রক্তস্রোত
সম্রাট আরনাতের রক্ষিতা প্রিন্সেস লিলি ওরফে কুলসুম কথা বলছিল বাকারের সাথে। কুলসুম বাকারকে বললো, ‘আরনাতের সাথে আমি সুখেই ছিলাম। কিন্তু আমার অন্তরে জ্বলছিল প্রতিশোধের আগুন। সে মাঝে মাঝে আমাকে বলতো, ‘সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারা ছদ্মবেশে এখানে আসে। তারা আমাদের গোপন তথ্য নিয়ে আবার সুযোগ মত পালিয়ে যায়।’ আরনাত আরও বলেছে, ‘খৃষ্টান ও ইহুদী সুন্দরী মেয়েরা মুসলমানদের দেশে গিয়ে সেখানকার বড় বড় আমীর ও অফিসারকে তাদের রূপের জালে বন্দী করে ফেলে। তারা আমাদের স্বার্থ উদ্ধারে আমীরদের ব্যবহার করে।’’
কুলসুম বললো, ‘আরনাত আমাকে সেসব মেয়েদের কাহিনী প্রায়ই বলতো। তার গল্প শুনে আমার মনে হতো, ধর্মের জন্য ওই মেয়েরা কতই না ত্যাগ স্বীকার করছে! তারা এ জন্য নিজের সম্ভ্রম পর্যন্ত বিসর্জন দিচ্ছে। বাকার! আমিও এক নারী। আমি জানি নারীরা সম্ভ্রমকে কত অমূল্য সম্পদ মনে করে। সতীত্ব রক্ষা করার জন্য মেয়েরা নিজের জীবন দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। অথচ ওই মেয়েরা অকাতরে তা বিলিয়ে দিচ্ছে। এ যে কত বড় ত্যাগ তুমি তা কল্পনা করতে পারো?’
থামল কুলসুম। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললো, ‘বাকার, আমার সম্ভ্রম তো লুট হয়েই গেছে। আমার ইচ্ছা আমি আমার ধর্মের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ ও কোরবানী স্বীকার করি। প্রয়োজনে এ জন্য আমি আমার জীবন দিয়ে দেবো। এতদিন এ ত্যাগ স্বীকারের কোন সুযোগ পাইনি আমি। আরনাত এ সম্মেলনে এসে আমার কাছে এমন গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে যে তথ্য সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছানো জরুরী মনে করছি আমি। হয়তো এই কল্যাণকর কাজের জন্যই আল্লাহ আমাকে এই জাহান্নামের মধ্যে পাঠিয়েছে। তুমি কি মনে করো, এই সংবাদ সুলতানের কাছে পৌঁছালে তাতে কোন উপকার হবে?’
‘হ্যাঁ, অনেক উপকার হবে।’ বাকার বললো, ‘কিন্তু এ সংবাদ আমরা নিয়ে যাব না। আমি ও তুমি দু’জনেই যদি এখান থেকে নিখোঁজ হয়ে যাই তবে সম্রাট আরনাত বুঝে ফেলবে, আমরা দু’জনই গোয়েন্দা ছিলাম। এতে তারা তাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফেলবে। তখন এই খবর সুলতান আইয়ুবীর উপকারে না লেগে তা তাঁর পরাজয়ের কারণ হবে।’
‘তার মানে, এত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছাতে পারব না?’ কুলসুমের কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘অবশ্যই এ খবর সুলতানের কাছে পৌঁছবে।’ বাকার বললো, ‘আগে ক্রাকে যাই, ওখানে গিয়েই আমি এ খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।’
‘তুমি নিজে যাবে?’ কুলসুম জিজ্ঞেস করলো, ‘কিন্তু তুমি চলে গেলে আমি যে এখান থেকে পালাতে চাচ্ছি তার কি হবে?’
‘আমি যাব না, তুমিও পালাবে না।’ বাকার বললো, ‘ক্রাকে আমার সঙ্গী রয়েছে। খবর পৌঁছানোর দায়িত্ব তারাই পালন করবে। আমার দায়িত্ব শুধু তথ্য জোগাড় করা। তোমার কাজ এখনও শেষ হয়নি, সবেমাত্র শুরু হয়েছে। আমি তোমাকে জানাবো সুলতান আইয়ুবীর কেমন ধরনের সংবাদ প্রয়োজন। সে সংবাদ তুমি আমাকে জোগাড় করে দেবে আর আমি তা দামেশক পর্যন্ত পৌঁছে দেব।’
‘তবে আমাকে এই জাহান্নামেই থাকতে হবে?’ কুলসুম উদাস কণ্ঠে বললো।
‘হ্যাঁ।’ বাকার উত্তর দিল, ‘তোমাকে এই জাহান্নামে এবং মৃত্যুর মুখমুখিই থাকতে হবে কুলসুম! যদি তুমি জাতির জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে চাও তবে এরচেয়ে ভাল কোন সুযোগ পাবে না। দ্বীনের জন্য এমন কোরবানী দেয়ার সুযোগ সবার ভাগ্যে জোটে না।’
কুলসুম শুনছিল বাকারের কথা। নতুন এবং অদেখা এক জগত যেনো তার চোখের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। সে অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল বাকারের দিকে। বাকার বললো, ‘গোয়েন্দাদের ব্যাপারে সুলতান কি বলেন জানো? তিনি বলেন, একটি মাত্র গোয়েন্দা আমাদের সমস্ত সৈন্যবাহিনীর জয় ও পরাজয়ের কারণ হতে পারে। তাদের মিশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুঁকিবহুল। গোয়েন্দারা প্রতি মুহুর্তে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু মৃত্যু নয়, মৃত্যুর অধিক বিপদ ওঁৎ পেতে থাকে তাদের জন্য। কোন গোয়েন্দা শত্রুদের হাতে ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করা হয় না। তথ্য আদায়ের জন্য তাদের দেয়া হয় কঠিন শাস্তি। তাদের চামড়া ছিলে তাতে লবণ মাখানো হয়। তাকে এমন কঠিন শাস্তি দেয়া হয় যে, তারচেয়ে মৃত্যু হলে সে বেঁচে যেত। কিন্তু তাদের মরতেও দেয়া হয় না, বাঁচতেও দেয়া হয় না।’
‘কুলসুম!’ বাকার বললো, ‘কিন্তু নিজের ধর্ম, নিজের দেশ ও আপন জাতির জন্য কাউকে না কাউকে তো এমন ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়। সুলতান বলেন, ‘যে জাতির সন্তানদের মধ্য থেকে জাতির জন্য ত্যাগ ও কোরবানীর আবেগ নিঃশেষ হয়ে যায় অল্পদিনের মধ্যেই পৃথিবীর বুক থেকে সে জাতির অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যায়।’ তুমি যেখানে নিরুপায় হয়ে চারটি বছর কাটিয়ে দিয়েছ সেখানে আরো চারটি মাস কাটিয়ে দাও মহান এক মিশন নিয়ে, নতুন এক স্বপ্ন নিয়ে।’
‘তুমি বলছো, তাতে জাতির কল্যাণ হবে! আমার পাপ মোচন হবে?’
‘হ্যাঁ কুলসুম! আরনাত এখন আর তোমার প্রভু নয়, সে তোমার শিকার। এ শিকার যেনো হাতছাড়া না হয় সেদিকে তোমার কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। তার সাথে আগের চেয়ে অধিক ভালবাসার ভাব দেখাবে। কিন্তু মনে রাখবে, তুমি এক বিষধর সাপকে আগলে রেখেছো। এ সাপ যদি তোমার নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে যায় তবে সে মুসলিম বিশ্বের বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’
‘তবে আমাকে বলো!’ কুলসুম অধীর কন্ঠে বললো, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে বলো, আল্লাহ আমার এ খেদমত গ্রহণ করবেন এবং তিনি আমাকে মাফ করে দেবেন!’
‘নিশ্চয়ই! আল্লাহ বান্দার কোন আমলই বিফলে যেতে দেন না।’
‘তাহলে বলো আমাকে কি করতে হবে?’
বাকার তাকে বুঝিয়ে বলতে শুরু করল তার কি করণীয়। সে তাকে বলল, ‘সবার সামনে এমন ভাব প্রকাশ করো না, যাতে তোমার এবং আমার মাঝে কোন গোপন সম্পর্ক রয়েছে মানুষ এমন ধারণা করতে পারে। সব সময় মনে রাখবে, এখানে আমাদের মত গোয়েন্দাদের ধরার জন্য খৃষ্টান গোয়েন্দারাও ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এটাও মনে রাখবে, এখানে শুধু আমরা দু’জনই নই, আমাদের সাথী আরো গোয়েন্দারা কাজ করছে। শুধু এখানেই নয়, খৃস্টানদের প্রতিটি শহরে ও গ্রামে ঘুরে বেরাচ্ছে আমাদের সাথীরা।
কুলসুম, এ খবর শুনে অহংকারী ও বেপরোয়া হয়ে যেও না। মনে রেখো, এখানে খৃস্টান জেনারেল ও শাসকরা আছেন। তারা সব আহাম্মক এমনটি মনে করার কোন কারণ নেই। এদের মধ্যেও অনেকেই আছেন যারা সাহসী ও বুদ্ধিমান। তাদের চোখ কান খোলা। তাই যা করবে বুঝেশুনে করবে। একদিকে নিজের বুদ্ধি বিবেক কাজে লাগাবে আর সারাক্ষণ নির্ভর করবে শুধু আল্লাহর উপর। আমরা স্বেচ্ছায় এক কঠিন দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছি। এ দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে পরিপূর্ণ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে। এ কাজ করতে গিয়ে যত বিপদই আসুক না কেন সবই আমাদের মাথা পেতে নিতে হবে, সহ্য করতে হবে।’
কুলসুম তাঁবুর কাছে এসে গাড়ী থেকে নামলো। সে এখন আর কুলসুম নয়, প্রিন্সেস লিলি। আর গাড়ীর চালক বাকার বিন মুহাম্মদও এখন একজন নিষ্ঠাবান খৃস্টান, যার নাম সায়বল। কুলসুম যখন গাড়ী থেকে নামলো, সায়বল তখন বগির পাশে এক নিরীহ চাকরের মত মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো।
প্রিন্সেস লিলি তাঁবুতে ঢুকে দেখল সম্রাট আরনাত একটি নকশার ওপর ঝুঁকে আছেন। লিলি বললো, ‘অমন করে কি দেখছ?’
আরনাত নকশা থেকে মুখ না তুলেই বললো, ‘খুবই জরুরী জিনিস। তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’
‘প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়েছিলাম।’ লিলি বললো, ‘সেই সাথে একটু শিকার করারও শখ চেপেছিল।’
আরনাত নকশা থেকে মুখ তুলে হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করলো, ‘তা কি শিকার করেছো?’
‘কিছুই না।’ লিলি উত্তর দিল, ‘সব তীরই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।’ তারপর মন খারাপ করে বললো, ‘তুমি তো আর আমাকে তীর চালাতে শেখাওনি যে আমি শিকার ধরতে পারবো।’
আরনাত হেসে বললো, ‘তাই! তা আমাকে বলবে তো! ঠিক আছে রাণী, দেখবেন এক সপ্তাহের মধ্যে আপনি পাকা শিকারী হয়ে গেছেন।’
‘তুমি সত্যি বলছো!’ আনন্দিত গলায় বললো লিলি, ‘কখন শেখাবে, কবে শেখাবে?’ কথা বলতে বলতে সে আরনাতের পাশ ঘেঁষে বসে পড়লো।
আরনাত আবার নকশার দিকে দৃষ্টি দিয়েছিল, সে আরনাতের পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিসের নকশা? অভিযানের, নাকি প্রতিরক্ষার?’
‘অভিযান চালাবেন সুলতান আইয়ুবী।’ আরনাত অন্যমনস্ক ভাবে বললো, ‘আর প্রতিরক্ষাও তাকেই করতে হবে। আমরা তাকে ফাঁদে ফেলতে চেষ্টা করছি। তাঁর শক্তি যখন নিঃশেষ হবে তখন আমরা অভিযান চালাবো। তখন আমাদের বাঁধা দেয়ার আর কেউ থাকবে না।’
‘সাংঘাতিক পরিকল্পনা তো!’ লিলির চোখে মুখে বিস্ময়।
‘হ্যাঁ লিলি, তুমি এখন তোমার তাঁবুতে যাও। আমাকে আরো অনেক কিছু চিন্তা করতে হবে। আজ রাতে সম্রাটদের যে কনফারেন্স হবে তাতে এই পরিকল্পনা ও নকশা পেশ করতে হবে আমাকে। আমি এমন নিখুঁত পরিকল্পনা পেশ করতে চাই যাতে কোন ভুল ত্রুটি না থাকে।’
‘মেয়েটির নাম কুলসুম ও তার সাথীর নাম বাকের বিন মুহাম্মদ। কুলসুমকে কোন মুসলিম কাফেলা থেকে লুট করেছিল সম্রাট আরনাত, তারপর নিজের হেরেমে ঢুকিয়ে নিয়েছে। আমাদের এজেন্ট বাকার আরনাতের গাড়ী চালক। ওখানে সে খৃস্টান পরিচয়ে আছে। মেয়েটি পালাতে গিয়ে বাকারের হাতে ধরা পড়লে নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। তথ্যের মূল উৎস সেই মেয়ে। বাকার তাকে ট্রেনিং দিয়ে কাজের উপযোগী করে গড়ে নিয়েছে।’ সুলতান আইয়ুবীর কাছে এ তথ্য তুলে ধরছিল গোয়েন্দা বিভাগের উপ-প্রধান হাসান বিন আবদুল্লাহ।
সুলতান আইয়ুবী হাসান বিন আবদুল্লাহর রিপোর্ট শুনছিলেন। তার চেহারা ক্রমেই কঠোর হয়ে উঠছিল। তিনি রক্তিম চোখে তাকালেন হাসানের দিকে। বললেন, ‘হাসান, কে বলতে পারবে আমাদের কত মেয়ে কাফেরদের কাছে এমনিভাবে বন্দী হয়ে আছে? আফসোস! আমাদের পাপের কারণে আমাদের মেয়েরা আজ কাফেরদের ভোগের সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। আমি আরনাতকে ক্ষমা করবো না। মনে রেখ হাসান, এ মেয়েকে আমি সেখান থেকে উদ্ধার করবো। ইজ্জত বিকিয়ে দিয়ে মেয়েরা আমাকে সাহায্য করুক, এ আমি চাই না। আরে, আমি তো লড়াই করছি আমার বোন ও কন্যাদের সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য। একজন মুজাহিদের জীবন তো তখনই সফল হয় যখন সে তার এক বোনের ইজ্জত বাঁচানোর জন্য ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে।’
‘সুলতান! ক্রাকে আমাদের যে লোক আছে তারাই সময় মতো তাকে বের করে আনবে।’ হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘আক্রার পাদ্রী ও সম্মিলিত খৃস্টান রাজন্যবর্গ নসিবায় তিন দিন ধরে বৈঠক করে যুদ্ধের প্লান ও নকশা তৈরী করেছে। কুলসুম আরনাতের কাছ থেকে সেই পরিকল্পনার পুরোটাই জেনে নিয়েছে ও বাকারকে বলে দিয়েছে। এতোক্ষণ আমি বাকারের পাঠানো খবরই আপনার সামনে পেশ করলাম।’
খৃস্টানরাও সুলতান আইয়ুবীর গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য সচেষ্ট ছিল। তাদের গোয়েন্দা মুশেল, হলব, দামেশক, কায়রোসহ মুসলিম অধ্যুষিত প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ছড়িয়ে ছিল। তাদের মাধ্যমেই খৃস্টানরা জানতে পেরেছিল, মিশর থেকে সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা বেরিয়ে পড়েছে। তারা আরও জানতে পেরেছে, সুলতান আইয়ুবী খুব শিঘ্রই অভিযান চালাচ্ছেন। সে জন্যই তারা প্রতিরোধ ব্যবস্থা দৃঢ় করে সুলতান আইয়ুবীর চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা বিভিন্ন স্থানে সৈন্য সমাবেশ করেছে। তারা এখনও জানতে পারেনি, সুলতান আইয়ুবী কোন দিক থেকে অভিযান চালাবেন আর সমরক্ষেত্র কোনটি হবে? তারা অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই সৈন্য সাজাচ্ছিল। তবে সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য সংখ্যা, বিশেষ করে তাঁর কি পরিমাণ তীরন্দাজ, পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য এবার অভিযানে বের হয়েছে সে পরিসংখ্যান তারা পেয়ে গেছে বলে খুবই উল্লসিত ছিল তারা।
কুলসুম ও বাকারের কাছ থেকে আসা গোয়েন্দার কাছ থেকে হাসান বিন আবদুল্লাহ বিস্তারিত সংবাদ নিয়ে সুলতান আইয়ুবীর কাছে সব বিবরণ তুলে ধরলেন। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিবরণের সাথে এ তথ্যের মিল আছে। এটা তো আমরা আগেই জানতে পেরেছি, খৃস্টানরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এখন ক্রাকের সংবাদ এর সত্যটা আরো দৃঢ় করলো। নতুন খবর যা পেলাম তা হলো, খৃস্টান রাজন্যবর্গ তাদের মতপার্থক্য ভুলে আবারো একত্রিত হয়েছে এবং তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সম্মিলিতভাবেই তারা আমাদের মোকাবেলা করবে। অর্থাৎ এবারও আমাদেরকে খৃস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীর সাথেই যুদ্ধ করতে হবে।’
‘এ ছাড়া নতুন যে তথ্য পেয়েছি তাহলো, এবার আমরা তাদের সামরিক শক্তির একটি সঠিক পরিসংখ্যান পেয়েছি।’ বললেন হাসান বিন আবদুল্লাহ, ‘এবার তাদের বাহিনীতে থাকবে দুই হাজার দুইশো নাইট সৈন্য। নিঃসন্দেহে এটা এক বিরাট শক্তি। নাইটদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত থাকে লোহার পোশাক। এই পোশাকের কারণে তারা থাকে অধিক সুরক্ষিত ও নিরাপদ। নাইটদের ঘোড়াগুলোও সাধারণ সৈন্যদের ঘোড়ার চেয়ে অধিক শক্তিশালী ও দ্রুত গতিসম্পন্ন।’
‘এ নিয়ে আমি মোটেই উদ্বিগ্ন নই। আমি তাদের এমন সময় যুদ্ধের মাঠে নামাবো যখন প্রকৃতিতে থাকবে প্রচণ্ড উত্তাপের দাবদাহ। মাথার উপর থাকবে প্রখর সূর্য, পায়ের নিচের বালি থাকবে আগুনের হলকার মতোই উত্তপ্ত। তখন তাদের পোশাকই তাদের শত্রু হয়ে দাঁড়াবে।’
‘আমরা আরো জানতে পেরেছি, প্রতিটি নাইট বাহিনীর সাথে থাকবে আট হাজার অশ্বারোহী ও ত্রিশ হাজার পদাতিক।’ হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘সৈন্যের এ সংখ্যাটা কিন্তু বিশাল।’
‘এটা জানা থাকায় আমার পরিকল্পনা করতে সুবিধা হবে। তবে আমি অবাক হয়েছি যে খবরটা শুনে তা হলো, আর্মেনিয়ার শাহের সৈন্যও নাকি খৃস্টানদের সাথে যোগ দিচ্ছে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এ সৈন্য ক্রুসেডদের সৈন্যের অতিরিক্ত। আর এদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যারা আমার যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে জানে। সম্ভবত ওদের পরামর্শেই ক্রুসেড বাহিনী এবার আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
‘সে অনুযায়ী আপনি হাতিন এলাকা থেকে যুদ্ধ শুরু করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা খুবই সঠিক ও যুক্তিযুক্ত হয়েছে। কারণ হাতিন অঞ্চল আমাদের জন্য খুবই উপযোগী ও পরিচিত এলাকা।’
‘হে, আমার বন্ধুগণ! এখন আমাদের সামনে সেই সময় উপস্থিত, যখন আমাদের জীবন আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দেয়ার ডাক এসেছে। এ পৃথিবীর আলো বাতাস ডেকে বলছে, ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ো মুজাহিদ। এ ফরজ আমাদের ওপর অর্পণ করেছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত। তিনিই আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, দুশমন ময়দানে এলে খবরদার ঈমানদার, কখনো পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না। আমাদের হত্যা করার জন্য আজ জোট বেঁধেছে দুশমন। এ অবস্থায় কোরআন আমাদের ডেকে বলছে, হে আল্লাহর সৈনিকেরা, ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ো। মারো আর মরো। মানবতার দুশমনদের হাত থেকে বাঁচাও বিপন্ন মানুষকে।’
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী দামেশকে তাঁর বিরাট কামরায় সেনাপতি ও কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ‘ক্ষমতা লাভের জন্য নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করা ও নিজেরাই শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেননি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে পরস্পরের অনেক রক্ত ঝরিয়েছি, ক্ষয় করেছি নিজেদের অনেক শক্তি। এই দীর্ঘ সময়ে শত্রুরা তাদের শক্তি আরও বহু গুণে বৃদ্ধি করে নিয়েছে। ফিলিস্তিন তারা শুধু দখলই করেনি, সেখানে তারা তাদের স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।
জাতি আমাদের হাতে তাদের স্বার্থ ও সম্মান রক্ষার জন্য অস্ত্র তুলে দিয়েছে। আমরাও স্বেচ্ছায় এ কঠিন দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে সৈনিকের খাতায় নাম লিখিয়েছি। জনগণ এই আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে, যেন আমরা শত্রুদের নির্মূল করে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন নিশ্চিত করি। যেন আরবের পবিত্র ভূমি থেকে কাফেরদের বিতাড়িত করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হেফাজত করি।
আমি জানি, আপনারা কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পরেছেন। কিন্তু আমি বলতে চাই, ওটা যুদ্ধ ছিল না, ওটা ছিল ভ্রাতিঘাতি সংঘাত। গৃহযুদ্ধ আমাদের অনেক সময় ও শক্তি নষ্ট করেছে কিন্তু তাতে জাতির কোন কল্যাণ হয়নি। আমরাই আমাদের মেরেছি আর পরস্পর নিঃশেষ হয়েছি। কতিপয় গাদ্দারের কারণে জাতির অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেলো।’
সালাউদ্দিন আইয়ুবী বললেন, ‘বন্ধুরা, আসল যুদ্ধ সবেমাত্র শুরু হতে যাচ্ছে। আপনারা কেন এই যুদ্ধে জড়াতে যাচ্ছেন তা ভাল মতো বুঝে নিন। কোন ব্যক্তির প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা অস্ত্র হাতে নেইনি। কোন দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করাও আমাদের টার্গেট নয়। পাশবিক শক্তি আজ মানবিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। মানুষের জীবন আজ বিপন্ন হতে চলেছে। এ জমিন আল্লাহর, এখানে হুকুম চলবে আল্লাহর। কারণ আল্লাহই ভাল জানেন কিসে মানুষের কল্যাণ আর কিসে অকল্যাণ। মানুষের জীবনকে শান্তিময় করার জন্যই তিনি তাঁর রাসূলের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন ইসলাম।
একমাত্র ইসলামই মানবতার রক্ষাকবচ। এখানে কোন অবাঞ্চিত হস্তক্ষেপ নেই। আছে শাশ্বত কল্যাণ ও মুক্তির দিকনির্দেশনা। রাসূলই আমাদের নেতা। কোরআন আমাদের সংবিধান। আমরা মানবতার স্বার্থে এই শাশ্বত জীবন বিধান গ্রহণ করার জন্যই সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই। আমরা তাই অবিনাশী সত্য ও চির সুন্দরের আপোষহীন সৈনিক। আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সভ্যতার সংরক্ষণ ও মানবতার কল্যাণ। অতএব মনকে জীবন্ত ও সতেজ করে তুলুন। কঠোর শপথ নিন, অশুভ, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। মানুষ বসবাস করবে স্বাধীন পৃথিবীতে, একমাত্র আল্লাহর গোলামী ছাড়া আর কারও গোলামী করতে সে বাধ্য নয়। কেবল এ পথেই মানব জাতি আপন মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
বন্ধুগণ, এই লক্ষ্য হাসিলের জন্যই আমাদের পূর্ব পুরুষরা ছুটে গেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। ইসলামের বিজয় নিশান উড়িয়ে দিয়েছেন দেশ হতে দেশান্তরে। তারেক বিন জিয়াদ স্পেনের মাটিতে জ্বেলেছেন সত্যের আলো। মুহাম্মদ বিন কাসিম এই আলো নিয়েই পৌঁছেছিলেন সুদূর ভারতে। তাদের পদচিহ্ন ধরে ভবিষ্যৎ বংশধরদের দায়িত্ব ছিল আল্লাহর বাণী সেখান থেকে আরও দূরদূরান্তে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু আল্লাহর সৈনিকরা যখন গাফলতির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো তখন আল্লাহর রাজত্ব ক্রমশ সংকীর্ণ হতে শুরু করলো।
আফসোস! শত্রুরা এখন আমাদের ঘরে এসে বসে আছে। এখন তারা আমাদের কাবাঘর ও নবীর (সা.) রওজা মুবারক ধ্বংস করার পায়তারা করছে। কেমন করে এমনটি সম্ভব হলো? ব্যক্তির মধ্যে যখন বাদশাহ হওয়ার খায়েশ জাগে আর মানুষের মধ্যে সংকীর্ণ জাতীয়তার উন্মাদনা সৃষ্টি হয় তখন মানবতা বিপর্যস্ত হয়। তখন ইসলামের বিকাশ না হয়ে বরং তা সংকীর্ণ হতে থাকে। শাসক তার গদী ও ক্ষমতার লোভে ইসলামই বিসর্জন দেয় না, নিজের লজ্জাবোধও বিসর্জন দিয়ে দেয়।
আজ বিশ্বব্যাপী সভ্যতার সংকট ও সার্বিক অবনতির কারণ শাসকবৃন্দের ক্ষমতা ও গদীর নেশা এবং মানুষের সীমাহীন লোভ ও ধনরত্নের প্রতি প্রবল আগ্রহ। প্রকৃত ঈমানদার দুনিয়ার ওপর কর্তৃত্ব করে আর এখন দুনিয়া আমাদের উপর চেপে বসে আছে। দুনিয়ার মোহে আমরা পরকালের পরিণতির কথাও ভুলে গেছি। কে মানবতার প্রকৃত বন্ধু আর কে শত্রু সে বিচারের বিবেকও হারিয়ে ফেলেছে মানুষ। ফলে আমাদের বন্ধু ও শত্রুর পরিচয়ও আজ কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে।
এবার সামরিক শক্তির প্রসঙ্গে আপনাদের কিছু বলতে চাই। জাতির ভাগ্য অস্ত্রের মুখেই নির্ধারিত হয়। যাদের হাতে অস্ত্র থাকে ইতিহাস লেখা হয় সেই সব মুজাহিদদের নামে। যতদিন মুজাহিদরা নিজেদেরকে জাতির সেবক মনে করে ততোদিন তারা থাকে অজেয়। কিন্তু যখন সেই বাহিনীর সেনাপতি নিজেকে বাদশাহ ভাবতে আরম্ভ করে আর তার মুজাহিদরা আত্মতুষ্টির ঢেকুর তুলতে শুরু করে তখন তাদের বাহুতে আর কোন শক্তি থাকে না।
তাদের খাপ খোলা তরোয়ালগুলো ঢুকে যায় খাপের ভেতর। তাদের মন থেকে হারিয়ে যায় জাতির সম্মান ও গৌরব রক্ষার আবেগ। তাদের অধঃপতন হতে হতে এই পর্যায়ে পৌঁছে যে, অবশেষে তারা নিজের ঈমানের দাবী পূরণেও আর সক্রিয় থাকে না। ধর্মকে তখন তারা ব্যবহার করতে শুরু করে প্রজাদের ধোঁকা দেয়ার কাজে। গোপনে শত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করে তারা। প্রজাদের উপর নিজেদের শাসন চালাতে ব্যবহার করে আল্লাহর নাম।
আমরা আজ ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য আপন বাড়ী ঘরের মায়া ত্যাগ করে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য একত্রিত হয়েছি। আমরা ক্ষমতা ও সম্পদের মোহ থেকে নিজেদেরই কেবল মুক্ত করিনি, যারা ক্ষমতা ও সম্পদের পূজারী তাদের সমুচিত শিক্ষা দিয়ে জাতিকে মুক্ত করেছি তাদের কবল থেকে। এতদিন জাতির আস্তিনের ভেতর লুকিয়েছিল যে বিষধর সাপ আমরা তার মাথা গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। এখন যদি আমরা হেরে যাই তবে তার কারণ একটাই হবে, আর তা হলো আমাদের নিয়তের ত্রুটি ও গণ্ডগোল। এ জন্যই আমি আপনাদের ময়দানে পা বাড়াবার আগে এ ব্যাপারে সতর্ক করার প্রয়োজন বোধ করছি। আমরা যদি আমাদের নিয়তকে পরিচ্ছন্ন করতে পারি, আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহর রহমাত আমাদের বিজয়ের জামিনদার হয়ে যাবে।’
সুলতান আইয়ুবী এমন আবেগময় দীর্ঘ বক্তৃতায় অভ্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু তিনি যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে অভিযানে বেরোতে যাচ্ছেন সে সম্পর্কে সকলকে মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য এ ভাষণ জরুরী হয়ে পড়েছিল।
উপস্থিত সবাই ছিলেন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সেনাপতি ও কমান্ডার। এদের মধ্যে ছিলেন সেনাপতি মুজাফফরউদ্দিন। যিনি একজন যোগ্য ও বীর সেনাপতি হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এক সময় তিনি সুলতানের সঙ্গ ছেড়ে তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন এবং সুলতানের বিরুদ্ধে লড়াইতেও অংশ নিয়েছিলেন। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার ফিরে এসেছেন সুলতানের বাহিনীতে। এ ছাড়া ছিলেন সেনাপতি তকিউদ্দিন, আফজালউদ্দিন, ফররুখ শাহ এবং মালেক আদিলের মত বীর ও যোগ্য সেনাপতিবৃন্দ। এদের কেউ কেউ ছিলেন সুলতান আইয়ুবীর নিজ বংশের এবং রক্ত সম্বন্ধীয় আত্মীয়। আর ছিলেন সেনাপতি কাকবুরী, যিনি সুলতান আইয়ুবীর দক্ষিন হস্ত রূপে পরিচিত ছিলেন। এদের মধ্যে এমন কেউ ছিল না, যার কৌশল, দক্ষতা ও তেজস্বীতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এমনি একদল সুদক্ষ সেনাপতি নিয়ে সুলতান আইয়ুবী ফিলিস্তিন অভিমুখে অভিযান চালাতে যাচ্ছিলেন। তার চোখের সামনে তখন ভাসছিল মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস, যেখান থেকে আমাদের প্রিয় নবী মেরাজে গমন করেছিলেন।
এ অভিযান ছিল খুবই বিপদসঙ্কুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। ক্রুসেডদের সামরিক শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্বই কেবল বেশী ছিল এমন নয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থার দিক দিয়েও ক্রুসেড বাহিনী ছিল সুবিধাজনক অবস্থানে। ক্রুসেডাররা উল্লসিত ছিল এ জন্য যে, তারা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট মজবুত ও সংহত করে নিতে পেরেছে। তারা নিজেদের মাটিতে থেকে যুদ্ধ করবে, ফলে তাদের রসদের ঘাটতি পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তার এলাকা থেকে বহু দূরে যুদ্ধ করতে আসবে। অনেক বাঁধা মাড়িয়ে দীর্ঘ পথ তাদেরকে রসদপত্র বহন করে আনতে হবে।
যুদ্ধের স্বাভাবিক বিবেচনায় সামরিক কৌশলগত দিক থেকেও আক্রান্ত বাহিনীর চাইতে আক্রমণকারী বাহিনী থাকবে বেকায়দায়। এ জন্য আক্রমণকারী সৈন্য সংখ্যা আক্রান্ত বাহিনীর ছয়গুন না হলেও দ্বিগুণ তো অবশ্যই হওয়া উচিত। কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী দ্বিগুন তো দূরের কথা, সমানও ছিল না। বরং খৃস্টান বাহিনীর চাইতে অনেক কম সৈন্য নিয়েই সুলতানকে যুদ্ধযাত্রা করতে হচ্ছিল।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, এ যুদ্ধ অনেক সময় নেবে। সুলতান পরাজয় মেনে না নিয়ে ঝটিকা আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত রাখবেন খৃস্টানদের। আর খৃস্টানরা উন্নত অস্ত্র, বিপুল রসদসম্ভার, অধিক সৈন্য আর আপন ভুবনে যুদ্ধ করার সুবিধার কারণে পরাজয় মেনে না নিয়ে একের পর এক প্রতিহত করে যাবে সুলতানের প্রতিটি আক্রমণ। এই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আইয়ুবীর সৈন্যরা তৈরী হচ্ছিল। তারা ভাবছিল, হয়তো দীর্ঘ দিন আর বাড়ী ফেরা সম্ভব হবে না। হয়তো এ জীবনে আর কোন দিনই বাড়ী ফিরতে পারবে না তারা। কিন্তু তাতে কোন আফসোস ছিল না তাদের।
সুলতান আইয়ুবীও তাদেরকে এ কথাটিই বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি সৈন্য ও সেনাপতিদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন, তারেক বিন জিয়াদের ইতিহাস। বলছিলেন, ‘বিজয় ছিনিয়ে আনতে হলে আমাদেরও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সমস্ত নৌযানগুলো আগুন লাগিয়ে পুড়ে ফেলার মত সাহস ও হিম্মত রাখতে হবে। পিছু হটার সব পথ বন্ধ না করলে বিজয় আমাদের পদচুম্বন করবে না। এই অনুভূতি নিয়ে ময়দানে পা বাড়াতে হবে আমাদের, এটাই আমার জীবনের শেষ যাত্রা, আর কোন দিন আমরা কেউ স্বদেশ ও স্বজনদের কাছে ফিরে আসতে পারবো না।’
কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘সুলতান আইয়ুবী বিশ্বাস করতেন, কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ও দুনিয়ায় আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করা এমন ফরজ, যে দায়িত্ব আল্লাহ তাকে অর্পন করেছেন। আল্লাহ মুসলমানদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার যে আদেশ দান করেছেন এটাই তার জীবনের সবচে বড় ফরজ। এ দায়িত্ব দুনিয়ার সকল কাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। অধিকাংশ দেশ আল্লাহর আইনের শাসনে আনয়ন করা ও মানব জাতিকে আল্লাহর আনুগত্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করাই একজন মুমিনের প্রকৃত কাজ। তিনি সমস্ত সৈন্য বাহিনীকে একত্রিত করে তাদের মধ্যে এই চেতনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন।
সুলতান আইয়ুবীর অন্তর দৃষ্টি ভবিষ্যতের আলো-অন্ধকার যেন পুরোটাই দেখতে পাচ্ছিলো। সেই আলোকে তিনি হাতিন অঞ্চলকেই আগামী যুদ্ধের মোক্ষম ক্ষেত্র বিবেচনা করলেন।
ফিলিস্তিনের এক অখ্যাত পল্লী ছিল হাতিন। কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর সংকল্প ও পরিকল্পনার কারণে এই অঞ্চলটি পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন মহিমা ও ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। খৃস্টান ঐতিহাসিকরা সুলতান আইয়ুবীর চিন্তা ও দূরদর্শিতা দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন। ক্রুসেড বাহিনীর সম্মিলিত শক্তিকে হাতিন অঞ্চলে টেনে আনা, অভাবিত চাল ও রণ কৌশলের মাধ্যমে বিশাল খৃস্টশক্তিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে সুলতান আইয়ুবী নিজেকে এক দিগ্বিজয়ী সেনানায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। খৃস্টান রাজন্যবর্গের সম্মিলিত বাহিনীর মাত্র একটি দল ছাড়া সব কয়টি দল এ যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে এবং পরাজিত বাহিনীর অসংখ্য সৈন্য বন্দীত্ব কবুল করে নিজেদের আত্মরক্ষা করতে বাধ্য হয়।
সামরিক বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিকগণ এ যুদ্ধে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগ এবং তার কমান্ডো বাহিনীর বিস্ময়কর তৎপরতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে বাকার বিন মুহাম্মদ ও কুলসুমের তৎপরতা ছিল অবিস্মরণীয়। বাকার মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও প্রয়োজনীয় গোপন তথ্য সংগ্রহ করে তা সুলতান আইয়ুবীকে পৌঁছে দিয়েছিল। কুলসুম রাজকীয় বিলাসিতা ও সুখের জীবন উপেক্ষা করে আইয়ুবীর সৈন্যদের জন্য গোপন তথ্য সরবরাহ করেছে। তারা এবং তাদের মতো অসংখ্য গোয়েন্দা, যাদের নাম মানুষের দৃষ্টির অন্তরালেই রয়ে গেছে, তাদের ত্যাগ, কোরবানী ও শাহাদাতের বিনিময়ে রচিত হয়েছে নতুন ইতিহাস। আল্লাহর রাহে জীবন বিলিয়ে দেয়ার তামান্না নিয়ে যেসব মুজাহিদ হাতিনের ময়দানে রক্ত দিয়েছে তাদের ত্যাগের বিনিময়ে হাতিনের মত নগণ্য গ্রাম ইসলামের ইতিহাসে স্মৃতির নিদর্শন হয়ে আছে।
সুলতান আইয়ুবী সর্বদা জুম্মার দিনে তার অভিযানের সূচনা করতেন। কারণ এ দিনটিকে তিনি আল্লাহর অধিক পছন্দনীয় ও পবিত্র দিন মনে করতেন। এই পবিত্র দিনে প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহর কাছে নতজানু থাকে। যখন এই দিনে সৈন্যরা অভিযানে বের হয় তখন সমগ্র জাতি আল্লাহর কাছে তাদের সফলতা কামনা করে দোয়া করতে থাকে।
হাতিনের ময়দানে যাওয়ার জন্যও তিনি জুমার দিন বেছে নিলেন। দিনটি ছিল ১১৮৭ সালের ১৫ মার্চ। সুলতান আইয়ুবী তার বিশাল বাহিনীর মাত্র একটি ব্যাটেলিয়ান সঙ্গে নিয়ে ক্রাকের কাছে ক্যাম্প করে বসলেন।
খৃস্টান গোয়েন্দারা দ্রুত এই খবর সম্মিলিত ক্রুসেড বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিল। গোয়েন্দারা বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী ক্রাকের কাছে অবস্থান নিয়েছেন। সম্ভবত তিনি ক্রাক শহর অবরোধ করবেন।’
কিন্তু সুলতানের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। এটা ছিল হজ্জের কাফেলা যাতায়াতের সময়। মিশর ও সিরিয়ার হজ্জ কাফেলাগুলো এই পথে যাতায়াত করতো। খৃস্টান দুর্বৃত্তরা এই সব কাফেলায় আক্রমণ চালাতো। এ সব আক্রমণ চালানো হতো ক্রাকের খৃস্টান সরকারের সহায়তায়। ক্রাকের সম্রাট শাহ আরনাত কুখ্যাত লুটেরা হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল।
সুলতান আইয়ুবী চাচ্ছিলেন হজ্জ কাফেলাগুলো যেন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে। এ জন্যই তিনি ক্রাকের কাছে গিয়ে অবস্থান নিলেন। তিনি জানতেন, তার এ উদ্দেশ্যের কথা খৃস্টানরা ধারনা করবে না। তারা ভাববে, সুলতান তাদের ওপর আক্রমণ করার জন্যই ওখানে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে মুসলিম কাফেলায় আক্রমণ করার চিন্তা যেমন বাদ দেবে তেমনি আক্রান্ত না হওয়ায় তারা থাকবে অজানা আশঙ্কা ও পেরেশানীতে। এতে দুশমনের মনোবল ভেঙ্গে পড়বে।
ক্রাকের সন্নিকটে অবস্থান নেয়ায় সুলতানের দুটো উদ্দেশ্যই পূরণ হলো। ক্রুসেড বাহিনী সুলতানের চালাকি বুঝতে পারলো না। তারা ক্রাকের প্রতিরক্ষা জোরদার করার জন্য তাদের বাহিনীকে সদা প্রস্তুত অবস্থায় বসিয়ে রাখলো কেল্লার ভেতর। এদিকে হজ্জ কাফেলাগুলো নির্বিঘ্নে এগিয়ে গেল কাবার দিকে। সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতি ও কমান্ডারদের বুঝিয়ে দিলেন, কাফেলাগুলো চলে গেলে তাদের কি করতে হবে।
সুলতানের ক্রাক অবরোধের ব্যাপারটি ছিল বেশ মজার। একদিন গভীর রাতে ক্রাকের রাজমহলে হঠাৎ যেন ভুকম্পন শুরু হয়ে গেল। শাহ আরনাতকে মাঝরাতে জাগানো হলো। তাকে বলা হলো, সুলতান আইয়ুবী ক্রাক শহর অবরোধ করে বসেছেন। শহর প্রাচীরের বাইরে সুলতানের বিশাল বাহিনী ক্যাম্প করে বসেছে। শাহ আরনাত হতচকিত হয়ে উঠে বসলেন। ভীতচকিত কণ্ঠে বললেন, ‘কি বললে? সুলতান আইয়ুবী শহর অবরোধ করেছেন?’
কুলসুম তখন তার পাশেই ছিল। সে শাহ আরনাতের সাথে দৌড়ে শহরের মেইন গেটে গেল। সেখানে দেয়ালের উপর উঠে দেখলো প্রাচীরের বাইরে নিরাপদ দূরত্বে শত শত মশাল জ্বলছে। বেশীর ভাগ মশালই নড়াচড়া করছে, অর্থাৎ সেখানে তাঁবু টানানো হচ্ছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ঘোড়ার চি হি হি শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
শাহ আরনাত আইয়ুবীর অবরোধ ঠেকাতে শহরের প্রাচীরের উপর সৈন্য সমাবেশ করলেন। শহরের মেইন গেটের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দৃঢ় করলেন। শাহ আরনাত ছুটাছুটি করে সৈন্যদের নানা রকম নির্দেশ দিচ্ছিলেন, কুলসুমের দিকে তার কোন খেয়াল ছিল না।
কুলসুম ফিরে গেল মহলে। শাহ আরনাতের রক্ষীরা তার নির্দেশে ছুটাছুটি করছিল। মহলের পাশে দাঁড়িয়েছিল শাহী গাড়ী। এ গাড়ীতে করেই কুলসুম প্রতিদিন ভ্রমণ করতে যায়। গাড়ীর পাশে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাকার বিন মুহাম্মদ। মোট কথা, ক্রাকের রাজমহলের প্রতিটি ব্যক্তিই তখন নিজ নিজ দায়িত্বে তৎপর ছিল।
কুলসুম আদেশের ভঙ্গিতে বললো, ‘সায়বল। গাড়ী এদিকে আনো।’
বাকার যখন গাড়ী আনলো, তখন কুলসুম তার ওপর উঠে বসলো ও গাড়ী একদিকে চালাতে হুকুম দিল। শাহ আরনাতের অন্দর মহলের মেয়েরা সবাই ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। তারা মহলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল রক্ষীদের ছুটাছুটি। হঠাৎ তারা দেখতে পেলো, প্রিন্সেস লিলি গাড়ীতে উঠে গাড়ী চালককে গাড়ী চালাতে হুকুম করছে। তাদের মধ্যে এক মেয়ে রাগে দাঁত পিষে বললো, ‘এ হতভাগী কোন মুসলমানের বেটি, অথচ সে নিজেকে রাজরাণী মনে করে। তাকে শায়েস্তা করতেই হবে।’
‘সময় এসেছে।’ অন্য এক মেয়ে বললো, ‘সুলতান আইয়ুবীর অবরোধ খুব শক্ত ও ভয়ংকর হয়। তিনি অগ্নিবান নিক্ষেপ করবেন। মেনজানিক দিয়ে পাথর নিক্ষেপ করবেন। তখন শহরের মধ্যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে। সে সময় আমরা ওই মুখপোড়া ডাইনীকে শায়েস্তা করতে পারবো। দেখবে দু’দিনেই তার দেমাগ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।’
‘তুমি আর বাহাদুরী করো না। তুমি না বলেছিলে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে যে জেনারেল তাকে দিয়ে ঐ মেয়ের দেমাগ ঠাণ্ডা করে দেবে? কই, কিছুই তো করতে পারলে না।’ বললো অন্য আরেক মেয়ে।
‘তিনি সুযোগ করে উঠতে পারেননি। এবার দেখো ঠিকই সুযোগ এসে যাবে।’ আগের মেয়েটি বললো, ‘আগামীকাল সন্ধ্যা নাগাদ শহরের কি অবস্থা হয় দেখে নিও। সম্রাট আর শাহজাদী লিলির দিকে তাকাবারও ফুসরত পাবে না।’
কুলসুম গাড়ী নিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি এক স্থানে পৌঁছলো। গাড়ী দাঁড় করিয়ে সে বাকারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাদের কোন লোক ভেতর থেকে কি ফটক খোলার ব্যবস্থা করতে পারবে?’
‘সময় মতো চেষ্টা করে দেখা যাবে।’ বাকার বললো, ‘এই সৈন্য বাহিনী আমাদের কিনা তা আমি নিশ্চিত নই। আমি বিস্মিত হচ্ছি এই ভেবে যে, যদি এরা আমাদের বাহিনীই হবে তবে তারা আগে কেন সংবাদ দেয়নি। সুলতান আইয়ুবী তো এমন ভুল করেন না। সকাল হলেই স্পষ্ট জানা যাবে, এ বাহিনী আসলে কার?’
‘যদি এরা সুলতানের বাহিনী হয় তবে কি আমরা এখান থেকে পালাতে পারবো?’ কুলসুম জিজ্ঞেস করলো।
‘সেটা অবস্থার ওপর নির্ভর করবে।’
‘এই বিশৃংখল অবস্থায় আমি আরনাতকে সহজেই হত্যা করতে পারি।’
এমন কাজ খবরদার করবে না।’ বাকার বললো, ‘সৈন্যরা শহরে প্রবেশ করার সময় আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তিনি পালাতে না পারেন।’
‘তাহলে আমি এখন কি করবো? এ অবস্থায় আমাদের কি কিছুই করণীয় নেই?’
‘আছে। তবে তার আগে দেখতে হবে এটা সুলতানের বাহিনী কিনা? আর শাহ আরনাত কোন দিক থেকে কিভাবে অভিযান চালান তাও আমাদের দেখতে হবে।’
কুলসুম আবেগ ও উত্তেজনায় টগবগ করছিল। ঠিক কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না সে। তার অস্থিরতা লক্ষ্য করে বাকার বললো, ‘এখন অবস্থা অন্য রকম হয়ে গেছে। আমি খবর পেয়েছিলাম তিনি সৈন্যদের নিয়ে গেলিলি সাগরের দিকে যাবেন। কিন্তু…’
‘কিন্তু তিনি ক্রাক অবরোধ করে ঠিক কাজই করেছেন। এখন আমাদের উচিত তাকে সহায়তা করা।’
‘থামো। এতো উতলা হয়ো না। নিজেকে সংযত করো। কি করতে হবে সময় মতো আমি তোমাকে বলবো। চলো। এখানে আর বেশীক্ষণ দেরী করা ঠিক হচ্ছে না।’ বাকার বললো, ‘চলো ফিরে যাই।’
এই হট্টগোলের মধ্য দিয়েই কেটে গেল রাত। প্রভাতের আলো ফুটতে শুরু করলো পূর্ব দিগন্তে। ক্রাকের প্রাচীরের উপর দূরপাল্লার কামানগুলো অগ্নিবর্ষণ করার জন্য মুখ হা করে বসেছিল। মেনজানিকগুলো প্রস্তুত হয়েছিল পাথর ও অগ্নিবান নিক্ষেপের জন্য। সৈন্যরা প্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল সম্রাট আরনাতের নির্দেশের অপেক্ষায়।
সম্রাট শাহ আরনাত প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিলেন সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর দিকে। যখন তিনি দেখতে পেলেন ওখানে মুসলিম বাহিনীর নিশান উড়ছে তখন তিনি নিশ্চিত হলেন এটা সুলতান আইয়ুবীরই বাহিনী। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন না, সুলতান আইয়ুবী এই বাহিনীর সাথে আদৌ আছেন কি নেই।
তিনি বাহিনীর সজ্জা দেখে বিস্মিত হলেন। বাহিনীর সজ্জা মোটেও অবরোধের মত নয়। তারা তাঁবু টানিয়ে ক্যাম্প করেছে ঠিক, কিন্তু সৈন্যরা প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছে। হামলা করার কোন তৎপরতাই তাদের মধ্যে নেই।
সেদিনটি কেটে গেল নির্বিঘ্নে। কোন দিক থেকেই কোন হামলা হলো না। এভাবেই কাটলো আরও পাঁচটি দিন। আরনাতের অপেক্ষা অস্থিরতায় পরিণত হলো। কিন্তু তিনি জানতে পারলেন না, রাতে সুলতান আইয়ুবী অশ্বপৃষ্ঠে আরোহন করে তার বিশ্বস্ত কমান্ডো সৈন্যদের রাস্তায় দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন, যে রাস্তায় হাজীরা যাতায়াত করবে।