» » দুর্গম পাহাড়

বর্ণাকার

এ যুবকের গায়ের রঙ উজ্জ্বল ফর্সা। কথাবার্তায় চটপটে। প্রশস্ত বক্ষ। সুন্দর স্বাস্থ্য। চোখে সারল্য আর মমতা মাখামাখি হয়ে আছে।

ট্রেনিংয়ে সে যথেষ্ট নৈপুন্য ও দক্ষতা প্রদর্শন করে। তার অভিনয় গুণের কথা অন্যরা না জানলেও সে ভালই জানতো। ট্রেনিং শেষে সহজেই সে মহলের নিরাপত্তা বিভাগে নিয়োগ পেয়ে যায়। ওখান থেকে সে নিয়মিত কায়রোতে সংবাদ ও তথ্যাবলী পাঠাতে লাগলো। তাদের গ্রুপ লিডার হাতেম আলী এখন এ বাড়ীতেই থাকে। তার মত মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করছে তারা গোপনে তার সাথে যোগাযোগ রাখে।

‘মুশেলের দু’জন দূত সম্রাট বিলডনের কাছে এসেছে।’ হাসান তার লিডারকে বললো, ‘আমার বিশ্বাস এরা মুশেল থেকেই এসেছে আর দু’জনই মুসলমান। তাদের দু’জনকে বিলডন তার খাস কামরায় নিয়ে যায়। সেখানে কি আলাপ হয় তা আমি শুনতে পারিনি, তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তারা মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিনের কোন পয়গাম নিয়ে এসেছে!’

‘ওরা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে খৃস্টানদের সাথে কোন গোপন চুক্তি করতে এসেছে।’

লিডার বললো, ‘তাহলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সুলতান আইয়ুবী এখন পর্যন্ত ধোঁকায় পড়ে আছেন। তিনি ভাবছেন, ইয়াজউদ্দিন ও ইমামউদ্দিন তাঁর অনুগত ও বন্ধু। তিনি জানেন, তারা আর কিছু উপকার না করুক তার বিরুদ্ধে যাবে না। এখন এটা জানা প্রয়োজন যে, তাদের সাথে খৃষ্টানদের কি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়?’

‘তাদের কথাবার্তা বদ্ধ কামরায় হয়েছিল, ফলে এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।’

হাসান বললো, ‘তবে আমার মনে হয়, যা চুক্তি হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমি তাদের একজনের সাথে কথা বলেছি। তাকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। হতভাগা মদ এমনভাবে পান করেছিল যে সে নেশার ঘোরে আমাকে স্পষ্ট বললো, ‘তারা দুজনই মুসলমান এবং তারা মুশেল থেকে এসেছে। আমাকে বলছিল, তোমাদের খৃস্টানদের ভালবাসা দেখতে চাই। সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। মদের নেশায় এক সময় মাটিতে পড়ে গেল।’

‘ঠিক আছে, আমি সুলতান আইয়ুবীকে এখন এ সংবাদটুকুই পাঠিয়ে দেই যে, বৈরুতে মুশেলের দুই দূত এসেছে।’

হাতেম আলী বললো, ‘আমরা আমাদের সুলতানের কাছে খুবই লজ্জিত যে, তার কাছে এখনও আমাদের কোন সংবাদ পৌঁছলো না। তিনি বৈরুত অবরোধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষে তিনি প্ল্যান পরিবর্তন করতে বাধ্য হন এ কারণে যে, তার পরিকল্পনার খবর বৈরুতে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল।’

‘এতে আমাদের কোন ত্রুটি ছিল না।’ হাসান বললো, ‘ইসহাক তুর্কীকে যথাসময়ে পাঠানো হয়েছিল। সে ছলনা করার মত লোক নয়। হয়তো রাস্তায় সে মারা গেছে নয়তো ধরা পড়ে গেছে, যে কারণে সে কায়রোতে খবর পৌঁছাতে পারেনি!’

‘বৈরুতের অবরোধে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর যে ক্ষতি হয়েছে, আমাদের সে ক্ষতি পুষিয়ে দিতে হবে।’

হাতেম আলী বললো, ‘তার জন্য এ সংবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, মুশেলের শাসক খৃস্টান সম্রাট বিলডনের সাথে বন্ধুত্বের চুক্তি করেছে। কিন্তু এটুকু খবরই তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়। আমাদেরকে এ চুক্তির পূর্ণ বিবরণ তাকে দিতে হবে। চুক্তিতে কি কি শর্ত আরোপ করা হয়েছে এবং তারা কি প্ল্যান করেছে সব জানতে হবে আমাদেরকে।

সুলতান এখন নিশ্চিন্তে আছেন এই ভেবে যে, তিনি বন্ধুদের মধ্যেই নিরাপদে অবস্থান করছেন। কিন্তু তিনি যে আসলে শত্রুদের দ্বারা বেষ্টিত আছেন এবং শক্রদের মাঝেই ক্যাম্প করে বসে আছেন এ খবর তাঁর জানা নেই।’

হাতেম আলী হাসানকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মহলে কি তুমি এমন কোন মাধ্যম তৈরী করতে পারো না যাকে দিয়ে এ চুক্তির শর্ত ও পরিকল্পনা জানা যায়?’

ওরা কথা বলছিল ভেতরের কামরায় বসে। কামরার দরজা বন্ধ। হাসান উত্তর দিল, ‘বিলডন বা তার উপদেষ্টা ও সেনাপতিদের কাছে এ কথা জিজ্ঞেস করা সম্ভব নয়। অথচ এ খবর ওদের মনের সিন্ধুকে বন্দী। এর বাইরে এ খবর জানে আর দু’জন, যারা মুশেলের দূত হয়ে এসেছে। এদের কাছ থেকেই আমি খবরটা বের করে নেয়ার একটা না একটা উপায় বের করে নেব ইনশাআল্লাহ।’

‘যদি তোমার চেষ্টা সফল না হয় তবে অন্য পথ অবলম্বন করতে হবে। ওরা যখন ফিরে যাবে তখন তাদেরকে রাস্তায় পাকড়াও করতে হবে। প্রয়োজন হলে ওদের খুন করবো কিন্তু এ তথ্য বুকে নিয়ে ওদের আমি মুশেল ফিরে যেতে দেবো না।’

‘ওদেরকে হত্যা করলে তো আমাদের সমস্যা দূর হবে না।’

হাতেম আলী বললো, ‘আমাদেরকে জানতেই হবে বিলডন ও ইয়াজউদ্দিনের মাঝে কি পরিকল্পনা ও চুক্তি হয়েছে।’

‘আমি সে চেষ্টাই করবো।’ হাসান বললো, ‘যদি তাদের পরিকল্পনার সংবাদ না পাই তবে কি তাদের হত্যা করবো?”

‘তাদের হত্যা করা এখন খুব জরুরী নয়, জরুরী হচ্ছে তথ্য। আগে তুমি সে তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করো। প্রয়োজন হলে যে কোন সময় তাদেরকে হত্যা করা যাবে।’

হাতেম বললো, “আর শোন, এ কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধা করতে হবে। পারলে আজ রাতেই তা সংগ্রহ করো, যাতে আগামী কাল সকালে যাকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠাবো সে পূর্ণ সংবাদ নিয়ে যেতে পারে। আর যদি তা না পারো তবু সকালে আমি কাসেদ পাঠাবো। তখন শুধু বলবো, সম্রাট বিলডনের কাছে ইয়াজউদ্দিনের দু’জন দূত এসেছে। তাদের মাঝে সামরিক চুক্তি সাক্ষরিত হয়ে গেছে। চুক্তির শর্তাবলী পাওয়ার সাথে সাথেই আপনাকে জানাবো। এখন শুধু জেনে রাখুন, ইয়াজউদ্দিন আপনার বন্ধু নেই। আপনি এখন বন্ধুবেশী শত্রুর বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে আছেন।’

‘ঠিক আছে, আমি তাহলে এখন যাই। ’

‘যাও, তবে অত্যল্প সময়ের মধ্যেই পুরো সংবাদ সগ্রহ করতে চেষ্টা করো। সাবধান থেকো।’

‘আপনি আমার সফলতার জন্য দোয়া করুন।’ হাসান উঠে বেরিয়ে গেল।

‘খৃষ্টান কমাণ্ডোোদের জীবিত ধরার চেষ্টা করো।’ সেনাপতি সালেম মিশরী তার কমাণ্ডোো বাহিনীর কমাণ্ডোোদেরকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। তিনি তাদের বললেন, ‘কিন্তু তোমরা তোমাদের আত্মরক্ষার পথ ঠিক রেখে আক্রমণ করতে চেষ্টা করবে। যেখানে আক্রমণ চালাবে সেখানে কঠিন আঘাত হানবে, একই সাথে সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথও নিরাপদ রাখবে।

আর যদি তোমাদের উপর আক্রমণ আসে তবে তোমরা মূল বাহিনীকে সংবাদ দেবে। আমাদের বিশাল বাহিনী শুধু তোমাদের পাহারায় বিশ্রাম করছে। আর এত বিশাল পরিমাণ খাদ্য শস্য ও রসদ সম্ভার সবই তোমাদের দায়িত্বে আছে। অতএব সর্বদা সতর্ক পাহারা জোরদার রাখবে।’

কমাণ্ডোো বাহিনীর দায়িত্ব সম্পর্কে কমাণ্ডোোদের পুরোপুরি জ্ঞান ছিল।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তার ক্যাম্প থেকে দূরে পাহাড়ী উপত্যকার উঁচু স্থানে ত্রিশ চল্লিশজন সৈন্যের একটি বিশেষ চৌকি স্থাপন করলেন। সেখান থেকে ওরা চারদিকে সতর্ক নজর রাখতে পারতো এবং নিজেদের বিশাল বাহিনীর তৎপরতাও দেখাশোনা করতে পারতো।

এ চৌকিটা ছিল পাহাড়ের ঠিক মাঝামাঝি। চারদিকে টিলা পরিবেষ্টিত। তাদের পিছনে উঁচু উঁচু পাহাড় শ্রেণী এবং একটি প্রশস্ত মাঠ। এই ময়দানের মধ্য দিয়ে সৈন্যরা চলাফেরা করতো।

সহজে যাতে শত্রুর নজরে না পড়ে সে জন্যই তিনি এমন একটি স্থান বেছে নিয়েছিলেন। সেখানে সর্বদা দুজন অশ্বারোহী প্রস্তুত অবস্থায় থাকতো।

এক সন্ধ্যায় সে ফাঁড়িতে অদৃশ্য থেকে কয়েকটি তীর ছুটে এলো এবং দু’জন মুজাহিদ তাতে শহীদ হয়ে গেল। কিন্তু অনেক তালাশ করেও কোথেকে এই তীর এলো তার হদিস বের করা গেল না।

পর পর তিন চার দিন ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। সূর্য ডোবার পর পরই অকস্মাৎ ছুটে আসে তিন চারটা তীর। তারপর আর কোন ঘটনা নেই। ইতিমধ্যে এই তীরে আরো একজন মুজাহিদ শহীদ হয়ে গেল।

এরপর দু’তিন দিন আর কোন ঘটনা নেই। এক সন্ধ্যায় তিন চারটি তীর এসে বিদ্ধ হলো এক ঘোড়ার পিঠে আর ঘোড়টি ছটফট করতে করতে মারা গেল।

তীর আশপাশের কোন পাহাড়ের আড়াল থেকেই আসতো। কিন্তু একটু পরই ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে যেতে পাহাড়শ্রেণী। তাই তীর চালানো লোকদের খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে যেতো।

একদিন সন্ধ্যার একটু আগে ফাঁড়ির দুই সৈন্য পাহাড়ের পাশে এক গোপন জায়গায় গিয়ে বসে রইলো। উদ্দেশ্য কোত্থেকে তীর আসে তার হদিস বের করা।

সূর্য সবে ডুবতে বসেছে, দুটি তীর ছুটে এলো। অভ্যর্থ নিশানা। দুটি তীরই দুই সৈন্যের পিঠে এসে বিদ্ধ হলো। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই শহীদ হয়ে গেল। সকালে তাদের অর্থ খাওয়া লাশ উদ্ধার করা হলো। রাতে নেকড়ে বাঘ বা পাহাড়ি শেয়াল লাশ দুটো খেয়ে গেছে।

এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে, এই হামলা খৃষ্টান কমাণ্ডোোদের দ্বারাই হচ্ছে। কিন্তু কোন খৃস্টান সৈন্য তারা আশপাশে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলো।

একদিন দশ বারোজন সৈন্যের একটি দলকে সেই এলাকায় অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হলো। পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে তারা তিন চার গ্রুপে ভাগ হয়ে গেল। এক স্থানে দশ বারো বছরের এক শিশুকে দেখতে পেল একটি দল। ছেলেটি সৈন্যদের দেখেই দৌড়ে এক উঁচু পাহাড়ের গর্তে লুকিয়ে গেল।

ওরা ভাবল, ছেলেটি হয়তো রাখাল বালক। কিন্তু আশেপাশে কোন ছাগল বা উট দেখতে পেল না ওরা। সৈন্যরা যেখানে গিয়ে ছেলেটি দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিল সেখানে গেল। সেখানে পাহাড়ের গায়ে সরু একটা গর্তের মুখ। এটা কোন পর্বত গহ্বর হতে পারে। ছেলেটা নিশ্চয়ই এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

সৈন্যরা গহ্বরের মুখে কান লাগিয়ে ভেতরের শব্দ শোনার চেষ্টা করলো। ভেতর থেকে মানুষের গলার স্বর শোনা গেল। সৈন্যদের দেখে কোন ছেলের গর্তে ঢুকে পড়া কোন আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। এই সৈন্যরা ছেলেটির কাছে থেকে খৃস্টানদের কমাণ্ডোো বাহিনী সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় কিনা জানতে চাচ্ছিল। তারা ছেলেটিকে অনুরোধ করলো গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে। তারা তাকে নানা রকম অভয় দিল, কিন্তু ছেলেটি গর্ত থেকে বেরোলো না। তার পরিবর্তে গর্তের মধ্যে পরিপূর্ণ নিরবতা ছেয়ে গেল।

এবার সৈন্যরা হুমকি দিল, ‘ভেতরে যে বা যারাই থাকো বের হয়ে এসো, নইলে সবাইকে হত্যা করা হবে।’

হুমকিতে কাজ হলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক মধ্য বয়সী মহিলা। সে তার নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায় সৈন্যদের গালিগালাজ করতে লাগলো। পরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বললো, ‘তোমরা আমাকে হত্যা করো। আমার ছেলেকে ক্ষমা করে দাও।’

মেয়েটির কোলে এক শিশু, পেছনে দশ বারো বছরের আরেকটি ছেলে।

সৈন্যরা তাদের বুঝালো, ‘আমরা মুসলমান। তোমাদের কোন ভয় নেই। আমরা তোমাদের কোন ক্ষতি করবো না। কিন্তু তুমি বলো, তোমার এ অবস্থা কেন? লোকালয় ছেড়ে এই পাহাড়ের গুহায় তুমি কি করছো?’

মেয়েটি এবার কান্নায় ভেঙে পড়লো। সে অনেক কাকুতি মিনতি করে বললো, ‘আমাদের ছেড়ে দাও। আমরা এখান থেকে চলে যাবো।’

‘কিন্তু তার আগে তোমাকে বলতে হবে তুমি এখানে কি করে এলে? কেন এলে?’

সে কাঁদতে কাঁদতে যা বললো তার মানে দাঁড়ায় এ রকমঃ কয়েক দিন আগে তাদের গ্রামে পনেরো ষোলজন খৃস্টান সৈন্য এসে গ্রাম দখল করে নেয়। তারা গ্রামের সব কটা বাড়ীতে তল্লাশী চালিয়ে শিশু, যুবক, বৃদ্ধ ও গ্রামের সমস্ত মেয়েদের এক স্থানে একত্রিত করে সবার চোখের সামনে কয়েকজন যুবককে হত্যা করে। তারপর তারা বলে, যদি কেউ আমাদের হুকুম অমান্য করে তবে তার অবস্থা এরকমই হবে।

তারা আরো বলে, আমরা এখানে আছি এ সংবাদ যেন কোন প্রকারে গ্রামের বাইরে না যায়। কেউ যেন না জানে এখানে বাইরের সৈন্য রয়েছে।’

তারপর তারা ঘোড়ার রাখালির দায়িত্ব গ্রামবাসীদের উপর ন্যস্ত করে নিজেরা গ্রামে আশ্রয় নেয়।

মেয়েটি বললো, কথা শেষ করে তাদের কমাণ্ডোার তলোয়ার বের করলো। আমার স্বামী তার সামনেই দাঁড়িয়েছিল। কমাণ্ডোার আমার স্বামীকে বাহু ধরে সামনে টেনে নিলো এবং তলোয়ারের এক আঘাতে তার শিরচ্ছেদ করতো। তারা গ্রামবাসীদের বললো, যদি কেউ আমাদের আদেশ মানতে অস্বীকার করে তবে তার শাস্তি এমনটিই হবে।’

সে আরো জানালো, “এই সেনারা তিনটি বাড়ী খালি করে সেখানে অবস্থান নেয়। গ্রামের মেয়েদের বাধ্য করে তাদের খেদমত করতে। আমি রাতে সুযোগ পেয়ে বাচ্চা নিয়ে পালিয়ে এসেছি।’

‘সৈন্যরা কি এখনো সে গ্রামে আছে?’ প্রশ্ন করলো এক সিপাই।

মেয়েটি মাথা নেড়ে বললো, “জানি না।’

মেয়েটির কাছ থেকে সৈন্যরা জেনে নিল গ্রামটির নাম ও অবস্থান। গ্রামটি সেখান থেকে কাছেই ছিল। সৈন্যরা মহিলা ও বাচ্চা দুটিকে সেখানে রেখে সেই গ্রামের দিকে চলে গেল।

পাহাড়ী এলাকায় টিলার সারি শেষ হলো। শুরু হলো বিস্তীর্ণ প্রান্তর। এ প্রান্তরের শেষ মাথায় ছোট্ট একটি গ্রাম। ওখানে বড়জোর পনেরো বিশ ঘর লোকের বাস।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর প্রহরারত সৈন্যরা সকলেই অশ্বপৃষ্ঠে আরোহী ছিল। সংকেত দিয়ে অন্য গ্রুপগুলোকে ওখানে একত্রিত করলো ওরা। তারপর অতর্কিতে সেই গ্রামের উপর আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

সৈন্যরা গ্রামের কাছাকাছি চলে এলো। মেয়েটি সত্যি কথাই বলেছিল, খৃস্টান কমাণ্ডোোরা সত্যি ওই গ্রাম দখল করে নিয়েছিল। তারা সেখানে পাহারা দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।

অশ্বারোহীদের দেখেই সমস্ত খৃস্টান সৈন্য ঘর ছেড়ে বাইরে চলে এলো। তাদের সামনে দাঁড় করালো মেয়ে ও শিশুদের।

অশ্বারোহীরা কাছাকাছি হলে একজন সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের লক্ষ্য করে চিৎকার দিয়ে বললো, ‘যদি তোমরা সামনে অগ্রসর হও তবে আমরা এই বাচ্চা ও মেয়েদেরকে হত্যা করবো।’

অশ্বারোহীরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে গেল। তারা খৃষ্টানদের হাতে এতগুলো মুসলমান শিশু ও নারীকে খুন হতে দিতে পারে না।

‘ওরে কাপুরুষের দল!’ সুলতান আইয়ুবীর কমাণ্ডোো বাহিনীর কমাণ্ডোার বললো, “তোমরা যদি ক্রুশের জন্যই যুদ্ধ করতে এসে থাকো তবে পুরুষের মত সামনে এসে যুদ্ধ করো। শিশু ও নারীদের কেন ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছো?”

‘তোমরা সবাই ফিরে যাও।’ খৃস্টান কমাণ্ডোার বললো, ‘আমরাও গ্রাম ছেড়ে চলে যাবো। কথা দিচ্ছি আমরা আর এখানে থাকবো না।’

যে শিশু ও নারীদেরকে খৃস্টানরা আটকে রেখেছিল তাদের মধ্য থেকে এক মহিলা সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের লক্ষ্য করে চিৎকার দিয়ে বললো, “হে ইসলামের সৈনিকরা, তোমরা থেমে গেলে কেন? তোমরা আমাদেরকে অশ্বপদতলে পিষে মারো, কিন্তু এই কাফেরদের একটাকেও জীবিত ফিরে যেতে দিও না। আমরা শিশুসহ সকলেই মরতে প্রস্তুত।’

খৃস্টান কমাণ্ডোার চোখের পলকে তলোয়ার বের করে আঘাত করলো মহিলার দেহে। দিখণ্ডোিত হয়ে লুটিয়ে পড়লো মহিলা। সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরাও সঙ্গে সঙ্গে তীর ধনুক হাতে নিল। তারা কোষ থেকে তীর বের করে নিশানা করতেই সমস্ত খৃস্টান সৈন্য শিশু ও নারীদের পিছনে বসে পড়লো।

‘ওরে কাপুরুষের দল!’ মুসলমান কমাণ্ডোার বললো, ‘সৈনিক কখনও শিশু ও নারীদের পিছনে লুকায় না।’

খৃস্টানরা একটা ভুল করলো, তারা শুধু সামনের দিকটাই লক্ষ্য করছিলো, কিন্তু পিছনে যে গ্রামবাসী পুরুষরা আছে, তাদের দিকে তাদের নজর ছিল না। এতক্ষণ এইসব পুরুষরা ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে নির্বাক দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এক মহিলার রক্ত তাদের সচকিত করে তুললো।

এ সময় এক মহিলা তার তিন বছরের শিশুকে কোল থেকে আছাড় মেরে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো, “কাফেররা তো কাপুরুষ! তোমরা আমাদের খুন নিয়ে ভয় পাচ্ছো কেন? আমি আমার এই শিশুকেও কোরবানী দিতে রাজী আছি, তোমার ছুটে এসো। কাফেরদের পায়ের তলায় পিষে মারো। তোমরা ওদের ছেড়ে দিলেও ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে না। মরতে যদি হয় আমি এই খৃষ্টান সৈন্যদের সঙ্গে নিয়েই মরবো।’

মহিলা পাশের এক খৃস্টান সৈনিকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

খৃস্টান সৈন্যটি মহিলাকে হত্যা করার জন্য তলোয়ার উঠাচ্ছিল, কিন্তু সে সুযোগ সে পেল না। পিছন থেকে এক গ্রামবাসী ঝাঁপিয়ে পড়ে কেড়ে নিল সৈনিকটির তলোয়ার। মুহুর্তে হাতাহাতি লড়াই বেঁধে গেল।

গ্রামবাসী হাতের কাছে যা পেলো তাই নিয়ে চড়াও হলো তাদের ওপর। খৃস্টান সৈন্যরা যেই গ্রামবাসীদের প্রতিরোধ করতে গেল আইয়ুবীর অশ্বারোহীরা চিৎকার করে বললো, ‘নারী ও শিশুরা পালিয়ে যাও। তোমরা সরে দাঁড়াও এক পাশে।’

মেয়েরা শিশুদের কোলে নিয়ে পালাতে লাগলো। গ্রামের লোকেরা ঘোড়ার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণের মধ্যে দুই খৃস্টান ছাড়া সমস্ত খৃষ্টান সৈন্য নিহত হয়ে অশ্ব পদতলে মাংসের কিমা হয়ে গেল।

গ্রামবাসীরা সে দু’জনকে হত্যা করতে চাইল। কিন্তু মুসলিম সেনা কমাণ্ডোার তাদের বুঝালো, ‘ওদের দুজনের নিকট থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। জরুরী প্রয়োজনে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।’

এই দুজন খৃস্টানকে নিয়ে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হাসান বিন আব্দুল্লাহর কাছে সঁপে দেয়া হলো। তিনি তাদের প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাদের কমাণ্ডোো দল কোথায় কোথায় আছে জলদি বলে দাও।’

তারা দুজন জানতো এ প্রশ্নের জবাব না দিলে কি হবে। মিথ্যে তথ্য দিলে তার খেসারত কি হতে পারে তাও তাদের অজানা ছিল না। হাসান বিন আব্দুল্লাহ তাদের জেরা করে সমস্ত তথ্যই তাদের কাছ থেকে নিয়ে নিলেন।

তারা স্বীকার করলো, সম্রাট বিলডন হাজারখানেক কমাণ্ডোো সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য ও খাদ্যশস্য ধ্বংস করার জন্য বৈরুত থেকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওদের এখনও কোন নির্দিষ্ট ক্যাম্প করার সুযোগ হয়নি। তারা সমস্ত এলাকায় গ্রুপ গ্রুপ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

তাদের বলা হয়েছে, তারা যেন ছোট ছোট গ্রাম দখল করে সেখান থেকে খাদ্যশস্য যোগাড় করে ও সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদলের ওপর চোরাও হামলা চালিয়ে তাদের ক্ষতি সাধন করতে থাকে।’

এই দুজন খৃষ্টান কমাণ্ডোোকে সুলতান আইয়ুবীর সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি তাদের কথা শুনলেন, গ্রামের উপর অত্যাচার করার কথাও শুনলেন। সব শুনে তিনি আদেশ, দিলেন, “এদের দূরে কোথাও নিয়ে হত্যা করো। কারণ এরা খুনী। খুনের বদলে খুন ওদের পাওনা হয়ে গেছে।’

কমাণ্ডোোদের দূরে সরিয়ে নেয়া হলো। তিনি তার সেনাপতিদের বললেন, ‘এই ঘটনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল, খৃস্টান কমাণ্ডোোদের মুশেলের কোন কেল্লাতে থাকার অনুমতি এখনো দেয়া হয়নি। সে রকম অনুমতি থাকলে ওরা এই গ্রামকে আড্ডা বানাতো না।

সুলতান আইয়ুবী আদেশ দিলেন, আশপাশের প্রতিটি গ্রামে দু’চার জন করে কমাণ্ডোো গোয়েন্দা পাঠিয়ে দাও। আর তাদের কঠোরভাবে নিষেধ করে দাও তারা যেন গ্রামে কারো কোন ক্ষতি না করে।

তিনি কঠোর ভাষায় তাদের সাবধান করে দিয়ে বললেন, তারা নিজেদের খোরাক ও ঘোড়ার খাবার নিজেরাই সংগ্রহ করে নেবে। প্রয়োজনে উপযুক্ত দাম দিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করবে। কিন্তু কোন গ্রাম থেকেই খাদ্যের একটি দানাও যেন বিনা পয়সায় গ্রহণ করা না হয়।’

হাসান ইদরিস হাতেম আলীকে রিপোর্ট করে নিজের ঘরে ফিরে এলো। কিন্তু সে বাকী রাত ঘুমোতে পারলো না। তার মনে শুধু সারার কথাই জাগছিল। তার বুঝতে বাকি রইল না, ঐ দাজ্জাল মহিলা সারার ওপর চড়াও হবে। তাকে এ জন্য কোন শাস্তি দেয় ভাই চিন্তা করছিল হাসান।

সে জানতো, এই মহিলা কে? কিন্তু সে ঐ মহিলার সাথে দেখা করে সারার জন্য কোন সুপারিশ করতে পারে না। কারণ সে তাকে বলতে পারবে না, আমিই সে রাতে সারার কামরায় গিয়েছিলাম।

সারার কথা ভুলে তার মনে জেগে উঠতো দায়িত্বের কথা। কেমন করে সে মুশেলের দূতের কাছ থেকে জেনে নেবে বিলডনের সাথে তাদের কি চুক্তি হয়েছে। এ গোপন তথ্য তো শুধু তাদের কাছ থেকেই নেয়া সম্ভব। তাদের গোপন বৈঠকে কোন চাকর চাকরানী ছিল না যে, তাদের কাছ থেকে হাসান কোন তথ্য উদ্ধার করতে পারবে।

একদিকে সারার চিন্তা অন্য দিকে মুশেলের দূতের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের ভাবনা তাকে অস্থির করে তুলল। সে অনেক ভেবেও কোন সমস্যারই কুলকিনারা করতে পারলো না।

সারা! তার মুখ থেকে সহসাই শব্দটি বের হয়ে গেল। অনিচ্ছাকৃতভাবে বের হলেও শব্দটি কানে যেতেই চমকে উঠলো হাসান। চিন্তার দিগন্তে নতুন আলো ঝিলিক দিয়ে উঠলো। হ্যাঁ, সারাই তো এ সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে!

মুশেল শব্দটি সারাকে যেভাবে নাড়া দিয়েছে তাতে ধরে নেয়া যায়, সারার শৈশব কেটেছে মুশেলে। নিশ্চয়ই সারা মুসলমানের মেয়ে। সারা ইচ্ছে করলে সহজেই সে এ সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবে।

হাসান চিন্তা করে দেখলো, মুশেলের দূতকে বশীভূত করা সারার জন্য কোন ব্যাপারই না। মদ ও সৌন্দর্যের যাদুর ফাঁদে ফেলে তার মনের সকল গোপন কথা সহজেই জেনে নিতে পারবে সারা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সারা কি তা করবে? নাকি সারার মাধ্যমে এ তথ্য উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই ধরা পড়ে যাবে?

মরু সাইমুমের মতই ভাবনার ঝড় বইছে তার মাথায়। একটা সিদ্ধান্তে তাকে আসতেই হবে। যে করেই হোত চুক্তির গোপন তথ্য বের করতে হবে তাকে।

সে জানে, গোয়েন্দাদের বিপদের ঝুঁকি নিতে হয়। ঝুঁকি এখন তাকেও নিতে হবে। এ চেষ্টায় সফল হলে বিরাট প্রাপ্তি ঘটবে। আর যদি ব্যর্থ হয়, যদি ধরা পড়ে যায় বে তাকে পালাতে হবে এখান থেকে।

হয়তো পালাতে পারবে, হয়তো পারবে না। হয়তো ধরা পড়ে নিক্ষিপ্ত হবে কারাগারে অথবা পালাতে গিয়ে মারা যাবে। কিন্তু পিছু হটার উপায় নেই তার। ঝুঁকি তাকে নিতেই হবে। হাসানকে এবার তার কথার নৈপুণ্য দেখাতে হবে। বশীভুত করতে হবে সারাকে।

সারার কথা ভাবতে গিয়েই তার মনে পড়লো, সারা অনেকবারই তাকে মুসলমান বলে সন্দেহ করেছে। সন্দেহ করার পরও সে তাকে পছন্দ করছে। সে নিজে থেকেই বলেছে, মুসলমানদের আচার কানুন তারও পছন্দ। মুসলমানদের প্রতি এই দুর্বলতার একটাই কারণ হতে পারে যে, সে মুসলমান। যদি তাই হয় তাহলে সারা কিছুতেই তাকে ধরিয়ে দেবে না। হয়তো হাসানের আসল পরিচয় জানলে নিজের পরিচয়টাও প্রকাশ করতে পারে। এইসব ভাবতে ভাবতে হাসানের রাতটা পার হয়ে গেল।

হাসানের মস্তিষ্ক যখন চিন্তায় চিন্তায় ক্লান্ত তখন দূরের মসজিদ থেকে ভেসে এলো ফজরের আজান ধ্বনি। আল্লাহু আকবার ধ্বনি কানে বাজতেই সে বিছানায় উঠে বসলো। ভাবলো, যে মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ধ্বনি ঘোষিত হচ্ছে মিনার থেকে সেই আল্লাহই আমাকে সাহায্য করবেন।