ্ত ও ঠাণ্ডা মনে হচ্ছিল। গত রাতের সেই আবেগঘন মুহূর্তের আলাপ আর এই উচ্চারণ একই কণ্ঠ থেকে বের হচ্ছে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তার। কিছুক্ষণ সে কোন কথাই বললো না। তারপর এক সময় মুখ তুলে আকুতিভরা কণ্ঠে বললো, ‘তুমি আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলো।’ লিজা তাকে বললো, ‘আন নাসের! আমাকে একটু আশ্রয় দাও।’