সুলতানের যুদ্ধপলিসির কাছে খ্রিষ্টানরা হেরে গেছে। বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে মুসলমানদের কমাণ্ডো হামলা ওদের অতিষ্ঠ করে তুলছিল। বিপদে পড়ে পেছনে সরে যাচ্ছিল ওরা।
সুলতান আশঙ্কা করছিলেন ক্রাক দুর্গ থেকে খ্রিষ্টান সেনাবাহিনী ওদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে। ওদের বাধা দেওয়ার জন্য সুলতানের কাছে পর্যাপ্ত সৈন্য ছিল না। ও মুহূর্তে মিসর থেকেও সৈন্য আনা সম্ভব নয়। ফাতেমী খেলাফতের পতনের পর মিসর হয়ে পড়েছিল ষড়যন্ত্রের লীলাভূমি। গাদ্দাররা যে কোন সময় প্রশাসনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
এ পর্যন্ত গাদ্দারী আর ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তিনি যাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই মুসলমান এ জন্য সুলতানের হৃদয় ছিল বেদনা ভারে জর্জরিত।
সুবাক কেল্লার পশ্চিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুলতান সালাহুদ্দীন, সাথে সামরিক বেসামরিক উপদেষ্টাবৃন্দ।
শহরের মুসলিম অধিবাসীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছিল। অন্যদিকে ছিল শহীদদের বহনকারী উটের সারি। সুলতান গভীর চিন্তায় ডুবেছিলেন।
আনন্দ মিছিল থেকে ভেসে আসছিল শানাইয়ের সুর ঝঙ্কার। উল্লসিত জনতা পাঁচিলের পাশে এসে থামল। সেদিকে তাকিয়ে রইলেন সালাহুদ্দীন।
তার নির্বাক ঠোঁটে কোন হাসি নেই। তিনি দেখছিলেন মুসলমানদের উচ্ছসিত আনন্দ। ওরা নাচছে পাগলের মত। মিছিল থেকে কেউ কেউ চিৎকার দিয়ে বলছে, ‘নাজমুদ্দীনের ছেলে সালাহুদ্দীন আইউবী সুবাকে তোমাকে স্বাগতম। তুমি এক মুক্তিদূত। তুমি সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান।’
মিছিল থেকে শ্লোগান উঠল, ‘কুর্দির কৃতি সন্তান সালাহুদ্দীন আমরা তোমায় সিজদা করি।’
জেগে উঠল সালাহুদ্দীনের ঈমানী চেতনা। দরাজ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আমায় গুনাহগার করো না বন্ধুরা। আমি আল্লাহর এক নগন্য গোলাম মাত্র। আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সিজদা করা বৈধ নয়।’
কিন্তু তার কথায় কেউ কান দিল বলে মনে হল না। তারা আগের মতই লাফাচ্ছে, শ্লোগান দিচ্ছে।
একজন সেনা অফিসারকে ডেকে তিনি বললেন, ‘ওদের এসব বলতে নিষেধ কর। বলবে, এসব শ্লোগানে সুলতান রাগ করেন।’
সেনা অফিসার হাঁটা দিতেই আবার তাকে ডেকে বললেন, ‘শোন, ওদের ধমকের সুরে নয়, শান্তভাবে বলবে। ওরা যেন মনে ব্যথা না পায়। ওদের নাচতে দাও, গাইতে দাও। ওরা জুলুমের জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়েছে সে জন্য আমিও খুশি। আমার জীবন এই মজলুম মানুষগুলোর জন্যই। কিন্তু আমার নামে শ্লোগান দেওয়ার দরকার নেই। বিশেষ করে আমাকে সিজদা করার মত নাজায়েয কথা যেন কেউ না বলে।’
তিনি আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল তার কণ্ঠ। তিনি আর কিছুই বলতে পারলেন না। আবেগে চোখে এসে জমা হল অশ্রুরাশি। উদগত অশ্রু আড়াল করার জন্য তিনি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
একটু পর সবার দিকে নজর বুলিয়ে বললেন, ‘আমরা এখন ফিলিস্তিনের আঙ্গিনায় পা রেখেছি। মঞ্জিল এখনও অনেক দূরে। এ মরুভূমি রোম উপসাগর ঘুরে সেখান থেকে পশ্চিমে মোড় নিয়েছে, আমাদের যেতে হবে সেখান পর্যন্ত। শত্রুদের ক্রুশ ডুবিয়ে দিতে হবে রোম উপসাগরের অথৈ জলে।’
সুলতান শহর-প্রধানকে বললেন, ‘প্রতিটি অলিগলিতে ঘোষণা করে দাও, ‘কোন অমুসলমানের প্রাণ-ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার দরকার হবে না। কেউ তাদের উত্যক্ত করবে না। যদি কোন নাগরিক কাউকে বিরক্ত করে সরাসরি দূর্গের ফটকে এসে অভিযোগ করবে। প্রশাসন প্রতিটি নাগরিকের সমস্যা দূর করার চেষ্টা করবে।
আমি আবারও বলছি, আমরা কাউকে কষ্ট দিতে আসিনি। আসিনি কারও বিপদের কারণ হতে। আমরা এসেছি স্নেহ ও ভালবাসার বারতা নিয়ে। ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে কোন তৎপরতার বিচার ইসলামী আইনেই করা হবে। এ আইন মসুলিম অমুসলিম সকলের জন্য সমান।
শহরে যদি খ্রিষ্টানদের কোন গুপ্তচর লুকিয়ে থেকে থাকে আশ্রয়দাতা সহ তাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার জন্য আমি জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
উপদেষ্টাদের নিয়ে পাঁচিল থেকে নেমে এলেন সুলতান। প্রথমেই গোয়েন্দাদের সদর দপ্তরে তল্লাশী নেওয়া হল। কোন কাগজপত্র পাওয়া গেল না। খ্রিষ্টানদের গোয়েন্দা প্রধান হরমুন এবং তার সঙ্গীরা পালিয়ে গেছে।
আটজন তরুণী গোয়েন্দা পালাতে পারেনি। তাদেরকে আলী বিন সুফিয়ানের হাতে তুলে দেওয়া হল। জবানবন্দীতে ওরা বলল, ‘মেয়েদের সবাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে পালিয়েছে। কোন পুরুষ ওদের সহযোগিতা করেনি।’ ওরা আরও জানাল, ‘লুজিনা (এটা সিনথিয়া হবার কথা? লুজিনা লিখা কেন?) নামে আমাদের এক সঙ্গিনী ছিল। একজন মুসলমান সৈন্যকে পালাতে সাহায্য করে সে নিজে আত্মহত্যা করেছে।
আলী ওদের নিরাপদ স্থানে আটকে রাখলেন।
নিরাপত্তা এবং শান্তি সৃষ্টির জন্য সুলতানের নির্দেশে তৎপর ছিল সুবাকের প্রশাসন।
ক্রাকের খ্রিষ্টান শিবিরে চলছিল সুবাক আক্রমণের পরিকল্পনা। কিন্তু সালাহুদ্দীনের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে তা নিশ্চিত না হয়ে চটজলদি কিছু করে বসার বোকামী করতে আর রাজী নয়, তাই ওদের তৈরী হতে দেরী হচ্ছিল।
বিশেষ করে সুবাকের বিপর্যয় তাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। যেখানে গোয়েন্দাদের কাছ থেকে তারা নিশ্চিত রিপোর্ঠ পেয়েছিল সুলতান সালাহুদ্দীন ক্রাক আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কায়রোসহ অন্যান্য এলাকার গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকেও একই রকম তথ্যাই পাওয়া যাচ্ছিল, তারা এ খবরও পেয়েছিল যে সালাহুদ্দীনের নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী ক্রাকের দিকে যাত্রা করেছে এবং তারা দ্রুত এগিয়ে আসছে। ফলে সালাহুদ্দীনের উদ্দেশ্য ছিল তাদের কাছে স্পষ্ট। এজন্য পথেই মুসলিম বাহিনীকে বাধা দেয়ার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু এসবই যে ছিল সুলতানের সাজানো খেলা, বিস্ময়কর যুদ্ধ চাল তা কে জানত।
শেষ মুহূর্তে দেখা গেল সুলতান ক্রাকে আক্রমণ না করে সুবাকে হামলা করলেন। মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযান রোধ করার জন্য যাদের পাঠানো হয়েছিল পথে ওঁৎ পেতে থাকা সেই সব খ্রিষ্টান সৈন্যরা অযাচিত কমাণ্ডো হামলার শিকার হল। অথচ যুদ্ধের সমুদয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল গোয়েন্দাদের নিশ্চিত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই।
ক্রাকের খ্রিষ্টান শিবিরে কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছে। কয়েকজন সম্রাট এবং সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এতে শরীক হয়েছেন। অপরাধীর বেশে এসেছেন গোয়েন্দা প্রধান হরমুন। আলেমরূপী গোয়েন্দা ডিউককে আনা হয়েছে হাতে হাতকড়া পরিয়ে। তার ভুল তথ্যের কারণে খ্রিষ্ঠান সৈন্যরা পরাজিত হয়েছে, হাতছাড়া হয়েছে সুবাকের মত গুরুত্বপূর্ণ দূর্গ।
এ তথ্য কিভাবে পেয়েছে ডিউক আবার কনফারেন্সে তা শুনালো। সবশেষে বলল, ‘আমার দেওয়া তথ্যে সন্দেহ হলে আপনারা সে অনুযায়ী কাজ করলেন কেন? গোয়েন্দা সংস্থা এ নিয়ে কেন যাচাই বাছাই করেনি?’
হরমুনকে প্রশ্ন করা হল, ‘গোয়েন্দা বৃত্তিতে অভিজ্ঞ হওয়ার পরও কিভাবে আপনি এ ভুল করলেন?’
হরমুন বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমার অনেক কিছু বলার আছে। অবশ্যই আমি গুপ্তচর বৃত্তি এবং গোয়েন্দা কাজে অভিজ্ঞ। এরপরও কোন কোন ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা এবং পরিশ্রমকে ওভারলুক করা হয়েছে।
আমাদের পরাজয় আমার একার ভুলে হয়েছে এ কথা বলার কোন অবকাশ নেই। সত্য প্রকাশের খাতিরে আমাকে কিছু তিক্ত কথা বলতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত।
আমি সেই সব সেনাপতি ও শাসকদের হুকুমের সামনে অসহায় ছিলাম যারা আমার পরামর্শের তোয়াক্কা না করে আমার যোগ্যতাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। এখানে তিনজন সম্রাট এবং সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ রয়েছেন। কেন আমরা পরাজিত, সুবাক হাত ছাড়া হল কেন, এক বিশাল এলাকা কেন আমাদেরকে হারাতে হল, এক্ষেত্রে আমাদের ভুলগুলি কি ছিল তা কনফারেন্সে তুলে ধরা আমার কর্তব্য বলে মনে করছি।
যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে বিনয়ের সাথে বলতে চাই আমরা সবাই ক্রশ হাতে নিয়ে শপথ করেছিলাম। শপথ করেছিলাম ক্রুশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেব। ব্যক্তিগত মর্যাদা নয় ক্রুশের মর্যাদা বৃদ্ধিই আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু আমরা অনেকেই আমাদের শপথের মর্যাদা রক্ষা করতে পারিনি।’
কোনার্ড, গে অব লুজিনাম এবং শাহ অগাষ্টাসের মত আত্মম্ভর সম্রাটগণও হরমুনের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বলার সাহস পেতেন না। গোয়েন্দা জগতে তার ছিল একচ্ছত্র ক্ষমতা। যে কোন শাসককেই তিনি গুপ্তভাবে হত্যা করতে পারতেন।
কনফারেন্সের পিনপতন নীরবতার মাঝে হরমুন প্রশ্ন করলেন, ‘বুঝতে পারছি না শত্রুর গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য মেয়েদের ব্যবহার করা হচ্ছে কেন?’
‘কারণ নারী হচ্ছে মানুষের সবচে বড় দুর্বলতা।’ কোনার্ড বললেন। ‘মানুষের চরিত্র নষ্ট করার জন্য নারীর বিকল্প নেই। হোক সে রক্ত মাংসের মানুষ বা সাহিত্যের মোড়কে নারীর শারীরিক বর্ণনা। তুমি কি অস্বীকার করতে পার হরমুন, নারীদের দিয়েই আমরা আরবের অনেক আমীর ওমরাকে আমাদের গোলামে পরিণত করেছি?’
‘না অস্বীকার করি না। কিন্তু এখন মুসলিম শাসন আমীর ওমরাতের হাতে নয়, সেনাবাহিনীর হাতে। মিসরের শাসক একজন গভর্ণর হয়েও খলীফাকে বরখাস্ত করেছেন। নুরুদ্দীন জঙ্গী একজন সেনাপতি এবং মন্ত্রী। তিনিও কেন্দ্রীয় নির্দেশের তোয়াক্কা করেন না।
এ জন্য ক‘জন আমীর ওমরাকে হাত করলে বড়জোর ক’জন গাদ্দার বৃদ্ধি পাবে। ওরা দেশের এক ইঞ্চি মাটিও আপনাদের দিতে পারবে না।
এখন সেনাবাহিনীর হাতেই সর্বময় ক্ষমতা। সালাহুদ্দীন এবং জঙ্গী সৈন্যদেরকে এমন ট্রেনিং দিচ্ছে নারীদের দিয়ে আপনারা ওদের নৈতিক স্খলন ঘটাতে পারছেন না এবং পারেননি। ইসলাম মদ হারাম করেছে। ফলে সৈন্যদের জন্য মদ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। তাই কেউ বিবেকশূন্য হয় না। সালাহুদ্দীন মদে অভ্যস্ত হলে বিজয়ী হয়ে নয় সুবাক আসত বন্দী হয়ে।’
‘হরমুন,’ বিরক্তি প্রকাশ করল এক সেনাপতি, ‘তোমার কথা মেয়েদের মধ্যেই সীমাবন্ধ রাখ। মুসলমানের প্রশংসা শোনার জন্য আমরা এখানে আসিনি।’
‘আমি বলতে চাই, গুপ্তচর বৃত্তিতে মেয়েদের ব্যবহার করে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। গত দু’বছরে মিসর পাঠিয়ে আমরা অনেক মূল্যবান মেয়ে হারিয়েছি। মনে রাখতে হবে মেয়েরা সাধারণভাবেই আবেগ্রবণ। যত ট্রেনিং-ই দেওয়া হোক ওরা পুরুষের মত কঠিন হতে পারে না।
আমরা ওদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করি। কখনও অবস্থা পাল্টে যায়। যুবতীদেরকে ভোগ না করে বরং নিরাপদ আশ্রয় দান করে মুসলমানরা। এর ফলে মেয়েদের ভেতর প্রচণ্ড আবেগ জন্ম নেয়। ওদের চারিত্রিক দৃঢ়তায় অভিভূত হয়ে অনেকেই তাদের ভক্ত হয়ে যায়।
কিছুদিন পূর্বে সালাহুদ্দীনের এক কমাণ্ডার আমাদের একটা মেয়েকে দস্যুর কবল থেকে মুক্ত করে নিজে আহত হয়ে পড়ে। মেয়েটা কমাণ্ডারকে সুবাক নিয়ে এসেছিল। আমরা তাকে মুসলমানদের ক্যাম্পে স্থানান্তর করেছিলাম। মেয়েটা আমাদের এক অফিসারের উর্দি পরিয়ে তাকে দুর্গ থেকে পালাতে সাহায্য করেছে। হোষ্টেলে ফিরে নিজে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে। মৃত্যুর সময় আমি ওর পাশে ছিলাম। আমাদের শাস্তির ভয়ে ও আত্মহত্যা করেনি। প্রতারণার জালে আটকে গিয়ে নিজের দেহ ব্যবহার করেছে, এ অনুভূতি ওকে বিষপানে বাধ্য করেছে।
এ প্রসঙ্গে আমি আরও দু’একটা উপমা দিচ্ছি। আমাদের বেশীর ভাগ গোয়েন্দা মেয়েকে শৈশবে কোন মুসলিম কাফেলা বা মুসলমানদের বাড়ি থেকে অপহরণ করে এসেছি। পরে ওদেরকে আমাদের ধর্মের রঙে রাঙিয়ে ট্রেনিং দিয়েছি। যৌবনে এসে মেয়েরা ভুলে গেছে তাদের অতীত, তাদের মৌলিক অস্তিত্ব। ওরা জানে না ওরা মুসলিম ঘরের সন্তান। আমরা ওদের নাম, ধর্ম এবং কর্ম বদলে দিয়েছি, কিন্তু ওদের রক্ত পরিবর্তন করতে পারিনি।
আমি মানুষের সাইকোলজি বুঝি। মুসলমানের মানসিকতা অন্য সব ধর্মের অনুসারীদের মানসিকতার চেয়ে ভিন্ন। এসব মেয়েরা কোন মুসলমানের হাতে পড়লে অস্তিত্বে নতুন অনুভূতি জন্ম নেয়। সে তখন ভাবে আমার দেহেও বইছে মুসলিম পিতার রক্ত। মুসলিম রক্ত থেকে ইসলামকে কোন ভাবেই আলাদা করা যায় না।’
‘তুমি কোন মেয়েকে গেয়েন্দা কাজে পাঠাতে চাইছ না’ এক সেনাপতি প্রশ্ন করল।
‘না, কারণ সে সব মেয়ের দেহে মুসলিম রক্ত বইছে। আমার সংস্থা থেকে মেয়েদের বাদ দিলেই বরং ক্রুশের জন্য ভাল হবে। আপনারা মুসলমান আমীর ওমরাদের হারেমে মেয়েদের পাঠিয়ে সহজেই ওদের শিকার করতে পারছেন। কারণ ওরা যুদ্ধের ময়দান দেখেনি। আমাদের তরবারীর সাথে ওদের তরবারী সংঘর্ষ হয়নি। শুধু সৈন্যরাই আমাদের চেনে। সেনাবাহিনীই কেবল দুশমন এবং বন্ধুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। এজন্য ওরা আমাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দেয় না।’
সম্রাট অগাষ্টাস ছিলেন জটিল ও কুটিল মনের অধিকারী। মুসলমানদের বিরোধিতায় অন্যদের তুলনায় একধাপ এগিয়ে ছিলেন তিনি। বললেন, ‘তোমার দৃষ্টি সীমাবদ্ধ হরমুন। তুমি দেখছ নুরুদ্দীন জঙ্গী এবং সালাহুদ্দীন আইউবীকে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ইসলাম। আমরা এ ধর্মটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাই। এ জন্য প্রয়োজন ওদের নৈতিকস্খলন।
ওদের চিন্তা চেতনায় সন্দেহ সৃষ্টি করতে হবে। মুসলমানদেরকে এক আকর্ষণীয় সংস্কৃতির জালে আটকে ফেল। আমরা বেঁচে থাকতেই এ উদ্দেশ্য পুরণ হতে হবে এমন কোন কথা নেই। পরবর্তী প্রজন্মের হাতে দিয়ে যাব আমাদের দায়িত্ব। এরপর এমন একক সময় আসবে যখন ইসলামের নাম নিশানাও থাকবে না। থাকলেও সে ধর্ম থেকে জন্ম নেবে না কোন নুরুদ্দীন বা সালাহুদ্দীন।
আমি দৃঢ়তার সথে বলছি, ধর্ম হবে মুসলমানদের নিজস্ব, কিন্তু তার দেহে থাকবে আমাদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির পোশাক। আমাদের চিন্তা চেতনায় রঙ্গীন হবে ওই ধর্ম।
হুরমুন, আজ থেকে শত বর্ষ পরে দেখ। জয় পরাজয় ক্ষণস্থায়ী। আবার আমরা সুবাক জয় করব। মিসরে ষড়্যন্ত্রের জাল বিছিয়ে দাও। ফাতেমী, সুদানী এবং কাফ্রিদের সাহায্য কর। ব্যবহার কর গুপ্তঘাতকদের। বিজয়ী আমরাই হবই। ওদের সভ্যতা সংস্কৃতি, ওদের চিন্তা চেতনা এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্ব হবে আমাদের।
কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করল একজন খ্রিষ্টান অফিসার। ধুলোমলিন চেহারা। সালাহুদ্দীনকে পথে বাধা দেয়ার জন্য পাঠানো একটা দলের কমাণ্ডার। এরা মুসলিম কমাণ্ডো বাহিনীর চাপে ক্রাকের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছিল।
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কমাণ্ডার বলল, ‘আমাদের সৈন্যদের অবস্তা ভাল নয়। এ পরিস্থিতিতে আমি একটা প্রস্তাব পেশ করতে চাই।’
‘কি তোমার প্রস্তাব?’ কোনার্ড বললেন।
‘ক্রাকে অবস্থানকারী সৈন্যদের সাথে আরও কিছু যোগ করে এ মুহূর্তে সুবাক আক্রমণ করা উচিৎ। এতে মুসলমানরা সামনাসামনি যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে। কেন্দ্রের নির্দেশে আমাদের ফৌজ ক্রাকের দিকে পিছিয়ে আসছে। মুসলমানদের কমাণ্ডো বাহিনী রাতে আচম্বিত আক্রমণ করে পালিয়ে যায়। তীরন্দাজ গ্রুপ হঠাৎ করেই তীর বর্ষণ শুরু করে। ওদের টার্গেট আমাদের ঘোড়া এবং উট। আহত পশুগুলো বেসামাল হয়ে দিকবিদিক ছুটতে থাকে। আমরা জওয়াবী হামলা করতে যাব ততক্ষণে ওরা হাওয়া হয়ে গেছে। ওরা সামনা সামনি যুদ্ধ করছে না। ওদের মনমত স্থানে এনে ওরা আমাদের অনেক সৈন্য হত্যা করেছে। সাহস হারিয়ে ফেলছে আমাদের সৈন্যরা। এভাবে আর কদিন চলবে? এজন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে আমরা ওদেরকে মুখোমুখী যুদ্ধ করতে বাধ্য করব।’
এ বিষয়ের ওপর আলোচনা শুরু হল।
এ মুহূর্তে আক্রমণ করার জন্য ওদের সামনে বড় সমস্যা হল লড়াকু সৈনিকদের বেশীল ভাগই বিস্তৃত মরুতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভীষণ বিপদে আছে ওরা। মুসলিম ফৌজ দিনে লুকিয়ে থেকে রাতে গেরিলা আক্রমণ করছিল। সুবাকের উত্তরপূর্ব সীমান্তে পাঠানো খ্রিষ্টান ফৌজের কোন কাজ ছিল না। নুরুদ্দীন জঙ্গীর আক্রমণের ভয়ে ওদের আনাও যাচ্ছিল না।
অন্যদিকে নগন্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সুবাকে অবস্থান করছিলেন সুলতান সালাহুদ্দীন। তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। খ্রিষ্টানদের পাল্টা আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তার ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে তিনি খ্রিষ্টানদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন। যার ফলে খ্রিষ্টান বাহিনী প্রতি-আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। খ্রিষ্টানদের পরিকল্পনা জানার জন্য ক্রাকে অনেক গুপ্তচর পাঠিয়েছিলেন সুলতান সালাহুদ্দীন। খ্রিষ্টানদের ছদ্মবেশে ওরা ক্রাকে প্রবেশ করেছিল। গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সমগ্র মরুভূমিতে। ওরা সুলতানকে নিয়মিত যুদ্ধের সংবাদ সরবরাহ করছির। সুবাকের আশপাশের এলাকা থেকে নতুন সৈন্য ভর্তি শুরু করে দুর্গেই ওদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হল। ওদের দেওয়া হল খ্রিষ্টান বাহিনীর ফেলে যাওয়া উট, ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র।
মরুভূমিতে যুদ্ধরত সৈন্যদের তিনি নির্দেশ পাঠালেন, পশুগুলো না মেরে যেন দুর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
‘ক্রাকের কনফারেন্সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মেয়েদের ব্যবহার না করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হল। ছেড়ে দেওয়া হল আলেম গোয়েন্দাকে। তাকে বলা হল, মুসলমানদের সংস্কৃতি এবং চিন্তা-চেতনা পরিবর্তন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে।
হরমুনকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘সুবাকে এখন কতজন গোয়েন্দা রয়েছে?’
জবাবে হরমুন বলল, ‘কয়েকজন মেয়ে এবং পুরুষ মুসলমানদের হাতে ধরা পড়েছে। পুরুষদের বেশীর ভাগই সুবাক রয়ে গেছে। কয়েকজন গেয়োন্দা পালিয়ে এসেছে। গুটি কতক মেয়ের সন্ধান পাওয়া যায়নি। মুসলমানদের ছদ্মবেশে কাজ করার জন্য আমি পুরুষ গোয়েন্দাদের খবর পাঠিয়েছি।’
কোনার্ড বললেন, ‘বন্দী মেয়েদের হয়ত মুক্ত করা যাবে না। খ্রিষ্টানদের ঘরে যে সব মেয়ে আত্মগোপন করে আছে তাদেরকে বের করে আনা উচিৎ।’
সিদ্ধান্ত হল সুলতান সালাহুদ্দীনের কমাণ্ডো বাহিনীর মত বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী আত্মত্যাগী একটা গ্রুপ তৈরী করে সুবাক পাঠাতে হবে। ওরা বলবে ক্রাকের খ্রিষ্টান নির্যাতনের কারণে ওরা পালিয়ে এসেছে। ওদের কাজ হবে গোয়েন্দা মেয়েদের খুঁজে আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সাজাপ্রাপ্ত সে সব বন্দীদেরকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছিল ওদেরকে ও গ্রুপের সদস্য করবে। যারা সুবাকে ছিল প্রাধান্য দেবে তাদের।
সুলতান সালাহুদ্দীনের ফৌজ বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে মরুভূমি ছড়িয়ে গিয়েছিল। কেউবা পথ ভুলে পাহাড়ের ফাঁকে ক্ষুৎপিপাসায় মৃত্যুবরণ করছিল। খ্রিষ্টান বাহিনী ইচ্ছে করলেই প্রত্যাক্রমণ করে সুবাক ফিরিয়ে নিতে পারত। কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যাপারে মনযোগ দিতে গিয়ে এ দিকে তারা দৃষ্টি দিতে পারেনি।
সালাহুদ্দীনকে দুর্বল করার জন্য নুরুদ্দীন জঙ্গীর সাথে সালাহুদ্দীনের সম্পর্ক নষ্ট করার প্রয়োজন ছিল। এ জন্য গোয়েন্দারা ছিল তৎপর। নুরুদ্দীন জঙ্গীকে বুঝানো হল সালাহুদ্দীন কোন খেলাফতের তোয়াক্কা করে না। নিজেই স্বাধীন সুলতান হওয়ার জন্য রাজ্য বিস্তারে মন দিয়েছে।
এ সংবাদ সালাহুদ্দীনের পিতা নজমুদ্দীনের কানে গেল। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তিনি সুবাক পৌঁছলেন এর সত্যতা যাচাই করার জন্য। পিতাকে সুবাকে দেখে আশ্চর্য হলেন সুলতান। ভাবলেন সুবাক বিজয় করায় তিনি ধন্যবাদ দিতে এসেছেন। মোসাফেহা করে তার হাতে চুমো খেলেন।
মুখ খুললেন নজমুদ্দীন আয়ুব। ‘আমার মত এক অখ্যাত ব্যক্তির সন্তানকে মিসরের গভর্নর করে জঙ্গী কি ভুল করেছেন? নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আমার ছেলে জঙ্গীর শত্রু হয়ে গেছে, এ কথাও আমায় শুনতে হল। যাও, গিয়ে নুরুদ্দীন জঙ্গীর কাছে ক্ষমা চাও।’
সুলতান পিতাকে বুঝালেন। বললেন, ‘আমি মাননীয় জঙ্গীর কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করতে চেয়েছি।’
তিনি নুরুদ্দীন জঙ্গীর কাছে চিঠি লিখে ঈসা আল হুকারীর হাতে দিয়ে পিতার সাথে রওয়ানা করিয়ে দিলেন। সাথে সুবাকের কিছু উপহার সামগ্রী। তিনি লিখলেন, ‘সবচে মূল্যবান সুবাক দূর্গ আপনার পদতলে নিবেদন করছি। ইনশাল্লাহ ক’দিন পর ক্রাকের দুর্গও আপনার খেদমতে পেশ করব। খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্রের সাথে কিছু মুসলিম আমীর ওমরাও জড়িত। বিধর্মীদের চাইতে ওরাই ইসলামের বড় ক্ষতি করছে।
ইসলামের জন্য লড়াই করছে সেনাবাহিনী। মরুর বালুকারাশি শুষে নিচ্ছে ওদের তাজা রক্ত। মরুর নেকড়ে আর শকুনের আহার হচ্ছে ওদের লাশ। আপনার আত্মীয় স্বজন ছেড়ে মরুর বিশাল বিস্তারে শত্রুর পেছনে ঘুরে মরছে ওরা। ওরা ইসলামের মর্যাদা যদ্দুর বুঝতে পারে অন্য কেউ তা পারে না।
অসামরিক আমীর ওমরারা যুদ্ধের ময়দান থেকে অনেক দূরে নিরাপদে অবস্থান করে। ইসলামের জন্য, দেশের জন্য ওদের রক্ত ঝরে না। ওরা হারেমের আনন্দে ডুবে থাকে সর্বক্ষণ। ইসলামের দুশমনের সাথে হাত মিলিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে।
আমি যখন ফিলিস্তিনের আঙ্গিনায় পা রেখেছি ফিলিস্তিন শত্রু মুক্ত না করে ফিরব না ইনশাল্লাহ। এসময় বেসামরিক প্রশাসনের দিকে কঠোর দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।
প্রতিটি মসজিদে ঘোষণা করে দিতে হবে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বাগদাদ খেলাফতের অধীন। খেলাফতের আনুগত্য প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ। কিন্তু জুম্মার খোৎবায় খলিফার নাম নেওয়া যাবে না। শিয়া সুন্নীর বিভেদ উস্কে দেওয়া হচ্ছে। এ দিক সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।’
নুরুদ্দীন জঙ্গী সুলতান সালাহুদ্দীনের চিঠি পেয়ে অত্যন্ত প্রীত হলেন।
খ্রিষ্টানদের কেন্দ্রীয় সামরিক কমাণ্ড মরুভূমিতে ছড়িয়ে থাকা সৈন্যদের কাছে সংবাদ পাঠাল মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ না করে ধীরে ধীরে ক্রাকে ফিরে আসতে। এরপর চল্লিশ সদস্যের কমাণ্ডো বাহিনী তৈরী করা হল। ওরা মুসলমানদের ছদ্মবেশে সুবাক প্রবেশ করবে এবং মেয়েদের মুক্ত করার চেষ্টা করবে।
সালাহুদ্দীন মিসরে নেই। তার অনুপস্থিতিতে মিশরে গোয়েন্দা তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করার জন্য হরমুনকে নির্দেশ দেওয়া হল। গোয়েন্দারা সুদানী এবং ফাতেমীদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে মিসরে আক্রমণ করার জন্য সবরকম সাহায্য করবে।
সুবাক এবং ক্রাকের মধ্যবর্তী অঞ্চলের সবটাই মরুভূমি ছিল না। কোথাও বালিয়াড়ি, কোথাও পাথুরে পর্বত আবার কোথাও পাহাড় শ্রেণী।
পথ ভুলে কেউ পাহাড়ের ফাঁকে ঢুকে পড়লে আর বেরোবার রাস্তা খুঁজে পেত না। মরতে হত ওখানেই। এভাবে দু’ বাহিনীর সৈন্যরাই মারা যাচ্ছিল। সুবাক থেকে পালিয়ে আসা লোকজনও মরছিল এসব পাহাড়ে।
আকাশে উড়ছিল শকুনের ঝাঁক। পার্বত্য শৃগাল আর নেকড়েরা ছিঁড়ে খাচ্ছিল নিহতদের লাশ। মরুভূমির কোথাও ছিল খর্জুর বীথি এবং পানির ঝর্ণা। ক্লান্ত শ্রান্ত সৈনিক গভীর তৃষ্ণায় ছুটে আসত সেসব পানির উৎসের কাছে।
আরমান হাশেমী মুসলিম বাহিনীর একজন প্লাটুন কমাণ্ডার। নিজকে পরিচয় দিত সিরীয় হিসেবে। তার হৃদয়ে ছিল খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা। এ ঘৃণার সাথে ছিল প্রচণ্ড প্রতিশোধ স্পৃহা।
সবাই জানত আরমান এতিম। তার আপন বলতে কেউ নেই। কিন্তু আরমানের ধারণা, সে পিতৃহীন নয়। পিতা তার সামনে মরেননি।
ও বাড়ি ছেড়েছে চৌদ্দ বছর বয়সে। থাকত সুবাক।
তার স্পষ্ট মনে আছে তখন খ্রিষ্টান সৈন্যরা সুবাক দখল করে মুসলিম নিধনে মেতে উঠেছে। খ্রিষ্টানদের নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেই বড় হয়েছে সে। দেখেছে নিরপরাধ মুসলিম বন্দীদের। নিহত হতে দেখেছে অসহায় মানুষ।
দেখেছে মুসলমানদের সুন্দরী মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। যুবকদের পাঠাচ্ছে বেগার ক্যাম্পে।
সুবাকের মুসলমানদের বলত, ‘খ্রিষ্টান সৈন্যরা কোথাও পরাজিত হলে আমাদের ওপর তার প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে।’
আরমানের পরিবারও নিরাপদ ছিল না। সাত আট বছর বয়সী এক বোনের কথা ওর মনে আছে। ভীষণ সুন্দরী ছিল। মনে হত পুতুল। পিতা এবং বড় একজন ভাই ছিল।
ছোট বোন একদিন খেলতে বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। একজন মুসলমান প্রতিবেশী বলেছিল ওকে খ্রিষ্টান সৈন্যরা তুলে নিয়ে গেছে।
আরমানের পিতা শহর প্রধানের কাছে অভিযোগ পেশ করলেন। তিনি মুসলমান শুনে জ্বলে উঠল শহর প্রধান। শাসক জাতির বিরুদ্ধে এত বড় অপবাদ।
তার পিতা বাড়ি ফিরে এলেন। বড় ছেলেকে নিয়ে মহল্লার সবাইকে জানালেন। এক রাতে তাদের বাড়ি আক্রান্ত হল। বড় ভাই এবং তা নিহত হল আরমানের চোখের সামনে।
আরমান পালিয়ে একজন মুসলিম প্রতিবেশীর ঘরে আশ্রয় নিল। তার আর ঘরে ফেরা হয়নি। তাকেও মেরে ফেলতে পারে ভেবে কয়েকদিন ওখানেই লুকিয়ে রইল।
কয়েকদিন পর প্রতিবেশী আরমানকে আর একজন মুসলমানের হাতে তুলে দিল। লোকটি গোপনে তাকে শহর থেকে বের করে এক কাফেলায় সঙ্গী করে দিল।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কাফেলা পৌঁছল সিরিয়া। আরমান একজন আমীরের বাড়িতে চাকরি পেয়ে গেল।
বেঁচে থাকার তাগিতে আরমান আমীরের বাড়িতে চাকরী করছে। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ল তার। হৃদয়ে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। এ চাকরীর চাইতে সেনাবাহিনী তার ভাল লাগত।
আমীরের চাকরী ছেড়ে ও একজন সেনা কমাণ্ডারের বাড়িতে কাজ নিল। কমাণ্ডারকে শুনাল তার অতীত কাহিনী। আবেদন জানাল সেনা ফৌজে ভর্তি হওয়ার জন্য।
ষোল বছর বয়সে কমাণ্ডার আরমানকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে দিলেন। তিন চারটে যুদ্ধে শরীক হল ও। সুলতান সালাহুদ্দীনের অনুরোধে নুরুদ্দীন জঙ্গী যে ফৌজ মিসর পাঠিয়েছিলেন ও ছিল তাদের সঙ্গে।
ও এখন আটাশ বছরের টগবগে তরুণ। মিসরে কাটল দু’বছর। আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেছেন।
সুবাক দুর্গ আক্রমণকারী বাহিনীর সাথে ওকেও নেওয়া হল। হৃদয়ে ওর ঝড় বইছিল। কিছুদিন পরই যুদ্ধ হবে খ্রিষ্টান বাহিনীর সাথে।
আরমানের কমাণ্ডো বাহিনী প্রতিপক্ষের ওপর শিকারী বাজের মত ঝাঁপিয়ে পড়ত। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল তার নাম। অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সাথে নিয়ে মরুময় ঘুরে বেড়াত আরমান। খ্রিষ্টান সৈন্য দেখলেই চিতাবাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ত।
হৃদয়ের আগুন এতে নিভত না। একমাস পর তার গ্রুপের চারজন মাত্র বেঁচে রইল। বাকীরা শহীদ হল যুদ্ধ করে।
একরাতে সে পঞ্চাশ জনের একটা দলকে আক্রমণ করল। দিন ভর লুকিয়ে অনুসরণ করেছিল ওদের। আক্রমণ করেনি। দিনের বেলা পঞ্চাশ জনকে আক্রমণ করা চারজনের পক্ষে সম্ভব নয়।
খ্রিষ্টান সেনা দলটি অনেক দূরে এগিয়ে গেল। রাতে থামল ওরা। ছাউনি ফেলল বিশ্রামের জন্য। ক’জন সান্ত্রীকে পাহারায় রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
মাঝ রাতে ছাউনির মাঝ বরাবর ঘোড়া ছুটাল আরমান। ডানে বায়ে তরবারীর আঘাত করে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘোড়ার পায়ের চাপে থেতলে গেল ক’জন খ্রিষ্টান সৈন্যৈর দেহ। সান্ত্রীরা তীর ছুঁড়ল। অন্ধকারে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হল তীর।
সামনে গিয়ে সঙ্গীদের থামাল আরমান। ধীরে ধীরে পিছিয়ে এল। একবারও ভাবল না শত্রু এতক্ষণে সতর্ক হয়ে গেছে।
ছাউনির কাছে গিয়ে আবার ঘোড়া ছুটাল ওরা। সৈন্যদের দলে পিষে বেরিয়ে গেল সামনে।
ওরা এখন তিনজন। দু’জন শহীদ হয়েছে খ্রিষ্টানদের তীরের আঘাতে। আরমানের রক্তে আগুন ধরে গেল। সঙ্গীদের বলল, ‘এবার প্রতিশোধ নেব।’
এ ছিল এক ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। দু’জন সঙ্গীকে নিয়ে আরমান আবার ফিরে এল ছাউনির কাছে।
ততক্ষণে জেগে উঠেছে ছাউনির সবাই। ঘোড়াগুলো ক্লান্ত। ঘোড়া ছুটাল ওরা। খ্রিষ্টান সৈন্যরা হামলে পড়ল তাদের ওপর। নিমিষে তার সঙ্গী দু’জন শহীদ হয়ে গেল।
এখন বেঁচে আছে শুধু আরমান। তাকে ধাওয়া করছে দু’জন খ্রিষ্টান সৈন্য। পেছন থেকে ভেসে এল খ্রিষ্টানদের সতর্কবানী, ‘থামো! পালাতে পারবে না, তুমি এখন একা।’
ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দিল ও।
তারবারী দিয়ে আক্রমণ করল দুই ধাওয়াকারী। বর্শা দিয়ে একাই দু’জনের মোকাবিলা করল আরমান।
দীর্ঘ সময় ধরে চলল মুখোমুখী যুদ্ধ। কাফেলা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে ওরা।
শেষ পর্যন্ত আরমান বিজয়ী হল। নিহত হল দু’জন খ্রিষ্টান সৈন্য।
সুবাক পাঠানোর জন্য ওদের ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র তুলে নিল ও। বুঝতে পারছে না কোথায় এসেছে। ঘোড়াটা ক্লান্ত। বিশ্রাম প্রয়োজন। আরও কিছু দূর এগিয়ে এক পাহাড়ের কোলে থামল আরমান।
খ্রিষ্টান সৈন্যরা যে কোন সময় আক্রমণ করতে পারে ভেবে রাতভর জেগে রইল।
আকাশের নক্ষত্র দেখে সুবাক এবং ক্রাক কোন দিকে নির্ধারণ করল ও। কোন দিকে গেলে মুসলিম সৈন্যদের পাওয়া যাবে তাও বুঝল আরমান।
ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়ল ও। মরুভূমিতেই ও বড় হয়েছে, সুতরাং পথ হারাবার ভয় নেই। ও এক অভিজ্ঞ কমাণ্ডো সদস্য। দূর থেকেই বিপদের গন্ধ পায়।
অনেক দূরে খ্রিষ্টান সৈন্যেদের কয়েকটা দলকে যেতে দেখল ও। অতিরিক্ত ঘোড়া দুটো সাথে না থাকলে একাই আক্রমণ করে বসত ওদের।
খ্রিষ্টান সৈন্যদের দৃষ্টি বাঁচিয়ে এগিয়ে চরল আরমান। পথের বিভিন্ন স্থানে পড়ে আছে উট ঘোড়া এবং খ্রিষ্টান সৈন্যদের মৃত লাশ। শিয়াল শকুন খাবলে নিচ্ছে লাশের মাংস।
ও পথ চলছে, মাথার উপর উঠে এসেছে সূর্য। সামনে পাহাড় শ্রেণী। এখানে পথ এঁকে বেঁকে চলে গেছে।
পাহাড়ের ফাঁকে খ্রিষ্টান সৈন্যদের লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ওরা রাতে বিশ্রামের জন্য এখানে থামতে পারে।