» » গোপন বিদ্রোহী

বর্ণাকার

হাবশীরা ছুটল নদীর দিকে। নদীর পাড়ে গিয়ে দেখলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্ত, এক পাশে পড়ে আছে দুটো পালকি। একজন সেই রক্তের দিকে ইশারা করে ঘোষণা করলো, ‘এই সেই মনোনীত পুরুষ ও নারীর রক্ত, যাদেরকে এখানে গত রাতে বলীদান করা হয়েছে।’

হাবশীরা সন্তুষ্ট চিত্তে ফিরে এলো আস্তানায়। রিপোর্ট করলো যার যার কমান্ডারের কাছে গিয়ে।

হাবশী সৈন্যদের সংখ্যানুপাতে গ্রুপ ভাগ করে ফেলা হলো। তীরন্দাজরা পৃথক হয়ে গেল তাদের দলে। বর্শাধারীরা সমবেত হলো বর্শাধারীদের ওখানে। যুদ্ধের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদেরকে সাজানো শেষ হলে হাশীদের নিয়ে পাহাড়ী এলাকা থেকে বের হয়ে এলো আলকিন্দি। হাবশীদের নিয়ে ছুটলো কায়রোর দিকে।

হাবশীরা যুদ্ধের গান গাইতে গাইতে অগ্রসর হচ্ছিল। দশ হাজার নিগ্রোর বিশাল কাফেলা। বীর দর্পে এগিয়ে চলেছে মরুভূমিতে ধূলিঝড় তুলে।

রাত হয়ে গেলে এক স্থানে ক্যাম্প করে বিশ্রাম নিল ওরা। পরদিন সকালেই আবার শুরু হলো ওদের যুদ্ধ যাত্রা।

পাহাড়ী অঞ্চল অনেক পিছনে পড়ে রইলো। এগিয়ে চললো কাফেলা। দিনভর পথ চললো ক্লান্তিহীনভাবে। সূর্য অস্ত গেল। কায়রো এখনো অনেক দূর। আরও একটি রাত পথেই কাটাতে হলো তাদের। হাবশী সৈন্যদের ক্যাম্প করতে বলা হলো। তারা খেয়ে দেয়ে মরুভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে পড়লো।

মধ্যরাতের পর।

হাবশীরা ঘুমিয়েছিল। মিশরের কমান্ডো বাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের ওপর। মরুভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে থাকা সুদানী হাবশী সৈন্যরা কিছু টের পাওয়ার আগেই একদিক থেকে কমান্ডো বাহিনীর একটি দল মার মার, কাট কাট করে ঝড়ের বেগে বয়ে গেল তাদের ওপর দিয়ে। বহু হাবশী সৈন্য তাদের ঘোড়ার পদতলে পিষে মারা গেল।

হাবশীদের মাঝে মহা হুলস্থুল পড়ে গেল। আহতদের আর্ত চিৎকারে ভারী হয়ে উঠল মরুর বাতাস। কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলো না তারা। মাত্র কয়েক মিনিটের একটি ঝড়, তারপর সব সুনসান। কোথাও কোন বাহিনীর ছায়াও দেখা যাচ্ছে না।

সম্বিত ফিরে পেয়ে সৈন্যরা আহতদের ব্যান্ডেজ বাঁধতে লেগে গেল। বাকীরা এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে কোত্থেকে এই আকস্মিক ঝড় এলো তাই নিয়ে শঙ্কিত চিত্তে জটলা করছে। এ সময় হঠাৎ অন্য পাশ থেকে বয়ে গেল আরও একটি ঝড়। প্রচণ্ড গতিতে কমান্ডোরা আক্রমণ চালালো ওদের ওপর। অশ্ব পদতলে পিষ্ট হওয়া ছাড়াও বর্শা ও তলোয়ারের আঘাতে ধরাশায়ী হলো অসংখ্য হাবশী সেনা। দশ হাজার হাবশীর বিশাল বাহিনীর একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল মিশরীয় বাহিনী। মুহূর্তে হারিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে।

আলকিন্দি দ্রুত অবশিষ্ট ফৌজকে সংগঠিত করে প্রস্তুত হয়ে গেল পরবর্তী হামলা মোকাবেলার জন্য। সুদানী কমান্ডার ও খৃষ্টান উপদেষ্টারা বললো, ‘এ গেরিলা আক্রমণ বলে দিচ্ছে, ‘আমাদের প্রতিটি নড়াচড়া মিশরীয় বাহিনী প্রত্যক্ষ করছে।’

আলকিন্দি বললো, ‘সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর এ এক বিশেষ ধরনের যুদ্ধ। এখন আমরা সামনেও অগ্রসর হতে পারবো না, পিছাতেও পারবো না। যেদিকেই কদম উঠবো সেদিকেই বিপদের পাহাড় ভেঙ্গে পড়বে।

তোমরা এখন যতই চেষ্টা করো মিশরের সেনাবাহিনীর সাথে মুক্ত মরুভূমিতে যুদ্ধ করে টিকতে পারবে না। এমনকি তোমরা অক্ষত অবস্থায় পালাতেও পারবে না। আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেছে। কায়রবাসী শুধু সজাগই হয়নি, তারা তাদের সেনাবাহিনীও পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন বাঁচার কোন পথ নেই। তবে পিছিয়ে গিয়ে ওই পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে যদি সেখান থেকে যুদ্ধ করতে পারো, তাহলে হয়তো কিছুটা রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

‘কেন, আমরা কি মিশরীয় সৈন্যদের মরুভূমিতে খুঁজে খুঁজে বের করে মারতে পারবো না?’ এক সুদানী কমান্ডার বললো।

আলকিন্দি বললো, ‘আমি মিশর বাহিনীর সেনাপতি, তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো না, এই সৈন্যদের সাথে কেমন কৌশলে লড়তে হবে।’

পরদিন ভোরবেলা।

হাবশী সৈন্যরা দেখলো, তাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে সহযোদ্ধাদের অসংখ্য লাশ। সে সব লাশের কোন সৎকার না করেই আলকিন্দির হুকুমে হাবশী সেনাদল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে চললো। পেছনে খোলা মরুভূমিতে পড়ে রইলো বন্ধুদের লাশগুলো।

আলকিন্দি ঠিকই বলেছিল, ওদের প্রতিটি নড়াচড়া মিশরীয় সৈন্যরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল। মিশরীয় বাহিনীর লক্ষ্য ছিল আলকিন্দির গতিবিধির ওপর।

হাবশী সৈন্যদের পিছাতে দেখে তকিউদ্দিন তাৎক্ষনিকভাবে বুঝে নিলেন, আলকিন্দি পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ করার প্ল্যান করেছে।

তিনি কাল বিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে অশ্বারোহীদের একটি দলকে পাহাড়ী এলাকায় পাঠিয়ে দিলেন। তাদের পিছন পিছন পাঠালেন তীরন্দাজ ও পদাতিক বাহিনীকে।

তিনি অধিকাংশ দক্ষ সেনাদের নিজের কাছে রেখে তাদের নিয়ে হাবশী বাহিনীকে অনুসরণ করে বহু দূর দিয়ে পাশাপাশি চলতে লাগলেন।

রাস্তাতেই রাত হয়ে গেল। হাবশীরা রাতে একস্থানে ক্যাম্প করে রাত কাটানোর ব্যবস্থা নিল।

আজ আর ওরা অরক্ষিত অবস্থায় ঘুমাতে গেল না। হাবশীদের একটি সেনাদলকে সজাগ রাখা হলো। তারা সবাই দক্ষ তীরন্দাজ। তারা তীর ধনুক নিয়ে সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে রইল।

রাতে মিশরীয় কমান্ডোরা হামলা করলো। বেপরোয়া তীর চালাতে লাগলো হাবশী তীরন্দাজরা। এতটা প্রতিরোধ আশা করেনি কমান্ডো বাহিনী, ফলে বহু অশ্বারোহী কমান্ডো আহত ও শহীদ হয়ে গেল।

এ হামলা মিশরীদের ভীষণ ক্ষতি হলো ঠিকই, কিন্তু হাবশীদের মনোবল একবারেই ভেঙ্গে গেল। যুদ্ধ করার সাহস ও শক্তি দুটোই হারিয়ে ফেললো ওরা।

যেখানে তাদের প্রত্যাশা ছিল, অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ওরা কায়রো দখল করে নেবে, সেখানে পথেই এ ঝটিকা হামলায় নাস্তানাবুদ হওয়ার ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তাছাড়া ওরা কেউ গেরিলা যোদ্ধা ছিল না, নিয়মিত লড়াই ও সম্মুখ যুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে কমান্ডোদের মোকাবেলা করতে গিয়ে ওরা নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছিল। এই অভিজ্ঞতা ছিল তাদের চিন্তা ও ধারনার অতীত।

শত্রু সেনাদের তারা দেখতেই পায় না, অথচ তারা ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালিয়ে মুহূর্তে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। হাবশীরা মিশরীয় বাহিনীর এই লড়াই পদ্ধতি ও সাথীদের অসংখ্য লাশের স্মৃতি নিয়ে যখন পাহাড়ী এলাকায় এসে পৌঁছলো, সূর্য ডুবে যেতে তখনও বেশ বাকি।

তারা পাহাড়ী অঞ্চলে প্রবেশ করলো। আলকিন্দি এ বাহিনীকে এক জায়গায় জড়ো না রেখে পাহাড়ের উপরে, নিচে ও পাদদেশে মোতায়েন করে দিলো। হুকুম পাওয়া মাত্র সৈন্যরা নিজ নিজ অবস্থানে পজিশন নিতে শুরু করলো। মাত্র অর্ধেক সৈন্য পাহাড়ের ওপর চড়েছে, তাদের উপরে ওপর থেকে তীর বর্ষণ শুরু হলো।

মিশরের ক্ষিপ্রগতি সৈন্য দল আগেই সেখানে গিয়ে পজিশন নিয়ে বসেছিল, ওরা তীরের আওতায় আসতেই শুরু করলো তীর বর্ষণ।

হাবশী সৈন্যরা চিৎকার ও শোরগোল করে পাহাড়ের আড়ালে পালালো। তারপর সেখান থেকেই তারা পাল্টা জবাব দিতে লাগলো তীর ছুঁড়ে। হাবশীদের অর্ধেক সৈন্য তখনও যুদ্ধের বাইরে। তাদেরকে পিছনে সরে যেতে বলা হলো।

আলকিন্দি যুদ্ধরত সৈন্যদের পাহাড়ের উপরে উঠে ওপর থেকে তীর চালাতে আদেশ দিল, কিন্তু যত বার ওরা উপরে উঠার চেষ্টা করলো ততবারই তকিউদ্দিনের সৈন্যদের তীর বৃষ্টির সম্মুখীন হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো ওরা।

তকিউদ্দিন তার তীরন্দাজদের বললেন, ‘ওদের যখন উপরে ওঠার এতই শখ, আবার যখন চেষ্টা করবে তাদের একটু সুযোগ দিও।’

তীরন্দাজদের এ হুকুম দিয়েই সরে গেলেন পাশের টিলায়। ওখানেও তার একদল তীরন্দাজ বসেছিল। আলকিন্দির একদল সৈন্য তীর নিক্ষেপ করতে করতে কৌশলে উপরে উঠে গেল। দলটি উপরে উঠে গেলে তকিউদ্দিন সেই টিলার তীরন্দাজদের হুকুম দিলেন, ‘তীর চালাও।’

আচমকা উল্টো দিক থেকে তীর ছুটে আসায় পিছন দিক থেকে আক্রান্ত হলো দলটি। তকিউদ্দিন চতুর্দিক থেকে ওদের ঘেরাও করে ফেললেন। অশ্বারোহীদের পাঠিয়ে দিলেন নদীর পাড়ে।

চতুর্দিক দিয়ে অবরোধের মধ্যে পড়ে গিয়ে বেপরোয়া হয়ে পড়লো হাবশী সৈন্যরা। তারা প্রাণপন চেষ্টা করলো মিশরীয় বাহিনীর মোকাবেলা করতে।

আসোয়ানের দুর্গম পর্বত শ্রেণী ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। সমতলে, পাহাড় চুড়ায় দু’দলের তীর বর্ষিত হচ্ছিল বৃষ্টির মত।

এবার ময়দানে নেমে এলো অশ্বারোহী বাহিনী। পাহাড়ের পাদদেশে যুদ্ধের নতুন ময়দানে তৈরী করলো অশ্বারোহীরা।

তারা একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঁধভাঙা জোয়ারের মত।

এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখতে দেখতে পশ্চিম আকাশের রক্তিম সূর্য এক সময় হারিয়ে গেল অন্ধকারের অতলে। সময়ের স্রোত বেয়ে নেমে এলো রাত। এই রাত হাবশীদের অন্তরে ভয় ও আতঙ্কের এক চরম বিভীষিকা ছড়িয়ে দিল। জড়সড় হয়ে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে গেল ওরা।

অপরদিকে মিশরীয় বাহিনীকে পেট্রোল ভেজা অগ্নি বোমা নিক্ষেপ করার আদেশ দিলেন তকিউদ্দিন। তারা স্থানে স্থানে অগ্নি বোমা নিক্ষেপ করতে লাগলো।

এরপর অগ্নি বোমার আলোতে দেখে দেখে শুরু করলো অগ্নি তীর নিক্ষেপ। রাতের অন্ধকারে আলোকিত হয়ে উঠলো চারদিকের অগ্নি শিখায়। এই আলোতেই যুদ্ধ চললো রাতভর।

তখনও ভোরের আলো ফুটে উঠেনি, হাবশীরা একেবারে নীরব হয়ে গেল। তারা মাটির তলের ফেরাউনের মহলগুলোতে গিয়ে লুকালো। মিশরীয় বাহিনী সে সব গোপন কক্ষে তল্লাশী চালিয়ে বহু কষ্টে তাদের বিতাড়িত ও বন্দী করলো।

সকাল হলো।

আলকিন্দির লাশ পাওয়া গেল মাঠের এক কোনায়। কোন তীর বা তলোয়ারের আঘাতে মারা যায়নি সে, নিজের তলোয়ার দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

কয়েকজন সুদানী কমান্ডার ও খৃষ্টান উপদেষ্টা ধরা পড়লো। হাবশী যুদ্ধ বন্দীর সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও বেশী। সুলতান তকিউদ্দিন যুদ্ধের ময়দান থেকেই সুলতান আইয়ুবীর কাছে এ সাফল্যের সংবাদ দিয়ে এক কাসেদকে পাঠিয়ে দিলেন। তাকে বললেন, ‘সুলতান নিশ্চয়ই খুব পেরেশান আছেন। তাকে জলদি গিয়ে এখানকার সংবাদ দাও। বলবে, আল্লাহ তার বান্দাদের বিজয় দান করেছেন।’

মুসলিম বিশ্বের যে এলাকায় আজ সিরিয়ার এক শ্রেনীর মুসলমান লেবাননী খৃষ্টানদের সাথে মিলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীদের সামরিক শক্তি বলে স্তব্ধ করে দিতে চাচ্ছে, সেখানে আটশ বছর আগে এক শ্রেণীর মুসলমান শাসক সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর নয় বছরের সন্তানকে সামনে রেখে খৃষ্টানদের সাহায্য ও সহযোগিতায় সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সামরিক জোট গঠন করেছিল। অথচ নুরুদ্দিন জংগীর একমাত্র অনুসারী মুসলিম হিতৈষী ছিলেন সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী।

সুলতান আইয়ুবী মুসলমানদের সেই প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাসকে খৃষ্টানদের কবল থেকে মুক্ত করার শপথ নিয়ে জিহাদে নেমেছিলেন। তাঁর মনে দুর্মর স্বপ্ন, মসজিদুল আকসায় দু’রাকাত নামাজ পড়া।

খৃষ্টানরা তাঁর জিহাদের মোকাবেলায় ফিলিস্তিন ধরে রাখতে পারতো না। কিন্তু ফিলিস্তিন উদ্ধারের পথে মুসলমানরাই তার বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো।

ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামীরা বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত করার জন্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে সিরিয়ার মুসলমানরা তাদেরকে তোপের তলায় গুড়িয়ে দিয়েছিল। আজও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। খৃষ্টান সমর্থিত ইহুদীদের কবল থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস মুক্ত করার জন্য জেহাদরত মুজাহিদরা মুসলিম বিশ্বের শাসকদের আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত। পরাশক্তি আমেরিকার জুজুর ভয়ে কাঁপছে সব ভেড়ার দল। অথচ একদিনের জন্য যদি মুসলিম বিশ্ব এক হতে পারতো তবে পাল্টে যেতো পৃথিবীর চেহারা। বিশ্বের মুসলমানদের দুর্ভাগ্য, তারা এমন লোককে শাসক বানায়, যারা আল্লাহর চাইতে আমেরিকাকেই ভয় করে বেশী।

১১৭৫ সালের মার্চ মাস। সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী পার্বত্য এলাকা ‘আর রিস্তান’ পর্বতমালার এক জায়গায় ক্যাম্প করে তাঁর সামরিক উপদেষ্টা ও কমান্ডারদের নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কিভাবে কোথায় নেয়া যায় সে বিষয়ে পরামর্শ করছিলেন।

তিনি হলবের অবরোধ উঠিয়ে খৃষ্টান সম্রাট রিমান্ডের মোকাবেলা করতে ছুটে এসেছিলেন এখানে। কিন্তু আইয়ুবীর সাথে যুদ্ধ না করেই কৌশলে সরে যায় রিমান্ড। হলববাসী তাদের আমীরদের মিথ্যা প্রচারে বিশ্বাস করে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। রিমান্ড ফিরে যাওয়ায় সুলতান আইয়ুবী আবার হলব আক্রমণ করে গাদ্দারদের ঘাঁটি ভেঙ্গে দেয়ার পরিকল্পনা করছিলেন, এমন সময় মিশর থকে সংবাদ আসে, তাঁর সেনাপতি আলকিন্দি খৃষ্টান ও সুদানীদের সাহায্য নিয়ে গোপনে মিশর আক্রমণের প্রতস্তুতি নিচ্ছে।

এ খবর পেয়ে সুলতান নতুন অভিযানে বেরোনোর আগে মিশরের অবস্থা কোন দিকে যায় বুঝার চেষ্টা করছিলেন। ফলে আর রিস্তান থেকে সৈন্য চালনায় বিরত থাকেন তিনি। সুলতান আইয়ুবীর ভাই সুলতান তকিউদ্দিন আলকিন্দিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছেন এবং আলকিন্দি আত্মহত্যা করেছে এ খবর তখনও সুলতানের কাছে এসে পৌঁছেনি। সে জন্য তিনি আর রিস্তান পর্বতমালায় তাঁর হেডকোয়ার্টারে অস্থির ভাবে বসে ছিলেন।

ইসলামের এ মহান খাদেম ও অনুসারী সব সময় চারদিকে বিপদ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। কতিপয় মুসলিম শাসক ও আমীর তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক জোট গঠন করে খৃষ্টানদের সহায়তায় তাঁর বিরুদ্ধে ময়দানে নেমে এসেছিল। তাদের তুলনায় সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম। কিন্তু আল্লাহর ওপর ভরসা করে জেহাদী জজবা নিয়ে তিনি মোকাবেলা করছিলেন তাদের।

তিনি এমন সব দুঃসাহসিক ও অভাবিত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা কারো ধারনা বা কল্পনায় আসেনি কোনদিন। শত্রুদের ধারনা ছিল, এ পাহাড়ী এলাকায় এমন শীত ও ঠাণ্ডার মধ্যে যুদ্ধের কোন চিন্তাই তিনি করতে পারবেন না।

পাহাড়ের চুড়ায় চুড়ায় তখন সাদা বরফের পুরো আস্তরন। এই বরফের রাজ্যে যুদ্ধ করার মত শারীরিক ও মানসিক ট্রেনিং নিয়েই সুলতান আইয়ুবী ময়দানে নেমেছিলেন। আইয়ুবীর সৈন্যদের এমন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ প্রতিপক্ষের সৈন্যদের মনে ভয়ের কাঁপন জাগিয়ে দিয়েছিল।

তাদের একটাই ভরসা, সংখ্যায় তারা বেশী। কিন্তু তারপরও তাদের মনে মাঝে মধ্যে ব্যর্থতার আশংকা জাগতো।

সুলতান আইয়ুবী আশংকা করছিলেন, সম্রাট রিমান্ড হয়ত রাস্তা পরিবর্তন করে অন্য কোন পথে আক্রমণ চালাতে পারে। আর রিমান্ড আশংকা করছিল, তিনি রাজধানীতে নেই এ খবর পেয়ে সুলতান আইয়ুবী হয়তো তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে বসতে পারে।

রিমান্ড তার রাজ্যে ফিরে গিয়ে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার দিকে মনোযোগ দিল।

সুলতান আইয়ুবী যেভাবে তাকে তাড়িয়ে দেন তাতে তিনি সহজেই রিমান্ডের পিছু ধাওয়া করতে পারতেন। কিন্তু সৈন্য সংখ্যা কম থাকায় সামনে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত থাকেন আইয়ুবী। আরেকটি কারণ ছিল, মিশরে সেনাপতি আলকিন্দির বিদ্রোহ।

তিনি আশংকা করলেন, মিশরের অবস্থা যদি আরও খারাপ হয়ে যায় তবে তাকে মিশরে ফিরে যেতে হতে পারে। এ রকম একটি আশংকা ও ভয় থাকায় তিনি রিমান্ডের পিছু ধাওয়া থেকে বিরত থাকেন।

তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, যদি তাকে মিশরে ফিরে যেতে হয় তবে এখানকার মুসলমান গাদ্দার আমীররা আবার খৃষ্টানদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ পেয়ে যাবে। এ অবস্থায় মিশর থেকে কি সংবাদ আসে তার ওপরই নির্ভর করছিল সবকিছু। তিনি তার সেনাপতি ও উপদেষ্টাদের সাথে মিশরের এ সমস্যা নিয়েই আলোচনা করছিলেন।

এ সময় প্রহরী এসে সংবাদ দিলো, ‘কায়রো থেকে কাসেদ এসেছে।’

তিনি তাকে ভেতরে ডেকে নিতে পারতেন, বরং এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু মিশরের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি এতটাই পেরেশান ছিলেন যে, খবর পেয়ে নিজেই ছুটে বেরিয়ে এলেন।

কায়রোর দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি ও অবসাদ নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে সুলতানের তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছিল, সুলতান আইয়ুবী দ্রুত তাঁবুর বাইরে এসে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাল সংবাদ নিয়ে এসেছো তো?’

‘অতি উত্তম সংবাদ এনেছি মোহতারাম সুলতান!’ কাসেদ মুহূর্তে ক্লান্তি ও অবসাদ ঝেড়ে স্বতঃস্ফূর্ত সতেজ কণ্ঠে বললো, ‘আপনার ভাই মোহাতারাম তকিউদ্দিন সুদানী বাহিনীকে আসোয়ানের পাহাড়ী অঞ্চলে এমন মার দিয়েছে যে, দীর্ঘ দিন সুদানের দিক থেকে আর কোন আশংকা ও ভয়ের কারণ নেই। আলকিন্দি আত্মহত্যা করেছে।’

সুলতান আইয়ুবী দুই হাত আকাশের পানে তুলে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানালেন। বললেন, ‘হে পরোয়ারদিগার! তোমার দ্বীনের এ মুজাহিদদের একমাত্র মহাফিজ তুমি। তোমার হাতেই কল্যান ও বিজয়ের চাবিকাঠি। আমাদেরকে তোমার দ্বীনের জন্য কবুল করো। যেসব মুজাহিদ তোমার দ্বীনের পতাকা বুলন্দ করতে গিয়ে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছে, তাদের শাহাদাতকে কবুল করো তুমি।’

তাঁবু থেকে সুলতানের পেছন পেছন বেরিয়ে এসেছিলো সুলতানের উপদেষ্টা ও অফিসারেরা। সুলতানের সাথে তারাও হাত তুললেন এবং ‘আমীন’ বলে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলেন।

এরপর কাসেদকে তিনি তাঁবুর মধ্যে নিয়ে গেলেন। সেখানেই তার জন্য নাস্তা-পানির ব্যবস্থা করা হলো। নাস্তা খেতে খেতে যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছিল সে।

সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের সৈন্যের হতাহতের সংখ্যা কত হবে?’

‘তিনশ সাতাশ জন শহীদ হয়েছেন!’ কাসেদ উত্তর দিল, ‘পাঁচশ’রও বেশী আহত। শত্রুদের সমস্ত সামরিক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হাতে এসেছে। সুদানী কমান্ডার ও খৃষ্টান উপদেষ্টা ছাড়াও এক হাজার দু’শ দশজন হাবশী সৈন্য যুদ্ধবন্দী হয়েছে।’

এরপর কাসেদ সুলতানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘মুহতারাম তকি জানতে চেয়েছেন, যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে আপনার আদেশ কি?’

‘খৃষ্টান উপদেষ্টা ও সুদানী সেনাপতিদের কয়েদখানায় রাখো। আর হাবশী বন্দীদের আসোয়ানের পাহাড়ে যেখানে যত লুকানোর স্থান আছে, সেসব কামরা ও গুহা পাথর দিয়ে ভরাট করাও। পাহাড় কেটে ফেরাউনরা যেসব মাটির মহল বানিয়েছিল, সেগুলোও ভরিয়ে দাও।

এসব কাজে ব্যবহার করো হাবশী বন্দীদের। যদি কোথাও পাহাড় কাটা বা খোদাই করার প্রয়োজন হয়, সে কাজও হাবশীদের দিয়ে করিয়ে নাও, যাতে পাহাড়ে কোন গহ্বর ও ভিতরে কোন মহল না থাকে।

তকিউদ্দিনকে বলবে, কয়েদীদের সাথে যেন মানবিক ব্যবহার করে। যে যতটুকু কাজ করতে সক্ষম, তাকে ঠিক ততটুকু কাজে খাটাবে। ওরা বন্দী, শুধু এ জন্যই ওদের সাথে কর্কশ আচরণ ও মন্দ ব্যবহার করবে না।

আসোয়ান পাহাড়ের পাদদেশে তাঁবু টানিয়ে উন্মুক্ত বন্দীখানা বানিয়ে নাও। ওদের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করো সেখানে। আর যদি সুদানীরা যুদ্ধবন্দী ফেরত চায় তবে আমাকে জানাবে। আমি নিজেই ওদের সাথে বিনিময় মূল্য ও শর্ত নির্ধারণ করবো।’

এরপর সুলতান কাসেদকে বললেন, ‘তকিউদ্দিনকে বলবে, আমার বিশেষ সেনা সাহায্য প্রয়োজন। এ জন্য নতুন সৈন্য ভর্তির কাজ দ্রুত ও জোরদার করতে বলবে। সামরিক ট্রেনিং পুরোদমে চালিয়ে যাবে। চারদিকে গোয়েন্দাদের জাল বিছিয়ে রাখতে বলবে আলীকে।

আলকিন্দির মতো যোগ্য ও বিশ্বাসী সেনাপতি যদি বিশ্বাসঘাতক হতে পারে, তবে যে কেউ, যে কোন সময় গাদ্দার হয়ে যেতে পারে। শয়তান বসে নেই। আমাকেও গাদ্দার বানানোর জন্য সে সব সময় চেষ্টা করবে। তাই সব সময় সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। কারো উপরই ভরসা করে চোখ কান বন্ধ রাখা যাবে না। এ ব্যাপারে আলী বিন সুফিয়ান কে আরো সতর্ক ও সাবধান থাকতে বলবে।’

‘মিশর থেকে সৈন্য সাহায্য না আসা পর্যন্ত কোন বিরাট ঝুঁকি না নেয়াই উত্তম হবে।’ সুলতান আইয়ুবী কাসেদকে ফেরত পাঠানোর পর তাঁর সেনাপতিদের বললেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা সে সফলতা পেয়েছি তার প্রতিরক্ষার দিকে নজর দেয়া দরকার। বর্তমানে তোমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু তোমাদের ভাই। হলবে আল মালেকুস সালেহ তোমাদের গর্দান কাটার জন্য বসে আছে। এই তিন শক্তি এক হয়ে যদি আমাদের বিরুদ্ধে ময়দানে নামে, আমাদের পক্ষে তাদের মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে যাবে।

রাজা রিমান্ডকে আমরা পিছু হটিয়ে দিয়েছি, কিন্তু সে তো এই অপেক্ষায়ই বসে আছে, মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে শক্তি ক্ষয় করুক, তারপর সে ওখান থেকে ফায়দা লুটবে।’

‘আল মালেকুস সালেহ, সাইফুদ্দিন ও গুমাস্তগীনকে ইসলামের সঠিক পথে আনা যায় কিনা তার একটা চেষ্টা করলে কেমন হয়?’ এক সেনাপতি বললো।

‘না। ’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যেসব ব্যক্তি তাদের মন মগজ ও বিবেক সত্য থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ও বিমুখ করে নিয়েছে, আল্লাহর গজব ও শক্তি ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছু নেই। আমি কি এ বিষয়ে চেষ্টা করিনি? তার উত্তরে তারা আমাকে হুমকি দিয়েছে। আবার যদি আপোষের জন্য দূত পাঠাই, তবে তারা ভাববে ও বলবে, সালাউদ্দিন এখন যুদ্ধ করতে ভয় পাচ্ছে।

আমি ওদের আর এমন অভিযোগ করার সুযোগ দেবো না। আমি এখন ওদের উপরে আল্লাহর গজব ও অভিশাপ হয়ে আঘাত হানতে চাই। আর আল্লাহর সে গজব হচ্ছো তোমরা ও তোমাদের দুর্ধর্ষ সৈন্যদল।’

তিনি আফসোস করে বললেন, ‘তোমরা তো হলব অবরোধ করেছিল, দেখেছ হলবের মুসলমান কেমন বীরের মত লড়েছিল? তোমরা কি সে কথা ভুলতে পারবে? তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে কিন্তু তাদের মনোবল দেখে প্রশংসা না করে পাড়ি না। এমন জানকবুল করে যুদ্ধ শুধু মুসলমান জাতিই করতে জানে। হায়, যদি এই শক্তি ইসলামের জন্য ব্যয় হতো তবে কতই না কল্যাণ হতো!

তোমরা জানো, আমি রাজ্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধ করছি না, আমার উদ্দেশ্য শুধু মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করা। আমি মুসলিম বিশ্বের সম্প্রসারণ চাই, বিস্তৃতি চাই।’

‘আমরা এ ব্যাপারে নিরাশ নই।’ এক সেনাপতি বললো, ‘নতুন রিক্রুট চলছে। দামেশকের যুবকরাও দলে দলে ভর্তি হচ্ছে ফৌজে। মিশর থেকেও সেনা সাহায্য আসছে। ওদের নিয়ে আমরা আপনার প্রতিটি আশা পুরন করবো ইনশাআল্লাহ।’

‘কিন্তু আমি আর কতদিন দুনিয়ায় বেঁচে থাকবো!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আর তোমরাই বা কতদিন বাঁচবে? তুমি যে নতুন রিক্রুটের কথা বলছো এটা অবশ্যই আশার কথা। কিন্তু দূরদর্শিতা ভিন্ন জিনিস। তোমাকে কেবল নিজের শক্তির দিকে তাকালেই চলবে না, দেখতে হবে প্রতিপক্ষের শক্তিও। শয়তানের দলও বড় হচ্ছে, তাদেরও পরিধি বাড়ছে। আমার সেই প্রিয় বন্ধু, যার ওপর আমার এত বিশ্বাস ও ভরসা ছিল, শেষে সেও খৃষ্টানদের যাদুর ফাঁদে পা দিয়ে শেষ হয়ে গেল! তোমরা তো জানো, আলকিন্দি তোমাদের কত বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল। সেই আলকিন্দি সুদান থেকে হাবশী সৈন্য এনে গোপনে মিশর জয় করে নিজেই তার শাসনকর্তা হতে চাইবে, এটা কি কোনদিন তোমরা ভাবতে পেরেছিল!

সে আমাকে এটুকু দয়া করেছে, যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিজেকে নিজেই শেষ করে প্রায়শ্চিত্য করেছে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কষ্ট আমাকে করতে হয়নি। কিন্তু তার এই করুণ পরিনতি আমদের হৃদয়গুলোকে কি ক্ষত-বিক্ষত করেনি!

নেতৃত্ব ও ক্ষমতার নেশা খুবই ভয়ংকর ও মারাত্বক নেশা। এ নেশা, প্রতিপত্তি ও ধনের নেশা বা নারী এবং মদের নেশার চেয়েও ভয়ংকর। বহু ভাল ভাল লোক কখন যে এ নেশায় পড়ে অন্ধ হয়ে গেছে, টেরও পায়নি।

বলতে পারো, ঈমানের ধন হারিয়ে গেলে মুমীন জীবনের আর কি মূল্য থাকে? ঈমান তো আর সোনা রুপা নয় যে, বিক্রি করা যাবে! মেয়ে মানুষ নয় যে ভোগ করা যাবে! ঈমান তো আত্মার সম্পদ! একবার যদি হৃদয়ের বন্ধ করো, ঈমান বেকার বস্তুতে পরিণত হবে। বিবেককে ঢেকে দেবে কালো পর্দার আবরণ।

যে বীর মুজাহিদরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নিজেদের জাহাজগুলো নিজহাতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল, কল্পনা করো তাদের ঈমানের জোর! ঈমান কি অমূল্য সম্পদ তাদের কাছ থেকেই তা আমাদের শিখতে হবে। তারাই জানে ঈমানের মূল্য কি? বিজয় বা শাহাদাত ছাড়া বিকল্প কোন পথ ছিল না তাদের সামনে। পরাজিত হয়ে ফিরে যাওয়ার কোন ধারনা তাদের মনে স্থান পায়নি।

অস্ত্রের জোরে নয়, ঈমানের জোরে তারা স্পেন জয় করেছিল। তাদের বিদেহী আত্মা আজো দুনিয়ার পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে চিৎকার করে বলছে, যে হৃদয়ে পলায়নী মনোবৃত্তি ও আপোষকামীতা থাকে সে হৃদয় ঈমানদার নয়। ঈমানদার সেই, যে লোক ভয়শুন্য ও বিচক্ষণ।

মুসলমানদের শিথিলতার সুযোগে ব্যর্থ হয়ে যায় শত শত শহীদের রক্তদান। আল্লাহর দরবারে শহীদরা বিজয়ী বীরের মর্যাদা পায় ঠিকই, কিন্তু যাদের সুখ শান্তির জন্য জীবন দেয় ওরা, তাদের জীবনে নেমে আসবে দুর্ভোগ ও জিল্লতি।’

অফিসাররা অভিভুত হয়ে শুনছিল সুলতানের কথা।

তিনি খানিক বিরতি দিলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘কোন জাতি যদি তার শহীদদের ভুলে যায়, আল্লাহ যাদেরকে মৃত নয় বলে ঘোষণা করেছেন, তাদেরকে হারিয়ে ফেলে আপন স্মৃতি থেকে, সে জাতির পতন অনিবার্য। আরো শুনে রাখো, জেহাদের জন্য পরীক্ষিত ও প্রানপাতকারী মুজাহিদদের পরিবর্তে যদি সুবিধাবাদী লোকেরা কোন কাফেলার নেতৃত্বে আসে, তাদের পতনও কেউ রোধ করতে পারে না।

জেহাদের পথ বেয়ে আমাদের খলিফা ও আমীররা ক্ষমতা লাভ করেনি। তারা ক্ষমতা পেয়েছে উত্তরাধিকার সুত্রে। ফলে দেশ ও জাতির জন্য তাদের সেই মায়া নেই, যে মায়া থাকলে জাতির জন্য ওরা অকাতরে নিজের রক্ত বিলিয়ে দিতে পারতো।