‘সুবাক দুর্গে আক্রমণ’ আসাদ বিন হাফিজ রচিত ‘ক্রুসেড সিরিজে’র তৃতীয় উপন্যাস। সিরিজের প্রথম দু’টি উপন্যাসের মত এটিও লিখিত হয়েছে ‘আবদুল হক’ অনূদিত ‘আলতামাশে’র ‘দাস্তান ঈমান ফারুশোকী’র ছায়া অবলম্বনে। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে। লেখক নিজেই এটির প্রকাশক। বইটির সপ্তম মুদ্রণ প্রকাশিত হয় জানুয়ারি ২০১২তে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রীতি প্রকাশন, ৪৩৫/ক বড় মগবাজার, ঢাকা ১২১৭। গ্রন্থস্বত্ব লেখকের।
বইটি সম্পর্কে শেষ প্রচ্ছদে লেখা হয়েছে— “গাজী সালাহুদ্দীন সেই অসামান্য সেনাপতি, অজস্র কুটিল ষড়যন্ত্র, ভয়াবহ সংঘাত আর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য থেকে যিনি ছিনিয়ে এনেছিলেন বিজয়। খ্রিস্টানরা চাচ্ছিল দুনিয়ার বুক থেকে ইসলামের নাম নিশানা মুছে দিতে, তাদের সহযোগিতা করছিল ক্ষমতালোভী, বিলাসপ্রিয় মুসলিম আমীর ওমরারা। কৈশোরেই তিনি হাতে নিয়েছিলেন অস্ত্র, জীবন পার করেছেন এমন সব অবিশ্বাস্য ঘটনার মধ্য দিয়ে যা কল্পনা করতেও শিউরে উঠে মানুষ। বীরত্ব ও মহানুভবতার এমন সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যার কারণে শত্রুর চোখেও হয়ে উঠেছেন ‘গ্রেট সালাদীন’।
“ইতিহাসে তাঁর সংঘাত, সংঘর্ষ ও বিজয়ের বিস্তর কাহিনী থাকলেও পাশ্চাত্য লেখকরা খ্রিস্টানদের লেলিয়ে দেয়া সেইসব গুপ্তচররূপী ছলনাময়ী রূপসী নারীদের কথা লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছে, যারা বার বার আঘাত হেনেছে সালাহুদ্দীনকে।
“সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সেইসব অকথিত কাহিনী এবং অবিশ্বাস্য ঘটনাবহুল জীবনের শিহরিত ও রোমাঞ্চকর বর্ণনায় ভরপুর ‘ক্রুসেড’ সিরিজের ভূবনে সবাইকে স্বাগতম।”
এই সিরিজের পূর্বের দুটি গ্রন্থের মত এটিও ‘ইসলামী উপন্যাস’ হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করলেও নারীদেহের অত্যধিক সৌন্দর্য বর্ণনা এবং ভাষা ইসলামী সাহিত্যের সাথে বেমানান মনে করেন সমালোচকেরা। এছাড়া ইতিহাস নির্ভর কাহিনী হলেও এর সাথে প্রকৃত ইতিহাসের মিল খুব সামান্যই। বলা চলে এটি নিছক সাহিত্য।
বিষের ছোঁয়া
কায়রোর উপশহরের এক মসজিদ। একদিন সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে শহরতলীর সে মসজিদের কাছে এসে থামল আটজন অশ্বারোহী। মসজিদ থেকে সামান্য দূরে এক সরাইখানার ফটকে এসে ঘোড়া থেকে নামল ওরা। ঘোড়াগুলো তুলে দিল সরাইখানার লোকজনের হাতে। তারপর দু’জন দু’জন করে চারটে দলে ভাগ হয়ে ওরা মসজিদের চারদিকটা ভাল করে ঘুরে দেখল।
এশার নামাজের আযান হল। ওরা একে একে এসে প্রবেশ করল মসজিদে। প্রথম সারিতে নামাজ পড়ল চারজন, চারজন দাঁড়াল মসজিদের ভিতরের সর্বশেষ কাতারে।
নামাজ শেষ হল, মিম্বরে উঠে দাঁড়ালেন ইমাম সাহেব। লোকজন প্রতিদিনের মত আজও ইমাম সাহেবের ওয়াজ শোনার জন্য যে যার জায়গায় বসে পড়ল।
ওয়াজ শুরু করলেন ইমাম সাহেব। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ‘ইমাম সাহেব! আল্লাহ আপনার জ্ঞানের আলো আরও বাড়িয়ে দিক। আপনার খ্যাতি শুনে আমরা আটজন অনেক দূর থেকে এসেছি। সমস্যা মনে না করলে জিহাদের বিষয়ে কিছু বলুন। জিহাদের তাৎপর্য আমরা বুঝি না। লোকজন বলছে আমাদের নাকি জিহাদের ভুল অর্থ বুঝানো হয়েছে।’
‘আমরা জিহাদ সম্পর্কে আপনার বয়ান শুনতে চাই।’ সাতটি কণ্ঠ একসঙ্গে প্রতিধ্বনিত হল।
একজন বলল, ‘এ হচ্ছে সময়ের দাবী। আমাদের জিহাদের ভুল ব্যাখ্যা শোনানো হয়েছে। আমরা সঠিক অর্থ জানতে চাই।’
‘কোরআনের নির্দেশ কেউ পরিবর্তন করতে পারে না।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘কোরানের বাণী মানুষের কান পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া আমার দায়িত্ব। একবার নয়, হাজার বার আমি আপনাদের কাছে জিহাদের তাৎপর্য তুলে ধরতে প্রস্তুত। জিহাদের অর্থ অন্যের জমি দখল করা বা কারও গলা কাটা নয়। হত্যা, মারামারি বা খুনাখুনিও জিহাদ নয়।’ তিনি কোরানের আয়াত পড়ে বললেন, ‘এ আমার কথা নায়, খোদার কালাম। সর্বোত্তম জেহাদ হচ্ছে নিজের নফস বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করা। তাইতো আমি বলি, পাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই হচ্ছে আসল জিহাদ। তোমরা শোননি, ইসলাম তরবারীর জোরে নয়, প্রেম এবং ভালবাসা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে জিহাদের অর্থ বলদে গেছে। এর অর্থ পরিবর্তন করেছে ক্ষমতালোভীরা। খ্রিষ্টানরা অন্যের দেশ দখল করাকে ধর্মযুদ্ধ বলে। মুসলমানও একই উদ্দেশ্যে লড়াই ও ঝগড়া করাকে জিহাদ বলে। আর এসব কথা বলে ক্ষমতাসীন শাসকরা। তারা এসব বলে তাদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। মানুষকে ধর্মের কথা বলে যুদ্ধে লিপ্ত করে রাজা বাদশারা। এতে রাজাদের শাসন ক্ষমতা পাকাপোক্ত হয়। কিন্তু প্রাণ যায় সাধারণ মানুষের।’
‘সালাহুদ্দীন আয়ুবীও কি মানুষকে অন্যায়ভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে দিয়েছেন?’ প্রশ্ন করল একজন।
‘না! তার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হোক। বড়রা তাকে যা বলেছে, আন্তরিকতার সাথে তাই তিনি পালন করছেন। খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে তার মনে ঘৃণা সৃষ্টি করা হয়েছে। ভেবে দেখো—খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়! দু’জন নবীর কথাইতো এক। হযরত ঈসা (আ.) প্রেম ভালবাসার কথা বলেছেন। আমাদের নবীও মানুষকে ভালবাসতে বলেছেন। তাহলে এসব যুদ্ধ বিগ্রহ এল কোত্থেকে! আল্লাহর জমিনে যারা নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করে মানুষকে গোলামে পরিণত করতে চায় এসব তাদের আবিষ্কার।
আমি মিসরের সম্মানিত আমীরের কাছে যাব। তাঁকে বোঝাব জিহাদের সত্যিকার তাৎপর্য। অশিক্ষা এবং অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে তিনি যা করছেন এ হচ্ছে সত্যিকারের জিহাদ। খোতবা থেকে খলিফার নাম মুছে তিনি বড় জিহাদ করেছেন। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সামরিক প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। শিশুদেরকে খোদার নামে যুদ্ধবিগ্রহ শেখানো হচ্ছে। এদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে তীর ও তরবারী। এ তীর ও তরবারী ওরা কোথায় ব্যবহার করবে? অবশ্যই কিছু মানুষ দেখিয়ে বলতে হবে, এরা তোমাদের শত্রু। এদের নিশ্চিহ্ন কর।’
ইমাম সাহেবের কণ্ঠে ছিল অবর্ণনীয় আকর্ষণ। যাদুগ্রস্তের মত আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল শ্রোতারা। তিনি আবার শুরু করলেন, ‘তোমাদের শিশুদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর। তাদের সাথে তোমরাও আগুনে পুড়বে। তোমরাই ওদেরকে পাপের পথে নিক্ষেপ করেছ। সেনাপিত এবং সম্রাটগণ তোমাদের স্বর্গে নিয়ে যেতে পারবে না। শুধু দ্বীন ইসলামের প্রদীপধারী ইমাম এবং আলেমরাই স্বর্গ দিতে পারবে। সমগ্র জীবন নামাজ পড়লে এবং ভাল কাজ করলেও মানুষের রক্তে রঙ্গীন হাত দোজখে নিক্ষিপ্ত হবে।
তোমরা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাকাত প্রদান কর। কোষাগার হল সরকারের, সরকার গরীব নয়। যাকাত হল গরীবের অধিকার। তোমাদের যাকাতের টাকায় অস্ত্র এবং ঘোড়া কিনে মানুষকে হত্যা করা হয়। যাকাত দিয়ে তোমরা বেহেস্তে যাবে, অথচ এখন পাপের ভাগী হচ্ছ। এজন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাকাত দেয়া যাবে না।’
ইমাম সাহেব আলোচনার বিষয় ঘুরিয়ে বললেন, ‘অনেক কথা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। বলারও কেউ নেই। মানুষের মধ্যে রয়েছে একটা কামজ রিপু। এ এক জৈবিক সত্বা। তোমাদের কি নারীর প্রয়োজন হয় না! এ হচ্ছে স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদা। আল্লাহই এ চাহিদা তৈরী করেছেন। তোমরা এ চাহিদা পূরণ করতে পার। এ জন্যই আল্লাহ একসঙ্গে চার স্ত্রী ঘরে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। একজন স্ত্রীও যদি না রাখতে পার তবে টাকার বিনিময়ে কোন নারীর কাছে আকাঙ্ক্ষা পুরণ করতে যাওয়া অপরাধ হবে কেন? এ চাহিদা এ আকাঙ্ক্ষা তো খোদারই দান। তাই নিরূপায় হলে এ চাহিদা তোমাদেরকে অন্ধগলিতে নিয়ে যায়। এ অপরাধ নয়। এরপরও পাপ থেকে বেঁচে থেকো, কোন পুরুষের কাছে যেয়ো না। কারণ, কোরানে আছে, পুরুষের কাছে যাওয়ার অপরাধে আল্লাহ আ’দ ও সামুদ জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল।
এক থেকে চার পর্যন্ত যত ইচ্ছে বিয়ে করতে পার। নিজের স্ত্রী এবং মেয়েদেরকে ঘরের ভেতর রাখবে। আমি দেখেছি যুবতী মেয়েদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। শেখানো হচ্ছে ঘোড়সওয়ারী, অসি চালনা এবং আহতকে প্রাথমিক চিকিৎকা দানের পদ্ধতি। ওরা যুদ্ধে যাবে। আহতদের সেবা করবে। প্রয়োজনে যুদ্ধ করবে। ফলে পর্দার বিধান লঙ্ঘিত হবে। এ চরম পাপ। এ পাপ থেকে নিজে বেঁচে থাকো। যারা মসজিদে আসে না তাদেরকেও বলো। খোদার বিধানে কেউ হস্তক্ষেপ করো না। এ বড়ই গুণার কাজ।’
ইমাম সাহেবের ওয়াজ শেষ হল। বসার স্থান না পেয়ে দাঁড়িয়েই অনেক শ্রোতা। একজন একজন করে হুজুরের সাথে হাত মিলিয়ে সবাই ফিরে যেতে লাগল। কেউবা ঝুঁকে তাঁর হাতে চুমো খেলো।
ইমাম সাহেবের সামনে দু’জন লোক বসা। পরণে জুব্বা। মাথায় পাগড়ি। জরির কাজ করা রুমালে ঢাকা মুখের একাংশ। কাল দীর্ঘ দাড়ি। পোশাকে আশাকে মধ্যবিত্ত মনে হয়। একজনের এক চোখ হলুদ কাপড়ে বাঁধা। বললেন, হুজুর, ‘জিহাদ সম্পর্কে আরও কিছু বলুন।’
‘তোমার চোখে কি হয়েছে?’
‘হুজুর, আমার এক চোখ খারাপ।’
ইমাম সাহেব তাকালেন সঙ্গীর দিকে। সঙ্গীটির মুখের একাংশ রুমালে ঢাকা, ঘন দাড়ি। এ দু’জন ছাড়া সবাই চলে গেছে।
‘তোমাদের সন্দেহ এখনও দূর হয়নি?’ মৃদু হেসে ইমাম সাহেব প্রশ্ন করলেন।
‘সন্দেহ দূর হয়েছে।’ জবাব দিল একচোখা লোকটি। ‘আমরা সম্ভবত আপনাকেই খুঁজছি। মিসরের অর্ধেকটা চষে বেড়িয়েছি আপনার জন্য। আমাদেরকে ভুল ঠিকানা দেয়া হয়েছিল।
‘অর্ধেক মিসরেও আমার মত আলেম পাওনি?’
‘খুঁজেছি তো আপনাকে। আমরা কি সঠিক স্থানে আসিনি? ওয়াজ শুনে মনে হল আমরা আপনাকেই চাইছি।’
বাইরের দিকে তাকালেন ইমাম সাহেব। বললেন, ‘আবহাওয়া কেমন হবে জানি না।’
‘বৃষ্টি আসবে।’ একচোখা লোকটির জবাব।
‘পরিষ্কার আকাশ।’
‘আমরা মেঘের সৃষ্টি করব।’ বলেই হেসে উঠল লোকটি। ইমাম সাহেব মুচকি হেসে ফিসফিসিয়ে বললনে, ‘কোত্থেকে এসেছ?’
‘এক মাস ছিলাম ইস্কান্দারিয়া, তার আগে সুবাক।’
‘মুসলমান?’
‘ঘাতক দলের সদস্য। মুসলমান মনে করতে পারেন।’
এবার দু’জনই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
‘আপনাকে ওস্তাদ মানছি।’ লোকটির সঙ্গী বলল। ‘এ যে আপনিই আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না।’
‘আপনি ব্যর্থ হতে পারেন না।’
‘সাফল্য অত সহজ নয়।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘সালাহুদ্দীনকে তোমরা চেন না। আমি জিহাদ এবং জীবন সম্পর্কে এদের চিন্তাধারা বদলে দিয়েছি। কিন্তু সালাহুদ্দীনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের সফল হতে দিচ্ছে না। জিহাদ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য তোমরা কেন আমাকে বারবার চাপ দিচ্ছিলে?’
‘সুবাক থেকে আমাদের বলা হয়েছে এটিই আপনরার বড় পরিচয়।’ জবাব দিল একচোখা লোকটি। ‘আপনার বলা প্রতিটি কথাই ওখানে আমাদে শোনানো হয়েছে। আমাদের আরও বলা হয়েছে, আপনার ওয়াজে অবশ্যই যৌনতার প্রসঙ্গ থাকবে। এসব শিখতে আপনি নিশ্চয় অনেক পরিশ্রম করেছেন?’
‘আমার নাম কি?’
‘আপনি কি আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন? সন্দেহ করছেন আমাদের? পরস্পরের পরিচিতির জন্য নাম নয় আমরা বিভিন্ন সংকেত ব্যবহার করি।’
‘তোমরা কি জন্য এসেছ?’
‘ঘাতকদল কি কাজ করে?’
‘আমার কাছে পাঠানো হয়েছে কেন?’
‘একটা উষ্ট্রীর জন্য। আপনার কাছে দু’টি রয়েছে। আপনার কাছে আসার কথা ছিল না। আপনি হয়ত খবর পেয়েছেন সালাহুদ্দীনের এক কমাণ্ডার রজবের কাছে সুবাক থেকে তিনটি উষ্ট্রী দেয়া হয়েছিল। একটা ছিল আমাদের জন্য। কিন্তু দু’টাই মারা গেছে। রজবের কাটা মাথা আর সবচে সুন্দরী উষ্ট্রীটা সালাহুদ্দীনের হাতে পৌঁছেছে। ওটাও শেষ।’
‘হ্যাঁ, শুনেছি।’ ইমাম সাহেবের বিষন্ন কণ্ঠ। ‘আমাদের অনেক ক্ষতি হল। সালাহুদ্দীনের এক শক্তিশালী সেনাপতি আমাদের হাতে ছিল। তাকেও জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। ভেতরে চল, এসব কথার জন্য এ স্থান উপযুক্ত নয়।’
দু’জনই ইমাম সাহেবের সাথে বেরিয়ে গেল।
ইমাম সাহেব দু’জনকে নিয়ে বাড়ীতে প্রবেশ করলেন। বাড়িটি পরিচ্ছন্ন। দু’ তিনটা কামরা পেরিয়ে একটি কামরার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। ওদের সামনে পুরনো এক দরজা। দরজায় তালা লাগানো। মনে হয় দীর্ঘ দিন থেকে খোলা হয়নি। এক পাশে জানালা। ইমাম সাহেব হাত লাগালেন। জানালার পাল্লা খুলে গেল। সবাই ভেতরে তাকাল। সাজানো গোছানো কক্ষ। দেয়ালে ঝুলছে সোনার তৈরী ক্রুশ। একপাশে যিশুর অন্যদিকে মা মেরীর হাতে আঁকা ছবি। ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমার গীর্জা। আমার আশ্রয়।’
‘আকস্মিক বিপদ থেকে বাঁচার জন্য কি ব্যবস্থা রেখেছেন?’ একচোখা লোকটি প্রশ্ন করল। ‘ক্রুশ এবং ছবিগুলো এভাবে রাখা ঠিক হয়নি।’
‘এখানে আসার দুঃসাহস কেউ করবে না।’ ইমাম সাহেব হেসে বললেন। ‘মুসলমানরা সরল এবং আবেগপ্রবণ জাতি। হালকা যুক্তি আর আবেগময় কথায় ওরা জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। জৈবিক চাহিদা মানুষের বড় দুর্বলতা। আমি এ দুর্বলতা উস্কে দিচ্ছি। এদের শিখাচ্ছি চারটে বিয়ে করা ফরজ। ধীরে ধীরে নিয়ে যাচ্ছি অশ্লীলতার দিকে। ধর্মের নামে মুসলমানকে দিয়ে ভাল-মন্দ দুটোই করানো যায়। হাতে কোরান দেখলে এরা মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে নেয়। এ আমার সফল অভিজ্ঞতা। আমি এমন একদল লোক তৈরী করব যারা কোরান হাতে নিয়ে মসজিদে বসেই জিহাদ এবং সৎকর্ম নিশ্চিহ্ন করে দেবে। আমি মেয়েদের ব্যাপারে ওদের চিন্তাধারা পরিবর্তন করে দিচ্ছি। সালাহুদ্দীন মেয়েদের সামরিক ট্রনিং দিচ্ছে। আমি ওদের ঘরের কোণে বন্দী রেখে অর্ধেক জনশক্তি বেকার করে দেব।’
‘সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছাড়ানো উচিৎ।’ একচোখা লোকটির সঙ্গী বলল। ‘সালাহুদ্দীনের বড় সাফল্য, তিনি ফৌজ এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। এ মহূর্তে যদি ঘোষণা করেন, ফিলিস্তিন জয় করব, তবে মিসরের সব মানুষ তার সঙ্গী হবে।’
‘তিনি এমন ঘোষণা দেবেন না। কারণ তিনি বুদ্ধিমান। আবেগপ্রবণ লোক তিন পছন্দ করেন না। একশ’ উত্তেজিত জনতার চেয়ে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিককে তিনি বেশী প্রাধান্য দেন। তিনি সস্তা শ্লোগান দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করার লোক নন, তিনি বাস্তববাদী। মানুষকে বাস্তবতা আর প্রশিক্ষণ থেকে দূরে রেখে আবেগপ্রবণ করাই আমাদের কাজ। চিন্তা ছেড়ে দেবে মুলসমানরা। অবাস্তব আবেগে উত্তেজিত হবে। থমকে যাবে শত্রুর নিক্ষিপ্ত প্রথম তীর দেখে। আবেগ ছাড়া ওদের সব কিছুই আমরা নিঃশেষ করে দেব। দেখনি ওয়াজে আমি সালাহুদ্দীনের কেমন প্রশংসা করেছি।’
‘এসব কথা পরে হবে। আমরা উষ্ট্রী দুটো দেখতে চাই। তারপর বলুন, আমাদের কিভাবে আশ্রয় দেবেন। ও দু’জন ছাড় এখানে কি অন্য কোন লোক থাকে?’
‘না, এখানে আর কেউ থাকে না।’
ইমাম সাহেব এখন সন্দেহমুক্ত। আলাপচারিতা থেকে তিনি নিঃসন্দেহ হয়েছেন যে এরা গোপন ঘাতক দলের সদস্য। তিনি তালা খুলে কামরায় প্রবেশ করে বসতে দিলেন ওদের।
‘আপনারা বসুন, আমি ওদের নিয়ে আসছি।’
কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। একটু পর ফিরে এলেন সঙ্গে দুই অপরূপা যুবতীকে নিয়ে। দু’জনই আরব্য রজনীর পরীদের মত অপূর্ব সুন্দরী। পরনে মখমলের কালো ঘাগরায় সোনালী জরির কাজ, উপরে দুধে-আলতা রঙের হাতাকাটা মিনি ব্লাউজের ওপর পাতলা রেশমী ওড়না। চোখে মুখে স্নিগ্ধ কমনীয়তার কোমল পরশ। কচি লাউ ডগার মত সতেজ আর পেলব ত্বক।
লোকজন জানে এরা ইমাম সাহেবের স্ত্রী। আপাদমস্তক বোরকায় ঢেকে ওদের এখানে আনা হয়েছিল। এখন বোরকা নেই। দেহের বেশীল ভাগ উন্মুক্ত। ওদের সাথে যুবতীদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে আলমারী থেকে মদের বোতল বের করলেন ইমাম সাহেব। গ্লাস ভরলেন। লোক দু’জন ছু’ল না, এমনকি এক নজর দেখেই চোখ ধাঁধাঁনো যুবতীদের দিক থেকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
‘আগে কাজের কথা বলি, তারপর এসব হবে।’ বলল একচোখা লোকটি।
‘আমরা দু’জনকে হত্যা করতে চাই।’ সঙ্গীর কণ্ঠ, ‘সালাহুদ্দীন আয়ুবী এবং আলী বিন সুফিয়ান। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তাদের আমরা কখনও দেখিনি। ওদেরকে চিনিয়ে দেবেন। আপনি কি দেখেছেন কখনও?’
‘এতবেশী, এখন অন্ধকারেও ওদের চিনতে পারব। ওদের চেনাই ছিল আমার এ অভিযানের প্রথম কাজ। আলী ভীষণ ঘাগু। ছদ্মবেশ ধারণে ওস্তাদ। তবে ছদ্মবেশে এলেও আমি তাকে ঠিকই চিনতে পারব।’
‘সালাহুদ্দীনের ব্যাপারে কি অভিমত?’ একচোখা লোকটি বলল।
‘তাকেও চিনতে কষ্ট হবে না।’
একচোখা লোকটি কানের কাছে তুলে আনলেন হাত। এক ঝটকায় খুলে আনলেন কৃত্রিম দাড়ি, গোঁফ। ছুঁড়ে ফেললেন দূরে। টেনে ছিঁড়ে ফেললেন চোখের হলুদ পর্দা। মুর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলেন ইমাম সাহেব। হাঁ হয়ে গেছে মুখ। বিষ্ফারিত চোখ। আতঙ্কিত মেয়ে দু’টো একবার তাকাচ্ছিল ছদ্মবেশী লোকটির দিকে আবার দেখছিল ভয়ে পাংশু হয়ে যাওয়া ইমাম সাহেবের মুখের দিকে। ভয়, আতঙ্ক আর উদ্বেগ মেশানো কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে উঠল ইমাম সাহেব, ‘সালাহুদ্দীন আয়ুবী!’
‘হ্যাঁ বন্ধু! আমি সালাহুদ্দীন আয়ুবী, তোমার খ্যাতি শুনে ওয়াজ শুনতে এসেছিলাম।’
সঙ্গীর দাড়ি মুঠোয় চেপে এক ঝটকায় খুলে ফেললেন সুলতান আয়ুবী।
‘হ্যাঁ চিনি।’ ইমামের কণ্ঠে পরাজয়। ‘আলী বিন সুফিয়ান।’
আকস্মাৎ মেয়ে দু’টো ঘুরে পেছনের আলমিরার ওপর থেকে ছুরি টেনে নিল। সালাহুদ্দীন আয়ুবী ও আলী বিন সুফিয়ান ওদের ক্ষিপ্রতা দেখে মোটেও অবাক হলেন না। ওরা যে সব রকমের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তা ওদের ক্ষিপ্রতা দেখেই বুঝে নিলেন।
ওরা যখন মেয়েদের তৎপরতা দেখছিলেন সেই ফাঁকে ইমাম সাহেব পেছনে হাত চালিয়ে বের করে আনলেন তরবারী। চোখের পলকে আঘাত করলেন সালাহুদ্দীনের মাথায়।
সালাহুদ্দীন আয়ুবী এ আঘাতের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। চকিতে সরে দাঁড়ালেন তিনি।
ততক্ষণে দু’জনই জুব্বার বেতর থেকে তরবারী বের করে নিয়েছেন।
তরবারী চালনায় দক্ষ হলেও আরবের বিখ্যাত দুই বীরের সামনে দাঁড়াতে পারল না ওরা।
আলী মেয়েদের ছুরি ধরা হাতের কনুই বরাবর ছেড়ে লাথি চালালেন। সাঁই করে ছুটে গিয়ে ছুরি দুটো দেয়ালে ঠক করে বাড়ি খেল।
সালাহুদ্দীনের তলোয়ার স্পর্শ করল ইমামের তরবারী। তলোয়ারে তলোয়ার ঠেকিয়ে চাপ বাড়ালেন তিনি। পেছনে সরে যেতে চাইল ইমাম। সালাহুদ্দীন ওর দু’পায়ের ফাঁকে নিজের পা ঢুকিয়ে দিয়ে ওকে আরেকটু ঠেলে দিলেন পিছনে। ফলে তাল সামলাতে না পেরে কাত হয়ে পড়ে গেল ছদ্মবেশী ইমাম। হাত থেকে ছিটকে গেল তলোয়ার।
আলী এগিয়ে এসে অস্ত্রগুলো তুলে নিল এক এক করে। সালাহুদ্দীন আলীকে বললেন, ‘বাইরে তোমার যে বন্ধুরা আছে ডাক তাদের।’
বেরিয়ে গেলেন আলী। ফিরে এলেন অস্ত্রধারী ছ’জন সঙ্গীকে নিয়ে। এতক্ষণ এরা বাইরে পাহারা দিচ্ছিল।
পরদিন মসজিদের সামনে জনতার প্রচণ্ড ভীড় জমে উঠল। ইমাম এবং মেয়ে দু’টোকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল জনতার সামনে। ছদ্মবেশী ইমাম সাহেব কিভাবে জিহাদ আর যৌনতার বিরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছিল তা তুলে ধরা হল জনতার সামনে।
সালাহুদ্দীন আবেগময় ভাষায় বললেন, ‘মুসলিম ভাইয়েরা আমার! আমার কাছে ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর কালাম ও রাসূলের সুন্নাহ। প্রিয় নবী (সা.) যা বলেছেন ও করেছেন ইসলাম বলতে আমি তাকেই বুঝি, এর বেশীও না কমও না। পরহেজগারীর নামে দিনরাত মসজিদ ও খানকায় পড়ে থাকার নাম ইসলাম হতে পারে না। আল্লাহ যেমন জামাতে নামাজ পড়ার কথা বলেছেন তেমনি বলেছেন নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে দুনিয়ার কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে। এটাই ইসলাম।
আপনারা দেখতে পেয়েছেন কিভাবে সুফী ও দরবেশ সেজে আমাদেরকে কর্মবিমুখ করার সুগভীর চক্রান্তে মেতে উঠেছে শয়তানরা। যেখানে প্রিয় নবীর সহধর্মিনীরা প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন, ছুটে গেছেন জেহাদের ময়দানে, পূর্ণ্যময়ী মহিলা সাহাবীগণ শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন, সেখানে পর্দার নামে আমাদের অর্ধেক জনশক্তিকে গৃহবন্দী করার পায়তারা করছে। যেন রাসূলের চাইতে তারা ইসলাম বেশী বুঝে, সাহাবীদের চাইতে তারা বেশী মুত্তাকী ও পরহেজগার। এ ধরণের আলেমদের ব্যাপারে আপনারা সতর্ক থাকবেন, এরা আলেম নয় খ্রিষ্টানদের চর। ইসলাম কোন ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। আমাদের মেয়েরা অবশ্যই পর্দা করবে, তবে ততটুকুই, যতটুকু করার জন্য ইসলাম তাদের নির্দেশ দিয়েছে। আবার আমাদের মেয়েরা সমাজিক ক্রিয়াকর্মেও অংশগ্রহণ করবে, তাবে ততটুকুই, যতটুকু করার অধিকার ইসলাম তাদের দিয়েছে।
ঘরে আগুন লাগলে পর্দার জন্য মেয়েদের ঘরের ভেতর পুড়ে মরতে হবে ইসলাম যেমন এ কথা বলে না, তেমনি খোলামেলা শরীরে রাস্তায় ঘুরে বেহায়াপনা ছড়িয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অবাধ লাইসেন্সও দেয় না ইসলাম। ইসলাম সর্বাবস্থায় মধ্যমপন্থী জাতি। আমরা আমাদের মাতা-ভগ্নীদেরকে বাজারের পণ্য বানাতে পারি না, এ ধরনের যে কোন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে, সেই সাথে শরিয়ত নির্ধারিত পন্থায় ব্যাপকভাবে সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের সকল সুযোগ তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে তাদের মর্যাদা ও অধিকারকেও নিশ্চিত করতে হবে।
বন্ধুরা আমার, ওরা আমাদের ভালবাসার মন্ত্র শোনায়, মানবতার কথা বলে। আমরা ওদের মত ঘৃণার বেলুনের ওপর ভালবাসার রঙিন মোড়ক লাগাই না। আমরা মানুষকে ভালবাসি হৃদয়ের গভীর মমতা দিয়ে। আমাদের আদর্শ সেই মহামানব, প্রতিদিন চলার পথে কাটা বিছিয়ে রাখার পরও নিঃসঙ্গ অসুস্থ বুড়িকে সেবা দিয়ে যিনি আপন করে নিতে পারেন।
ভালবাসা ও সেবার ক্ষেত্রে জাত-পাতের কোন ভেদাভেদ করতে শিখিনি আমরা। আমাদের নবী স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে যে ব্যক্তি পেটপুরে খায় সে আমার উম্মত নয়। এর চে’ অধিক মানব প্রেমের কথা কে কবে বলেছে? যার মাঝে এতটুকু মানব প্রেমের সৃষ্টি না হবে সে মুসলমান হবে কেমন করে। ভেবে দেখুন, যদি আমরা নবীর উম্মতই হতে না পারলাম তবে আমাদের এতসব এবাদত বন্দেগী কোন কাজে লাগবে?
তাই তো আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে মানবতারই জয় ঘোষিত হয়। ইসলাম চায় মানুষ যেন অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। তাই মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা একজন মুজাহিদের পবিত্র দায়িত্ব। মানুষের আহার, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য চেষ্টা করা আমাদের কাছে নিছক দুনিয়াবী কাজ নয়, বরং একজন সত্যিকার মুজাহিদের কাছে এটুকু ইসলামের ন্যুনতম দাবী। এ দাবীকে পাশ কাটিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি না আমরা। আবার আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার চেষ্টা বাদ দিয়ে কেবল দুনিয়াবী সমস্যার সমাধান করাকেও আমরা ইসলাম মনে করতে পারি না।
প্রিয় ভাইয়েরা, আমাদের সংগ্রাম তাই দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর সংগ্রাম। ওরা আমাদের অস্ত্রের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে আমরা রক্তপিপাসু। না, ক্ষমার মহত্তম দৃষ্টান্ত আমরাই দেখাতে পারি। এক ফোটা রক্ত না ঝরিয়েও আমরা মক্কা জয় করতে পারি। তারপরও আমাদের নবীকে অর্ধশতাধিক লড়াই পরিচালনা করতে হয়েছিল কি জন্য? মানবতার অপমান আমরা বরদাস্ত করতে পারি না। মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আমরা আপোষ করতে পারি না। আমরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছি নিপীড়িত মজলুম মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। চোর যদি ধর্মের কাহিনী শুনতো তবে আমাদের অস্ত্র হাতে নেয়ার প্রয়োজন হত না। কিন্তু আমরা জানি, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী।
সর্বাবস্থায় সর্বক্ষেত্রে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য আমাদের এ লড়াই অব্যহত থাকবে। খ্রিষ্টানদের যে কোন হামলা ও ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দেয়ার জন্য সবসময় সজাগ ও প্রস্তুত থাকার জন্য আমি আপনাদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।’
সালাহুদ্দীনের বক্তৃতার পর খ্রিষ্টান গোয়েন্দাদের মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দেয়া হল। অবাক বিস্ময়ে জনতা শুনল ছদ্মবেশী ইমাম এবং মেয়ে দু’টোর স্বীকারোক্তি।
তারপর জনতাকে একজন একজন করে লাইনে দাঁড় করিয়ে ইমাম সাহেবের ঘরে নিয়ে দেখানো হল ক্রুশ, মেরী আর যিশুর মূর্তি। সাধারণ মানুষের সামনে খুলে গেল এক ছদ্মবেশী খ্রিষ্টান গোয়েন্দার অপকর্মের নমুনা।
* * *
সুলতানের নির্দেশে সমগ্র দেশে গুপ্তচরের নিশ্ছিদ্র নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন আলী বিন সুফিয়ান। খ্রিষ্টান গোয়েন্দায় ভরে গিয়েছিল দেশ। ইসলামী সংস্কৃতি বিনষ্ট করার গভীর ষড়যন্ত্র সুলতানকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল।
একজন ইমাম ইসলামী চিন্তাধারা পাল্টে দিচ্ছে সংবাদ পেয়েও তিনি তাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেননি। বলেছিলেন, ‘আলী! ধর্ম আজ বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হতে শুরু করেছে। ইমাম সাহেব হয়ত এমন কোন উপদলের লোক। অথবা তিনি মনগড়া তাফসীর করছেন। ধর্মীয় ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আমি প্রশাসক—আলেম নই, যদি তাকে গুপ্তচর মনে কর ভালভাবে যাঁচাই বাছাই করে নাও। আমার চাইতে একজন ইমামের মর্যাদা অনেক উর্ধে।’
গোয়োন্দা হলে চিনে ফেলতে পারে এ জন্য আলী নিজে মসজিদে যাননি। ক’জন লোক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দশ থেকে বার দিন গিয়েছে ওরা। আলীকে শুনিয়েছে ইমামের বক্তৃতার হুবহু বর্ণনা।
আলী সুলতানকে বললেন, ‘লোকটা গোয়োন্দা না হলেও ভ্রান্ত আকিদার। তাকে ধরা উচিৎ। সে এমনভাবে জিহাদের ব্যাখ্যা করছে যা শুধু একজন শত্রুর পক্ষেই করা সম্ভব।’
সুলতান মনোযোগ দিয়ৈ আলীর কথা শুনে বললেন, ‘ব্যাপারটা মসজিদ এবং ইমাম সম্পর্কে। কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগে আরেকটু যাচাই করা দরকার।’
অবশেষে সুলতান সিদ্ধান্ত নিলেন আলী সহ নিজেই যাবেন ইমামের ওয়াজ শুনতে।
আহমদ কামালের গ্রেফতার করা মেয়েটার কাছ থেকে আলী জেনে নিয়েছিলেন খ্রিষ্টান গোয়েন্দাদের ব্যবহৃত কোড বা সংকেত। মেয়েটা বলেছিল, ‘গোয়েন্দারা কেউ কারো নাম বলে না। ‘আমরা মেঘ নিয়ে আসব’ বলে পরস্পরকে পরিচিত হতে হয়। সুলতান তাই করেছিলেন। ধরা পড়ল ইমাম।
ওদের তিনজনকে কারাগারে পাঠিয়ে তদন্ত শুরু করলেন গোয়েন্দা প্রধান।
তদন্তে জানা গেল, কায়রো উপশহরের এ মসজিদ জামে মসজিদ না হলেও মুসল্লীর অভাব নেই। এলাকাটায় মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত লোকের বাস। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় এখানকার লোকগুলো জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত। ফলে বেশিরভাগ লোকই কুসংস্কারে বিশ্বাসী। ওরা সহজেই মন ভোলানো আবেগময় কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়ে।
ছ’সাত মাস ধরে এলাকার মসজিদের কথা সবার মুখেমুখে। নতুন পেশ ইমাম এশার পর এমন ওয়াজ করেন যা কেবল মর্মস্পর্শীই নয়, অভিনব ও চিত্তাকর্ষকও।
ঘটনার বিবরণে জানা গেল, ‘একদিন দু’জন স্ত্রীসহ একজন লোক এল গাঁয়ে। উঠল এক ব্যাক্তির ঘরে। দেখতে আলেমের মত। মসজিদে আসা যাওয়া করতে লাগলেন তিনি। ধীরে ধীরে ইমাম সাহেবের ভক্ত হয়ে গেলেন নতুন আলেম।
পনর ষোল দিন পর একদিন ইমাম সাহেব মসজিদে এলেন না। খবর নিয়ে জানা গেল তিনি অসুস্থ।
হাকীম সাহেব তার বাসায় গিয়ে দেখলেন ইমাম সাহেবের পেটে ব্যাথা। কোন ওষুধ কাজ হল না। তিন দিন পর মারা গেলেন ইমাম সাহেব। ইমাম সাহেব যেদিন অসুস্থ হন সেদিন আগন্তুক আলেম গ্রামে ছিলেন না, আগে যেখানে থাকতেন সেখান থেকে জিনিসপত্র আনতে গেছেন।
ইমাম সাহেবের মৃত্যুর পর দিন ফিরে এলেন তিনি।
পরনে লাল জুব্বা, ফর্সা চেহারা, ধূসর দাড়ি, মধুর তেলওয়াত। ইমাম সাহেবের আকস্মিক মৃত্যুর খবর শুনে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বললেন, ‘আহা! অমন ভাল লোক আর হয় না। উনি তো চলে গেলেন, এখন আমাদের কি হবে?’
‘কি হবে মানে?’
‘না, বলছিলাম, এখন তো আমাদে একজন ইমাম দরকার।’
‘তা দরকার বৈকি। তবে কিছু মনে না করলে বলব, আপনার যা এলেম-আমল এ দায়িত্বটা যদি আপনি নেন তবে আমাদের আর কোন দুশ্চিন্তা থাকে না।’
তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বরলেন, ‘আপনারা সবাই চাইলে এ দায়িত্ব আমি নিতে পারি। এখানে থাকলে নিরিবিলিতে কিছু এবাদত বন্দেগীর সুযোগ পাবো। যদিও শহরে ইমামতি করেই দিন কাটাতাম কিন্তু হৈ-হাঙ্গামা এ বয়সে আর ভাল্লাগেনা বলেই এখানে চলে এসেছি।’
তার কথায় লোকজন খুবই খুশি হল। ইমাম হিসাবে এমন একজন অভিজ্ঞ আলেম পাওয়া তো ভাগ্যের কথা। এলাকার গণ্যমান্য লোকজন সামান্য পরামর্শের পর তাকেই ইমাম হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিল।
বেতন নিয়ে তিনি কোন দরকষাকষি করলেন না। বললেন, ‘আপনারা যা বিবেচনা করে দেবেন তাতেই আমার হবে। তবে কারো দেওয়া নজরানা, হাদিয়া বা তোহফা আমি গ্রহণ করতে পারবো না। আমার দরকার শুধু খাওয়া-পরা ও স্ত্রীদের নিয়ে পর্দা পুশিদা মত থাকার মত একটা বাড়ি।’
লোকজন মসজিদের পাশেই কায়েক কামরার একটি বাড়ী খালি করে দিল। সবার সামনে তিনি বাড়ীতে এসে উঠলেন। সাথে দুই স্ত্রী। স্ত্রী দু’জনই বোরকা পড়া, হাতে দস্তানা, পায়ে মোজা। লোকজন হুজুরের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র সরবরাহ করল। তার ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত হল সবাই। সকলকে মোহিত করল তার সুরেলা কণ্ঠের যাদু।
মসজিতে আযান দিলেন মৌলভী সাহেব। আযানের শব্দে নিরবতা ছেয়ে গেল সমগ্র এলাকায়। যেন ইথারে ভেসে বেড়াচ্ছে পবিত্র এক সুর। সুরের মূর্চ্ছনায় মসজিদে ছুটে এল মানুষ। যারা বাড়ীতে নামাজ পড়তেন ছুটে এলেন তারাও। এশার পর সমবেত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে ওয়াজ করলেন তিনি। বললেন, প্রতিরাতে এভাবে ওয়াজ করবেন।
সুরেলা কণ্ঠের প্রতিদিন রাতে এশার নামাজের পর নিয়মিত ওয়াজ করে যাচ্ছেন ইমাম সাহেব। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর খ্যাতি। ছ’সাত মাসের মধ্যে তিনি পুরো এলাকায় সর্বজনমান্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন। তার ভক্তের সংখ্যা বেড়ে চলল প্রতিদিন। অনেকে মুরিদও হল। এ মসজিদে আগে জুম্মা পড়া হত না, তিনি প্রথম জুম্মা চালু করলেন।
চারদিকে ইমাম সাহেবের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে ওয়াজ শুনতে ছুটে আসতে লাগল দূর-দূরান্তের লোকেরা। তার আলোচনায় স্থান পেত ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো। ইবাদাত এবং ভালবাসা ছিল প্রধান বিষয়। মানুষকে বুঝাতেন, মানুষ নিজে তার ভাগ্য গড়তে পারে না। মানুষ এক দুর্বল কিটাণুকীট। খোদার হাতেই মানুষের ভাগ্য। ওয়াজের সময় পবিত্র কোরান থাকত তার হাতে। মন্ত্রমুগ্ধের মত শ্রোতারা তার কথা শুনত। তিনি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রশংসা করে বলতেন, ‘মিসরের সৌভাগ্য যে, তার মত এমন এক ব্যক্তিত্বকে পেয়েছে শাসক হিসাবে।’
তিনি জিহাদের নুতন ব্যাখ্যা দিলেন। মানুষ নির্দ্বিধায় তা মেনে নিল।
সুলতান আইউবী খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে জেহাদে শরীক হওয়ার আহ্বান জানালে দু’টো কারণে এ এলাকার লোকারা ব্যাপকভাবে তাতে সাড়া দিয়েছিল। প্রথম কারণটি ছিল অর্থনৈতিক। সুলতান সৈন্যদের যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা দিতেন।
দ্বিতীয় কারণ, সালাহুদ্দীন আইউবীর দেয়া জ্বালাময়ী ভাষণ। তিনি যখন বললেন, ‘খ্রিষ্টানরা পৃথিবীর বুক থেকে ইসলামের চিহ্ন মুছে দেয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য হল জিহাদের ময়দানে ঝাড়িয়ে পড়া’ তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের ঈমানের শিখা জ্বলে উঠল। জিহাদ যে প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ সুলতান ওদেরকে তা ভালভাবেই বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে ইসলামের জন্য জীবন দেওয়ার উদগ্র বাসনা নিয়েই ওরা সুলতানের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিল। এদের বিশ্বাসে চিড় ধরাবার জন্যই ইমামরূপী গোয়োন্দা এখানে আশ্রয় গেড়েছিল।