হাসান অনুনয় ঝরা কণ্ঠে বললো, ‘সারা, এবার তুমি তোমার পরিচয় বলো। আমি তোমাকে আমার গোপন পরিচয় বলে দিয়েছি, তুমিও তোমার গোপন পরিচয় আমাকে বলো। তোমার শরীরের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই, আমি তোমার পবিত্র আত্মাকে শ্রদ্ধা করি।’
সারার উপর হাসান যেন যাদু করে বসে আছে। সারার চোখে পানি এসে গেল। সে আস্তে বললো, ‘হ্যাঁ হাসান, আমি মুসলমান। আমি আমার বাবার পাপের শাস্তি ভোগ করছি। আমি সারা নই সায়েরা।’
‘পাপ যারই হোক।’ হাসান বললো, “তোমার কথার ভঙ্গিতে বুঝা যায় তুমি পাপের গ্লানিতে বিদ্ধ হয়ে আছে। তুমি খৃষ্টানদের ঘৃণা করো আর মুসলমানদের পছন্দ করে এ কথা কয়েকবারই বলেছে। এতেই আমি বুঝে নিয়েছি, এই খাঁচা তোমাকে অশান্ত করে রেখেছে।’
‘যখন থেকে তুমি আমার আত্মাকে পবিত্র ভালবাসা কি জিনিস চিনিয়ে দিয়েছো, তখন থেকে আমার আরাম ও আনন্দ জাহান্নামের চেয়েও বেশী বেদনাদায়ক মনে হতে শুরু করেছে। আমি পাপের মধ্যেই পালিত হয়েছি। পাপের মধ্যেই যৌবনে পৌঁছেছি। পাপের আনন্দ এখন যেন বিষধর সর্প হয়ে আমাকে দংশন করে। আমি এখন আর বেঁচে থাকতে চাই না।’
‘আত্মহত্যা করাও মহাপাপ।’ হাসান বললো, ‘আল্লাহ ক্ষমাকারী, বড় দয়াবান। এটা আল্লাহর ওয়াদা। তওবাকারীকে ক্ষমা করার অঙ্গীকার আল্লাহ নিজে করেছেন। তুমি তোমার পাপের কাফফারা আদায় করো, দেখবে তোমার সকল অস্থিরতা আত্মার শান্তিতে পরিণত হয়ে যাবে।’
‘কি করবো আমি? কিভাবে কাফফারা আদায় করবো সারা অশ্রু মুছে বললো, নামাজ পড়ব? দুনিয়া ত্যাগী হয়ে যাবো? বলো আমি কি করবো?’
‘গোয়েন্দাগিরী!’ হাসান উত্তর দিল। ‘শুধু একবার, প্রথম ও শেষবার। কিন্তু তুমি সে পর্যন্ত গোয়েন্দাগিরী করতে পারবে না। যতক্ষণ তুমি কেন এ কাজ করছে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত ধারনা না পাবে। মানুষ তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দ্বারাই মহান ও শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে। তুমি তো জানো সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি ছিল? সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কি উদ্দেশ্যে পাহাড় পর্বত চষে বেড়াচ্ছেন?’
‘জানি, কিন্তু এসব মহান ব্যক্তিদের তুলনায় আমি তো কিছুই না। এসব জেনেই আমি কি করবো।’
‘তুমি ঠিকই বলেছো। তাদের তুলনায় আমরা কিছুই না। কিন্তু তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য জেনে নিজেকে সেই উদ্দেশ্যের সাথে জড়িয়ে নিতে পারলে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
তুমি আমার মধ্যে এমন কিছু পেয়েছে যার দরুণ তুমি তোমার মনের কথা আমার কাছে অকপটে বলে দিয়েছে। এটা আসলে আমার নিজের কোন প্রভাব নয়, এটা আমার মহান উদ্দেশ্যের গুণ। এই গুণ আমার ঈমানকে তরতাজা করে দেয়। আমার চলার পথ তৈরী করে দেয়। আমার ব্যক্তিত্ব, আমার মহত্ব সবটাই এ গুণেরই সৃষ্টি।
তুমি একটু চিন্তা করো, তোমার রূপ যৌবন একজন আবেদ ব্যক্তির ধ্যানও ভঙ্গ করে দিতে পারে, অথচ আমার উপর তা কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কেন পারেনি? শুধু এই কারণে যে, আমার ঈমান তা অনুমোদন করে না। আর ঈমানের এই জোশটুকু আমি পেয়েছি জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমার সুস্পষ্ট ধারনা থাকার কারণে।’
‘আমি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর উদ্দেশ্য ভাল ভাবেই জানি।’ সারা বললো, ‘আমি এটাও জানি, খৃস্টান শাসকরা মুসলমান আমীর ও শাসকদেরকে সাহায্য করার নাম করে তাদেরকে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। এ জন্য তাদেরকে দিচ্ছে নানা রকম বিলাসিতার সামগ্রী। আমি এও জানি, খৃস্টানরা মুসলিম বিশ্বকে খৃস্টানদের অধীনস্ত করতে চায়।
হাসান! আমি এ উদ্দেশ্য এখানে এসেই জানতে পেরেছি। যখন এ কথা জানলাম তখনই আমার মধ্যে জন্ম নিল জাতির প্রতি টান। নইলে আমিও খৃষ্টানদের পাপের স্রোতে ভেসে যেতাম। এখানে আমি কেন কিভাবে এলাম জানতে চেয়েছো তুমি। যে স্রোত আমাকে এই পর্যন্ত টেনে এনেছে সেই কাহিনীও আমি তোমাকে শোনাবো।’
ওরা কথা বলছিল। কথা তো নয়, নিজেকে মেলে ধরছিল একে অন্যের কাছে। সারা বলছিল, ‘কিছুদিন ধরেই আমার মনে মসজিদুল আকসা চেপে বসেছিল। পর পর দুই রাত আমি স্বপ্নে মসজিদুল আকসায় গিয়েছি। দেখি, মসজিদটি বিরাণ পড়ে আছে। কিন্তু সত্যি কথা হলো, আজ পর্যন্ত আমি সেই মসজিদ বাস্তবে দেখিনি।
আমি মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলাম মসজিদের দিকে। হঠাৎ একটি গুরুগম্ভীর আওয়াজ শুনতে পেলাম, এটা তোমার আল্লাহর ঘর, একে আবাদ করো।’
কোত্থেকে এ আওয়াজ আসে দেখার জন্য আমি চারদিকে তাকালাম, কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেলাম না। এরপর আমার ঘুম ভেঙে যায়। পর পর দু’রাত আমি এ স্বপ্ন দেখি। এ স্বপ্ন আমার মনে স্থায়ীভাবে বসে গেছে। তবে কি এটাকেই আমি আমার লক্ষ্য বানাতে পারি?’
‘এটা তো প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আজ ফরজ হয়ে আছে।’ হাসান বললো, ‘আমি এ ফরজ আদায়ের জন্যই বৈরুতে পড়ে আছি। আমি এমন এক মিশনে আছি যেখানে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ভয় ও শঙ্কা বিরাজ করছে। আমি যেদিন ধরা পড়বো সেদিন আমার জীবনের শেষ দিন হবে। তুমি কি নিজেকে দ্বীনের জন্য এভাবে বিলিয়ে দিতে পারবে?’
‘পারব। অবশ্যই পারবো। আমি তো নিজেকে কোরবান করার জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।’ সারা বললো, ‘তুমি আমাকে আমার দায়িত্ব বুঝিয়ে দাও।’
‘বুড়ি তোমাকে মুশেলের দূতের কাছে যেতে বলেছে, তুমি এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও এবং স্বেচ্ছায় তার কাছে চলে যাও,’ হাসান বললো।
এ কথায় সারার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। সে এতটাই বিস্মিত হলো যে, মুখ দিয়ে তার কথা সরলো না। অবাক চোখে সে হাসানের দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘হ্যা, সারা।’ হাসান বললো, ‘জাতির প্রয়োজনেই তোমাকে এ কোরবানী দিতে হবে। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী গোয়েন্দাগিরীতে মেয়েদের কোথাও পাঠান না। তিনি বলেন, ‘একটি নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে একটি মজবুত কেল্লা শত্রুদের হাতে ছেড়ে দিতে আমি রাজি। আমি নারীর সতীত্ব রক্ষার একজন প্রহরী।
কিন্তু সারা তুমি এখানে রয়ে গেছো। আমাদের যে দায়িত্ব পালন করতে হবে সে দায়িত্ব শুধু তোমার দ্বারাই পালন হওয়া সম্ভব। জানি, কারো আনন্দের পাত্রী হওয়া তুমি পছন্দ করো না। আমি তোমাকে দু একটি নিয়ম কানুন শিখিয়ে দেবো যাতে তোমার সতীত্ব রক্ষা পায় আবার তার কাছ থেকে তুমি গোপন তথ্যও সংগ্রহ করতে পারো।’
হাসান বললো, ‘কারো সাথে গোপনে দেখা সাক্ষাৎ করা শরিয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েজ। তেমন অনুরোধ তোমাকে আমি করতে পারি না। কিন্তু এখানে তুমি খৃস্টান পরিচয়ে আছো এবং শরিয়ত মোতাবেক চলা তোমার পক্ষে এখন কিছুতেই সম্ভব নয়।
পাপের রাজ্যে ডুবে থাকা এক নারী হয়েও যদি তুমি দ্বীনের সামান্য খেদমত করতে পারো তবে সে খেদমত আমি নেবো না কেন? সে জন্যই তোমাকে বলছি, তুমি যাও তার কাছে। আমি আশা করি আল্লাহ তোমার মান সম্মান সতীত্ব রক্ষার করবেন।’
‘ঠিক আছে, আমি রাজি। এখন আমাকে বলো আমার কি করতে হবে।’ সারা বললো, ‘আমি তো বেপর্দা মেয়েই। যদি আল্লাহ আমার নিকট থেকে এমন কোরবানী নিয়ে খুশী হন তবে আমি এ কোরবানী দিতে রাজি।’
‘এ দুই দূতই মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিনের নিকট থেকে এসেছে।’ হাসান তাকে বললো, ‘আমার বিশ্বাস, তারা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সম্রাট বিলডনের কাছ থেকে সাহায্য নিতে এসেছে। এ সময় আমাদের সৈন্য নাসিবা নামক স্থানে ক্যাম্প ও সেনা ছাউনি করে আছে। সুলতান আইয়ুবী নিশ্চিন্তে আছেন যে, তিনি বন্ধুদের দেশে ও তাদের মাঝে ক্যাম্প করে আছেন। কিন্তু তিনি যে তাঁর বন্ধুবেশী মুসলমান শক্রদের মধ্যে বাস করছেন তা তো তিনি জানেন না।
এখন আমাদের জানতে হবে সম্রাট বিলডন তাদের কি ধরনের সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কোন চুক্তি হয়েছে কিনা, হলে চুক্তির শর্তগুলো কি? এ বিষয়গুলো জেনে সুলতানকে সাবধান করতে হবে আমাদের। তোমাকে জানতে হবে, খৃস্টানরা যুদ্ধের কি ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। মুশেল ও হলবের ছোট ছোট রাজ্যগুলোর মনোভাবই বা কি? তারা কি সত্যি গোপনে খৃস্টানদের সাথে জোট বেঁধেছে?’
হাসান তাকে বিস্তারিতভাবে তার কাজ বুঝিয়ে দিল। তারপর বললো, ‘তুমি মনে করো না, তুমিই একমাত্র মেয়ে যে এ কাজ করছে। মুসলমানরা নারীদেরকে এ কাজে না লাগালেও খৃস্টানরা এ কাজে মেয়েদেরই বেশী ব্যবহার করে। খৃস্টান মেয়েরা মুসলমানদের দেশে গিয়ে সেখানকার আমীর, শাসক, সেনাপতি ও সামরিক অফিসারদের পিছনে জোঁকের মত লেগে থাকে।
এমন কোন মুসলমান দেশ নেই যেখানে ইহুদী ও খৃস্টান মেয়েরা এ কাজ করছে না। বরং বলতে পারো, মুসলিম দেশগুলোর অধিকাংশ অভিজাত ঘরেই তারা ঢুকে পড়েছে।
তারা তাদের সৌন্দর্যের মোহ দিয়ে মুসলমানদের সকল গোপন পরিকল্পনার খবর জেনে নেয়।’
‘আজ থেকে এখানে আমিও সেই কাজ করবো। আমি তো আত্মহত্যারই চিন্তা করছিলাম, অতএব এ কাজে মৃত্যু নেমে এলেও আমি তা পরোয়া করি না।’
‘তোমার আর আত্মহত্যা করার প্রয়োজন হবে না।’ হাসান বললো, ‘আমি তোমাকে পবিত্র ও খুশীময় জীবনের সুসংবাদ দিচ্ছি। আমি জানি তুমি মজলুম এক মুসলিম মেয়ে। সম্ভবতঃ শিশুকালে কোন কাফেলা থেকে খৃস্টান দস্যুরা তোমাকে লুট করে এনেছিল। তারাই তোমাকে এ পাপ পঙ্কিল জীবনে টেনে নামিয়েছে।’
‘না, তা নয় হাসান!’ সারা বললো, ‘আমি নিজেই আমাকে ছিনতাই করেছিলাম। আমার এ অভিশপ্ত জীবন কাহিনী আজ নয় পরে কোনদিন তোমাকে শোনাবো। আমাকে আগে এই কাজটা শেষ করতে দাও। দোয়া করো যেন আল্লাহ আমাকে সফল করেন আর আমি আমার এ কাজের মধ্য দিয়ে আমার পাপের কাফফারা আদায় করতে পারি।’
ততোক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। সারা তার কাপড় পরে হাসানের কামরা থেকে বেরিয়ে এলো। সে যখন তার বাসায় পৌঁছলো, দেখলো সেই মহিলা তার কামরার সামনে বসে আছে।
সারাকে দেখেই মহিলাটি হেসে বললো, রাতের জন্য প্রস্তুত থেকো। আমার লোক মুশেলের দূতের সাথে কথা বলেছে। আজ রাতে কোন নাচগান হবে না, আমি তোমাকে তার কামরাতে রেখে আসবো।’
‘ঠিক আছে খালা, আমি যখন কথা দিয়েছি তখন আমি প্রস্তুত হয়েই থাকব।’ সারাও হেসেই জবাব দিল।
মুশেলের দুই দূতের অবস্থা ঠিক ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত। তারা এখানে এসেছে ঈমান বিক্রি করতে। মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন ইসলামের সাথে গাদ্দারী করার জন্য এ দুজনকে নির্বাচিত করে কোন ভুল করেনি। তারা যথেষ্ট কৃতিত্বের সাথেই তাদের দায়িত্ব পালন করে যানে। এখানে তারা এসেছে খৃস্টান সম্রাট বিলডনের কাছ থেকে সাহায্য নিতে।
সম্রাট বিলডন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থে হাসিলের জন্য কতিপয় শর্ত আরোপ করে। মুসলমান শাসকদেরকে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে পারলে এর চাইতে লাভের বিষয় তার জন্য আর কিছুই হতে পারে না। এ জন্য সে গাদ্দার মুসলিম শাসকদের পাঠানো দূতদের শাহী সম্মান ও খাতির যত্নের কোন ত্রুটি করেনি।
মুসলমান দূতদের মাঝে ঈমানের কোন লেশ ছিল না। জাতির মঙ্গল ও কল্যাণের কোন চিন্তাও ছিল না। একজন মুসলমান হিসেবে নিজেদের মধ্যে যে আত্মসম্মানবোধ ও লজ্জাবোধ থাকা দরকার তারও লেশ ছিল না তাদের মধ্যে। তাই সম্রাট বিলডনের সরবরাহ করা মদ ও মেয়ে ভোগ করতেও বিবেকে বাঁধেনি তাদের।
আমোদ ফুর্তির এ সুযোগ পেয়ে তারা বরং খুশী। আরো খুশী ম্রাটের কাছ থেকে নানা রকম উপহার ও উপঢৌকন পেয়ে।
দূত দু’জন বৈরুতের উপকুল সংলগ্ন ভুমধ্যসাগরে নৌভ্রমণে বেরিয়েছে। এ সময় নর্তকীদের সরদারের এক লোক তাদের সাথে দেখা করলো। কথাপ্রসঙ্গে সে তাদের জানালো, বৈরুতে সারা নামে একজন নর্তকী আছে যার তুল্য সুন্দরী এই বৈরুতে নেই। দূত বললো, ‘তাকে কি একবার আমাদের দেখাতে পারবে?’
লোকটি মাথা চুলকে বললো, ‘কিন্তু দামী উপহার না পেলে যে সে কোথাও যায় না!’
‘ওটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি তাকে আমাদের কাছে এনে দাও, আমরা তাকে খুশী করে দেবো।’
অন্যজন বললো, ‘শুধু তাকে কেন, তোমাকেও খুশী করে দেবো।’
‘তাহলে কোন চিন্তা করবেন না। ধরে নিন সে আপনাদের কামরায় এসে গেছে।’
তারা দু’জন খুশীতে বাগ বাগ। দালাল লোকটি তাদের সাথে বিনিময় মূল্য ধার্য করে সেখান থেকে বিদায় হয়ে গেল। যাওয়ার আগে বললো, ‘কিন্তু কার কামরায় আগে পাঠাবো?
দূত দু’জন মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। শেষে একজন বললো, “এই মিশনের তিনিই প্রধান। অতএব আগে তার কামরাতেই পাঠিয়ে দিও।’
সন্ধ্যার আগে আগেই নৌভ্রমণ থেকে ফিরে এলো ওরা। রাত নেমে এলো। অন্ধকার কালো রাত। আপন কামরায় বসে সারার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগল দূত প্রধান।
কালো রাতের কালো অন্ধকারে কালো আবরণে নিজেকে জড়িয়ে এক সময় সারা এসে প্রবেশ করলো সেই কামরায়।
দূতের বয়স পঞ্চাশের উপরে। গত রাতে সে এত মদ পান করেছিল যে, এক সময় সে বেহুশ হয়ে যায় এবং তাকে বেহুশ অবস্থায় রেখেই ভোরে তার প্রমোদ সঙ্গিনী কামরা থেকে বের হয়ে যায়।
আজ সে কথা মনে হতেই সাবধান হয়ে যায় দূত। কিন্তু মদের নেশা তাকে টানতে থাকে। ফলে সন্ধ্যার পর থেকেই সে অল্প অল্প পান করতে থাকে।
সে এক নর্তকীর জন্য অপেক্ষা করছিল। মনে মনে কল্পনা করছিল তার রূপ মাধুরীর কথা। যার সৌন্দর্যের রসালো কাহিনী তাকে অধীর করে তুলেছিল।
দরজা খুলতেই সে দেখলো এক মেয়ে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে শরীর ঢেকে কামরায় প্রবেশ করছে। কাপড়ের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে একটি নিটোল দেহ-কাঠামো।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। দূত বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেল তাকে ধরতে। মেয়েটির কালো আবরণ উন্মুক্ত হওয়ার আগেই দূত অশ্লীল ভাষায় উল্লাস প্রকাশ করে তাকে ঝাপটে ধরলো। তখন সে তার বয়সের কথাও ভুলে গেল।
সারা তার বাহু বেষ্টন থেকে মুক্ত হয়ে কালো আবরণ খুলে দূতের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে সে বিস্ময়ে হা হয়ে গেল এবং ভয় ও বিস্মরে সে কয়েক হাত পিছনে সরে গেল। তারপর সে আবারো তাকালো দূতের দিকে, এবং তাকিয়েই সরতে সরতে পেছনে একেবারে দেয়ালের সাথে ঠেকে গেল।
সে দু হাত দিয়ে তার মুখ ঢেকে নিল। দূত এগিয়ে গিয়ে সারার মুখ থেকে হাত সরিয়ে তার চেহারার দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ থেকে অস্ফুট স্বর বেরিয়ে এলো, ‘সায়েরা!’
সারা অপলক নয়নে তাকে দেখতে লাগলো, যেন তার ভাষা বন্ধ হয়ে গেছে। দৃত বিস্মিত হয়ে ভয় কম্পিত স্বরে আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘সায়েরা! তুমি কি সায়েরা?’
কয়েক সেকেণ্ডো লাগলো তার নিজেকে সামলে নিতে। তারপর দু’কদম পিছিয়ে মৃদু হেসে বললো, ‘না। আমি বুঝি ভুল করছি। তোমার চেহারা আমার এক মেয়ের মতই লাগছে। তার নাম সায়েরা ছিল।’
‘সে সায়েরাই আমি, আপনি কোন ভুল করেননি, আমিই আপনার সেই হারিয়ে যাওয়া কন্যা। সারার মুখের বাঁধন খুলে গেল। সে ঘৃণায় দাঁত কটমট করে বললো, আমি আপনার সেই বেবী, যাকে আপনি কোলে নিয়ে আদর করতেন।
কিন্তু আপনি এক লোভী ও স্বার্থপর পিতা। স্বার্থের জন্য করতে পারেন না এমন কোন কাজ নেই। আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি এক নির্লজ্জ ও অমানুষ পিতার কন্যা।’
দূতের মাথা ঘুরে গেল। সে টলমল পায়ে দু’পা এগিয়ে পালংকের ওপর ধপ করে বসে পড়লো। এখন তার মুখে কোন ভাষা নেই। গলা শুকিয়ে গেছে। একি দেখছে সে! সায়েরা তারই মেয়ে! সন্দেহ নেই, এ মেয়ে তারই!
সায়েরা বাপের কাছ থেকে পৃথক হয়েছে আজ দুবছর কয়েক মাস। মেয়ে এখন কোথায় আছে, কিভাবে আছে কিছুই জানতো না সে।
‘বেঈমান পিতার কন্যা বারবনিতাই হয়।’ সারা মনে এগিয়ে পিতার সামনে দাঁড়িয়ে ঘৃণায় দাঁত কটমট করে লতে লাগলো; ‘আজ তোর নিজের কর্মের ফল দেখ। বদমাশ আজ তুই তোর আপন কন্যার সতীত্বের গ্রাহক। তোর কন্যা তোর প্রমোদ কামরাতেই রাত কাটাতে এসেছে।’
সারা ক্ষিপ্ত বেগে দুই হাত বাড়িয়ে বললো, ‘দে, আমার মূল্য বের কর। আমি আজ রাত তো এখানেই কাটাতে এসেছি।’
‘ওরে মা, তুই, তুই!’ পিতার ভাষা এলোমেলো হয়ে গেল। ‘তুই ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলি। আমি নির্লজ্জ নইরে, তুই নির্লজ্জ!’
‘যে পিতা তার যুবতী মেয়ের সামনে কন্যার বয়সী মেয়েদের নিয়ে নির্লজ্জ আচরণ করে, নিজের কন্যার মত মেয়েদের নাচিয়ে সুখ পায়, মদের নেশায় মাতাল হয়ে তাদের দিকে হাত বাড়ায়, সে বাপের বেটির কি আর লজ্জা থাকতে পারে। সময় হলে সেও নর্তকী ও প্রয়োদবালা হয়ে যায়। বাবা যদি তার বিয়ে দিয়ে দেয় তবে এ পরিবেশে বেড়ে উঠা মেয়েরা স্বামীকে ধোঁকা দিয়ে গোপনে পরকিয়ায় মেতে উঠে।
ওরে পিতা, তুই শুনে নে, আমি তোর অতীত ও বর্তমানের কথা বলছি। আমি যখন দামেশকে তোর বাড়ীতে থাকতাম, এখন আমার সামান্য বুদ্ধি হলো তখন থেকেই দেখছি, তুই পরনারী নিয়ে গোপনে আমোদ ফুর্তি করিস।
নুরুদ্দিন জঙ্গী মারা গেলে তুই আল মালেকুস সালেহের সাথে গোপনে পালিয়ে গেলি। যাওয়ার সময় আমাকে আর মাকেও সঙ্গে নিলি। হলবে এসে তুই মদ ধরলি।
তখনো আমি যৌবনে পা দেইনি, বলতে গেলে শিশুই ছিলাম। দেখতাম তোর কাছে সাদা চামড়ার খৃষ্টানরা আসছে। খৃষ্টানরা তোকে ধন দৌলত দান করলো, খুব সুন্দরী মেয়েও দান করলো। তখন তুই প্রকাশ্যে আমাদের সামনেই মদ গিলতে লাগলি।
বাড়ীতে মদের আসর বসে গেল। মেয়েরা নাচতে লাগলো। সাদা চামড়ার খৃস্টানরা আমাকে টানাটানি করতে লাগলো, তুই এসব দেখেও না দেখার ভান করলি।
পরে যখন আল মালেকুস সালেহ মারা গেল, তোর কাছে খৃস্টানরা আরও বেশী আসতে লাগলো। তুই আগের চেয়েও বেশী মাতাল ও নারী বিলাসী হয়ে উঠলি।
ইয়াজউদ্দিন তোকে আরও বড় পদে দায়িত্ব দিয়ে দিল। আমিও তোর প্রমোদবালা নর্তকীদের সাথে মিশতে লাগলাম।
তাদের কাছ থেকে নাচ শিখলাম। তুই যখন জানলি আমি ভাল নাচতে শিখেছি তাতে তুই খুবই খুশী হলি।
খৃষ্টানরা যখন আমার নাচ দেখলো তারা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলো, চুমু খেলো। তখন তুই সেটাও খারাপ মনে করলি না শুধু এই জন্য যে, আমার পরিবর্তে তারা তোকে ইউরোপের সুন্দরী মেয়ে দান করতো। তুই তোর ঈমান বিক্রি করে দিয়েছিলি, লজ্জা শরম ধুয়ে মুছে দিয়েছিলি।
এতটুকুতেই ক্ষান্ত হলি না তুই, তুই সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করলি। এ কাজে তোর অনেক দোসর জুটে গেল। তাদের নিয়েই তুই মশগুল হয়ে গেলি। এদিকে তোর একমাত্র কন্যার কি হলো, স্ত্রীর কি হলো কিছুই দেখার সময় হলো না তোর।
এ সময় এক খৃস্টান আমাকে স্বপ্নপুরী দেখালো। আমি তোর বাড়ীকে সালাম জানিয়ে তার সঙ্গে চলে এলাম।’
এটুকু বলেই সায়েরা আবার দু’হাতে মুখ ঢাকলো। ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলো সে। দূত স্তব্ধ হয়ে বসে শুনছিল তার কথা। মেয়ের চেহারায় পিতার প্রতি যে চরম ঘৃণা প্রকাশ পাচ্ছিল, সে মনে মনে বলছিল, সে চিত্র দেখার দুর্ভাগ্য যেন কোন বাপের না হয়। মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে তার ভেতরটাও নড়ে উঠলো। সে মুখ তুলে করুণ স্বরে বললো, ‘তারপর! তারপর কি হলো সায়েরা?’
সে কথা আমাকে আর জিজ্ঞেস করো না। যেভাবে আজ রাতে আমি তোমার বিলাস কামরায় এসেছি এমনিভাবে কত যে লোকের বিলাস কামরা আলোকিত করেছি তার তো কোন হিসাব রাখিনি। সেই খৃষ্টান আমাকে ধোঁকা দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল।
আমি তোমার মত অসংখ্য ধনীদের বিলাস বাসরের রাণী হয়ে অবশেষে ঘুরতে ঘুরতে বৈরুত এসে পৌঁছেছি। এখানে আমাকে শাহী দরবারের নর্তকী হিসেবে রাখা হয়েছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আর্জ আপন পিতাই আমার সতীত্বের খরিদ্দার হয়ে এসেছে।’
দূত লজ্জা ও শরমে নিজের মাথা দু’হাতে চেপে ধরে রেখেছিল। আবেগ ও অনুশোচনায় তার সর্বশরীর কাঁপছিল তখন।
‘বেঈমানীর মূল্য আর কত পরিশোধ করবে?’ সারা অবজ্ঞা ভরে বললো, ‘আজ তুমি ফিলিস্তিন ও মসজিদুল আকসা বিক্রি করতে এসেছে। তোমার জানা উচিত ছিল, আপন কন্যার ইজ্জত লুটার চেয়েও এটা জঘন্য কাজ। সম্রাট বিলডনের দরবারে এসেছো তুমি আপন জাতির ইজ্জত বিক্রি করতে।’
সায়েরা আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো, “আজ আমার জীবনের শেষ রাত। আমি আগামী কালের সূর্যোদয়কে আমার এ পাপ মুখ আর দেখাতে চাই না। এক বাপ তার কন্যাকে একদিন পাপের যে পথ দেখিয়েছিল সেই গোনাহের বোঝা নিয়েই আমি এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেবো।’
পিতা ধীরে ধীরে তার মাথা উঠালো। তার চোখের পানি গাল বেয়ে অঝোর ধারায় বয়ে চলেছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা। সে উঠলো এবং দেয়ালে লটকানো তলোয়ার নামিয়ে তলোয়ার খাপ মুক্ত করে সারার হাতে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘বেটী, এই নাও, তোমার পাপিষ্ঠ পিতাকে তুমি নিজ হাতে হত্যা করো। এতে যদি আমার গোনাহের কাফফারা কিছুটা আদায় হয় তাই বা কম কিসে।’
সারা তার হাত থেকে তলোয়ারটি নিজের হাতে নিয়ে নিল। বললো, “আজ রাসুলুল্লাহর উম্মত এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, যেখানে এক পিতা তার কন্যার হাতে তলোয়ার দিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত করার কথা না বলে, সেই তলোয়ার দিয়ে নিজেকে হত্যা করার আবদার জানায়। ভাবে, এতে তার পাপের কাফফারা কিছুটা হলেও আদায় হবে। হায়রে দুর্ভাগা জাতি!’’
পিতার অনুশোচনা ও বেদনার অশ্রু দেখে সারার কণ্ঠও নরম হয়ে এলো। ধীরে ধীরে কমতে লাগলো তার ঘৃণার উত্তাপ। পিতা নত মস্তকে দাঁড়িয়েছিল তার সামনে।
এক সময় থামলো সারার রাগ। শান্ত হয়ে এলো এতোক্ষণের ক্রোধের বহ্নিশিখা। পিতার দিকে ফিরে বললো, ‘মরে কোন দিন পাপের কাফফারা আদায় করা যায় না। পাপের কাফফারা আদায় করার একটাই পথ এখন আপনার সামনে খোলা আছে, আর সেই পথ হচ্ছে বেঁচে থেকে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা, তওবা করে জিহাদে শরীক হয়ে যাওয়া। আপনার কি সেই হিম্মত হবে? যদি সাহস করেন তবে আমি আপনাকে সে সুযোগ দিতে পারি।’
পিতা পরাজিত মন নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখের ভাষায় সীমাহীন কাতরতা ও অনুনয়।
‘সম্রাট বিলডনের সাথে আপনি কি চুক্তি করেছেন। সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করার জন্য কোন পরিকল্পনা করেছেন কি? করে থাকলে কি সেই পরিকল্পনা আমাকে বলুন।’
সারা বললো, ‘আমি সেই সংবাদ সুলতানকে পৌঁছে দেবো। এর চেয়ে ইসলামের খেদমত ও নেকী আর কিছু হতে পারে না। এতে আপনার পাপেরই ক্ষমা হবে না, বাপ-বেটি মিলে যে পাপ করেছি, আমি বিশ্বাস করি তারও ক্ষমা হয়ে যাবে। আমরা নিজেদেরকে আবার ইসলামের খাদেম মনে করতে পারবো।’
পিতা চুপ করে শুনছিল মেয়ের কথা। সারা পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, ‘আমাদের দুই বাপ বেটীর নাজাতের এই একটি মাত্র পথই খোলা আছে বাপজান। আমরা বাপ বেটী এখান থেকে পালিয়ে যাবো। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে গিয়ে বলবো আমাদের পাপের কথা। তার হাত ধরে তওবা করবো। আপনি তাকে নিজের মুখে শুনিয়ে দেবেন ষড়যন্ত্রের সব খবর। আমি মনে করি এতেই আমাদের কল্যাণ ও মঙ্গল হবে।’
‘হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত।’ বাবা বললো, ‘কিন্তু আমরা এখন থেকে বের হবো কেমন করে?’
সে ব্যবস্থা আমি করবো। সারা বললো।
পিতা কন্যাকে জড়িয়ে ধরলো। বাপ বেটি মিলে কাঁদলো অনেকক্ষণ। অন্তরের আবেগ যেন গলে গলে পড়ছে।