হেমসের যোদ্ধা
জাভীরা। শত হোক, সে এক মেয়ে বৈ তো নয়! একটার পর একটা ভয় ও আতংকের স্রোত জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেলে কয়টার মোকাবেলা করবে সে? পাহাড়ে ধ্বস নামলে যেমন ছোট-বড় অসংখ্য পাথর অনবরত ছুটে আসতে থাকে, তেমনি একটার পর একটা বিপদ ক্রমাগত ছুটে আসতে লাগল তার দিকে। সেই বিপদ দেখে ভয়, শংকা ও ত্রাসের স্রোতে হাবুডুবু খেতে লাগল জাভীরা।
জাভীরার ঝড়ের আতংক হারিয়ে গিয়েছিল প্লাবনের বিভীষিকা দেখে। প্লাবনের ভয় হারিয়ে গেল যখন অচেনা বিধর্মী যুবকের হাতে লাঞ্ছিত হবার ভয় এসে তাকে জাপটে ধরলো। সর্বনাশা স্রোত কেড়ে নিয়েছে তার উট। তার নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব ছিল যাদের, কাফেলার সেই সঙ্গীরা হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে। যে গোপন ও ভয়ংকর অভিযানে যাচ্ছিল ওরা, এখন সে অভিযানের কি হবে? কেমন করে কাদের নিয়ে সেই অভিযান সফল করবে জাভীরা?
এ সব দুশ্চিন্তা যখন ওকে দিশেহারা করে তুলছিল তখনি সেই অচেনা বিধর্মী যুবকের কাছ থেকে তার কাছে এলো নির্ভরতার আশ্বাস। সেই আশ্বাস ও ব্যবহার তাকে বলছিল, আতংক দূর করে দাও মেয়ে। একজন মুমীন কখনো অসহায় নারীর জন্য ভয় ও ত্রাসের কারণ হতে পারে না। বরং পৃথিবীর সকল অসহায় মানুষের আশ্রয় ও সহায় হয়ে দেখা দেয় একজন ঈমানদার। অতএব ভয়ের জগত থেকে বেরিয়ে এসে আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখো। ভুলে যেওনা, এই মুসলমানরা এমন সমাজ নির্মাণ করতে পারে, যেখানে মরুভূমির দুর্গম পথে কোন নারী একাকী শত শত মাইল পাড়ি দিতে পারে সম্পূর্ণ শংকাহীন চিত্তে। এটাই ইতিহাস, এটাই সত্য এবং বাস্তবতা।’
কিন্তু জাভীরা ভাবছিল, ‘এতই কি সহজ ভয় শূন্য হওয়া! একজন মানুষ বলল, তুমি ভয় শূন্য হয়ে যাও আর তাতেই ভীত লোকটির অন্তর থেকে সব ভয় পালিয়ে যাবে? মানুষ কি এতই বিশ্বাসযোগ্য? এই আশ্বাসের মধ্যে প্রতারণা নেই, ছলচাতুরি নেই, কে এমন নিশ্চয়তা দেবে?’
যুবকের আশ্বাস পেয়ে ভাবছিল জাভীরা, আমার অন্তর কি এই যুবকের ভালমানুষী চেহারা দেখে সত্যি সত্যি ভয় শূন্য হতে পেরেছে? না, বরং সে অনুভব করলো, ভয় ও আতংকের একটার পর একটা ঢেউ এখনো আছড়ে পড়ছে তার জীবনে।
মুসলিম যুবকের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ভয় কেটে যেতেই অন্য ভয় এসে বাসা বাঁধলো তার মনে। এমন কি হতে পারে না, লোকটি বড় অর্থলোভী? অনেক টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়ার মানসেই এ যুবক আমাকে এভাবে আগলে রাখছে? এ কথা মনে হতেই জাভীরার মন বিক্রি হয়ে যাওয়ার পরবর্তী জীবনের কথা ভেবে শিউরে উঠল। সেই অনাগত ও অনিশ্চিত জীবনের পদে পদে সে অনুভব করলো হাজারো বিপদ তার জন্য ওঁৎ পেতে আছে।
দুর্যোগের রাতটি তারা কাটিয়ে দিল পাহাড়ের এক গুহায়। জাভীরার মনে পড়লো, রাতে যুবককে হত্যা করার একটি ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছিল সে। কিন্তু অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল যুবক।
জাভীরার হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর চরম উৎকণ্ঠা পেয়ে বসেছিল তাকে। ভেবেছিল, এ রাতই তার জীবনের শেষ রাত। আর কোন দিন সে এ পৃথিবীর আলো বাতাস দেখতে পাবে না। কাল ভোরেই তার এ সুন্দর দেহ আর কমনীয় শরীর খুবলে খাবে শেয়াল শকুন।
খুনীকে কি কেউ ক্ষমা করে? কেন করবে? তাকে বাঁচিয়ে রাখার কি দায় ঠেকেছে এই মুসলিম যুবকের যে মেয়ে একবার তাকে খুন করার চেষ্টা করেছে, সুযোগ পেলে সে মেয়ে আবার তাকে খুন করার চেষ্টা করবে না, এমন নিশ্চয়তা তাকে কে দিয়েছে? যুবকের নিরাপত্তার সহজ পথ হচ্ছে প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করে দেয়া। যুবকটি কি শেষ পর্যন্ত তাই করবে?
এ প্রশ্ন মনে উদয় হতেই মৃত্যু ভয় মেয়েটির চেহারা আবার বিবর্ণ করে দিল। জাভীরা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, ‘মরতে যদি হয়-ই তবে এ যুবককে ছেড়ে দিয়ে লাভ কি? ওকে সঙ্গে নিয়েই আমি মরবো।’
তানভীরকে খুন করার অদম্য ইচ্ছা ও বাসনা নিয়েই জাভীরা চুপচাপ বসেছিল গুহার ভেতর। কিন্তু কখন ঘুম এসে তাকে কাবু করে ফেলল সে টেরই পায়নি। যখন ঘুম ভাঙল, তখন সকাল হয়ে গেছে।
পাহাড়ের গুহায় সেই মুসলিম যুবকের সাথে তার প্রথম রাতটি শেষ হয়ে গেল। ভোরে যখন তার ঘুম ভাঙল সে এই ভেবে অবাক হলো, যুবক তানভীর তাকে তো খুন করেইনি, এমনকি তার এমন আকর্ষণীয় দেহ এবং লোভনীয় শরীরের প্রতিও কোনরূপ খেয়াল করেনি। এ কি কোন নির্বোধ আহাম্মক! নাকি অনুভূতিহীন কোন কাপুরুষ! তানভীরের কাণ্ড দেখে এ প্রশটাই প্রথম তার মনে জাগলো।
পূর্বাকাশে রাঙা সূর্য উঠল। সূর্যের রোদ গুহায় ঢুকল না বটে, তবে তার আলোয় গুহা এবং তার আশপাশের এলাকা আলোকিত হয়ে উঠলো। ভোরের সেই স্নিগ্ধ আলোর দিকে তাকিয়ে চেতনার কোন অতল তলে হারিয়ে গেল জাভীরা, সে নিজেও তা টের পেলো না। ভোরের সেই স্নিগ্ধ আলোর দিকে তাকাতেই তার সমস্ত ক্লান্তি, অবসাদ ও অচেনা যুবকের লাঞ্ছনার ভয় সব যেন দূর হয়ে গেল। এতক্ষণ সে যাকে অনুভূতিহীন এক কাপুরুষ যুবক মনে করছিল, সেই যুবকের দিকে বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জাভীরা।
তানভীরের ঠোঁট নড়ছে। জাভীরার মনে হচ্ছে, এ লোক সরাসরি আল্লাহর সাথে আলাপ করছে। জাভীরার মনে পড়লো, তানভীর বলেছিল, খোদা শুধু তাকেই সাহায্য করেন, যার নিয়ত ও মন পবিত্র। তাহলে কি এই সে পবিত্র লোক। নাকি এ লোক মানুষ নয়, কোন ফেরেশতা মানুষের রূপ ধরে এসেছে তাকে বাঁচাতে! এ সব ভাবতে ভাবতে জাভীরার অসীম মুগ্ধতা আছড়ে পড়লো তানভীরের সেই প্রার্থনারত ঠোঁটের ওপর।
নিজের জীবনের কথা মনে পড়লো তার। ভেবে দেখলো, নিজের দেহটাই কেবল অপবিত্র নয়, অপবিত্র তার ইচ্ছা এবং নিয়তও। তাই তো তানভীরের মত সুন্দর যুবকদের প্রতারিত করার চেষ্টাতেই কেটে যায় তার সকাল ও সন্ধ্যা।
জাভীরা রাতে এটাও চিন্তা করে রেখেছিল, যদি কোন অলৌকিক কারণে সে যুবককে হত্যা করতে না পারে বা যুবকের হাতে সে নিহত না হয় তবে সে যুবকটিকে রূপের ফাঁদে আটকে ফেলবে। যদি সকাল পর্যন্ত যুবক নিজে তার রূপের সাগরে ঝাঁপ না দেয় তবে সকালে সে নিজেই উদ্যোগ নেবে যুবককে তার প্রেমের শেকলে বন্দী করার। সে তার রূপ ও যৌবন যুবকটিকে দান করে বলবে, ‘এর বিনিময়ে আমাকে হেমসে পাঠিয়ে দাও।’
জাভীরা জীবনে এই প্রথম তার সংকল্প পরিত্যাগ করলো। সে অনুভব করলো, তার সাথে কেবল একটা শরীর নয়, আত্মা এবং বিবেকও আছে। যদিও সে আত্মা পাপ পংকিলতায় ভরা, কিন্তু আত্মার তো একটা মানবিক চাহিদাও আছে! বিবেক তো সত্যকে অস্বীকার করতে পারে না। এই যুবক যে মহত্ব ও মহানুভবতা দেখালো তা তো মিথ্যে নয়!
জাভীরা নিজের জীবন ও আচরণের কথা মনে করে খুবই লজ্জা অনুভব করতে লাগলো। তানভীরকে এখন সে আর দশজন মানুষের মত কোন সাধারণ মানুষ ভাবতে পারছে না। তার দৃষ্টিতে সে এখন ফেরেশতার মত মহান। সে তাদেরই একজন, যে মানুষ স্বয়ং আল্লাহর সাথে কথা বলতে পারে।
মেয়েটি এসব ভাবছিল আর তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। যতই তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ছিল ততই সে অনুভব করছিল, তার হৃদয়ের পাষাণভার হালকা হয়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছিল, তানভীরের অস্তিত্বের মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দিতে পারলেই সে পরিপূর্ণ শান্তি ও তৃপ্তি পাবে।
নামাজ শেষে তানভীর দোয়ার জন্য হাত উঠালো। তার ধারণা ছিল, জাভীরা ঘুমিয়ে আছে। এই নির্জন কক্ষে সে ছাড়া আর কেউ জেগে নেই। তাই সে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো, “হে মহান প্রভূ। তুমি আমাকে পাপের পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র রাখো। আমাকে পবিত্র থাকার চেতনা ও ক্ষমতা দান করো। আমার আত্মাকে পরিশুদ্ধ রাখো এবং যে আমানত তুমি আমার হাতে সোপর্দ করেছে খেয়ানত ছাড়াই তাকে ঠিকানায় পৌঁছে দেয়ার শক্তি দাও। হে আল্লাহ! আমার অন্তরে সেই ভয় পয়দা করে দাও, যে ভয় এক সুন্দরী যুবতীর রূপ ও যৌবনের প্রলোভনকে উপেক্ষা করে তোমার পথে টিকে থাকতে পারে। প্রভু হে, আমি তোমার এক অবুঝ ও দুর্বল বান্দা। তুমি আমাকে সেই শক্তি দান করো, যেনো আমি শয়তানের শয়তানী ও কুমন্ত্রণার সাথে লড়াই করে তোমার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমার মর্যাদা রক্ষা করতে পারি।’
তানভীর ফেরেশতা নয়, সে মানুষ। মানুষের কুপ্রবৃত্তি, লোভ লালসা, মোহ, দুর্বলতা সবই তার মধ্যে ছিল। কিন্তু ঈমান এমন এক জিনিস, যা মানুষকে এসব দুর্বলতা থেকে বাঁচিয়ে রাখে। আল্লাহর ভয়, পরকালের ভয় মানুষকে পশুত্ব ও বর্বরতা থেকে রক্ষা করে। এই মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তানভীর সেই শক্তিই সঞ্চয় করছিল। সততা ও দায়িত্বশীলতার বর্ম দিয়ে আবৃত করছিল নিজেকে।
দোয়া শেষ করে প্রশান্ত মনে উঠে দাঁড়াল তানভীর। ঘুরে জাভীরার দিকে তাকাতেই দেখলো, জাভীরা নির্ণিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।
কি কারণে মেয়েটি কাঁদছে জানে না তানভীর। সে কি পিতৃ হারানোর শোকে! অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায়! যে কারণেই কাঁদুক, তানভীর ওকে বিরক্ত না করে চুপচাপ থাকার সিদ্ধান্ত নিল।
জাভীরাও তেমনি। অপলক চোখে কেবল তাকিয়েই রইলো, কোন নড়াচড়া করলো না। কোন কথাও বললো না। একটু পর। তানভীর জাভীরাকে বললো, বাইরে যাও। বাইরে পরিষ্কার পানির ঝরনা আছে, তাতে হাত মুখ ধুয়ে এসো।
তানভীর তার মাথায় জড়ানো পাগড়ি খুলে জাভীরার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, “এটা নাও। ভাল করে মুখ-হাত ধোও। তোমার চুলে এখনো কাদামাটি লেগে আছে, ওগুলো পরিষ্কার করো। আমি তোমাকে তোমার সাবেক চেহারায় তোমার আত্মীয়দের হাতে তুলে দিতে চাই, যেমনটি তুমি দুর্যোগের আগে ছিলে।’
জাভিরা তার হাত থেকে কাপড়টা নিয়ে এমন ভঙ্গিতে বের হয়ে গেল, যেন কোন শিশু গুরুজনের আদেশ পালন করছে।
তানভীরের কাছে খাবার ও পানীয় যা কিছু ছিল সেগুলো ঘোড়ার জিনের সাথে বাঁধা ছিল। এখন ঘোড়াও নেই, কোন খাবার বা পানীয়ও নেই। তাই সে চুপচাপ জাভীরার ফিরে আসার অপেক্ষায় বসেছিল।
জাভীরা ফিরে এলো। তানভীরের কথামত ভাল করে মাথা ও মুখমন্ডল ধুয়ে এসেছে সে। একটু আগে জাভীরার চুল মাটি ও কাদায় জট পাকিয়েছিল। চেহারার অবস্থাও ছিল তথৈবচ। এখন শিশির ধোয়া ফুলের মতই সজীব ও প্রাণবন্ত চেহারা নিয়ে ফিরে এসেছে সে।
তানভীর জাভীরার এ রূপের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলো, যেন তাকে চিনতেই পারছে না। মনে মনে হোঁচট খেল সে। এ যেন যাদুর চমক। এত তাড়াতাড়ি মেয়েটি শোক ও কষ্ট কাটিয়ে এমন স্বাভাবিক ও পরিপাটি হতে পারবে, ভাবতেই পারেনি তানভীর। পল্লী গ্রামের মানুষ সাধারণত এমন আকর্ষণীয় রূপ লাবন্যের অধিকারী নারীর দেখাই পায় না। কোন ধনীর দুলালীই কেবল এমন মায়াময় চেহারা ও এত আকর্ষণীয় দেহবল্লরীর অধিকারী হতে পারে। তানভীর জাভীরার এ রূপ দেখে বিস্মিত না হয়ে পারল না।
তানভীর সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বললো, ‘আমাদের হাতে খাওয়ার মত কিছু নেই। খালি পেটেই আমাদের রওনা করতে হবে। তাই আর দেরী করতে চাই না। চলো বেরিয়ে পড়া যাক।’
সে উঠার উদ্যোগ করতেই জাভীরা দু’কদম এগিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, আর একটু বসো। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই, কিছু জানতে চাই তোমার কাছে।’
তানভীর প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল। বলল, ‘বলো, কি জানতে চাও?’
‘তুমি যখন তোমার আল্লাহর সাথে কথা বলছিলে, তখন কি তুমি তাকে দেখতে পেয়েছিলে?’
‘আল্লাহকে মানুষের এই সীমিত দৃষ্টি দিয়ে দেখা যায় না।’ তানভীর বললো, ‘আমি আলেম নই, এ জন্য বলতে পারছি না, দেখা না দিয়ে আল্লাহ কেমন করে তার অস্তিত্ব প্রকাশ করেন। আমি শুধু এতটুকু জানি, আল্লাহ আমার সব কথাই শুনতে পান। তিনি আমার দোয়া শুনেছেন এবং আমার দোয়া কবুল করেছেন, তার প্রমাণ আমি বহুবার পেয়েছি।’
‘তোমার কি বিশ্বাস, চেষ্টা ও শক্তির বিনিময়ে তুমি ঝড় ও স্রোতের কবল থেকে রক্ষা পাওনি বরং তোমাকে ও আমাকে মহা দুর্যোগ থেকে আল্লাহই বাঁচিয়েছেন?’ জাভীরা প্রশ্ন করলো।
‘একশো বার।’ দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তানভীর জবাব দিল, ‘খতিব সাহেব বলেন, যত বড় বিপদই হোক, যদি কেউ মন থেকে আল্লাহর সাহায্য চায় তবে মহা বিপদ থেকেও আল্লাহ মানুষকে রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু তার চাওয়া হতে হবে আন্তরিক ও নিষ্কলুষ।’ তানভীর বললো, যদি আমি এই আশায় তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম যে, তোমার মত সুন্দরীকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যাব, তবে কাল সেই প্লাবনের সয়লাবে তোমার সাথে আমিও ডুবে মরতাম।’
‘কিন্তু আমার আত্মা তো পবিত্র নয়!’ জাভীরা দুঃখভরা কণ্ঠে বললো, ‘আমাকে আল্লাহ কেন সাহায্য করবেন? আমাকে কেন বাঁচাবেন?’
‘এই প্রশ্নের জবাব আল্লাহই ভাল জানেন। তবে হেমসে গিয়ে খতিবকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি তিনি এর কোন জবাব জানেন কিনা?’ তানভীর বললো, ‘আমার মধ্যে এত এলেম নেই যে, তোমাকে আল্লাহর সব মহিমা বুঝাতে পারবো।’
‘এই প্রশ্নের জবাব না হয় খতিবকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে। কিন্তু এটা তো বলতে পারবে, আমার মত যুবতীর এমন নজরকাড়া সৌন্দর্য আর লোভনীয় রূপ দেখেও কেমন করে তুমি এমন নির্লিপ্ত থাকতে পারলে? কেন থাকলে?’ জাভীরা প্রশ্ন করলো।
‘তুমি যা বলতে চাইছো যদি আমি তাই করতে চাইতাম, তবে আমি তোমার খঞ্জরের আঘাত থেকে বাঁচতে পারতাম না। আল্লাহ আমাকে হেফাজত করার জিম্মা নিতেন না।’ তানভীর উত্তরে বলল, ‘তুমি আমার কাছে আল্লাহর এক পবিত্র আমানত। মুসলমান রিপুর তাড়নায় আমানতের খেয়ানত করতে পারে না।’
তানভীর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল। হঠাৎ সে তার চোখ নামিয়ে নিল এবং চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘তুমি বড় বিপজ্জনক আমানত জাভীরা! তোমাকে নিয়ে আমি বড় ভয়ের মধ্যে আছি। তোমার হেফাজতের চিন্তায় আমি এমনিতেই অস্থির, দয়া করে আমাকে আর পেরেশান করো না। চলো এখন যাই।’
সে অধীর হয়ে উঠতে চাইলো কিন্তু জাভীরা তার কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘আরেকটু বসো। আমাকে বলো, আমাকে নিয়ে তোমার কিসের ভয়? তুমি কি ভাবছো আবার আমি তোমাকে আক্রমণ করবো।’
‘তাহলে তো বেঁচে যেতাম।’ তানভীর বললো, ‘তোমার শত্রুতা আমার জন্য বিপদের নয়, বিপজ্জনক হচ্ছে তোমার বন্ধুত্ব, তোমার সঙ্গ। আমাকে তোমার পাশে আর বেশীক্ষণ এভাবে আটকে রেখো না আমি ফেরেশতা নই জাভীরা, আমিও মানুষ। আমাকে এমন কঠিন পরীক্ষায় ফেলো না, যে পরীক্ষায় ফেল করলে আমার দুনিয়া আখেরাত উভয়ই বরবাদ হয়ে যাবে। আমাকে আল্লাহর কাছে নতি স্বীকার করতে দাও। তার রহমত থেকে আমাকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করো না।’
‘তোমার আল্লাহর কসম!’ জাভীরা বললো ‘আমাকেও তোমার মত বানিয়ে নাও। তোমার আল্লাহর কাছে লজ্জিত হওয়ার যোগ্য করে দাও আমাকে। তুমি কোন সাধারণ মানুষ নও, তুমি সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক উপরে। তুমি খোদার দূত! আমি জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু যারা মহান তাদের ক্ষমার শক্তি যে আমার পাপের চেয়েও বিশাল।’ জাভীরা কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল।
‘তুমি কাঁদছো কেন জাভীরা, কি জন্য কাঁদছো তুমি?’ জাভীরার কান্না দেখে অস্থির কণ্ঠে বলল তানভীর।
‘আমি জঘন্য খারাপ মেয়ে, আমি পাপিষ্ঠা। জাভীরা বললো, ‘আল্লাহ আমার প্রতি দারুণ অসন্তুষ্ট। যখন স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছিল, তখনও আমার অন্তরে আল্লাহর কথা জাগেনি। আমি আমার দেহ-সম্পদের জন্য গর্ব করতাম। জানতাম, আমার দেহে আছে অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদ যতক্ষণ আমার সঙ্গে থাকবে ততক্ষণ আমি রাজরাণী। এই দেহটাকে বাঁচাতে গিয়ে যখন আমি ব্যর্থ হলাম তখন তুমি এই দেহের ভার নিলে। আমাকে উদ্ধার করে আনলে সেই দুর্যোগের মধ্য থেকে। তাই ভয় পাচ্ছিলাম, যে কোন সময় এ দেহ তুমি দাবী করে বসতে পারো। এ ভয়েই আমি তোমাকে ছোরা নিয়ে আক্রমণ করেছিলাম। কারণ এ দেহই ছিল আমার শক্তি ও ক্ষমতার উৎস। কিন্তু আমি ব্যর্থ হলাম। স্বাভাবিকভাবেই এ ব্যর্থতার পর তুমি আমার জীবন ও দেহ চেয়ে বসলে আমার কিছুই করার ছিল না। কিন্তু তোমার আচরণ থেকে জানতে পারলাম, দেহটা মানুষ নয়, মানুষের খোলসমাত্র। আসল মানুষ বিরাজ করে অন্তরে অন্তরের সেই মানুষ মারা গেলে দেহ হয়ে যায় নিথর লাশ। তাহলে যাকে আমি অমূল্য সম্পদ জ্ঞান করতাম তা নিছক লাশ বৈ তো নয়! আমি কত মুর্খ দেখো, সামান্য একটা পচনশীল লাশের গর্বে মাটিতে আমার পা পড়তো না। কিন্তু যখন তোমার প্রার্থনা শুনলাম, তখন বুঝলাম আমি কত বড় আহাম্মক! বুঝলাম, আমি বা তুমি কিছু নই, আমাদের অতীত আমাদের নয়, বর্তমান আমাদের নয়, ভবিষ্যতও আমাদের নয়। আমরা আমাদের রক্ষা করতে জানি না। এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় নিয়ন্ত্রিত হয় আমাদের জীবন। কিন্তু সেই শক্তি কি? কোথায় এবং কেমন করে সেই শক্তির নাগাল পাবো আমি?’
‘যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই আমাদের একমাত্র রক্ষক। এ ক্ষমতা কেবল তার হাতেই নিবদ্ধ। তোমার আত্মাকে পবিত্র করো, এ শক্তি তোমার হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু আমার সারাটা জীবন কেটেছে পাপের মধ্যে, কেমন করে আমি পবিত্র হবো?’
তানভীর তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘আমাকে পরিষ্কার করে বলল, তুমি কি নর্তকী? তুমি কি কোন আমীরের হেরেমের রাণী? নাকি তুমি কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির আদরের দুলালী, জমিদারের সোহাগী কন্যা? শুনেছি এমন সব মেয়েরা খুব রূপসী হয়। তোমার মত সুন্দরী মেয়ে আমি এ জীবনে কোনদিন দেখিনি।’
জাভীরা চুপচাপ মাথা নিচু করে শুনছিল তার কথা। তানভীরের কথা শুনে তার চোখে অশ্রু এসে গেল। সে তানভীরের আরো কাছে সরে এলো। তাকে ঘনিষ্ট হতে দেখে তানভীর একটু দূরে সরে গেল। জাভীরা বললো, ‘তানভীর, আমার খুব ভয় করছে। তুমি জানো না, সেদিন ঝড়ের রূপ ধরে আমাকে গ্রাস করতে এসেছিল আমার পাপ! তোমার পবিত্র হাতের ছোঁয়া পেয়েছিলাম বলে সে যাত্রা বেঁচে গেছি। দোহাই তোমার, আমাকে বাঁচাও। তোমার কাছ থেকে আমাকে দূরে ঠেলে দিও না। ঝড়ের সময় যেভাবে আমাকে আগলে রেখেছিলে সেভাবে আমাকে আকড়ে ধরে রাখো।’
‘না!’ তানভীর সচকিত হয়ে বললো, ‘তুমি এভাবে আমার ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করো না। এতে যে কোন সময় আমি বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারি।’
‘অ, বুঝেছি। আমি পাপী বলে তুমি আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছো, যেন বিপথগামী হয়ে না যাও। স্বীকার করছি, আমি অনেক লোককে বিপথগামী করেছি। কিন্তু তখন পাপ ও পূণ্যের কোন বোধ আমার মধ্যে ছিল না।’
জাভীরা লক্ষ্য করলো, তানভীরের মধ্যে ঈমানী চেতনা প্রবল পরিমাণেই আছে, কিন্তু তার মধ্যে জ্ঞানের গভীরতা নেই। এ ধরনের লোককে বিভ্রান্ত করা খুব কঠিন কিছু নয়। জাভীরা জানে, যদি এ ধরনের লোককে একবার বিভ্রান্ত করা যায় তবে তারা সহজে সেই বিভ্রান্তি থেকে বেরোতে পারে না। আর যদি তাদেরকে কোন ছাঁচে ঢেলে সাজানো যায় তবে তারা সে ছাঁচেই চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
জাভীরা তার সাথে খোলাখুলি কথা বলা শুরু করে দিল। সে বলতে লাগলো, ‘তানভীর, তুমি জানো এ জগত সংসারে এখন আমার কেউ নেই। একমাত্র সম্বল বাবাও মারা গেলেন ঝড়ের কবলে পড়ে। এখন আমি এক অসহায়া নারী। বাঁচতে হলে আমার একটি অবলম্বন দরকার। যদি আমি তোমাকে বলি, এসো আমরা সারা জীবন একসাথে কাটাই, পরম্পর জীবন সঙ্গী হয়ে যাই, তুমি কি উত্তর দেবে?’
তানভীর তার মুখের দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞের মত একটু হাসলো। বললো, ‘সে উত্তর জানার চাইতে আগে তোমার হেমসে পৌঁছা দরকার। চলো এখন যাওয়া যাক। রোদ বেড়ে গেলে পথ চলা মুশকিল হয়ে যাবে।’
এ জবাব ভাল না মন্দ জাভীরা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। সে তার সঙ্গে উঠে যাত্রা করলো।
পাহাড়ী রাস্তা ধরে পথ চলছে ওরা। তানভীরের দৃষ্টি সামনে। জাভীরা বার বার তার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করছে তাকে। গত রাতে এ তানভীরকেই হত্যা করে হেমসে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করেছিল সে। কিন্তু আজ? আজ দিব্বি তার সাথে দ্বিধাহীন চিত্তে হেমসের পথে হেঁটে যাচ্ছে।
তানভীর খুব দ্রুত হাঁটছিল। তার সাথে তাল মিলাতে কষ্ট হচ্ছিল জাভীরার। সে তানভীরের হাত ধরে বললো, ‘এত তাড়া কেন, ধীরে চলো।’
‘আমার আস্তে চলা উচিত নয়।’ তানভীর বললো, ‘নইলে আবার রাত হয়ে যাবে।’
‘তা, রাত আসতে দাও না! জাভীরা বললো, ‘আমি এত দ্রুত হাঁটতে পারছি না।’
‘চেষ্টা করো। যখন আর হাঁটতে পারবে না তখন আমি তোমাকে আমার কাঁধে উঠিয়ে নেবো, কিন্তু চলার গতি কমাতে পারব না।’ তানভীর বললো, ‘আমার প্রচণ্ড তাড়া আছে।’
❀ ❀ ❀
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ভাই তকিউদ্দিন খৃস্টান সম্রাট বিলডনকে হিম্মত দুর্গের বাইরে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করেন। যার দরুণ হতভম্ব হয়ে বিলডনের সৈন্যেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। খৃস্টান সম্রাট বিলডন তার বিচ্ছিন্ন সেনাদলকে অতি কষ্টে একত্রিত করেন। একত্রিত করার পর তিনি বুঝতে পারলেন, তার কি পরিমাণ সৈন্য ক্ষয় হয়েছে।
তিনি দেখতে পেলেন, তার কাছে তখনো অর্ধেকের কিছু বেশী সৈন্য অবশিষ্ট আছে। তিনি এ বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন দামেশক পর্যন্ত দখল করতে। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, তার প্রায় অর্ধেক সৈন্য তকিউদ্দিনের কমাণ্ডো বাহিনীর আক্রমণে মারা গেছে, নয়তো পালিয়ে পাহাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে।
সম্রাট বিলডন পলাতক সৈন্যদের অবস্থা জানতেন না। তারা তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে দিকবিদিক ছুটছিল। মুসলিম যাযাবর ও রাখালেরা ধাওয়া করছিল সেই পলাতক সৈন্যদের। এমনকি গ্রামের সাধারণ মুসলমান যুবক বুড়ো এবং ছেলে ছোকরার দল তাদের ধরে ধরে হত্যা করছিল। কেউ ছিনিয়ে নিচ্ছিল তাদের অস্ত্রশস্ত্র, কেউ হস্তগত করছিল তাদের ঘোড়াগুলো।
সম্রাট বিলডন তার অবশিষ্ট সৈন্যদের একত্রিত করে হিম্মত দূর্গ থেকে কিছুটা দূরে এক পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান নেয়ার হুকুম দিলেন। সেখানেই তিনি খবর পেলেন তার পলাতক সৈন্যরা বিচ্ছিন্নভাবে পালাতে গিয়ে সাধারণ মুসলমানদের হাতে নিহত হচ্ছে।
পরাজিত বিলডন পরাজয়ের কারণে এমনিতেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছিলেন। এ সংবাদ পেয়ে তিনি আরো দিশেহারা হয়ে গেলেন। রাগে উন্মত্ত হয়ে তিনি সৈন্যদের আদেশ দিলেন, ‘যেখানেই মুসলমানদের গ্রাম ও বস্তি চোখে পড়বে, সেখানেই নির্বিচারে লুটতরাজ চালাবে। সুন্দরী ও যুবতী মেয়েদের লাঞ্ছিত করবে। গ্রামের বাড়িঘর ও বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দেবে।’
আদেশ জারী করেই তিনি তার বাহিনীকে একদিকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। বিলডনের পরাজিত বাহিনী ক্যাম্প গুটিয়ে রওনা হলো। পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তারা পথে যেখানেই মুসলমান বস্তি ও গ্রাম পেলো সেখানেই লুটতরাজ চালাতে লাগলো।
মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করার পর সেই গ্রামে তারা আগুন ধরিয়ে দিতো। গ্রামের নারীদের লাঞ্ছিত করতো এবং সুন্দরী ও যুবতী মেয়েদের অনেককেই ধরে নিয়ে যেতে লাগলো বাহিনীর সাথে। এতে মুসলিম জনসাধারণ তাদের উপরও মারমুখী হয়ে উঠলো। গ্রামের যুবক ও কিশোররা সেই বাহিনীর ক্ষতি সাধন করার জন্য জোট বেঁধে হামলা চালাতে লাগল। এভাবেই বিলডনের পরাজিত সৈন্যরা পথ চলছিল।
এক রাতে হেমস থেকে ছয় সাত মাইল দূরে এক জায়গায় গিয়ে রাত্রি যাপনের জন্য ক্যাম্প করলো ওরা।
বিলডন মনে মনে আশা করছিলেন, কোন খৃস্টান সম্রাট হয়তো তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবে। যদি তিনি বাইরে থেকে নতুন করে সৈন্য সহযোগিতা পান তবে তিনি ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে তকিউদ্দিনের কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে রুখে দাঁড়াবেন। তিনি আশা করছিলেন, আরেক বার তকিউদ্দিনের মুখোমুখি হলে নিশ্চয়ই তকিউদ্দিন ভড়কে যাবে। চাইকি দামেশক পর্যন্ত তার রাজ্য বিস্তারের পথও খুলে যেতে পারে।
রাতে ক্যাম্পে বসে এসবই তিনি ভাবছিলেন। তখনই তার মনে পড়লো সম্রাট রিনাল্টের কথা। সম্রাট রিনাল্ট ক্রুসেড রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এ যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। যদি সম্রাট রিনাল্টের সহযোগিতা পাওয়া যায় তবে তকিউদ্দিনকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া তেমন কঠিন হবে না ভেবে তিনি রিনাল্টের সাথে যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
❀ ❀ ❀
জাভীরার কোন সন্ধান না পেয়ে নিরাশ হয়ে বৃদ্ধ খৃস্টান ও তার সাথীরা সারা রাত পথ চলে সকালে গিয়ে হেমসে পৌঁছলো। কাফেলার অন্যরাও হেমসে পৌঁছে গেলো ওদের সাথে। কিন্তু তাদের কারো কারো গন্তব্য ছিল আরো দূরে। তারা হেমসের বাসিন্দা ছিল না, ফলে তারা হেমসে না থেমে আরও অগ্রসর হওয়ার জন্য ওদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। জাভীরার সঙ্গীরা হেমসে তাদের ঠিকানায় গিয়ে উঠল। তানভীরের ঘোড়া তাদের সাথেই ছিল। তারা ঘোড়াটি এক মসজিদের ইমামের কাছে হেফাজত রেখে বললো, ‘এ ঘোড়ার মালিক হেমসের এক যুবক। সে তুফানের মাঝে ঘোড়া থেকে পড়ে ডুবে গেছে। ঘোড়াটি কোন মতে বেঁচে গিয়ে নদীর কুলে উঠে এসেছিল। আমরা ঘোড়াটি ফেলে না রেখে নিয়ে এসেছি।’
মসজিদ থেকে ঘোড়া যখন তানভীরের বাড়ী পৌঁছলো, তখন সেখানে শোকের ছায়া নেমে এলো।
সেখানে এক ইহুদী বণিকের বাড়ী ছিল। ইহুদী বণিকটি ছিল ধনাঢ্য লোক। জাভীরার স্বঘোষিত বাবা বৃদ্ধ খৃস্টান তার সাথীদের নিয়ে সেই ইহুদীর বাড়ী গিয়ে উঠলো।
ইহুদী লোকটি তাদের সাদরে বরণ করে নিয়ে বলল, “তোমাদের সাথে তো একটি মেয়ে আসার কথা, ও কোথায়?’
বৃদ্ধ শোক প্রকাশ করে আফসোসের সাথে বলল, ‘জাভীরা উত্তাল স্রোতে ডুবে মারা গেছে।’
এ কথা শুনে সেই ইহুদী এবং উপস্থিত সকলেই আফসোস করলো। বৃদ্ধ লোকটি ইহুদীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘হেমসের মুসলমানদের অবস্থা কি? জেহাদের পক্ষে এখানে কেমন তৎপরতা চলছে?’ ইহুদী এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগেই বৃদ্ধ আবার বলল, ‘তারা কি এখানে সংকল্পবদ্ধ ও সংগঠিত হয়েছে? অস্ত্রের ট্রেনিং নিচ্ছে?’
ইহুদী বণিক উত্তরে বলল, ‘এখানকার অবস্থা খুবই খারাপ। এখানে মুসলমানদের তৎপরতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তারা যথারীতি অস্ত্রের ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এ এলাকাকে সুলতান আইয়ুবী তার কমান্ডো দলের কেন্দ্র বানিয়ে নিয়েছে। এখানকার খতিব তার জ্বালাময়ী ভাষণের মাধ্যমে মুসলমানদের উত্তেজিত করে তুলছে। লোকটাকে আমার কেবল ইমাম বলে মনে হয় না, মনে হয় এ লোক কোন সামরিক অফিসার। তার প্রতিটি কথা ও পদক্ষেপ অত্যন্ত সুপরিকল্পিত! কখন কি করতে হবে বা বলতে হবে এ কথা তিনি ভাল করেই জানেন। তিনি দক্ষ সেনা কমান্ডারের মতই প্রতিটি চাল চালছেন।’
‘যদি তাকে কৌশলে হত্যা করি তবে কি উপকার হবে মনে করেন?’ বুড়ো খৃস্টান বললো।
‘না, তাতে কোনই উপকার হবে না।’ ইহুদী বণিক বললো, বরং তাতে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। ‘মুসলমানরা এ জন্য আমাদের সন্দেহ করবে এবং আমাদের সকলকে ধরে ধরে হত্যা করবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এ এলাকায় এখনো তাদেরই শাসন জারী আছে।’
‘এখানে যেসব খৃস্টান ও ইহুদী রয়েছে তাদের মেয়েরা কি কিছুই করতে পারছে না?’ বৃদ্ধ খৃস্টান জিজ্ঞেস করলো।
‘আপনি তো ভাল করেই জানেন এমন কাজ করতে কি পরিমাণ ট্রেনিং ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়।’ ইহুদী বনিক বললো, ‘আমাদের মেয়েদের মধ্যে কেউ তেমন প্রশিক্ষণ পায়নি।’
‘আপনি কি এখানে মুসলমানের মধ্যে যুদ্ধের ট্রেনিং বন্ধ করে দিতে চান?’ বৃদ্ধ প্রশ্ন করলো।
‘আপনি কেন্দ্র থেকে কি নির্দেশ নিয়ে এসেছেন?’ ইহুদী পাল্টা প্রশ্ন করলো।
‘আমাকে বলা হয়েছে এখানে মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধানোর আয়োজন করতে। সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে। জাভীরার জন্য এ কাজ তেমন কঠিন ছিল না। কিন্তু তাকে ছাড়া তো এ কাজ করা সম্ভব নয়। এ কাজ করতে হলে এখানে তার মত আরো দুটি মেয়ে আনানো প্রয়োজন।’
‘কিন্তু আমাদের হাতে সময় খুবই কম।’ ইহুদী বললো, ‘আপনি তো জানেন, রমলার যুদ্ধে যে আইয়ুবীকে আমরা পরাজিত করেছিলাম, তিনি বসে থাকার লোক নন। আপনি বাস্তবতা স্বীকার করলে বলবো, এই পরাজয় সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর উদ্যম আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বাঘকে খোঁচা দিলে সে বাঘ যেমন ভীত না হয়ে আরো মারমুখী হয় তেমনি হয়েছে আইয়ুবীর অবস্থা। তিনি নিশ্চয়ই এতদিনে পরাজয়ের ধকল সামলে নিয়ে তার অদক্ষ সৈন্যদেরকে দক্ষ সৈনিকে পরিণত করে নিয়েছেন। কায়রো থেকে গোয়েন্দারা যে রিপোের্ট পাঠাচ্ছে তা মোটেই ভাল নয়। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যে কোন মুহূর্তে কায়রো থেকে যুদ্ধ অভিযানে বের হয়ে যেতে পারেন। এখনও জানা যায়নি তিনি কোন দিকে অভিযান চালাবেন বা কোথায় আক্রমণ করবেন। কিন্তু তিনি যে শিঘ্রই অভিযানে বেরোবেন তা নিশ্চিত।
এদিকে তার ভাই তকিউদ্দিনের কাছেও দামেশক থেকে সৈন্য ও রসদ পৌঁছে গেছে। তিনি সম্রাট বিলডনকে এমনভাবে পরাজিত করেছেন, দীর্ঘ দিন সম্রাট বিলডন তার বাহিনীকে ময়দানে পাঠাতে পারবেন কিনা সন্দেহ। ফলে অবস্থা আমাদের জন্য খুবই জটিল ও ঝুঁকিবহুল হয়ে উঠেছে।’
‘হ্যা, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী অতর্কিত ও কমাণ্ডো আক্রমণে অসম্ভব পারদর্শী। এবারও তিনি এ ধরনের আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনাই করবেন এটাই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের আক্রমণ চালালে আমাদের রসদপত্র তাদের কমান্ডো বাহিনীর আক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখা খুবই কঠিন হবে। যদি হেমসের মুসলমানদের মধ্য থেকেই তারা কমান্ডো নির্বাচন করে থাকে তবে এ বিপদের মাত্রা আরো একশো গুণ বেড়ে যাবে। তখন তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের রসদপত্র অন্যত্র পাঠানো যেমন নিরাপদ নয়, তেমনি বাইরে থেকে সাহায্য আসার পথও বিপদ মুক্ত নয়।’
‘এ জন্যই বলছিলাম, এই অবস্থায় মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে তাদেরকে দ্রুত চক্রান্তের জালে বন্দী করাটা জরুরী হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে বিলম্ব করলে তা আমাদের জন্য কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই ডেকে আনবে। আর গুপ্তহত্যার যে চিন্তা আপনি করেছেন তা বাদ দিতে হবে। কারণ ওই পথে গেলে ব্যর্থতা গ্রাস করবে আমাদেরকে। তখন প্রমাণিত হবে আমরা এর সাথে জড়িত আছি। আর এমনটি ঘটলে এখানে যে দু’চার ঘর ইহুদী ও খৃস্টান আছে তাদেরকে মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলবে এখানকার মুসলমানরা।’
‘কিন্তু মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার মত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়ে এখানে নেই। নতুন করে মেয়ে আনতে গেলেও অনেক সময় লাগবে। তারচেয়ে আমার যে সঙ্গীরা আছে তারা দু’চারটি অপারেশন করলে তারা একটা ঝাঁকি খাবে। অস্ত্রশস্ত্রের ট্রেনিং সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে পারে। কিছু না করে বসে থাকার চেয়ে একটা কিছু তো করা দরকার। তাদের জানান দেয়া দরকার যে, হেমসেও তোমাদের দুশমন আছে।’
“কিন্তু তা করতে গেলে ওরা আমাদের মেরে একবারে সাফ করে দেবে!’ ইহুদী তার হাতকে তলোয়ারের মত করে ডানে বামে ঘুরিয়ে বললো, ‘এই মুসলিম এলাকা থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেবে আমাদের। এই অবস্থায় আমাদের স্ত্রী সন্তান-পরিজন ও ধন-সম্পদসহ এখান থেকে বের হয়ে যেতে হবে।’
‘আমি আশা করি খৃস্টান সম্রাটরা তোমাদের অন্যত্র বসতি স্থাপনে সাহায্য করবেন। অবস্থা বুঝিয়ে বলতে পারলে তারা ক্ষতিপুরণ দিতেও প্রস্তুত থাকবেন।’
‘ঠিক আছে, আপনি যা ভাল বুঝেন তাই করেন। আপনাকে কেন্দ্র থেকে পাঠানো হয়েছে। সবদিক বিবেচনা করে আপনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই আমাদের সিদ্ধান্ত। আমি ইহুদী, জেরুজালেমে আমাদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য আমি নিজের বাড়ীঘর ধন-সম্পদ ত্যাগ করতেও রাজী আছি।’
‘যদি এটাই হয় তোমাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত তবে বিষয়টি আমি নতুনভাবে খতিয়ে দেখতে চাই। সে ক্ষেত্রে গুপ্তহত্যার পথে না গিয়ে পুরো জনপদ ধ্বংস করে দেয়ার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?’ বৃদ্ধ প্রশ্ন করলো।
‘এ জন্য তো সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হবে!’ অবাক হয়ে বলল ইহুদী।
‘সে ব্যবস্থাও আছে। সেনাবাহিনী রেডী হয়েই আছে।’ বৃদ্ধ বলল, ‘সমাট বিলডনের সৈন্য বাহিনী এখান থেকে পাঁচ ছয় মাইল দূরে ক্যাম্প করে আছে। আপনি হয়তো জানেন না, এই বাহিনী এখানে আসার পথে যত মুসলিম পল্লী পেয়েছে সব আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, অকাতরে লুণ্ঠন চালিয়েছে। তাদের মধ্যে যে ক্ষোভ আছে সেখানে একটু ঘি ঢাললে তাদের দিয়েই হেমস ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব। আপনি ভাববেন না, আমি আজই সেখানে যাবো এবং সম্রাট বিলডনকে বলবো হেমস দখল করার এটাই উপযুক্ত সময়।’
‘কিন্তু নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ চালালে এখানকার ইহুদী ও খৃস্টানদের কি হবে? আমরা কি এলাকা থেকে সরে পড়বো?’
‘আরে না, আমাদের উদ্দেশ্য এটা নয় যে, এলাকাটা ধ্বংস হোক।’ বৃদ্ধ বললো, ‘বরং আমাদের টার্গেট থাকবে যাতে এখানকার কোন মুসলমান জীবিত না থাকে। সৈন্যরা যে পরিমাণ সম্পদ পারে নিয়ে যাবে, বাকীটা তোমাদের। তোমরা নিজেরা তখন মুসলমানদের বাড়ীঘরগুলো দখল করে নেবে। আমি সেভাবেই অভিযান চালানোর জন্য বলে দেবো সম্রাট বিলডনকে।’
‘আর সুন্দরী মেয়েদেরকে?’ বুড়োর এক সঙ্গী পেছন থেকে প্রশ্নটা তুলল।
‘সৈন্যেরা ওদের মধ্য থেকে যাদের পছন্দ করবে উঠিয়ে নিয়ে যাবে, অবশিষ্টদের পাবে তোমরা।’
সবাই এ প্রস্তাবে একমত হলো। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আজ রাতেই বৃদ্ধ অতিথি সম্রাট বিলডনের ক্যাম্পে যাবেন।
তারা যখন এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বৈঠক শেষ করে বাইরে এলো, তখন এক অশ্বারোহীকে দেখলো ছুটে আসছে গ্রামের দিকে। অশ্বারোহী গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করলো। স্থানীয় ইহুদী আগন্তুককে চিনতে পারল না। বুঝা গেল এ লোক বাইরে থেকে কোন খবর নিয়ে এসেছে। ইহুদী তাকিয়ে রইলো আগন্তুকের দিকে।
সামনেই খতিবের বাড়ী দেখা যাচ্ছিল। অশ্বারোহী খতিবের বাড়ীর সামনে গিয়ে থেমে গেলো এবং অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে এলো। ইহুদী লোকটি দেখতে পেলো যুবক খতিবের দরোজায় করাঘাত করছে।
খতিব বাইরে বেরিয়ে এলেন এবং আন্তরিকতার সাথে আগন্তুকের সঙ্গে মুছাফেহা করলেন। তারপর দু’জনই ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলেন।
‘এই অশ্বারোহী দামেশক বা কায়রোর কাসেদ।’ ইহুদী বণিক বললো, “নিশ্চয়ই কোন গুরুতর খবর নিয়ে এসেছে।’
এশার নামাজের পর সমস্ত মুসল্লীরাই চলে গেল। মাত্র পাঁচ ছয় জন লোক খতিবের পাশে বসে রইলো। তাদের মধ্যে আগন্তুক অশ্বারোহীও ছিল। খতিব কোন একজনকে বললো, ‘দরোজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দাও।’
‘আমার বন্ধুগণ!’ খতিব বললেন, ‘আমার এ বন্ধু সুলতান তকিউদ্দিনের কাছ থেকে এই সংবাদ নিয়ে এসেছে যে, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খুব শিঘ্রই কায়রো থেকে যুদ্ধ যাত্রায় বের হবেন। আপনারা সকলেই কমাণ্ডো বাহিনীর একেকজন উস্তাদ। আপনাদের এখন কি করতে হবে সে কথা বলে দেয়া আমি নিষ্প্রয়োজন মনে করি। আপনাদের কাজ আপনারা ঠিক করে নিন। তবে তার আগে নিজ নিজ বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও ট্রেনিং ঠিক মত হয়েছে কিনা তা আবারো যাচাই করে নিন। তকিউদ্দিন সংবাদ পাঠিয়েছেন, খৃস্টান সম্রাট বিলডন তার সৈন্যসহ হিম্মত এলাকা থেকে পরাজিত হয়ে পালিয়ে আমাদের আশপাশে কোথাও ক্যাম্প করে আছে। যে কোন সময় সে আমাদের ওপর আঘাত হানতে পারে। তাই এদিকে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
আজ রাতেই হেমসের বাইরে চারদিকে গোয়েন্দা পাঠিয়ে তারা কোথায় আস্তানা গেড়েছে খবর নিতে হবে। তারা কোথায় এবং কত দূরে আছে জানতে হবে আমাদের। তাদের চলাফেরা ও মতিগতির উপরে দৃষ্টি রেখে তাদের তৎপরতা সম্পর্কে তকিউদ্দিনের কাছে রিপোর্ট পৌঁছাতে হবে। তিনি আরও আদেশ দিয়েছেন, পরিস্থিতি বুঝে বিলডনের খৃস্টান বাহিনীর উপর অতর্কিত কমান্ডো আক্রমণ চালাতে দ্বিধা করবে না। তাদের উপর ততক্ষণ কমান্ডো আক্রমণ অব্যাহত রাখবে, যতক্ষণ তারা পরাজয় স্বীকার না করে বা তোমাদের সাহায্যে আমরা এসে না পৌঁছাই। যাতে তারা শান্তিতে থাকতে না পারে তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব এখন আমাদের।
সেই সাথে তকিউদ্দিন আরও বলেছেন, তাদের সৈন্যরা অনেক মুসলমান গ্রাম ও বস্তি ধ্বংস করে হেমসের কাছে পৌঁছেছে। তাদের মনোভাব ভাল থাকার কথা নয়। সুযোগ পেলে তারা হেমসেও আক্রমণ করে বসতে পারে। অতএব তাদের ব্যাপারে খুবই সাবধান থাকবে।
তকিউদ্দিন আরো জানিয়েছেন, তার কাছে সৈন্য সংখ্যা কম বলে তিনি খৃস্টান সৈন্যদের পিছু ধাওয়া করেননি। তিনি বলেছেন, যদি বিলডনের বাহিনী আরও পিছনে সরে যেতে চায় তবে তাদের বিরক্ত করবে না। তাদেরকে নির্বিঘ্নে সরে যেতে দেবে। অযথা আক্রমণ করে হেমসের জনপদে হামলে পড়ার সুযোগ তাদের দেয়ার দরকার নেই।
তিনি আমাদের প্রশিক্ষণ ও ট্রেনিং জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, এমনও হতে পারে, সুলতান আইয়ুবী অভিযান শুরু করলে বিলডন গোপনে পিছন থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করতে পারে। তাই অবস্থার প্রেক্ষিতেই আমাদেরকে বিলডনের বাহিনীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনে অতর্কিতে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে তাদের গতিরোধ করে সেখানেই আটকে রাখতে হবে যেন কোন দিকে তারা অগ্রসর হতে না পারে।’
খতিব বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দিলেন বিলডন বাহিনীর তালাশে আর অবশিষ্টদের বললেন, ‘পূর্ণ সতর্ক অবস্থায় তোমাদেরকে মহল্লার চারদিকে পাহারা বসাতে হবে।’
❀ ❀ ❀