কিশোরীর চপলতা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে এসে বাসা বেঁধেছে যুবতীর লাজনম্র ভীরুতা। তাই সে এখন তাকে দেখলেই লজ্জায় আরক্তিম হয়ে ওঠে।
উসমান সব বুঝতে পারে। কিন্তু রাজ পরিবারের দিকে হাত বাড়াবার সাহস পায় না সে। সেও নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
কিন্তু এই গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টাই পরস্পরের মধ্যে আকর্ষণ আরো তীব্রতর করে তোলে। সেই আকর্ষণের টান এড়াতে না পেরে তারা গোপনে মনের ভেতর পরস্পরকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করে।
এ জাল বুনতে বুনতেই তারা একে অন্যের আরো নিকটতর হয়ে যায়। পরস্পর পরস্পরের কাছে মেলে ধরে নিজেকে। বিয়ের স্বপ্নও দেখে। কিন্তু বিয়ের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তাদের সামাজিক মর্যাদা।
আমের বিন উসমানের পক্ষে শামসুন নেছার মত বংশীয় মেয়ের আশা করাই দুরাশা। কিন্তু তবু তারা মন দেয়া-নেয়ার এ খেলা থেকে বিরত থাকার কথা কেউ চিন্তা করতে পারছিল না।
শামসুন নেছা ইয়াজউদ্দিনের অফিস থেকে বের হয়ে দেখলো আমের বিন উসমান বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শামসুন নেছা তাকে দেখে হেসে ফেলল এবং কিছু একটা ইঙ্গিত করে চলে গেল।
আমের সে ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মাথা সামান্য নেড়ে তাতে সায় জানাল। এর অর্থ হলো, সে অবশ্যই যাবে।
তারা যে জায়গাটিতে মিলিত হলো সে জায়গাটি গাছপালা ও ঝোপঝাড়ে ঢাকা। তার ওপরে রাতের অন্ধকার জায়গাটিকে ভূতুরে করে রেখেছে। আমের বিন উসমান এবং শামসুন নেছা মহলের আলো থেকে দূরে সেই নির্জন স্থানে গিয়ে বসল।
‘আজ আমি আমার মায়ের সাথে দেখা করেছি।’ শামসুন নেছা বললো, ‘এখন থেকে মায়ের সাথেই থাকবো।’
‘তোমার মা-ও শাহী পরিবারের মহিলা।’ আমের বললো, ‘তিনি তো তোমার বিয়ে কোন শাহজাদার সাথেই দিতে পছন্দ করবেন।’
‘না।’ শামসুন নেছা বললো, ‘তিনি শাহী পরিবারের মেয়ে সত্য, কিন্তু তিনি তাঁবুতে থাকতে পছন্দ করেন ও রণাঙ্গনের পাশে ক্যাম্পে থাকতে চান। তিনি আমাকেও সামরিক শিক্ষা দিয়ে বীর সেনানী বানাতে চান।’
‘তুমি কি আশা করো তোমার ও আমার সম্পর্ক এবং ভালবাসার কথা জানলে তিনি তা মেনে নিবেন?’ আমের প্রশ্ন করলো।
‘যদি আমি তার আশা পূরণ করি তবে আমার বিশ্বাস, তিনিও আমার আশা পূরণ করবেন। তার কিছু পরিকল্পনা আছে। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি আমার সহযোগিতা চেয়েছেন। আমার সাথে তোমাকেও এ কাজে সহযোগিতা করতে হবে।’ শামসুন নেছা বললো।
‘তুমি কি তাকে আমার কথা বলেছো নাকি?’
‘না।’ শামসুন নেছা উত্তর দিল, ‘তিনি শুধু আমাকে তাঁর উদ্দেশ্য বলেছেন। সেটা কার্যকর করতে তিনি আমার সহযোগিতাও চেয়েছেন। কিন্তু বিস্তারিত পরিকল্পনা ও কার্যক্রম জানার আগে তোমাকে এর গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিজ্ঞা করতে হবে। তুমি আমাকে সাহায্য করবে কি না সে ব্যাপারে কথা দিতে হবে।’
‘যদি আমি প্রতিজ্ঞা না করি এবং কথা না দেই তবে কি হবে?’ আমের হেসে বললো এবং তাকে কাছে টেনে নিল।
শামসুন নেছা আমেরের এ আকর্ষণে সাড়া না দিয়ে বরং নিজেকে একটু দূরত্বে সরিয়ে নিল। তার চেহারায় স্পষ্ট অভিমান।
আমের বিষয়টা হালকা করার জন্য বললো, ‘আমি আগেও তোমাকে বলেছি, এখনও প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাকে ছাড়া আমার দুনিয়া অন্ধকার। সুতরাং প্রতিজ্ঞা করানোর দরকার নেই, তুমি যা বলবে আমি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো।’
‘আমিও তোমাকে স্পষ্ট বলেছি, আমার বিয়ে তোমার সাথেই হবে। তোমাকে ছাড়া আমি এ জীবনে আর কাউকে গ্রহণ করতে পারবো না। তবে তার আগে আমাকে সেই কাজ সম্পন্ন করতে হবে, যে কাজ মা আমাকে দিয়েছেন। আর তুমি এর গোপনীয়তা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি না দেয়া পর্যন্ত তোমাকে আমি সে বিষয়ে কিছুই বলবো না।’
আমের বিন উসমান শামসুন নেছার এ কোথায় একটু আহত এবং আশ্চর্য হলো। এমন শর্ত তো সে কোনদিন আরোপ করেনি! কি এমন কথা, যা শপথ না করলে বলা যায় না!
সে চমকে গিয়ে বললো, ‘তোমার অন্তরে কি আমার ভালবাসা নিয়ে এখনো সন্দেহ রয়ে গেছে শামছি? এতদিনেও তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না! মুখের হলফ কি অন্তরের ভালবাসার চেয়েও শক্তিশালী?’
‘কাজটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, আমার জীবনের চাইতেও তাকে অধিক মূল্যবান মনে করি। এই গুরুত্ব বুঝানোর জন্যই আমি শপথ নেয়া জরুরী মনে করেছি।’
শামসুন নেছা আবেগভরা কণ্ঠে বললো, ‘আমি আমার মায়ের আদেশে জান দিয়ে দেবো, যদি তুমি সাথে না থাকো তবুও।’
‘আমিও তোমার ভালবাসার খাতিরে জীবন দিয়ে দেবো, যদি তুমি আমাকে সাথে না নাও তবুও।’
‘না।’ শামসুন নেছা বললো, ‘ভালবাসার জন্য নয়, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য। তবে এই ইসলামের জন্য নয়, যে ইসলাম আমরা এ মহলে দেখছি।
আমি সেই ইসলামের কথা বলছি, যে ইসলামের জন্য আমার মহান পিতা কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাঁর জীবন শেষ করে গেছেন আর যে ইসলাম রক্ষার জন্য সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এখনো লড়ছেন।’
‘আমি কোরআন ছুঁয়ে শপথ নেবো, আমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হবে আমি সে দায়িত্ব জীবন বাজি রেখে পালন করে যাবো।’
আমের বিন উসমান শামসুন নেছার হাত নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললো, ‘যদি আমি শপথ ভঙ্গ করি বা শপথের বিরুদ্ধে কোন কাজ করি তবে তুমি আমাকে হত্যা করে আমার লাশ কুকুর শৃগালকে দিয়ে দেবে। এখন বলো আমাকে কি করতে হবে?’
‘গোয়েন্দাগিরি।’ শামসুন নেছা বললো, ‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মিশরে আছেন। তিনি এই ভরসাতেই সন্তুষ্ট আছেন যে, তিনি আমার ভাই আল মালেকুস সালেহের সাথে যে বন্ধুত্ব ও চুক্তি করেছিলেন তা অটুট আছে।
আমার ভাই মারা গেছেন। এখন সে চুক্তি ঠিক আছে কিনা সে বিষয় তুমি আমার চেয়ে ভাল জানো। বর্তমান হলব সরকারের ওপর খৃস্টানদের প্রভাব আছে কিনা জানতে হবে আমাদের।
ইয়াজউদ্দিনকে সুলতান সালাহউদ্দিন নিজের বন্ধু জানেন। কিন্তু আম্মাজান সে বিষয়ে শংকা বোধ করছেন।’
‘আমার মালিক তোমার মাকে বিয়ে করার পর তো তেমন আশংকার কোন কারণ দেখি না। তিনি তো এজন্যই তোমার আম্মাকে বিয়ে করেছেন, যাতে ইসলামী জগতের সাথে তার সম্পর্ক আরো অটুট হয়।’ আমের বললো।
‘বাহ্যতঃ জগত তাই মনে করবে। কিন্তু বস্তবতা অন্য রকম মনে হচ্ছে বলেই তো ভয় পাচ্ছি। সমস্যা তো এই বিয়ে থেকেই শুরু হয়েছে।’
আমের কিছুটা অবাক হয়ে বলল, ‘সেটা কি রকম?’
শামসুন নেছা বললো, ‘ইয়াজউদ্দিন মাকে বন্দী করার কৌশল হিসাবে এ বিয়ে করেছেন। আম্মা যাতে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সহযোগিতায় আর কখনো এগিয়ে যেতে না পারেন সে জন্য বিয়ের ছলে মাকে আসলে এ মহলে বন্দী করা হয়েছে।’
‘কি অবাক করা কথা বলছো তুমি?’
‘হ্যাঁ, অবাক করা কথাই বটে। ইয়াজউদ্দিন শুধু এ জন্যই মাকে বিয়ে করেছেন, যাতে দামেশকের জনগণ তার সঠিক নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। আম্মা কার্যত এখানে বন্দী। মহলের একটি নির্দিষ্ট অংশে তাকে থাকতে দেয়া হয়েছে, কিন্তু মহল ঘুরে দেখার অনুমতিটুকু পর্যন্ত ইয়াজউদ্দিনের কাছ থেকে পাননি আম্মা।’
‘বলো কি!’ বিস্মিত আমের বিন উসমান বললো, ‘তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো তো!’
‘আমি কি বলছি আমি ভাল করেই জানি। ইয়াজউদ্দিন এখানে ষড়যন্ত্রের বিশাল ফাঁদ পেতে বসেছে। কিন্তু সে কি করতে চাচ্ছে এবং কতদূর এগিয়েছে, আমরা এখনো তা জানি না।’
আমের বিন উসমান কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে রইল। এ ধরনের কোন দুঃসংবাদ শোনার জন্য সে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। এ খবর তাকে হতবুদ্ধি করে ফেলল।
সে সহসা বলে উঠল, ‘তাহলে এখন উপায়? এ অবস্থায় আমরা কতটুকু কি করতে পারবো? তোমার আম্মা এ নিয়ে কি চিন্তা করেছেন?’
‘এ মহলের গোপন তথ্য উদ্ধার করে সে তথ্য কায়রো পৌঁছাতে হবে। আর এটাও আমাদের জানতে হবে, খৃস্টানরা কি গোপন দুরভিসন্ধি নিয়ে ইয়াজউদ্দিনের সাথে হাত মিলিয়েছে? তারা কি আবারও আমাদের ঐক্যবদ্ধ সেনাদলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে গৃহযুদ্ধের সূচনা করতে চায়? তারা কি কোন বড় আকারের যুদ্ধ বাধানোর গোপন প্রস্তুতি নিচ্ছে?
তুমি এমন এক স্থানে আছো যেখানে বসে তুমি সবদিকেই নজর দিতে পারবে। আজ থেকে তুমি ভুলে যাও, তুমি ইয়াজউদ্দিনের রক্ষী দলের কমান্ডার। তুমি ইসলামের এক বীর সৈনিক, সকাল সন্ধ্যা প্রতিটি মুহূর্ত এ অনুভুতি নিয়েই এখন থেকে তোমাকে কাজ করতে হবে।’
‘হ্যাঁ, আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি।’ আমের বিন উসমান বললো, ‘তুমি ঠিকই বলেছো, আমি এমন স্থানে আছি যেখানে বসে আমি সব কিছুই দেখতে পাই।
শামছি! আমি যা দেখে আসছি এবং এখনও দেখছি, সেদিকে আমি কোনদিনই খেয়াল করিনি। আমি একজন মর্দে মুজাহিদ ছিলাম, আর এখন একজন চাকুরীজীবী হয়ে গেছি। যখন সৈনিক মুজাহিদ থেকে চাকরিজীবী হয়ে যায় তখন তার দশা এমনই হয়।
এই মহলে আমার চোখের সামনে কত বিচিত্র ঘটনা ঘটছে, অথচ আমি তার কিছুই দেখতে পাইনি।
সৈন্যদের চাকরীর প্রয়োজন আছে। কিন্তু সে চাকরী বাঁচাতে যখন সে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বাদ দেয় তখন তাকে গ্রাস করে নানা রোগ। তখন সে তোষামোদকারী হয়ে যায়। উপরওয়ালাকে খুশী করতে ও তার কাছ থেকে বখশিশ নিতে গিয়ে সে আর সৈনিক থাকে না, পদোন্নতির আশায় সে হয়ে পড়ে চাটুকার।
যুদ্ধ ও তোষামোদকারীর মধ্যে এত পার্থক্য, যেমন পার্থক্য জয় ও পরাজয়ের মধ্যে। আমাকে একথা কেউ বলেনি যে, সৈন্যদের শুধু বাইরের শত্রুর সাথেই যুদ্ধ করতে হয় না, ঘরের, এমনকি অন্তরের শত্রুর সাথেও যুদ্ধ করতে হয়।’
‘তুমি ঠিকই বলেছো, এটাও সৈনিকের দায়িত্ব। যখন কোন সরকার জাতি ও দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়, দেশের স্বাধীনতাকে হুমকির সম্মুখীন করে তোলে, তখন তার বিরুদ্ধে সিপাহী বিপ্লব করে সেই গাদ্দার সরকারকে নির্মূল করে দেশের স্বাধীনতাকে হেফাজত করা।
সেনাবাহিনী সরকারের নয়, দেশপ্রেমিকের জনতার। তাদের দায়িত্ব দেশের অস্তিত্ব রক্ষা করা, সৈন্যদের কখনো এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।’
আমের বিন উসমান শামসুন নেছার হাত চেপে ধরে বললো, ‘ব্যস আর বলতে হবে না। তুমি আমাকে আমার আসল দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছো। তুমি আমার চোখের পর্দা সরিয়ে দিয়েছো। এখন আমাকে বলো, কাউকে হত্যা করতে হবে, নাকি শুধু গোপন তথ্য উদ্ধার করার মধ্যেই আমার কাজ সীমাবদ্ধ রাখবো।’
‘প্রয়োজন হলে আমাদের দুটি কাজই করতে হবে।’ শামসুন নেছা উত্তরে বলল, ‘গোপন তথ্য নিতে গিয়ে যদি কোন গাদ্দারকে হত্যা করতে হয়, তাও করতে হবে।’
‘শোন শামছি।’ আমের বিন উসমান বললো, ‘আমি এখন আর চাকরের মত কথা বলবো না, একজন মুজাহিদের মত কথা বলবো। গোপন কথা হলো, হলব এখন খৃস্টানদের জালে বন্দী।
ইয়াজউদ্দিন যদি সুলতান আইয়ুবীর বন্ধুও হন এবং নিজে ইসলামের পক্ষেও হন তবুও তিনি হলবের সেনাদলকে মিশরের সৈন্য দলের ঐক্যজোটে শামিল করাতে পারবেন না। কারণ তাঁর গভর্নর, উজির, উপদেষ্টা এমন কি সেনাপতিরাও খৃস্টানদের কাছে ঈমান বিক্রি করে বসে আছে। এরা তোমার ভাই মারা যাওয়ার আগেই ঈমান বিক্রি করেছিল, ইয়াজউদ্দিন ক্ষমতা গ্রহণের পরও তারা গাদ্দারই রয়ে গেছে।’
আমের বিন উসমান আরো বললো, ‘তারা সরকারী কোষাগার শূন্য করে ফেলেছে। দেশের অর্থ, সোনা দানা সব উধাও করে দিয়েছে।’
‘আমার ধারণা, এটাও ষড়যন্ত্রকারীদেরই কাজ। তারা দেশকে দেউলিয়া করে ইয়াজউদ্দিনকে বাধ্য করবে খৃস্টানদের কাছ থেকে অর্থ ঋণ নিতে।’
‘ইয়াজউদ্দিন নিজের গদি রক্ষার জন্য যে যা চাচ্ছে, তাই দিয়ে দিচ্ছেন।’
‘এতে প্রমাণিত হয়, ইয়াজউদ্দিন এক দুর্বল ও অযোগ্য শাসক।’ শামসুন নেছা বললো।
‘তুমি ঠিকই বলেছো। তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, তিনি গদি আঁকড়ে থাকতে চান। যে কোন মূল্যে গদি ধরে রাখার জন্যই তিনি এভাবে বেহিসাবী খরচ করছেন।’
আমের বিন উসমান আরো বললো, ‘আমি তাঁর যে বক্তব্য শুনেছি তাতে বলতে পারি, তিনি তাঁর গদী টিকিয়ে রাখার জন্য খৃস্টানদের সঙ্গে মিতালী করতে মোটেই দ্বিধা করবেন না। আমি এখন থেকে তাঁর ও তাঁর সভাসদবর্গের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবো এবং তোমাকেও সে কথা বিস্তারিত জানাবো।’
‘এ কথা কিন্তু সব সময় খেয়াল রাখবে, এ মহল ও তাঁর আশেপাশে খৃস্টানদের গোয়েন্দারা সারাক্ষণ তৎপর আছে।’
শামসুন নেছা বললো, ‘এখানে আমাদের গোয়েন্দারাও নিশ্চয়ই কাজ করছে। কোনদিন তাদের সঙ্গেও তোমার সাক্ষাত হয়ে যেতে পারে।’
শামসুন নেছা একটু হেসে বললো, ‘তোমার সুদানী পরী কি অবস্থায় আছে? সে কি এখনও তোমার সাথে দেখা করে?’
‘হ্যাঁ, সে দেখা করে।’ আমের বিন উসমান বললো, ‘সে আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। গত পরশু সে দেখা করে কেঁদেই ফেললো। বললো, ‘একবার আমার কামরায় আসো না।’
‘শামছি, আমি অই মেয়েকে বড্ড ভয় পাই। তুমি জানো, তার সৌন্দর্যে জাদু আছে। তার যাদুতে যে একবার পড়েছে সে আর বের হতে পারে না। আমি তাকে এ জন্য ভয় পাই না যে, সে খুব সুন্দরী এবং আমার উপর ভীষণ আকৃষ্ট। সে আমাকে তার জালে আটকে ফেলবে এ ভয়েও ভীত নই আমি।’
‘তাহলে তাকে নিয়ে তোমার কিসের ভয়?’ শামসুন নেছা জানতে চাইল।
‘তাকে নিয়ে ভয় হলো, সে হলবের বাদশাহ ইয়াজউদ্দিনের হেরেমের মূল্যবান হীরা। মহলের ভেতরে সবাই তাকে সুদানী পরী বলে ডাকে।
যদি ইয়াজউদ্দিন বা তাঁর সভাসদরা জেনে যায়, মেয়েটি আমাকে চায়, তবে মেয়েটিকে তারা কিছুই বলবে না। সোজা এসে আমার ঘাড় মটকে ধরবে। আমাকে কারাগারের গোপন কক্ষে রেখে এমন কঠিন শাস্তি দেবে যা শুনলেই তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবে।
আবার ওকে যদি আমি সরাসরি নিরাশ করি তবে তাঁর প্রতিহিংসার শিকার হতে হবে আমাকে। সে আমার চরিত্রের ওপর দোষ দিয়ে আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে দ্বিধা করবে না।’
‘সে তো জানে না যে, তুমি আমাকে ভালবাসো এবং আমাদের সাক্ষাতও হচ্ছে?’ শামসুন নেছা জিজ্ঞেস করলো।
‘সে এ কথা জানতে পারলে আমাদের দু’জনের ভাগ্যে কি ঘটবে তা আমি কল্পনাও করতে পারি না।’ আমের বিন উসমান বললো, ‘এ মেয়ে কতটা হিংস্র আর ক্ষমতাধর তুমি জানো না, এ মেয়ে আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না।’
এ মেয়ের নাম উনুশী। খৃস্টানদের উপঢৌকন হিসাবে সে হলবে এলেও সে এক ইহুদী কন্যা। মহলে যখন এ মেয়ে প্রথম আসে তখন আল মালেকুস সালেহ অসুখে পড়ে মারা যায়।
ইয়াজউদ্দিন হলবের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করলে সে ইয়াজউদ্দিনের সম্পত্তি হয়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যেই এ মেয়ে ইয়াজউদ্দিনকেও কব্জা করে ফেলে।
সে যুগে নিয়ম ছিল, রাজ মহলে শাসকের স্ত্রীদের জন্য পৃথক স্থানে খাস কামরা থাকতো আর অবিবাহিত বাদী দাসীদের জন্য থাকতো আলাদা অন্দর মহল।
খৃস্টান এবং ইহুদীদের মত মুসলমান শাসকদের চরিত্র নষ্ট করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের পাঠিয়ে দিত মুসলিম শাসকদের অন্দরে। তারা মুসলমান শাসক গোষ্ঠীকে ধ্বংসের অতল তলে পৌঁছে দিত।
খৃস্টান এবং ইহুদীরা একই পদ্ধতি অবলম্বন করতো মুসলিম আমীর ওমরা ও সেনাপতিদের চরিত্র নষ্টের জন্যও। তাদের কাছেও সুন্দরী মেয়েদের তারা উপঢৌকন হিসেবে পাঠাতো।
সে মেয়েদের কাজ ছিল প্রভুকে খুশী করে গোপন তথ্য সংগ্রহ করা এবং তা যথাসময়ে যথাস্থানে পাঠিয়ে দেয়া।
এক মুসলমানের সাথে অপর মুসলমান আমীরের ঝগড়া বিবাদ বাঁধানো, নিজের মুনীবকে খৃস্টানদের অনুগত বানানোসহ নানা রকম অপকর্মের কৌশল শিক্ষা দিয়ে তাদের পাঠানো হতো মুসলিম এলাকায়।
উনুশী এমনি এক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়ে। সে ইয়াজউদ্দিনের মহলের মেহমানদের মদ পান করাতো। সে নিজেও তাদের সাথে মদ পান করতে অভ্যস্ত ছিল।
সে ইয়াজউদ্দিন ছাড়াও হলবের দু’জন বিশিষ্ট সভাসদকে তার রূপের জালে বন্দী করে ফেলেছিল। তারা হলবের ভাগ্যকে ভাঙতেও পারতো, গড়তেও পারতো। তাদের সহায়তায় উনুশী ইয়াজউদ্দিনের চরিত্রই কেবল নয় তার উদ্দেশ্যও কলুষিত করতে সফল হয়েছিল।
মেয়েটির সর্ব শরীরে ছিল পাপের আবেদন। আমের বিন উসমান ইয়াজউদ্দিনের দেহরক্ষী দলের কমান্ডার হওয়ার সুবাদে সব সময় তার কাছাকাছিই থাকতো।
এ যুবকের দৃষ্টি ছিল ঈগল পাখীর মতো সুদূরপ্রসারী, চালচলন ছিল ক্ষিপ্র। উনুশী যখন তাকে দেখল তখনই এ সুদর্শন যুবক তার দৃষ্টিতে আটকে গেলো। সে তাকে পাওয়ার জন্য এবং তাকে নষ্ট করার জন্য পিছু লেগে গেল।
কিন্তু আমের বিন ছিল হুশিয়ার যুবক। শামসুন নেছাকে সে ভালোবাসতো। তাই সব সময় সে উনুশীর নাগালের বাইরে থাকার চেষ্টা করতে লাগলো।
সে ভালমতই জানতো, এই হেরেমের হীরা মুক্তা শুধু তার মনীবদের জন্য। এদের দিকে দৃষ্টি দেয়া আর মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো একই কথা। এদের সাথে কথা বলার বিষয়টিও কেউ লক্ষ্য করলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ।
উনুশী মাঝে মধ্যে আমের বিন উসমানের সাথে সাক্ষাত করে তাকে প্রলুদ্ধ করার চেষ্টা করতো। আমের নানা অজুহাতে তাকে সরিয়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করতো।
‘আমি তো শুধু এই মহলের চাকর মাত্র।’ আমের একদিন তাকে বললো, ‘যদি তোমার অন্তরে আমার জন্য ভালবাসা জন্মে থাকে তবে আমার প্রতি দয়া করো ও আমার কাছ থেকে দূরে থাকো।’
‘কে বলেছে তুমি এক চাকর! তুমিই তো এ মহলের সেরা তীর। তুমি বাদশাহর রক্ষীদলের কমান্ডার, তোমার পদমর্যাদাই বা কম কিসে।’
‘তবু তোমার দিকে আমার চোখ তুলে তাকাবারও অধিকার নেই।’
উনুশী তাকে বললো, ‘এক সময় সুযোগ করে আমার কামরায় এসো, অধিকার আমি নিজের হাতেই তোমার কাছে তুলে দেবো।’
এই মেয়ে ইয়াজউদ্দিনকে নানা শলাপরামর্শ দিয়ে তার মাথাটা বিগড়ে দিয়েছিল। মেয়েটি তার মনে প্রচণ্ড ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল সুলতান আইয়ুবী সম্পর্কে।
মেয়েটির প্ররোচনায় ইয়াজউদ্দিনের মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, হলবের প্রতি সুলতান আইয়ুবীর নজর পড়েছে। হয়তো শীঘ্রই তিনি হলব অধিকার করে নেবেন।
ইয়াজউদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর সাথে প্রকাশ্যে যুদ্ধে জড়াতে ভয় পাচ্ছিলেন। তিনি তার এক যোগ্য ও সাহসী সেনাপতি মুজাফফরুদ্দিন কাকবুরীর সঙ্গে এ নিয়ে পরামর্শ করলেন। তিনি তার অন্তরের সাত পর্দার অন্তরালে ঢাকা গোপন রহস্য ও তথ্য তুলে দিলেন কাকবুরীর হাতে।
ইয়াজউদ্দিনের হলবের দায়িত্ব গ্রহণের পর মুশেলের শাসন কাজ চালানোর জন্য তিনি তার ভাই ইমাদউদ্দিনকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। ইমাদউদ্দিন প্রকাশ্যেই সুলতান আইয়ুবীর বিরোধী ছিলেন।
কয়েকদিন পর এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটলো। কার পরামর্শে এবং কিভাবে তা ঘটলো ইতিহাসে তার কোন বিস্তারিত বর্ণনা না থাকলেও এই ঘটনা সবাইকে হতবাক করে দিল। একদিন হঠাৎ করেই পাল্টে গেল হলব ও মুশেলের ক্ষমতার দৃশ্যপট। ইয়াজউদ্দিন গিয়ে মুশেলের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করলেন আর ইমাদউদ্দিন হলবে এসে হলবের শাসনকর্তা সেজে বসলেন।
রাজ্য ও শাসন ক্ষমতার এই রদবদলে দুই দেশের জনগণের মধ্যে একটা ধাঁধাঁর সৃষ্টি করলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই পরিবর্তনের ব্যাপারে ভিন্ন মতামত ব্যক্ত করলেও নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে এর কোন কারণ দর্শাতে পারেননি।
ইয়াজউদ্দিন হলব থেকে মুশেলের কেল্লার দিকে রওনা হলে সঙ্গে তার বিবি রাজিয়া খাতুন এবং তার কন্যা শামসুন নেছাও যাত্রা করল। ইয়াজউদ্দিনের সঙ্গে এই মুশেল যাত্রায় আরো রওনা হলো তার রক্ষিতা রমনী এবং তার একান্ত নিজস্ব বিশ্বস্ত রক্ষীদল ও সে দলের কমান্ডার আমের বিন উসমান।
এ ছিল এক বিরাট কাফেলা। অনেকগুলো উটের পিঠে পালকির মত হাওদা বসানো। সে হাওদা পর্দা দিয়ে ঢাকা। তাতেই বসেছে নারীরা।
রাজিয়া খাতুন ও শামসুন নেছার উট সবার আগে। রাজিয়া খাতুনের দাসীও আছে তাদের সঙ্গে।
এক স্থানে গিয়ে রাতের মত বিশ্রামের জন্য থামলো কাফেলা। ইয়াজউদ্দিন রাজিয়া খাতুনকে বললেন, ‘তোমরা বিশ্রাম নাও। আমাকে একটু সেনাপতি ও উপদেষ্টাদের নিয়ে বসতে হবে।’
ইয়াজউদ্দিনের উপদেষ্টারা বলল, ‘আপনার খুব তাড়াতাড়ি মুশেল পৌঁছা দরকার।’
‘আমিও এ কথাই বলতে চাচ্ছিলাম।’
সেনাপতি বলল। ‘এত লটবহর ও মহিলাদের নিয়ে কাফেলা দ্রুত ছুটানো সম্ভব নয়। সৈন্যদের একটা দল নিয়ে আপনি বরং আগে চলে যান।’
এ প্রস্তাব সবারই মনপূত হলো। একজন আমীরকে দলনেতা নিয়োগ করে তিনি কাফেলা ছেড়ে এগিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে গেল একদল সৈন্য ও দু’তিন জন উপদেষ্টা।