ইবনে খতিব বললো, ‘ও, তাইতো! হরমন কে সে কথাই তো বলা হয়নি!” এই বলে সে খৃস্টান গোয়েন্দাদের পরস্পরের পরিচয়ের জন্য যেসব সাংকেতিক কথাবার্তা বলা হয় সে সব কথা শুরু করলো। তিন ব্যবসায়ী একে অন্যের দিকে তাকাল বিস্ময় নিয়ে। তারা ভাবতেই পারেনি আস সালেহের গেটেই তারা নিজেদের কোন বিশ্বস্ত লোককে পেয়ে যাবে। এই অভাবিত আবিষ্কারে তিনজনই প্রচণ্ড পূলক বোধ করলো এবং নিজেদের আনন্দ ধরে রাখতে না পেরে হো হো করে হেসে উঠল।
তাদের আনন্দ দেখে হেসে উঠল ইবনে খতিবও।
এরা সবাই ছিল খৃস্টান গোয়েন্দা বিভাগের অনুসন্ধানী গ্রুপের সদস্য। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজে দক্ষ ও পারদর্শী। ইবনে খতিবের ইঙ্গিতধর্মী কথায় তার গোপন পরিচয় পেয়ে বণিকেরা তাদের আসল পরিচয় ফাঁস করে দিল। জানাল, তারা তিনজনই সম্রাট বিলডনের পক্ষ থেকে আল মালেকুস সালেহের উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য এসেছে।
তাদেরকে আগেই বলা হয়েছিল, আল মালেকুস সালেহের দরবারেও আমাদের গোয়েন্দা রয়েছে। ফলে ইবনে খতিবকে তারা বিশ্বাস করলো। ইবনে খতিবও তাদের নতুন পরিচয়। সঠিক বলেই ধরে নিল।
‘তাহলে আপনারা এ উদ্দেশ্যেই এসেছেন?’ ইবনে খতিব প্রশ্ন করলো, ‘আমার কাছে কিছু গোপন করবেন না। কিভাবে কি করতে চান আমাকে খুলে বলুন। আমিই আপনাদের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ করে দেবো।’
‘হ্যাঁ!’ একজন উত্তর দিল। ‘কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা শোনার আগে বলো, এখানে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা কেমন আছে? তারা কি এ মহলেও আছে?’
‘হ্যাঁ আছে। কিন্তু তাদের উপর আমরা কড়া দৃষ্টি রাখছি।’ ইবনে খতিব বললো, ‘তাদের সামনে যেনো আপনাদের না পড়তে হয় সে ব্যবস্থাও আমি করবো। এখন বলুন আপনারা কিভাবে কি করতে চান?’
সে সাংকেতিক ভাষায় আবার তাদেরকে কিছু বলল। তার এই গোপন সংকেত শুনে তাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হলো যে, ইবনে খতিব সন্দেহাতীতভাবেই তাদের লোক।
তারা তার কাছে তাদের পরিকল্পনা তুলে ধরল। ইবনে খতিব ভেতরে গিয়ে আল মালেকুস সালেহকে সংবাদ দিল, ‘তিনজন বণিক আপনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করতে চান।’
‘তুমি রক্ষী দলের নতুন কমাণ্ডার?’ আল মালেকুস সালেহ জিজ্ঞেস করলেন।
‘জী, হুজুর!’ সে উত্তর দিল।
‘কোথাকার বাসিন্দা?’
সে অজানা কোন এক গ্রামের নাম করলো। আল মালেকুস সালেহ তার উত্তর শুনে বললো, ‘যে যখন চাইবে তখনই আমি তার সাথে দেখা করবো ভাবলে কি করে? যাও, ওদের গিয়ে বলল, হুজুর ব্যস্ত আছেন, এখন দেখা হবে না।’
তারপর একটু বিরতি দিয়ে বললেন, ‘কেন দেখা করতে চায় ওরা?’
‘ওরা নাকি এমন সব হীরা জহরত ও মনিমানিক্য নিয়ে এসেছে, যা কেবল কোন রাজা বাদশাহর পক্ষেই সগ্রহ করা সম্ভব।’
আল মালেকুস সালেহের তখনই মনে পড়ে গেল সম্রাট বিলডনের দূতের সাথে তার কথোপকথনের কথা। তিনি আবার ফিরলেন কমাণ্ডারের দিকে। বললেন, ‘ঠিক আছে, যাও। ওদেরকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’
সে বাইরে গিয়ে তাদের তিনজনকে ভেতরে পাঠিয়ে দিল আর চোখের ইশারায় বলে দিল, ‘সাবধান! খুব হুশিয়ারীর সাথে কথা বলবে।’
রাতে এশার নামাজের পর ইবনে খতিব মসজিদের ইমামের কাছে গিয়ে বসলো। সেখানে আরও দু’জন লোক ছিল।
‘এখন আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল মালেকুস সালেহ আরেকবার খৃস্টানদের জালে আবদ্ধ হতে চলেছে।’ ইবনে খতিব বললো, ‘আমি আপনাদের প্রথমে দূত ও তার উপঢৌকন দেয়া সম্পর্কে সংবাদ জানিয়েছি। সেগুলো যে খৃষ্টানদের কাছ থেকেই এসেছিল তাও বলেছি। তাদের সাথে ছিল এক সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু দূত ফেরার সময় মেয়েটিকে সঙ্গে নেয়নি। আল মালেকুস সালেহের মগজ ধোলাই করার জন্য তাকে এখানেই রেখে গেছে। নিশ্চয়ই সে মেয়ে এখন তার মহলেই আছে।
আজ নিশ্চিত হলাম, এই দূত এসেছিল সম্রাট বিলডনের কাছ থেকে। বিলডন উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে আবার আল মালেকুস সালেহের ঈমান ক্রয়ের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। আল মালেকুস সালেহ যে বিলডনের টোপ গিলেছে তাও এখন স্পষ্ট।’
‘কিন্তু তুমি কি করে নিশ্চিত হলে যে ওই দূত বিলডনের কাছ থেকেই এসেছিল?’ ইমাম সাহেব জানতে চাইলেন।
‘আজ তিনজন বণিক আল মালেকুস সালেহের সাথে বাণিজ্য বিষয়ে কথা বলার জন্য এসেছে। আপনি জানেন আমি দু’বছর বায়তুল মুকাদ্দাসে ছিলাম খৃস্টানদের সাথে। ওখানে গোয়েন্দাগিরী করার সময়ই আমি তাদের কিছু গোপন সংকেত জানতে পারি, যার মাধ্যমে তারা একে অপরকে সনাক্ত করে। এই তিন বণিকের চেহারা, ভাষা ও কথা বলার ভঙ্গিতে আমার সন্দেহ জাগে। তারা আরবী পোষাক পরে থাকলেও সেটা যে তাদের ছদ্মবেশ বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি। আমি তাদেরকে ভেতরে নিয়ে কিছু সাংকেতিক কথাবার্তা বলার পর তারা নিশ্চিত হয়ে যায়, আমি তাদেরই একজন। আল মালেকুস সালেহের দরবারে তাদের গোয়েন্দা আছে এ কথা তাদেরও জানা ছিল। আমি তাদেরকে সব রকম সাহায্য করার আশ্বাস দিলে তারা তাদের আসল পরিচয় প্রকাশ করে। আমি তাদেরকে আল মালেকুস সালেহের দরবার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে তাদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করে নিয়েছি।’
‘তোমার বায়তুল মুকাদ্দাসে গোয়েন্দাগিরী করার অভিজ্ঞতা এখন খুব কাজে লাগছে দেখছি।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘সম্মানিত আলী বিন সুফিয়ানের প্রশিক্ষণের মর্যাদা তোমরাই রাখতে পারবে।’
সুলতান আইয়ুবীর এক চৌকস গোয়েন্দা ইবনে খতিব। কিছু দিন হলো সে হলবে এসেছে। এখানে আল মালেকুস সালেহের এক সহ-সেনাপতির চেষ্টায় তাকে গার্ড বাহিনীর কমাণ্ডার পদে নিযুক্ত করা হয়েছে। এ সহ-সেনাপতিও সুলতান আইয়ুবীর একজন সমর্থক।
ইবনে খতিব আলী বিন সুফিয়ানের একান্ত সান্নিধ্যে কিছুদিন থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল। সে সময় তার কাছ থেকে এমন বিশেষ কিছু প্রশিক্ষণ সে পেয়েছিল যার জন্য সে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করতো।
এই ইবনে খতিব ছিল মেধাবী ও নির্ভীক গোয়েন্দা। সে দু’বছর এক খৃস্টান সম্রাটের দরবারে কাজ করেছে। দু’বছর ছিল খৃস্টানদের সামরিক হেড কোয়ার্টারে। সেখানে সে সময় কাটিয়েছে খৃস্টান জেনারেলদের সাথে। গোয়েন্দাগিরী করেছে সাফল্যের সঙ্গে।
জামে মসজিদের ইমামও একজন ঝানু গোয়েন্দা। তিনি হলবে সুলতান আইয়ুবীর প্রেরিত গোয়েন্দা কমাণ্ডার। কোন গোয়েন্দার রিপোর্ট দেয়ার প্রয়োজন হলে সে নামাজের সময় মসজিদে চলে আসতো। ইমামরূপী কমাণ্ডারের কাছে রিপোর্ট করে ফিরে যেতো নিজের কাজে। বিশেষ করে এশার নামাজের পর ইমাম সাহেব মুসল্লীদের সাথে মত বিনিময় করতেন এবং সবার ভাল-মন্দের খোঁজ খবর নিতেন। এ সুযোগে দৈনন্দিন রিপোর্ট দেয়ার কাজটি সেরে নিত গোয়েন্দারা। কখনো কখনো বিশেষ আলাপ থাকলে তিনি খাস কামরায় ডেকে নিতেন সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দাকে। মানুষ তাঁর কাছে ছেলের পরীক্ষা, বেগমের অসুস্থতা এইসব নানা সমস্যা বলে দোয়া চেয়ে নিত। কোন গোয়েন্দা একান্তে কথা বললেও তাই কেউ কিছু মনে করতো না।
ইবনে খতিব আজ খুব মূল্যবান রিপোর্ট এনেছে। এ নিয়েই হুজুরের খাস কামরায় বসে আলাপ করছিল গোয়েন্দারা। এ সময় এক মধ্য বয়সী মেয়েলোক হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে সেখানে হাজির হলো। মেয়েটি আপাদমস্তক বোরকা আবৃত। মুখে নেকাব। সে ভেতরে এসে মুখের নেকাব খানিকটা সরিয়ে দিল। ইমাম সাহেব তাকে দেখে হেসে বললো, ‘কি খবর নিয়ে এসেছে?’
এ মেয়ে ছিল আল মালেকুস সালেহের এক দাসী। আল মালেকুস সালেহের অন্দর মহলের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল এই মহিলার ওপর। আল মালেকুস সালেহের অন্দর মহলের সকল গোপনতত্ত্বের খবর এই মহিলা নিয়মিত ইমাম সাহেবকে জানিয়ে যেতো।
যেদিন আল মালেকুস সালেহের অন্দরে সম্রাট বিলডনের পাঠানো মেয়েটি প্রবেশ করে সে দিনই সে ইমাম সাহেবকে তা রিপোর্ট করে গিয়েছিল। ইমাম সাহেব বলেছিলেন, ‘নজর রাখো। আর দেখতে থাকো কি করে এই মেয়ে।’
দাসী জানাল, ‘খৃস্টানদের পাঠানো মেয়েটি আল মালেকুস সালেহকে কব্জা করে নিয়েছে। তার চেহারা ও শরীরের গঠন, গায়ের রং, কথা বলার ভঙ্গি এবং ভাষার মাধুর্য যে কোন যুবককে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট। এ মেয়ের চেহারা ও কণ্ঠে এমন যাদু আছে যার প্রভাব এড়ানো দরবেশ ব্যক্তির পক্ষেও কঠিন। সে ইমাম সাহেবকে বলল, ‘আপনি জানেন, আস সালেহ এখনো বিয়ে করেনি। কিন্তু মেয়েটি আসার পর তার প্রতিটি রাতই হয়ে উঠছে বাসর রাত। এমন কোন রাত নেই যে রাতে মেয়েটি তাকে সঙ্গ দিচ্ছে না।’
‘তার মানে মেয়েটি তাকে কব্জা করে ফেলেছে?’
‘তো আর বলছি কি! এই মেয়ে আস সালেহকে তার গোলাম বানিয়ে ফেলেছে।’
‘গোলাম নয় বরং বলো কয়েদী করে ফেলেছে।’
দাসী বললো, ‘সে মেয়েটির জন্য এমন পাগল হয়ে গেছে যে, আমাকে আজ বললো, দেখো তো এ মেয়েটাকে তোমার পছন্দ হয় কিনা? একে আমি বিয়ে করে ফেলতে চাই, তুমি কি বলো? আমি তাকে বললাম, এ কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনার বোনকে জিজ্ঞেস করে দেখুন সে কি বলে? আমার কথা শুনে উনি আৎকে উঠে বললেন, না না, খবরদার! ওকে এখন এসব কিছুই জানাবে না। ও জানতে পারলে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে।’
‘তার হেরেমে এখন কয়টি মেয়ে আছে?’ জানতে চাইলেন ইমাম সাহেব।
‘ছিল কয়েকজন। কিন্তু এ মেয়ে আসার পর তাদের কারোরই আর তার খাস কামরায় যাবার অনুমতি নেই। তিনি সবাইকে কঠোরভাবে তার কাছে ঘেঁষতে নিষেধ করেছেন।’
‘বুঝতে পারছি। তার মানে, আল মালেকুস সালেহ এখন পুরোপুরিই সে মেয়েটার জালে আটকা পড়ে গেছে।’
একজন বললো, ‘এক্ষুণি সুলতান আইয়ুবীকে সব জানানো দরকার! খৃস্টানরা আস সালেহকে দিয়ে কখন কি করিয়ে বসে তার কি ঠিক আছে!’
ইমাম সাহেব বললেন, ‘এখুনি সংবাদ পাঠানোর দরকার নেই। আস সালেহ যদি চুক্তি ভঙ্গ করে বা গুরুতর কিছু করেই বসে তখন সুলতান আইয়ুবীকে জানানো হবে।’
‘সুলতান আইয়ুবী ময়দান থেকে আবার মিশরে চলে গেছেন। ময়দানে আছেন তাঁর ভাই তকিউদ্দিন। তিনিও সুলতানের পরামর্শ ও আদেশ ছাড়া কিছু করবেন না।’ অন্য একজন বললেন। লোকটিকে যথেষ্ট জ্ঞানী বলেই মনে হলো। তিনি বললেন, ‘কিন্তু বেশী সময় নিলে এখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই এমন কিছু চিন্তা করা উচিত যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। এ সমস্যার সমাধানে আমাদেরই উদ্যোগ নেয়া দরকার।’
‘আমি আপনাকে একটি পরামর্শ দিতে পারি।’ দাসী বললো, ‘আস সালেহের ধ্যান-জ্ঞানে এখন ওই মেয়েটি ছাড়া আর কিছু নেই। নিজের ভাল-মন্দ চিন্তা করার যোগ্যতাও তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। এ মেয়ে তাকে দিন রাত সব সময় মদ পান করিয়ে মাতাল করে রাখে। এ হতভাগা আগেও মদ পান করতো, কিন্তু তার একটা সীমা ছিল। দিনে কখনো তিনি মদ পান করতেন না। আর এখন তিনি এত বেশী মদ পান করেন। যা কল্পনাও করা যায় না। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি তার বোনের সামনে উপস্থিত হন না। আগে অন্ততঃ বোনের সাথে তার দিনের বেলা দেখা সাক্ষাত হতো। কিন্তু যেদিন ওই হতভাগী মেয়েটা এসেছে সেদিন থেকে ভাই-বোনের আর সাক্ষাতই হয় না। বোনের মধ্যে মা-বাবার আদর্শ এখনো কিছুটা টিকে আছে। ভাইয়ের ব্যাপারে সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও পেরেশান। যখনই সে ব্যাকুল হয়ে ভাইয়ের ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করে, আমি বলি, রাজ্য শাসনের কাজে সর্বদা তাকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে, তিনি তোমার সাথে দেখা করার সুযোগই হয়তো পান না। কিন্তু আমার এ উত্তর তাকে কখনোই সন্তুষ্ট করতে পারে না। আমার পরামর্শ হলো, এই নতুন মেয়েটাকে আপনারা গায়েব করে দিন। তাতে আস সালেহের হুঁশ ফিরে আসতে পারে। আমি এটুকু নিশ্চয়তা আপনাদের দিতে পারি, মেয়েটা না থাকলে সে খৃস্টানদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।’
এ ব্যাপারে অন্যরা মতামত দেয়ার আগেই একজন প্রস্তাব করলো, ‘শুধু মেয়েটাকে নয়, বণিক তিনজনকেও গায়েব করে দেয়া উচিত।’
উপস্থিত গোয়েন্দাদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। কেউ প্রস্তাব দুটো সমর্থন করলো, কেউ এ কাজের ঝুঁকি ও বিপদ সম্পর্কে হুশিয়ার করলে অন্যদের। ব্যাপক আলোচনার পর ইবনে খতিব বললো, ‘আপনারা যদি তাদের গায়েব করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তবে ঝুঁকি থাকার পরও এ দায়িত্ব আমি গ্রহণ করতে রাজি আছি।’
ইমাম সাহেব বললেন, ‘আস সালেহকে সতর্ক ও সাবধান করা আমাদের দায়িত্ব। তাকে সোজা পথে রাখার জন্যই আমাদের এখানে পাঠানো হয়েছে। নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে ওদের গায়েব করে দেয়ার অভিযানটি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী বা আলী বিন সুফিয়ানকে পেরেশান করার আগে এ কাজটি সমাধা করার জন্য চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। অতএব প্রস্তাব দু’টো গৃহীত হলো। তবে চারজনকে এক সাথে গায়েব করে দেয়া অসম্ভব হলে আগে মেয়েটাকে ধরতে হবে। এরপর সুযোগ বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে বণিকদের ব্যাপারে।’
আল মালেকুস সালেহের দরবারে বসে তারই আশ্রিতা ও অতিথিবৃন্দকে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দেয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেষ হলো এ গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক।
১১৮১ খৃস্টাব্দের নভেম্বর মাসের কোন একদিন। উটের কাফেলার পাশে বাজার বসিয়ে বেচা-কেনা করছে খৃস্টানদের পাঠানো তিন উপদেষ্টা। এখনো আগের মতই তাদের পরণে আরবী পোশাক। ইবনে খতিবের সহযোগিতায় তারা এ পোষাকেই আস সালেহের সাথে গোপনে দেখা সাক্ষাত করতো।
একাধিক বৈঠকের পর আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হলে কিভাবে আল মালেকুস সালেহ ও খৃস্টান বাহিনী পরষ্পরকে সহযোগিতা করবে এবং এই যুদ্ধের জন্য কিভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে তার কিছু নীতিমালা ঠিক করলো ওরা। শর্তগুলো কোথাও লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হলো না ঠিকই, কিন্তু উভয় পক্ষই জানে নিজেদের প্রয়োজনেই উভয় পক্ষ এ শর্ত মেনে চলবে।
আলাপ-আলোচনা মোটামুটি শেষ। এবার বিদায়ের পালা। বিলডনের উপদেষ্টাদের অভিযান পুরোপুরি সফল। বণিক তিনজনের চেহারাতেই লেগে ছিল সেই সাফল্যের আনন্দময় দ্যুতি। খুশী আল মালেকুস সালেহও। কারণ এ শর্তের সবটাতেই তার কেবল লাভ আর লাভ। সেই লাভের অংক কষার মত সময়ও তার হাতে ছিল না। বিলডনের পাঠানো ইহুদী মেয়েটির চুলের অরণ্যে সে তখন তার সব লাভ জমা করছিল।
খুশীতে টইটম্বর আল মালেকুস সালেহ এ উপলক্ষে এক বিরাট ভোজসভার আয়োজন করলেন। দাওয়াতপত্রে যদিও উপলক্ষের কারণ সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল না, কিন্তু তাতে কারো কিছু যায় আসে না। শাহী খেয়ালের শাহী কারবার। যে কোন সময় যে কাউকে দাওয়াত করে তারা খাওয়াতেই পারেন!
সেই মাসের ১৭ তারিখ রাতে বড়সড় বিনোদন মাহফিলের আয়োজন করা হলো। মহলের ভেতর স্থান সংকুলান হবে না বিধায় মহলের বাইরে খোলা মাঠে বিশাল সামিয়ানা টানানো হলো। সেই সামিয়ানার ভেতর ও বাইরে চমৎকার আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হলো। প্রতিটি টেবিলের জন্য আলাদা খানসামা নিয়োগ করা হলো। তাদের হাতে খাবারসহ তুলে দেয়া হলো মদের সোরাহী ও গ্লাস।
আমন্ত্রিতরা এ দাওয়াতের কোন কারণ না জানলেও আস সালেহ এবং সেই খৃস্টান তিন উপদেষ্টা জানতো এর প্রকৃত কারণ। খৃস্টানদের সাথে গোপন ও অলিখিত চুক্তি সম্পাদনই ছিল এ আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যের খবর জানতে সেনাবাহিনীর আরো দুই সেনাপতি, যাদের সাথে কথা হয়েছিল বিলডনের সেই দূতের। আর জানতো, ইবনে খতিব, ইমাম সাহেব আর আইয়ুরীর গোয়েন্দারা।
সন্ধ্যা পেরিয়ে নেমে এলো রাত। আমন্ত্রিত শত শত মেহমান সাজগোছ করে জোড়ায় জোড়ায় এসে আসন গ্রহণ শুরু করলো।
আমন্ত্রিতদের মধ্যে সেই খৃস্টান তিন উপদেষ্টাও ছিল। তারা তখনও বণিকের বেশে আরবী পোষাকেই সজ্জিত ছিল। তাদের কাফেলার অন্যান্যরাও নিমন্ত্রিত ছিল। এরা অধিকাংশই ছিল খৃস্টান গোয়েন্দা। অবশিষ্টরাও ছিল খৃস্টান সৈন্য বা সেনা বাহিনীর অফিসার।
ভোজ সভায় শামিল হয়েছিল সেই ইহুদী সুন্দরী। আস সালেহের বোনও ছিল নারীদের সাথে। তারা মেহমান নয় মেজবান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিল।
শান্তিপূর্ণ অনুষ্ঠান। মেহমানরাও সব উচ্চপদস্থ সামরিক ও প্রশাসনিক অফিসার এবং শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি। এ আনন্দঘন অনুষ্ঠানে বিঘ্ন ঘটাতে পারে এমন কাউকে দাওয়াতই করা হয়নি। তাই অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ার কোন গরজ কারো পক্ষ থেকেই ছিল না। এ সুযোগটাই কাজে লাগাল আইয়ুবীর গোয়েন্দারা।
মেহমানরা দল বেঁধে আসছে এবং পানাহার করছে। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে উপভোগ করছে নাচ-গান। ঘুরে ঘুরে একে অন্যের সাথে পরিচিত হচ্ছে। পরিচিতজনরা পরস্পর কুশল বিনিময় করছে। কারো মনেই কোন ভয় ও শংকার চিহ্ন নেই। বিশেষ করে আস সালেহের তো ভয়ের কোন কারণই নেই। তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী ছায়ার মত তাঁর সাথে ঘুরছে।
চারদিক থেকে ভেসে আসছে রোস্ট করা দুম্বার ঘ্রাণ। মাঝে মধ্যে মদের গ্লাসের টুংটাং আওয়াজ।
বিস্তীর্ণ মাঠে মোটা তিরপল ও ছামিয়ানার নিচে আনন্দে মশগুল লোকগুলোর সময় যেন থমকে আছে। রাত বাড়ছে সামিয়ানার বাইরে কিন্তু সামিয়ানার নিচে রঙিন আলোর মাঝে রাত বাড়ার কোন প্রভাবই পড়ছে না।
রাত গভীর হলেও মেহমানদের আপ্যায়ন পুরোদমেই চলছিল। চারদিকই গমগম করছিল মেহমানদের ভীড়ে।
ইহুদী মেয়েটি রূপের গর্বে ও সফলতার আনন্দে যেন প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াচ্ছিল। সে এ টেবিল থেকে ছুটে যাচ্ছিল সে টেবিলে।
তখন অনেক রাত। মেহমানরা ক্লান্ত। সঙ্গীতের সুরে হৃদয় আবেশ করা আমেজ। সেই দাসী যে ইমাম সাহেবের হুজরায় গিয়েছিল পানি পড়া আনতে ইহুদী মেয়েটির কাছে এসে তাকে থামিয়ে দিয়ে এক সেনাপতির নাম করে বললো, সে তোমাকে ডাকছে।
মেয়েটি জানতো এ সেনাপতি তাদেরই লোক। বললো, ‘কোথায় সে?’
দাসী তাকে সামিয়ানার বাইরে এক আলো-আঁধারীর দিকে ইঙ্গিত করে বললো, “ওখানে।’
মেয়েটি বিলম্ব না করে সেদিকে চলে গেল। কিন্তু সেই যে গেল আর সেদিক থেকে ফিরে এলো না।
আস সালেহ ব্যস্ততার জন্য অনেকক্ষণ খবর নিতে পারেনি ইহুদী মেয়েটির। সে জানতেই পারলো না তার প্রাণের পাখি উড়ে গেছে, গায়েব হয়ে গেছে সেই ইহুদী কন্যা।
ইবনে খতিব সারাদিন ডিউটি করেছে। রাতে উৎসবের সময় তার ডিউটি ছিল না, কিন্তু কমাণ্ডার বলে সেও উৎসবে খাওয়ার দাওয়াত পেয়েছিল।
সময় মত সেও মাহফিলে হাজির হলো। সেই তিন বণিকের সাথে কয়েকবারই তার দেখা হলো। বণিকরা যার যার মত পানাহার ও খোশগল্পে ব্যস্ত। গভীর রাতে সে এক বণিককে কাছে পেয়ে ইশারায় তাকে ডেকে সামিয়ানার বাইরে নিয়ে এলো। তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। সে বণিককে একা পেয়েই বলে উঠলো, ‘আপনার অন্য সাথীরা কোথায়?’
‘কেন, আছে আশেপাশেই! তোমাকে পেরেশান দেখাচ্ছে কেন?”
‘আপনারা তিনজন জলদি এখান থেকে সরে পড়ুন।’ ইবনে খতিব এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘নইলে মারা পড়বেন। এইমাত্র খবর পেলাম, মেহমানদের ছদ্মবেশে সুলতান আইয়ুবীর কিছু কমাণ্ডো মাহফিলে ঢুকে পড়েছে। তারা কি অঘটন ঘটাবে জানি না। এখানে আপনারা ছাড়া অন্যদের বিপদ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা নেই। অন্যদের অবশ্য ভয়ের কোন কারণও নেই। কিন্তু তারা আপনাদের সন্দেহ করে থাকলে বিপদ আছে। এক্ষুণি আপনার অন্য দুই বন্ধুকে ডেকে নিয়ে আসুন। সাবধান! তাড়াহুড়ো করবেন না, আপনারা সরে পড়ছেন, কেউ যেন টের না পায়।’
বণিক কথা না বাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে গেল সামিয়ানার নিচে। সঙ্গীদের খুঁজে পেয়ে বলল, ‘জলদি বাইরে চলো। জরুরী কাজ আছে।’
বণিক তার অন্য দুই সঙ্গীর কানে কানে বিপদের কথা জানালো। ওরা কোন কথা না বলে সবার অলক্ষ্যে বেরিয়ে এলো সামিয়ানা থেকে।
ইবনে খতিব বললো, ’চলুন, আগে আপনাদের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছতে হবে। ওখানে পৌঁছে সব বিস্তারিত বলছি। ইবনে খতিবকে অনুসরণ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা এক নিরাপদ স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিল। তাদের তিনজনকে লুকানোর ব্যবস্থা করে ইবনে খতিব বললো, “আইয়ুবীর গোয়েন্দা ও কমান্ডো বাহিনী অযথা মাহফিলে আসেনি। নিশ্চয়ই তারা আপনাদের সন্দেহ করেছে। এ জায়গা নিরাপদ, কিন্তু রাজমহল আপনাদের জন্য আর নিরাপদ নয়।’
খৃস্টান বণিক বললো, ‘আমাদের এখানকার কাজ শেষ। এখন এখানে ঝুঁকি নিয়ে অবস্থানের কোন মানে হয় না। তারচেয়ে এ মুহূর্তে আমরা হলব থেকে বেরিয়ে যেতে চাই।’
‘আমাদের এখান থেকে বের হতেই হবে এবং এক্ষুণি।’ বলল অন্যজন।
‘তবে জলদি করুন।’ ইবনে খতিব বললো, ‘আপনারা রওনা হয়ে যান। কাল আমি কাফেলাকে আপনাদের চলে যাওয়ার খবর পৌঁছে দেবো। দেরী করবেন না, দেরী করলে এখান থেকে সকালে আপনাদের লাশ বের করতে হবে।’
ইবনে খতিব কামরা থেকে বেরিয়ে গেল এবং একটু পরই চারটি ঘোড় নিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। কাউকে কিছু না বলে প্রথমেই সে নিজে ঘোড়ায় চেপে বসলো। তার দেখাদেখি বণিক তিনজনও চড়ে বসলো ঘোড়ায়। চার আরোহী হালকা চালে হলবের রাস্তায় বেরিয়ে এলো।
ভোজ অনুষ্ঠানে তখনো চলছে নাচ, গান। মদ খেয়ে বাজনার তালে তালে দুলছে মেহমানরা। তাদের অলক্ষ্যে চারটি ঘোড়া শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল সামনে।
আল খালেকুস সালেহ এবং তার ষড়যন্ত্রের দোসর তিন খৃষ্টান গোয়েন্দা জানতেও পারল না, নকল ভীতি থেকে পালিয়ে তারা ছুটছে মরণ পথের দিকে। লোকালয় থেকে দূরে এক বাড়ীতে নিয়ে ওদের তুলল ইবনে খতিব। বলল, ‘আপনাদের পোষাক পাল্টাতে হবে। বণিকের বেশ ছেড়ে সাধারণ নাগরিকের বেশ ধরতে হবে আপনাদের। আইয়ুবীর গোয়েন্দারা যখন টের পাবে আপনারা মাহফিলে নেই, কেটে পড়েছেন, তখন চারদিকে তারা ছড়িয়ে পড়বে আপনাদের খোঁজে। সকাল হওয়ার আগেই আপনারা ওদের হাতে পড়েন তা আমি চাই না।’
তিন খৃস্টান বণিক ইবনে খতিবের প্রশংসা করে বলল, ‘প্রভু বড় মঙ্গলময়, নইলে তোমাকে এভাবে সাহায্যের জন্য পাঠিয়ে দেবেন কেন?’ তারা সেখানে বসে পড়ে শহর থেকে বেরোতে পারায় আল্লাহর শুকুর গোজারী শুরু করল।
ইবনে খতিব তাদের শান্তনা দিয়ে বলল, ‘ভয় নেই। এখন আপনারা নিরাপদ। বিশ্রাম নিন। সকাল বেলা কোন কাফেলার সাথে আপনাদের শামিল করে দেবো। শুধু আপনারা তিনজন এক কাফেলায় থাকলে সন্দেহের তালিকায় পড়ে যাবেন। তারচেয়ে যে কাফেলায় নারী ও শিশু আছে তেমন কোন কাফেলার সাথে আপনাদের শামিল করে দিলে ওরা আর কিছুতেই আপনাদের সনাক্ত করতে পারবে না।’
‘সত্যিই তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।’ এক বণিক বললো, ‘তোমার মত হুশিয়ার গোয়েন্দা আস সালেহের বাড়ীতে ঠাঁই করে নিতে পেরেছে, এটা খুবই আশার কথা। পরিকল্পনা মত সব কাজ এগুচ্ছে কিনা এদিকে নজর রেখো।’
‘কিন্তু আপনাদের পরিকল্পনা কি তাইতো জানি না!’ ইবনে খতিব জিজ্ঞেস করলো, ‘সুলতানের সাথে আপনাদের কি কথা হলো? ওনার সাথে কি আপনাদের কোন চুক্তি হয়েছে?’
‘লিখিত চুক্তি করা আমরা ঠিক মনে করিনি। চুক্তি যা হয়েছে সবই মৌখিক। ইচ্ছে করেই লিখিত চুক্তির ঝুঁকি নিলাম না।’
‘আপনারা ঠিকই করেছেন। চুক্তির শর্তগুলো উভয় পক্ষের জানা থাকলেই হলো। তা সুলতানের সাথে কি কি চুক্তি হলো?’
‘বলছি। মনোযোগ দিয়ে শুনে রাখো। সুলতান এসব শর্ত ঠিক ঠিক পালন করছে কিনা তা তো তোমাকেই নজর রাখতে হবে।’
‘ও নিয়ে আপনারা ভাববেন না। আমার চোখ কান সব সময় খোলাই থাকে।’ বিলডনের উপদেষ্টা বললো, ‘আস সালেহকে আমরা গোপনে যুদ্ধের সরঞ্জাম ও ঘোড়া সরবরাহ করবো। আমাদের অফিসাররা এখানে এসে তার সেনাবাহিনীকে ট্রেনিং দিয়ে যাবে। তাকে আমরা গোয়েন্দা সাপোর্ট দিয়ে যাবো। যখন সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হবে তখন আমাদের মধ্য থেকে যে আক্রান্ত হবে সে লড়বে সমুখ দিক থেকে আর অন্য পক্ষ পেছন থেকে সুলতান আইয়ুবীকে আক্রমণ করবে। সংক্ষেপ কথা হলো, আস সালেহ সুলতান আইয়ুবীর সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করবে, কিন্তু চুক্তি তখন ভঙ্গ করবে যখন। আমরা তাকে ইঙ্গিত দেবো।’
‘এখন আমাদের সামান্য বিশ্রাম নিয়ে নেয়া উচিত।’ এক খৃস্টান বললো।
‘হ্যাঁ।’ ইবনে খতিব বললো, ‘আসুন আমার সাথে। পাশের কামরায় সামান্য ঘুমিয়ে নিন।’
ইবনে খতিব পাশের কামরার দরজা খুললো। ঘরটা অন্ধকার। সে তিন জনকেই বললো, “আসুন, এ ঘরেই আপনারা আরামে ঘুমাতে পারবেন।’
অন্ধকারেই ভেতরে পা রাখল ইবনে খতিব। তিনজনই তার পিছন পিছন সে কামরায় গিয়ে ঢুকল। অকস্মাৎ তারা অনুভব করলো, কেউ তাদের গলা পেঁচিয়ে ধরছে। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। যখন বুঝতে পারল তারা আক্রান্ত ততক্ষণে তাদের গলা ও বাহুতে শক্ত হয়ে চেপে বসেছে কারো পুরুষ্ট আঙুল। তারা এ আকস্মিক আক্রমণ প্রতিহত করার কোন সুযোগই পেল না, তার আগেই প্রত্যেকের বুকে আমূল ঢুকে গেছে ইস্পাতের ধারালো খঞ্জর।
কামরার এক কোণে আগেই এক গর্ত করা ছিল। তিনজনের লাশই তার মধ্যে ফেলে দেয়া হলো। সেই কামরারই এক কোণে ইহুদী মেয়েটি বসেছিল। অন্ধকারের জন্য ওকে খৃস্টানরা দেখতে পায়নি। তার হাত-পা ছিল বাঁধা। মুখের ভেতর গোঁজা ছিল কাপড়। তাকেও সেই অনুষ্ঠান থেকে ডেকে এনে এখানে তুলেছে আইযুবীর গোয়েন্দারা।
কামরায় এখন খতিব ছাড়া আরও পাঁচজন লোক। তারা মেয়েটার হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে দিল। মুখের কাপড়ও সরিয়ে দিল একজন। কামরায় আলোর ব্যবস্থা করা হলো। মেয়েটা তিন খৃস্টান বণিকের লাশগুলোর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। লাশগুলো যেন তাকে বোবা করে ফেলেছে। একটু পর মেয়েটি লাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে বললো, ‘আমাকে অন্য কামরায় নিয়ে চলো। এখানে আমার বমি আসছে।’
তাকে অন্য কামরায় নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানেও টিমটিম করে জ্বলছিল এক প্রদীপ।
‘তোমরা কি কখনও আমার মত এমন রূপসী নারী আর কোথাও দেখেছো?’ পাশের কামরায় গিয়ে মেয়েটি তাদের জিজ্ঞেস করলো।
‘তুমি কি আমাদের মত এমন ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান মানুষ আর কোথাও দেখেছো?’ ইবনে খতিব পাল্টা প্রশ্ন করলো মেয়েটিকে। বললো, ‘আমরা তোমাকে আমাদের ঈমান নষ্ট করার সুযোগ আর দেবো না।’
‘আমি তোমাদের কাছে আমার প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছি।’ মেয়েটি বললো, ‘যদি তোমরা আমাকে পছন্দ না করে তবে কতো সোনা দাবী করে বলো, আমি তোমাদের দাবী মিটিয়ে দেবো। তোমরা আমার প্রাণ ভিক্ষা দিলে আমি ওয়াদা করছি, এক মুহূর্তও আমি এখানে থাকবো না, সাথে সাথে জেরুজালেম রওনা হয়ে যাবো।’
মেয়েটির প্রস্তাব শুনে খতিব সাথীদের দিকে তাকালো। সাথীদের চোখেও সে লক্ষ্য করলো লোভের পরিবর্তে ঈমানী দৃঢ়তা। তাদের চোখগুলো ইবনে খতিবকে বলছে, কথা বলে সময় নষ্ট করছো কেন? যদি তার কাছ থেকে কিছু জানার থাকে জিজ্ঞেস করো। নইলে শেষ করে দাও।
ইবনে খতিব তার খঞ্জর বের করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল এবং তাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তৎক্ষনাৎ তার বুকে বসিয়ে দিল হাতের খঞ্জর। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো মেয়েটি। ইবনে খতিব তার খঞ্জর টেনে বের করে সঙ্গীর দিকে ইশারা করলো। দু’জন এগিয়ে মেয়েটির চুল ধরে টেনে অন্য কামরায় নিয়ে গেল এবং আগের সেই গর্তে খৃস্টান বণিকদের লাশের ওপর ফেলে দিল তার লাশ। তারপর সবাই মিলে গর্তটা মাটি চাপা দিয়ে ভরে দিল।
রাত তখনো শেষ হয়নি, ইমাম সাহেবকে জানানো হলো, ‘কাজ সমাধা করা হয়েছে।’
এদিকে আস সালেহ তখন তিন বণিক ও মেয়েটিকে দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখতে না পেয়ে তাদের খুঁজে ফিরছিলেন। তিনি মহলের কর্মচারী ও বাঁদীদের বলছিলেন, “ওদেরকে অনুষ্ঠান স্থলে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কোথায় খুঁজে বের করো।’
রাতের শেষ প্রহর। শেষ মেহমানটিও বিদায় নিয়ে চলে গেছে। আস সালেহ গভীর একাকীত্ব অনুভব করলেন। তিনি তার অন্তরঙ্গ সাথীদের জিজ্ঞেস করছিলেন, সে কোথায়? সে আজ একটি বারও দেখা করলো না আমার সাথে! যাকে আনন্দ দেয়ার জন্য এ অনুষ্ঠান, আনন্দের মাহফিলে সেই নেই, এ কেমন কথা!
সঙ্গীরা বলছিল, ‘এত হাঙ্গামা হয়তো সইতে পারেনি। ভাল লাগেনি বলে মহলে ফিরে গেছে। মহলেই আছে কোথাও, খুঁজে দেখুন।’
বন্ধুরাও বিদায় নিল। তন্নতন্ন করে খোঁজা হল মহল। কিন্তু না, কোথাও নেই সে মেয়ে।
মেয়েটির জন্য অধীর হয়ে উঠলেন আস সালেহ। তিনি তার দাসীদের জানটা খেয়ে ফেলছিলেন রাগ, গোস্বা আর ধমকের দাপটে।
অবশিষ্ট রাতটুকু না তিনি নিজে ঘুমোলেন, না কাউকেও শুতে দিলেন।
ভোরে দাসী ইমাম সাহেবকে জানাল, ‘মেয়েটিকে হারিয়ে আস সালেহের জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তিনি এখন পাগলের মত প্রলাপ বকছেন।’
ইমাম সাহেব ইবনে খতিবকে খোঁজ নিতে বললেন। ইবনে খতিব খবর নিয়ে দেখলেন, দাসীর মন্তব্যই ঠিক। সত্যি তিনি পাগলের মত প্রলাপ বকছেন আর মহলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছুটাছুটি করছেন।
সমাপ্ত