দুর্গম পাহাড়
খৃস্টান সম্রাট বিলডনের দরবার। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মিত্র ইয়াজউদ্দিন মাসুদের দুই দূত কথা বলছিল সম্রাটের সাথে।
‘আপনি দেরী না করে দামেশকে অভিযান চালান। আইয়ুবী এখন দামেশক থেকে অনেক দূরে। আর দামেশক হচ্ছে আইয়ুবীর শক্তি ও ক্ষমতার মূল ঘাঁটি। আইয়ুবীর ওপর চুড়ান্ত আঘাত হানার এটাই মোক্ষম সময়।’
দূতের পরামর্শ শুনে সম্রাট বিলডন বললেন, ‘কিন্তু যদি আমি রওনা হওয়ার আগেই সুলতান আইয়ুবী দামেশকের দিকে রওনা হয়ে যান।’
‘এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ইয়াজউদ্দিন মাসুদ সুলতানকে আটকে রাখার জন্য সম্ভাব্য সব কিছুই করবেন, যাতে আপনি সহজেই দামেশকে ছুটে যেতে পারেন।’
এ কথায় সম্রাট বিলডন খামোশ মেরে গেলেন। গভীর চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো তাঁর চোখে মুখে। তিনি খানিক চিন্তা করে বললেন, ‘সুলতান আইয়ুবীর কাছে দামেশকের কর্তৃত্ব হারানো আর আত্মহত্যা করা এক কথা। এ অবস্থায় নিশ্চয়ই তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটি নিতেও দ্বিধা করবেন না। দুর্বলও যখন বুঝতে পারে, লড়াইটা তার জীবন মরণের প্রশ্ন তখন সে কতটা মরিয়া হয়ে উঠতে পারে, তোমরা না জানলেও আমি তা জানি। জেনে শুনে আমি সাপের ছোবল খেতে যাবো কেন?’
দূত বললো, ‘এ ব্যাপারেও আমাদের মধ্যে আলাপ হয়েছে। ইয়াজউদ্দিন মাসুদ আপনাকে জানাতে বলেছেন, যখন সুলতান আইয়ুবী নাসিবা থেকে রওনা হবেন তখন থেকেই আমরা আমাদের কাজ শুরু করে দেবো।’
দূত আরো বললো, ‘আমরা তার সাথে প্রকাশ্য লড়াইয়ে আপাতত যেতে পারবো না। তবে তিনি রওনা হওয়ার পর প্রতি রাতেই হলব ও মুশেলের বাহিনী তার ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালাবে। এ ব্যাপারে সতর্কতার সাথে আমরা এখনই কাজ শুরু করে দিয়েছি। আমাদের প্রস্তুতি প্রায় শেষ।’
দূতের এ উদ্দীপনাময় বক্তব্য শুনেও সম্রাট খুব বেশী আশান্বিত হতে পারলেন না। বললেন, ‘তোমাদের ছিটেফাটা হামলায় তিনি কাবু হয়ে যাবেন এমনটি মনে করার কোন কারণ আছে?’
‘সম্রাট, আমরা মোটেও-ছিটেফাটা হামলা চালাবো না। আমি আপনাকে এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে চাই, যখন তিনি দূর থেকে দামেশকের মিনারের চূড়া দেখতে পাবেন তখন তার বাহিনী আর যুদ্ধ করার মত অবস্থায় থাকবে না।’
দূত তাকে আশ্বস্ত করে বললো, ‘তিনি দামেশক পৌঁছার আগেই আমাদের কমাণ্ডোো আক্রমণ তার কোমর ভেঙে দেবে। আপনি এমন এক শত্রুর সাথে লড়বেন, যার চোখে থাকবে আগুনের স্ফুলিঙ্গ, কিন্তু হাত দু’টো থাকবে শিথিল আর দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তিনি তালাশ করবেন সামান্য অবলম্বন।’
‘হলব এবং মুশেলের অবস্থা জানলাম। কিন্তু বিভিন্ন পরগণার ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলোর অবস্থা কি? তাদের আমীররা কি লড়াই শুরু হলে আমাদের পক্ষ নেবে, না আইয়ুবীর?’
‘তাদেরকে আমরা এ কথা বুঝানোর চেষ্টা করছি যে, আইয়ুবীর হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের সবাইকেই একজোট হয়ে চেষ্টা করতে হবে। নইলে সে আমাদের সবাইকে গিলে ফেলবে। আপনি চিন্তা করবেন না, তারা আমাদের সঙ্গেই থাকবেন।’
সম্রাট যেন তাদের কথায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও এ প্রস্তাব মেনে নিচ্ছেন এমন একটি ভাব নিয়ে বললেন, ‘আমাদের কিছু ফৌজ কি তোমাদের সাথে দিয়ে দেবো, যাতে কমাণ্ডোো অভিযানের সময় তারা তোমাদেরকে সহায়তা করতে পারে? আমাদের দক্ষ কমাণ্ডোোরা তোমাদের সাথে থাকলে তোমাদের হামলা অনেক বেশী কার্যকর হবে। আইয়ুবী তখন চোখে সর্ষে ফুল দেখবে।’
‘আপনার প্রস্তাবটি উত্তম, কিন্তু এখানে একটু সমস্যা আছে। আপনার সৈন্যদের মুশেলে অবস্থান করার অনুমতি দিলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, আমরা আপনার সাথে কোন চুক্তিতে আবদ্ধ আছি। কিন্তু আমরা তো সুলতান আইয়ুবীকে এই ধোঁকায় ফেলে রেখেছি যে, আমরা তার বন্ধু।’
দূতরা যখন এসব আলাপ করছিল তখন সম্রাট বিলডনের সঙ্গে তার দু’জন জেনারেল সেখানে উপস্থিত ছিল। ইয়াজউদ্দিনের এই দূতরাও ছিল সামরিক ব্যক্তিত্ব। যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে তারা ছিল অভিজ্ঞ। তারা এমনভাবে কথা বলছিল, যেন মুশেলকে নিরাপদ রেখে বিলডনকে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া যায়।
দূতের জবাব শুনে সম্রাট বিলডন বুঝলেন, এই মুসলমানরা আইয়ুবীর বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে তার সাহায্য চাইছে। তিনি নিজেও আইয়ুবীর বিনাশ চান। অতএব এ মুহূর্তে একটি অভিযান চালালে মন্দ হয় না। কিন্তু তিনি মনের ভাব গোপন করে দূতদের কাছে এ ব্যাপারে তার শর্ত আরোপ করতে শুরু করলেন।
‘তোমাদের কথায় মনে হচ্ছে, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর রণকৌশল ও যোগ্যতা সম্পর্কে তোমাদের পরিপূর্ণ ধারনা নেই। তোমরা ভাবছো, কমাণ্ডোো আক্রমণ করে তোমরা তাকে নাজেহাল করতে পারবে। কিন্তু তার কমাণ্ডোো বাহিনী সম্পর্কে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে।’
তিনি বললেন, ‘আমি জানি, তারা কতটা ক্ষিপ্র ও দুর্দান্ত। তাকে রাতের অন্ধকারে হামলা করে কিছুই করতে পারবে না তোমরা। তার কমাণ্ডোো বাহিনীর জাল ভেদ করে মূল বাহিনীর কাছেও পৌঁছতে পারবে না।’
সম্রাট বিলডন আরো বললেন, ‘আমি যদি দামেশক অবরোধ করি তবে তিনি বজ্রবেগে ছুটে এসে আমাদের ওপর আক্রমণ চালাবেন। এমতাবস্থায় দামেশকে অভিযান চালানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তোমরা জানো না, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে হাতের তালুর মতই যুদ্ধের সমস্ত ময়দান স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। তিনি আমাদের পরিকল্পনার খবর আমরা পরিকল্পনা নেয়ার সাথে সাথেই পেয়ে যান। তিনি ঈগল ও শকুনের মত বহু দূর থেকে শিকার দেখতে পান এবং সেখানে এমনভাবে ঝাপটা মারেন যে, তখন পিছু হটাও অসম্ভব হয়ে উঠে। আমি এমন আত্মঘাতি যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে পারি না।’
‘কিন্তু মহামান্য সম্রাট।’ দূত মরিয়া হয়ে বললো, ‘আইয়ুবী তার জীবনের সবচেয়ে নাজুক সময় অতিক্রম করছেন এখন। এভাবে বসে থাকতে দিলে সে আবারও সিংহের ন্যায় শক্তিশালী হয়ে উঠবে। সে আমাদের জন্য যেমন বিপদের কারণ, আমরা মনে করি আপনার জন্যও সে তেমনি বিপদজনক শক্র। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে তিনি আবারও বৈরুত অবরোধ করবেন, এতে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। আপনি কি তাকে আবারও সেই সুযোগ দিতে চান?’
‘না, তা চাই না।’ তিনি বললেন, ‘এ জন্য আমি আমার মত করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিচ্ছি। তাহলে তোমাদের বলি, আইয়ুবী যেন শান্তিতে থাকতে না পারে সে জন্য আমি আমার কমাণ্ডোো বাহিনীকে নাসিবা অভিমুখে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদেরকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। এই বাহিনীর জন্য একটা মজবুত আশ্রয় দরকার। সেটা যদি তোমরা ব্যবস্থা করতে পারো তবে আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্য বাহিনীকে এই কমাণ্ডোো বাহিনী দিয়েই অস্থির করে রাখতে পারবো। তারা তখন আর যুদ্ধ করার যোগ্য থাকবে না।’
তিনি বললেন, ‘তোমরা আমাদের বাহিনীকে আশ্রয় দান করবে, সাহায্য ও খাদ্য সরবরাহ করবে। আর আমি অস্ত্র ও যুদ্ধের সামগ্রী সরবরাহ করতে থাকবো।
তোমরা হলবের আমীর ইমামউদ্দিনকেও বলে দেবে, সে যেন আমার উপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখে। আমার কমাণ্ডোো বাহিনীকে যেন সময় মত আশ্রয় ও সাহায্য দেয়। অন্যান্য দুর্গাধিপতি যারা আছে তাদের দিকে লক্ষ্য রাখবে যেন তারা কেউ সুলতান আইয়ুবীর সাথে গিয়ে যোগ দিতে না পারে।’
সম্রাট বিলনের সাথে ইয়াজউদ্দিন মাসুদের দূতদের শর্ত পাকা হয়ে গেল। ইয়াজউদ্দিন মাসুদ তার দূতদের শর্ত পাকা করার সমস্ত অধিকার দিয়ে দিয়েছিল। পাঠানোর সময় সে তাদের বলেছিল, ‘যেভাবেই হোক সম্রাটের সাথে শর্ত পাকা করে আসবে। যদি ওরা কোন সুবিধা দাবী করে, মেনে নিও। এ মুহূর্তে ওদের সাহায্য আমাদের বিশেষ দরকার।’
সম্রাট বললেন, ‘তাহলে তোমাদের সাথে কথা পাকা হয়ে গেল, কি বলো? এবার গিয়ে আনন্দ করো। আমাদের পরীরা নতুন মেহমান পেলে খুব খুশী হয়। বিশেষ করে মুসলমান মেহমানদের পেলে নাকি তাদের আনন্দের অন্ত থাকে না।’
সুতরাং তারা তাদের ঈমান এক খৃস্টান সম্রাটের কাছে শুধু এ জন্য বন্ধক রেখে দিল, যাতে তাদের রাজ্যটা নিরাপদ থাকে।
সম্রাটের কামরা থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। ওদের সামনে তখন খুলে যাচ্ছিল পতনের অতল তলে হারিয়ে যাওয়ার সব দরজাগুলো।
কামরা থেকে বেরিয়ে এলো দূত দু’জন। ওদের চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। মিশন সফল হওয়ার আনন্দকে মধুরতর করার জন্য ওরা পা বাড়াল সেই পানশালার দিকে, যেখানে একটু আগে ডানাকাটা পরীরা তাদের মদ পরিবেশন করছিল। মদের চাইতে সেই নারীরাই যেন বেশী নেশা উদ্রেককারী।
‘এই মুসলমানদের উপর বেশী বিশ্বাস করবেন না!’ সম্রাট বিলডনকে তার এক জেনারেল বললো, ‘কারণ এই মুসলমানরা বিশ্বাসঘাতক। এখন যেমন আপনার সমস্ত শর্ত ওরা মেনে নিয়েছে তেমনি যখন প্রয়োজন মনে করবে আপনার অজ্ঞাতেই সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পায়ের উপর গিয়ে লুটিয়ে পড়তেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না।’
‘আমার কমাণ্ডোো বাহিনীর জন্য একটা আশ্রয়স্থল প্রয়োজন ছিল।’ সম্রাট বিলডন বললেন, ‘যদি মুশেলে আমি সেই আশ্রয় পেয়ে যাই তবে ধীরে ধীরে আমার সমস্ত সৈন্য সেখানে নিয়ে জড়ো করবো। তারপর সুযোগমত ইয়াজউদ্দিনকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে আগে মুশেল দখল করবো। এরকমই হওয়া উচিত আমাদের সকলের পরিকল্পনা। মুসলমানদের আমরা কখনো ঐক্যবদ্ধ হতে দেবো না। তাদের পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে রাখবো এবং সুযোগ পেলেই টপ করে গিলে ফেলবো ছোটখাট রাজ্যগুলো। এভাবেই ধীরে ধীরে মুসলমানদের এলাকাগুলো অধিকার করে নিতে হবে আমাদের।’
‘আপনার পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে উত্তম। আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি, মুসলমানরা সুখ সুবিধা ও আমোদ ফুর্তিতে মত্ত। শাসক হওয়ার লোভে তারা অন্ধ। তারা তাদের ব্যক্তিত্ব, তাদের ধর্ম সব আপনার পায়ের তলায় রেখে দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না যদি আপনি তাদের আস্থায় রাখতে পারেন। তারপর সুযোগমত তাদের গিলে ফেলা আপনার জন্য কোন ব্যাপার হবে না।
ইয়াজউদ্দিন বলো আর ইমামউদ্দিন বা ছোট ছোট মুসলিম ওমরারা, তারা শুধু এ জন্যই সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে রয়েছে, যাতে সবাই আপন আপন এলাকার শাসক হয়ে আরাম আয়েশে দিন কাটাতে পারে। তারা ঝামেলা ও বিপদ থেকে মুক্ত থাকতে চায়।
কিন্তু সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আরাম আয়েশে রাজত্ব করতে অভ্যস্ত নন। তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে সবাইকে এক রণক্ষেত্রে এনে ফিলিস্তিন থেকে আমাদের বিতাড়িত করতে চান। এই পরিকল্পনা নিয়েই তিনি মাঠে নেমেছেন। কিন্তু যাদের তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে চান তারা এত বড় যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। আমি এই ভয়কে পুঁজি করেই তাদেরকে আইয়ুবীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবো।’
তিনি সেই জেনারেলের দিকে ফিরে বললেন, “তোমার মত আমিও মুসলমানদের বিশ্বাস করি না। যদি বুঝি তারা আমার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছে, আমি তাদের সে চিন্তা সফল হতে দেবো না। ইয়াজউদ্দিন ও ইমামউদ্দিন বা তাদের কোন সাথী যদি এমন চিন্তা করে তবে আমার হাশিশ বাহিনী তাদের ফয়সালা করবে। হাশিশ বাহিনীর হাতে যে মরণ-বিষ আছে তাদের হত্যা করার জন্য তার তিল পরিমাণই যথেষ্ট।’
বিলডন তার জেনারেলদের বললেন, ‘ইয়াজউদ্দিনের এই দূত দু’জনকে এমন খাতির যত্ন করো যেন তাদের বুদ্ধি জ্ঞান সব লোপ পেয়ে যায়। তাদের যেন স্মরণই না থাকে তাদের একটা ধর্ম আছে। জীবনকে ভোগ করার চিন্তাই হবে তাদের একমাত্র ধর্ম।’
তিনি জেনারেলদের আরো কিছু নির্দেশ দিলেন এবং তাদের সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘এসব কথা গোপন রাখবে। এই কামরায় দূতদের সাথে যে আলোচনা হলো সে কথা যেন কখনো বাইরে না যায়।
সব সময় মনে রাখবে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দারা বৈরুতে বসে নেই। তারা নিশ্চয়ই গোপন খবরের আশায় মহলের চারপাশে ঘুর ঘুর করছে। চাই কি এই মহলেও তাদের চর থাকতে পারে, যাদের আমরা সনাক্ত করতে পারিনি।’
দূত দু’জন তখন মদ ও মেয়েদের নিয়ে ফুর্তিতে মশগুল। অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা মদের নেশায় অজ্ঞান ও বিবেকশূন্য হয়ে পড়লো। এই বিবেকহীন দূতকে নিয়ে খেলছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুই তরুণী। কলের পুতুলের মতই তখন তারা দুই তরুণীর ইচ্ছা অনিচ্ছার জালে বন্দী।
অন্যান্য মেহমানরাও এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে মদ পান করছিল। কেউবা পান করছিল যুবতীদের রূপসুধা।
মাহফিলের নিমন্ত্রিত মেহমানরা যখন খোশগল্প ও পানাহারে মশগুল জ্যাকব তখন হন্যে হয়ে খুঁজছে সেই দূতদের। সম্রাটের দরজার সামনে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে রক্ষীদের কাছে বিষয়টি প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়াবে ভেবে ওখান থেকে সরে এসেছিল সে। তারপর অপেক্ষা করছিল তাদের বেরিয়ে আসার। কারণ সে জানে, ওরা সম্রাটের কাছে বসে থাকতে আসেনি। মিশন শেষ করে এক সময় তাদের বেরোতেই হবে।
দূতরা কখন সম্রাটের কামরা থেকে বেরিয়ে আসবে জানা নেই তার। তাই সে মাহফিলের সবখানেই নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিল। মাহফিলের মূল চত্বর ছাড়াও মেহমানদের বিশ্রামের জন্য এবং অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর জন্য অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি কিছু এলাকা ছিল মহলের ভেতর দিকে। সেসব অঞ্চলের দরজার ওপর ‘সংরক্ষিত’ নোটিশ ঝুলানো থাকতো। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ওই সংরক্ষিত এলাকায় সে এক দূতকে পেয়ে গেল।
দূত মদ পান করছিল। পরীর মত এক নারী তার হাতে তুলে দিচ্ছিল কারুকার্য খচিত মদের পেয়ালা। জ্যাকব তাকে দেখেই তার দিকে এগিয়ে গেল এবং সামরিক কায়দায় স্যালুট দিয়ে বললো, ‘আপনি সম্ভবত মুশেলের অতিথি? আমি মুশেলবাসীদের খুব ভালবাসি।’
‘আমি মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন মাসুদের রাজকীয় দূত।’ দূত মদের নেশায় মাতাল ছিল। সে জড়িত কণ্ঠে যা বললো তার মানে হচ্ছে, ‘আমি জানতে এসেছি, বৈরুতের খৃষ্টানদের মনে মুশেলের মুসলমানদের প্রতি কতখানি ভালবাসা আছে?’
দূতের ভাষা যেমন এলোমেলো ছিল তেমনি তার পা-ও টলছিল। সে এত বেশী মদ পান করেছিল যে, নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না।
সে এলোমেলো পায়ে জ্যাকবের কাছে এসে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বললো, ‘মদের এমনই গুণ যে, মানুষের মন থেকে ধর্মের বিভেদ দূর হয়ে যায়। সেখানে জন্ম নেয় ভালবাসা। আমার এখন কেবল ভালবাসতে ইচ্ছে করছে।’
দূত টলতে টলতে বললো, ‘তোমাকে মনে হচ্ছে কতদিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু। তোমার গলায় ঝুলানো ছোট্ট এই ক্রুশটাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। তোমার এই বর্শাটাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। যেদিন এই বর্শা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বুকে বিদ্ধ হবে সেদিন আমি প্রধান সেনাপতি হয়ে যাবো।’
সেখানে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ ছিল না জ্যাকবের। তার ডিউটি শুধু ঘোরাফেরা করে দেখা, সন্দেহজনক কিছু দেখলে সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা। দূতকে টলমল অবস্থায় রেখেই ওখান থেকে সরে এলো জ্যাকব। মনোনিবেশ করলো নিজের টহল ডিউটিতে। কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পেলো, ওই দূতকে দু’জন লোক ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে পাশের এক কামরায়। দূতের তখন বেহাল অবস্থা, কোন হুশ নেই।
মাঝরাতে জ্যাকবের ডিউটি শেষ হলো। নাচগান তখনো চলছিল। জ্যাকব ও তার সাথীদের স্থলে অন্য লোক এলো ডিউটিতে। জ্যাকব তার কামরায় চলে গেল।
জ্যাকব দেরী না করে ডিউটির পোষাক পরিবর্তন করে পরে নিল সাধারণ পোষাক। যদিও মধ্যরাত পর্যন্ত ডিউটি করে সে খুবই ক্লান্ত ছিল কিন্তু বিছানায় যাওয়ার কথা সে ভাবতে পারলো না। তার পরিবর্তে সে আলতো পায়ে কামরা থেকে বেরিয়ে এলো। রাতের অন্ধকার গিলে ফেললো তাকে।
সাবধানে পা চালাচ্ছিল সে। তার গতি ছিল সেই দিকে যেখানে সব রাজকন্যার মত সুন্দরীরা থাকে। এই মেয়েরা সাধারণ মেয়েদের মত নয়। এরা সবাই ঝানু গোয়েন্দা। প্রচুর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের শেখানো হয়েছে নানা রকম দুষ্কর্ম।
গোয়েন্দাগিরীর কৌশল ও মানুষকে জালে আটকানোর কায়দা কানুন শেখানো হলে ওদের পাঠিয়ে দেয়া হয় কোন মুসলমান এলাকায়। সেখানকার আমীর, সেনাপতি এবং শাসকদের পেছনে লেগে থাকে তারা। তাদের ওপর থাকে খৃস্টানদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের নির্দেশ ও দায়িত্ব।
প্রভাবশালী মুসলমানদের জালে ফাঁসানোর কাজটি তারা সম্পন্ন করে নিখুঁতভাবে। যেসব মুসলিম অঞ্চল খৃস্টানদের অধিকারে চলে গেছে সেখানেও এইসব মেয়েদের পাঠানো হয়। এসব অঞ্চলে তাদের কাজ থাকে মুসলমান গোয়েন্দাদের অনুসন্ধান করা এবং খৃস্টান স্বার্থবিরোধী কোন তৎপরতা যেন চলতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা।
এ ছাড়া মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনার বিনাশ সাধনের জন্য নাচ-গান ও নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা।
মুসলিম যুবকদের নৈতিক চরিত্র ধ্বংস করার জন্য তাদের মধ্যে নানা রকম নেশার সামগ্রী বিতরণ করাও তাদের দায়িত্ব।
এসব মেয়েরা যে বাড়িটিতে থাকতো সেটি ছিল একটি পাকা দালান। এ বাড়ীর উল্টো দিকেই থাকে নর্তকী ও গানের মেয়েরা। তাদের মর্যাদা গোয়েন্দা মেয়েদের মত না হলেও তাদের শরীরের জৌলুস এবং সৌন্দর্য গোয়েন্দা মেয়েদের চেয়ে কম নয়।
তাদের কাজ রাজকীয় অনুষ্ঠানে মেহমানদের মধ্যে আনন্দ বিতরণ করা। প্রতি রাতেই কোন না কোন উপলক্ষে রাজকীয় অনুষ্ঠানের কোন বিরাম নেই। তবে বাইরের কোন মেহমান এলে আসর হয় জমজমাট।
সে রাতে মুশেলের মুসলমান দূতদের সম্মানে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল তাতেও ছিল নাচগানের ব্যাপক আয়োজন। কিন্তু সেদিন নর্তকী ও গায়িকাদের মক্ষীরানী সারা উপস্থিত ছিল না সেখানে।
সারা ছিল ভুবনমোহিনী এক নারী। অনিন্দ্য সুন্দরী সারার চেহারায় ছিল কমনীয়তার দুর্লভ আভা। চোখে মায়ার অঞ্জন। তার চুলে ছিল মেঘমেদুর আকাশের মাধুর্য। ইউরোপীয় মেয়েদের মত স্বর্ণকেশী ছিল না সে। দেখলে যে কেউ ভাববে, এ মেয়ে মিশর কিংবা গ্রীসে জন্মগ্রহণ করেছে। তবে বৈরুতের মেয়েও হতে পারে। কিন্তু কেউ জানতো না এ মেয়ে কোথাকার বাসিন্দা।
জ্যাকব গোয়েন্দা মেয়েদের দালানের পাশ দিয়ে সারার কামরার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। নাচগানের আসরে সারাকে না পেয়ে তার মন উতলা হয়ে আছে। তার অনুপস্থিতির কারণ কি? সে কি অসুস্থ? নাকি এই জঘন্য পরিবেশ ও পেশা থেকে বাঁচার জন্য সে কোথাও পালিয়ে গেছে?
কারণ জ্যাকব জানে, সারা এই কাজ ও পেশাকে খুবই ঘৃণা করে। তার অসুখী অন্তরের অনেক কথাই জানে জ্যাকব। এখানে সে স্বেচ্ছায় আসেনি। পরিস্থিতি তাকে এখানে আসতে এবং এই পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে।
জ্যাকবের মনে পড়ে গেল সারার সাথে তার প্রথম সাক্ষাতের কথা। বরাবরই রাজকীয় অনুষ্ঠানগুলোতে তার ডিউটি থাকে। এমনি এক অনুষ্ঠানে প্রথম সে সারাকে দেখতে পায়।
সারাকে দেখেই চমকে উঠে জ্যাকব। এত সুন্দরও মানুষ হয়! প্রথম দেখাতেই মুগ্ধতার আবেশে যেন গলে পড়ে জ্যাকব। সেই মুগ্ধতাই তাকে টেনে নেয় সারার কাছে।
মানুষের মন ভালবাসা টের পায়। জ্যাকবের মুগ্ধ ভালবাসাও যথাসময়ে টের পায় সারা। সবাই সারাকে খুব অহংকারী মেয়ে বলেই জানতো। কারণ সে কারও সাথে কথা বলতো না, কারও সাথে তেমন মিশতোও না। কিন্তু জ্যাকবের মধ্যে সে কি পেলো সেই জানে, সে জ্যাকবকে পছন্দ করতে লাগলো।
এক রাতে অনুষ্ঠান শেষে সারা মহল থেকে বেরিয়ে তার কামরার দিকে যাচ্ছিল, পথে জ্যাকবকে পেয়ে গেল। সারা তাকে বললো, ‘তুমি কি আমাকে আমার কামরা পর্যন্ত এগিয়ে দেবে?’
‘একা যেতে ভয় পাচ্ছো?’ জ্যাকব বললো, ‘এখানে তো ভয়ের কিছু নেই। তোমাকে এখানে কেউ অপহরণ করতে আসবে না।’
‘তা হয়তো আসবে না।’ সারা মুখ গম্ভীর করে স্বতকণ্ঠে বললো, ‘তবে আমি নিজেই যে নিজের ছিনতাইকারী হয়ে যেতে চাই।’ তারপর জ্যাকবের দিকে ফিরে বললো, ‘একা যেতে ভয় পাচ্ছি না, তবে এ পথটুকুতে তোমার সঙ্গ কামনা করছি।’
জ্যাকবের জন্য এ ছিল এক অভাবিত পাওয়া। যার জন্য তার মুগ্ধ চিত্তের ব্যাকুল আকর্ষণ সেই সারা তাকে সঙ্গ দিতে বলছে! রাজি হয়ে গেল জ্যাকব।
জ্যাকব নিজেকে একজন হুশিয়ার পুরুষ বলেই জানতো। নিজের পৌরুষ ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সে যথেষ্ট সচেতনও ছিল। কত মেয়ে তাকে বন্ধুত্ব ও ভালবাসার প্রস্তাব দিয়েছে কিন্তু জ্যাকব তাতে সাড়া দেয়নি।
সে বরাবর নিজেকে ওইসব মেয়েদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। গায়ে পড়ে প্রেম নিবেদন করা মেয়েগুলোকে সে ভাবতো নষ্টা, অপবিত্র। যাদের মধ্যে ইজ্জত ও সতীত্ব বলে কিছু নেই তাদেরকে কেন ভালবাসতে যাবে সে?
জ্যাকব তাদের প্রত্যাখ্যান করায় তার দাম আরো বেড়ে যায়। প্রত্যাখ্যাত মেয়েরা তার প্রতি আরো বেশী করে আকর্ষণ বোধ করতে থাকে।
জ্যাকব যেই পরিবেশে ছিল সেখানে ব্যভিচারকে পাপের কাজ মনে না করে আনন্দ ফুর্তির বৈধ উপায় মনে করা হতো। কিন্তু জ্যাকব ছিল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সারাকে ভাল লাগলেও তাকে তাদেরই একজন মনে করে জ্যাকব নিজেকে গুটিয়ে নেয়। নিজের ভাল লাগাকে ভালবাসায় পরিণত করা থেকে বিরত থাকে।
ওদিকে জ্যাকবের প্রতি সারার আগ্রহ দিন দিন বাড়তেই থাকে। যখন সারা জানতে পারে, জ্যাকব মদ পান করে না, নেশা করে না, অন্য মেয়েদের কাছে যায় না তখন তার আগ্রহ ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়। সারা ছিল বুদ্ধিমতি এবং সেও বেলেল্লাপনা পছন্দ করতো না। চরিত্রের এই সৌন্দর্যই মনের দিক থেকে পরস্পরকে কাছাকাছি নিয়ে এলো।
সারা চলতে চলতে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি তো আমার নাচ দেখে কিছু বললে না! অন্যরা তো এভাবে রাস্তায় আমাকে একা পেলে আমার নাচ ও শিল্প নৈপূন্যের প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো।’
‘আমার মুখ থেকে তোমার নিজের প্রশংসা কোন দিন শুনতে পাবে না।’ জ্যাকব উত্তর দিল, ‘অবশ্যই তোমার শরীরে আছে অদ্ভুত এক মাদকতা। যে রূপের বর্ণনা করা আমার সাধ্যের অতীত। যাদুর চেয়েও দ্রুত তা মানুষকে মোহগ্রস্ত করতে পারে এ কথাও আমি অস্বীকার করবো না। আল্লাহ তোমার চেহারায় আকর্ষণের যে সম্পদ ঢেলে দিয়েছেন তার কোন তুলনা আমার সামনে নেই। কিন্তু তোমার এ অপূর্ব দেহবল্লরী অন্যের অঙ্গুলি হেলনে নাচবে তা আমার ভাল লাগে না।’
জ্যাকব আরো বললো, ‘এই সৌন্দর্য কোন বাজারের পণ্য নয়। তোমাকে এ রূপমাধুর্য দান করা হয়েছে কোন একক পুরুষের জন্য। যদি তুমি তেমন কোন পুরুষকে কবুল বলে গ্রহণ করতে পারতে এবং এই দেহ-সম্পদ তাকে দান করে নিজেকে ধন্য মনে করতে তবে সেটাই হতো শোভন। কিন্তু তুমি যা করছে তা আমার পছন্দ নয়। আমার কথায় তুমি যদি রাগ করো তাতেও আমার করার কিছু নেই। আমি নিজের অন্তরের সাথে প্রতারণা করতে পারবো না।’
জ্যাকবের এমন অকপট ও স্পষ্ট উচ্চারণে চমকে উঠল সারা। মনে মনে বললো, আহা! আমার মনের কথাগুলো তুমি জানলে কি করে? থমকে দাঁড়িয়ে বললো, “জ্যাকব, তুমি কি সত্যি চাও না আমি রাজ দরবারে নাচি?’
‘আমি তো স্পষ্ট করেই আমার মতামত বলেছি। কালেমা পড়ে কারো ঘরণী হলেই তুমি তোমার প্রতি সুবিচার করতে। রূপের জৌলুস প্রদর্শন আর ভালবাসার প্রেম বিতরণ এক জিনিস নয়।
প্রেম মানুষকে সম্মান করতে শেখায়, অন্যকে মূল্য দিতে শেখায়। যদি ভালবাসার আবরণে নিজেকে সাজিয়ে নিতে পারতে, নিজেকে নিয়ে যেতে পারতে পর্দার আড়ালে তবে তোমার এ দেহের ওপর আল্লাহর রহমত নাজিল হতো। তুমি যা করছে তাতে আল্লাহর দানকেই অপমান করছে।’
‘জ্যাকব!’ সারা বিস্মিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কোন কালেমার কথা বলছো? কোন পর্দার কথা বলছো? খৃষ্টানরা তাদের কনেকে কখনো বোরখার আবরণে নিয়ে যায় না।’
জ্যাকব একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কিন্তু সহসাই নিজেকে সামলে নিয়ে হো হো করে হেসে উঠে বললো, ‘আমার মাথায় সব সময় মুসলমানদের শালীনতার ছবি ভাসতে থাকে। নিজে তো এখনো বিয়ে করিনি, কিন্তু মুসলমানদের বিয়ে দেখেছি। যা সুন্দর ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান।’
সারা তাকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। জ্যাকব আর কি বলবে কথা খুঁজে পায় না। সে মুখ ঘুরিয়ে শূন্যে দৃষ্টি মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সারা অস্থির হয়ে জ্যাকবের বাহু আকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি তো মুসলমান নও জ্যাকব? আমার এ কথা বলার উদ্দেশ্য এ নয় যে, তুমি গোয়েন্দা।’ সারা বললো, ‘চাকরীর খাতিরে হয়তো তুমি নিজেকে খৃস্টান বানিয়ে রেখেছো, অথবা খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে, আমি এ কথাই বুঝাতে চাচ্ছি।’
‘জ্যাকব কখনও মুসলমান হতে পারে না সারা!’ জ্যাকব বললো, ‘আমার নাম গিলবার্ট জ্যাকব। ক্রুশের পক্ষে কাজ করার জন্য সৈনিকের খাতায় নাম লিখিয়েছি। আমি জানি মুসলমানরা আমার শত্রু।
কিন্তু ছোটবেলায় আমাদের পড়শী ছিল এক মুসলিম পরিবার। ওই পরিবারের ছেলেমেয়েরা ছিল আমার খেলার সাথী। আমি তাদের এক বিয়ের অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। সেই অনুষ্ঠান আমার এত ভাল লেগেছিল যে, আজো স্মৃতিতে তা অক্ষয় হয়ে আছে।’
‘তোমাকে একটা গোপন কথা বলবো?’ সারা বললো, ‘হয়তো কথাটা শুনলে তুমি আমাকে ভুল বুঝতে পারো। তবু তোমাকে বলি, আমারও কিন্তু মুসলমানদের আচার অনুষ্ঠান ভাল লাগে। তাদের বিয়ে, পর্দা এসবের মধ্যে একটা পবিত্রতা ও প্রাণ আছে। কালেমা পাঠ করার পর স্বামীটি স্ত্রীকে ভালবাসার সাথে সাথে তাকে যে মর্যাদা দেয়, যেভাবে স্ত্রীর সম্ভ্রম রক্ষায় সচেষ্ট থাকে আমাদের সমাজে তা নেই। আমাদের সমাজে নারী পুরুষের যে অবাধ মেলামেশা ও যৌনাচারের ছড়াছড়ি তা আমার মোটেও ভাল লাগে না।’ কথা শেষ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো সারা।
‘এটা কি তোমার মনের কথা?’
‘কেন, এটা কি তুমি বুঝতে পারো না, একজন নারীকে উলঙ্গ করলে তার মনের কি অবস্থা হতে পারে? তখন সে নারী অনুভব করে পর্দা ও আবরণের মধ্যে এক আধ্যাত্মিক শান্তি ও পবিত্রতা ছিল। অনুভব করতে পারে সে কি হারিয়ে ফেলেছে।’ সারা বললো, ‘যখন একজন নারীর সতীত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয় তখন আত্মগ্লানিতে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে তার।’
জ্যাকব অবাক হয় সারার কথা শোনে। বলে, ‘এসবই তোমার মনের কথা?’
‘হ্যাঁ জ্যাকব, লোলুপ একদল পুরুষের সামনে নাচায় কোন আনন্দ ও স্বাদ নেই। নিজের সৌন্দর্যের যাদু দিয়ে অন্যকে আঙ্গুলের ইশারায় নাচাতে যারা পছন্দ করে আমি সে ধরনের মেয়ে নই।
আমি যখন একাকী আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই তখন আমাকে একটি ঘৃণার পাত্রী মনে হয়। আমি নিজেকে ঢেকে রাখতে পারি না। আমার এই শরীরের ওপর কোন পর্দা চাপাতে পারি না। নাচের সময় আমার শরীর যত উন্মুক্ত হয় ততই আমার আত্মার ওপর ছড়িয়ে পড়ে গ্লানির চাদর। আর এই গ্লানিতেই কেটে যায় আমার প্রতিটি প্রহর।’
‘তুমি যদি এই পেশাকে এতই ঘৃণা করো তবে ছেড়ে দাও না কেন?’