» » রক্তস্রোত

বর্ণাকার
🕮

হাতিন ও তার আশপাশে মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে পড়েছিল খৃস্টানদের লাশ। এমনকি যে সব আহত সৈনিকের পালাবার শক্তি ছিল না তারাও অসহায়ভাবে পড়েছিল ময়দানে। মরণপথের এসব আহত যাত্রীরা যন্ত্রনায় ছটফট করছিল, কিন্তু তাদের উদ্ধার করার কেউ ছিল না আশপাশে। সামান্য আহত সৈন্যরা মারা গেছে হতাশা ও পিপাসায়। নাইটদের লোহার পোষাকগুলো তপ্ত কড়াই হয়ে উঠার ফলে পোষাকই হয়ে উঠেছিল তাদের মৃত্যুর কারণ। আহতদের দেখার কেউ ছিল না, তাদের পানি পান করানো ও সেবারও কেউ ছিল না। এত বিপুল পরিমাণ আহত সৈন্যের সেবা ও লাশের সৎকার করার মতো সুযোগ ছিল না মুসলমানদেরও। কারণ প্রচণ্ড যুদ্ধে তাদেরও অনেক সাথী আহত ও শহীদ হয়ে গিয়েছিল।

ঐতিহাসিক এন্থনী জুলিয়েট সে যুগের ঐতিহাসিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, হাতিন রণাঙ্গনে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজারেরও অধিক। এত লাশ উঠানোর কোন ব্যবস্থা ছিল না। তাদের যে সব সাথী বেঁচেছিল তারা হয় যুদ্ধবন্দী ছিল নয়তো ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। এন্থনী জুলিয়েট আরো লিখেছেন, তাদের লাশ শকুন, কাক ও শিয়ালরা ভক্ষন করছিল। লাশের তুলনায় শিয়াল ও শকুন ছিল কম। তাই যে সব লাশ শিয়াল ও শকুন খেতে পারেনি কয়েক দিনের মধ্যে সেগুলো শুকনো কংকালে পরিণত হয়েছিল। পাহাড়ের চূড়া, টিলা আর সমতল ময়দান সর্বত্র সেই সব কংকাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল দীর্ঘদিন। প্রথমে কংকালগুলো ছিল কালো, কিন্তু অল্পদিনেই রোদের প্রচণ্ড উত্তাপে সেই অস্থিগুলো সাদা ও ফ্যাকাসে হয়ে যায়।

হাতিনের এই যুদ্ধের ফসল কেটেছিলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। সে অঞ্চলের লাশগুলো পরিষ্কার করার কোন তাগিদ তিনি অনুভব করেননি, সুযোগও পাননি। কারণ সেখানে থাকার মতো অবসর তার ছিল না। তাঁর গন্তব্য ছিল জেরুজালেম। সেখানকার পবিত্র মসজিদ বায়তুল মোকাদ্দাস তাকে হাতছিনি দিয়ে ডাকছিল। সেই গন্তব্যে পৌঁছার জন্য তিনি ছিলেন বেকারার।

কিন্তু বায়তুল মোকাদ্দাস পৌঁছার আগে তিনি আক্রা দখল করতে চাচ্ছিলেন। মুসলমানদের জন্য যেমন মক্কা মুয়াজ্জমা, খৃস্টানদের কাছে তেমন পবিত্র ভূমি আক্রা। কারণ ওখানেই বাস করতেন খৃস্টানদের পবিত্র ক্রুশের রক্ষক মহান পাদ্রী। খৃস্টানদের বিশ্বাস মতে, তাদের সবচে বড় ক্রুশটিও ওখানেই ছিল।

ক্রুসেড যোদ্ধারা যেই ক্রুশ ছুঁয়ে শপথ করে ময়দানে আসতো তাদের সেই পবিত্র ক্রুশটি এখন পড়ে আছে সুলতান আইয়ুবীর তাঁবুর পাশে। আর এই ক্রুশের রক্ষক মহান পাদ্রীর লাশ পড়ে আছে হাতিনের ময়দানে। ফলে আক্রার খৃস্টানরা ভুগছিল চরম আতঙ্কে। এই আতঙ্কের সুযোগ নিতে চাচ্ছিলেন সুলতান আইয়ুবী।

‘আমাদের এখন সোজা আক্রার ওপর আক্রমণ চালানো উচিত।’ সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতিদের বললেন, ‘আল্লাহর অশেষ শোকর যে, তিনি আমাদের বিজয় দান করেছেন।’

তিনি সবার ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে হেসে বললেন, ‘তোমরা এ কথা মনে করো না, তোমাদের ক্লান্তি ও অবসাদ সম্পর্কে আমার কোন অনুভূতি নেই। তোমাদের এ ত্যাগের মূল্য আল্লাহ অবশ্যই দান করবেন। আমরা যদি এখন বিশ্রাম নিতে বসি তবে খৃস্টানরা আবার একত্রিত হয়ে শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পেয়ে যাবে। আমি তাদের এই ক্ষত শুকাতে দিতে চাই না।’

সেনাপতিরা বিস্মিত হয়ে শুনছিলেন সুলতান আইয়ুবীর কথা। তাদের আশা ছিল, সুলতান এবার বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে অভিযান চালানোর আদেশ দেবেন। কিন্তু তিনি আক্রা দখলের ইচ্ছা প্রকাশ করায় তারা অবাক হলেন।’

সুলতানের পিছনেই বিরাট ক্রুশটি দাঁড় করানো ছিল। তিনি ক্রুশটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। সবাই নিরব। তিনি হঠাৎ সেনাপতিদের দিকে ঘুরে বললেন, ‘বন্ধুগণ! এটা ঈমান বা বিশ্বাসের যুদ্ধ! এটা সত্য ও মিথ্যার সংঘর্ষ। এই ক্রুশের সাথে লেগে থাকা রক্তের চিহ্ন দেখো! এ রক্ত হযরত ঈসা (আ.) এর নয়। এ রক্ত সে পাদ্রীরও নয় যিনি খৃস্টান জগতের মহান ক্রুশের রক্ষক ছিলেন। এ রক্ত সেই সব খৃস্টান নেতাদের, যারা ক্রুশের মর্যাদা রক্ষার কথা বলে অগণিত বনি আদমকে টেনে এনেছে যুদ্ধের ময়দানে। এরা সবাই আল্লাহর সৈনিকদের হাতে মারা গিয়েছে। অতএব এ রক্ত কোন ব্যক্তির নয়, এ রক্ত ভিত্তিহীন বিশ্বাস ও আকিদার।’

সুলতান আইয়ুবী আবেগময় কণ্ঠে বললেন, ‘তোমরা যখন শত্রুর সাথে যুদ্ধ করছিলে, যখন তোমাদের ওপর অবিরাম তীর বর্ষণ হচ্ছিল, যখন শত্রুর মেনজানিক তোমাদের উপর আগুন ও পাথর নিক্ষেপ করছিল, সে সময় জাতির মাতা-ভগ্নি-শিশুসহ আবালবৃদ্ধবনিতা হাত তুলে তোমাদের সাফল্যের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছে। আমি এ জন্যই সকল যুদ্ধ যাত্রা শুক্রবারে করি যাতে জাতির মঙ্গল কামনা তোমাদের সঙ্গে থাকে এবং সেই দোয়ার বরকতে তোমরা বিজয় লাভ করতে পারো।

এ বিজয় প্রমাণ করে, তোমাদের ওপর আল্লাহ খুশী আছেন। এটা আমাদের মহান বিশ্বাস ও ঈমানের বিজয়। আমি তোমাদের কেন এ কথা বলছি? বলছি এ জন্য যে, এভাবেই আমরা আমাদের ঈমানকে আরো দৃঢ় ও মজবুত করে নিতে চাই, যাতে আমরা আল্লাহর রশি আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে পারি।

তোমরা হয়তো বিস্মিত হচ্ছো, আমি আক্রার উপর আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি বলে। এর পেছনে কোন আবেগ নেই এমন নয়। খৃস্টানরা একবার মক্কা ও মদীনার দিকে অভিযান চালিয়েছিল। সম্রাট শাহ আরনাত ও কাউন্ট রিজনাল্ট মক্কা মুয়াজ্জমা থেকে মাত্র চার মাইল দূরে ছিল। আমি সম্রাট আরনাতের মক্কা আক্রমণের দূরভিসন্ধির প্রতিশোধ নিয়েছি। এখন খৃস্টান শাসকদের দুঃস্বপ্ন মিটিয়ে দেয়া বাকি। আক্রা তাদের মক্কা। আক্রা দখল করে আমি তাদের মনোবল গুড়িয়ে দিতে চাই। আজও তারা মসজিদুল আকসা অপবিত্র করছে। তাই আমাদের দৃষ্টি আটকে আছে বাইতুল মোকাদ্দাসে। কিন্তু ওখানে পৌঁছতে হলে আগে আক্রা দখল করা প্রয়োজন। এতে খৃস্টানদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে এবং বাইতুল মোকাদ্দাস উদ্ধার করা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।’

সুলতান আইয়ুবীর হাতে যুদ্ধের নকশা ছিল। তিনি সেটি খুলে সবার সামনে মেলে ধরলেন। হাতিনের ওপর আঙ্গুল রেখে বললেন, ‘আমরা এখন এইখানে।’ তিনি আঙ্গুল আক্রার দিকে এমনভাবে নিয়ে গেলেন, যেন তিনি কিছু কাটছেন। তারপর বলতে লাগলেন, ‘আমি খৃস্টানদের রাজ্যকে দুটি অংশে বিভক্ত করে তার মাঝখানে গিয়ে বসবো। আক্রা অধিকার করে টায়ের, বৈরুত, হায়ফা, আসকালান ও সাগর কূলের ছোট বড় সমস্ত শহর ও গ্রামগুলোকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে নেবো। একটি খৃস্টানকেও, সে সৈন্য হোক বা বেসামরিক লোক, এ অঞ্চলে থাকতে পারবে না। কারণ উপকূলবর্তী এলাকাগুলো যুদ্ধের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের কিছু সম্রাট এখানকার খৃস্টানদের সাহায্যের জন্য ছুটে আসতে পারে। তারা এলে আসবে এই সমুদ্র পথেই। তাই উপকূল অঞ্চল থাকতে হবে তোমাদের দখলে, যাতে শত্রুদের কোন সমুদ্র তরী কূলে ভিড়তে না পারে। এখান থেকেই আমরা বায়তুল মোকাদ্দাসের যুদ্ধ পরিচালনা করবো।’

ফিলিস্তিন (বর্তমান ইসরাইলসহ) ও লেবাননের মানচিত্র দৃষ্টির সামনে তুলে ধরলে এখনো দেখা যায় গ্যালিলি সাগরের পাড়ে হাতিন অঞ্চল। তার বিপরীত দিকে সাগরের উপকূলে আক্রা শহর অবস্থিত। দক্ষিণে জেরুজালেম ও বায়তুল মোকাদ্দাস। হাতিন থেকে আক্রা মাত্র পঁচিশ মাইল দূরে আর জেরুজালেম সত্তর মাইল তফাতে অবস্থিত। বর্তমানে ফিলিস্তিন ও লেবাননে খৃস্টান আধিপত্য চলছে। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পরিকল্পনা ছিল, হাতিন থেকে আক্রা পর্যন্ত তিনি এমন অভিযান চালাবেন যাতে রাস্তার পাশে যে সব এলাকা পড়বে সেখানে মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। সেখানে শুধু মুসলমানদেরই আবাসভূমি থাকবে। অন্য কোন ধর্মের লোক এই সাগর উপকূলে থাকবে না। যুদ্ধ বিশেষজ্ঞগণ তার পরিকল্পনাকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। মুসলমানরা এই পরিকল্পনার ওপর টিকে থাকতে পারলে বর্তমান ফিলিস্তিনের চেহারা হতো ভিন্ন রকম।

সুলতান আইয়ুবী খৃস্টান শক্তিকে দুই ভাগে ভাগ করতে চেয়েছিলেন। কারণ তাঁর সৈন্য বাহিনী খৃস্টানদের তুলনায় ছিল কম। যদিও এই অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়েই তিনি বিশাল খৃস্টান বাহিনীর প্রভূত ক্ষতি সাধন করেছেন, তবু তিনি চাচ্ছিলেন খৃস্টশক্তিকে বিভক্ত করে ফেলতে, যাতে তারা কখনো তীব্র চাপ সৃষ্টি করতে না পারে।

‘আক্রার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী।’ সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতিদের বললেন, ‘আমাদের গোয়েন্দারা জানিয়েছে, সেখানে যুবক ও কর্মঠ মুসলমানদের তারা বন্দী করে বেগার খাটাচ্ছে। শিশু ও মেয়েসহ সব মুসলমানই সেখানে মূলতঃ গৃহবন্দী। তাই লড়াই শুরু হলে ভেতর থেকে আক্রার মুসলমানরা তেমন কোন সাহায্য করতে পারবে না। অপরদিকে খৃস্টানরা শহরের প্রতিরক্ষায় জীবন পণ করে লড়বে। কারণ আধিপত্য হারানোর পরিণাম কি তা তারা ভাল করেই জানে।’

সুলতান বললেন, ‘আমি আক্রায় দীর্ঘ কোন অবরোধ করতে চাই না। আমাদের আক্রমণ হবে ঝড়ের মত উদ্দাম। আক্রা পর্যন্ত আমাদের অভিযানে সহযোগিতা করবে কমান্ডো বাহিনী।

রাস্তায় যে সব বস্তি পড়বে সে সব তছনছ করে এগুবো আমরা। কিন্তু সেনাবাহিনীর কোন সদস্য গনিমতের মালের আশায় পথে কোথাও থামতে পারবে না। এ কাজের জন্য আমি আলাদা বাহিনী নিয়োগ করছি।’

আক্রায় মুসলমানদের অবস্থা এমন ছিল, কোন বৃদ্ধ বা অচল ব্যক্তিও স্বাধীন ও মুক্ত ছিল না। সবাই আতঙ্কের জীবন কাটাচ্ছিল। বেগার কয়েদীদের সংখ্যা ছিল হাজার হাজার। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, পুরো আক্রা শহরই মুসলমানদের জন্য ছিল একটি বৃহৎ কারাগার। কোন মুসলমানের স্ত্রী-কন্যার মান সম্মান নিরাপদ ছিল না। খৃস্টানদের উদ্দেশ্য ছিল, মুসলমানরা আক্রায় থাকবে, তবে তারা থাকবে শুধু খৃস্টানদের সেবা করার জন্য।

তারা সেখানে মুসলিম শিশুরা যেন ইসলামী জীবনবোধে উজ্জীবিত হতে না পারে সে জন্য সেখানকার সব ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল। সেখানকার মসজিদগুলো বিরান হয়ে পড়েছিল মুসল্লির অভাবে।

১১৮৭ সালের ৪ জুলাইয়ের পর সেখানে খৃস্টানরা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও উৎপীড়নে নতুন মাত্রা যোগ করে। তারা নতুন করে ভীষণ নির্যাতন চালাতে শুরু করে। বাড়ীতে যে সব মুসলমানরা ছিল তাদেরকে তাড়া করে বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করে দেয়। শহরে ভাসমান মুসলমানদের জোর করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। কারাগার মানে তাদের সেই চিরাচরিত বেগার ক্যাম্প, যেখানে বিনা পয়সায় মুসলমানদের শ্রম আদায় করা হয়।

সেখানে মুসলমানদের কাছ থেকে জবরদস্তি পশুর মত বেগার শ্রম আদায় করতে লাগলো খৃস্টানরা। ৫ জুলাইয়ের পর তাদেরকে কাজের জন্য বাইরে না এনে তাদের উপর কঠোর নির্যাতন শুরু করে। বিনা কারণে প্রহারে প্রহারে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে এই সব হতভাগা বন্দীরা। মুসলমানরা বুঝতে পারে খৃস্টানরা কোথাও চরম পরাজয়ের শিকার হয়েছে, অথবা মুসলমানরা কোন খৃস্টান শহর অবরোধ করে রেখেছে।

মেয়েরা এই জুলুমের হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর দরবারে আকুল হয়ে প্রার্থনা করতে লাগলো। তারা সিজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করছিল। কারাগারের নিষ্পাপ শিশুদের চেহারায় লেপ্টে ছিল নীরব কান্না। কচি শিশুরা ঘুম থেকে জেগে উঠলে মায়েরা তাদেরকে দোয়ার জন্য হাত উঠাতে বলতো। বলতো, ‘বলো বাছারা, আল্লাহ যেন আমাদের হেফাজত করেন। তিনি যেন ইসলামের বিজয় দান করেন। মুক্ত মুসলমানদের যেন শক্তি ও সাহস দান করেন। তারা যেন আমাদেরকে জালিমের জুলুম থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারে।’

শত শত শিশু ও মায়েরা এভাবে আকুল হয়ে কাঁদছিল আল্লাহর দরবারে। শিশুরা কিছু না বুঝেই মায়ের চোখে অশ্রু দেখে কাঁদতো। তাদের কান্না ও আহাজারির ধ্বনিতে কাঁপছিল আল্লাহর আরশ। তাদের মনে হতো, কোটি কোটি জ্বিন ও ফেরেশতারাও যেন শামিল হয়েছে সে আহাজারিতে।

ভীত সন্ত্রস্ত মুসলমানরা চোখ মেললেই দেখতে পেতো, নতুন নতুন বন্দীদের ধরে আনা হচ্ছে বেগার ক্যাম্পে। শহরে যাদের বাড়ী ছিল, ভিটামাটি ছিল, সম্পন্ন ব্যবসা ছিল, সবখান থেকেই তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন ও মর্যাদাবান এসব নাগরিকের স্ত্রী ও শিশুদেরও ধরে এনে তাদের ওপর চাবুক মেরে মেরে ক্ষত বিক্ষত করা হচ্ছে তাদের।

১১৮৭ সালের ৬ জুলাই। মধ্যরাত অতীত হয়ে গেছে। সহসা শহরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। শহরের এখানে ওখানে জ্বলে উঠলো আগুনের লকলকে শিখা। ঘুমন্ত মানুষের ঘুম ছুটে গেল মানুষের কোলাহলে। খৃস্টানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো অজানা ভীতি ও আতঙ্ক। শহরের চার দেয়ালের বাইরে থেকে একের পর এক ছুটে আসছে অগ্নিতীর। সেই তীরের কয়েকটি এসে পড়লো বেগার ক্যাম্পের কাছে।

মোটা রশির জাল দিয়ে ঘেরাও করা ছিল ক্যাম্পের বেড়া। খুব কড়া পাহারার প্রয়োজন ছিল না। কারণ ওই কয়েদখানা থেকে পালাবার কথা চিন্তাও করতো না কেউ। রাতে ক্যাম্পের আশপাশে মশাল জ্বালিয়ে রাখা হতো যাতে বন্দীদের দেখতে পাওয়া যায়।

শহর জুড়ে চলছিল হুলুস্থুল। এই ডামাডোলের মধ্যে এক কয়েদী বাইরে থেকে আসা একটি তীর ছুটে গিয়ে উঠিয়ে আনলো। মশালের আলোয় এনে তীরটি দেখেই চিৎকার দিয়ে বললো, ‘এ তীর আমি খুব ভালমত চিনি, এ তীর মুসলিম বাহিনীর।’

রশির জালের বেড়া ভেদ করে একটি তীর শাঁ করে এসে ওই কয়েদীর বুকে বিদ্ধ হলো। বন্দীর চিৎকার শুনে এক খৃস্টান রক্ষী সঙ্গে সঙ্গে তীর মেরে স্তব্ধ করে দিল এক মুসলমান কয়েদীর উল্লাস।

ততোক্ষণে সমস্ত শহর জেগে উঠেছে। শহর ও কেল্লার প্রাচীরের ওপর ছুটাছুটি করছে খৃস্টান রক্ষী সেনারা। বাইরে থেকে তীরের বর্ষণ আরো তীব্রতর হলো। শহরের বাইরে থেকে ভেসে এলো আল্লাহু আকবর ধ্বনি।

সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা এবার মেনজানিক দিয়ে বড় বড় পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করলো। যে সব খৃস্টান সৈন্য প্রাচীরের ওপর উঠে গিয়েছিল সে সব পাথর এসে আঘাত করছিল তাদের ওপর।

সুলতান আইয়ুবীর এটা ছিল অতর্কিত ঝটিকা আক্রমণ। তিনি নিজেই এ আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। প্রথম ধাক্কার রেশ কেটে গেলে কেল্লার পাঁচিলের ওপর অবস্থান নিল খৃস্টান সৈন্যরা। পাঁচিলের ওপর দেয়ালের আড়াল নিয়ে তারাও তীর বর্ষণ শুরু করলো। পাঁচিলের ওপর বিভিন্ন জায়গায় সেন্ট্রিবক্স ও মেনজানিক কামান বসানো ছিল। রক্ষীরা সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে সেখান থেকে শুরু করলো কামান দাগা। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।

শহরে অগ্নি নিক্ষেপের চেয়ে মেনজানিক দিয়ে দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল মুসলমানরা। তারা শহরের প্রধান ফটক ও প্রাচীরের ওপর ভারী পাথর নিক্ষেপ করছিল।

সুলতান আইয়ুবীর জানবাজরা চাকাওয়ালা উঁচু উঁচু মাচান তৈরী করে নিয়েছিল। প্রত্যেক মাচানের ওপর দশ-বিশজন সৈন্য দাঁড়াতে পারতো। মাচানগুলো টানার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল উট ও ঘোড়া। এই চলন্ত মাচান নিয়ে দেয়ালের দিকে অগ্রসর হলো মুসলমানরা। খৃস্টানরা তাদের প্রাণপণে বাঁধা দিল। কিন্তু কয়েকটি গাড়ী তীব্র বাঁধা উপেক্ষা করে শহর রক্ষা প্রাচীরের কাছে পৌঁছে গেল।

প্রাথমিক ধাক্কা কাটতেই শহরের খৃস্টান নাগরিকরা সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য ছুটে গেল। তারা পাঁচিলের ওপর গোলাবারুদ ও তীর ধনুক তুলে দিচ্ছিল। যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিল বিভিন্ন নাইটরা। যে সব যুবক তীর চালাতে জানতো তারাও পাঁচিলের ওপর উঠে সৈন্যদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে লাগলো। তারা চলন্ত মাচানের ওপর তীর বর্ষণ করছিল। কিন্তু ওরা অবাক হয়ে দেখতে পেলো, মাচানের ওপরের সৈন্যরা মাচান থেকে নেমে কাঠের মাচান মাথার ওপর তুলে নিয়ে প্রাচীরের দিকে ছুটে আসছে। ওদের পাঠানো তীরগুলো গেথে যাচ্ছে সেই কাঠের পাটাতনে।

খৃস্টান সৈন্যরা তীর মারা বাদ দিয়ে এবার ওদের ওপর পেট্রোলের হাড়ি ও অগ্নি বর্ষণ শুরু করলো। এবার বিপাকে পড়ে গেল মুসলমানরা। তাদের মাথার ওপর যে কাঠের পাটাতন ছিল তাতে পেট্রোল ও আগুন নিক্ষিপ্ত হওয়ার মুহূর্তে মাথার ওপর জ্বলে উঠল দাউ দাউ আগুন।

ভেতরে বন্দীদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সূচনা হলো। হাজার হাজার বন্দী ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শব্দে জোরে জিকির আরম্ভ করলো। মেয়েরাও পুরুষের সাথে অশ্রুভেজা কণ্ঠে জিকির করছিল। এক সময় একজন উচ্চস্বরে বললো, ‘নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারিব।’ শিগ্রই সমস্ত পুরুষ নারী ও শিশুর কণ্ঠে উঠে এলো এ শব্দ। বাতাসে গুঞ্জরিত হতে থাকলো সেই সুরেলা শব্দ, ‘নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারিব।’ মনে হলো, সমস্ত শহরে এ শব্দ ধ্বনি প্রতিধ্বনি হচ্ছে।

কয়েকজন খৃস্টান সৈন্য ভেতরে এসে বন্দীদের শব্দ করতে নিষেধ করলো। কিন্তু তাদের কথা গ্রাহ্য করলো না বন্দীরা। কতিপয় অতি উৎসাহী বন্দী সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

খৃস্টান সৈন্যরা গেট খোলা রেখেই বন্দীদের থামাতে এসেছিল। এই সুযোগে সমস্ত বন্দী কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ছুটলো গেটের দিকে। অবস্থা বেগতিক দেখে বাইরের রক্ষীরা বন্দীদের ওপর তীর ছুঁড়তে শুরু করলো। তীরের আঘাতে সামনের কিছু বন্দী লুটিয়ে পড়লো গেটের কাছে। বন্দীরা দিশেহারা হয়ে উল্টো দিকে ছুটতে শুরু করলো।

বন্দীদের মধ্যে এই বিশৃংখলা দেখে ছুটে এলো খৃস্টান অশ্বারোহীরা। তারা হাতে বর্শা নিয়ে খোলা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই ঝাঁপিয়ে পড়লো কয়েদীদের ওপর। কিছু কয়েদী অশ্বারোহীদের বর্শার আঘাতে মারা পড়তেই থেমে গেল বন্দীদের কোলাহল। আতঙ্কিত কয়েদীরা ভয়-বিস্ফারিত নয়নে ফিরে গেল নিজ নিজ বিছানার কাছে।

পলায়নপর কয়েদীরা সফল হতে পারলো না। নারী ও শিশুরা মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। শহরের একপাশে তখন মুসলমানরা বড় মেনজানিক দিয়ে প্রাচীরের উপর ভারী পাথর বর্ষণ করছে।

সারা রাত ধরে সুলতান আইয়ুবীর জানবাজ সৈন্যরা জীবন বাজি রেখে প্রাচীরের কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করলো। উদ্দেশ্য, দেয়াল ভেঙ্গে শহরে প্রবেশ করবে। কিন্তু ওপর থেকে অব্যাহত গতিতে খৃস্টানদের অগ্নিবর্ষণ ও পাথর নিক্ষেপ চলতে থাকায় তা আর সম্ভব হলো না। সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা বেহিসেব জীবন দিয়েও সেই রাতে শহরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হলো।

যখন সকাল হলো, দেখা গেল দেয়ালের ওপর নগরবাসী ও খৃস্টান সৈন্যরা নিশ্ছিদ্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তারা প্রাণপণে তীর ও পাথর নিক্ষেপ করে যাচ্ছে।

সারাদিন অব্যাহত যুদ্ধ চললো। কিন্তু তাতে কোন সুরাহা হলো না যুদ্ধের। রাতদিন একাকার করে যুদ্ধ চলতেই লাগলো। রাতে এক অভিনব ও অভাবিত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেন সুলতান। অতীতে এ ধরনের কোন পরিস্থিতির শিকার তাকে হতে হয়নি। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি কেবল বিস্মিতই হননি রীতিমত বিপর্যস্ত হয়ে গেলেন। খৃস্টানরা এমন মারমুখী ও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এমন কোন ধারনাও করেননি সুলতান।

ঘটনাটি এ রকম। অতীতে আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনীর অভিজ্ঞতা থেকে খৃস্টানরাও নিজেদের মধ্যে কমান্ডো গ্রুপ তৈরী করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো। কয়েকজন নাইটের তত্ত্বাবধানে তৈরী হলো কয়েকটি কমান্ডো গ্রুপ। সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের দেয়া হলো মানসিক প্রশিক্ষণ। খৃস্টান পাদ্রী তাদের বুঝালো, ‘ধর্মের জন্য জীবন দিলে স্বর্গ নিশ্চিত। প্রয়োজনে তাদের আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মুসলমান কমান্ডোদের মতো জীবন উৎসর্গ করার শপথ নিয়ে ঢুকে পড়তে হবে শত্রুর বুহ্যে।’ তাদের আরো বলা হলো, ‘যারা এই বাহিনীতে শরীক হবে সাধারণ সৈন্যদের চেয়ে তাদের বেতন হবে দশগুণ। যদি কেউ মারা যায় তিন পুরুষ পর্যন্ত তার পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করবে গীর্জা। অর্থাৎ ইহকাল ও পরকাল দুই কালই তোমাদের সফলতায় ভরে উঠবে।’

ওই রাতে তারা পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে আইয়ুবীর বাহিনীর পেছন থেকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল। তখন এক নাইট বললো, ‘আমরা পেছন থেকে আক্রমণ করেও তাদের ততো ক্ষতি করতে পারবো না যতোটা সম্ভব কৌশলের আশ্রয় নিলে। আমরা ক্রাকের নির্যাতীত মুসলমানের ছদ্মবেশে ওখানে যাবো এবং ওদের সাথে মিশে ওদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করে নেবো। তারপর সুযোগ বুঝে সেই অস্ত্র ঘুরিয়ে ধরবো ওদের দিকে।’

প্রস্তাবটা মনপূত হলো সবার। ওরা সাধারণ মুসলমানের পোষাক পরে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে ছুটে গেল আইয়ুবীর বাহিনীর দিকে। আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে বললো, ‘আমরা ক্রাকের নির্যাতিত মুসলিম। যুদ্ধের ডামাডোলে পেছন দরজা দিয়ে আমরা পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের আরো সঙ্গী শহরে রয়ে গেছে। খৃস্টানরা টের পেয়ে ফটক বন্ধ করে দেয়ায় ওরা আসতে পারেনি। আপনি আমাদের জিহাদে শরীক করে নিন।’

সুলতান তাদেরকে অস্ত্র এগিয়ে দেয়ার কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে নিয়োগ করলেন। ওরা কিছুক্ষণ খুব আন্তরিকতা ও দরদের সাথেই মুজাহিদদের হাতে তুলে দিল তীর ধনুক। তারপর যখন নিজেরা সবাই তীর ধনুক হাতে নেয়ার সুযোগ পেলো তখন রাতের অন্ধকারে খুব কাছে থেকে মুসলমান সৈনিকদের ওপর তীর চালাতে শুরু করলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে বহু মুজাহিদ ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। যখন সুলতান এবং মুসলিম সেনাপতিরা বিষয়টি বুঝতে পারলেন ততোক্ষণে ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে।

সুলতান ত্বরিত দলটিকে ঘিরে ফেলার আদেশ দিলেন। মুজাহিদরা মুহূর্তে দলটিকে ঘিরে ফেললো। এরপর তুমুল যুদ্ধ হলো ওদের সাথে। ওরা কেউ আত্মসমর্পণ না করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে গেলো। পরে এই আত্মঘাতি দলের এক আহত কমান্ডোর কাছ থেকে উদ্ধার হলো আসল ঘটনা।

সেই রাতেই দেয়ালের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল যে সামান্য সংখ্যক মুসলিম সেনা, তারা বসেছিল না। প্রাচীরের সাথে মিশে গিয়ে তারা দেয়াল ভাঙ্গার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। সকালে দেখা গেল, একস্থানে তারা দেয়ালের ভেতর বেশ বড়সড় গর্ত করে ফেলেছে।

সকালে সুলতান আইয়ুবী ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা। মুজাহিদবেশী খৃস্টান আত্মঘাতি দলের সদস্যদের লাশগুলো দেখিয়ে এক সেনাপতিকে বললেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ হলো। এখন থেকে এ ধরনের আত্মঘাতি বাহিনীর মোকাবেলা করার বিষয়টিও আমাদের নজরে রাখতে হবে।’

তিনি ঘোড়া নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একস্থানে গিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। দেখলেন, জানবাজ মুজাহিদরা দেয়ালের বেশ খানিকটা ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তিনি তার সৈন্যদের আদেশ দিলেন, যেখানে দেয়াল ভাঙ্গা হচ্ছে ওর আশপাশে তীর বর্ষণ তীব্রতর করতে। বললেন, ‘দরকার হলে অন্যদিক থেকে তীরন্দাজদের এখানে নিয়ে এসো। দেয়াল ভাঙ্গা সৈন্যদের ওখানে আরো সৈন্য পাঠাও। তারা আগের সৈন্যদের সাথে মিলে দেয়াল ভাঙ্গার কাজ দ্রততর করবে।’

জানবাজ আরো কিছু মুসলিম সৈন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেল। মুসলমান তীরন্দাজরা প্রাচীরের ওপর এমন তীব্রভাবে তীর বর্ষণ করছিল যে, দেয়ালের ওপর অবস্থিত খৃস্টান সৈন্যদের নিচের দিকে তাকাবার কোন সুযোগ পাচ্ছিল না।

আইয়ুবীর দুর্ধর্ষ সৈন্যরা দ্রুত হাতে কাজ করছিল। নতুন সৈন্যের আগমনে ওদের সাহস এবং উদ্যম আরো বেড়ে গেল। তারা অল্প সময়ের মধ্যেই সুড়ং আরো বড় করে ফেললো। দুপুরের মাঝেই দেয়ালের মাঝে এক সাথে দু’জন লোক যাতায়াত করার মত সুড়ং তৈরী হয়ে গেল।

সুলতান আইয়ুবী সেই সুড়ং পথে সৈন্যদের ভেতরে প্রবেশ করার হুকুম দিলেন। জেহাদী জযবায় ভরপুর মুজাহিদরা কালবিলম্ব না করে ছুটলো সুড়ংয়ের দিকে। তাদের মাঝে বিরাজ করছিল যুদ্ধের উন্মাদনা। নির্দেশ পাওয়া মাত্র তারা দেয়ালের ফুটোর দিকে দৌড় দিল এবং লাইন ধরে ভেতরে চলে গেল।

খৃস্টান বাহিনী দেয়ালের ওপর থেকে নিচে এলো তাদের বাঁধা দিতে। তারা নেমে আসতে যে সময় লাগলো ততোক্ষণে অনেক মুসলিম সৈন্য শহরের মধ্যে ঢুকে গেলো। শহর রক্ষী খৃস্টান সৈন্য ও নাগরিকরা জীবনপণ লড়াই করতে লাগলো।

লড়াই চলছিল শহরের রাস্তায় রাস্তায়। তলোয়ালের ঠোকাঠুকি ও আহতদের আর্ত চিৎকারে শহরে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। কয়েকজন মুজাহিদ দৌড়ে গিয়ে শহরের প্রধান ফটক খুলে দিল। এবার দলে দলে মূল ফটক দিয়ে শহরে প্রবেশ করতে শুরু করলো আইয়ুবীর সৈন্যরা। পদাতিক বাহিনীকে সরিয়ে দিয়ে প্রথমেই ঢুকলো অশ্বারোহী বাহিনী। তাদের পেছন পেছন ঢুকলো পদাতিক ফৌজ। সারা শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হলো।

মুসলমানরা শহরে প্রবেশ করতেই সারা শহরে হুলুস্থুল ও ছুটাছুটি আরম্ভ হয়ে গেল। সেখানকার খৃস্টানরা আগেই সংবাদ পেয়েছিল, তাদের মহান ও বিশাল ক্রুশটি মুসলমানদের দখলে চলে গেছে। এই ক্রুশের মহান রক্ষকও নিহত হয়েছেন হাতিনের যুদ্ধে।

হাতিন থেকে পালিয়ে আসা খৃস্টান সৈন্যরাই আক্রাতে এ খবর রটিয়েছিল। এসব পালিয়ে আসা সৈন্যদের অনেকেই ছিল আহত। তারা তাদের পরাজয়ের বিভীষিকাময় সংবাদ ছড়িয়ে আগেই শহরে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরী করে দিয়েছিল। যখন সুলতান আইয়ুবীর দুর্ধর্ষ সৈন্যরা দেয়াল ভেঙ্গে বন্যার মত ভেতরে প্রবেশ করলো তখন আক্রার খৃস্টান নাগরিকরা ভয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। খৃস্টান বাহিনী প্রাণপণ যুদ্ধ করেও মানুষের সেই আতঙ্ক দূর করতে পারেনি।

মুসলমানরা শহরে ঢুকতেই সেখানকার সাধারণ খৃস্টানরা শহর ছেড়ে পালানোর জন্য গেটের দিকে ছুটে গিয়েছিল কিন্তু ওই পথে মুসলমানদের ঢুকতে দেখে এবার তারা ছুটলো পেছন দরজার দিকে। তারা শহরের সব কয়টি ফটকই খুলে দিল। খৃস্টান সৈন্যরা তাদের বাঁধা দেয়ার কোন সুযোগই পেলো না। শহরের সব লোক ছুটলো সেই খোলা ফটকের দিকে।

শহরের সব কটা দরজা খোলা পেয়ে মুসলমান অশ্বারোহীরা তাদের কমান্ডারের আদেশে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। তারা অশ্বপদতলে লোকদের মাড়িয়ে শহরে প্রবেশ করতে শুরু করলে খৃস্টানরা দিশেহারা হয়ে শহরময় ছুটাছুটি করতে লাগলো।

এই হট্টগোলের মধ্যে মুজাহিদদের বাঁধা দেয়ার শক্তি হারিয়ে ফেললো খৃস্টানরা। সমস্ত দরজা দিয়ে মুসলমানরা দলে দলে প্রবেশ করছে দেখতে পেয়েই খৃস্টান সৈন্যরা অস্ত্র ফেলে পালাতে শুরু করে।

অসহায় নারী ও শিশুদের ক্রন্দনরত প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে গিয়েছিল। কাফেরদের নির্মম অত্যাচার উৎপীড়ন সইতে না পেরে যেসব শিশু ও মেয়েরা কাঁদছিল তাদের আহজারীতে কেঁপে উঠেছিল আল্লাহর আরশ। আল্লাহ সুলতান আইয়ুবীর মাধ্যমে তাদের মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাই খৃস্টানদের সকল বাঁধাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের নিয়ন্ত্রণভার মুসলমানদের হাতে চলে গেল। পরাজিত খৃস্টান সৈন্যরা হাতিয়ার ফেলে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো।

সূর্য ডোবার খানিক আগে আক্রার বন্দী সৈন্যদের সুলতান আইয়ুবীর সামনে হাজির করা হলো। সুলতান আইয়ুবী খৃস্টান বাহিনীর সেনাপতি, কমান্ডার ও সৈন্যদের পৃথক স্থানে রাখার হুকুম দিয়ে ছুটে গেলেন বেগার ক্যাম্পের দিকে। সেখানকার অবর্ণনীয় অবস্থা দেখে সুলতানের চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।

বেগার ক্যাম্পের প্রহরী ও রক্ষীরা পালিয়ে গিয়েছিল। কয়েদীরা কয়েদখানায় বেড়া কাটতে আরম্ভ করে দিয়েছিল। কয়েকজন চেষ্টা করছিল গেট ভাঙ্গার।

সুলতান আইয়ুবী দূর থেকেই তাদের দেখতে পেলেন। সেখানকার হাড্ডিসার মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো ওরা মানুষ নয়, জীবন্ত কঙ্কাল। তিনি যখন অসহায় নারী ও শিশুদের দেখলেন তখন তাঁর চোখের অশ্রু আর বাঁধা মানলো না, তাঁর ঝাপসা দৃষ্টি থেকে টপটপ করে গড়িয়ে নিচে পড়তে লাগলো।

‘যাও, গেট খুলে দাও। না পারলে বেড়া কেটে ওদের মুক্ত করো।’ সুলতান আইয়ুবী অশ্রুভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘আর তাদের বলবে, সময় মতো আমি তাদের সাহায্যে আসতে পারিনি বলে তাদের কাছে আমি খুবই লজ্জিত।’

সুলতান আইয়ুবীর একদল অশ্বারোহী ছুটে গেল সেখানে। তারা কাঠের গেট ভেঙ্গে ফেললো। কয়েদখানার বেড়াও ভেঙ্গে দিল। বন্দীরা দৌড়ে বেরুতে গিয়ে কয়েকজনকে পায়ের নিচে পিষে মারলো। অশ্বারোহীরা তাদের শান্ত করার জন্য উচ্চস্বরে বলতে লাগলো, ‘তোমরা শান্তির সাথে বের হও। হুড়োহুড়ি করো না। তোমরা এখন আর বন্দী নও। কেউ আর তোমাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করতে পারবে না। ওই দেখো, এই শহর ও কেল্লার ওপরে শান্তির পতাকা উড়ছে।’

‘ওরা আমাদের পাপের শাস্তি ভোগ করছে।’ সুলতান আইয়ুবী একটু দূরে দাঁড়িয়ে এক সেনাপতিকে বললেন, ‘এটা গাদ্দারদের পাপের শাস্তি। গাদ্দারদের পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে হচ্ছে এই সব নিষ্পাপ ও অসহায়দের। কারণ গাদ্দাররা যখন দ্বীন ও ঈমানের সাথে বেঈমানী করছিল তখন সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওদের টুটি চেপে ধরেনি। নিজের গায়ে আচড় লাগেনি বলে চুপ করে থেকে সুযোগ দিয়েছে গাদ্দারদের। গাদ্দাররা জাতির শত্রুকে বন্ধু বানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তারা চিন্তা করেনি, তাদের এ কাজের পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে। জাতির জন্য তাদের এ ভূমিকা কি ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে। যখন সেই বিপদ তাদের মাথায় চাপলো তখন আর ওদের করার কিছু ছিল না। ফলে এই অমানুষিক লাঞ্ছনা, অপমান ও দুর্গতি ভোগ করা ছাড়া ওদের আর কোন উপায় ছিল না।’

‘কিন্তু সুলতান, ওরা তো মানবতার কথা বলে? প্রেমের বাণী শোনায়? এই কি ওদের প্রেমের নমুনা?’

‘হযরত ঈসা (আ.) প্রেম ও ভালবাসার বাণীই প্রচার করেছিলেন। শুধু হযরত ঈসা (আ.)ই নন, সকল নবী রাসূলই মানুষকে মানবতা ও মহত্বের শিক্ষা দিয়েছেন। তারা মানুষকে সভ্যতার বিকাশ ও নিরাপত্তা রক্ষার উপায় শিখিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রুশের পূজারী ধর্মরক্ষকদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ এতটাই প্রবল যে, তারা তাদের নবীর কথাও ভুলে গেছে।

তারা বলে, ‘দুনিয়াতে মাত্র একটি ধর্মই টিকে থাকবে। হয় ইসলাম, নয়তো খৃস্টধর্ম। অতএব মুসলমানদের ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। তাদের প্রতি অনুকম্পা দেখানো মানে নিজের গলায় ছুরি চালানো। তাই ইসলামকে কবর দিতেই হবে। এখানে ভক্তি বা বিদ্বেষের কিছু নেই।’ অতএব খৃস্টানরা যা করছে সব বুঝেশুনেই করছে। এ জন্যই খৃস্টানদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ ও অন্তর্কলহ থাকলেও যখন দুনিয়াব্যাপী মুসলিম নিধনের প্রশ্ন আসে তখন তারা এক হয়ে যায়।’

‘সুলতান, মুসলমানদের মধ্যে সচেতনতার অভাব বলেই খৃস্টানরা এমনটি করতে পারছে। যদি এই ঘুমন্ত জাতি একবার জেগে উঠে মাথা ঝাড়া দেয় তাহলে কোন অস্ত্রই তাদের ঈমানের সামনে টিকতে পারবে না।’

‘খুবই খাঁটি কথা বলেছো। আমরা দুনিয়ার মিথ্যা আড়ম্বর ও লোভ মন থেকে দূর করতে না পারলে খৃস্টানরা আমাদের এই পাপে ডুবিয়েই ইসলামের সমাধি রচনা করবে।’

খৃস্টান সেনাপতি ও কমান্ডাররা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সুলতান আইয়ুবী সেনাপতিকে নিয়ে সেখানে গেলেন। তাদের বললেন, ‘তোমরা বিনা অপরাধে অসংখ্য মুসলিম নরনারীকে হত্যা করেছো। বেগার ক্যাম্পে এনে বিনা পারিশ্রমিকে মুসলমানদের দিয়ে অমানুষিক কাজ করিয়ে শেষে কাজের অনুপযুক্ত হলে তাদের হত্যা করেছো। এবার বলো এর কি শাস্তি তোমারা চাও?’

খৃস্টান সেনাপতি ও কমান্ডাররা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ সুলতানের অভিযোগ অস্বীকার করতে এগিয়ে এলো না। সুলতান গর্জন করে বললেন, ‘এই সব পাপিষ্ঠদের সমুদ্র পাড়ে নিয়ে যাও। সেখানে ওদের হত্যা করে লাশগুলো সমুদ্রে ভাসিয়ে দেবে। আর সাধারণ সৈন্যদের যারা অপরাধ স্বীকার করবে তাদের দামেশকে পাঠিয়ে দাও। অবশিষ্টদের শেষ করে দাও। সাবধান, কোন নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর হস্তক্ষেপ করবে না। তাদের মধ্যে স্বেচ্ছায় যারা শহর ছেড়ে চলে যেতে যায় তাদের কোন বাঁধা দিওনা। যারা এখানে থাকতে চায় তাদের সসম্মানে থাকতে দিবে।’

৮ জুলাই ১১৮৭ সাল। আক্রার ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব কায়েম হলো মুসলমানদের। রাতে সুলতান আইয়ুবী সবেমাত্র খাওয়া দাওয়া শেষ করেছেন, এক রক্ষী এসে সংবাদ দিল, ‘একজন গুরুত্বপূর্ণ বন্দী আনা হয়েছে।’

‘সে কে?’

‘বন্দির নাম হরমন।’

‘কোন হরমন?’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘খৃষ্টানদের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান? যেমন আমাদের আলী বিন সুফিয়ান?’

‘জ্বী, সম্ভবত তিনিই।’

‘ঠিক আছে, তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’

ঘটনা প্রবাহে সম্রাট হরমনের নাম আমরা অনেক বার শুনেছি। এ লোক ষড়যন্ত্র ও কূটনীতিতে খুবই পারদর্শী ছিল। যেসব ইহুদী ও খৃস্টান মেয়েরা মুসলমান এলাকায় গোয়েন্দাগিরী করতে আসতো তাদেরকে ভাল মতো ট্রেনিং দিতেন এই হরমন। তিনি একদল খৃস্টান মেয়েকে ট্রেনিং দেয়ার জন্য আক্রায় অবস্থান করছিলেন। কিন্তু আক্রার পতনের পর শহর ছেড়ে পালাবার সময় সবাই দলসহ ধরা পড়ে যায়।

তিনি এবং তার সঙ্গের মেয়েরা গোপনে শহর থেকে পালাচ্ছিল। দলটিকে দেখে সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দার সন্দেহ হয়। সে তাদের পিছু নেয়। ফটকে পৌঁছলে রক্ষীদের জানায় সে তার সন্দেহের কথা। এক গোয়েন্দা কমান্ডার এগিয়ে যায় দলটির দিকে। হরমন তখন ছদ্মবেশে ছিল। তারপরও তাকে দেখেই চিনতে পারে সেই কমান্ডার।

হরমন তখন গ্রাম্য কৃষকের ছদ্মবেশে ছিল। মেয়েরাও কৃষক কন্যার মতোই পোষাকে পরে ফিরে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আনাজ-তরকারী বিক্রি করতে এসে তারা শহরে আটকা পড়ে যায়। এখন সুযোগ পেয়ে তারা ফিরে যাচ্ছে আপন গাঁয়ে।

গোয়েন্দা কমান্ডার বললো, ‘তুমি খুব দামী উপহার জোগাড় করেছ। এসো, এক্ষুণি ওদের পাকড়াও করতে হবে।’

কমান্ডার কয়েকজন রক্ষী সৈন্যের সহযোগিতা নিয়ে হরমন ও তার সঙ্গীদের কাফেলাটিকে ঘিরে ফেললো। সম্রাট হরমনের সঙ্গে মেয়েদের দলটিই শুধু ছিল না, সঙ্গে সোনাদানাও ছিল প্রচুর। হরমন কমান্ডারের সামনে সোনার পুটলি মেলে ধরে কমান্ডার ও সৈন্যদের লক্ষ্য করে বললো, ‘তোমরা এই সোনা ভাগ করে নাও এবং যে মেয়েকে তোমাদের পছন্দ হয় নিয়ে যাও, আমাকে এবং বাকী মেয়েদের ছেড়ে দাও।’

‘আমাদের যে সব কটা মেয়েই পছন্দ!’ কমান্ডার বললো, ‘আমরা সব কটা মেয়েকেই নেবো, সমস্ত সোনাদানাও নেবো, সঙ্গে আপনাকেও সাথে নিয়ে যাবো।’

‘ঠিক আছে, তোমরা সব কটা মেয়েকেই নাও, সোনাদানাও নিয়ে যাও, শুধু আমাকে ছেড়ে দাও।’

‘তা কি করে হয়? আমার যে আপনাকেই সবচেয়ে বেশী পছন্দ হয়।’ কমান্ডার রহস্যময় কণ্ঠে বললো হরমনকে।

কমান্ডার হরমনসহ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সুলতান আইয়ুবীর দরবারে হাজির হলো। সমস্ত সোনাদানা ও মেয়েদেরকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিল কমান্ডার।

সম্মিলিত খৃস্টান গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান সম্রাট হরমন সুলতান আইয়ুবীর কাছে ছিলেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কয়েদী। তাকে সুলতান আইয়ুবীর কামরায় হাজির করা হলে সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘হরমন, আমি জানি তুমি ভাল আরবী বলতে পারো!’ তাই আমি চাই তুমি এখন আরবী ভাষাতেই কথা বলো। আমি তোমার গুণ, দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করি। তোমার সম্মান আমি যতটুকু বুঝতে পারি অন্য কেউ তা পারবে না। তোমার মর্যাদার কথা বিবেচনা করে আমি তোমার সাথে এমন কিছু কথা বলতে চাই, যা অন্য কারো সাথে বলা আমি সমীচিন মনে করি না।’

‘যদি দয়া করে আমার সঙ্গে কথা না বলে আমাকে হত্যা করার হুকুম দেন তাতেই আমি খুশী হবো।’ সম্রাট হরমন বললেন, ‘আমি জানি, শেষ পর্যন্ত আমাকেও আক্রার জেনারেল ও কমান্ডারদের মত নিহত হতে হবে। সুতরাং আর কথা বলার প্রয়োজন কি?’

‘হরমন! তোমাকে হত্যা করা হবে না!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি যাকে হত্যা করতে চাই, তার শুধু মুখের দিকে তাকাই, তার সঙ্গে কখনও কথা বলি না’