» » গাজী সালাহুদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান

বর্ণাকার
🕮

‘গাজী সালাহুদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান’ আসাদ বিন হাফিজ রচিত ‘ক্রুসেড সিরিজে’র প্রথম উপন্যাস। এটি লিখিত হয়েছে ‘আবদুল হক’ অনূদিত ‘আলতামাশে’র ‘দাস্তান ঈমান ফারুশোকী’র ছায়া অবলম্বনে। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালের মে মাসে। লেখক নিজেই এটির প্রকাশক। বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয় অক্টোবর ১৯৯৭ সালে এবং তৃতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয় ২০০২ সালের বইমেলায়। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রীতি প্রকাশন, ৪৩৫/ক বড় মগবাজার, ঢাকা ১২১৭। গ্রন্থস্বত্ব লেখকের।

বইটি সম্পর্কে শেষ প্রচ্ছদে লেখা হয়েছে— “গাজী সালাহুদ্দীন সেই অসামান্য সেনাপতি, অজস্র কুটিল ষড়যন্ত্র, ভয়াবহ সংঘাত আর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য থেকে যিনি ছিনিয়ে এনেছিলেন বিজয়। খ্রিস্টানরা চাচ্ছিল দুনিয়ার বুক থেকে ইসলামের নাম নিশানা মুছে দিতে, তাদের সহযোগিতা করছিল ক্ষমতালোভী, বিলাসপ্রিয় মুসলিম আমীর ওমরারা। কৈশোরেই তিনি হাতে নিয়েছিলেন অস্ত্র, জীবন পার করেছেন এমন সব অবিশ্বাস্য ঘটনার মধ্য দিয়ে যা কল্পনা করতেও শিউরে উঠে মানুষ। বীরত্ব ও মহানুভবতার এমন সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যার কারণে শত্রুর চোখেও হয়ে উঠেছেন ‘গ্রেট সালাদীন’।

“ইতিহাসে তাঁর সংঘাত, সংঘর্ষ ও বিজয়ের বিস্তর কাহিনী থাকলেও পাশ্চাত্য লেখকরা খ্রিস্টানদের লেলিয়ে দেয়া সেইসব গুপ্তচররূপী ছলনাময়ী রূপসী নারীদের কথা লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছে, যারা বার বার আঘাত হেনেছে সালাহুদ্দীনকে।

“সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর সেইসব অকথিত কাহিনী এবং অবিশ্বাস্য ঘটনাবহুল জীবনের শিহরিত ও রোমাঞ্চকর বর্ণনায় ভরপুর ‘ক্রুসেড’ সিরিজের ভূবনে সবাইকে স্বাগতম।”

‘ইসলামী উপন্যাস’ হিসেবে বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলেও নারীদেহের অত্যধিক সৌন্দর্য বর্ণনা এবং ভাষা ইসলামী সাহিত্যের সাথে বেমানান মনে করেন সমালোচকেরা। এছাড়া ইতিহাস নির্ভর কাহিনী হলেও এর সাথে প্রকৃত ইতিহাসের মিল খুব সামান্যই। বলা চলে এটি নিছক সাহিত্য।

উপন্যাসটি রচিত হয়েছে টানা, প্রায় এক হাজার অনুচ্ছেদে। অনলাইনে একসাথে এত দীর্ঘ লেখা পড়ে পাঠক ক্লান্তিবোধ করবেন, তাই আমরা বইটিকে কয়েকটি অনুচ্ছদে বিভক্ত করে প্রকাশ করেছি। অবশ্যই লক্ষ্য রাখা হয়েছে যাতে কোন পরিচ্ছেদে কাহিনী বর্ণনার ছেদ না পড়ে।

গাজী সালাহুদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান

জাদুল আসাদির তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। শিরস্ত্রাণ খোলেননি। তাঁবুর বাইরে সশস্ত্র দেহরক্ষীরা পাহারা দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য রক্ষীবাহিনীর কমাণ্ডার একটু অন্যদিকে গেলেন। একজন গার্ড পর্দা ঈষৎ ফাঁক করে উঁকি দিল তাবুর ভেতর। দু’চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন সুলতান। গার্ড বাইরে দাঁড়ানো চারজন সঙ্গীর দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ করে খুলল একবার। সে চারজন দেহরক্ষী অন্যদের সাথে গল্প জুড়ে দিল।

তাঁবুতে ঢুকল প্রথম রক্ষী। খঞ্জর হাতে নিল। বিড়ালের মত নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ঘুমন্ত সুলতানের দিকে। খঞ্জর বাগিয়ে ধরে হাত উপরে তুলল। সালাহুদ্দীনের বুক লক্ষ্য করে যখন নেমে আসছিল হাত, ঠিক সে মুহূর্তে পাশ ফিরলেন তিনি। রক্ষীর আঘাত গিয়ে পড়ল সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর শিরস্ত্রাণে।

বিদ্যুৎ গতিতে দাঁড়িয়ে গেলেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। নিমিষেই ঘটনা আঁচ করে নিলেন। নিজের বাছাই করা দেহরক্ষী আক্রমণ করছে দেখেও হতবাক হলেন না।

রক্ষী শিরস্ত্রাণের পাশ কেটে মাটিতে গেঁথে যাওয়া খঞ্জর টেনে তুলছিল। পলকে পূর্ণ শক্তিতে রক্ষীর মুখে ঘুসি মারলেন সালাহুদ্দীন। মট করে হাড় ভাঙ্গার শব্দ হল। বিকট শব্দ করে চিৎ হয়ে পরে গেল রক্ষী।

সালাহুদ্দীন আইয়ূবী রক্ষীর হাত থেকে ছিটকে পড়া খঞ্জর নিজের হাতে তুলে নিলেন। চিৎকার শুনে বাইরে থেকে ছুটে এল দু’জন রক্ষী।

‘ওকে বেঁধে ফেল।’ নির্দেশ দিলেন সুলতান।

কিন্তু ওরা সুলতানের আদেশ অমান্য করে উল্টো তাঁকেই আক্রমণ করে বসল। একা খঞ্জর দিয়ে দুই রক্ষীর তলোয়ারের মোকাবেলা করতে লাগলেন সালাহুদ্দীন। তাঁবুর ভেতর শুরু হলো অসম এক লোমহর্ষক লড়াই।

দু’এক মিনিটের মধ্যেই অন্য গার্ডরাও ভেতরে প্রবেশ করল। অবাক বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত তারা তাকিয়ে রইল সালাহুদ্দীন ও রক্ষীদের অসম লড়াইয়ের দিকে। সম্বিত ফিরে এলে একজন এগিয়ে এসে আঘাত করল রক্ষীদের। দেখাদেখি অন্য রক্ষীরাও ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবার রক্ষীরা দুই দল হয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করল। আপন পর পার্থক্য করতে না পেরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী।

সংঘর্ষ থেমে গেল। দু’জন নিহত হল এই সংঘর্ষে। আহত হল কয়েকজন, পালিয়ে গেল একজন। তদন্ত শেষে দেখা গেল দেহরক্ষীদের সাতজন ছিল ঘাতক দলের সদস্য। গুমাস্তিগীন নামে খলিফা সালেহের এক কেল্লাধিপতি সালাহুদ্দীনকে হত্যার জন্য এদের নিয়োগ করেছিল।

সালাহুদ্দীন আইয়ূবীকে হত্যা করার এ ধরনের কয়েকটি প্রচেষ্টা পরপর ব্যর্থ হল। এ হত্যা পরিকল্পনার হোতা ছিল সাইফুদ্দীন। সাইফুদ্দীন ছিল সালাহুদ্দীনের চাচাতো ভাই খলিফা আস-সালেহের একজন আমীর। যে সময়ের কথা বলছি, তখন মুসলিম বিশ্বের প্রধান হলেও কার্যত ইসলামী দুনিয়া ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত। বিভিন্ন প্রদেশের গভর্ণরগণ সুলতান উপাধি ধারণ করে বলতে গেলে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এ ঘটনার পর একদিন ভোরে সাইফুদ্দীনকে লক্ষ্য করে একটি চিঠি পাঠালেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। তাতে তিনি লিখলেন, “খাঁচায় বন্দী পাখির মাঝে তুমি চিত্তপ্রসাদ খোঁজ, নারী আর মদের মাঝে খোঁজ জীবনের মানে, কিন্তু জানো না সৈনিকের জীবন মানেই এক বিপজ্জনক খেলা।’

চিঠিটি লিখেছিলেন তিনি ১১৭৫ সালের এপ্রিল মাসে। খলিফা সালেহ এবং সাইফুদ্দীন খৃষ্টানদের সহযোগিতায় সালাহুদ্দীনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলো। পরাজিত হয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেল সাইফুদ্দীন। তার তাঁবুতে পাওয়া গেল অগণিত সম্পদ। পাওয়া গেল খাঁচায় বন্ধী রঙবেরঙের পাখি, এক ঝাঁক সুন্দরী তরুণী, নর্তকী, গায়িকা। বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্র আর পিপা ভর্তি মদ।

সালাহুদ্দীন খাঁচায় দুয়ার খুলে দিলেন, পাখীরা উড়ে গেল উন্মুক্ত আকাশে। নর্তকী, গাায়িকা আর তরুণীদের মুক্ত করে দিলেন। চিঠি লিখলেন আমীর সাইফুদ্দীনের কাছে, ‘তোমরা বেঈমানী করে খৃষ্টানদের সহযোগিতায় আমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছ। একবারও কি ভেবেছ, তোমাদের এ ষড়যন্ত্র ইসলামী বিশ্বের মানচিত্র মুছে দিতে পারে? যদি আমাকেই ঈর্ষা কর, যদি আমিই তোমাদের শত্রু হয়ে থাকি, মেরে ফেল আমায়। দু’বার সে চেষ্টাও করেছ। সফল হওনি, আবার না হয় চেষ্টা করে দেখ। এবার সফল হলে হতেও পার।

‘যদি নিশ্চয়তা দিতে পারো, আমাকে হত্যা করলে ইসলাম আরো গৌরবোজ্জ্বল হবে, তবে আমার মাথা কেটে তোমাদের পায়ের কাছে রেখে দিতে বলব। মনে রেখো, অমুসলিম কখনো মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না। ইতিহাস এর সাক্ষী। ফ্রান্স সম্রাট এবং রিমাণ্ডের মতো খৃষ্টানকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সহযোগিতা করছ বলে তোমরা ওদের বন্ধু। ওরা সফল হলে ওদের প্রথম শিকার হবে তোমরাই। এরপর পৃথিবীর বুক থেকে ইসলামের নামও মুছে যাবে।

‘তোমরা যোদ্ধা জাতির সন্তান। সৈন্য হওয়া তোমাদের জাতীয় পেশা। প্রতিটি মুসলমানই আল্লাহর সৈনিক। তার জন্য শর্ত কেবল ঈমান ও সৎকাজ। খাঁচায় বন্দী পাখির মাঝে তুমি চিত্তপ্রসাদ খোঁজ, নারী আর মদের মাঝে খোঁজ জীবনের মানে, কিন্তু জানো না সৈনিকের জীবন মানেই এক বিপজ্জনক খেলা। অনুরোধ করি, আমার সাথে সহযোগিতা কর। জিহাদে শরীক হও,  না হলে কমপক্ষে বিরোধীতা কোরো না। আমি তোমাদের কোন শাস্তি দেব না। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।’

—সালাহুদ্দীন আইয়ূবী।

এ সব যুদ্ধের ফলে অজস্র যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর হাতে এসেছিল। বন্দীর সংখ্যা ছিল অগণিত। তিনি যুদ্ধলব্ধ সম্পদকে তিন ভাগে ভাগ করলেন। এক ভাগ যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে তাদের মুক্ত করে দিলেন। এক ভাগ দিলেন সৈন্য এবং গরীবদের। তৃতীয় ভাগ পাঠিয়ে দিলেন নিজামুল মুল্‌ক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন। নিজের জন্য এবং জেনারেলদের জন্য কিছুই রাখেননি। বন্দীদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। কিছু অমুসলিমও ছিল, সালাহুদ্দীনের মহানুভবতায় ওরা তার আনুগত্য গ্রহণ করে সোবাহিনীতে ভর্তি হয়ে গেল।

ইবনে সাবার ফেদাই গ্রুপ দু’বার সালাহুদ্দীনকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করেছিল। ফেদাইদেরকে ঐতিহাসিকগণ  ঘাতক দল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দু’-দু’বারই তিনি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তৃতীয় আক্রমণ হল খৃষ্টান এবং সাইফুদ্দীনের সম্মিলিত শক্তিকে পরাজিত করার পর। সাইফুদ্দীন পালিয়ে গুপ্তঘাতক দলের সাহায্য কামনা করল।

সালাহুদ্দীনের প্রায় একশো বছর আগে হাসান ইবনে সাবা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন উপদলের জন্ম দিয়েছিল। নিজেদের পরিচয় দিত মুসলমান হিসেবে। কিছু অলৌকিক কাজ দেখিয়ে মানুষকে অনুসারী বানাতো। সুন্দরী তরুণী, মদ, হিপটোনিজম এবং চাটুকারিতা ছিল ওদের পুঁজি। বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য ছিল বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঘাতক দল। ওরা মানুষকে হত্যা করত গোপনে।

এরা ছিল সতর্ক, বুদ্ধিদীপ্ত এবং দুঃসাহসী। এরা পোশাক আশাক এবং ভাষা পরিবর্তন করে বড় বড় জেনারেলের দেহরক্ষীর চাকরী নিত। সময় সুযোগ বুঝে এমন ভাবে সারতো হত্যার কাজ, নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীকে কোনভাবেই খুঁজে পাওয়া যেত না। ধীরে ধীরে ইবনে সাবার দল ঘাতকদল হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠল। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে ওরা ছিল পারদর্শী, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যার কাজে ব্যবহার করত বিষ। সুন্দরী যুবতীরা মদের সাথে এ বিষ মিশিয়ে দিত।

সালাহুদ্দীন আইয়ূবীকে রূপসী নারী দিয়ে বা মদ খাইয়ে হত্যা করা সম্ভব ছিল না। তিনি এ দুটো থেকেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতেন সতর্কভাবে। ফলে আকস্মিক আক্রমণ ছাড়া তাঁকে হত্যা করার অন্য কোন পথ ছিল না। কিন্তু বিশ্বস্ত ও নিবেদিত প্রাণ দেহরক্ষীদের উপস্থিতিতে তাও ছিল অসম্ভব। সালাহুদ্দীন ভেবেছিলেন পরাজয়ের পর সালেহ এবং সাইফুদ্দীন আর মাথা তুলে দাঁড়াবে না। সম্মিলিত বাহিনীর অহমিকা চুর্ণ হবার পর সালাহুদ্দীনের সাথে টক্কর দেওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে সংশোধন হয়ে যাবে। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল ওরা।

বিজয়ের পর সালাহুদ্দীন আইয়ূবী তাঁর অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখলেন। দখল করলেন গাজাসহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী— দুঃসাহসী এক যোদ্ধা, অসাধারণ এক সেনাপতি। ইসলামের শত্রুরা আজও তাকে সম্বোধন করে ‘গ্রেট সালাদীন’ বলে, মুসলমানরা স্মরণ করে জাতীয় বীর হিসাবে।

মুসলিম মিল্লাতের ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লেখা রয়েছে তাঁর নাম। খৃষ্টান জগৎ তাঁর সাহস, বুদ্ধিমত্তা আর রণকৌশলের কথা কোনদিন ভুলতে পারবে না। ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে আছে তাঁর জয় পরাজয়ের বিস্ময়কর কাহিনী। কিন্তু ক্রুশের ধ্বজাধারীরা মদ আর রূপের মায়াজালে যে ষড়যন্ত্রের বিস্তার ঘটিয়েছিল, নিজেদের সে সব অপকর্মের চমকপ্রদ কাহিনী ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি।

১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ। মিসরের গভর্ণর এবং সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে এলেন সালাহুদ্দীন। তিনি ছিলেন রাজপরিবারের সন্তান। অল্প বয়সেই যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মনে করতেন শাসক রাজা নয়, শাসক হলো ইসলামের রক্ষক। বুদ্ধি হওয়ার পর তিনি দেখেছিলেন মুসলিম শাসকদের অনৈক্য। বিলাসপ্রিয় শাসকবর্গ সুন্দরী রমণী আর মদে আকণ্ঠ ডুবেছিল। গাদ্দারী, বিলাসিতা আর অবিশ্বাসের কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল মুসলিম মিল্লাতের ভবিষ্যৎ।

রাষ্ট্রের কর্ণধারদের হারেমের শোভা বর্ধন করছিল ইহুদী আর খৃষ্টান যুবতীরা। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব সুন্দরী রমনীদের রূপের আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছিল মানুষের ইসলামী জোশ আর স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বার আবেগ অনুভূতি।

এ সুযোগে খৃষ্টান শাসকগণ একের পর এক ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলো দখল করে নিচ্ছিল। মুসলিম শাসকবর্গ প্রজার রক্ত শুষে খৃষ্টানদেরকে বাৎসরিক কর প্রদান করত। ওদের সেনা শক্তির ভয়ে সর্বক্ষণ তটস্ত হয়ে থাকত। খৃষ্টানরা মুসলমানদেরকে ভোগবিলাসের হারেমে বন্দী রেখে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব দখলের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলছিল।

সালাহুদ্দীন শিক্ষা লাভ করেছিলেন নিজাম-উল-মুলক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে শিক্ষার্থীদেরকে খালেছ ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলার ব্যবস্থা ছিল। আর সে জন্যই ঘাতকদলের প্রথম শিকার ছিলেন নিজাম-উল-মুলক। রোমানদের রাজ্যবিস্তারে তিনি ছিলেন বড় বাঁধা। এ বাঁধা দূর করার জন্য তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

সালাহুদ্দীন এখানেই সেনা প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। প্রশাসনিক কাজে তাঁকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছিলেন নুরুদ্দীন জঙ্গী। মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার সকল গুণাবলী এখানেই অর্জন করেছিলেন তিনি। সালাহুদ্দীন আইয়ূবী গোয়েন্দা বৃত্তি, কমাণ্ডো অভিযান এবং গেরিলা অপারেশনকে সবচে’ বেশী গুরুত্ব দিতেন। তিনি দেখেছিলেন গুপ্তচর বৃত্তিতে খৃষ্টান জগৎ অনেক অগ্রসর। মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা আর সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছিল ওদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। সালাহুদ্দীন অত্যন্ত ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে এর মোকাবিলা করেছিলেন।

তিনি মিসরের গভর্ণর ও সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে এলে শুরু হল ষড়যন্ত্র। বড় বড় জেনারেলরা এ পদের জন্য ছিল লালায়িত। তাঁরা যখন দেখল তাঁদের আশায় গুড়ে বালি, তখন ক্ষুব্ধ জেনারেলগণ ষড়যন্ত্র শুরু করল তাঁর বিরুদ্ধে।

ওদের ধারণায় সালাহুদ্দীন একজন বালকমাত্র। এ পদের যোগ্যতা তাঁর মধ্যে নেই। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে জেনারেলদের সে ধারণা ভেঙে গেল। সালাহুদ্দীন কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতেন। সৈন্যদের জন্য ভোগবিলাস এবং মদ নিষিদ্ধ করলেন। মনোনিবেশ করলেন ওদের শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে। ফলে অল্প দিনেই সেনাবাহিনী সুশৃংখল ও সুসংগঠিত হয়ে উঠল। অল্পবয়স্ক অর্বাচীন বালক বলে তাঁকে যারা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখছিল, টনক নড়ে উঠল তাদের।

সালাহুদ্দীন খৃষ্টান শক্তির মোকাবিলার জন্য একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। মুক্ত ফিলিস্তিনে শ্বাস নেয়ার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সেনাবাহিনীকে সে ভাবে গড়ে তুলতে লাগলেন তিনি। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘যে খোদা আমাকে মিসরের গভর্ণর করেছেন, অবশ্যই তিনি ফিলিস্তিনও মুক্ত করবেন।’ তাঁর এ ঘোষণার জন্য কেবল খৃষ্টানই নয়, খৃষ্টানপন্থী মুসলমান আমীর ওমরারাও তাঁর শত্রু হয়ে দাঁড়াল। বাইরের শত্রুর চাইতে ঘরের শত্রুরা হয়ে উঠল তাঁর জন্য অধিকতর বিপজ্জনক।

নতুন গভর্ণরের অভ্যর্থনার আয়োজন করা হল। আয়োজন করলেন জেনারেল নাজি। পঞ্চাশ হাজার ফৌজের অধিনায়ক তিনি। অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী ছাড়াও বেসামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত। মুচকি হেসে একে একে সকলের সাথে করমর্দন করলেন সালাহুদ্দীন আইয়ূবী। কণ্ঠে স্নেহ-ভালবাসার উষ্ণ পরশ। কোন কোন অফিসারের ঠোঁটে কুটিল হাসি। দৃষ্টিতে ঘৃণা আর উপহাস। ওদের ধারণা, নুরুদ্দীন জঙ্গীর সাথে সুসম্পর্ক এবং রাজপরিবারের সন্তান বলেই সালাহুদ্দীন গভর্ণর হতে পেরেছেন। এক প্রবীণ অফিসার আরেকজনের কানে কানে বলল, ‘এখনো শিশু, আমরা পেলে পুষে নেব।’

অনুষ্ঠানে তাঁকে শিশুই মনে হচ্ছিল। জেনারেল নাজির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন সালাহুদ্দীন। কপাল কুঞ্চিত হল ঈষৎ। করমর্দনের জন্য হাত প্রসারিত করলেন। নাজি তোষামুদে দরবারীদের মত সালাহুদ্দীনকে কুর্নিশ করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমো খেয়ে বললেন, ‘আপনার জীবন রক্ষার্থে আমার দেহের শেষ রক্তবিন্দুটুকুও বিলিয়ে দেব। আপনি আমাদের কাছে মাননীয় জঙ্গীর আমানত।’

‘ইসলামের চাইতে আমার জীবনের দাম বেশী নয় সম্মানিত জেনারেল।’ সালাহুদ্দীন বললেন, ‘প্রতিটি ফোঁটা রক্ত সংরক্ষণ করে রাখুন। খৃষ্টান ষড়যন্ত্রের ঘণঘটা মুসলিম বিশ্বের আকাশে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।’

জবাবে মৃদু হাসলেন নাজি। যেন তাঁকে রূপ কথার গল্প শোননো হচ্ছে। নাজি ছিল ফাতেমী খেলাফতের সিপাহসালার। পঞ্চাশ হাজার ফৌজের অধিনায়ক। সৈন্যদের সবাই ছিল সুদানের অধিবাসী। তাঁর বাহিনী ছিল আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত। বলতে গেলে এরা ছিল নাজির ব্যক্তিগত সৈন্য। নাজি ছিল মুকুটহীন সম্রাট।

তখন মুসলিম দেশগুলোর কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করত। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছিল খৃষ্টান জগৎ। মিসর এবং আশপাশের শাসকদের জন্য নাজি ছিল এক ত্রাস। তাঁর মস্তিষ্ক ছিল ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রভূমি। ভেড়া দেখলে নেকড়ের যেমন দাঁত বেরিয়ে আসে, সালাহুদ্দীনকে দেখে নাজিরও তেমনি দাঁত বেরিয়ে এসেছিল। সালাহুদ্দীন তাঁর এ ক্রুর হাসির মর্ম না বুঝলেও এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, এ শক্তিধর জেনারেলকে তাঁর প্রয়োজন।

‘হুজুর অনেক দূর থেকে এসেছেন। খানিক বিশ্রাম করে নিন।’ নাজি বলল।

‘যে কঠিন দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে, আমি তার যোগ্য নই। এ দায়িত্বভার আমার বিশ্রাম এবং নিদ্রা কেড়ে নিয়েছে। প্রথমে অফিসে গেলেই কি ভাল হয় না?’

‘হুজুর কি আগে খেয়ে নেবেন?’ বলল একজন অফিসার।

একটু ভেবে ওদের সাথে হাঁটা দিলেন সালাহুদ্দীন। দু’সারিতে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র গার্ডবাহিনী। ওদের হাতের অস্ত্র এবং পেশীবহুল বলিষ্ঠ দেহ দেখে তাঁর চেহারায় হেসে উঠল আনন্দের দ্যুতি। দরজার কাছে পৌঁছতেই চেহারায় এ আলো হঠাৎ নিভে গেল। তার বদলে হতাশার আঁধার এসে গ্রাস করল তাঁকে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চারজন রূপসী তরুণী। তাদের পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে রেশম কোমল চুল। পরনে পাতলা পোশাক। হাতে ফুলের ঝুড়ি। সালাহুদ্দীনের পথে ওরা ফুল ছুঁড়তে লাগল। সাথে সাথে বেজে উঠল দফ ও রবাবের সুর ঝঙ্কার।

থমকে দাঁড়ালেন সালাহুদ্দীন। ডানে বাঁয়ে নাজি এবং তাঁর সহকারীরা। ভারতীয় রাজরাজড়াদের মত ওরা নুয়ে তাঁকে সামনে চলার জন্য অনুরোধ করল।

‘সালাহুদ্দীন ফুল মাড়ানোর জন্য আসেনি।’ গমগম করে উঠল সালাহুদ্দীনের কণ্ঠ। ঠোঁটে শ্লেষের হাসি। যে হাসি দেখতে ওরা অভ্যস্ত নয়।

‘হুজুর চাইলে আমরা আকাশের তারা এনে দিতে পারি’ নাজি বলল।

‘আমাকে খুশী করতে হলে একটা জিনিসই আমার পথে ছড়ানো যেতে পারে।’

‘আদেশ করুন।’ মুখ খুলল নাজি’র সহকারী, ‘কোন জিনিস আপনাকে তুষ্ট করতে পারবে।’

‘খৃষ্টানদের লাশ।’ মৃদু হেসে বললেন সালাহুদ্দীন।

ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল অফিসারের।

মুহূর্তে বদলে গেল সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর চেহারা। দু’ চোখ থেকে ঠিকরে বেরোতে লাগল আগুনের হল্‌কা। বললেন, ‘মুসলমানদের জীবন ফুলশয্যা নয়। আপনারা কি জানেন না খৃষ্টানরা মুসলিম বিশ্বকে ইঁদুরের মত কেটে টুকরো টুকরো করে চলছে?’

তাঁর গম্ভীর কণ্ঠের ধ্বনি বদলে দিল ঘরের পরিবেশ। প্রতিটি শব্দ থেকে বিস্ফোরিত হচ্ছিল প্রচণ্ড ক্রোধ। ‘আমাদের মেয়েদের উলঙ্গ করে ওদের ইজ্জত পদদলিত করেছি বলেই আজ আমরা ফুল মাড়াতে পারছি। শুনুন, আমার দৃষ্টি আটকে আছে ফিলিস্তিনে। আপনারা কি আমার পথে ফুল বিছিয়ে মিশর থেকে ইসলামকে বিদায় করতে চাইছেন?’

তিনি চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমার পথ থেকে ফুল সরিয়ে নাও। এ ফুলে পা পড়লে আমার হৃদয় কাঁটার ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। সরিয়ে দাও মেয়েদের। আমি চাই না ওদের সোনালী চুলে জড়িয়ে গিয়ে আমার তরবারী গতি হারিয়ে ফেলুক।’

‘হুজুরের ইজ্জত সম্মান……।’

‘আমাকে আর কখনো হুজুর বলবে না।’ ঝাঁঝের সাথে বললেন তিনি। মনে হল শব্দের তীব্র আঘাতে ওদের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দেয়া হয়েছে। ‘তোমরা যার কালেমা পড়েছ হুজুর তো তিনি। আমি তাঁর দাসানুদাস মাত্র। সে হুজুরের জন্য আমার জীবন নিঃশেষে বিলিয়ে দিতে চাই। তাঁর পয়গাম আমার বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছি। খৃষ্টান জগৎ ওই পয়গাম ছিনিয়ে নিয়ে রোম উপসাগরে ডুবিয়ে দিতে চাইছে। ডুবিয়ে দিতে চাইছে মদের দরিয়ায়। আমি বাদশা হয়ে এখানে আসিনি।’

নাজির চোখের ইশারায় মেয়েরা ফুল কুড়িয়ে দরজা থেকে সরে গেল। দ্রুতপায়ে ভেতরে ঢুকলেন সালাহুদ্দীন। প্রশস্ত কক্ষ। ফুল দিয়ে সাজানো বিশাল টেবিল। টেবিলে নানা রকম সুস্বাদু খাবার।

খাবারে দৃষ্টি বুলিয়ে তিনি তাকালেন সহকারী সালারের দিকে।

‘মিসরের সব মানুষ কি এমন খাবার খেতে পারে?’

‘না হুজুর’। সহকারীর জবাব, ‘গরীবরা তো এসব খাবার স্বপ্নেও দেখে না।’

‘তোমরা কোন্ সমাজের লোক? যারা এমন খাবার স্বপ্নেও দেখে না ওরা কি তোমাদের চেয়ে ভিন্ন জাতি?’

সকলেই নির্বাক।

‘এখানে যত চাকর-বাকর এবং ডিউটিরত সেপাই রয়েছে সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো। এ খাবার ওরা খাবে।’

সালাহুদ্দীন আইয়ূবী একটা রুটির সাথে ক’টুকরা তরকারী তুলে তড়িঘড়ি খাওয়া শেষ করলেন। এরপর নাজিকে সাথে নিয়ে হাঁটা দিলেন গভর্ণর হাউসের দিকে।

দু’ঘন্টা পর। গভর্ণর হাউস থেকে বেরিয়ে এল নাজি। দ্রুত এগিয়ে গেল ঘোড়ার দিকে। এক লাফে ঘোড়ায় চড়ে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল।

রাত নেমেছে। নাজি খাস কামরায় কয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে নিয়ে মদের আসর বসিয়েছে। নাজি বলল, ‘যৌবনের তেজ কয়েক দিনের মধ্যেই ঠাণ্ডা করে দেব। কমবখ্‌ৎ বলল কি জান? বলল, কাবার প্রভুর শপথ! মুসলিম বিশ্ব থেকে খৃষ্টানদের বিতাড়িত করে তবে আমি বিশ্রাম নেব।’

‘সালাহুদ্দীন আইয়ূবী? হুহ্!’ সহকারী সালারের কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর। ‘ইসলামী রাষ্ট্রের দম ফুরিয়ে গেছে সে এ খবরও জানে না। এখন তো সুদানীরা দেশ চালাবে।’

অন্য এক কমাণ্ডার প্রশ্ন করল, ‘পঞ্চাশ হাজার ফৌজের সবাই সুদানী একথা তাঁকে বলেননি। বলেননি যে ওরা আপনার নির্দেশে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না?’

‘তোমার কি মাথা খারাপ এডরোস? আমি বরং তাঁকে নিশ্চয়তা দিয়েছি। বলেছি আপনারা ইশারা পেলে আমার সৈন্যরা খৃষ্টানদের ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। কিন্তু…’

থেমে গেল নাজি।

‘কিন্তু কি?’

‘মিসরের লোকদেরকে ফৌজে ভর্তি করার জন্য সে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে। কারণ ফৌজ এক এলাকার থাকা নাকি উচিৎ নয়। সে মিসরের লোকদেরকে আমার সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে।’

‘আপনি কি বললেন?’

‘বলেছি আপনার নির্দেশ পালন করা হবে। কিন্তু আমি তা করব না।’

‘তার মনমানসিকতা কেমন বুঝলেন?’

‘একরোখা জেদী।’

‘আপনার বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতার সামনে সে এখনো শিশু। নতুন গভর্ণর হয়ে এলো তো! কদিন পরই পদের নেশায় পেয়ে বসবে।’

‘আমি তাঁর এ নেশা দূর করবো না। নেশায় নেশায় তাকে নিঃশেষ করব।’

ওরা অনেকক্ষণ ধরে সালাহুদ্দীনকে নিয়ে কথা বলল। নতুন গভর্ণর এই মুকুটহীন সম্রাটের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে কি পদক্ষেপ নেয় হবে তাও আলোচিত হল।

অন্যদিকে সালাহুদ্দীন তাঁর সহকারীদের বলছিলেন, ‘আমি এখানে রাজা হয়ে আসিনি। কাউকে রাজত্ব করতেও দেবো না।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমাদের সামরিক শক্তির প্রয়োজন। এখানকার সেনাবাহিনীর গঠন পদ্ধতি আমার পছন্দ নয়। পঞ্চাশ হাজর ফৌজের সবাই সুদানী। অথচ সব এলাকার লোকেরই সৈন্য হবার অধিকার আছে। এভাবে ওদের জীবনের মানও উন্নত হতে পারে। সব এলাকা থেকে সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তি করার জন্য আমি নাজিকে বলে দিয়েছি।’

‘নাজি কি আপনার নির্দেশ পালন করবে?’ একজন সহকারী প্রশ্ন করল।

‘কেন, সে কি আমার হুকুম অমান্য করবে নাকি?’

‘করতেও পারে। ফৌজের সর্বময় কর্তা তিনি। তিনি কারো নির্দেশ পালন করেন না, বরং অন্যকে তাঁর নির্দেশ পালনে বাধ্য করেন।’

এ কথায় সালাহুদ্দীন একটু নীরব রইলেন। তবে তাঁর চেহারায় কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি কি ভাবছেন তা বুঝে উঠার আগেই আলী বিন সুফিয়ানকে রেখে অন্যদের বিদায় জানালেন তিনি।

আলী মধ্য বয়সী এক চৌকস গোয়েন্দা লিডার। কুশলী, সাহসী এবং অসম্ভব বাকপটু। গুপ্তচর বৃত্তির জন্য সে বিশ্বস্ত ও নিবেদিতপ্রাণ কিছু লোককে ট্রেনিং দিয়ে পারদর্শী করে তুলেছে। তাদের নিয়ে গড়ে তুলেছে নিজস্ব গোয়েন্দা দল। আকাশ থেকে তারকা ছিনিয়ে আনতে বললেও যারা পিছপা হবে না। চিন্তা চেতনার দিক থেকে সে ছিল আইয়ূবীর সমমনা। সালাউদ্দীন তাকে বাগদাদ থেকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন।

‘শুনলে আলী! এরা বলল, কারো হুকুম পালন করতে নয়, নাজি হুকুম দিতে অভ্যস্ত!’

‘শুনলাম তো। চিনতে ভুল না করলে বলব, লোকটি ধুরন্ধর ও বড় ধরনের ক্রিমিনাল। তার ব্যাপারে আগে থেকেও আমি কিছুটা জানি। জনগণের টাকায় লালিত সেনাবাহিনী এখন তার নিজস্ব ফৌজ। তার ষড়যন্ত্রের ফলে প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। ‘সব এলাকার লোকই সেনাবাহিনীতে ভর্তি করার প্রয়োজন’ আপনার এ সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী এবং সঠিক হয়েছে। আমার তো আশংকা হচ্ছে সুদানী সৈন্যরা প্রয়োজনের সময় আপনার হুকুম অমান্য করে তারই অনুগত্য করবে। বলা যায় না, ফৌজের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি পরিবর্তন করে নাজিকে আপনার অপসারণও করতে হতে পারে।’

‘না, নাজির মত প্রভাবশালী ব্যক্তিকে এখনই বিরূপ করতে চাই না। এ মুহূর্তে তাঁকে অপসারণ করা ঠিক হবে না। নিজেদের রক্ত ঝরানোর জন্য আমি অস্ত্র হাতে নেইনি, আমাদের তরবারী শত্রুর জন্য। আমি আগে ভালবাসা দিয়ে তাকে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করব। তুমি বর্তমান সেনাবাহিনী আমাদের কদ্দুর কাজে আসবে তা-ই বোঝার চেষ্টা কর।’

‘আপনার ভালবাসা তাকে শুধরাতে পারবে বলে মনে হয় না’।

সালাহুদ্দীন যা ভেবেছিলেন নাজি ততটা সহজ ছিল না। ভালবাসা শব্দটি তার অভিধানে ছিল না। তার সব প্রীতি এবং মমতা ছিল ক্ষমতার সাথে। ক্ষমতার প্রশ্নে সে ছিল অত্যন্ত কঠোর। মানুষ হিসাবে ছিল অসম্ভব ধূর্ত। ষড়যন্ত্র ছিল তার হাতিয়ার। কাউকে ফাঁসাতে চাইলে তার সাথে মোমের মত কোমল ব্যবহার করত। সালাহুদ্দীনের সাথে তার ব্যবহার ছিল অনুগত দাসানুদাসের মত। তার সামনে সে কখনো বসত না। সালাহুদ্দীনের প্রতিটি কথায় জি-হুজুরীর ভূমিকা পালন করত।

নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সে মিসরের সকল অঞ্চল থেকেই সেনা ভর্তি শুরু করে দিয়েছিল। সময় এগিয়ে যাচ্ছে। সালাহুদ্দীনও তাকে একটু একটু পছন্দ করা শুরু করেছেন। নাজি তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, সেনাবাহিনী আপনার নির্দেশের অপেক্ষায়। ফৌজের পক্ষ থেকে নতুন গভর্ণরকে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়ার প্রস্তাবও দিল সে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তিনি তার এ আমন্ত্রণ মুলতবী রাখলেন।

রাত নেমেছে। নিজের কক্ষে দু’জন কমাণ্ডার নিয়ে মদ পান করছিল নাজি। মৃদু লয়ে বাজছে সংগীতের সুর মুর্ছনা। তালে তালে নাচছে দু’জন নর্তকী। পায়ে নুপুর নেই। বে আব্রু দেহের ভাঁজে ভাঁজে মাদকতা। প্রহরী ভেতরে এসে নাজির কানে কানে কি যেন বলল।

মদির আবেশে মত্ত নাজির আনন্দে বিঘ্ন ঘটাবার সাহস কারও ছিল না। কিন্তু এ আসর থেকে তাকে কোন্ সময় তুলে নেয়া যায় প্রহরী তা জানত।

উঠে দাঁড়াল নাজি। প্রহরী তাকে একটি কক্ষে নিয়ে গেল। সুদানী পোশাক পরে একজন লোক বসে আছে। সাথে এক যুবতী।

নাজিকে দেখে দু’জন উঠে দাঁড়াল। যুবতীর রূপ মাধুর্য দেখে নাজি খানিক হতভম্বের মত তাকিয়ে রইল। সে নারী শিকারী। শুধু ভোগের জন্যই নয়, বড় বড় অফিসারদের ব্লাকমেল অথবা তাদেরকে হাতে রাখবার জন্যও সুন্দরী যুবতীদের ব্যবহার করত নাজি। কসাই যেমন পশু দেখলে গোশত পরিমাণ করতে পারে, সেও প্রথম দেখাতেই বুঝত কাকে দিয়ে কোন কাজ করানো যাবে। নারী ব্যবসায়ীরা প্রায়শই তার কাছে মেয়ে নিয়ে আসত।

বিক্রেতা যুবতীর ব্যাপারে বলল, ‘দারুণ স্মার্ট। নাচতে পারে, গাইতে পারে, মুখের মধুতে পাথরও গলিয়ে দিতে পারে।’

নাজি ওর ইন্টারভিউ নিয়ে চমৎকৃত হল। ভাবল, একটু তৈরী করে নিলে যে কোন কাজেই ব্যবহার করা যাবে।

দাম দস্তুর শেষে টাকা নিয়ে চলে গেল লোকটি। নাজি ওকে নিয়ে চলে এল জলসা ঘরে। নাচতে বলল তরুণীকে। দেহের বাড়তি কাপড় ফেলে দিয়ে দু’পাক ঘুরতেই হা হয়ে গেল তিন দর্শক। ফ্যাকাশে হয়ে গেল আগের দু’নর্তকীর চেহারা। নতুন মেয়েটার সামনে ওরা এখন মূল্যহীন বাসি ফুল।

আসর ভেঙে দিল নাজি। নতুন মেয়েটাকে রেখে সকলকে বিদায় করে দিল।

‘নাম কি সুন্দরী?’

‘আমার নাম জুলি’।

‘তোমাকে যে দিয়ে গেল সে বলেছে, তুমি নাকি পাথর গলাতে পার। আমি তোমার সে যোগ্যতা যাচাই করতে চাই।’

‘কে সে পাথর?’

‘মিসরের নতুন গভর্ণর। যিনি একই সাথে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও।’

‘সালাহুদ্দীন আইয়ূবী?’

‘হ্যাঁ, যদি তাকে বশে আনতে পার তবে তার ওজন সমান সোনা তোমার পুরষ্কার।’

‘তিনি কি মদ পান করেন?’

‘না, মুসলমান শূকরকে যেমন ঘৃণা করে, সে মদ, নারী, নাচ, গান এবং ভোগবিলাসকে তেমনি ঘৃণা করে।’

‘শুনেছি আপনার কাছে এমন সব যুবতী রয়েছে যাদের দেহের যাদু নীল নদের স্রোতকেও রুদ্ধ করে দিতে পারে। ওরা কি ব্যর্থ?’

‘এখনও পরীক্ষা করে দেখিনি। আমার বিশ্বাস তুমি এ কাজ করতে পারবে। সালাহুদ্দীনের বিশ্বাস এবং চরিত্র সম্পর্কে আমি তোমাকে বিস্তারিত বলব।’

‘তাকে কি বিষ খাওয়াতে হবে?’

‘এখন নয়। তার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। আমি চাই সে তোমার মত রূপসীর আঁচলে বাঁধা পড়ুক। এরপর তাকে আমার পাশে বসিয়ে মদ খাওয়াব। মারতে চাইলে তোমার প্রয়োজন নেই, ঘাতক দলকে দিয়ে সহজেই তা করানো যায়।’

‘তার মানে আপনি দুশমনি নয় বন্ধুত্ব চাইছেন?’

জুকির বুদ্ধিমত্তায় নাজি কতক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

‘হ্যাঁ জুকি।’

ওর রেশম কোমল চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল নাজি, ‘আমি তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। এমন বন্ধুত্ব, যেন সে আমার কথায় উঠে এবং বসে। এর পর কি করতে হবে তা আমি জানি।’ থামল নাজি।

একটু ভেবে নিয়ে আবার বলল, ‘একটা কথা তোমাকে বলা প্রয়োজন। সালাহুদ্দীনের হাতেও একটা চাল আছে। তোমার রূপ যৌবনের ওপর তার চাল বিজয়ী হলে তুমি বাঁচতে পারবে না। সালাহুদ্দীনও তোমায় বাঁচাতে পারবে না। তোমার জীবন আমার হাতে। এ জন্যই তোমার সাথে এত খোলামেলা কথা বলছি। নইলে আমার মত জেনারেল তোমার মত এক গনিকার সাথে এভাবে আলাপ করত না।’

‘অনাগত ভবিষ্যত বলে দেবে কে ধোঁকা দেয়। এবার বলুন তার কাছে আমি পৌঁছব কিভাবে?’

‘আমি তার সম্মানে এক সংবর্ধনার আয়োজন করতে যাচ্ছি। রাতে তার শয়ন কক্ষে তোমায় ঢুকিয়ে দেব।’

‘ঠিক আছে, এর পরের কাজ হবে আমার।’