» » বিষাক্ত ছোবল

বর্ণাকার

এখন গভীর রাত। চারদিকে রাতের আঁধার ও নিস্তব্ধতা। কেল্লার কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় বাতি জ্বলছে। তার আলোয় আশপাশের সামান্য অংশই আলোকিত। ঘন এবং চাপ চাপ অন্ধকার কেল্লার সবখানে। আকাশে চাঁদ নেই। তারার আলোও নিষ্প্রভ। সম্ভবত হালকা মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে তারকারাজি।

আন নাসের খৃষ্টান অফিসারের কামরা থেকে বেরিয়ে এলো। খৃষ্টান অফিসার এবং গুমাস্তগীন অনেক তর্ক-বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত তার দাবী মেনে নিয়েছে, এ জন্য খুশী আন নাসের। বন্ধুদের কামরার দিকে হাঁটা দিল সে।

বারান্দা ধরে হাঁটছে আন নাসের, মেয়েলি কণ্ঠের একটি ভূতুড়ে ডাকে থমকে দাঁড়ালো সে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো, কে ডাকে। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না।

খৃষ্টান অফিসার এবং গুমাস্তগীনের আচরণ তাকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। এরা যদি তার সাথে শত্রুর মত নির্দয় আচরণ করতে তবে তা সে সহজভাবেই মেনে নিতে পারতো। কিন্তু বন্দীর সাথে এটা কোন ধরনের ব্যবহার! গুমাস্তগীনের মত দাম্ভিক ব্যক্তিটি কি আসলেই ভাল হয়ে গেছে! সে যে যুদ্ধে যায়নি এটা তো পরিষ্কার। তার সাথে তারা এমন সম্মানজনক আচরণ করলো ও এমনভাবে কথা বললো, যার কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না আন নাসের।

আন নাসের কামরা থেকে বেরোনোর আগেই লিজা ও কারিশমা বেরিয়ে গিয়েছিল কামরা থেকে। আন নাসের যখন কামরা থেকে বেরিয়ে বারান্দা ধরে ধীর পদে হেঁটে যাচ্ছিল, মেয়েলি কণ্ঠের ছোট্ট একটি ডাক আবার তাকে থামিয়ে দিল। বারান্দার এ অংশটা ডুবে ছিল অন্ধকারে, আন নাসের থামতেই একটি কালো ছায়া তার সামনে এগিয়ে এলো।

ছায়াটি লিজার। সে এসে আন নাসেরের বাহু চেপে ধরে বললো, ‘এখন তো তোমার বিশ্বাস হয়েছে, আমি পরী নই, নির্ভেজাল এক মানব কন্যা?’

‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, আমাদের নিয়ে এসব কি হচ্ছে?’ আন নাসের রুষ্ঠ কণ্ঠে বললো, ‘আমি একজন কয়েদী, অথচ আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করা হচ্ছে, যেন আমি কোন রাজপুত্র!’

‘এতে তোমার অবাক হওয়ার কিছু নেই।’ লিজা বললো, ‘একটু বুঝার চেষ্টা করো, মাথা খাটাও, সব তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। গুমাস্তগীন তো তোমাকে বলেই দিয়েছে, তিনি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে শত্রুতা বাদ দিয়েছেন। এখন তিনি আইয়ুবীর কোন সৈন্যকে আর যুদ্ধবন্দী মনে করেন না। তুমি এবং তোমার সঙ্গীদের বড় সৌভাগ্য যে, তোমরা এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলে, আর একই সাথে গুমাস্তগীনও এখানে এসে পড়েছিলেন।

দ্বিতীয় কারণটি আমার একান্ত নিজস্ব, বলতে পারো ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি আমার মর্যাদা ও পরিচয় কিছুই জানো না। আমি তোমার দৃষ্টিতে একজন নষ্টা মেয়ে বৈ কিছু নই। ধনী আমীর ও সামরিক অফিসারদের বিলাসিতার উপকরণ মাত্র। যদি তুমি এটাই ভেবে থাকো, তাহলে বলবো, তুমি মিথ্যা ধারণা ও সন্দেহের রাজ্যে বসবাস করছে!

লিজা তার বাহু টেনে ধরে বললো, ‘এসো, এটা কথা বলার মত উপযুক্ত জায়গা নয়। সব কিছু জানতে হলে চলো কোন গোপন জায়গায় নিরিবিলিতে গিয়ে বসি।’

লিজা তাকে টানতে টানতে বারান্দা থেকে নামিয়ে বাগানে নিয়ে গেল। বাগানের এক কোণে বসতে বসতে বললো, ‘এখানে মাথা ঠাণ্ডা করে বসো। দেখি তোমার সন্দেহ দূর করা যায় কিনা।’

‘মাখা তো আমার কখনোই গরম ছিল না।’ বসতে বসতে বললো আন নাসের, ‘কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।’

‘তুমি যে এখন মুক্ত স্বাধীন, এটা তো বুঝতে পেরেছে! নইলে এই গভীর রাতে কারাগারের পরিবর্তে এক যুবতীকে নিয়ে বাগানের অন্ধকারে বসে থাকতে পারতে না, এটা বোঝ?’

‘হ্যাঁ, এটুকু বুঝতে পারছি।’

‘তাহলে এবার বলল, আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা কি? আমি কি জ্বীন না মানুষ আমার সম্পর্কে তোমার মন্তব্য আগে শুনে নেই, তারপর সবই তোমাকে খুলে বলবো।’

দুর্গের এ অংশটি ছিল একটি বাগান। চারপাশে ফুলের গাছ, মাঝখানে খোলা মাঠ। মাঠের মাঝে ফাঁকা জায়গায় বড় বড় পাথর দিয়ে বসার আসন তৈরী করা হয়েছে। তারই একটিতে বসলো ওরা। বিকেলে এখানে বেড়াতে আসে কেল্লায় আগত মেহমান ও অফিসাররা। সন্ধ্যার পরও হয়তো কিছুক্ষণ থাকে, কিন্তু এখন এই গভীর রাতে বাগানে ওরা দু’জন ছাড়া আর কেউ ছিল না।

আন নাসের আশপাশে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিল বাগানটি কেমন পরিপাটি। বিচিত্র ফুলের সৌরভ ভেসে আসছিল তার নাকে, কিন্তু অন্ধকারের জন্য কোথায় কি গাছ আছে বুঝা যাচ্ছিল না।

আন নাসের দৃষ্টি প্রসারিত করে দূরে তাকালো। দুর্গের প্রাসাদগুলোর বিন্যাস দেখে বুঝতে পারল, দুর্গটি বেশ বড় এবং দুর্গটি লম্বাটে ধ্বনের।

লিজা আন নাসেরকে প্রাসাদ থেকে বের করে যেখানে নিয়ে এসেছে, সে জায়গাটি খুবই মনোরম। ওরা পাথরের ওপর বসে যখন আলাপ করছিল, আন নাসের ধরেই নিয়েছিল, কেউ তাদের দেখতে পাচ্ছে না, তাদের এ আলাপও কেউ শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু প্রাসাদের বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বহু দূর থেকেও ওদের দেখতে পাচ্ছিল খৃস্টান অফিসার এবং কারিশমা। কারিশমা বারান্দার এক পিলারের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে নীরবে তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে।

‘লিজা কি তাকে তার যাদুর ফাঁদে ফেলতে পারবে!’ খৃষ্টান অফিসার শঙ্কিত কণ্ঠে বললো।

‘হ্যাঁ, লিজা খুব আবেগী মেয়ে।’ কারিশমা বললো, ‘ভাবছি, ভাব করতে গিয়ে সে তার মূল দায়িত্বই না ভুলে যায়!

‘আসলে এতো অল্প বয়সে তাকে এ ধরনের জটিল ডিউটিতে পাঠানো উচিত হয়নি আমাদের।’ খৃস্টান অফিসারের কণ্ঠে সহানুভূতির সুর।

‘আরে, এতো ঘাবড়ানোর কি আছে! আমরা তার সঙ্গে আছি না! আর সেও একেবারে কচি খুকী তো নয়, আশা করি ঠিকই সামলে নিতে পারবে। যদি কুলিয়ে উঠতে না পারে, আমি তো আছিই।’

ওরা যখন এসব বলাবলি করছিল, লিজা তখন আন নাসেরকে বলছিল, ‘তুমি তো আমাকে জিজ্ঞেস করছিলে, আমি তোমার প্রতি কেন এত সদয় হয়েছি। তুমি তো তখন আমাকে শক্র তেবেই একথা জিঞ্জেস করছিলে। আচ্ছা, তুমিই বলো তো, তোমার আমার মাঝে কিসের শত্রুতা? শত্রুতা তো তোমার ও আমার সুলতান ও সম্রাটের ব্যাপার। তাদের সে শত্রুতা তোমার ও আমার মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করবে কেন?’

‘আর বন্ধুত্বই বা কেমন করে, হবে, যেখানে আমরা দুই প্রতিদ্বন্দী দলের সদস্য।’ আন নাসের জিজ্ঞেস করলো।

‘সেটা তো লড়াইয়ের ময়দানের ব্যাপার! আচ্ছা, এটা কি কোন যুদ্ধের মাঠ, নাকি এখানে এখন কোন সংঘাত চলছে। এই নিস্তব্ধ রাত, এই শীতল হাওয়া, এই ফুলের সুবাস, এই নির্জনতা, এরা কি যুদ্ধের কথা বলে, নাকি প্রেমের বারতা বয়ে আনে?’

‘প্রেমের বারতা তো প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য, আমরা তো যোদ্ধা, আমরা কমাণ্ডো সৈনিক। প্রেমের ভাবালুতায় মজে যাওয়ার সময় কোথায় আমাদের?’

লিজা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত বাতাস যেন আন নাসেরকে স্পর্শ করে গেল। লিজা তার কোমল বাহু আন নাসেরের কাঁধে রেখে বললো, ‘তুমি কি সত্যি এক কঠিন পাথর? আমি শুনেছিলাম, মুসলমানের মন রেশমের মত নরম ও কোমল। ধর্ম বিষয়টা কিছুক্ষণের জন্য দূরে সরিয়ে রেখে তুমি কি নিজেকে এবং আমাকে মানুষ ভাবতে পারো না? তুমি মুসলমান আর আমি খৃষ্টান, এটা তো পরের ব্যাপার, পৃথিবীতে আমরা তো এসেছি মানুষ হিসাবে! সেই মনুষত্বের কি কোন মূল্য নেই। আমাদের উভয়ের বুকের মধ্যে আল্লাহ যে একটা কোমল মন দিয়েছেন, তাকে কি তুমি অস্বীকার করতে চাও? চোখ বন্ধ করে একটু হৃদয়ের হাহাকার শোন। উপরের আবরণ সরিয়ে অন্তরের অন্তস্থলে যে সুরের মূর্ছনা বাজছে, কান পেতে শোন সে আওয়াজ। নিজের আত্মাকে জিজ্ঞেস করো, সে কি চায়? চারদিক থেকে একটি ধ্বনিই কেবল শুনতে পাবে তুমি, ভালবাসা, ভালবাসা। এই ভালবাসাকে যে অস্বীকার করে, সে মানুষ নয়। হয় সে ফেরেশতা, নয়তো শয়তান। জানি না তুমি এর কোনটি।’

‘দেখো লিজা! আমি ফেরেশতাও নই, শয়তানও নই। আর দশজন রক্তমাংসের মানুষের মত আমিও মানুষ। কিন্তু আমার যেমন আত্মা আছে তেমনি বিবেকও আছে। আত্মা আমার কাছে অনেক কিছুই চায়, কিন্তু আমি ততটুকুই তাকে দেই, যতটুকু বিবেক অনুমোদন করে। মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য কি জানো? পশু আত্মার গোলামী করে আর মানুষ বিবেকের হুকুম মতো চলে। তুমি কি তোমার বিবেককে অস্বীকার করতে চাও? তুমি কি বলতে চাও, তোমার মধ্যে বিবেক বলে কিছু নেই?’

‘হয়তো আছে, হয়তো নেই?’ লিজা উদাস কণ্ঠে বললো, ‘তুমি পুরুষ মানুষ! তুমি তোমার মনকে বাঁধতে পারো। কিন্তু আমি যে এক অবলা নারী! আমার তো সে শক্তি ও সাহস নেই, যা দিয়ে আমি বশ করবো আমার চিত্তকে। আমি আমার অন্তরের হাহাকার শুনব, তার বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হবো। আমার রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত চিত্ত দেখে আমার দুর্বল মন ছন্নছাড়া হয়ে যাবে, এইতো আমাদের নিয়তি! আচ্ছা, বলতে পারো নিয়তি এত নিষ্ঠুর কেন?’

‘নিয়তিকে অযথা দোষারোপ করছো কেন, সে তো আমাদের দুজনকে দুই আলাদা ঠিকানা ঠিক করে দিয়েছে, যাতে বেদনার তীর পরস্পরকে বিদ্ধ করতে না পারে।’

‘না, ভুল বললে তুমি। দু’দিন আগেও আন নাসের বলে কাউকে চিনতাম না আমি। নিয়তিই তোমাকে আমার কাছে এনে দিয়েছে। তোমাকে দেখে আমার চোখে নতুন স্বপ্নের বীজও বুনেছে নিয়তিই। আমার মনের ভেতর তোমার যে ছবি অক্ষয় হয়ে আছে, সে ছবি কে এঁকে দিয়েছে আমার মনে? এটাও নিয়তিরই কাজ। আমার মনের মনিকোঠায় তোমার যে ছবি খোদাই করা হয়েছে, পৃথিবী উল্টে গেলেও সেখান থেকে কেউ কোন দিন তা সরাতে পারবে না।’

‘লিজা, এসব কথা বলে আমাকে তুমি পটাতে পারবে না। ট্রেনিং দেয়ার সময়ই এ ব্যাপারে আমাদের সাবধান করা হয়েছে। তোমাদের পাতা ফাঁদে পা না দেয়ার জন্য বার বার সতর্ক করা হয়েছে আমাদের অতএব আমার পেছনে সময় ব্যয় না করে তুমি অন্য কাজে মন দিতে পারো।’

‘কি! আমাকে তুমি তাদের দলে ফেলতে চাও, যারা প্রতারক, ধোঁকাবাজ। তোমার বিশ্বাস, ভালবাসার কথা বলে আমি তোমাকে ফাঁদে জড়াতে চাইছি। কিন্তু না, এটা তোমার ভুল ধারনা।’

লিজা কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে লাগলো, ‘তাহলে শোন, আমি তোমাকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এই দুর্গে নিয়ে এসেছিলাম। শেখ মান্নান তোমাদের চারজনকেই কারাগারের গোপন প্রকোষ্ঠে বন্দী করার হুকুম দিয়েছিল। যদি তোমাদেরকে সেখানে সত্যি বন্দী করা হতো, তবে তোমাদের লাশ ছাড়া আর কিছুই সেখান থেকে বের হতো না। আমি তোমাদের এই পরিণতির কথা স্মরণ করে শিউরে উঠলাম। শেখ মান্নানকে বললাম, এরা তোমার কয়েদী নয়, আমাদের শিকার। এরা আমাদের হেফাজতেই থাকবে। এই নিয়ে ওর সাথে আমাদের অনেক কথা কাটাকাটি হয়। সে শর্ত আরোপ করে বলে, যদি তুমি এই বন্দীদেরকে কয়েদখানার জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে চাও, তবে এক শর্তে আমি তা মেনে নিতে পারি, তুমি আমার স্বপ্নপুরীতে এসে আমার আশা পূরণ করবে। কিন্তু শেখ মান্নানের মত জঘন্য খুনীকে আমি ঘৃণা করি। তার মত এক বুড়োর কুৎসিত আহবান প্রত্যাখ্যান করে আমি বলি, এটা কিছুতেই সব নয়।’ শেখ মান্নানও তার শর্তে অনড়। বললো, “ঠিক আছে, এই চার কমান্ডো কারাগারে থাকবে নাকি তুমি আমার স্বপ্নপুরীতে আসবে, এটা তুমিই ফায়সালা করো। এ শর্তের কোন নড়চড় হবে না।’

কারিশমা আমাদের ঝগড়া থামাতে অনেক চেষ্টা করেছে। সে একবার শেখ মান্নানকে বুঝায়, একবার আমাকে। কিন্তু আমরা উভয়েই যার যার সিদ্ধান্তে অটল থাকি। তখন কারিশমা আমাকে একদিকে টেনে নিয়ে বললো, ‘লিজা, এটা শেষ মান্নানের দুর্গ। আমাদের মত দুই মেয়ে তার সাথে লাগালাগি করে কখনো পারবো না। তুই যদি শেখ মান্নানের কাছে নাও যাস, আপাতত তুই তার শর্ত মেনে নে। তারপর কি করা যায় আমি দেখবো।’

আমার তখন জিদ চেপে গেছে। যে করেই হোক তোমাদের আমি মুক্ত রাখার অটল সিদ্ধান্ত নিলাম। কেন যেন আমার তখন মনে হচ্ছিল, যুগ যুগ ধরে তুমি আমার পরিচিত। আমি যেন তোমাকে আজ থেকে নয়, সেই ছোট বেলা থেকেই ভালবেসে এসেছি। শুধু তোমার জন্যই আমার এ দেহ ও মন এত যত্ন করে গড়ে তুলেছি। আমি শেখ মান্নানের শর্ত মেনে নিয়ে তোমাদের মুক্ত করে নিলাম।’

‘তুমি কি তোমার সম্ভ্রম ও ইজ্জত কুরবানী করে দিয়েছ?’ আন নাসের উদ্বিগ্ন হয়ে ব্যথিত কণ্ঠে বললো।

‘না!’ লিজা বললো, ‘আমি শুধু তাকে ওয়াদা দিয়েছি। বলেছি, দুদিন সময় দাও, আমার শরীরটা এখন ভাল নেই। শরীর ঠিক হলেই তোমার ডাকে আমি সাড়া দেবো। এই বলে তাকে ঠেকিয়ে রেখেছি।’

“তুমি খুব বেশী ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে লিজা। শেখ মান্নান মানুষ নয়।’

‘জানি, কিন্তু সে আমার আশ্বাসেই খুশী। আমার সম্মতি গুনে সে খুশীতে ডগমগ হয়ে বলেছে, ঠিক আছে, ভাল হওয়ার আগ পর্যন্ত যত খুশী কেল্লার ভেতর মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘুরে ফিরে বেড়াও, ভাল হলেই চলে আসবে আমার কাছে।’

আন নাসের বললো, ‘ঠিক আছে, তুমি চাইলে আমি তোমার ইজ্জত ও সম্ভ্রমের হেফাজত করবো।’

‘আমি কি তাহলে ধরে নেবো, তুমি আমার ভালবাসাও গ্রহণ করেছো?’ লিজা তার ডাগর দু’চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলো আন নাসেরকে।

আন নাসের এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। সে তখন ভাবছিল তার প্রশিক্ষণকালীন শিক্ষার কথা। ট্রেনিং দেয়ার সময় তাদের বার বার সাবধান করে বলা হয়েছে, ইহুদী ও খৃষ্টান মেয়েদের থেকে সব সময় দূরে থাকবে। তারা তাদের রূপ ও যৌবনের পসরা নিয়ে তোমাদের সমোহিত করতে চাইবে। ভালবাসার নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতে জালে আটকাতে চেষ্টা করবে তোমাদের।

কিন্তু সে সাবধানতা মুখের ভাষা ও কিছু উপদেশ ছাড়া আর কিছু ছিল না। এসব মেয়েদের ফাঁদ কত ভয়ংকর এবং জাল কত শক্ত হতে পারে, এ সম্পর্কে কোন বাস্তব ধারনা ছিল না আন নাসেরের। আন নাসের ও তার সঙ্গীরা নারীর চাক্ষুষ হামলার শিকার হয়নি কোনদিন। ফলে সতর্কতা সত্ত্বেও এমন হামলা থেকে বাঁচার কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা বা ট্রেনিং তারা পায়নি।

এখন যখন এক খৃস্টান মেয়ে তাকে এই ফাঁদে ফেলার চক্রান্ত করছিল, তখন মানুষের স্বভাবগত দুর্বলতার শিকার হতে লাগলো আন নাসের। তার জ্ঞান ও বুদ্ধি ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে লাগলো, সেখানে প্রভাব ফেলতে লাগলো বিভ্রান্তির মোহ। সে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকা রাশিতে এবং কন্টকাকীর্ণ জঙ্গলে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে অভ্যস্ত! ভীতি কখনো তাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। কিন্তু এখনকার ধন্দ তো তার প্রজ্ঞার সাথে আবেগের। প্রজ্ঞাকে সজাগ ও সচল রাখতে হয় সক্রিয় চেতনার মাধ্যমে আর আবেগ পরিবেশের হাতে পড়ে আপনাতেই চেপে বসে মানুষের মনের গোপন তন্ত্রীতে। একটির জন্য দরকার সচেতন কর্মপ্রয়াস অপরটির জন্য দরকার এই প্রয়াসের সামান্য নিষ্ক্রিয়তা। ফলে সচেতন না থাকলে সহজেই মানুষ আবেগ-বন্দী হয়ে পড়ে। আন নাসের সেই নিষ্ক্রিয়তারই শিকার হতে লাগলো।

সে লিজার মত এমন আকর্ষণীয় ও সুন্দরী মেয়ে জীবনে কখনও দেখেনি। প্রথম যখন সে লিজাকে দেখেছিল, তখন তার সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করলেও সেই সৌন্দর্যের প্রতি বিন্দুমাত্র। আকর্ষণ সৃষ্টি হয়নি তার। কিন্তু এখনকার পরিবেশ ভিন্ন। লিজার রেশমের মত কোমল চুল কখনও তার গাল, কখনও বাহু স্পর্শ করছিল। সেই স্পর্শ তার অস্তিত্বে জাগিয়ে তুলছিল এক অনাস্বাদিত শিহরণ। সেই শিহরণে বার বার তার দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

তার জীবনে এমন ঘটনাও ঘটেছে, শক্রর নিক্ষিপ্ত তীর কয়েক বারই তার দেহকে স্পর্শ করে চলে গেছে। বর্শার আঘাতে তার শরীরের চামড়া ছিড়ে গেছে, তবুও সেদিকে সে খেয়াল করেনি, এমনকি ভীতও হয়নি। তীর ও বর্শার আঘাত তার মনে কোনই কম্পন জাগাতে পারেনি। মৃত্যুও কয়েকবার তার সামনে দিয়ে চলে গেছে, কিন্তু তাকে ভড়কে দিতে পারেনি। সে আগুন নিয়ে খেলেছে। দুশমনের রসদ ভাণ্ডারে আগুন দিয়ে সেই অগ্নিশিখার ভেতর থেকে সে হাসতে হাসতে লাফিয়ে বেরিয়ে এসেছে দ্বিধাহীন চিত্তে। সেই বীর আজ নতুন এক আক্রমণের শিকার। কি করে এই আক্রমণের মোকাবেলা করবে, তা তার জানা নেই। অবস্থা এখন এমন যে, সে যে আক্রান্ত এই অনুভূতিও যেন সে হারিয়ে ফেলছে।

সামান্য এক অবলা মেয়ের চুলের সৌরভ ও তার কণ্ঠের যাদু আন নাসেরের মধ্যে যেন ভূ-কম্পনের মত কাঁপন সৃষ্টি করলো। সেই কাঁপন যেন তাকে অবশ করে ফেললো। সেই আবেশ বিহবলতার কারণে এই মেয়ের মাদকতাময় প্রলোভন থেকে বাঁচার চেষ্টা বাদ দিল আন নাসের। তীর ও বর্শার আঘাত থেকে বাঁচার যেমন চেষ্টা ছিল তার, তেমন কোন চেষ্টা করলো না সে, এমনকি চেষ্টা যে করতে হবে এই কথাও যেন সে ভুলে গেল।

লিজা তার যতই কাছে সরে আসছিল, এই আচ্ছন্নতা ততই তাকে আরও তীব্রভাবে গ্রাস করছিল। এক সময় আন নাসেরের মনে হলো, লিজাকে নিবিড় করে কাছে পাওয়ার স্বপ্ন বা ইচ্ছে তার মধ্যেও জেগে উঠছে।

লিজা ছিল ট্রেনিং পাওয়া যুবতী। কেমন করে শিকারীকে বশীভূত করতে হয় তার সব ছলাকলাই জানা ছিল তার। সে তার এতদিনের শেখা বিদ্যা বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখছিল।

আন নাসেরের হৃদয়ে আকাঙখার পিপাসা জাগলো। এ এমন এক পিপাসা, মরুভূমির পিপাসার সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই। এ পিপাসার ধরন ভিন্ন, পিপাসা নিবৃত্তির পদ্ধতিও ভিন্ন। পানি দিয়ে সে পিপাসাকে নিবৃত্ত করা যায় না।

রাত যতই বেড়ে চললো, আন নাসের হারিয়ে যেতে লাগলো। লিজার ভুবনে। প্রথম তার দেহ কাঁপলো, পরে তার ঈমান কাঁপলো, তারপর আবেগের স্রোত এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চললো অজানা স্বপ্নের রাজ্যে।

‘হ্যাঁ!’ আন নাসের আবেগমথিত স্বরে বললো, ‘আমি তোমার ভালবাসা গ্রহণ করে নিলাম। কিন্তু এর পরিণাম কি হবে জানি না।’

‘নাসের! পরিণামের কথা আমিই কি জানি! তোমার সাথে এভাবে দেখা হবে, তোমাকে দেখেই আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলবো তোমার মধ্যে, দুদিন আগেও কি আমি তা জানতাম? তোমার আমার ধর্ম আলাদা, জগত আলাদা, অথচ সে স্ব অবলীলায় তুচ্ছ করে আমরা দুজন একাকার হয়ে যাবে, কে জানতো এ কথা?’

অন্ধকারের মাঝেও তারার আবছা আলোয় ওরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আন নাসেরের হৃদয় তোলপাড় করছিল নানা রকম জটিল দ্বন্দ্বে। সে লিজার দিকে তাকিয়ে বললো, “আচ্ছা, তুমি কি আমাকে আমার ধর্ম ত্যাগ করে তোমার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বলবে? তুমি কি এখন আমাকে তোমার সঙ্গে যেতে বলবে?’

‘না, আমি এমন কোন সিদ্ধান্ত তোমার ওপর চাপিয়ে দেয়ার কথা কখনো ভাবিনি।’

লিজা বললো, ‘যদি তুমি আমার সঙ্গে যেতে চাও, যাবে। আর যদি আমাকে জীবনের মত সঙ্গিনী করে তোমার সাথে নিয়ে যেতে চাও, আমি খুশী মনে তোমার হাত ধরে পথে নামতে রাজি। ধর্মকর্ম আমি কখনো তেমন একটা করিনি। যদি তুমি চাও, ধর্ম ত্যাগ করতেও আমার কোন আপত্তি নেই। তোমার জন্য যে কোন ত্যাগ ও কুরবানী করতে আমি প্রস্তুত। আমার পবিত্র ভালবাসার কসম, ভালবাসা ছাড়া তোমার কাছে আমি আর কিছুই চাই না। আমার নিষ্কলুষ প্রেম পার্থিব চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে। তুমি যেমন আমার হৃদয়ে আসন গেড়ে বসে আছে, আমি শুধু তেমনি তোমার আত্মায়, তোমার চেতনায় একটু ঠাঁই চাই।’

প্রেমের জালে পুরোপুরি বন্দী হয়ে গেল আন নাসের। রাত তখন অর্ধেকেরও বেশী পার হয়ে গেছে। আন নাসের তবু সেখান থেকে উঠার নাম নিল না। এক সময় লিজাই তাকে বললো, ‘রাত প্রায় শেষ হতে চললো। কেউ এভাবে আমাদের দেখে ফেললে পরিণতি খুবই খারাপ হবে। তুমি তোমার কামরায় চলে যাও। কি করে আমরা এখান থেকে বের হবো সে চিন্তা আমি করছি। আমাদের এ সম্পর্কের কথা এখন কাউকে বলার দরকার নেই। কখন কি করতে হবে সময় মত সব আমি তোমাকে জানাবো।

❀ ❀ ❀

আন নাসের কামরায় প্রবেশ করলো। তার সঙ্গীরা তখন গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। সেও শুয়ে পড়লো, কিন্তু তার চোখে ঘুম এলো না। লিজাও তার কামরায় প্রবেশ করলো। দেখলো কারিশমা ঘুমিয়ে আছে। সে পোশাক পাল্টাতে শুরু করলো। তখনই চোখ মেলে চাইলো কারিশমা। ‘এত দেরী হলো যে?’ কারিশমার প্রশ্ন।

‘আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনীর পাথর গলানো কি এতই সহজ যে, এক ফু’তেই মোমের মত নিভে যাবে?’ লিজা বললো। মোমের মত না নিভুক, আগুনের পরশ পেলে মোমের মত গলতে দোষ কি! তা শেষ পর্যন্ত পাথর কি গললো?’

‘কেন, তুমি কি ভেবেছিলে আমি ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ফিরে আসবো।’

‘না, বলছিলে পাথর খুব শক্ত, তাই বললাম।’

‘হ্যাঁ, পাথর খুব শক্ত।’ লিজা উত্তর দিল, ‘সে জন্যই আমাকে খুব সাবধানে বেছে বেছে তীর ছুঁড়তে হয়েছে। তবে তুমি এখন এ কথা ভাবতে ভাবতে নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারো যে, সে তোমার বান্ধবীর একান্ত গোলাম হয়ে গেছে।’

‘সত্যি করে বলো তো, সে তোমার গোলাম হয়েছে, না তুমি তার ক্রীতদাসী হয়ে ফিরে এসেছো? তুমি যে আবেগী মেয়ে, আমার তো ভয় হচ্ছে, পুরুষ স্পর্শে তুমিই না গলে মোম হয়ে যাও!’ কারিশমা বললো।

‘ভয়টা একেবারে অমূলক নয়। এমন সুন্দর যুবককে দেখলে, গলে যেতে কতক্ষণ’! লিজা হেসে বললো, ‘এ যুবককে সত্যি আমার খুব ভাল লেগেছে। এ ধরনের সরল সুন্দর লোককে ভাল না বেসে পারা যায় না। এর কথা ও কাজে কোন রকম ছলচাতুরী নেই। সাইফুদ্দিনের মত বুড়োর সাথে থাকতে থাকতে জীবনের প্রতি যে ঘেন্না ধরে গিয়েছিল, এর সাথে থাকতে পারলে সেটা কিছুটা দূর হবে।’

‘তার মানে ছুড়ি তুই মরেছিস!’

‘আরে ধ্যাত, আমাকে এত সরল সহজ মনে করো না।’

কারিশমা বললো, ‘কিন্তু শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে পারবি তো? মনে রাখিস, তার হাত দিয়ে আমাদের বড় শত্রু সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে খুন করাতে হবে।’

কারিশমা উভয়ের মধ্যে কি কি কথা হয়েছে পুরো কাহিনী শুনলো। শেষে তাকে আরও কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ দিয়ে বললো, ‘নে, এবার শুয়ে পড়।’ তারা উভয়ে শুয়ে পড়লো।

আন নাসের তখনও জেগেই ছিল। কিছুতেই তার চোখে ঘুম আসছিল না। শুয়ে শুয়ে সে লিজার কথাই ভাবছিল। মেয়েটি মিথ্যা তো কিছু বলেনি! তাকে সে সত্যি ভালবাসে। নইলে শেখ মান্নানের হাত থেকে সে ওদের রক্ষা করার ঝুঁকি নিতে যাবে কেন? দিনেও একবার এ কথা বলতেই কি সে ছুটে এসেছিল? বন্দী হওয়ার পরও যে জামাই আদর পাচ্ছি তার কারণ তো এই মেয়ে। তাহলে তার ভালবাসাকে কি করে মিথ্যা বলবো?

পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গেল ট্রেনিংকালীন সময়ের কথা। স্মরণ হলো, প্রশিক্ষণের সময় তাদের বার বার সতর্ক করা হয়েছে। খৃস্টান মেয়েদের প্রতারণার কাহিনী তুলে ধরে বলা হয়েছে, খবরদার, এদের সম্পর্কে সাবধান থাকবে। একবার এদের খপ্পরে পড়ে গেলে ইহ ও পরকাল উভয়ই বরবাদ হয়ে যাবে। তাহলে লিজা কি সেই ধোকা, যে তার ইহকাল ও পরকাল সব বরবাদ করতে এসেছে?

এক অস্বস্তিকর দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল আন নাসের। একবার মনে হয়, লিজার ভালবাসা সত্য, আবার মনে হয় ধোঁকা। এভাবে ছটফট করেই বাকী রাতটুকু কাটলো তার। শেষে সে এই সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হলো যে, লিজার ভালবাসা ধোকা নয়। তার সুঠাম সুন্দর দেহ ও সুদর্শন চেহারা যে কোন মেয়েকেই আকর্ষণ ও আকৃষ্ট করতে পারে। আগুন দেখে পতঙ্গ ঝাঁপ দিলে তাকে অস্বীকার করার কিছু নেই।

এই সিদ্ধান্তে আসার পর তার এতক্ষণের উত্তেজনা ও টেনশন কিছুটা দূর হলো। সঙ্গে সঙ্গে নিস্তেজ হয়ে এলো শরীর। সারা রাতের ক্লান্তি ও ঘুম এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ভোর হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ঘুমের কোলে ঢলে পড়লো আন নাসের।

অনেক বেলায় এক লোক তাকে ডেকে তুললো। বললো, ‘কারিশমা আপনাকে তার কামরায় ডেকে পাঠিয়েছে।’

আন নাসের উঠে বসলো। হাত-মুখ ধুয়ে লোকটির সাথে রওনা দিল কারিশমার ওখানে। কামরায় কারিশমা একাই ছিল। লোকটি তাকে কারিশমার কামরায় পৌঁছে দিয়েই চলে গেলো।

‘বসো, নাসের!’ কারিশমা বললো, ‘আমি তোমার সাথে খুব জরুরী কিছু কথা বলতে চাই।’

আন নাসের তার সামনে এক চেয়ারে বসলো। কারিশমা বললো, ‘আমি তোমাকে একথা জিজ্ঞেস করবো না যে, রাতে লিজা তোমাকে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল, না, তুমি তাকে বাইরে নিয়ে গিয়েছিলে?’

রাতের প্রসঙ্গ উঠতেই আন নাসের ভয়ে ও লজ্জায় একেবারে এতটুকু হয়ে গেল। সে কোন রকমে ঢোক গিলে মাটির দিকে চেয়ে রইলো, মুখে কিছু বললো না।

কারিশমাই আবার মুখ খুললো। বললো, এ জন্য আমি তোমাকে তিরস্কার করতে এখানে ডেকে আনিনি। আমি জানি, মেয়েটা খুবই সুন্দরী ও শিশুর মত সরল! সে তোমাকে অসম্ভব পছন্দ না করলে এভাবে রাতে গোপনে তোমার সাথে দেখা করতো না। কিন্তু আমি তাকে এবং তোমাকেও এ অনুমতি দিতে পারি না যে, এভাবে রাতভর তোমরা বাইরে কাটাও। এটা একটা কেল্লা, এটা কোন প্রেম কানন নয় যে, সারা রাত তোমরা অভিসারে মেতে থাকবে। হয়তো গত রাতের ঘটনা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। লিজা আমার রুমে না থাকলে হয়তো আমিও টের পেতাম না। কিন্তু প্রতিদিন এমনটি নাও ঘটতে পারে। তোমরা ধরা পড়ে যেতে পারো। ধরা পড়লে তার ফলাফল যে ভাল হবে না, এটুকু বোঝ?’

“জ্বি।’ কোন রকমে উচ্চারণ করলো আন নাসের।

কারিশমা বললো, ‘ঠিক আছে, এ কথা আমি আর কাউকে বলবো না। কিন্তু আর কখনো লিজাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে না।’

‘বিশ্বাস করুন, আমি কখনও এমন চেষ্টা করিনি।’ আন নাসের বললো, “রাতে আপনাদের সাথে আলাপ সেরে যাওয়ার পথে হঠাৎ লিজার সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। আমরা দুজনে কথা বলতে বলতে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলাম সত্যি, কিন্তু লিজাকে আমি বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করিনি।’

“দেখো আন নাসের, আমার চোখে ধুলো দিতে চেষ্টা করো না। আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আমি তোমাদের চোখের দিকে তাকিয়েই এমন সব কথা বলে দিতে পারবো, যা হয়তো তোমরা নিজেরাও বলতে পারবে না। লিজা তোমার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে যাক এটা আমি চাই না।’ কারিশমা তাকে বললো, ‘আমি তোমার কাছেও আশা করবো, তার অল্প বয়সের সুযোগ তুমি গ্রহণ করবে না। এই বয়সে প্রেমের বাণ মেরে যে কোন মেয়েকেই ঘায়েল করা যায়।’

‘আমি আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। স্বীকার করি, লিজা রাজকুমারীদের মতই রূপসী। তার কাছে এমন রূপ ও যৌবন আছে, যা যে কোন মানুষকে অন্ধ করে দিতে পারে।’ আন নাসের বললো, ‘কিন্তু আমরা আপনাদের কয়েদী! আর আমি নিজে একজন নগণ্য যোদ্ধা মাত্র। তাছাড়া লিজার ও আমার ধর্ম ভিন্ন। দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে যেমন প্রেম হতে পারে না, তেমনি রাজকন্যা এবং এক বন্দীর মধ্যেও ভালবাসা হতে পারে না।’

‘তুমি নারীর স্বভাব সম্পর্কে কিছুই জানোনা যুবক।’ কারিশমা বললো, ‘রাজকুমারী যদি কোন কয়েদীকেই ভালবেসে ফেলে তখন সে তাকেই মনে করে শাহজাদা। ওই শাহজাদার বাহুবন্ধনে বন্দী হওয়ার জন্য সে তখন কেবল ছটফট করতে থাকে। আর ধর্মের কথা বলছে! ধর্মই তো মানুষকে প্রেমিক বানায়। সব ধর্মের সার কথা, মানুষকে ভালবাসো। মানুষকে ভালবাসার মধ্য দিয়ে যে মানব ধর্মের সৃষ্টি হয়, সেটাই তো প্রকৃত ধর্ম! ভালবাসা ধর্মের ক্ষুদ্র বন্ধন ছিন্ন করে ফেলে। তার সাথে আলাপ করে আমি তাজ্জব হয়ে গেছি! সে তোমার এতটাই অনুরক্ত হয়ে পড়েছে যে, তোমার থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করলে সে বাঁচবে কিনা সন্দেহ। তাকে যখন আমি চাপ দিলাম এবং বললাম, খবরদার, আর কখনো তার সাথে মিশবি না। সে কাঁদতে কাঁদতে বললো, না, না, অমন কথা বলল না। তাহলে আমি বাঁচব না। এখন থেকে আমার বাঁচা মরা সবই আন নাসেরের জন্য।’

আমি বললাম, ‘সে এক মুসলমান আর তুই খৃস্টান কন্যা। ধর্ম সাক্ষী করে সে তো তোকে বিয়ে করতে পারবে না!’

‘কেন পারবে না, সে যেই খোদাকে মানে আমিও তো তাকেই মানি। যদি ধর্ম তার ও আমার মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, আমি তার ধর্ম কবুল করে তার সঙ্গে চলে যাবো।’

আন নাসের অবাক হয়ে শুনছিল কারিশমার কথা। এ কথা শুনে লিজার জন্য তার অন্তরেও ভালবাসার ঢেউ উঠলো। সে তার অসহায়ত্ব আর ভালবাসার জটিল সমীকরণে ডুবে গেল। চিৎকার করে বললো, ‘চুপ করুন। আমিও তো মানুষ, না কি! দয়া মায়া, প্রেম ভালবাসা এসব কি আমার থাকতে নেই? আপনি জানেন, লিজা শুধু আমার জন্যই শেখ মান্নানকে অসন্তুষ্ট করেছে? শেখ মান্নান আমাকে ও আমার সঙ্গীদেরকে কারাগারে বন্দী করতে চেয়েছিল। কিন্তু লিজা তার ইজ্জত ও সম্ভ্রমের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের মুক্ত রেখেছে। কেন সে এ কাজ করেছে। শুধু আমার ভালবাসার টানে। আপনি কি আমাকে তার সাথে গাদ্দারী করতে বলেন। তার পবিত্র ভালবাসাকে অপমান করতে বলেন?’

‘শেখ মান্নানও তো লিজাকে ভালবাসে। লিজাকে ভালবাসে বলেই তো সে তার কথায় তোমাকে ও তোমার সঙ্গীদেরকে মুক্ত রেখেছে। ভালবাসে বলেই তো সে লিজার শর্ত মেনে নিয়েছে। এখন লিজাকেও তার শর্ত পূরণ করতে হবে। লিজা যদি শেখ মান্নানের স্বপ্নপুরীতে না যায় তবে কিসের জন্য শেখ মান্নান তোমাদের মুক্ত রাখবে?’

‘শেখ মান্নান লিজাকে ভালবাসে না, ভোগ করতে চায়। যদি আপনার কথা মতো ধরে নিই সে লিজাকে ভালবাসে, তাতেও কিছু আসে যায় না। কারণ লিজা তাকে ভালবাসে না। অতএব শেখ মান্নানের স্বপ্নপুরীতে তার যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। লিজা আমাকে ভালবাসে, আমিও লিজাকে ভালবাসি। অতএব আপনি আপনার নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিন। দয়া করে আপনি আমাদের পথ আগলে দাঁড়াবেন না।’

‘কিন্তু শেখ মান্নানও তো তার ভালবাসায় অন্ধ হয়ে আছে। এ কেল্লার অধিপতি সে। সে কি তোমাদের ভালবাসা মেনে নেবে। যুবক, তুমি বুঝতে পারছে না, তুমি যা বলছে তার পরিণতি কত ভয়ংকর! শেখ মান্নান তোমাদের কাউকেই জীবিত রাখবে না। আমি আবারও বলছি, তুমি লিজার পথ থেকে সরে দাঁড়াও।’

‘না, এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। প্রয়োজন হলে আমি লিজার সম্ভ্রম বাঁচাতে নিজেকে কুরবানী করে দেবো।’ আন নাসের বললো, ‘যদি সে মেয়ে হয়ে আমার প্রতি তার ভালবাসার কথা প্রকাশ করতে পারে, তবে আমি কেন তা প্রকাশ করতে পারবো না। আমি পুরুষ, লিজার প্রতি আমার অন্তরে যেমন গভীর ভালবাসা রয়েছে, তেমনি তাকে রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করার দায়িত্বও রয়েছে। আমি সে দায়িত্ব প্রাণ দিয়েই পালন করবো।’

‘আস্তে বলো, দেয়ালেরও কান আছে। আমি বুঝতে পারিনি তোমরা পরস্পরকে এত বেশী ভালবাসো। আমি তোমার মঙ্গলের জন্যই তোমাকে লিজার পথ থেকে সরে দাঁড়াতে বলেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, মহাপ্রভু সত্যি তোমাদের দু’জনের অন্তরকে এক করে গেঁথে দিয়েছেন। কিন্তু তোমাদের মিলনের পথে মহা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শেখ মান্নান। তার মোকাবেলা করার সাধ্য এ মুহূর্তে আমাদের কারো নেই। সে যদি তোমাদের সম্পর্কের কথা টের পায় তাহলে দু’জনকেই খুন করে ফেলবে। সে এক গুপ্তঘাতক দলের সর্দার। তোমাকে গুমাস্তগীনের হাতে তুলে দিতে রাজি হলেও লিজাকে সে ছাড়বে না। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, এখন আমি কি করবো?’

দুশ্চিন্তায় ছেয়ে গেল কারিশমার চেহারা। একটু পর মুখ তুলে আন নাসেরকে ইশারায় কাছে ডাকলো। আন নাসের তার কাছে গেলে সে বললো, ‘তুমি কি সিরিয়াস? তুমি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে, তুমি তার সঙ্গে কোন প্রতারণা না করবে না।’

‘বুকে হাত দিয়ে নয়, আপনি যদি চান, এই গর্দান কেটে দিয়ে আমি প্রমাণ করবো, আমার ভালবাসায় কোন খাদ নেই।’

‘তাহলে আমার কথা শোন। লিজা আমার ছোট বোনের মত। তাকে আমি যেমন শাসন করি, তেমনি ভালও বাসি। আজ সে জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থায় আমি নিস্ক্রিয় থাকতে পারি না। যদি লিজাকে বাঁচাতে চাও এবং নিজে বাঁচতে চাও, তবে তোমাদের এখান থেকে পালাতে হবে। তোমরা যদি জলদি এ কেল্লা থেকে পালাতে না পারো, তবে লিজাকে শেখ মান্নান তার শর্ত মান্য করতে বাধ্য করবে।’

‘না, সে সুযোগ আমি তাকে দেবো না। আপনি একটু রহমদীল হোন। একটু সহায়তা করুন আমাদের। আমি লিজাকে নিয়ে অবিলম্বে এ কেল্লা থেকে পালাতে চাই।’

‘মাথা ঠাণ্ডা করো। ভেবে দেখি কি করা যায়।’ কারিশমা বললো, ‘তুমি এখন আর কয়েদী নও, গুমাস্তগীনের অনুরোধে শেখ মান্নান তোমাদেরকে তার হাতে তুলে দিয়েছেন। গুমাস্তগীন নিজের মেহমান বলে গণ্য করেছেন তোমাদের।’

আন নাসেরের মনে লিজা সম্পর্কে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল, কারিশমার সাথে এ আলাপের মধ্য দিয়ে তা পরিষ্কার হয়ে গেল। লিজার প্রতি তার ভালবাসা আরও গভীর হলো। লিজাকে দেখা ও তাকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো তার মন। সে কারিশমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘লিজা এখন কোথায়?’

কারিশমা তাকে বললো, ‘রাতে ফেরার পর তাকে আমি অনেক বকাঝকা করেছি। দুঃখে, লজ্জায় সে রাতভর জেগে কাটিয়েছে। ভোরে আমি তাকে আদর করে বললাম, কাঁদিস না, যে যুবককে তুই মন দিয়েছিস, সে কয়লা না হীরা আমি বাজিয়ে দেখি। যদি তোদের প্রেম খাঁটি হয়, তাহলে তুই তাকে পাবি। আর যদি দেখি প্রেম নয়, এ শুধু চোখের নেশা, তাহলে তুই মরেছিস। এখন আর কান্নাকাটি করার দরকার নেই। নাস্তা করে পাশের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে থাক, আমি আন নাসেরের সাথে আলাপ করে তোকে ডেকে তুলবো।

ও প্রথমে যেতে চায়নি, শেষে আমি জোর করে তাকে শুইয়ে দিয়ে এসেছি। এখন হয়তো সে ঘুমিয়ে আছে।’

কারিশমার তীর পরিপূর্ণ লক্ষ্য ভেদ করলো। সে লিজার জন্য আন নাসেরকে পাগল বানাতে চাচ্ছিল, তার সে উদ্দেশ্য সফল হলো। আন নাসের সেখান থেকে যেন বাতাসে উড়ে বাইরে এলো। যখন সে তার কামরায় গেল, সাথীরা জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’

সে ওদের মিথ্যা বললো এবং সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘পালাবার একটা ব্যবস্থা হচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই, সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।’

কিন্তু সে যে তখন তার দায়িত্ব থেকে অনেক দূরে সরে গেছে, বন্ধুরা তার কিছুই টের পেলো না।

❀ ❀ ❀