সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এজাজ দুর্গের অধিপতির উত্তর শুনে এবং দূতের সাথে তার খারাপ ব্যবহারের খবর পেয়ে খুবই মর্মাহত হলেন। তার এ ব্যবহারে তিনি কেবল মর্মাহতই হলেন না, যথেষ্ট রাগান্বিতও হলেন। উপলব্ধি করলেন, এর একটি সমুচিত জবাব দেয়া ফরজ হয়ে গেছে।
তিনি তখনই সে কেল্লা দখল করার সংকল্প করলেন। সঙ্গে সঙ্গে হলব শহরও অবরোধ করার পরিকল্পনা করলেন।
বুজা ও মুমবাজ দুর্গ বিনা বাধায় দখল হয়ে গিয়েছিল। সেখানকার সেনাবাহিনী সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়ে সুলতানের বাহিনীতে শামিল হয়ে গিয়েছিলো। সুলতান তার বাহিনীর পরীক্ষিত সৈন্যদেরকে সেই দুই কেল্লার দায়িত্বে পাঠিয়ে সেখানকার সেনাদলকে নিজের বাহিনীর সাথে একীভূত করে দিলেন।
এরপর তিনি এজাজ ও হলবে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করলেন। অভিযান চালানোর আগে ওখানকার অবস্থা সরেজমিনে তদন্তের জন্য তিনি তাঁর গোয়েন্দা বিভাগের বিশেষ বাহিনীকে আগেই পাঠিয়ে দিলেন। বাহিনীর সাথে পাঠালেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, যাতে তিনি অভিযান চালানো ও হলব অবরোধের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী প্রণয়ন করতে পারেন।
গোয়েন্দা বাহিনী যথাসময়ে সুলতানের কাছে হলব ও এজাজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করলো।
সুলতান আইয়ুবীর এটি ছিল একটি ব্যতিক্রমী অভিযান। তিনি এ অভিযানে তার নিজস্ব পতাকা সঙ্গে না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। নিজের দেহরক্ষীদের বললেন, ‘এ অভিযানে আমাকে সঙ্গ দেয়ার কোন দরকার নেই তোমাদের।’
এরপর তিনি তার ঘোড়া পাল্টালেন। তার নিজস্ব ঘোড়ার রং ছিল সাদা। সেই সাদার মধ্যে মাঝে মাঝে উজ্জ্বল লাল রংয়ের ডোরাকাটা দাগ। শত্রুরা এ ঘোড়াটিকে ভালমতই চিনতো।
এসব কিছুর উদ্দেশ্য ছিল একটাই, শত্রুরা যাতে তাকে চিনতে না পারে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এখন কোথায় আছেন, এ প্রশ্নের উত্তর যেন জানা না থাকে কারো।
গোয়েন্দা বাহিনীর রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে পথ চলতে লাগলেন তিনি। নিজেও মিলিয়ে নিচ্ছিলেন, রিপোর্টগুলো ঠিক আছে কিনা। যাত্রা পথের সকল বাঁধা ও প্রতিবন্ধকতাগুলো সচক্ষে দেখে, ধীরে ধীরে এগুচ্ছিলেন তিনি, যাতে যুদ্ধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ছোটখাটো বিষয়গুলোও দৃষ্টি না এড়ায়।
যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে তিনি যেসব উপদেষ্টা ও সেনাপতিদের পরামর্শ গ্রহণ করেন, তারা তাকে বার বার সতর্ক করলো, “দয়া করে আপনি দেহরক্ষী ছাড়া একা কোথাও যাবেন না।” কিন্তু ব্যক্তিগত বিষয় বলে এ প্রসংগটিকে তিনি কোন রকম আমলেই নিলেন না।
আসলে এজাজের ব্যবহারে তিনি এতটাই অসন্তুষ্ট ও ক্ষীপ্ত হয়েছিলেন যে, তিনি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিলেন না। তার মাথায় রীতিমত খুন চেপে গিয়েছিল। তিনি শেষবারের মত তার মুসলমান শত্রুদের নাকানি-চুবানি খাওাতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলেন। কিন্তু তিনি যে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, সেদিকে কোন খেয়াল নেই।
তিনি এখন যে এলাকাটি অতিক্রম করছিলেন তা সর্বত্র টিলা ও পাহাড়ী উপত্যকায় পরিপূর্ণ। কোথাও কোথাও বৃক্ষের ছায়া আছে। কোন কোন স্থানে আবার গভীর খাদ। এলাকাটি দুর্গম ও সত্যি ঝুঁকিপূর্ণ। এমন এলাকায় দেহরক্ষী ছাড়া সুলতান আইয়ুবীর একাকী চলাফেরা ছিল খুবই আশংকা ও বিপদের কারণ।
‘সুলতানে মুহতারাম।’ তাঁর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হাসান বিন আবদুল্লাহ এ ভয়ানক অঞ্চলে পৌঁছার পর এক সময় সুলতানকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ না করুক, আপনার উপর যদি ফেদাইন ও খৃস্টানদের হত্যা ষড়যন্ত্র সফল হয়ে যায়, তাহলে আপনার হয়তো কোন ব্যক্তিগত ক্ষতি হবে না, কিন্তু মুসলিম মিল্লাত অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তারা তাদের রাহবার হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়বে। আপনার মত নেতা পাওয়া আমাদের ভাগ্যের ব্যাপার।
যদি কখনো এমন দূর্ঘটনা ঘটে যায়, তখন আমরা জাতির কাছ মুখ দেখানোর যোগ্য থাকবো না। পরবর্তী বংশধররা আমাদের বলবে, ‘সুলতান আইয়ুবীর হেফাজতের জিম্মা কেন তোমরা পালন করতে পারোনি?’
‘যদি আমার মৃত্যু কোন ফেদাইন বা ক্রুসেডারের হাতে আল্লাহ মঞ্জুর করে থাকেন, তবে সে মৃত্যুকে আমি ঠেকাবো কেমন করে?’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘দেশের শাসক যদি তার জীবন রক্ষায় ব্যস্ত থাকেন, তবে তিনি দেশ ও জাতির হেফাজত করতে পারবেন না। যদি আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসে থাকে, তবে আমার কাজ দ্রুত শেষ করতে দাও। আমাকে রক্ষীদের হাতে বন্দী করে রেখো না। আমার উপর বাদশাহীর বিলাসিতা চাপিয়ে দিও না। তোমরা তো জানো আমার ওপর আন্তর্জাতিক গুপ্তঘাতকরা কতবার আঘাত করেছে। আল্লাহ আমাকে প্রত্যেকবার বাঁচিয়েছেন, এখনও তিনিই আমাকে রক্ষা করবেন।’
তাঁর নিজস্ব রক্ষী বাহিনী তাঁর নিরাপত্তার জন্য বরাবরই উৎকণ্ঠিত ছিল এবং নিরাপত্তা রক্ষায় যথাসাধ্য চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু দেখা গেছে সবক’টি আক্রমণের সময়ই তিনি ছিলেন একা।
সুলতান আইয়ুবী কখনোই নিজের নিরাপত্তার বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিতেন না। তিনি তার নিজস্ব রক্ষীদের কোন এক স্থানে দাঁড় করিয়ে রেখে একাই টিলা বা উপত্যকার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যেতেন। হাসান বিন আবদুল্লাহ বিষয়টি জানতেন বলে তিনিও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে রেখেছিলেন। দূরে থাকলেও দেহরক্ষীরা সুলতান আইয়ুবীর উপর দূর থেকেই দৃষ্টি রাখতো।
কেউ জানতো না, কিছুদিন থেকেই চারজন খুনী আইয়ুবীকে হত্যা করার জন্য সে এলাকায় এসে আস্তানা গেড়েছিল এবং পাহাড়ে, জঙ্গলে ঘুরে বেরিয়ে সুলতানকে হত্যার সুযোগ খুঁজছিল। এরাই সেই চার ফেদাইন খুনী, যাদের সম্পর্কে আছিয়াত দুর্গে শেখ মান্নান গুমাস্তগীনকে বলেছিল।
এখানে এসেই ওরা পরিকল্পনা করলো, যেহেতু এটা যুদ্ধ কবলিত এলাকা, তাই শরণার্থী হয়ে ওরা সুলতান আইয়ুবীর কাছে যাবে এবং সুযোগ মত তাকে হত্যা করবে।
কিন্তু সুলতানের কাছে এসে তাদের আফসোসের সীমা রইলো না। তারা যখন দেখলো সুলতান আইয়ুবী রক্ষী ছাড়া একাই ঘোরাফেরা করেন, তখন তারা এই বলে আফসোস করতে লাগলো, ‘হায়, যদি সঙ্গে তীর ধনুক নিয়ে আসতাম! তাহলে সুযোগ মত তীর মেরেই তাকে শেষ করে দিতে পারতাম।’
কিন্তু তারা সঙ্গে করে তীর-ধনুক আনেনি, কেননা তাতে ধরা পড়ার ভয় ছিল। তাদের কাছে যদি একটি ধনুকও থাকতো তবুও গোপন স্থান থেকে নিশানা করতে পারতো; কেননা সেখানে লুকানোর মত যথেষ্ট জায়গা ছিল এবং তীর মেরে সহজে পালিয়ে যাওয়ারও সুযোগ ছিল। তারা তাদের লম্বা খঞ্জরের বাটে হাত বুলাতে বুলাতে এই আফসোসই করছিল।
ওদিকে আন নাসের লিজাকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দ্রুত ছুটছিল তুর্কমানের দিকে। সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে চার ফেদাইন খুনী রওনা হয়ে গেছে, এ কথা শোনার পর অনেক চেষ্টা করেও ঘোড়ার গতি আর বাড়াতে পারছিল না। তাছাড়া রাস্তায় ঘোড়ার বিশ্রাম এবং পানি পান করানোর দিকেও তাকে নজর রাখতে হচ্ছিল। ওদিকে সুলতান আইয়ুবী নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে সম্পূর্ণ বেখেয়াল হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এজাজ দুর্গের দিকে। চার খুনী গোপনে তাকে অনুসরণ করতে লাগলো।
সুলতান যে এলাকা অতিক্রম করছিলেন, সে এলাকায় কোন সৈন্য ছিল না, কোন জনবসতিও ছিল না। ফেদাইনরা বন্য পশুর শিকারীর বেশে তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে চললো।
সূর্য অস্ত চলে গেল, আন নাসের লিজাকে নিয়ে তখনো ঊর্ধশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে। কিন্তু দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে গিয়ে ঘোড়াটি কাহিল হয়ে পড়লো। ঘোড়াটির চলার গতি ক্রমে ধীর হয়ে আসতে লাগলো। আন নাসের বুঝতে পারলো, ঘোড়াকে যতই তাড়া করা হোক, সে আর দ্রুত চলতে পারবে না।
আন নাসের বোঝার ভার কমানোর জন্য ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লো। তারপর ঘোড়ার লাগাম ধরে পায়ে হেঁটে এগিয়ে চললো।
রাত বাড়তে লাগলো, কিন্তু সে চলা বন্ধ করলো না। লিজা তিন চার বার আন নাসেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, ‘আমি আর ঘোড়ার পিঠে বসে থাকতে পারছি না। আমার মায়ের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন আলাদা হয়ে গেছে।’
সবারই তখন বিশ্রাম জরুরী হয়ে পড়েছিল। ঘোড়াটি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আন নাসের নিজেও ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু সে থামলো না, বরং লিজাকে বললো, ‘তোমার ও আমার প্রাণের চেয়ে সুলতান আইয়ুবীর জীবনের মূল্য অনেক বেশী। আমি যদি থেমে যাই, আর কখনো শুনতে পাই, সুলতান আইয়ুবী নিহত হয়েছেন, আমি মনে করবো, ফেদাইনরা নয়, সুলতান আইয়ুবীকে আমিই খুন করেছি।’
লিজা আর কোন কথা বললো না, সে অর্ধ চেতন অবস্থায় ঘোড়ার পিঠ খামচে পড়ে রইলো।
সারা রাত এভাবেই পথ চললো ওরা, কোথাও থামলো না। সকাল হলো। আন নাসের তখনো পা টেনে টেনে পথ চলছে। লিজা ঘোড়ার পিঠে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
ঘোড়াটিও পা টেনে টেনে এগুচ্ছিল, হঠাৎ সামনে এক স্থানে ঘাস ও পানি দেখে দাঁড়িয়ে গেল। লিজা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় পথ চলছিল, ঘোড়াটি থামতেই হঠাৎ গতি পড়ে যাওয়ায় সে চমকে উঠে বসে পড়লো এবং আন নাসেরের দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের স্বরে বললো, “দেখো, খোদার কসম লাগে, এই অবোধ প্রাণীটিকে আর এভাবে টেনে নিও না! একে কিছু খেতে দাও, পানি পান করাও!’
আন নাসের ঘোড়াটিকে ছেড়ে দিল। লিজাকে ধরে নামালো ঘোড়া থেকে। ঘোড়াটি পানি পান করে তাজা ঘাসের ভেতর মুখ ডুবিয়ে দিল।
ঘোড়াটির পেট তখনো ভরেনি, আন নাসের আবার লাগাম ধরে ঘোড়াটিকে চলতে বাধ্য করলো। ঘোড়াটির দৌড়ানোর ক্ষমতা না থাকলেও প্রভুর ইচ্ছা সে বুঝতে পারলে, চলতে লাগলো ঘোড়া।
লিজার চেহারা দুঃখী মেয়েদের মত করুণ ও ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। তার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছিল না। আন নাসেরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। দানাপানি খাওয়ায় ঘোড়াটি কিছুটা সবল হয়ে উঠলো, আন নাসের লিজাকে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলো।
আন নাসের জানতো না, সুলতান আইয়ুবী এখন কোথায়। সে তুর্কমানের দিকে যাচ্ছিল। সুলতান আইয়ুবী সামনে অগ্রসর হতে হতে ‘কোহে সুলতান’এ পৌঁছে গেলেন। তারপর তিনি সেখান থেকেও অগ্রসর হতে লাগলেন।
আন নাসের চলতে চলতে কোহে সুলতানের কাছে চলে এসেছিল। সে দেখতে পাচ্ছিল, সামনেই কোহে সুলতানের উপত্যকা।
সে তুর্কমান পৌঁছার চিন্তাতেই বিভোর ছিল। কেমন করে তাড়াতাড়ি তুর্কমান গিয়ে পৌঁছবে, এ চিন্তা তার শারীরিক অবসাদকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সূর্য মাথার অনেক উপরে উঠে এসেছে, আন নাসের ঘোড়াকে তাড়া করলো।
সে সময় সুলতান আইয়ুবী একটি উঁচু পাহাড়ী এলাকা অতিক্রম করছিলেন। তিনি এক জায়গায় থেমে অঞ্চলটি জরিপ করে দেখছিলেন। সঙ্গী সাথীদের এক স্থানে রেখে একাই অন্য দিকে দেখতে গেলেন তিনি। কি করে কোন পথে বাহিনী পরিচালনা করবেন তারই পরিকল্পনা করছিলেন। তিনি অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে একটি টিলার উপরে আরোহণ করলেন এবং তার নক্সা এঁকে নিতে লাগলেন।
চারজন ফেদাইন উপত্যকার পাশে এক গোপন জায়গায় লুকিয়ে সুলতান আইয়ুবীকে লক্ষ্য করছিল। তিনি পাহাড়ের উপর উঠে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছিলেন।
‘তাকে নিচে নামতে দাও আগে।’ এক ফেদাইন সঙ্গীদের বললো।
‘এতো খুশী হয়ো না। তার দেহরক্ষীরা পাশেই হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে।’ অন্য ফেদাইন বললো।
‘না, আশেপাশে কেউ নেই। আজকেই আঘাত করার মোক্ষম সময় এবং এখুনি। সাবধান, এমনভাবে তাকে আঘাত করতে হবে, যাতে কোনভাবেই সে বাঁচতে না পারে।’ অন্য একজন বললো।
ফেদাইনদের দলনেতা একজনকে লক্ষ্য করে বললো, ‘তুমি একাই আঘাত করার জন্য এগিয়ে যাও। আঘাত পিছন থেকে করবে। প্রয়োজন হলেই আমরা সামনে যাবো।’
লোকটি গুপ্তস্থান থেকে রওনা হওয়ার আগেই সুলতান আইয়ুবী টিলা থেকে নেমে এলেন এবং ঘোড়ায় আরোহণ করে অন্যদিকে রওনা দিলেন। বাধ্য হয়ে ফেদাইনরা আবার তার পিছু নিল। তারা একবারই সুলতানকে আক্রমণ করতে চায় এবং সে আক্রমণে সফল হতে চায়। এ রকম আক্রমণের জন্য চাই উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ। কিন্তু সুলতান রওনা হয়ে যাওয়ায় তৈরী হওয়া পরিবেশটা নষ্ট হয়ে গেল।
আন নাসের এখনও সুলতান আইয়ুবীর দৃষ্টিসীমা থেকে বহু দূরে। সুলতান আইয়ুবী কিছু দূর অগ্রসর হয়ে আরও একবার ঘোড়া থেকে নামলেন। ঘোড়া থেকে নেমে তিনি আবার অন্য এক পাহাড়ে চড়তে শুরু করলেন। একটু পর সেখান থেকেও নেমে এলেন তিনি।
ঘোড়ার লাগাম ধরে সামনে চলতে শুরু করলেন আইয়ুবী। ফেদাইনরা সামান্য দূর থেকে লুকিয়ে দেখছিল তার কার্যক্রম। সুলতান আইয়ুবী এক স্থানে এসে থেমে গেলেন। তারপর ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলেন জায়গাটি। এটি পাহাড়বেষ্টিত একটি মাঠ। মাঠের সবদিকেই পাহাড়, কোথাও একটু বেশী উঁচু, কোথাও কম।
তিনি ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় পিছনে কারো দৌড়ানোর পদধ্বনি শুনতে পেলেন। এক ফেদাইন খুনী লম্বা খঞ্জর হাতে ছুটে আসছিল তার দিকে।
সুলতান আইয়ুবীর বুঝতে বাকী রইলো না, কি ঘটতে যাচ্ছে। চকিতে তিনি তাঁর খঞ্জর বের করে নিলেন। ফেদাইন খুনী তাকে আঘাত করলো। সুলতান আইয়ুবী সে আঘাত নিজের খঞ্জর দিয়ে ফিরিয়ে দিলেন। আক্রমণকারী ছিল পাকা খুনী, স্বাস্থ্যবান এবং যথেষ্ট শক্তিশালী। সে প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে আঘাত করলো আইয়ুবীর ওপর। সুলতান সে আক্রমণ ফিরিয়ে দিয়ে পাল্টা আঘাত হানলেন, কিন্তু তাকে ধরাশায়ী করতে পারলেন না।
এবার গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এলো আরেক ফেদাইন। সেও সুলতানকে আক্রমণ করলো। তিনি ক্ষিপ্রহস্তে উভয়ের আক্রমণ প্রতিহত করে চললেন। অবস্থার জটিলতা উপলব্ধি করে আরো এক খুনী বেরিয়ে এলো। সুলতান অবস্থা বেগতিক দেখে ঘোড়র আড়ালে আশ্রয় নিলেন।
এক ফেদাইন ঘুরে তাঁকে আবার আক্রমণ করতে গেল, কিন্তু সুলতান তার মুখে এমন জোরে বাম হাতে ঘুষি মারলেন যে, সে পিছন দিকে উল্টে পড়ে গেল। সুলতান সঙ্গে সঙ্গে তার বুকে খঞ্জর বসিয়ে দিলেন। খঞ্জরটি বের করার সময় তিনি এমনভাবে টান দিলেন, লোকটির বুক এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল। মারা গেল সে ফেদাইন খুনী।
আরেক ফেদাইন দ্রুত ছুটে এসে পিছন থেকে সুলতানকে আক্রমণ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সুলতান চটজলদি সরে পড়ে নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হলেন।
ফেদাইন খুনীর খঞ্জর সুলতানকে বিদ্ধ করলো না বটে, কিন্তু খঞ্জরের মাথা সুলতানের বাহু ছুঁয়ে গেল। এতে আহত হয়ে পড়লেন সুলতান। কিন্তু আঘাত কতটা গভীর তা দেখার সময় ছিল না, অন্য দুই ফেদাইনও সামনে এসে পড়েছিল সুলতানকে আঘাত করার জন্য। এ সময়ই তীর বেগে ছুটে আসা ঘোড়ার পদধ্বনি শুনতে পেলেন সুলতান। অশ্বারোহী বন্ধু না শত্রু সেদিকে নজর দেয়ার ফুসরত পেলেন না সুলতান, দুই খুনী একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার ওপর।
মুহূর্তে একদিকে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করলেন সুলতান, অশ্বারোহী ঝাঁপিয়ে পড়লো খুনীদের ওপর।
এই অনাকাঙখিত আক্রমণে ভড়কে গেল খুনীরা, একজন পালাতে গিয়ে ঘোড়র পায়ের তলে পিষে মারা পড়লো। বাকী ফেদাইনটিকে ধরে ফেললেন সুলতান আইয়ুবী।
যুদ্ধ শেষ। এবারও অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন সুলতান আইয়ুবী। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণী, তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের মধ্য থেকে যাঁকে ইচ্ছা এভাবেই রক্ষা করেন।
যখন সুলতানের ওপর আক্রমণ শুরু হয়, তার দেহরক্ষীরা দূরে এক টিলার ওপর দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখতে পায়। কারণ তারা দূর থেকেও সুলতানের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখছিল। তাদের এই সতর্কতা বৃথা যায়নি, আল্লাহ এই সতর্কতার উত্তম পুরষ্কার দান করেন, বাঁচিয়ে দেন সুলতান আইয়ুবীকে।
এই ঘটনা ১১৭৬ সালের মে মাস তথা ৫৭১ হিজরীর জিলকদ মাসে ঘটেছিল। এ ঘটনা সম্পর্কে কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার ডাইরীতে লিখেছেন, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এজাজ দুর্গ আক্রমণের জন্য যাওয়ার পথে তাকে একা পেয়ে ফেদাইন ধুনীরা তাঁর ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই তাকে বাঁচিয়ে দেন।
মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আকবার খান অবশ্য তার বইতে বহু উদ্ধৃতি টেনে ঘটনার কিছুটা ভিন্ন রকম বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, সুলতান আইয়ুবী এজাজ দুর্গ অবরোধের জন্য অগ্রসর হচ্ছিলেন। পথে বিশ্রামের সময় তিনি এক তাঁবুতে শুয়ে ছিলেন। এ সময় গুপ্তঘাতক ফেদাইন চক্র তার ওপর হামলা চালায়। কিন্তু তিনি ফেদাইনদের খঞ্জরের আঘাত ব্যর্থ করে দিতে সমর্থ হন।
যুদ্ধ ও সফরের সময় তিনি এক রকমের শক্ত পাগড়ী ব্যবহার করতেন। আক্রমণকারীর খঞ্জর তাঁর বাহুতে নয়, ওই পাগড়ীতে আঘাত করেছিল। সুলতান আইয়ুবী যখন এ আক্রমণ প্রতিহত করছিলেন তখন তাঁর দেহরক্ষীরা এসে তাদেরকে হত্যা করে।
কিন্তু জেনারেল আকবর খানের চাইতে বাহাউদ্দিন শাদ্দাতের বর্ণনাই অধিক সঠিক বলে মনে হয়।
যে ফেদাইন ধরা পড়েছিল, সে স্বীকার করে বলল, ‘আমরা চারজন আছিয়াত দুর্গ থেকে এসেছি।’
প্রাথমিক জবানবন্দীর পর তাকে হাসান বিন আবদুল্লাহর কাছে সোপর্দ করা হলো। তিনি বন্দীর কাছ থেকে আছিয়াত দুর্গ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিলেন। দুর্গে কতজন সৈন্য আছে, তাদের যুদ্ধ করার যোগ্যতা কেমন, অস্ত্রশস্ত্র কেমন আছে, সব স্বীকার করতে বাধ্য হলো লোকটি। অনুসন্ধানপর্ব শেষ হলে হাসান বিন আবদুল্লাহ সমস্ত রিপোর্ট সুলতান আইয়ুবীকে অবহিত করলো।
‘আগামীকাল রাতের শেষ প্রহরে আমরা আছিয়াত দুর্গের পথে অভিযান চালাবো।’ সুলতান আইয়ুবী তাঁর সেনাপতিদের একত্রিত করে বললেন, ‘ফেদাইনদের আড্ডাখানা ধ্বংস করা জরুরী হয়ে পড়েছে সবার আগে।’
তিনি সেনাপতিদেরকে অভিযানের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে তিনি তাঁবুতে প্রবেশ করলেন।
সেই সন্ধ্যায় প্রথমে হাসান বিন আবদুল্লাহর নজরে পড়লো একটি ক্লান্ত ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে দুই আরোহী। সন্ধ্যার লালিমায় দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল শুধু ওদের কালো অবয়ব। ওদের গতি তুর্কমানের দিকে। একটু দূর দিয়ে ওরা ওদের পাশ কেটে এগিয়ে যাবে।
হাসান বিন আবদুল্লাহ ওদের গতি রোধ করার জন্য দু’জন কমান্ডোকে পাঠিয়ে দিলেন ওদের পথে। কমাণ্ডেদের কাছাকাছি চলে এলো ওরা। একদম সামনাসামনি হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ কাউকে চিনতে পারেনি। মুখোমুখি হতে প্রথমে আন নাসেরই চিনলো ওদের, একই বাহিনীর লোক ওরা। ওরাও চিনতে পারলো, ‘আরে! এ যে আমাদের হারিয়ে যাওয়া আন নাসের!’
অনেকদিন পর তিন বন্ধু একত্রিত হলো। চিনতে পেরেই একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে! কেমন আছো তুমি। সঙ্গের এ মেয়েটিই বা কে?’
আন নাসের এসব কোন প্রশ্নেরই জবাব দিল না। বললো, ‘সবই পরে বলবো, আগে বলো সুলতান কোথায়? আমাকে জলদি সুলতানের কাছে নিয়ে চলো।’
সুলতান নয়, ওরা ওকে নিয়ে গেল হাসান বিন আবদুল্লাহর কাছে। আন নাসের ওখানে পৌঁছেই হাসান বিন আবদুল্লাহকে দেখে বলে উঠলো, ‘আমাকে জলদি সুলতানের কাছে নিয়ে চলুন। তাঁর জীবন বিপন্ন।’
‘শান্ত হয়ে বসো। আমাকে সব খুলে বলো। বলো এতদিন কোথায় ছিলে?’
লিজাকে পাশের রুমে সরিয়ে দিয়ে আন নাসেরকে নিয়ে একান্তে বসলো হাসান বিন আবদুল্লাহ। আন নাসের সব ঘটনা সংক্ষেপে খুলে বললো। আন নাসেরের কাছ থেকে সব রিপোর্ট জেনে নিয়ে হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘তোমাকে সুলতান আইয়ুবীর সাথে দেখা করাতে হবে।’
বিধ্বস্ত আন নাসের এবং লিজাকে সুলতানের সামনে হাজির করা হলো। একটানা পথচলা, ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় সে তখন অর্ধমৃত অবস্থায়। লিজার অবস্থা আরও করুণ। তার চেহারা তোবড়ানো ফুলের মতো বিবর্ণ।
আন নাসের তাদের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে সে বিবরণ সুলতানকে শোনালো। কোন কথাই গোপন করলো না সে। লিজা সম্পর্কেও সব কথা সুলতানকে অকপটে খুলে বললো।
সুলতান আইয়ুবী লিজাকে বললেন, ‘এবার তুমি তোমার কথা বলো। কোন রকম ভয় ও সঙ্কোচ ছাড়াই তুমি সব কথা স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করতে পারো।’
লিজা নিজেকে একজন অসহায় বন্দীনি ভেবে চুপচাপ বসেছিল আন নাসেরের পাশে। ভাবছিল, আন নাসের তার সম্পর্কে যে বিবরণ দিয়েছে, তাতে কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে তার ভাগ্যে। কিন্তু সুলতান তাকে স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়ায় বিস্মিত ও অভিভুত হয়ে পড়লো। সেও সব কথা অকপটে স্বীকার করে নিয়ে বললো, ‘আল্লাহর কসম, আমি এখন আর খৃস্টান নই। আমার অতীত অপরাধের জন্য আপনি যে শাস্তি নির্ধারণ করবেন, আমি খুশী মনেই তা মাথা পেতে নেবো। তবে যদি মরতে হয়, আমি একজন মুসলমান হিসাবে মরতে চাই।’
সুলতান বললেন, ‘মরার কথা ভাবছো কেন মেয়ে? আল্লাহ তার অপরাধী বান্দাদের জন্য তওবার দুয়ার খোলা রেখেছেন। আমার এ অধিকার নেই, তোমাকে সত্যের পথ থেকে সরিয়ে দেই। তুমি মুসলমান হিসাবেই জীবন যাপন করবে। এখন বলো, তুমি কোথায় যেতে চাও?’
‘তাহলে আমাকে আন নাসেরের সাথে থাকার অনুমতি দিন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি তার আশ্রয়েই থাকতে চাই।’
‘এ মুহূর্তেই তোমাকে এমন অনুমতি আমি দিতে পারি না। এখন তুমি একটি ঘোরের মধ্যে আছে। তোমাকে দামেশকে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেখানে মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর কাছে খুব সুখে এবং নিরাপদেই থাকবে তুমি। আন নাসের কিছুদিন পর তোমার সাথে দেখা করবে। তখন তোমার আবেগ ও ইচ্ছা তার কাছে ব্যক্ত করো। তারপর আমরা ভেবে দেখবো, তোমাকে আন নাসেরের আশ্রয়ে দেয়া যায় কিনা!’
ওখান থেকেই লিজা ও আন নাসেরকে আলাদা করে দেয়া হলো। পরদিন দামেশকে পাঠিয়ে দেয়া হলো লিজাকে আর আন নাসেরকে সুচিকিৎসার জন্য পাঠানো হলো ডাক্তারের কাছে। দামেশকে লিজার নিরাপত্তা ও আরাম আয়েশে কোন সমস্যা না হলেও অন্তরে তার শান্তি ছিল না। সেখানে তার প্রতিটি প্রহর কাটতে লাগলো আন নাসেরের অপেক্ষায়। কিন্তু লিজাকে নিয়ে ভাববার মত অবসর আন নাসেরের ছিল না, সে তখন সুলতান আইয়ুবীর অগ্রগামী বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে ছুটছে আছিয়াত কেল্লার দিকে। পেছনে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বিশাল বাহিনী। তাদের টার্গেট ফেদাইন খুনীচক্রের শক্তিশালী আস্তানা আছিয়াত কেল্লা, এজাজ দুর্গ এবং খৃস্টানদের দোসর গাদ্দার মুসলমানদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হলব শহর।
সমাপ্ত