গোপন বিদ্রোহী
সে রাতটি ছিল যদিও অমাবশ্যার, কিন্তু মিশরের আকাশ ছিল আয়নার মত স্বচ্ছ। আকাশে হীরার মত জ্বলজ্বল করছিল অসংখ্য তারা। কোনটি উজ্জ্বল, আবার কোনটি অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বল। কোনটি খাঁটি মোতির মত চমকাচ্ছে।
কায়রো শহর গভীর নিদ্রায় মগ্ন। কেউও ভাবতেও পারেনি, কায়রোর এই শান্তিপ্রিয় ঘুমন্ত মানুষগুলোর ওপরই এক সময় শুরু হয়ে যাবে কিয়ামতের বিভীষিকা।
কায়রোর সেনাবাহিনী ও শহর রক্ষীরা ঘুমিয়ে ছিল। শুধু জেগে ছিল কতিপয় টহলদার সৈনিক। কিন্তু তারা জেগে থাকলেও সতর্ক ছিলনা। প্রতিদিনের মত নিশ্চিন্তে বসে বসে গল্পগুজব করছিল। হাতিয়ারগুলো পড়েছিল একপাশে, অবহেলায়।
সীমান্ত রক্ষীরাও নির্বিকার। উত্তাপ ও উত্তেজনাহীন। একটি সাদামাটা দিন পার করে ক্যাম্প-খাটে ঘুমিয়ে পড়েছে। নীলনদ সংলগ্ন ফাঁড়ির ডিউটিরত দুই প্রহরী শুধু এখনও পথে। নদীর তীর ধরে এগিয়ে চলেছে ওদের ঘোড়াগুলো। ঘোড়ার উপর বিরহ কাতর চিত্তে বসে আছে দুই প্রহরী। এগিয়ে যাচ্ছে ওরা বণিক দলের সুন্দরী মেয়েদের কাছে।
পাশের ক্যাম্পটি এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের কাছাকাছি। সে ফাঁড়ির সিপাইদেরও দায়িত্ব সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু শান্তিময় নিরুপদ্রপ সময় সৈন্যদের অলস ও অকর্মণ্য বানিয়ে দিয়েছিল, ফলে দায়িত্বের ব্যাপারে কেউ সচেতন ছিল না।
কয়েকটি নৌকা বোঝাই সুদানী হাবশী সৈন্য প্রবেশ করল মিশরের মাটিতে। দুই ক্যাম্পের চার টহল সৈনিক তখন ডুবে আছে চার সুন্দরীর প্রেম সাগরে।
জোহরা ও তার সাথী নর্তকী তাদের তাঁবুতে শুয়েছিল। সঙ্গের পুরুষরা প্রকাশ্যে নিদ্রা গেলেও ভেতরে ভেতরে সবাই ছিল সজাগ, উৎকর্ণ ও সতর্ক। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা জানতে পেরেছে, আজকের রাতটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উপর থেকে নির্দেশ এসেছে, ‘রাতে আহাম্মকের মত ঘুমিয়ে না থেকে সবাই সতর্ক থেকো।’
ওদের উপর আরও নির্দেশ এসেছে, ‘বাইরের কোন লোককে নদীর পারে আসতে দেবে না। পাহাড়ি অঞ্চলের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেবেনা কাউকে। যদি কেউ যেতে চায় তবে তাকে ধরে এনে বন্দী করে রাখবে।’ বনিক ও বাদক উভয় দলের জন্য এই একই হুকুম ছিল।
অন্ধকার রাত। চাঁদ নেই আকাশে, মেঘও নেই। মেঘমুক্ত প্রকৃতি তারার আলোয় ঈষৎ আলোকিত। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে সবাই। অনেকক্ষন পর এক বাজনাদার উঠে বসলো বিছানায়। তাঁবু থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক ভাল করে পরখ করে দেখলো। ক্যাম্পের চারদিকে চক্কর দিল একবার। এরপর জোহরা ও নর্তকী যে তাঁবুতে শুয়েছিল, ওখানে গেল। তাঁবু ফাঁক করে উঁকি দিল ভেতরে, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না।
লোকটি এদিক ওদিক চাইলো আবার। না, কেউ কোথাও নেই। চট করে ভেতরে ঢুকে গেল লোকটি। অন্ধকারে হাতড়িয়ে দেখলো বিছানায়। মনে হলো, যা সন্দেহ করেছিল তাই ঘটেছে।
আগুন জ্বালালো সে। দেখলো জোহরা নেই, সে পালিয়েছে। অন্য মেয়েটি গভীর ঘুমে অচেতন। শুয়ে আছে এলোমেলো অবস্তায়। বাজনাদার তাকে আর জাগালো না। এ মেয়েকে জাগিয়ে কি লাভ? জোহরা কোথায় গেছে এ মেয়ের চাইতে ওইতো বেশী জানে। নিশ্চিত, পাশের ক্যাম্পের কমান্ডারের কাছে গেছে জোহরা। এ ছাড়া সে আর কোথায় যাবে?
জোহরা পালিয়েছে, এটা তেমন ভয়ের ছিলনা। কিন্তু ভয়ের কারন হলো, জোহরা যখন ফিরে আসবে তখন কমান্ডারও চলে আসতে পারে। প্রহরীদের না দেখলে কমান্ডার তাদের খোঁজাখুঁজি করবে। এমনও হতে পারে সে নদীর তীরে চলে যেতে পারে।
যে খবর এতদিন বাইরের দুনিয়া থেকে গোপন রাখা হয়েছে, লুকিয়ে রাখা হয়েছে লোকচক্ষুর অন্তরালে, সে খবর ফাঁস হয়ে যেতে পারে মুহূর্তে!
বাজনাদার তার দুই সাথীকে জাগালো। তাদেরকে জানালো, ‘জোহরা পালিয়েছে। নিশ্চয়ই সে ওই ক্যাম্পের কমান্ডারের কাছে গেছে।’
‘বলো কি! যদি সে কমান্ডারকে নিয়ে ফিরে আসে!’
‘তা আসতেই পারে। চলো এক কাজ করি। নদীর তীর থেকে দূরে ওদের আসার পথে ওঁৎ পেতে থাকি। যদি কমান্ডার মেয়েটার সঙ্গে চলে আসে এবং আমাদের গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তবে দু’জনকেই ধরে আমাদের কমান্ডারের কাছে পৌঁছে দেবো।’
‘তাই ভালো, চলো। যদি প্রয়োজন পড়ে তবে দু’জনকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেবো, কিন্তু কিছুতেই এ গোপনীয়তা ফাঁস হতে দেবো না।’ আরেকটু উৎসাহ নিয়ে বললো সঙ্গী।
পাহাড়ের সেই দুর্গম অঞ্চল। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় নিরেট এক পাথরের জগৎ, কিন্তু ভিতরের পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা। বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে পাহাড়ী অঞ্চলটি দাঁড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। এলাকাটি দুর্গম বলে সেখানে মানুষের কোন যাতায়াত নেই। লোক চলাচলের পথ থেকেও অঞ্চলটি বেশ দূরে।
জনশ্রুতি আছে, এখানে ফেরাউনের প্রেতাত্বারা বাস করে। ফেরাউন যাদের হত্যা করেছিল তাদের প্রেতাত্বারাও নাকি বাস করে এখানেই। লোকেরা একথাও বলে, এ দু’ধরনের প্রেতাত্বারা মাঝে মধ্যেই এখানে যুদ্ধ বিগ্রহে জড়িয়ে পড়ে। কোন লোক এ এলাকায় ঢুকে পড়লে সে আর অক্ষত বেরিয়ে আসতে পারে না। তার শরীর থেকে সব মাংস উধাও হয়ে যায়। কংকাল ছাড়া আর কিছুই থাকেনা তার শরীরে।
বহুদিন আগের কথা। এ পাহাড়ী এলাকার বিভিন্ন পাহাড় কেটে ফেরাউনদের বড় বড় মূর্তি বানানো হয়েছিলো। নিচ থেকে পাহাড় খুঁড়ে তার মধ্যে তৈরী করা হয়েছিল রাজকীয় মহল। এসব মহলে ছিল বড় বড় কামরা।
দীর্ঘদিন এ কামরাগুলোতে কোন মানুষ প্রবেশ করেনি। মহলগুলোও ছিল জনমানব শুন্য। প্রহরীদের দৃষ্টি এড়িয়ে এ কামরাগুলোতেই এসে আশ্রয় নিল সুদানী কুচক্রীরা।
যে রাতের ঘটনা, সে রাতে মাটির তলার এ মহল ও কামরাগুলোতে ছিলও আলোর ছড়াছড়ি। হাজার হাজার হাবশী সেনার পদভারে সরগরম হয়ে উঠেছিল গোটা পার্বত্য অঞ্চল। এ পাহাড়শ্রেণীর এক জায়গায় চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত এক বিশাল মাঠ। মাঠটি ছিল মনোরম সবুজ ঘাসে ভরা।
ওখানে সমবেত করা হলো সুদান থেকে আনা নিগ্রো হাবশী যোদ্ধাদের। সবাই এসে সমবেত হলে হাবশীদের ধর্মগুরু চিৎকার করে বললো, ‘উঁচু স্বরে কথা বলো না কেউ। একটু পরই তোমাদের সামনে হাজির হবেন তোমাদের ভগবান। মনের মধ্যে ভক্তি ও বিশ্বাস দৃঢ় করো। ভয় করো তার আক্রোশকে।’
ভয় ও আশংকায় কানে কানে কথা বলতেও ভুলে গেল লোকগুলো। সবচেয়ে বড় পাহাড়টার দিকে মুখ করে বসে ছিল ওরা। পাহাড়টির নিচ থেকে চূড়া পর্যন্ত খোদাই করা এক বিশাল মূর্তি। আবু সাম্বালের মূর্তি বলে পরিচিত এটা। হাবশীদের বলা হলো, ‘এটাই তোমাদের ভগবানের মূর্তি। আজ এ মূর্তি মানুষের রূপ নিয়ে সবার সামনে উপস্থিত হবে।’
সহসা মেঘের গর্জনের মত গুরুগম্ভীর গর্জন ভেসে এলো। হাবশীরা আগে থেকেই চুপ করে ছিল। এ গর্জন শোনার পর তাদের নিঃশ্বাসও যেন বন্ধ হয়ে গেল। এরপরই ভেসে এলো আরও একটি আওয়াজ, ‘ভগবান জেগে উঠছেন। সামনের পাহাড়ের দিকে থাকাও।’
গুরুগম্ভীর জোরালো কণ্ঠের ধ্বনি। পাহাড়ে ও উপত্যকায় এ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো বার বার।
এরপরই আকাশে দেখা গেলো দুটো উড়ন্ত অগ্নিশিখা। শিখা দুটো পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেল এবং পাহাড়ের সাথে ধাক্কা খেলো। সাথে সাথে সেখান থেকে ছড়িয়ে পরলো সহস্র আগুনের টুকরো। এ অগ্নিশিখায় আলোকিত হয়ে উঠলো আবু সাম্বালের মূর্তি।
মূর্তির মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়লো আলো। দেখা গেলো, সে বিশাল মূর্তির চোখ মিটমিট করছে। তার মুখ বারবার খুলছে ও বন্ধ হচ্ছে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, সবারই মনে হলো, মূর্তির মুখ ডানে বায়ে দুলছে।
হাবশীগুলোর ধর্মগুরু ভক্তিতে সিজদায় পড়ে গেলো। তার দেখাদেখি সিজদায় লুটিয়ে পড়লো মাঠে সমবেত হাজার হাজার নিগ্রো সৈন্য।
ধর্মগুরু একটু পর সিজদা থেকে মাথা তুলে বললো, ‘সবাই ভগবানের কাছে মন খুলে প্রার্থনা করো।’
লোকগুলো সিজদা থেকে মাথা তুললো। দু’হাত প্রসারিত করে প্রার্থনা জানাতে লাগলো ওরা।
ধর্মগুরু উচ্চস্বরে বলতে লাগলো, ‘হে আগুন ও পানির খোদা! মরুভূমির তপ্ত বালুর খোদা! নদীতে পানি দেয়ার খোদা! আমরা তোমাকে দেখেছি। তুমি আমাদের বলে দাও, তোমার পদতলে আমরা কত মানুষ বলি দেবো। পুরুষ দেবো, না নারী দেবো?’
‘একটি পুরুষ ও একটি নারী।’ পাহাড়ের দিক থেকে শব্দ হলো, ‘তোমরা এখনও আমাকে দেখোনি। আমি মানুষের রূপ নিয়ে তোমাদের সামনে আসছি। যদি তোমরা আমার শত্রুদের শেষ না করো, তবে তোমাদের সকলকে এ পাহাড়ের পাথর বানিয়ে রাখবো। তোমরা চিরদিন রৌদ্রে পুড়তে থাকবে। তোমাদের মধ্যে যারা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পলায়ন করবে, মরুভুমির বালু তাদের রক্ত চুষে নেবে। তোমরা অপেক্ষা করো, একটু পরই আমি দর্শন দেবো তোমাদের।’
সারা মাঠে পিনপতন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। অগ্নিশিখা ধিরে ধিরে কমে আসতে লাগলো। পাহাড়ের মধ্যে হাবশীদের ধর্মীয় সঙ্গীত বেজে উঠলো। বহু লোকের সমবেত কণ্ঠের এ সঙ্গীত। এ সঙ্গীত শুধু তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই বাজানো হয়। কণ্ঠের সাথে পাল্লা দিয়ে বাজছিল ঢোল তবলা, এটাই রীতি। নীচে বসে হাজার হাজার হাবশী মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনছিল এ সঙ্গীত। চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত খোলা মাঠে বসে রাতের এ আবছা অন্ধকারে গান শুনতে শুনতে ওদের মনে হচ্ছিল, ওরা কোন অদৃশ্যলোকে পৌঁছে গেছে। অপার্থিব কোন জগত থেকে ভেসে আসছে হৃদয় মথিত করা গান।
জোহরা বসেছিল কমান্ডারের তাঁবুতে। তার কণ্ঠে উচ্ছসিত আবেগের জোয়ার। সে কমান্ডার কে বলছিলো, ‘যদি আমি তোমাকে না দেখতাম তবে সারা জীবন নেচে গেয়ে, অন্যের মনতুষ্টি করেই হয়তো কাটিয়ে দিতাম। তোমাকে দেখার পর থেকে মনে হচ্ছে, আমি এক বাপের আদরের মেয়ে, কোন অসভ্য নির্লজ্জ নর্তকী নই। যদি আজ হঠাৎ কোন কারণে তুমি মারা যাও, মনে করবো আমার বাবা মারা গেছেন। আমি আবার নতুন করে এতিম হয়ে যাবো। যারা আমাকে নর্তকী হিসাবে ভাড়া এনেছিল তাদের সাথে আমার লেনদেন শেষ হয়ে গেছে। ওরা হয়তো আমাকে আমার মালিকের হাতে ফিরিয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু আমি আর তার কাছেও ফিরে যেতে চাই না। এখন থেকে আমি এখানেই থাকবো। আমি আমার বাবার কাছে থাকবো।’
‘দুর পাগলী! এটা সেনা ক্যাম্প না! এখানে তো তোকে রাখা যাবে না।’
‘যদি আমাকে এখানে রাখতে অসুবিধা হয়, তবে আমাকে তোমার গ্রামের বাড়ী পাঠিয়ে দাও।’ জোহরা জেদ ধরে বললো, ‘যদি আশ্রয় দিতে না পারো তবে আমাকে মেরে ফেলো, কিন্তু আমাকে ফিরে যেতে বলো না, কিছুতেই আমি আর ফিরে যাবো না।’
‘না জোহরা, অবুঝ হয়ো না। এমন জেদ করো না, যা রক্ষা করা আমার সাধ্যের অতীত।’ কমান্ডার বললো, ‘এখন তুমি বাড়ী ফিরে যাও। আমি ওয়াদা করছি, তোমাকে তোমার বাড়ী পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবো। তুমি তোমার কায়রোর ঠিকানা দিয়ে যাও আমাকে। যখন আমি ছুটি পাবো তখন তোমাকে সেখান থেকে আমাদের বাড়ীতে নিয়ে যাবো।’
কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না জোহরা। অবশেষে অনেক বলে কয়ে জোহরাকে ফেরত যেতে রাজি করালো কমান্ডার।
কিছুক্ষণ পর। কমান্ডার দুটো ঘোড়া প্রস্তুত করে জোহরাকে বললো, ‘চলো, তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’
ঘোড়ার উপর চড়ে বসলো ওরা। চলতে শুরু করলো ঘোড়া।
জোহরা কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘রাতের অন্ধকারে এখানে এত নৌকা আসে আসে কেন? দিনের বেলা তো এত নৌকা দেখি না!’
‘কি! নৌকা?’ কমান্ডার আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোন দিক থেকে আসে?’
‘ঐ দিক থেকে।’ সে সুদানের দিকে ইঙ্গিত করলো।
‘তুমি জানলে কি করে?’
ইদানিং রাতে আমার ঘুম আসে না। কখনো কখনো মাঝ রাতে বিছানা থেকে উঠে তাঁবুর বাইরে গিয়ে বসে থাকি। আপনার এখান থেকে বিদায় নিয়ে প্রথম যেদিন নদী পারের ক্যাম্পে গিয়ে উঠলাম, কিছুতেই ঘুম আসছিল না। রাতে পালিয়ে আপনার কাছে ছুটে এলাম। ভোর রাতে আপনি যখন আমাকে পৌঁছে দিলেন, ফিরে দেখি সেই ক্যাম্পের এক লোক না ঘুমিয়ে বসে আছে।
আমাকে সে জেরা করলো, কোথায় গিয়েছিলাম, কেন গিয়েছিলাম, ইত্যাদি। আমি নদীর পাড়ে হাঁটতে গিয়েছিলাম বলে তাকে এড়িয়ে গেলাম।
সে আমাকে শাসিয়ে বললো, তাকে না জানিয়ে যেনো ক্যাম্পের বাইরে কোথাও না যাই।
কিন্তু পরদিন ঘুম না আসায় মাঝ রাতে তাঁবুর বাইরে এলাম। দেখলাম, ওখানকার কাণ্ডকারখানা। প্রথম রাতে দেখলাম তিনটি, পরের রাতে দু’টি বিরাট বিরাট পাল তোলা নৌকা এসে কূলে ভিড়লো। নৌকার সাদা পাল রাতের অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
নৌকাগুলো নদীর পাড়ে লাগলে বহু লোকের গুঞ্জন শোনা গেল। আমি অন্ধকারে লুকিয়ে এগিয়ে গেলাম নদীর ঘাটের দিকে। তাকিয়ে সব দেখলাম।’
‘কি দেখলে?’ বিস্মিত কমান্ডার প্রশ্ন করলো।
‘দেখলাম নৌকা থেকে বহু লোক নেমে এল। এরপর তারা গাছের তল দিয়ে হেঁটে সোজা পাহাড়ের দিকে চলে গেল এবং পাহাড়ের মধ্যে সবাই অদৃশ্য হয়ে গেল।’
‘তুমি কি আমাদের দু’জন সিপাইকে টহল দিতে দেখোনি?’ কমান্ডার জিজ্ঞেস করলো, ‘তারা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে টহল দেয়। তাদের ডিউটি থাকে এই নদীর পাড়ে।’
‘না।’ জোহরা উত্তর দিলো, ‘আমি কখনও কোন সিপাইকে এখানে ডিউটি করতে দেখিনি। দিনের বেলা দু’জন সিপাই আসে, কাফেলার ক্যাম্পেই তারা আহার-নিদ্রা করে। একদিন আমি এক সিপাইকে একটি মেয়ের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছি। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে ওরা হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে গেল।’
জোহরার জানা ছিল না সীমান্তে কি কাণ্ডকারখানা চলছে আর কি হতে যাচ্ছে। সীমান্ত প্রহরীদের দায়িত্ব সম্পর্কেও তার কোন জ্ঞান ছিল না। তার এটাও জানা ছিল না, রাতে বা দিনে সুদানীদের নৌকা এদিকে আসা উচিত কি অনুচিত। সে সরল মনে যে প্রশ্ন করেছে, কমান্ডারের জন্য তার মধ্যে ছিল ভয়ংকর গুরুত্বপূর্ণ খবর। জোহরা যা বলেছে তা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে সে অত্যন্ত জরুরি ও অতি গোপনীয় এক তথ্যই সরবরাহ করেছে।
জোহরার কথায় কমান্ডার চমকে সজাগ হয়ে উঠলো। জোহরাকে বললো, ‘এসো, আজ এ নদীর পাড়েই ঘুরে বেড়াই।’ তারা নদীর পাড়ে গিয়ে পৌঁছলো। নদীর তীর ধরে পাশাপাশি ধীরে ধীরে চলতে লাগলো ওরা। কমান্ডারের দৃষ্টি নদীর উপরে ছুটে বেড়াতে লাগলো। ওরা পথ চলছিল নদীর পাড়ের রাস্তা ধরে। রাস্তাটা বৃক্ষের ছায়ায় বেশ অন্ধকার। হঠাৎ নদীর মাঝে একটু আলোর আভা দেখা গেল। মনে হল কোন লণ্ঠনের আলো। পরে আরও একটি আলো দেখা গেল। পরে অকস্মাৎ দুটো আলোই এক সঙ্গে নিভে গেল।
এদিকে নদীর কূলেও একটি আলো জ্বলে উঠেই সঙ্গে সঙ্গে আবার নিভে গেল। কমান্ডার কোথাও প্রহরীদের দেখতে পেলো না।
কমান্ডার নদীর তীর থেকে একটু উপরে যেখানে প্রহরীদের সেন্ট্রি রুম, সেখানে গেল। নাম ধরে ডাকলো সিপাইদের, কিন্তু কোথাও তাদের কোন সাড়া নেই। কমান্ডার আবারও উচ্চস্বরে ডাকলো, তবুও কোন উত্তর পাওয়া গেল না।
জোহরাকে নিয়ে কমান্ডার সতর্কতার সাথে আবার নিচে নেমে এলো।
সামনের নদীতে দুটো নৌকার সাদা পাল দেখা যাচ্ছে। কমান্ডার অধীর হয়ে উঠলো। তার সাথে যে জোহরা নামের একটি মেয়ে আছে সে কথাও বেমালুম ভুলে গেল।
সে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। জোহরাও তার পেছন পেছন ঘোড়া ছুটালো। কমান্ডার ছুটছে আর সিপাইদের ডেকে যাচ্ছে চাপা স্বরে।
ডিউটিতে আসা সৈন্য দু’জন তখন পাহাড়ের আড়ালে অভিসারে মত্ত। হঠাৎ তাদের কানে কমান্ডারের ডাক পৌঁছলো। তারা দ্রত সেখান থেকে উঠে ছুটে গেল যেখানে তাদের ঘোড়া রেখেছিল, সেখানে। যেখানে তাদের ঘোড়া বাঁধা ছিল সেখানে গিয়ে দেখলো দুটো ঘোড়াই গায়েব হয়ে গেছে। তারা সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। তাকিয়ে দেখলো, দূরে কারা যেন তাদের ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
কমান্ডারের ঘোড়া আগে, জোহরার ঘোড়া পিছনে, দু’জনেই ছুটছে সমানে। হঠাৎ অন্ধকার থেকে কে যেন বললো, ‘তুমি যাদের ডাকছো তারা অনেক আগে চলে গেছে।’
‘তোমরা কে?’ কমান্ডার জিজ্ঞেস করলো, ‘সামনে এসো।’
‘আমরা মুসাফির মানুষ।’
অন্ধকার থেকে দুটো ঘোড়া কমান্ডারের দিকে এগিয়ে এলো। কমান্ডার তলোয়ার বের করলো।
‘রাতে কোন মুসাফিরের অশ্বে আরোহন এবং সীমান্তে সন্দেহজনক ঘোরাঘুরির মানে জানো তোমরা?’ কমান্ডার ওদের চ্যালেঞ্জ করলো।
ওরা কমান্ডারের কাছে এসে থেমে গেল। একজন বললো, ‘ওদিকে দেখুন, ওরা আসছে।’ যখনই কমান্ডার সেদিকে তাকিয়েছে, লোক দু’জন হঠাৎ আক্রমন করে বসলো তার উপর। ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিতে চাইল ঘোড়া থেকে। পতন ঠেকাতে হাতিয়ার ফেলে ঘোড়ার পিঠ খামচে ধরলো কমান্ডার।
লোক দু’জন জাপটে ধরলো তাকে। এমন শক্ত ভাবে চেপে ধরলো, তার নড়ারও ক্ষমতা রইল না। একজন দ্রত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল কমান্ডারকে। এরপর ছুটল মেয়েটার উদ্দেশ্যে। দ্রুত তাকেও বেঁধে ফেলল। যে লোক কমান্ডারকে ধরে রেখেছিল সে ঘোড়াকে তারা দিল এগিয়ে যাবার জন্য।
ঘোড়া যখন চলতে শুরু করলো, ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো কমান্ডারের। অন্ধকারের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল আরও একজন। সে কমান্ডারের ঘোড়ায় চড়ে বসে তাকে ধরে থাকলো।
জোহরা চিনতে পারলো, এরা সেই বাজনাদার, যারা তাকে ভাড়া করে এনেছিল। আসলে এরা ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুদানী কমান্ডো সৈন্য। কমান্ডারের ডাক–চিৎকারে ওরা সতর্ক হয়ে গিয়েছিল এবং অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে জোহরা ও কমান্ডারকে আটক করতে সক্ষম হলো।
প্রহরীদের ঘোড়া এরাই চুরি করেছিল। সেই ঘোড়ায় চড়ে কমান্ডার ও জোহরাকে নিয়ে এগিয়ে চললো ওরা।
তাদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলো, ‘এদেরকে জীবিত নিয়ে চলো। উপর থেকে আদেশ আছে, কোন সন্দেহজনক লোক পেলে জীবিত ধরে নেয়ার।’
কমান্ডার জোহরাকে নিয়ে ওরা পাহাড়ের দিকে রওনা দিলো। নদীর ঘাট থেকে রওনা হবার সময় কমান্ডার দেখলো, নৌকার মধ্য থেকে কালো হাবশীরা দল বেঁধে নেমে আসছে। সঙ্গে প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী।
দুর্ভেদ্য দুর্গের মত পাহাড়ী অঞ্চলের হাজার হাজার হাবশী অপলক চোখে তাকিয়ে আছে আবু সাম্বালের মূর্তির দিকে। ধীরে ধীরে উড়ন্ত আলোর শিখাগুলো নিভে এলো। ধর্মীয় সঙ্গীতের মোহময় সুর ক্রমাগত বেজে চলেছে। সেই সুরের মূর্ছনা আঘাত হানছে হাবশীদের হৃদয়তন্ত্রীতে। যাদুর মত তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে রক্ত কণিকায়। সে প্রভাবে উদ্বেলিত ও উত্তেজিত হয়ে উঠছে ওদের হৃদয়গুলো। অন্তরে খেলা করছে অজানা শিহরনের বিমুগ্ধ স্রোত।
যে অল্প ক’জন হাবশী নিজ চোখে ভগবানকে দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য পাচ্ছে, নিজেকে তাদের একজন ভেবে গর্ব ও অহংকারে স্ফীত হয়ে উঠছে বর্বর হাবশীদের বুকগুলো। ওরা নিজেদেরকে এখানে অনুপস্তিত হাবশীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সৌভাগ্যবান ভাবতে লাগলো।
এক সময় থেমে গেল পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তোলা সঙ্গীতের সেই সুর। তখনি পাহাড়ের উপর আবার দেখা গেল বিদ্যুতের চমক। মনে হলো আকাশ থেকে গড়িয়ে পড়ছে সোনালী বিদ্যুতের কণা। এক সময় তা আবার এসে স্থায়ী হলো মূর্তির সম্মুখভাগে। আলোয় আলোময় হয়ে গেল মাথার উপরের আকাশ।
আবু সাম্বালের মূর্তির ওপর কোত্থেকে এলো এই আলো, কেউ জানতে পারলো না। মনে হচ্ছিল, অপার্থিব এ আলো ঠিকরে পড়ছে আবু সাম্বালের মূর্তি থেকে। নিজের আলোতেই তার চেহারা আলোময় হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ আলো নিভে গেল! একটু পর আবার যখন সেখানে আলো ফুটলো, দেখা গেল, আবু সাম্বালের মুখ দিয়ে একজন লোক বেরিয়ে এসে মূর্তির বিশাল ঠোঁটের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে।
তার পিছনে এসে দাঁড়াল আরও চারজন লোক। ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা লোকগুলোর শরীর। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত সমস্ত শরীরই সেই চাদরের নিচে। শুধু মুখগুলো আবরণ মুক্ত। সামনের লোকটিকে সম্রাটের মত দেখাচ্ছিল। তার মাথায় রাজ মুকুট। রাজ মুকুটের ওপর সাপের এক বিশাল ফণা। সেই ফণা থেকে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে। সে আগুনের হল্কার আলো এসে পড়ছে সম্রাটের গায়ের ওপর।
কোত্থেকে কেমন করে এই আলো আসছে কেউ বুঝতে পারল না। কিন্তু সেই আলো তার গায়ের তারকাখচিত কাপড়ে যখন পড়ছিল, তখন তা চমকাচ্ছিল দ্যুতি ছড়িয়ে।
তার এক হাতে বর্শা ও অন্য হাতে খোলা তলোয়ারও চমকাচ্ছিল। সাদা চাদর পরা লোকগুলো তার পেছনে দাঁড়িয়ে রইল।
পিনপতন নীরবতা মাঠ জুড়ে। ভয় আর মুগ্ধতার আবেশে নিথর হয়ে আছে লোকগুলো।
সেই নিরবতা খান খান হয়ে গেল পেছনের চার সাদা চাদরওয়ালার গুরুগম্ভীর উচ্চ রবে, ‘ভগবান নেমে এসেছেন মাটির পৃথিবীতে! খুব ভাল করে দেখে নাও তাকে। তারপর সিজদায় লুটিয়ে পড়ে প্রার্থনা করো তার কাছে।’
মাঠের দশ হাজার হাবশী সৈন্য একসাথে সিজদায় পড়ে গেল।
একটু পর আবার শোনা গেল গুরুম্ভীর ধ্বনি, ‘মাথা উঠাও, ভাল করে দেখে নাও ভগবানকে।’
সেজদা থেকে মাথা তুলল লোকগুলো। ভক্তিমাখা চোখে তাকালো ভগবানের দিকে।
ভগবান তার তলোয়ার উর্ধে তুলে ধরে পাথরের সাথে আটকে রাখা অদৃশ্য রশির মই বেয়ে মূর্তির পায়ের পাতায় এসে দাঁড়াল। তার দেখাদেখি নেমে এলো তার সঙ্গীরাও। উপস্তিত লোকগুলোর মনে হলো পাহাড়ের চূড়া থেকে ওরা উড়ে পাতালে নেমে এসেছে।
মূর্তির পায়ের পাতা দুটো বিশাল এবং উঁচু মঞ্চের মত দেখাচ্ছিল মাঠ থেকে। যেমন মঞ্চ বানানো হয় কোন মাঠে সভা করার সময়। লোকগুলো বসেছিল সেই মঞ্চের সামনে। সারা মাঠ ছিল অন্ধকার। কিন্তু ভগবান ও তার সঙ্গীদের ওপর কোত্থেকে যেন কোমল আলো এসে পড়ছিল। সেই আলোয় সৈনিকরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল তাদের।
এ সময় সবাইকে বিস্মিত ও অবাক করে চারজন অপ্সরী সেই আলোতে প্রবেশ করলো। তাদের পরণে পাতলা ঘাগরা। পিঠে পরীর মত দুই ডানা। মাথার চুলগুলো খোলা। মেয়েরা পরীর মত উড়ার ভঙ্গিতে ভগবানের চারপাশে নৃত্যের তালে তালে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতো আবার খনিক বাদে ছুটে আসতো নাচতে নাচতে। নাচের তালে তালে উড়তো ওদের মাথার চুল, পরীর ডানা।
পাহাড়ে যখন ভগবানের এই খেলা ও লীলা চলছিল ঠিক সে সময় চারজন লোক কমান্ডার ও জোহরাকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো।
তারা পর্বতের ভেতর ফেরাউনদের তৈরী মহলের এক কামরায় ওদের বন্দী করে রেখে একজনকে বাইরে পাঠিয়ে দিল। একটু পর সে অন্য একজনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো বন্দীদের কাছে।
‘এ লোক মিশরের বর্ডার ক্যাম্পের কমান্ডার আর মেয়েটি আমাদের ভাড়া করা নর্তকী। যখন আমাদের নৌকা থেকে হাবশীরা তাদের মালসামান ও রসদপত্র নামাচ্ছিল, তখন নদীর পাড়ে ওদের পেয়ে ধরে নিয়ে এসেছি।’ নবাগত লোকটিকে বললো সে।
কমান্ডার ও জোহরাকে ভাল করে দেখলো লোকটি। তার মুখে ফুটে উঠলো হাসি। বললো, ‘তুমি এদেরকে ঠিক সময়েই নিয়ে এসেছো। এই জংলী হাবশীরা মানুষের কোরবানীর জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। আমরাও আলকিন্দির আদেশে ঘোষণা দিয়েছি, ভগবানের আদেশ মত একজন পুরুষ ও একজন নারীকে কোরবানী দেয়া হবে।’ আমার ওপর হুকুম ছিল, ‘যেখান থেকে পারো একটি পুরুষ ও একজন নারীকে ধরে এনে দাও।’ আমি এখন মানুষ খোঁজার বিপদ থেকে বেঁচে গেলাম। ভালই হলো। তোমরা এক কঠিন সমস্যার সমাধান করে দিয়েছো, এ জন্য তোমাদের ধন্যবাদ।’
‘মনে হচ্ছে আমরা সফল হবো, কারন প্রতিটি কাজেই আমরা ভাগ্যের সহায়তা পাচ্ছি। এত সহজে কোরবানি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি।’ বললো অন্যজন।
একজন বললো, ‘হাবশীদের খুব শখ ছিল তাদের ভগবানকে দেখার। তাদের সে শখও পূরণ হয়েছে।’
‘আমরা হাবশীদের ভগবানকে কি কৌশলে দেখিয়েছি, তা যদি দেখতে, তবে তুমিও তার ভক্ত হয়ে যেতে।’
‘দেখার বড় লোভ ছিল, কিন্তু তা আর পারলাম কই? নিশ্চয়ই খুব জমকালো অনুষ্ঠান হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, পুরো অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ছিল এন্ডারসনের ওপর। ওর কাজকর্ম তো তুমি জানোই, সব কাজই সে নিখুঁত দক্ষতার সাথে করে।
প্রথমে সামনের পাহাড় থেকে দু’টি তীর নিক্ষেপ করে। তীর দুটোতে ছিল অগ্নিশিখা। তীর দুটো যেখানে পড়ে সেখানে এবং তার আশেপাশে আগেই তেল ও পেট্রোল জাতীয় বস্তু ছড়িয়ে রাখা হয়েছিল। তীর দুটো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আগুন ধরে গেল। মূর্তির মুখ আলোকিত হয়ে উঠল তাতে। এন্ডারসন কেমন করে জানিনা, সে আলোয় এমন একটি ভাব এনে দিল, মনে হলো, মূর্তিটি হাসছে, নড়াচড়া করছে। আলোর কারসাজিতে আমরাও দেখলাম, মূর্তিটির চেহারা ডানে বায়ে নড়াচড়া করছে।’
‘এরপর কি হলো? হাবশীদের মাঝে এর কি প্রতিক্রিয়া দেখা গেল?’ আগ্রহের সাথে জানতে চাইল সে।
‘তারা সবাই সিজদায় পড়ে গেল। এদিকে আস্তে আস্তে আলো নিভে গেল। আমরা আবার পেট্রোল ঢাললাম পাহাড়ে, মূর্তির গায়ে। হাবশীরা ভয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে বসে কাঁপছিল। অন্ধকারে আমরা আলকিন্দিকে পোশাক পরিয়ে মূর্তির কোলে বসিয়ে দিলাম। তার সঙ্গী হলো চারজন।
মূর্তির উপরে ‘সামেন’ পাহাড় থেকে অত্যন্ত সফল ভাবেই আলো নিক্ষেপ করা সম্ভব হয়েছিল। নিচে থেকে সামেন পাহাড়ের অগ্নিশিখা দেখতে পাচ্ছিল না কেউ, একটি বিরাট আয়নার সাহায্যে সেই আলো ফেলা হলো মূর্তির ওপর। আলোর কিরণে আলোকিত মূর্তি দেখে মনে হচ্ছিল, এ আলো মূর্তির নিজস্ব আলো।
তারপর আলকিন্দি যখন ভগবান সেজে দেখা দিল তখন আমাদের মেয়েরা স্বর্গের অপ্সরী সেজে তার চারপাশে এমনভাবে নাচলো, মনে হলো আমরা তখন স্বর্গেই আছি। তার সামনে দিয়ে সবাই নত হয়ে হেঁটে যাবে। তাদেরকে বলতে হবে, ভগবান স্বয়ং যুদ্ধের নেতৃত্ব দেবেন।’
‘বন্দী কমান্ডার ও জোহরাকে কি আজই কোরবানি করা হবে?’
‘সে সিদ্ধান্ত হাবশীরাই নেবে। সম্ভবত তারা দু’চারদিন তাদেরকে পেলে পুষে বশ মানাবে। তাদের কিছু ধর্মীয় নিয়ম পদ্ধতি পালন করাবে।’
তাদের কথার মাঝখানেই কিছু লোকের পদধ্বনি ও হাসির শব্দ কানে এল। ওরা তাকিয়ে দেখলো, আলকিন্দি ও তার চার সাথী এগিয়ে আসছে।
আলকিন্দি কাছে এলে ওরা বললো, ‘একজন পুরুষ ও একজন নারীকে হঠাৎ হাতে পাওয়া গেছে। এ দু’জনকেই বলীর জন্য হাবশীদের হাতে সমর্পণ করা যেতে পারে।’
আলকিন্দি জিজ্ঞেস করলো না, মানুষ দু’টি কে বা কারা। সে মাথা থেকে রাজমুকুট নামিয়ে বন্দীরা যে কামরায় ছিল সেখানে প্রবেশ করল। কমান্ডার ও জোহরা বন্দী অবস্থায় চুপচাপ বসেছিল সেখানে। কমান্ডারের পরণে সামরিক পোশাক ছিল না, আলকিন্দি তাকে চিনতে পারল না। কিন্তু কমান্ডার আলকিন্দিকে ঠিকই চিনতে পারল।
কামরার বাইরে লোক দু’জন যখন ওদের নিয়ে আলাপ করছিল তখনও কয়েকবারই কমান্ডার আল কিন্দির নাম শুনে ছিল। তাকে দেখতে পেয়ে তাই কমান্ডার খুব অবাক হয়নি, কিন্তু তিনি এখানে কি করছেন সে বুঝতে পারল না।
আলকিন্দি কামরা থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, ‘ঠিক আছে, ওদেরকে হাবশীদের ধর্মীয় নেতার কাছে তুলে দাও।’
আল কিন্দির এ কথায় কমান্ডার নিশ্চিত হয়ে গেল, তাকে ও জোহরাকে কোরবানী দেয়ার ফায়সালা চূড়ান্ত হয়ে গেছে।
আল কিন্দি বেরিয়ে গেলে একজন বললো, ‘কমান্ডারের ভাগ্যটাই খারাপ, নইলে বলীর পাঠা সেই হতে যাবে কেন?’
‘আরে রাখো, এ তো সবে শুরু। এই বলী যখন হাবশীদের পাগল করে তুলবে রক্তের জন্য, তখন তো কায়রোর সব কমান্ডারই বলীর পাঠা হয়ে যাবে।’ বললো তার সঙ্গী। এ কথা শুনে সঙ্গীটি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
❀ ❀ ❀