» » সুবাক দুর্গে আক্রমণ

বর্ণাকার
🕮

পরদিন সূর্যোদয়ের সময় ওরা সুবাক পৌঁছল। মরুভূমিতে কেটেছে একরাত একদিন।

ফটকে পৌঁছে আরমান নিজের পরিচয় দিল। এরপর গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে যাবার কথা বলে ওরা এগিয়ে চলল।

শহরের রাজপথ মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। পথে দু’পাশের লোকেরা আইওনাকে দেখছে।

চলতে চলতে হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে থেমে গেল আরমান। বাড়ির ফটক বন্ধ।

আইওনা প্রশ্ন করল, ‘থামলে কেন?’

জবাব না দিয়ে দরজার কাছে এল আরমান। ঘোড়ার পিঠে বসে বসেই দু’তিনবার করাঘাত করল। একজন সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধ দরজা খুললেন।

‘এখানে কে থাকে?’ আরমান আরবী ভাষায় প্রশ্ন করল।

‘কেউ না। একটা খ্রিষ্টান পরিবার ছিল। আমাদের সেনাবাহিনী আসার পর সবাই পালিয়ে গেছে।’

‘এরপর আপনি দখল করেছেন?’

ভড়কে গেল বৃদ্ধ। একজন সৈনিক তাকে জিজ্ঞেস করছে কেন এ বাড়ি দখল করেছেন। সুলতান ঘোষণা করেছেন কোন মুসলমান যদি কোন খ্রিষ্টানকে কষ্ট দেয় কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।

বৃদ্ধ বলল, ‘এ বাড়ি আমি দখল করিনি, হেফাজত করার জন্য এসেছি। এখনি বন্ধ করে দেব। এ বাড়ির মালিক মুসলমান। এখনও বেঁচে আছেন। পনর ষোল বছর ছিলেন খ্রিষ্টানদের বেগার ক্যাম্পে।’

‘সুলতান কি তাকে ক্যাম্প থেকে মুক্তি দেননি?’

‘সবাই মুক্ত। কিন্তু এখনও তিনি ক্যাম্পেই আছেন। অসুস্থ, দুর্বল। ওখানেই সুলতান ওদের জন্য ভাল খাবার এবং ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করেছেন। ডাক্তার সবসময় দেখাশোনা করেন। সুস্থ হলেই তাকে নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’

‘তা আপনি এখানে কেন?’

‘ওখানে যারা আছে তাদের আত্মীয় স্বজন প্রতিদিন ওদের সাথে দেখা করে। এ বাড়ির মালিকও ক্যাম্পেই আছেন। একে তো বৃদ্ধ, তার ওপর দীর্ঘদিনের যন্ত্রণায় বেচারা শুধু বেঁচে আছে। আমি প্রতিদিনই দেখতে যাই। আশা করি কিছু দিনের মধ্যে সুস্থ্য হয়ে উঠবেন। বাড়িটা খালি হয়েছে আমি তাকে বলে এসেছি।’

‘তার আত্মীয় স্বজনরা কোথায়?’

‘কেউ বেঁচে নেই।

বৃদ্ধ হাত তুলে বাঁ দিকে দেখিয়ে বললনে, ‘এখান থেকে চারটা বাড়ির পরের বাড়িটা আমার। এরা আমার প্রতিবেশী। আত্মীয়ও বলতে পারেন।’

ঘোড়া থেকে নেমে আরমান ভেতরে গিয়ে একটা কক্ষে ঢুকল। আইওনাও নেমে এল ঘোড়া থেকে।

আরমানের দিকে তাকাল ও। চোখ মুছছে।

আইওনা কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করায় ও বলল, ‘আমার শৈশবকে খুঁজছি। একদিন এ বাড়ি থেকেই পালিয়ে গিয়েছিলাম। এ-ই আমাদের বাড়ি।’

সাথে সাথে ওর চোখ ফেটে বেরিয়ে এল অশ্রুর বন্যা।

ঘর থেকে বেরিয়ে ওরা আবার উঠোনে এল। বৃদ্ধ তখনও সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে।

আরমান কান্না ভেজা কণ্ঠে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, ‘আত্মীয় স্বজন মরে গেছে। এর কোন ছেলে মেয়ে ছিল না?’

‘একটা মাত্র ছেলে বেঁচে ছিল। খ্রিষ্টান ডাকাতদের হাত থেকে পালিয়ে উঠেছিল আমার বাড়িতে। আমি গোপনে তাকে সিরিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এখানে থাকলে সেও মারা যেত।’

আরমানের মনে পড়ল সে দুঃসহ রাতের কথা। পালিয়ে প্রতিবেশীর বাড়িতে উঠেছিল। এই সেই প্রতিবেশী।

বৃদ্ধকে সে বলল না, যে বালককে আপনি সুবাক থেকে গোপনে সিরিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সে বালকই আপনার সাথে কথা বলছে।

উদ্গত কান্না রোধ করা আরমানের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ল। কিন্তু ও কঠিন হৃদয় সৈনিক। বৃদ্ধকে বলল, ‘আমি বাড়ির মালিকের সাথে দেখা করব। তার নামটা বলুন।’

বৃদ্ধ তাকে তার পিতার নাম বলল। এ নামটি তার হৃদয়ের মনি কোঠায় অযত্নে রক্ষিত আছে।

‘ছেলেটার এক বোন ছিল’, বৃদ্ধ বললেন, ‘ছোট। খ্রিষ্টানরা ওকে অপহরণ রকে নিয়ে গেছে। তার কারণেই এ বাড়ির সবাই নিহত হয়েছে।’

আইওনার দিকে ফিরল আরমান।

‘পবিত্র ক্রুশের পূজারীদের কাহিনী তো নিজের কানেই শুনলে।’

আইওনা এর কোন জবাব দিল না।

ও ছাদে দিকে তাকাতে লাগল। দরজার একটা পাল্লা বন্ধ করে দেখল কি যেন। কিছু আঁকি বুকি খোদাই করা।

বসে ও মনযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। আরমান তাকিয়ে রইল ওর দিকে।

আইওনা আঁকাগুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করল। তারপর উঠে দাঁড়াল ধীরে ধীরে। হঠাৎ কি হল, ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ও ছুটে গেল অন্য কক্ষে। ওখানকার দরজার পাল্লায়ও কি যেন খুঁজছে।

আরমান এগিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কি দেখছ?’ মেয়েটা মৃদু হেসে বলল, ‘তোমার মত আমিও আমার শৈশব খুঁজছি। এটাই কি তোমাদের বাড়ি ছিল? তুমি কি এখান থেকেই পালিয়েছ?’

‘হ্যাঁ, এ বাড়ি থেকেই আমি পালিয়েছিলাম।’

আরমান ওকে শুনাল তার পালানোর কাহিনী।

কিভাবে খ্রিষ্টানরা এ বাড়িতে আক্রমণ করে তার পিতা এবং ভাইকে হত্যা করেছিল তাও বলল। বলল, ‘ভেবেছিলাম আব্বাকেও ওরা মেরে ফেলেছে। কিন্তু এ বৃদ্ধ বললেন তিনি বেঁচে আছেন।’

‘বৃদ্ধকে কি বলেছ, যাকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন তুমিই সেই বালক?’

‘এ মুহূর্তে একথা বলতে চাই না।’

আইওনা গভীর চোখে আরমানকে দেখতে লাগল। বৃদ্ধ দূর থেকে ওদেরকে আশ্চর্য হয়ে দেখছিল। আরমান আনমনা হয়ে পড়ল।

বৃদ্ধ এগিয়ে গেল ওদের কাছে। বলল, ‘আমার জন্য কি হুকুম?’

চমকে বাস্তবে ফিরে এল আরমান। নির্দেশের ভঙ্গিতে বলল, ‘এ বাড়ি এখন আপনার অধিকারে, এর হেফাজত করবেন। চল, আইওনা।’

‘তোমার পিতার সাথে দেখা করবে না?’ অনুচ্চ কণ্ঠে বলল আইওনা।

‘আগে আপন কর্তব্য পালন করব। মরুভূমিতে কমাণ্ডার নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজছেন। এতক্ষণে হয়ত ভেবেছেন আমি মরে গেছি। ওখানে আমার প্রয়োজন রয়েছে। আমার সাথে এসো। এ আমানত নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেব।

‘নারী, নারী, নারী’, সুলতান সালাহুদ্দীনের উত্তেজিত কণ্ঠ। গোয়েন্দা প্রধান আলীকে বললেন, ‘বদমাশ খ্রিষ্টানগুলো কি পেয়েছে? ওরা কি আমার সামনে নারীদেহের প্রাচীর তৈরী করতে চায়? আমার সামনে যুবতীদেরকে নাচিয়ে কি সুবাক দুর্গ ফিরিয়ে নেবে?’

‘সম্মানিত আমীর’, আলী বললেন, ‘মেয়েরা দেয়াল নয় নিষিদ্ধ গন্ধম। আপনার এবং জঙ্গীর মাঝে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করা হয়েছে ওদের মাধ্যমে। এ নারীই মুসলিম আমীর ওমরাদের হাতে তুলে দিচ্ছে মদ আর হাশিশ। ওদের দেহের উত্তাপে গলে যাচ্ছে আমীর ওমরার দল। ব্যবহৃত হচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে।’

‘এ প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। থাক ওসব কথা। এ মেয়েগুলোর ব্যাপারে কিছু বল। ওরা আটজনই তো গোয়েন্দা। ওদের কাছ থেকে কোন তথ্য বের করতে পারলে?’

‘ওরা বলেছে সুবাকে খ্রিষ্টানদের অনেক গুপ্তচর এখনও কাজ করছে। কারও ঠিকানা জানা নেই। ট্রেসও করা যাচ্ছে না। এদের তিন জন ক’দিন মিসরে ছিল। কি কাজ করেছে তা তো আপনাকে বলেছি।’

‘এদেরকে কোথায় রেখেছ? জেলে?’

‘না, আগের জায়গায়ই আছে। তবে পাহারার ব্যবস্থা করেছি।’

প্রহরী ভেতরে এসে স্যালুট দিয়ে বলল, ‘আরমান নামে একজন কমাণ্ডার একজন খ্রিষ্টান মেয়েকে সাথে নিয়ে এখানে এসেছেন। মেয়েটাকে পেয়েছেন ক্রাকের পথে। ও নাকি গুপ্তচর।’

‘দু’জনকেই ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’

আরমান এবং আইওনা ভেতরে ঢুকল। সুলতান আরমানকে বললেন, ‘মনে হয় দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছ। তুমি কার সাথে ছিলে?’

‘আমি সিরিয়ার ফৌজে ছিলাম। আমার কমাণ্ডারের নাম এহতেশাম বিন মুহম্মদ। আমি কমাণ্ডো বাহিনী ‘আল বারকে’র কমাণ্ডার।’

‘আল বারক এখন কি অবস্থায় আছে?’

প্রশ্ন করেই সুলতান আলিকে বললনে, ‘আল বারক’ অর্থ বিদ্যুৎ। আসলেই ওরা বিদ্যুৎ। আমরা যখন সুদানীদের আক্রমণ করেছিলাম, তখন কমাণ্ডো হামলায় ছিল আর বারক। ওরা তুলনাহীন।’

‘মাননীয় সেনাপতি। গ্রুপের সবাই আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করেছে। বেঁচে আছি শুধু আমি।’

‘তোমার কারণে তো এতগুলো জীবন নষ্ট হয়নি? মৃত্যু আর উৎসর্গের মধ্যে অনেক তফাৎ।’

‘না, মাননীয় সেনাপতি! আল্লাহ সাক্ষী, আমরা প্রতিটি জীবনের বিনিময়ে অন্তত বিশজনকে হত্যা করেছি। ওদের দলের দু’একজন ক্রাক পৌঁছলেও আহত অবস্থায় পৌঁছেছে। খ্রিষ্টানদের রক্তে ফিলিস্তিনের মাটি রঙিন হয়ে গেছে।

 আমাদের দ্বিতীয় দলটিও শত্রুর জন্য ছিল আতঙ্ক। খ্রিষ্টানদের মধ্যে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার ক্ষমতা নেই।’

‘আর তুমি?’ যুবতীর দিকে তাকিয়ে সুলতান বললেন, ‘তোমার ব্যাপরে সব কথা কি আমাদের খুলে বলবে?’

‘সব কিছুই বলব।’ ওড়নায় চোখ মুছে বলল আইওনা।

‘আরমান?’ সুলতান বললেন, ‘তুমি যাও। খাওয়া গোসল সেরে বিশ্রাম কর। কাল আবার নিজের দলের কাছে ফিরে যেতে হবে।’

‘শত্রুর দুটি ঘোড়া এবং অস্ত্রও নিয়ে এসেছি।’

‘ঘোড়াগুলো আস্তাবল আর তীর তরবারী অস্ত্রাগারে জমা দাও।’

একটু ভেবে সুলতান বললেন, ‘ওগুলো তোমার ঘোড়ার চাইতে ভাল হলে বদলে নিও। ময়দানের ঘোড়াগুলো কী অবস্থায় আছে?’

‘চিন্তার কোন কারণ নেই। আমাদের একটা ঘোড়া নষ্ট হলে খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে দু’টো ঘোড়া পেয়ে যাই।’

সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল আরমান। আমানত নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিয়েছে ও। কিন্তু ওর হৃদয়ে এক অব্যক্ত বেদনাভারে পিষ্ট হচ্ছিল। এ ছিল আবেগের ভার। শৈশবের হারানো স্মৃতির বেদনা। পিতা পুত্রের ভালবাসার ব্যথা।

যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ও পিতার সাথে দেখা করতে চাইছিল না। আশঙ্কা ছিল পিতৃস্নেহ, আর অতীত বেদনা কর্তব্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ঘোড়াগুলো সাথে নিয়ে ও আস্তাবলের দিকে হাঁটা দিল। আশপাশের কোন খেয়াল নেই।

ও আনমনে হাঁটছে। সামনে সুবাকের অলিগলি। ওর জন্মস্থান। এখানে ওর শৈশব কেটেছে। দুরন্ত কৈশোর পেরিয়েছে। কিন্তু তাকে দেশছাড়া করা হয়েছিল। ওর উদাস চোখ দুটো বিষন্ন ব্যথায় ছলছল করে উঠল।

‘পথ ছাড় অশ্বারোহী!’

কারো ডাকে চমকে উঠল ও। ঘুরে পেছনে তাকাল। একদল ঘোড়সওয়ার আসছে।

ও দ্রুত রাস্তার পাশে সরে গেল। শেষ আরোহীটি অতিক্রম করার সময় ও বলল, ‘বাইরে থেকে এসেছ? ময়দানের কি খবর?’

‘আল্লাহর রহমতে সব ভাল দোস্ত। প্রতিদিনই শত্রু নিঃশেষ হচ্ছে। সুবাকের জন্য কোন বিপদ নেই।’

অশ্বারোহীর দল সামনে চলে গেলে ডান দিকে মোড় নিল আরমান।

‘আমি আপনার সামনে কিছুই লুকাইনি।’

সুলতান এবং আলীর সামনে বসে আইওনা বলল। কোন প্রশ্ন ছাড়াই ও শুনাল গোয়েন্দাবৃত্তির বিস্তারিত কাহিনী।

নির্যাতনের পরও গোয়েন্দারা যা বলে না ও বলল তারচে বেশী। সন্দেহে পড়ে গেলেন গোয়েন্দা প্রধান।

‘আইওনা!’ আলী বললেন, ‘আমিও তোমার বিষয়ে পারদর্শী। স্বীকার করি তুমি উঁচু স্তরের গোয়েন্দা। আমাদের নির্যাতন এবং জেল থেকে বাঁচার জন্য তোমার পদ্ধতি প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু আমি তোমার প্রতারণার জালে পা দেব না।’

‘আপনার নাম কি?’

‘আলী বিন সুফিয়ান। হরমুনের কাছে আমার নাম শুনে থাকবে।’

আইওনা দাঁড়াল। আলীর কাছে গিয়ে বলল হাঁটু গেড়ে আলীর ডান হাত তুলে নিল নিজের হাতে।

চুমো খেয়ে বলল, ‘আপনাকে জীবিত দেখে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। আপনার সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু বলার হয়েছে। হরমুন বলত, আলী মরে গেলে যুদ্ধ ছাড়ই আমরা মুসলমানদের নিঃশেষ করে দিতে পারি।’

যুবতী আবার নিজের স্থানে গিয়ে বসল।

‘কায়রোতে আমি আপনাকে দেখার অনেক চেষ্টা করেছি। দেখা হয়নি। আমার সামনেই আপনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছির। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছিল কিনা জানার আর সুযোগ হয়নি, কারণ আমাকে তখনই সুবাক ডেকে আনা হয়েছিল।’

‘আমরা কিভাবে বিশ্বাস করব তুমি যা বলেছ সত্য বলেছ?’ আলী বললেন।

‘আমাকে বিশ্বাস করছেন না কেন?’ আইওনার কণ্ঠে ঝাঁঝ।

‘কারণ তুমি খ্রিষ্টান।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

‘যদি বলি আমি খ্রিষ্টান নই মুসলমান, তাও হয়ত বিশ্বাস করবেন না। আমার কাছে এর কোন প্রমাণ নেই। ষোল বছর পূর্বে এ শহর থেকেই আমি অপহৃত হয়েছিলাম। এখানে এসে শুনেছি আমার পিতা ক্যাম্পে আছেন।’

আইওনা পিতার নাম উল্লেখ করে বলল, ‘তার নামটাও এখানে এসে জেনেছি। আমি তো বলেছি আরমানকে হত্যা করতে গিয়ে আমার হাত উঠেনি। দিনে ওর চেহারা এবং চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল ওকে আমি কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু মনে করতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস করায় ও বলেছে এ সম্ভব নয়। দু’জন খ্রিষ্টান সৈন্য আমার সম্ভ্রম লুটে নেয়ার চেষ্টা করছে। তখনও ওরাই আমার আপন।

একজনকে আরমান হত্যা করল। অন্যজনকে আমি। ওকে মেরে আমার সম্ভ্রম রক্ষা করেছি এজন্য নয় বরং খুশি হয়েছি আরমানের জীবন বাঁচাতে পেরেছি বলে।

পথে ওর মুখে আবেগভরা কিছু কথা শুনে এই প্রথম আমার হৃদয়ে অনুভূতি জন্ম নিল। সমস্ত পথেই আমি ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। স্মৃতির পাতা হাতড়ে এদ্দুর মনে হয়েছে, শৈশবে কেউ আমায় অপহরণ করেছিল।

আপনি তো জানেন মেয়েদেরকে কিভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয়। মন থেকে হারিয়ে যায় শৈশবের স্মৃতি। আমারও তাই হয়েছে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হতে লাগল আমি আরমানকে চিনি।

এ ছিল রক্ত সম্পর্কের দাবী। চোখ চোখকে এবং হৃদয় চিনেছে হৃদয়কে।

হয়ত আরমানের হৃদয়েও এমন অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। তা নয়ত আমার মত অপরূপা যুবতীকে আমলেই আনেনি। যেন সে একা। তার সাথে কেউ নেই। আমার দিকে একবারই সে গভীর চোখে তাকিয়েছে।

সুবাক এসে আরমান একটা বাড়িতে ঢুকল। আমিও পিছু নিলাম। ভেতরে ঢুকে আমার স্মৃতি জেগে উঠল। ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দরজার পাল্লায় খোদাই করা আঁকিবুকি চোখে পড়ল। দেখলাম।

বড় ভাইজানের খঞ্জর দিয়ে আমি নিজেই দরজার পেছনে এভাবে খোদাই করেছিলাম।

আবার আরমানের দিকে তাকালাম গভীর চোঁখে। দাড়ি থাকলেও ষোল বছর পূর্বের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলাম।

ওকে বলিনি আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া বোন। ও এত পবিত্র আর আমি কত অপবিত্র। ওকে বলে দিলে ও কি করত জানি না।’

মেয়েটির বলার মাঝে আলী কয়েকবারই সুলতানের দিকে তাকালেন। এখনও ও সন্দেহের উর্ধে নয়। কিন্তু উচ্ছাসিত আবেগ, উদ্গত অশ্রু এবং বেদনামাখা বর্ণনায় দু’জনই প্রভাবিত হচ্ছিল।

তার ফোঁপানির শব্দে মনে হচ্ছিল ও সত্য কথাই বলছে।

শেষ পর্যন্ত তার বলা কথা বএং তথ্যাবলী যাচাই বাছাই করার জন্য মেয়েটির দেওয়া প্রস্তাব দু’জনেই মেনে নিলেন।

ও বলল, ‘আপনারা আমাকে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, জেলে পাঠান বা যা ইচ্ছে তাই করুন, আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আমি বেঁচে থাকতে চাই না, যদি আপনারা অনুমতি দেন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে মরতে চাই।

‘কি করবে?’ সুলতান প্রশ্ন করলেন।

‘যদি আমাকে ক্রাক পৌঁছে দেন তবে খ্রিষ্টানদের চারজন সম্রাট এবং গোয়েন্দা প্রধান হরমুনকে হত্যা করতে পারি।’

‘আমরা তোমাকে ক্রাক পৌঁছে দিতে পারি। তবে কাউকে হত্যা করার জন্য নয়। ইতিহাস বলবে সুলতান সালাহুদ্দীন মেয়েদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে হত্যা করে নিজে দুর্গে বসেছিলেন। না মেয়ে, এ অপবাদ নিয়ে আমি মরতে চাই না।

যদি সংবাদ পাই কোন খ্রিষ্টান সম্রাট অসুস্থ আমি তার কাছে আমার ডাক্তার পাঠিয়ে দেব। তাছাড়া তোমাকে আমরা বিশ্বাসও করতে পারছি না। অবশ্য তুমি যদি ইচ্ছে কর তোমায় ক্ষমা করে ক্রাক পাঠিয়ে দেব।’

 ‘না। এমন কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমি এখানেই মরব। তবে আমার অনুরোধ আরমান যেন জানতে না পারে আমি তার বোন। আমার পিতাকে দেখতে যাব। তাকেও বলব না আমি তার মেয়ে।’

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল আইওনা।

আলী বিন সুফিয়ান ওকে প্রয়োজনীয় কয়েকটি প্রশ্ন করে সুলনাতের দিকে তাকালেন।

‘ওকে এখন কি করব?’

কিছুক্ষণ ভেবে সুলতান বললেন, ‘ওর আরাম আয়েশের প্রতি লক্ষ্য রেখো। ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেব।’

আলী ওকে সাথে নিয়ে গেলেন। অন্যান্য গোয়েন্দা মেয়েরা যেখানে থাকে তার একটা কক্ষ দিলেন ওকে।

আইওনা সেখানে থাকতে সরাসরি অস্বীকার করে বলল, ‘এ কক্ষগুলোকে আমি ঘৃণা করি। যেখান থেকে আমি অপহৃত হয়েছিলাম সে বাড়িতে কি আমায় রাখা যায় না?’

‘না, আবেগের কারণে আমি নিয়ম কানুন বদলে দিতে পারি না।’

প্রহরী এবং চাকরবাকরদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ওকে রেখে ফিরে গেলেন আলী।