» » ইহুদী কন্যা

বর্ণাকার

ইহুদী কন্যা

ইহুদী মেয়েটিকে হারিয়ে হলবের শাসক আল মালাকুস সালেহ উন্মাদ হয়ে গেলেন। সারা রাত চাকর-বাকর ও দাস-দাসীদের নাজেহাল করে ছাড়লেন মেয়েটির জন্য। তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজল মহলের প্রতি ইঞ্চি জায়গা। কিন্তু কোথাও তার ছায়াও পেল না।

সারা রাত এই হাঙ্গামায় কেউ ঘুমাতে পারল না। না আল মালেকুস সালেহ, না দাস-দাসীরা। আস সালেহের তর্জন গর্জন, রক্তচক্ষু, অনাকাংখিত ধমকে তটস্থ হয়ে সারা রাত ওরা ছোটাছুটি করল।

আস সালেহ নিজেও ছুটে বেড়ালেন চরকির মত। কিন্তু ফলাফল শুন্য। যুবক সালেহের চিত্তে উন্মাদনা সৃষ্টি করে মেয়েটি উধাও হয়ে গেছে। সেই সাথে উধাও হয়ে গেছে সম্রাট বিলডনের পক্ষ থেকে আগত বনিকবেশী তিন উপদেষ্টা।

সময় থেমে থাকেনা। মানুষের দুঃখ কষ্ট আনন্দ অস্থিরতা কোনোটাই স্থিতিশীল নয়। সময়ের গতি প্রবাহের সাথে সঙ্গতি রেখে পালটে যায় এসবের ধরন, পাল্টে যায় অনুভূতির রং ও রূপ।

সবাই আশা করছিল ভোরে যখন আলোর মুখ দেখবেন আস সালেহ, তখন হয়তো নেশার ঘোর কেটে যাবে। কিছুটা শান্ত হবেন তিনি।

কিন্তু সকালে দেখা গেল পরিস্থিতি উল্টো দিকে গড়াচ্ছে। আস সালেহের চোখ আরও রক্তবর্ণ ধারন করেছে। কাউকে ঠিকমত চিনতে পারছেন বলে মনে হলো না। যাকে সামনে পাচ্ছেন তাকেই জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছেন। অনবরত প্রলাপ বকছেন।

দাস-দাসীরা তাকে শান্ত করতে পারছে না। তারা তার হেফাজতের জন্য রক্ষী বাহিনীর সহায়তা চাইল। একজন ছুটে গেল ইবনে খতিবের কাছে। বলল, ‘সুলতান খুবই অস্থিরতার মধ্যে আছেন। সারা রাত ঘুমাননি। কখন কি অঘটন ঘটিয়ে বসেন এই ভয়ে আমরা অস্থির। চলুন, দেখবেন সুলতানকে।’

ইবনে খতিব মহলে প্রবেশ করল। দাসীদের সঙ্গে গিয়ে পৌঁছল আল মালেকুস সালেহের সামনে। দেখল তার বিবর্ণ দশা। এক রাতেই লোকটা যেন পাল্টে গেছে।

তাকে দেখতে পেয়েই আস সালেহ পাগলের মত ছুটে এলেন। রক্তবর্ণ চক্ষু মেলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একটি মেয়ে এবং বণিক তিনজনকে দেখেছ? ওদেরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। বলতে পারো ওরা কোথায়?’

‘হ্যাঁ, আমি তাদেরকে অনুষ্ঠানের সময় সভায় দেখেছিলাম।’ ইবনে খতিন বললো, ‘আমি আমার বাহিনী নিয়ে প্যান্ডেলের বাইরে সতর্ক পাহারায় ছিলাম। মাঝ রাতের সামান্য আগে বণিক তিনজন বাইরে এলো। তাদের সাথে একটি খুবসুরত মেয়েও ছিল।

আমি দেখলাম ওরা কথা বলতে বলতে ওদের বাণিজ্য কাফেলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই তারা অন্ধকারে হারিয়ে গেল। তারা অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার খানিক পরে আমি ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দ শুনে দ্রুত এগিয়ে দেখতে পেলাম, ওরা চারজন চারটি ঘোড়ায় চড়ে বসেছে আর ঘোড়া চারটি ওদের নিয়ে পশ্চিমের ফটকের দিকে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম তারা হয়তো ঘুরতে বেড়িয়েছে অথবা আপনার অনুমতি নিয়ে কোথাও যাচ্ছে। তাই আমি ওদের বাধা দেয়ার দরকার মনে করিনি। কিন্তু তারা সেই যে গেছে আর ফিরে আসেনি। ফিরে এলে আমার বাহিনী তাদের অবশ্যই দেখতে পেতো।’ এ সময় সুলতানের অসুস্থতার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে এলেন এক সেনাপতি। এ সেনাপতি সুলতান আইয়ুবীর এক বিশ্বস্ত সমর্থক ছিলেন।

তিনি ভাল করেই জানতেন, মেয়েটি এবং তিন খৃস্টান উপদেষ্টা এখন কোথায়। তিনি আস সালেহকে বললেন, ‘আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল এরা বণিক নয়।’ বণিক হলে তারা আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের সাথেই যোগাযোগ করতো। বণিকবেশী লোক তিনজন নিশ্চয়ই গোয়েন্দা ছিল। সম্ভবত মেয়েটিও তাদেরই সহযোগী। তারা এত সুন্দরী মেয়ে আপনার কাছে রাখতে চায়নি। আপনাকে ধোঁকা দিয়ে আপনার কাছ থেকে কোন গোপন তথ্য নিয়ে পালিয়েছে তারা।’

‘তারা আমার কাছ থেকে কি গোপন তথ্য নেবে?’ অনেকটা রাগের সাথেই বললেন আস সালেহ।

‘জানিনা। তবে গোয়েন্দারা তাদের কাজে এতই পারদর্শী হয় যে, যার কাছ থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করে তিনি জানতেও পারেন না কি গোপন তথ্য তিনি তাদের সরবরাহ করেছেন। হয়তো তারা এমন গোপন তথ্য নিয়ে গেছে যা আপনার ও জানা নেই।’

এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় জানা ছিল না আস সালেহের। একজন শাসক হিসেবে তিনিও জানতেন গোয়েন্দাদের দক্ষতার কথা। সেনাপতির কথা শেষ হলেও তাই তিনি এর কোন জবাব দিলেন না। বরং তিনি হঠাৎ করেই একদম চুপ মেরে গেলেন। এতক্ষণ যে প্রলাপ বকছিলেন সেই প্রলাপ বকাও বন্ধ হয়ে গেল।

তার মনে পড়ে গেল, মেয়েটা দিনের বেলায়ও তাকে মদ পান করিয়ে মাতাল করে রাখত। সেই মাতাল করা ঘোরের মধ্যে মেয়েটা কোন প্রশ্ন করেছিল কিনা তিনি মনে করতে পারলেন না। তবে মনে মনে স্বীকার করলেন, এ সময় অনেক গোপন কথা তার কাছ থেকে জেনে নেয়া সম্ভব।

এ কথা মনে হতেই তার মনে ভীষণ দুঃখ হলো। তার মধ্যে আবার হঠাৎ করেই জাগ্রত হলো দায়িত্ববোধ। এ বোধ তার মন থেকে মেয়েটির চিন্তা দূর করে দিল। কিন্তু সেখানে জন্ম নিল গোপন তথ্য পাচারের দুশ্চিন্তা।

সেই সাথে ভয় হলো, যদি এই কথা সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবি কোনো ভাবে জেনে যান? তার গোয়েন্দারা তো এ মহলেও থাকতে পারে! এ খবর পেলে তিনি কি ক্ষমা করবেন আমাকে? আমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিলে আমি কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবো? তিনি মনে মনে এসব ভাবছিলেন আর শিহরিত হচ্ছিলেন।

এসব ভাবনা তাকে পুরোপুরি পেয়ে বসলে ভয় ও হতাশায় তিনি একেবারে মুষড়ে পড়লেন। একটু পর তিনি সেখান থেকে উঠে আস্তে আস্তে নিজের শয়ন কামরার দিকে হাঁটা দিলেন। বিছানায় শুয়েও তিনি ঘুমোতে পারলেন না। ভয় আর দুশ্চিন্তা তাকে একেবারেই কাবু করে ফেলল।

অনেকদিন থেকেই তিনি রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা মদের নেশায় মাতাল অবস্থায় কাটাচ্ছিলেন। ছলনাময়ী এক নারীর পাল্লায় পরে এভাবে নিজের উপর অত্যাচার করায় দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ ছাড়াও তার মনে জন্ম নিল নিজের প্রতি ক্রোধ ও ঘৃণা। আস্তে আস্তে সেই ক্রোধ ও ঘৃণা অনুশোচনায় রুপান্তরিত হলো। অনুশোচনা যখন তীব্র আকার ধারন করলো তখনই তার মনে পড়লো বাণিজ্য কাফেলার কথা।

বণিকরা পালিয়ে গেলেও বাণিজ্য কাফেলাটি ত আর পালিয়ে যায়নি! হঠাৎ তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। তিনি বিছানা ছেড়ে সোজা দরবারে এসে ঢুকলেন। প্রহরীকে বললেন, ‘জলদি রক্ষী কমান্ডার ও সেনাপতিকে খবর দাও।’

খবর পেয়ে সাথে সাথে ছুটে এলেন সেনাপতি ও ইবনে খতিব। তিনি তাদেরকে সামনে পেয়েই অভাবিত এক কড়া হুকুম জারী করে বসলেন। বললেন, ‘বণিকদের সাথে যে বাণিজ্য কাফেলা এসেছে অই কাফেলার সবাইকে বন্দী করো। বণিক তিনজন কোথায় গেছে ওরা যদি তার হদিস ও সন্তোষজনক জবাবা দিতে না পারে তবে ওদের সবাইকে হত্যা করবে। তাদের উট এবং মাল-সামান সরকারী গুদামে সরকারী মাল হিসেবে পাঠিয়ে দাও।’

সেই সন্ধ্যাতেই আল মালেকুস সালেহের পেটে ভীষণ ব্যাথা শুরু হলো। ডাক্তার তাকে ঔষুধ ও ব্যাবস্থাপনাপত্র দিলেন কিন্তু তার বেদনা বেশেই চললো। রাত যত বাড়তে লাগল তার কষ্টও ততই বেড়ে চলল। প্রথমে তলপেটে, তারপর সে ব্যাথা ছড়িয়ে পড়ল নাভী এবং বুক পর্যন্ত।

পরের দিন ৯ই রজব। তার রোগের অবস্থা চিকিৎসকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। ডাক্তার সবসময় তার কাছে বসে থেকেও কিছুই করতে পারছেন না। তিনি বার বার মূর্ছা যেতে লাগলেন। রোগ বেড়েই চললো। সেই দিনটি এবং পরবর্তী রাতও এই অবস্থায়ই কেটে গেল।

পরের দিন। তার অবস্থা আরো খারাপ হলো। তিনি বেহুশের মত পড়ে রইলেন বিছানায়। ডাক্তার তার অবস্থা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি সেনাপতি, রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে তার আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে বললেন, ‘সুলতানের অবস্থা খুবই সংকটপূর্ণ। অচেনা রোগে আক্রান্ত তিনি। আমার কোন ঔষধই কাজ করছেনা। খুব বেশী সময় বাঁচবেন না তিনি।’

মসজিদের ইমাম সাহেবকে খবর দেয়া হলো। তিনি এসে আস সালেহের শিয়রে বসে কোরআন পাঠ করতে লাগলেন।

রাতে আস সালেহের জ্ঞান ফিরে এলো। তিনি ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। বিষণ্ণ চোখে তাকালেন ইমাম সাহেবের দিকে। ক্ষীন কন্ঠে বললেন, ‘যদি কোরআন সত্য হয়ে থাকে তবে তার বরকতে আমাকে সুস্থ করে তুলুন।’

ইমাম সাহেব বললে, ‘কোরআনের বরকত তার উপরই বর্ষিত হয়, যিনি কোরআনের বিধান অনুসারে জীবন পরিচালনা করেন। আমাকে মাফ করবেন, কারো অসন্তুষ্টির ভয়ে সত্য কথা বলা থেকে আমি বিরত থাকতে পারিনা। একজন ইমাম হিসেবে মানুষের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে দেয়াটা আমার দায়িত্ব।

আমার বলতে দ্বিধা নেই, আপনি কোরআনের বিরুদ্ধেই আপনার সারাটা জীবন ও শাসন চালিয়েছেন। এ অবস্থায় আল্লাহর রহমত পেতে হলে আপনাকে খালেছ দীলে তওবা করতে হবে। আল্লাহ যদি আপনার গোনাহ ক্ষমা করে দেন তবেই কেবল আপনি তাঁর রহমত আশা করতে পারেন।’

‘আমি তওবা করবো হুজুর। আপনি আমার তওবার ব্যবস্থা করুন।’

‘কিন্তু তওবার ব্যাপারে আল্লাহর বিধান হচ্ছে, তিনি মানুষের সাধারন গোনাহ ক্ষমা করলেও অন্য মানুষের সাথে কৃত অন্যায় ক্ষমা করেন ন। কোন মানুষকে কষ্ট দিলে বা কারো অধিকার হরণ করলে সেই ক্ষমা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকেই নিতে হয়। ব্যক্তি মাফ করলেই কেবল আল্লাহ তাকে ক্ষমার যোগ্য বিবেচনা করবেন।

এদিক থেকে আপনার অপরাধ যে সীমাহীন! আপনি তো আপনার মায়ের দুধেরও অপমান করেছেন! আপনি আপনার মায়ের মনে যে কষ্ট দিয়েছেন টা দূর করতে না পারলে আল্লাহ কখনোই আপনার প্রতি সদয় অবেন না।’

এ সময় শামসুন নেছা ভাইয়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল আর দোয়া দরূদ পড়ছিল। ইমাম সাহেবের এ তিক্ত কথাগুলো শুনে আস সালেহের মুখ থেকে সহসা বেড়িয়ে এলো, ‘মা, মাগো! তুমি তোমার এ পাপিষ্ঠ সন্তাকে ক্ষমা করে দাও।’

তার কাতর কণ্ঠের ধ্বনি ঘরের বাতাস বিষণ্ণ করে তুলল। শামসুন নেছা এগিয়ে ভাইয়ের মাথায় হাত রাখল।

আস সালেহ ছোট বোনের একটি হাত আঁকড়ে ধরে বললেন, ‘শামসি! বোন আমার! আমি আর বাঁচবো না। তুই কি পারবি মাকে একটু ডেকে আনতে! আমার যে মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে! শোন, আমি লোক দিচ্ছি, তুই মায়ের কাছে চলে যা। মাকে বলবি, তোমার একমাত্র ছেলে মৃত্যুশয্যায়। সে তোমাকে শেষ বারের মত দেখতে চায়! যদি মা আসেন, সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। আর যদি মা আসতে অস্বীকার করেন, তবে তাকে বলবি, মা, তোমার একমাত্র ছেলে মারা যাচ্ছে! তুমি তার দুধের ঋণ আর পাপ ক্ষমা করে দাও।’

ইমাম সাহেব তাকালেন শামসুন নেছার দিকে। সে তার ভাইয়ের কপালে মমতার হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আমি এক্ষুণি দামেশকের পথে যাত্রা করছি ভাইয়া! দেখিস, আমি ঠিক মাকে নিয়ে আসবো।’

শামসুন নেছা দ্রুত পদে কামরা থেকে বের হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সে যখন আবার কামরায় ঢুকল তখন তার বেশভূষা একদম পালটে গেছে। এক অশ্বারোহীর সাজে সজ্জিত সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গী মরহুমের একমাত্র ষোড়শী কন্যা শামসুন নেছা।

আস সালেহ চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন। চেহারায় কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। শামসুন নেছা ভাইয়ের শিয়রে গিয়ে দাঁড়াল। হাত রাখল তার কপালে।

চোখ মেলে চাইলেন আস সালেহ। শামসুন নেছা বলল, ‘চলি ভাইয়া! পথ চেনে এমন আটজন বিশ্বস্ত রক্ষী সঙ্গে নিয়েছি। তুমি কোনো চিন্তা করো না, মাকে সঙ্গে নিয়েই ফিরব ইনশাআল্লাহ।’

আস সালেহ তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে ক্ষীন কন্ঠে বললেন, ‘ফী আমানিল্লাহ!’

ভাইয়ের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে মহল থেকে বেরিয়ে এলো শামসুন নেছা। রাতের অন্ধকারেই লাফিয়ে চড়লো ঘোড়ার পিঠে। তারপর আটজন সঙ্গী নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল দামেশকের পথে। দুর্বার বেগে ঘোড়া ছুটে চলল দামেশকের দিকে।

ইতিহাসবিদ কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তাঁর বইতে লিখেছেন, ১৩ই রজব শামছুন নেছা রওনা হয়ে যাবার পর আস সালেহের অবস্থা এতই খারাপ হয়ে যায় যে, মহলের দরজা সবার জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো। সেনাপতি গুরুত্বপূর্ণ আমীর ও উজিরদেরকে মহলে এনে বসিয়ে রাখলেন পরিস্থিতির আলোকে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য।

দুপুরের পর সামান্য সময়ের জন্য আস সালেহের জ্ঞান ফিরে এলো। তিনি ইশারায় সেনাপতি ও উজিরকে কাছে ডাকলেন। ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, ‘আমি মারা গেলে সুলতান আইয়ুবীই হবেন হলবের মূল শাসক। তিনি পরবর্তী শাসক নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন মাসুদ হলবের শাসকের দায়িত্ব পালন করবেন।’

সাইফুদ্দিনের মৃত্যুর পর ইয়াজুদ্দিন মাসুদ হলবের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি তখন মুশেলেই ছিলেন। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে তাকে হলবেরও শাসনকর্তা নিয়োগ করা হলো।

এটুকু করেই শান্ত হলেন না আস সালেহ। ইশারায় রক্ষী বাহিনীর প্রধানকে ডেকে বললেন সকল আমীর ও সভাসদদের ডেকে আনতে। ইবনে খতিব কালবিলম্ব না করে সমস্ত আমীর ও সভাসদদের জরুরী ভিত্তিতে আস সালেহের নিকট হাজির হওয়ার জন্য খবর পাঠালো।

সবাই হাজির হলে আস সালেহ বললেন, ‘আমি চাই আপনারা সবাই ইয়াজউদ্দিন মাসুদের পক্ষে শপথ বাক্য পাঠ করুন। আমি আপনাদের মাঝে ঐক্য ও সংহতি দেখে মরতে চাই।’

আস সালেহের শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে দরবারের সকল আমীর ও সভাসদগন ইয়াজউদ্দিন মাসুদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ বাক্য পাঠ করলেন। আস সালেহ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন।

২৫ রজব। আস সালেহের তখন কোন হুশ ছিল না। অজ্ঞান অবস্থায়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তিনি মৃত্যুর আগেই মুশেলের পথে কাসেদ রওনা হয়ে গিয়েছিল। কাসেদ ইয়াজিউদ্দিন মাসুদের কাছে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আস সালেহের শেষ পয়গাম ও ফরমান। এই ফরমানে উল্লেখ ছিল হলবের দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পণ করার কথা। আরো উল্লেখ ছিল, হলবের সকল উজির, আমীর ও সভাসদগন যে তাঁর আনুগত্যের শপথ নিয়েছে এ খবর।

তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আরো একজন কাসেদকে মুশেলের উদ্দেশ্যে পাথিয়ে দেয়া হলো। তাকে বলা হলো, ‘তুমি গিয়ে মুশেলের বর্তমান শাসক ইয়াজউদ্দিন মাসুদকে জানাবে, সুলতান আস সালেহ মারা গেছেন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী এখন আপনিই হলবের শাসক। হলবের সকল আমীর, উজির এবং সেনাবাহিনী আপনার আনুগত্যের শপথ নিয়ে বসে আছে। তারা সবাই আপনার নির্দেশের অপেক্ষায়।’

সে সময় শামসুন নেছা দামেশকে তার মায়ের পদতলে বসে বলছিল, ‘মা, তোমার একমাত্র সন্তান মৃত্যু শয্যায়। মরার আগে সে তোনাকে একবার দেখতে চায়। চলো মা হলবে! ডাক্তার বলেছে, সে আর বাঁচবে না।

নূরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুন তখনো বলছিলেন, ‘যেদিন বিশ্বাসঘাতকের খাতায় নাম লিখিয়েছে আমার সন্তান, সেদিনই সে মারা গেছে। আমার কোন ছেলে আর বেঁচে নেই যাকে দেখার জন্য আমার হলবে যেতে হবে। তুমি ফিরে যাও, আমি কিছুতেই হলবে যাবো না।

‘মা, আপনার দুধের ঋণ আর পাপের ক্ষমা চেয়ে সে কান্নাকাটি করছে। আপনি মাফ না করলে আল্লাহও যে তাকে মাফ করবে না।’

‘তাকে বলিস, আমি তাঁর দুধের ঋণ ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু তার পাপের ক্ষমা আল্লাহ করবেন কিনা জানি না।’

‘আপনি দোয়া করুন মা। আল্লাহ যেন তাকে ক্ষমা করে দেন।’

‘না, কোন অপরাধীর জন্য আমি আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করতে পারবো না। গদীর লোভে যে জাতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে পারে, যার কারনে শত শত মুজাহিদকে পান করতে হয়েছে শাহাদাতের পেয়ালা, তাঁর জন্য ফরিয়াদ জানাব আমি! অসম্ভব, এ হতে পারে না। কাল হাশরের মাঠে আমি সেইসব মা, বোন ও স্ত্রীদের সামনে লজ্জিত হতে চাই না, যাদের ছেলে, ভাই ও স্বামীর মৃত্যুর কারন ছিল আমার সন্তান।’

সে সময়ই আস সালেহ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। শামসুন নেছা যখন হলবে ফিরে এলো তখন তার একমাত্র ভাই আস সালেহের লাশ নিয়ে লোকজন কেল্লা থেকে বাইরে বের হচ্ছিল। ফটকের বাইরে অনেক লোক। তারা সবাই এসে শামিল হয়েছিল নূরুদ্দীন জঙ্গীর একমাত্র সন্তান আল মালেকুস সালেহের জানাজায় অংশগ্রহণের জন্য।

ইয়াজউদ্দিন মাসুদের কাছে গিয়ে পৌঁছল আস সালেহের দূত। ইয়াজউদ্দিন মাসুদ তাঁর উজির ও পরিষদকে জানাল এ খবর।

বৈঠক থেকে তারা তখনো উঠেনি, এ সময় পৌঁছল দ্বিতীয় দূত। আস সালেহের মৃত্যু সংবাদ শুনে উপদেষ্টাবৃন্দ বললো, ‘আপনি এখনি রওনা হয়ে যান। হলবের জনগণকে আশ্বস্ত করুন, তারা যেন নিজেদের অভিভাবকহীন না মনে করে।’ ইয়াজউদ্দিন মাসুদ আস সালেহের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য তৎক্ষণাৎ হলবের উদ্দেশ্যে রওনা যাত্রা করলেন।

তিনি যত দ্রুত সম্ভব হলবে পৌঁছে যেতে চাচ্ছিলেন। এ জন্য তিনি প্রশস্ত সড়ক পথ পরিহার করে দূরত্ব কমানোর জন্য বিকল্প ছোট পথ ধরলেন। এ পথ চলাচলের জন্য আরামদায়ক না হলেও রাস্তা কমে যাবে অনেক।

আরো একটি কারণে এ পথে যাওয়া তিনি জরুরী মনে করলেন। সুলতান আইয়ুবীর চাই সুলতান তকিউদ্দিন এখন যেখানে সেনা ক্যাম্প করে আছেন সে ক্যাম্প এ পথেই পড়বে। হলবে পৌঁছার আগেই এ ব্যাপারে তিনি সুলতান তকিউদ্দিনের পরামর্শ গ্রহন করা জরুরী মনে করলেন। ইয়াজউদ্দিন মাসুদের ছোট্ট কাফেলা ও বাহিনী সুলতান তকিউদ্দিনের ক্যাম্পের কাছে চলে এলে তিনি তার বাহিনীর অগ্রগতি থামিয়ে দিলেন। ক্যাম্পের রক্ষীকে জানালেন তার আগমনের কথা। সুলতান তকিউদ্দিন নিজে এসে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। ইয়াজউদ্দিন মাসুদ হলবের পরিস্থিতি এবং আস সালেহের মৃত্যু সংবাদ তাকে জানিয়ে বললেন, ‘আস সালেহ মৃত্যুর পূর্বে আমাকে হলবের শাসক নিয়োগ করে গেছে। তাঁর সকল আমীর ও উজির এ নিয়োগ মেনে নিয়েছে। আমি এ দায়িত্ব গ্রহনের পূর্বে আপনার পরামর্শ নিতে এসেছি।’

সুলতান তকিউদ্দিন বললেন, ‘ভবিষ্যতে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে এবং হলবকে দামেশকের অধীনে রাখতে তোমার ভূমিকা রয়েছে। এক গাদ্দার মরে গিয়ে যে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে তাকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করো। হলবে যেন আর কোন গাদ্দার মাথা তুলতে না পারে সেদিকে তোমার খেয়াল রাখতে হবে। দামেশকের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিতেও সক্রিয় হতে হবে তোমাকে।’

ইয়াজউদ্দিন মাসুদ তাঁর এ নতুন ও কঠিন দায়িত্বের বোঝার কথা ভেবে চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে বললেন, ‘আপনি যে দায়িত্বের কথা বললেন তা নিয়ে আমি আগেও ভেবেছি। আস সালেহের নিয়োগের খবর পাওয়ার পর থেকেই ভাবছিলাম, কিভাবে অগ্রসর হব আমি। আমি জানি দামেশকের সাধারণ জনসাধারণ এখনো মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীকে অপরিসীম শ্রদ্ধা করে। তাঁর বিধবা স্ত্রী নূরুদ্দিন জঙ্গীর আদর্শ আঁকড়ে ধরে যে ত্যাগ-তিতীক্ষার সাগর পাড়ি দিয়েছেন সেজন্য দামেশকের জনসাধারণ তাকেও সমান শ্রদ্ধা করে। হলব ও দামেশকের সম্পর্ক দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করতে এই মহিলা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারবে। এই মহিলার সহযোগিতা আদায়ের ব্যাপারে আমি আপনার সাহায্য চাই।’

‘এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?’

‘এই মহিয়সী মহিলা সম্মত হলে আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। আমি মনে করি আমার আশা পূরণ হলে আপনার প্রত্যাশাও পূরণ হবে। মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই এই মহিলাকে আমার পাশে প্রয়োজন।’

‘আমি আজই দামেশকে রওনা হয়ে যাবো তোমার এই প্রস্তাব নিয়ে। আমার বিশ্বাস, তিনি তোমার এই প্রস্তাবকে অশ্রদ্ধা করবেন না।’

এ আলোচনার পর তকিউদ্দিন দামেশকের পথে আর ইয়াজউদ্দিন হলবের পথে রওনা হয়ে গেলেন। তকিউদ্দিন দামেশকে পৌঁছেই রাজিয়া খাতুনের দুয়ারে হাজির হলেন। রাজিয়া খাতুনকে তিনি জানালেন তাঁর ছেলের মৃত্যু সংবাদ।

‘আল্লাহ তাঁর পাপ ক্ষমা করুন।’ ছেলের মৃত্যু সংবাদ শুনে বললেন রাজিয়া খাতুন।

তকিউদ্দুন বললেন, ‘আস সালেহ মরার আগেই হলবের পরবর্তী শাসনকর্তা হিসাবে মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিন মাসুদকে নিযুক্ত করে গেছেন। ইয়াজউদ্দিন মাসুদও এ দায়িত্ব পালনে সম্মত হয়েছে।’

‘আলহামদুলিল্লাহ।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন রাজিয়া খাতুন।

তকিউদ্দিন বললেন, ‘বর্তমান সময়ে ইয়াজউদ্দিন মাসুদকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য আমি আপনার সহযোগিতা চাই।’

‘আমার সহযোগিতা! কি বলছেন আপনি! আমি তাকে কিভাবে সহযোগিতা করতে পারি?’

‘তিনি আপনাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।’এ প্রস্তাবের কথা শুনে রাজিয়া খাতুন আকাশ থেকে পড়লেন। মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর স্থলে আর কাউকে বসানোর কথা তিনি কল্পনাও করেননি।

তিনি প্রবল আপত্তি তুলে বললেন, ‘না, না, তা কি করে হয়! মরহুম জঙ্গীর জায়গায় অন্য কাউকে বসানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। না, এ কিছুতেই হতে পারে না। দয়া করে আপনি আপনার প্রস্তাব ফিরিয়ে নিন। আমাকে অযথা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবেন না।’

‘এ বিয়ে ইয়াজউদ্দিন মাসুদ ও আপনার মধ্যে নয়।’ তকিউদ্দিন বললেন, এটা হবে দামেশক ও হলবের সাথে ঐক্যবন্ধনের যোগসূত্র। এ বন্ধন গড়ে তোলা সম্ভব হলে ভবিষ্যতের জন্য গৃহযুদ্ধের দুয়ার বন্ধ হয়ে যাবে। খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত জনশক্তি গড়ে তোলা সহজ হবে। বিশেষ করে আপনার মত বলিষ্ঠ ঈমানদার মহিলা তাঁর পাশে থাকলে ভবিষ্যতে কখনো গাদ্দারির পথে পা বাড়াতে সে সাহস পাবে না। খ্রিষ্টানরা ষড়যন্ত্রে উস্তাদ এবং হলব সব সময়ই ষড়যন্ত্রকারীদের শক্ত ঘাটি হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। আমরা চাই না, ইয়াজউদ্দিন মাসুদের মত সম্ভাবনাময় যুবক দুশমনের খপ্পড়ে পড়ে শেষ হয়ে যাক।’

রাজিয়া খাতুনের চোখে তখন টলোমলো অশ্রু। তিনি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে সে অশ্রু মুছে নিয়ে বললেন, ‘যেই মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম, ইসলামের খেদমতের জন্যই আমার জীবন। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েমের জন্য আমি যে কোন কোরবানী দিতে প্রস্তুত। যদি আমাকে দিয়ে ইসলামের কোন উপকার হবে বলে মনে করেন, তবে নির্দ্বিধায় আদেশ করবেন। আমি সে আদেশ মাথা পেতে নেবো।’

রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘আমার নিজস্ব ইচ্ছা ও পছন্দ বলে কিছু নেই। ইসলামের স্বার্থে আমার ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা আমি আপনাদের হাতে সোপর্দ করছি। সুলতান আইয়ুবীকে আমি আমার ভাই ও নেতা মনে করি। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন। তিনি আমাকে যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমি তাই মাথা পেতে নেবো।’

সুলতান আইয়ুবীকে জানানো হলো ইয়াজউদ্দিন মাসুদের অভিপ্রায়। অবশেষে সুলতানের অনুমোদন নিয়ে ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারী ইয়াজউদ্দিন মাসুদ ও রাজিয়া খাতুনের বিবাহ সম্পন্ন হলো।

❀ ❀ ❀

সাপটি মাত্র এক ফুট লম্বা। কিন্তু এই সাপটিই ইসহাকের তাগড়া জোয়ান ঘোড়াটিকে অচল করে দিল। ইসহাকের গন্তব্যস্থান রখনো অনেক দূরে। সিনাই মরুভূমির দুর্গম অঞ্চল পাড়ি দিচ্ছিল সে। বলা যায় মাত্র অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছে, এখনও বাকি আছে আরো অর্ধেক পথ।

ইসহাক জন্মসূত্রে তুরস্কের বাসিন্দা। তুর্কী আভিজাত্য লেপ্টে আছে তার চেহারায়। সুন্দর সুগঠিত শরীর। অটুট স্বাস্থ্য। মুখের গড়ন আর গায়ের রঙ আকর্ষণীয় ও ফর্সা। চোখ দুটো নীল। তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই সে আরবী মুসলমান নাকি ইউরোপীয় খ্রিষ্টান। তার যেমন স্বাস্থ্য ভাল ছিল তেমনি ছিল রূপের জৌলুশ।

কিন্তু এ জন্যই সে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করত বলার উপায় নেই। বরং সে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করত তার ভরাট কণ্ঠস্বর আর বুদ্ধিদীপ্ত কথার জন্য।

আইয়ুবীর একজন সতর্ক ও চালাক সৈনিক হিসেবে সে ছিল অনেকেরই প্রিয়ভাজন। সে যখন সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিল তখন তার বয়স ছিল মাত্র আঠার বছর।

সৈন্য বিভাগের চাকরী সে শখের বশে বা জীবিকা উপার্জনের জন্যই কেবল গ্রহন করেনি বরং সে সৈন্য বিভাগে নাম লিখিয়েছিল ঈমানের অপরিহার্য দাবী পূরণের তাগিদে।

তার জীবন ছিল একজন মর্দে মুমিনের বাস্তব রূপ। ক্রুসেড বাহিনীর বিরাট সংকল্পের সংবাদ পেয়ে সে ইসলামের হেফাজতের জন্য দামেশক চলে আসে এবং সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। যখন সুলতান আইয়ুবীকে মিশরের শাসক নিযুক্ত করা হয় তখন ইসহাককে পাঠানো হয় মিশরে। সে নিজেকে তুর্কী মুসলমান বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতো।

তার মতো অনেক তুর্কী মুসলমান সুলতান আইয়ুবীর সেনাবাহিনীতে ছিল। সুলতান আইয়ুবী তাদের উপর যথেষ্ট আস্থা ও বিশ্বাস রাখতেন। তিনি যখন কমান্ডো ফোর্স গঠন করেন তখন বেশির ভাগ সৈন্যই নিয়েছিলেন তুর্কীদের মধ্য থেকে। সেই কমান্ডো বাহিনী থেকেই তিনি বাছাই করা সৈন্যদের নিয়ে গঠন করেছিলেন গোয়েন্দা বিভাগ। এই গোয়েন্দা বিভাগ গঠনের জন্য প্রথম দিকে যাদের বাছাই করেছিলেন, ইসহাক তুর্কী ছিল তাদেরই একজন।

সে তার অসাধারন বুদ্ধি ও সাহসের জন্য অচিরেই কমান্ডো গোয়েন্দাদের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে উঠে। এই বুদ্ধি ও সাহসের কারণে অচিরেই তাকে একটি গ্রুপের কমান্ডার বানিয়ে দেয়া হয়। পরে তাকে তার বাহিনী সহ খ্রিষ্টান এলাকায় গোয়েন্দাগিরি করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়।

দায়িত্বের ব্যাপারেও সে ছিল খুবই নিষ্ঠাবান। সে জীবন বাজি রেখে মাটির তল থেকেও গোপন তথ্য উদ্ধার করে আনতে পারতো।

সিনাই মরুভূমি পার হয়ে সে যাচ্ছিল কায়রো। কিন্তু এখন এই সিনাই মরুভূমির মধ্যে সামান্য একটি সাপ তাকে বিরাট ও কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিল।

এ সময় সুলতান আইয়ুবী কায়রো অবস্থান করছিলেন। ইসহাক তুর্কী বৈরুত থেকে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে কায়রো রওনা হয়েছিল। তথ্য পাওয়ার পর সে আর দেরী করেনি, সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া নিয়ে নেমে পড়েছে রাস্তায়। পথে সে অল্পই বিশ্রাম নিয়েছে। সবুজ শ্যামল এলাকা অতিক্রম করে বিশাল মরুভূমিতে ঢুকে পড়েছে নির্দ্বিধায়।

সিনাই মরুভূমির নাম শুনলেই অনেকের পিলে চমকে উঠতো। এমন ভয়ংকর মরুভূমিতে একা পা বাড়াবার তো প্রশ্নই উঠে না, দল বেঁধে রওনা দিতেও সাহস পেতো না অনেকে। ইসহাক তুর্কী জানে, এই মরুভূমিতে একবার পথ হারালে কোন মুসাফির আর জীবিত ফিরে আসতে পারে না। এই মরুভূমি মানুষ ও প্রাণীদের জন্য জীবন্ত আতঙ্ক হয়েই বিরাজ করছিল। কিন্তু ইসহাক তুর্কী ছিল নির্ভীক। তাছাড়া মরুভূমির রহস্য সে যতটা ভাল জানে অনেকেরই তা জানা নেই।

সে তার প্রয়োজনীয় পানি ঘোড়ার সাথে বেঁধে নিয়েছিল। রাস্তা সম্পর্কেও পূর্ণ তথ্য জেনে নিয়েছিল রওনা হওয়ার আগেই। রাস্তার দু’এক স্থানের পানির সন্ধানও জানা ছিল তার। কারণ এ রাস্তায় এর আগে একবার তার যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতাও হয়েছিল।

হলব থেকে বের হয়ে যখন সে মরুভূমিতে প্রবেশ করে তখন তার অন্তরে কোন ভয় বা আশংকা ছিল না। যে দুটো জিনিস কখনোই তাকে ভয় দেখাতে পারেনি তার একটি হলো খ্রিষ্টান, অপরটি মরুভূমি। যুদ্ধ আর দূরযাত্রার কষ্টকে সে বরং উপভোগ করতো। সে বিশ্বাস করত, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে এ দুটোই মানুষের সহায়ক হয়।

দুপুরের সূর্য হেলে পড়েছিল। ইসহাক তুর্কী একটানা দুপুর পর্যন্ত ঘোড়া ছুটিয়ে এক টিলার ছায়ায় এসে শুয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে ঘুম এসে গেল। হঠাৎ ঘোড়ার বিকট চিৎকারে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে দেখতে পেল, ঘোড়াটি সামান্য জায়গাতেই চক্রাকারে দৌড়াচ্ছে। ঘোড়ার এ আচরনের কোন কারণ বুঝতে পারল না ইসহাক তুর্কী। সে শোয়া থেকে উঠে বসল।

ঘোড়া আর বেশী দৌড়াতে পারল না, থেমে গেল। তার সারা শরীর তখন কাঁপছে। ইসহাক তুর্কী দেখতে পেল ঘোড়াটি যেখানে শুয়েছিল তার চার পাঁচ গজ দূরে এক ফুট লম্বা একটি সাপ ছটফট করছে। লেজের দিক থেকে অর্ধেক দেহ তার থেঁৎলানো। ঘোড়াটি সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল।

ইসহাক বুঝতে পারল, ঘোড়াটিকে সাপে দংশন করেছে। পরে সাপটি ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়ে গেছে হয়তো। ঘোড়াটির আর চলার ক্ষমতা ছিল না। ইসহাক তুর্কী তার জুতার তলা দিয়ে সাপের মাথাটি থেৎলে দিল। সাপটি মারা গেল নিঃশব্দে।

ঘোড়াটিরও বাঁচার আশা শেষ হয়ে গেল। মরুভূমির সাপ ও বিচ্ছু এমন বিষাক্ত যে, যাকে দংশন করে সে পানি পান করার সুযোগটুকুও ও পায় না। মরুভূমির যাত্রীরা জ্বলন্ত সূর্যের তাপ তাপ এবং ডাকাত ও লুটেরার চেয়ে বেশী ভয় পায় এই সাপ ও বিচ্ছুকে। মরুভূমিতে চলতে হলে এই সাপ ও বিচ্ছুর ব্যাপারে তাই সর্বাত্মক সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। একটু অসাবধান হলেই সীমাহীন বিপর্যয় গ্রাস করতে পারে পথিককে।

সমতল ভূমি বা পাহাড়ী সাপের মত এরা সামনে এগোয় না। বরং এরা আশ্চর্য ভঙ্গিতে পাশে অগ্রসর হয়। ইসহাক তার ঘোড়াটির দিকে তাকাল। সে চোখে লেপ্টে আছে নিরাশার ছায়া। ঘোড়াটি তখন প্রচণ্ড জোরে কাঁপছিল। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো জিভ। ঘোড়াটি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, পা ভেঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়লো। তারপর দু’তিনবার পা নেড়ে এক পাশে কাত হয়ে নিরব হয়ে গেল চিরদিনের মত।

ইসহাক ঘোড়াটিকে কোনই সাহায্য করতে পারল না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো বোবা জানোয়ারটির করুণ মৃত্যু।

এটা ছিল উঁচু জাতের যুদ্ধের ঘোড়া। এ জাতের ঘোড়া সবসময় সতেজ থাকতো। সহজে পিপাসায় দুর্বল হতো না। ঘোড়াটির মৃত্যু ইশাকের জন্য মহা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল।

এ এমন এক ক্ষতি যা পুরণ হওয়ার নয়। কিন্তু এ ক্ষতিতেও সে কাতর হতো না, যদি স্বাভাবিক সময়ে এর মৃত্যু হতো। কিন্তু ঘোড়াটি মারা গেল এমন এক সময়ে, যখন সে দুর্গম মরুভূমিতে এবং এ ঘোড়াটিই ছিল তার একমাত্র সঙ্গী ও বাহন।

ইসহাককে এখন পায়ে হেঁটেই কায়রো যেতে হবে এবং তাকে কায়রো পৌঁছতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। সে জানতো, সে যে গোপন তথ্য তার বুকের মধ্যে করে নিয়ে যাচ্ছে, যদি তা শিঘ্রই সুলতান আইয়ুবীকে জানাতে না পারে তবে যুদ্ধের এক বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবেন সুলতান।