» » রক্তস্রোত

বর্ণাকার

কয়েকদিন পর প্রথম কাফেলা আসতে দেখা গেল। এটি ছিল মিশরের কাফেলা। কমান্ডো অশ্বারোহীরা তাদের সাথে মিশে গেল। কাফেলা যখন সুলতান আইয়ুবীর তাঁবুর কাছে এসে পৌঁছলো, তখন সুলতান আইয়ুবী ছুটে গিয়ে হাজীদের সাথে দেখা ও মুসাফা করলেন। তিনি সম্মানের সাথে সবার হস্তচুম্বন করে হাজীদেরকে তাঁর ক্যাম্পে বিশ্রাম ও আহারের জন্য নিয়ে গেলেন। পরে কমান্ডো বাহিনীর পাহারায় তারা নিরাপদে ক্রাকের সীমানা অতিক্রম করলো। তার একদিন পরেই এলো সিরিয়ার কাফেলা। তাদেরকেও তিনি যথাসাধ্য আদর আপ্যায়ন করলেন। বিশ্রাম ও আহারাদির পর তাদেরও তিনি নিরাপদে ক্রাকের সীমানা পার করে দিলেন।

যে কোন সময় সুলতান আইয়ুবী হামলা করতে পারে এ আশঙ্কা নিয়ে কয়দিন ধরেই ক্রাক শহরের ভেতর খৃস্টান সৈন্যরা টানটান উত্তেজনা নিয়ে প্রস্তুত অবস্থায় অপেক্ষা করছিল। শহরের নাগরিকদের মধ্যে বিরাজ করছিল সীমাহীন ভীতি ও আতংক। সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগ এই অবস্থায়ও সুলতানকে সম্রাট শাহ আরনাতের তৎপরতার খবর সরবরাহ করছিল অত্যন্ত গোপনে ও সুকৌশলে।

একদিন সকালে সম্রাট আরনাত খবর পেলেন, সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা চলে যাচ্ছে। আরনাত বিস্মিত হয়ে দেখলেন সে দৃশ্য। দুটি হজ্জ কাফেলা সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের পাহারায় বিদায় হয়ে যাওয়া ছাড়া অবরোধকালীন সময়ে আর কোন ঘটনায় ঘটেনি। আরনাত এ রকম অবরোধের কোন কারণ বুঝতে পারলেন না। শুধু সুলতানের গোয়েন্দারাই জানতো আসল ব্যাপার, কিন্তু সে রহস্য জানার কোন উপায় ছিল না আরনাতের।

অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার সময় সুলতান গোয়েন্দাদের জানিয়ে দিলেন সৈন্যদের নিয়ে তিনি কোথায় যাচ্ছেন। গোয়েন্দাদের তিনি বললেন, ‘আমি যখন যেখানেই থাকি না কেন, ক্রাকের অবস্থা ও সম্রাট শাহ আরনাতের গতিবিধি সব সময় আমাকে অবহিত করবে।’

১১৮৭ সালের ২৭ মে সুলতান আইয়ুবী ইশতার নামক স্থানে সৈন্য সমাবেশ করলেন। সেখানে মিশর ও সিরিয়ার সৈন্য বাহিনী গিয়ে সুলতান আইয়ুবীর সাথে মিলিত হলো। সুলতান আইয়ুবীর জ্যৈষ্ঠপুত্র মাত্র ষোল বছরের বালক আল আফজাল তার বাহিনী নিয়ে সুদক্ষ সেনাপতি মুজাফফরউদ্দিনের সাথে মিলিত হলো।

এভাবে সুলতানের সকল সৈন্য একত্রিত হলো ইশতারে। তিনি সমস্ত সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের একত্রিত হওয়ার হুকুম দিলেন। ইশতারের ময়দানে সমবেত হলো সব সেনাপতি ও কমাণ্ডারবৃন্দ। তিনি তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে, আমার বন্ধুগণ! আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। অন্তর থেকে প্রিয়জন ও গৃহের কথা ভুলে যাও। অন্তরে শুধু গেঁথে নাও আমাদের প্রথম কেবলা উদ্ধারের কথা। মনে মনে জপতে থাকো সেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নাম, যিনি আমাদের উপর দায়িত্ব দিয়েছেন প্রথম কেবলা মুক্ত করার। মনে রেখো, আমরা পররাজ্য গ্রাস করতে যাচ্ছি না, আমরা যাচ্ছি আমাদের বোন ও কন্যাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে। কাফেরদের হাতে নির্যাতীত আমাদের ভাইদের উদ্ধার করতে।

এখন আমরা আমাদের স্বপ্ন নিয়ে আর কথা বলবো না, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমরা জানি, আমাদের সৈন্য সংখ্যা শত্রুদের তুলনায় অনেক কম। খৃস্টান সম্রাটরা সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করবে আমাদের। তাদের বাহিনীর সাথে আছে হাজার হাজার নাইট, যাদের আপাদমস্তক লৌহ পোষাকে আবৃত। তাদের আছে উৎকৃষ্ট ঘোড়া ও অস্ত্র। তারা নিজেদের মাটিতে যুদ্ধ করবে বলে পাবে পরিবেশের সুবিধা। তাদের খাদ্য ও রসদপত্রের কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু তাদের সাথে নেই আল্লাহর সাহায্য ও মজবুত ঈমানের শক্তি। এই শক্তি নিয়েই আমরা দাঁড়াবো বিশাল প্রতিপক্ষের সামনে। একদিকে সরাসরি শত্রুদের সাথে লড়াই করতে হবে আমাদের, অন্যদিকে দূর করতে হবে পরিবেশের বাঁধা।’

তিনি নকশা টানিয়ে তলোয়ারের মাথা দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন যুদ্ধের ময়দানে কোথায় কারা অবস্থান নেবে। বলছিলেন কিভাবে কোন পথে তারা পৌঁছবে নির্দিষ্ট জায়গায়। মূল লড়াইয়ের ক্ষেত্রটি দেখে চমকে উঠলেন সেনাপতিরা। তারা বিস্মিত হয়ে তাকালেন সুলতান আইয়ুবীর দিকে। সুলতান আইয়ুবী তাদের বিস্মিত হবার কারণ বুঝে হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, এটাই হাতিনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।’

সুলতান আইয়ুবী তাকালেন সেনাপতিদের দিকে। বললেন, ‘তোমরা চিন্তা করছো এ তো এক শুকনো মরুভূমি! গাছের শুকনো ছালের মত কঠিন মাটি। উঁচু নিচু দুর্গম পাথুরে পর্বত। এখন সময়ও খুব খারাপ। প্রকৃতিতে চলছে কাটফাটা খরার মৌসুম। এই শুকনো মাটি মুহূর্তেই চুষে নেবে মানুষ ও পশুর রক্ত। আশপাশের উঁচু নিচু শুষ্ক টিলাগুলো পানির তৃষ্ণায় ভুগছে। রোদে এগুলো লোহার মত উত্তপ্ত হয়ে যায়। তোমরা ভাবছো, কেন আমি যুদ্ধের জন্য এমন কঠিন ময়দান বেছে নিলাম।

এর উত্তর খুব সোজা। খৃস্টান সৈন্যদের মধ্যে এমন কে আছে, যে এই জাহান্নামের এলাকায় যুদ্ধ করতে চাইবে? সে সৈন্য আমাদের আছে। আমাদের হালকা পাতলা সৈন্যরা এখানে ফড়িং-এর মত উড়তে থাকবে, চিতাবাঘের মত লাফাতে থাকবে। আর শত্রুরা? তারা লৌহশিরস্ত্রাণ ও লোহার পোশাক পরে ময়দানে নামবে। তাদের নাইট বাহিনীর জমকালো পোশাকগুলো তাদের টানবে মাটির দিকে। পোশাকের ভারে অল্পতেই তারা হাঁপিয়ে উঠবে।

রোদের তাপে তাদের লোহার পোশাকগুলো যখন আগুনের মতো গরম হয়ে যাবে তখন তার ভেতর তারা সেদ্ধ হয়ে মরবে। তাদের সুসজ্জিত বাহিনী অল্পতেই পিপাসা ও ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়বে। লোহার ভারে তাদের গতি হয়ে পড়বে শ্লথ। তারা তখন চোখে শুধু সর্ষে ফুল দেখতে থাকবে। আর আমাদের জানবাজরা তাদের নাকের ডগা দিয়ে ছুটে বেড়াবে বিদ্যুৎবেগে।

আপনারা জানেন, আমি প্রত্যেক বিশেষ কাজ পবিত্র ও বরকতময় জুমার দিনে শুরু করি। আমরা সেই সময় অগ্রসর হবো যখন সকল মসজিদে আমাদের জন্য দোয়া ও প্রার্থনা শুরু হবে। মসজিদের ইমাম সাহেবানরা আমাদের বিষয়ে মুসল্লীদের সামনে ভাষণ দেবেন। তাদের বক্তৃতায় উদ্বেলিত হয়ে মুসল্লিরা আমাদের সফলতার জন্য আল্লাহর দরবারে প্রাণ খুলে দোয়া করবে। তাদের সেই দোয়ার বরকতে আমাদের ওপর নেমে আসবে আল্লাহর রহমত।

আজ সেই পবিত্র দিন। আমি প্রত্যেক গ্রাম ও এলাকায় খবর পাঠিয়ে দিয়েছি, সবাই যেন জুম্মার নামাজের পর মুজাহিদদের সফলতার জন্য দোয়া করে।’

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মানচিত্রের এক জায়গায় তলোয়ালের অগ্রভাগ স্পর্শ করে বললেন, ‘এই দেখো, এটা গ্যালিলি সাগর। এখানে সাগরের সাথে মিশেছে নদী।’ তিনি নকশার ওপর তলোয়ালের অগ্রভাগ সরিয়ে দেখাতে লাগলেন, ‘আর এটা এ অঞ্চলের একমাত্র হ্রদ যেখানে পানি আছে। অবশিষ্ট বিল ঝিলগুলো শুকিয়ে গেছে। এটা সেই মাস, যাকে খৃষ্টানরা জুন মাস বলে। যখন সর্বত্র পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। আমরা থাকব শত্রু ও পানির মাঝামাঝি। আমরা শত্রুদের এই ময়দানে টেনে আনবো এবং তাদেরকে পানি থেকে দূরে রাখবো। তাদেরকে আমরা এমন অবস্থায় ফেলবো যাতে তারা পিপাসায় ছটফট করতে করতে মারা যায়।

আমি জানি, শত্রুরা সমর ক্ষেত্র হিসাবে হাতিনে এসে যুদ্ধ করতে আপত্তি করবে। কিন্তু আমরা তাদের এখানেই যুদ্ধ করাবো। আমাদের সেনাবাহিনীকে আমি চারটি ভাগে ভাগ করেছি। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, সেনাপতি মুজাফফরউদ্দিন ও আমার ছেলে আল আফজাল আমাদের কাছে নেই। তারা বিরাট এক বাহিনী নিয়ে গ্যালিলি সাগরের দক্ষিণে জর্দান নদী পার হয়ে গেছে। এই বাহিনী জাবালুত তাঁবুর পর্যন্ত পৌঁছবে। হয়তো এতক্ষণে তারা সেখানে পোঁছেও গেছে। এটা একটা ধোঁকা যা আমি শত্রুদের দেখাচ্ছি।’

তিনি সৈন্যদের অবশিষ্ট তিনটি দলকে তাদের অবস্থান ও করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বললেন। এই তিন বাহিনীরই একটি দলকে তিনি নিজের কমান্ডে বেছে নিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে এই দলটি ছিল রিজার্ভ বাহিনী। এটা ছিল একটা চুড়ান্ত যুদ্ধের সিদ্ধান্ত ছিল।

এই তিনটি বাহিনীই পরিকল্পনা মতো বিভিন্ন স্থান দিয়ে নদী পার হলো। খৃষ্টানরা গোয়েন্দা মারফত সুলতানের এসব বাহিনীর অগ্রগতির সংবাদ নিয়মিতই পাচ্ছিল। কিন্তু তারা জানতে পারলো না, সুলতান আইয়ুবীর প্রকৃত প্ল্যানটি কি? সুলতান আইয়ুবী গ্যালিলি সাগরের পশ্চিম পাড়ে তিববিয়া নামক এক পাহাড়ে আরোহন করলেন।

খৃষ্টানদের জন্য আরও একটি বিপদ ওঁৎ পেতে ছিল। নিয়মিত বাহিনীর চাইতেও সুলতান গোয়েন্দা ও কমাণ্ডোদের বিশেষভাবে কাজে লাগাতেন প্রতিটি যুদ্ধে। সুলতান আইয়ুবীর এসব কমাণ্ডো বাহিনীর অবস্থান ও অগ্রগতি সম্পর্কে মোটেই ধারণা ছিল না খৃষ্টানদের। এই বাহিনীর অল্প সংখ্যক সৈন্য বিশাল বাহিনীর ওপর অতর্কিতে আঘাত হানতো। ‘আঘাত করো আর পালিয়ে যাও’ এই ছিল তাদের যুদ্ধনীতি।

খৃষ্টানরা সুলতানের এই ধরনের যুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত ছিল। তাই তাদের অস্তিত্ব টের না পেলেও এ ধরনের যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল।

মুজাফফরউদ্দিন ও আল আফজালের নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা খৃষ্টানদের সেনা ফাঁড়ির ওপর কমাণ্ডো স্টাইলে আঘাত শুরু করলো। তাতে খৃষ্টানদের ধারণা হলো, এরাই সুলতান আইয়ুবী কমাণ্ডো সেনা এবং সুলতান আইয়ুবী এবারও এই বিশেষ ধরনের যুদ্ধই চালাবেন। কিন্তু অচিরেই তারা উপলব্ধি করলো, সুলতান আইয়ুবী কৌশল পাল্টানোয় ওস্তাদ। তার কমাণ্ডো বাহিনী নিত্যনতুন ও অভিনব সব পদ্ধতি ব্যবহার করলো এই যুদ্ধে।

সুলতানের বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য খৃষ্টান সৈন্যরা শহরের বাইরে এসে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সুলতান আইয়ুবী ক্ষিপ্রগতিতে সৈন্য চালনা করলেন। যে পাশে গ্যালিলি সাগর ও পানির উৎস ছিল প্রথমেই তিনি তা দখল করে নিলেন।

খৃষ্টান বাহিনীর একটি দল সিফুরিয়া নামক স্থানে সমবেত হলো। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তাদের দিকে অগ্রসর না হয়ে তিববিয়া শহরের দিকে পিছু হটলেন এবং তিববিয়ার কাছে ক্যাম্প করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।

এর মাধ্যমে তিনি আসলে খৃষ্টানদেরকে হাতিনের ময়দানের দিকে টেনে আনতে চাইলেন। ক্রুসেড বাহিনী তার চাল বুঝতে না পেরে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। খৃষ্টানরা অগ্রসর হচ্ছে না দেখে তিনি তার পদাতিক বাহিনীর কিছু সৈন্যকে এগিয়ে গিয়ে হামলা করতে বললেন খৃষ্টান বাহিনীর ওপর। তারা এগিয়ে গেল খৃষ্টান বাহিনীর দিকে। এই অবসরে সুলতান নিজে একটি ক্ষুদ্র অশ্বারোহী দল নিয়ে তিববিয়ার ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালালেন। তিনি কমাণ্ডো বাহিনীর একটি দলকে আদেশ দিলেন, ‘তিববিয়াকে ধ্বংস করে দাও, শহরে আগুন ধরিয়ে দাও।’ তার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হলো।

তিববিয়ার সেনা ছাউনি ও কেল্লা শহর থেকে সামান্য দূরে ছিল। সেখানে খৃষ্টানদের অল্প সংখ্যক সৈন্যই মজুত ছিল। শহর বাঁচানোর জন্য সৈন্যরা কেল্লা ছেড়ে বাইরে এলো। তারা শহর উদ্ধারে এগিয়ে এলে সুলতান আইয়ুবী তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালেন। শহর রক্ষার আশা ছেড়ে দিয়ে তারা মুখোমুখি হলেন সুলতান আইয়ুবীর।

খৃষ্টানদের যে সৈন্যরা কেল্লা থেকে বেরিয়ে এসেছিল তার কমান্ড করছিলেন সম্রাট রিমান্ড। তিববিয়ার উপত্যকায় সম্রাট রিমান্ড ও সুলতান আইয়ুবীর মধ্যে শুরু হলো সামনাসামনি তুমুল লড়াই।

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার সচক্ষে দেখা যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘দু’দল সৈন্যই অশ্বে আরোহন করে একে অপরের ওপর প্রবল আক্রমণ চালালো। সামনের অশ্বারোহী দল তীর চালিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। তাদের পেছনে অগ্রসর হচ্ছিল পদাতিক বাহিনী। সুলতানের বাহিনী এত তীব্র গতিতে অগ্রসর হলো যে, খৃস্টান বাহিনীর চোখের সামনে ভয়াল মৃত্যু নাচতে লাগলো। মুসলমানদের পিছনে নদী ও সামনে শত্রু, তাই পিছনে সরে যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না তাদের। সে রকম কোন ইচ্ছেও ছিল না তাদের। তাই মুসলমানদের অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী মার মার কাট কাট রবে আক্রমণ চালালো। সে আক্রমণের তীব্রতা এত প্রকট ছিল যে তা আমি ভাষায় বর্ণনা করতে অক্ষম।’

দিনভর যুদ্ধ চললো। রাতেও মুসলিম কমান্ডো বাহিনী খৃষ্টানদের অতিষ্ঠ করে রাখলো। খৃষ্টান সৈন্য এবং তাদের ঘোড়াগুলো সারাদিনের যুদ্ধে ছিল পিপাসায় কাতর। কিন্তু পানির উৎস মুসলমানদের অধিকারে থাকায় রাতেও একটু পানি তারা পান করার জন্য পেলো না। খৃষ্টান সৈন্যরা যতোবার পানির কাছে যেতে চেয়েছে ততোবারই সুলতানের কমান্ডো বাহিনী তাদের বাধ্য করেছে পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে।

পরের দিন। খৃষ্টান বাহিনী টিকতে না পেরে পেছনের টিলার দিকে সরে গেল। তারা টিলার ওপর উঠে যুদ্ধ করেই বুঝলো, এতক্ষণে তারা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে যেতে পেরেছে। মুসলমান সৈন্যরা তখনো ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুঁড়ছে। তাদের আক্রমণে বিন্দুমাত্র ঢিল পড়েনি। কিন্তু খৃষ্টানরা উঁচুতে থাকায় তারা অধিক সুবিধা পাচ্ছিল।

মুসলমান সৈন্যরা হালকা পোষাকে থাকায় তারা টিলা অবরোধ করে এবার উপরে উঠতে শুরু করলো। তীরন্দাজ বাহিনীর ছত্রছায়ায় পদাতিক বাহিনী টিলার ওপর তরতর করে উঠে যাচ্ছে। তাদের মাথার উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তীরের বন্যা। হঠাৎ ক্রুসেড বাহিনী দেখলো, টিলার ওপর তাদের কমান্ডারের পতাকা দেখা যাচ্ছে না।

তারা ভাবলো, তবে কি সম্রাট রিমান্ড যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেলেন? কিন্তু তিনি তো ক্রুশে হাত রেখে শপথ করেছিলেন, যুদ্ধের ময়দানে পিঠ দেখাবেন না। আক্রমণের প্রচন্ডতা দেখে আমাদের রেখেই তিনি পালিয়ে গেলেন? এই চিন্তা মনে জাগতেই তারাও পালানোর সুযোগ খুঁজতে লাগলো।

কিন্তু মুসলমান সৈন্যরা টিলাটি ঘিরে ফেলায় খৃষ্টান সৈন্যরা পালাবারও পথ পাচ্ছিল না। তারা তখন টিলার উপরে থেকেই আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ শুরু করলো। তাদের তখন একমাত্র চিন্তা, কি করে নিজেকে বাঁচানো যায়। উঁচু স্থানে থাকায় তারা তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল।

সে দিনটিও অতীত হয়ে গেল। রাতে মুসলমান সৈন্যরা শুকনো ঘাস ও খড়ি সংগ্রহ করে খৃষ্টান সৈন্যদের আশেপাশে আগুন ধরিয়ে দিল। টিলার শুকনো ঘাসে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। ক্রমে চারদিক থেকে আগুন তাদের ঘিরে ধরতে লাগলো।

শত্রু সেনারা যখন হাতিন প্রান্তরে এলো, তারা জানতেও পারলো না কি ভয়ংকর ফাঁদে তারা পা দিয়েছে। সুলতান আইয়ুবী তার বাহিনীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে কারা কখন একশনে যাবে বুঝিয়ে দিলেন।

কমান্ডো বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার ওপর দায়িত্ব পড়লো শত্রু সেনাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখার। কমান্ডো বাহিনীর ওপর দায়িত্ব পড়লো খৃস্টানদের সেনা ফাঁড়িগুলোর নিয়ন্ত্রণ, তাদের রসদপত্র আমদানীর পথে বাঁধা সৃষ্টি এবং রাতে শত্রু সেনাদের ব্যতিব্যস্ত রাখার। এসব কমান্ডোরা খৃস্টানদের মুহুর্তের জন্যও বিশ্রামের সুযোগ দিত না। এমনকি খৃস্টান সেনাপতি যে তার কমান্ডারদের সাথে একটু পরামর্শ করবেন সে সুযোগও পেতেন না তিনি।

১১৮৭ সালের ৪ জুলাই। সুলতান আইয়ুবীর মধ্য ভাগের সৈন্যরা খৃস্টানদের ওপর সরাসরি আক্রমণ চালালো। হাতিন ময়দানের চারপাশে ছিল বিরাট বিরাট মাটির টিলা। ক্রমেই খৃস্টানদের জন্য ময়দান সংকীর্ণ হয়ে আসতে লাগলো। ক্রুসেড বাহিনী কোন দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করলেই মুসলমানদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল ছুটে যেতো তাদের সামনে। তারা এমন তীব্র গতিতে আক্রমণ করতো যে খৃস্টানদের গতি তাতেই রুদ্ধ হয়ে যেতো।

সুলতান আইয়ুবীর তীরন্দাজ বাহিনী উঁচু টিলার ওপর অবস্থান নিয়েছিল। তারা সেখান থেকে খৃস্টানদের ওপর তীর বর্ষণ শুরু করলো। সুলতান আইয়ুবীর অবস্থা এমন ছিল, তিনি কখনও উপরে যেতেন, কখনও নিচে নেমে আসতেন।

গোয়েন্দা বাহিনী প্রতি মুহূর্তে ময়দানের প্রতিটি খবর সুলতানকে পৌঁছে দিচ্ছিল। খৃস্টান নাইট ও সৈন্যরা লৌহ পোষাকের ভেতর পুড়ে মরছিল। তাদের ঘোড়াগুলোও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছিল। দূরে নদীর বুকে তারা দেখতে পাচ্ছিল টলটলে স্বচ্ছ পানি। সেই পানি তাদের পিপাসা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল।

ক্রুসেড বাহিনী নিরূপায় হয়ে শেষ চেষ্টা হিসাবে প্রবল আক্রমণ চালালো। তখনো আইয়ুবীর বাহিনীর তুলনায় সংখ্যায় তারা অনেক। এই সংখ্যাশক্তির কারণে তারা বিজয়ের স্বপ্ন দেখছিল।

সুলতান আইয়ুবী খৃস্টানদের এ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নতুনভাবে সৈন্য সাজালেন। চাঁদের মতো অর্ধ বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে গেল মুজাহিদরা। শত্রুরা সোজা সামনে ছুটে এলো। তকিউদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে চলে গেলেন খৃস্টানদের পেছনে। এতে খৃস্টানরা পূর্ণ গোলচক্রে ঘেরাও হয়ে পড়লো।

এবার চারদিক থেকে মুসলমানরা টুটে পড়লো ওদের ওপর। খৃস্টানদের প্রবল তোড়ের মুখে সামনের দিকটা ফাঁকা হয়ে গেল। পানির কাছে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল খৃস্টান বাহিনী। সামনের দিক ফাঁকা পেয়ে তারা ছুটলো সেদিকে। মুহূর্তে দু’পাশের পাহাড় থেকে শুরু হলো তীরবৃষ্টি। টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো কমান্ডো বাহিনী। তীরের আওতা থেকে বেঁচে যারা সামনে এগিয়ে গেল তারা পড়লো দুর্ধর্ষ কমান্ডোদের কবলে। অশ্বারোহী কমান্ডোরা তাদের নির্বিচারে হত্যা ও পদদলিত করতে লাগলো।

চারদিক থেকে আক্রান্ত হওয়ায় সামনে অগ্রসর হওয়ার গতি স্তিমিত হয়ে এসেছিল ক্রুসেডারদের। টিলার ওপর থেকে অনর্গল তীর বর্ষিত হওয়ায় ময়দানে লুটিয়ে পড়ছিল আহত সৈন্য ও ঘোড়া। তারা পিষে যাচ্ছিল সহযোদ্ধাদের ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের নিচে। চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গেল ক্রুসেড বাহিনী। যুদ্ধের অবস্থা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতেই ক্রুসেড বাহিনী আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ শুরু করলো।

তারা আশা করছিল, শহর ও আশপাশের ফাঁড়ি থেকে যে কোন সময় তাদের জন্য সাহায্য এসে যেতে পারে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তাদের জানা ছিল না। সুলতানের কমান্ডো বাহিনী আগেই আশপাশের ফাঁড়িগুলো দখল করে নিয়েছিল। বাইরে থেকে সাহায্য আসার সব কয়টি পথ তারা বন্ধ করে দিয়েছিল। রসদ আসার প্রতিটি পথে তারা ওৎ পেতে ছিল। ফলে কোথাও থেকে কোন সাহায্য পাওয়ার সুযোগ ছিল না খৃস্টানদের।

হাতিনের যুদ্ধ ক্ষেত্রে বাইরে থেকে কোন সাহায্য না আসায় ক্রমেই খৃস্টানদের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। মুসলিম বাহিনীর ছোট ছোট দলের বেপরোয়া আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো ওরা।

সৈন্যদের মনোবল অটুট রাখার জন্য ‘মহান ক্রুশের রক্ষক’ আক্রার পাদ্রী, যিনি খৃস্টবিশ্বে বিশপের দায়িত্ব পালন করছিলেন, রণক্ষেত্রের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছুটাছুটি করছিলেন।

ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাসে এই পাদ্রীর অবদানকে খৃস্টানরা সব সময় শ্রদ্ধার চোখে দেখেছে। পাদ্রী নিজে ময়দানে উপস্থিত হয়েছিলেন সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য। তিনিই মুসলমান ও ইসলামকে নিঃশেষ করার জন্য ক্রুসেড বাহিনীকে শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন। খৃস্টান সম্রাট থেকে শুরু করে প্রতিটি নাইট ও সেনা সদস্যকে মহান ক্রুশ স্পর্শ করে শপথ বাক্য পাঠ করতে হয়েছে। খৃস্টজগতে আক্রার এ ক্রুশ ছিল সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাবান। শপথের পর সেই ক্রুশের একেকটি ক্ষুদ্র সংস্করণ প্রতিটি সৈনিকের গলায় পরিয়ে দেয়া হয়েছে। পাদ্রী সেই মহান ক্রুশটিও সাথে করে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে এসেছিলেন।

তিনি যখন দেখলেন খৃস্টান সম্রাট ও সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার পায়তারা করছে, তখন তিনি খুবই পেরেশান ও বিচলিত হলেন। তিনি সেই বিশাল ক্রুশ দেখিয়ে সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছিলেন।

সম্রাট গে অব লুজিয়ান তার দুই সঙ্গীর সাথে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, মুসলমান অশ্বারোহী দল তাকে দেখতে পেয়ে জীবিত বন্দী করে ফেললো।

প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পরাজিত হলো খৃস্টান বাহিনী। যুদ্ধে আক্রার পাদ্রী মারা গেলেন। বিশাল ক্রুশটি মুসলমানদের হাতে এসে পড়লো। সুলতান আইয়ুবী বায়তুল মোকাদ্দাস বিজয় করার পর সেই বিশাল ক্রুশটি সেখানকার এক গির্জার পাদ্রীর কাছে সসম্মানে জমা দিয়ে দেন।

সেদিন সন্ধ্যার আগেই হাতিন রনাঙ্গনের লড়াই শেষ হয়ে গেল। ক্রুসেড বাহিনীর ক্ষতির কোন পরিমাপ ছিল না। কত সৈন্য মারা গেছে তার হিসাব নেয়ারও কেউ ছিল না। শেষ পর্যন্ত যারা বেঁচে ছিল তারা অস্ত্রসমর্পন করে বন্দীত্ব কবুল করে নিল।

সুলতান আইয়ুবীর সামনে যখন যুদ্ধ বন্দীদের হাজির করা হলো তিনি বিস্মিত হলেন। সম্রাট রিমান্ড ছাড়া সকল খৃস্টান সম্রাটই বন্দী হয়েছিল এই যুদ্ধে। এদের মধ্যে ছিল ক্রাকের সম্রাট শাহ আরনাতও। আরনাতকে সুলতান আইয়ুবী নিজ হাতে হত্যা করার কসম খেয়ে ছিলেন।

যুদ্ধবন্দীদের সুলতান আইয়ুবীর সামনে হাজির করা হলে খৃস্টান সম্রাট জেফ্রেকে সুলতান আইয়ুবী ঠাণ্ডা শরবত দান করলেন। এর মানে হচ্ছে, মুজাহিদদের রক্তে হাত লাল করার পরও সুলতান তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অসংখ্য মুসলিম সৈন্যের হত্যাকারী জেফ্রেকে তিনি মৃত্যুদণ্ড দেবেন না। এটা ছিল তৎকালীন প্রচলিত যুদ্ধনীতি। কোন বন্দীকে শরবত পান করানোর মানেই হচ্ছে তিনি অনুকম্পা লাভের সুযোগ পাবেন।

সম্রাট জেফ্রে সুলতানের ব্যবহারে বিস্মিত ও অভিভুত হয়ে সুলতানের হাত থেকে শরবতের পেয়ালা গ্রহণ করলেন। তিনি অর্ধেক শরবত পান করে বাকী অর্ধেক শরবতসহ পেয়ালাটি তার পাশে দাঁড়ানো শাহ আরনাতের দিকে এগিয়ে ধরলেন।

আরনাত পেয়ালা হাতে নিয়ে শরবত পান করা শুরু করতেই সুলতান আইয়ুবী গর্জন করে জেফ্রেকে বললেন, ‘শরবত আমি আপনাকে দিয়েছি, ওকে দেইনি। ওকে জীবন ভিক্ষা দেয়ার কোন সিদ্ধান্ত আমি নেইনি। ওকে বলে দিন, এ শরবত আমার পক্ষ থেকে নয় বরং আপনার কাছ থেকে সে পেয়েছে।’

আরবদের প্রথা অনুযায়ী যাকে জীবন ভিক্ষা দেয়া হয় তাকে ঠাণ্ডা শরবত পান করানো হয়। শাহ আরনাতকে শরবত পান করতে দেখে সুলতানের চোখ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো।

সুলতান আইয়ুবী তার এক সেনাপতিকে বললেন, ‘যুদ্ধবন্দীদের ভালমত মেহমানদারী করো। তাদের খানাপিনার ব্যবস্থা করো।’

যুদ্ধবন্দীদের মেহমানদারীর হুকুম জারী করেই সুলতান তার তাঁবুতে ঢুকে গেলেন। বন্দীদের সামনে খাবার পরিবেশন করা হলো। তারা যখন খেতে শুরু করেছে সে সময় সুলতান আইয়ুবী সম্রাট জেফ্রে ও শাহ আরনাতকে তাঁর তাঁবুতে ডেকে পাঠালেন।

তারা সুলতানের তাঁবুতে প্রবেশ করলে তিনি শাহ আরনাতকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তুমি আমাদের রাসুল (সা.) কে সর্বদা গালমন্দ করো। তাঁর শানে অপমানজনক কথা বলো। তুমি বহুবার আমাদের হজ্জ কাফেলায় আক্রমণ করেছো। অসহায় নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করেছো। নারীদের সতীত্ব লুণ্ঠন করেছো। এমনকি মাসুম শিশুরাও তোমার হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহায় পায়নি। আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার অপরাধ ক্ষমা করা গেলেও নিরীহ মানুষ হত্যার অপরাধ আমি ক্ষমা করতে পারি না। শুধুমাত্র একটি শর্তে তোমাকে ক্ষমা করা যায়। তুমি তোমার অতীত পাপের জন্য তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে। আর ইসলাম গ্রহণ করে ভবিষ্যতে কখনো এ ধরনের অপরাধ করবে না বলে ওয়াদা করবে।’

সম্রাট শাহ আরনাত ইসলাম গ্রহণ করতে সরাসরি অস্বীকার করে বললো, ‘সম্রাট হয়ে আরবের এক রাখাল বালকের দ্বীন গ্রহণ করতে বলো আমাকে? আমার আনুগত্য পাওয়ার কি যোগ্যতা আছে তার?’

সুলতান আইয়ুবী দ্বিধাহীন চিত্তে দ্রুত তলোয়ার বের করে এক আঘাতে তার একটি বাহু দেহচ্যুত করলেন। গর্জন করে বললেন, ‘শয়তান! তুই আমার রাসূলকে গালি দিস, আল্লাহর দোস্তকে অপমান করিস! এত বড় স্পর্ধা তোর? যদি গালি তুই আমাকে দিতি তাহলেও তুই বাঁচতে পারতি। কোন ঈমানদার নবীর অপমান সহ্য করে না। তোর মতো জালিমের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড।’

ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, সে সময় সুলতান আইয়ুবীর পাশে কয়েকজন সেনাপতি অবস্থান করছিলেন। তারা আরনাতকে বাইরে নিয়ে হত্যা করলো। সুলতান ঘৃণার স্বরে বললেন, ‘ওর লাশ বাইরে রাস্তার ওপর ফেলে রাখো।’

সম্রাট জেফ্রে যখন তার সঙ্গীর এমন অবস্থা দেখলেন, তখন তাঁর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি মনে করলেন, এবার বুঝি তাকে হত্যা করা হবে।

সুলতান আইয়ুবী তার এমন অবস্থা দেখে সম্রাট জেফ্রের কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে শান্তভাবে বললেন, ‘কোন শাসক অন্য শাসককে হত্যা করে না। কিন্তু তার পাপ এত বেশী ছিল যে, তাকে হত্যা না করে আমার উপায় ছিল না। আমি তাকে হত্যা করার শপথ নিয়েছিলাম। আপনি ভয় পাবেন না।’

সুলতান বন্দীদের তাঁবু খাটানোর নির্দেশ দিলেন। বললেন, ‘সাধারণ বন্দীদেরকে একত্রে রাখো। নাইটদের জন্য আলাদা তাঁবুর ব্যবস্থা করো। সম্রাটদের জন্য তাঁবু খাটাও আমার তাঁবুর পাশে। প্রত্যেককে স্বসম্মানে যার যার মর্যাদা অনুযায়ী রাখার ব্যবস্থা করো। কেউ যেন নিজেকে অপমানিত না ভাবে।’

বন্দীদের জন্য তাঁবু খাটানো শুরু হলো। সুলতান আইয়ুবী সিজদায় পড়ে গেলেন। বললেন, ‘হে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। এ কেবল তোমারই শান। এ বিজয়ের সমস্ত কৃতিত্বই একান্ত তোমার। তুমি তোমার দ্বীনের জন্য যারা জীবন দিল তাদের শাহাদাতকে কবুল করো।’

ক্রাকের রাজ প্রাসাদ। গভীর রাত। সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতিতে বিরাজ করছে সুনসান নিস্তব্ধতা। মহলে শাহ আরনাত নেই। তার সেনাপতি ও মন্ত্রীরাও কেও নেই। সেখানে আছে শুধু মহলের মেয়েরা। কুলসুম ও তার চাকর চাকরানীরা মহলেই ছিল। পাশে রক্ষীদের ছাউনিতে ছিল কিছু সংখ্যক রক্ষীসেনা।

তখনও মহলে সম্রাট শাহ আরনাতের মৃত্যু সংবাদ পৌঁছেনি। রাতের প্রথম প্রহর শেষ হয়েছে। সবাই জানে, কুলসুম ঘুমিয়ে আছে নিজের কামরায়।

এক নারী লঘু পায়ে কুলসুমের কামরায় প্রবেশ করলো। তার হাতে খঞ্জর। সে কুলসুমের পালংকের কাছে গেল। কামরায় কোন আলো ছিল না। মহিলাটি আন্দাজের ওপর ভর করে খঞ্জর উপরে তুলে পূর্ণ শক্তিতে নামিয়ে আনলো নিচে। কিন্তু কোন চিৎকারের শব্দ শোনা গেল না। খঞ্জরের আঘাত পালংকের গদিতে বিদ্ধ হয়ে খচ করে শব্দ হলো মাত্র। মহিলাটি বিস্মিত হয়ে বিছানার চাদরে হাত রাখলো, সেখানে কুলসুম নেই। মহিলাটি ভাবলো, কুলসুম হয়তো বাথরুমে গেছে, এক্ষুণি ফিরে আসবে। সে পালংকের পাশে ওঁৎ পেতে বসে রইলো।

একটু পর আলতো পায়ে কেউ কামরায় প্রবেশ করলো। পদশব্দ পালংকের কাছে এসে থেমে গেল। ওঁৎ পেতে থাকা মহিলা অন্ধকারেই দ্রুত উঠে খঞ্জর দিয়ে আঘাত করলো আগন্তুককে। নারীকণ্ঠের চিৎকার খান খান করে দিল রাতের নিস্তব্ধতা। তৎক্ষণাৎ আগন্তুক মহিলা তার খঞ্জর সামনের ছায়ামুর্তির পেটে চেপে ধরলো পূর্ণশক্তিতে। খঞ্জর আমূল ঢুকে গেল সেই মহিলার পেটে।

তখন উভয়ে উভয়কে জাপটে ধরে আঘাত করতে শুরু করলো। আঘাত খেয়ে দুজনই দৌড় দিল দরজার দিকে। ছিটকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে পড়লো দু’জন।

ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছিল দু’জনেরই শরীর থেকে। পেট চেপে ধরে উঠে বসলো দুই আততায়ী। তারা পরষ্পরের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সেখানে কুলসুম নেই, তারা উভয়েই মহলের চাকরানী।

তারা উভয়েই এসেছিল কুলসুমকে হত্যা করতে। দিনে দু’জন মিলেই এ হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কথা ছিল, কুলসুম ঘুমিয়ে গেলে আজ রাতেই তারা তাকে হত্যা করবে। কুলসুমকে হত্যার পরিকল্পনার সময় ওরা কেউ ভাবেনি, এমন ভুল ও জঘন্য ঘটনার শিকার হবে তারা নিজেরাই। নিজেদের ভুলের কারণে এখন দু’জনই মরণাপন্ন। অন্ধকার কামরায় ওরা কেউ কাউকে চিনতে পারেনি। প্রতিপক্ষ কুলসুম ছাড়া আর কেউ হতে পারে এমন ভাবনাও উদয় হয়নি কারো মনে।

সে সময় কুলসুম শুধু মহলেই নয়, ক্রাক শহর থেকেও অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। সেদিনই বাকার তার সাথী গোয়েন্দাদের মারফত খবর পেয়েছিল, হাতিনের সমরাঙ্গনে ক্রুসেড বাহিনী চরমভাবে পরাজয় বরণ করেছে।

ক্রাকের গোয়েন্দারা বাকারকে বললো, ‘এবার তুমি কুলসুমকে নিয়ে শহর থেকে পালিয়ে যাও।’

সে রাতে কুলসুমের জন্য শহরের দরজা খোলা কোন ব্যাপারই ছিল না। সবাই জানতো, এ মেয়ে সম্রাট আরনাতের কোন সাধারণ রক্ষিতা নয়, প্রিন্সেস লিলি সম্রাটের সবচেয়ে প্রিয়ভাজন নারী। যেখানে তার ইচ্ছার মূল্য দেয় স্বয়ং সম্রাট সেখানে কোন রক্ষীর পক্ষে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করা সম্ভব ছিল না।

রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে সে তার গাড়ীচালক সায়বলকে ডেকে পাঠালো। বললো, ‘সায়বল, বিকালে যখন বেড়াতে বেরিয়েছিলাম তখন আমার গলার হার কোথায় যেন পড়ে গেছে। সম্ভবত বাগানে যে পাথরের ওপর বসেছিলাম ওখানেই পড়েছে। জলদি গাড়ী বের করো। আমি এখনি ওখানে যাবো।’

অনুগত ভৃত্যের মতো সায়বল নামধারী বাকার বিন মুহাম্মদ সাথে সাথে গাড়ী নিয়ে ফটকে হাজির হয়ে গেল। প্রিন্সেস লিলি একই কথা বললো রক্ষীদের। বিলম্ব না করে প্রহরীরা ফটক খুলে দিল। বাকারকে কুলসুমকে নিয়ে বেরিয়ে এলো মহলের চার দেয়ালের বাইরে।

মহলের কোন মেয়েই কুলসুমকে রাতে যেতে দেখেনি। একমাত্র ফটকের রক্ষী ছাড়া আর কেউ জানতো না কুলসুম বাকারকে নিয়ে মহলের বাইরে গেছে। সেই রাতেই দুই মেয়ে তাকে হত্যা করতে গিয়ে নিজেরা রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়।

শহর থেকে সামান্য দূরে তাদের জন্য দুটি ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছিল এক গোয়েন্দা। কয়েকজন অন্ধকারে ওঁৎ পেতেছিল, যদি ওদের কেউ ধাওয়া করে তবে তাদের ব্যবস্থা করার জন্য। গোয়েন্দাটি ঘোড়া নিয়ে অন্ধকারে লুকিয়েছিল। দেখতে পেল এগিয়ে আসছে রাজকীয় গাড়ী। গোয়েন্দাটি সন্তর্পনে ঘোড়া দুটি নিয়ে অন্ধকার থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলো।

গাড়ী সেখানেই রেখে কুলসুম ও বাকার ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে বসলো এবং গোয়েন্দাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারের রাজ্যে। পরের দিন রাস্তায় এক কাসেদের কাছ থেকে জানতে পারলো, খৃস্টান বাহিনী সমূলে ধ্বংস হয়ে গেছে। সম্রাট আরনাত নিহত হয়েছেন। সুলতান আইয়ুবী এখন হাতিনেই আছেন তবে অচিরেই তিনি নাসিবা গমন করবেন।

কুলসুম সুলতান আইয়ুবীর কাছে যেতে চাচ্ছিল। সে বাকারকে বললো, ‘তাড়াতাড়ি চলো। আমি সুলতানকে নাসিবা গমন করার আগেই ধরতে চাই।’

তারা তখন গ্যালিলি সাগরের কাছে পৌঁছে গেছে। বাকার কুলসুমকে নিয়ে সাগর পেরিয়ে নির্বঘ্নে হাতিনে পৌঁছলো। তাকে যখন সুলতান আইয়ুবীর কাছে নিয়ে গেল বাকার, কুলসুম সুলতানের পায়ের উপর আছড়ে পড়লো।

‘ওরে আমার বেটি!’ সুলতান আইয়ুবী তাকে পায়ের ওপর থেকে টেনে তুলে আদর করে বললেন, ‘আমাদের এই সাফল্যের পেছনে তোমার মতো কতো যে মেয়ের অবদান ও ঋণ রয়েছে! আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তোমাদের কোরবানী কবুল করেন।’

‘আমি তার লাশটি দেখতে চাই।’ কুলসুম বললো।

‘সকল লাশই জর্ডান নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তাকে আমি নিজের হাতে শাস্তি দিয়েছি। বিশ্বাস করো, তার অপকর্মের শাস্তি সে পেয়েছে।’

‘আমি নষ্টা, পাপী। আপনি বলুন, আল্লাহ কি আমাকে ক্ষমা করবেন?’

‘আল্লাহ বড় মেহেরবান। তার দয়া থেকে নিরাশ হতে নেই। নিশ্চয়ই তিনি তোমার খেদমত কবুল করবেন।’

‘আমাকে কি আপনি আপনার সাথে থেকে আরো খেদমত করার সুযোগ দেবেন?’

সুলতান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘অবশ্যই তুমি দ্বীনের আরো খেদমত করার সুযোগ পাবে। তবে আমার সাথে থাকার জন্য আল্লাহ তোমাকে সৃষ্টি করেননি। আমাকে এখান থেকে আরো বহু দূর যেতে হবে। আমার কথা শোন। তোমাকে আগামীকাল কায়রো পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেখান থেকেই তুমি আমাদের জন্য দোয়া করতে থাকবে। দোয়া করবে আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে দ্বীনের জন্য কবুল করে নেন। যেন আমরা ক্রমশ আরো সামনে অগ্রসর হতে পারি। যেখান থেকে সূর্য উদয় হয় আর সন্ধ্যায় ডুবে যায় তার সবখানে যেন আমরা আল্লাহর দ্বীনের ঝাণ্ডা উড়িয়ে দিতে পারি। সবার কাছে যেন আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পয়গাম পৌঁছে দিতে পারি। আপাতত এটুকু করলেই আমাদের জন্য অনেক করা হবে মা।’

হাতিনের সফলতা মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল এ জন্য যে, এই বিজয়ের ফলে মুসলমানদের সামনে ফিলিস্তিনের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। হাতিনের সফলতার পথ ধরেই সুলতান আইয়ুবী ফিলিস্তিন প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। এতবড় বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করার পর তার জন্য বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করা খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। তিনি হাতিন ও তার আশপাশের এলাকায় নিজের মজবুত ঘাঁটি গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করার জন্য যে প্রস্তুতি, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্রের দরকার, এই বিজয়ের ফলে সে সব জোগাড় করা তাঁর জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিল।

হাতিন প্রান্তরে সুলতান আইয়ুবী যে সফলতা লাভ করেন তা কোন সাধারণ সফলতা ছিল না। খৃস্টানদের সাতটি সম্রাটের ঐক্যবদ্ধ শক্তি, যারা সুলতান আইয়ুবীকে চিরদিনের জন্য শেষ করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে নেমেছিল, হাতিন প্রান্তরে তারা নির্মমভাবে পরাজিত হয়েছিল।

খৃস্টানদের পরিকল্পনা ছিল সুলতান আইয়ুবীকে নিঃশেষ করার পর তারা মদীনা মনোয়ারা ও মক্কা মুয়াজ্জমার দিকে অগ্রসর হবে। মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র মক্কা মদীনা দখল করে তারা দুনিয়ার বুক থেকে ইসলামের নাম নিশানা মুছে দেবে। তাদের সম্মিলিত সামরিক শক্তি মরুভূমিতে এমন প্রলয় সৃষ্টি করবে, মরুভূমির বালির পাহাড়গুলো ধূলি ঝড় হয়ে সমগ্র মরুভূমিতে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু তাদের সে স্বপ্নই শুধু বানচাল হয়নি, এ যুদ্ধে চারজন প্রতাপশালী খৃস্টান শাসক যুদ্ধবন্দী হয়ে সুলতানের অনুকম্পার ভিখারী হয়েছেন। এদের মধ্যে জেরুজালেমের প্রবল শক্তিধর সম্রাট গে অব লুজিয়ানও আছেন। এই যুদ্ধের ফলে ক্রুসেড বাহিনীর নৈতিক শক্তি একদম ভেঙ্গে পড়েছিল। সুলতান আইয়ুবীর সামরিক শক্তির প্রাধান্য সর্বত্র স্বীকৃতি পেয়েছিল।

যুদ্ধ শেষ হলেও কমান্ডো বাহিনীর তৎপরতা বন্ধ হয়নি। তারা পলাতক খৃস্টান সৈন্যদের ধরে ধরে বন্দী করছিল। খৃস্টান সৈন্যদের মনোবল এমন ভেঙ্গে গিয়েছিল যে, মাত্র একজন মুসলিম সৈন্য ত্রিশ-চল্লিশজন পলাতক খৃষ্টান সৈন্যকে তাঁবুর রশি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যেতো। খৃস্টান সেনাদের নিরস্ত্র করে তাদের হাঁকিয়ে নেয়ার এমন দৃশ্য ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। ইউরোপের বিভিন্ন ঐতিহাসিকরাও এমন ঘটনার বর্ণনা করেছেন। তারা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সামরিক যোগ্যতা ও দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন।

ভূমধ্যসাগরের তীরে ইসরাইল রাষ্ট্রের উত্তরে একটি প্রসিদ্ধ শহর আক্রা। এই শহরের খ্যাতির কারণ ছিল, সেখানে ক্রুসেড যুদ্ধের মহান ধর্মীয় নেতা, খৃস্টান বিশ্বের সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিশপ নিজে অবস্থান করতেন। তার কাছেই ছিল খৃস্টানদের মর্যাদার প্রতীক বিশাল ক্রুশটি।

এই ক্রুশটি সম্পর্কে খৃস্টানদের ধারণা ও বিশ্বাস ছিল, হযরত ঈসা (আ.)কে এই ক্রুশ কাঠেই বিদ্ধ করা হয়েছিল। ফলে এই ক্রুশকে তারা মহান ও পবিত্র বলে জ্ঞান করতো। সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত প্রতিটি সৈনিককে এই ক্রুশ ছুঁয়ে শপথ করতে হতো- যতোদিন পৃথিবীর বুকে খৃস্টানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত না হবে ততোদিন তারা বিশ্রাম নেবে না। এই আধিপত্য বিস্তারের পথে অন্তরায় ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে মিটিয়ে দিতে হবে। এ জন্য মুসলমানদের সাথে যখন যুদ্ধ হবে তখন কেউ পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে না।

যুদ্ধবাজ খৃস্টানরা এই ক্রুশ স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করতো বলে তাদেরকে বলা হতো ক্রুশধারী আর তারা যে যুদ্ধ করতো তাকে বলা হতো ক্রুসেড। প্রতিজ্ঞাকারী সকল খৃস্টান এই ক্রুশের অনুরূপ ক্ষুদ্র ক্রুশ গলায় তাবিজের মতো ঝুলিয়ে নিত। সুতরাং যুদ্ধের ময়দানে যত খৃস্টান সৈন্য নিহত হতো ততোবার ক্রুশ পতিত হতো। আল্লামা ইকবাল খৃস্টানদের এই মৃত্যুকে বলতেন ক্রুশের পতন।