তিনি হাসান বিন আবদুল্লাহর দিকে ফিরে বললেন, ‘হাসান, তুমি আমাকে এক কাজ করে দেখাও। খৃস্টানরা অস্ত্রশস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র ও পেট্রোলের হাড়ি কোথায় জমা করেছে তা জলদি আমাকে জানাতে চেষ্টা করো।’
‘মনে হয় তারা সেগুলো কোন পাহাড়ের গুহায় বা গুপ্ত স্থানে গোপনে সুরক্ষিত রেখেছে।’
‘যদি তুমি সে স্থানের সংবাদ সংগ্রহ করতে পারো তবে সেগুলো ধ্বংস করে আমরা সহজেই অর্ধেক যুদ্ধ জয় করে নিতে পারবো।’
‘সে ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ আমি শিঘ্রই করবো।’ হাসান বললো।
‘এটা সব সময় খেয়াল রাখবে, শত্রুরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলা যুদ্ধ চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘ক্রুসেডাররা এবার প্রকাশ্য যুদ্ধ করার পরিবর্তে গুপ্ত আক্রমণ করার প্ল্যান এঁটেছে। কমাণ্ডোো যুদ্ধের মজা ওরাও বুঝে গেছে। তাদের এ লড়াইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের উত্তেজিত করা। তারা চাচ্ছে আমরাই যেন তাদের উপর আগে প্রকাশ্যে আক্রমণ চালাই। আমরা এমন বোকামী করবো না। আমরাও তাদের ওপর কমাণ্ডোো আক্রমণই চালাবো।
তারা আমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে ওঁৎ পেতে থাকবে। ফলে ওঁৎ পাতার মত স্থানে আমাদের কমাণ্ডোোদেরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ কাজগুলো তোমরা দুজনে মিলে সমাধা করার চেষ্টা করবে।’
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আর আমার প্রথম কাজ হবে সেই আমীরদের ঐক্যবদ্ধ করা ও সাথী বানানো, যারা খৃষ্টানদের বন্ধু হয়ে আছে। আমি তাদের কাছে সহযোগিতার করুণা ভিক্ষা চাইবো না। আমি এখন তলোয়ারের খোঁচায় তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা আদায় করবো।
আমি এখন প্রয়োজনে তাদের রক্ত ঝরাতেও আপত্তি করবো না, কারণ ওদের গাদ্দারীর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। মুসলমানের বিরুদ্ধে কাফেরদের সহযোগিতাকারী মুসলমানরা মুসলমান নামের অযোগ্য। তারা কাফেরদের বন্ধুত্ব কবুল করে মোনাফেকের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এখন আমার এই ভয় নেই যে, ইতিহাস আমাকে কি বলবে।
যদি আমাকে ভবিষ্যত নাগরিকরা খুনী বলে ও গৃহযুদ্ধের জন্য দায়ী করে তবুও আমি আমার সংকল্প থেকে ফিরে আসব না। আমি ভবিষ্যত নাগরিক ও ইতিহাসের কাছে জবাবদিহী করবো না, আমি জবাবদিহী করবো আল্লাহর কাছে। মানুষের মনের নিয়ত তো এক আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
দ্বীনের ব্যাপারে যদি আমার সামনে আমার ছেলেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তবে তাকেও আমি হত্যা করবো। আমি এখনও বলছি, যদি বায়তুল মুকাদ্দাস খৃস্টান ও ইহুদীদের হাত থেকে মুক্ত করার জেহাদ বন্ধ করে দেই তবে ইহুদী ও খৃষ্টানরা আমাদের পবিত্র কাবা শরীফের উপরও আধিপত্য বিস্তারের জন্য এগিয়ে আসবে।
বর্তমান অবস্থা দেখে আমি বলতে পারি, আমাদের আমীর ও শাসকরা এবং তাদের সন্তানরা ফিলিস্তিনকে ইহুদীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকবে। তাই এখন তলোয়ার ছাড়া আমার কাছে এর কোন চিকিৎসা নেই।’
‘আমরা আপনার আদেশের প্রতি চেয়ে আছি।’ সালেম মিশরী বললো, ‘যদি আপনি আমার মত জানতে চান তবে আমি এ কথাই বলবো, কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন, স্বাধীনতা লাভে ইচ্ছুক গাদ্দারদের চরম শাস্তি হওয়া দরকার।’
‘আর আমি তাদের শাস্তি অবশ্যই দেবো।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সালেম মিশরী ও হাসান বিন আবদুল্লাহকে যুদ্ধের নির্দেশনা দিয়ে উভয়কে বিদায় করলেন।
তারা দু’জন যখন চলে গেল তখন সুলতান আইয়ুবী অন্য একটা সমস্যার বিষয়ে খুব চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি যখন বৈরুতের অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে নাসিবাতে এসে ক্যাম্প করেন, ঠিক তার কিছু আগে তিনি সংবাদ পান লোহিত সাগরের পূর্ব উপকূলে আসিনিয়া, কেনিয়া ও সুদানে খৃষ্টান বাহিনী বিভিন্ন কাফেলার উপর লুটতরাজ শুরু করেছে।
তারা শুধু বেছে বেছে মুসলিম কাফেলাই লুট করে। মাল সম্পদ ছাড়াও উট ঘোড়া সব লুটে নিয়ে যায়। উঠিয়ে নিয়ে যায় শিশুকন্যা ও যুবতী মেয়েদের।
বেশীর ভাগ ডাকাতি সে সময় হতো যখন মিশরের হাজীদের কাফেলা যাতায়াত করতো। এই ডাকাতরা ঠিক সামরিক কায়দায় ডাকাতি করতো। কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর কাছে তখন ততবেশী সৈন্য ছিল না, তাই এ ব্যাপারে তিনি কোন পদক্ষেপ নিতে পারেননি।
তাছাড়া তার মাথায় তখন ফিলিস্তিন ও গাদ্দার মুসলমান শাসকদের বিষয়টি চেপে বসেছিল। তিনি টের পাচ্ছিলেন গোপনে এইসব মুসলমান শাসকরা খৃষ্টানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে এবং তাদের কাছ থেকে গোপনে সাহায্য সহযোগিতাও গ্রহণ করছে। এই সব কারণে সুলতান আইয়ুবী সেদিকে তখন মনযোগ গিতে পারেননি।
বৈরুতের অবরোধের সময় সুলতান আইয়ুবী সামুদ্রিক নৌবহর ব্যবহার করেছিলেন। সেই নৌবহরের এ্যাডমিরাল ছিলেন হিশামুদ্দিন লুলু। অবরোধ শুরুতেই বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে যায়। তখন সুলতান আইয়ুবী হিশামুদ্দিনকে সংবাদ দেন, তিনি যেন নৌবহর আলেকজান্দ্রিয়া নিয়ে যান।
তার কিছুদিন পরই সুলতান আইয়ুবী কায়রো থেকে সংবাদ পেলেন, খৃস্টানদের লুটতরাজ একটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, কোন মুসলিম কাফেলাই ঠিকানা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না।
সুলতান আইয়ুবী কায়রোতে উত্তর পাঠানোর পরিবর্তে আলেকজান্দ্রিয়ায় এ্যাডমিরাল হিশামুদ্দিনকে আদেশ পাঠালেন, ‘তুমি তোমার নৌবহর সেদিকে নিয়ে যাও যেখানে লোহিত সাগর তীরে ডাকাতদের উপদ্রপ বেড়েছে। তুমি তাদের এমনভাবে প্রতিরোধ করো যাতে যাত্রীরা নিরাপদে গন্তব্যস্থানে পৌঁছতে পারে।’’
সুলতান আইয়ুবী আরো জানালেন, ‘লোহিত সাগরে তোমার সাথে কেউ নৌযুদ্ধ করতে নামবে না। বরং তুমি সাগর তীরবর্তী দেশের মাটিতে নেমে ওৎ পেতে থাকো যেন সেই সব ডাকাতদের ধরতে পারো। যারা মুসলমান যাত্রীদের কাফেলায় লুটতরাজ করে তুমি তাদের প্রতিরোধ করো।
আমি জানতে পেরেছি, ডাকাতরা সবাই খৃস্টান সেনাবাহিনীর সদস্য। তারা পরিকল্পনা করে মুসলিম কাফেলায় লুটতরাজ করছে। এরা মরুভূমিতে থাকে না। সমুদ্রের কিনারায় থাকে।
তুমি নৌসেনাদের কয়েকটি দলে ভাগ করে নাও এবং সমুদ্রে ঘোরাফেরা করতে থাকো। যেখানে তোমার সন্দেহ হবে ডাকাতদের আড্ডা আছে সেখানে সৈন্যদের এক বা একাধিক দলকে স্থলভাগে নামিয়ে দেবে। তাদের কাজ হবে ডাকাতদের খুঁজে বের করা ও তাদের নির্মূল করা। আমার পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত তুমি লোহিত সাগরের তীরে এই অভিযান অব্যাহত রাখবে।’
হিশামুদ্দিন আদেশ পাওয়ার সাথে সাথেই লোহিত সাগর অভিমুখে রওনা হয়ে গেলেন।
যে যুগে ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের সাথে যোগাযোগের জন্য সুয়েজ খাল ছিল না। লোহিত সাগরে সুলতান আইয়ুবী কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজ ও বড় বড় নৌকা রেখেছিলেন। এই সাগরের পশ্চিম তীরে মিশর ও পূর্ব পাড়ে সৌদি আরব অবস্থিত। উত্তরে সিনাই মরুভূমি ও আকাবা উপসাগর।
বিভিন্ন কাফেলা যারা মিশর, সুদান ও সোমালিয়া থেকে হজ্জের জন্য যাত্রা করতো তাদের উট, ঘোড়া ও হাজীদের অন্যান্য মালামাল নৌকায় করে সুয়েজ উপসাগর পার করতে হতো। আবার কোন কোন কাফেলা লোহিত সাগরের পাড় ধরেও পথ চলতো, তাতে সাগরের ঠাণ্ডোা বাতাসে পথ চলা তাদের জন্য আরামদায়ক হতো।
হিশামুদ্দিন সেখানে পৌঁছে সুলতানের নির্দেশ মত দুটো দলকে উপকুলে নামিয়ে দিলেন। তারা স্থলভাগে নেমেই ডাকাতদের সামনে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কমাণ্ডোো আক্রমণ করে তাদের কয়েকজনকে হত্যা করলো, বাকীরা পালিয়ে গেল। সন্ধান নিয়ে দেখা গেল এরা সবাই মরু ডাকাত। সুলতানের কথা মত কোন খৃস্টান সৈন্য তিনি সেখানে খুঁজে পেলেন না।
হিশামুদ্দিন একদিন সংবাদ পেলেন, মিশর থেকে এক বিরাট হজ্জের কাফেলা হেজাযের পথে যাত্রা করেছে। কাফেলাটি আরব মরুভূমির মধ্য দিয়ে পথ চলছিল।
হিশামুদ্দিন তার কয়েকজন সৈন্যকে যাযাবরের বেশে সেদিকে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু তারা মরুভূমির অনেক পথ চষে বেড়িয়েও কাফেলার কোন সন্ধান পেলো না।
কাফেলার যাত্রীদের দুর্ভাগ্য যে, তারা সাগর তীর থেকে অনেক ভেতর দিয়ে পথ চলছিল। অত ভিতরে তাদের খুঁজতে যায়নি দলটি।
এক রাতে কাফেলা এক স্থানে ক্যাম্প করে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল। কাফেলায় হজ্জযাত্রীও ছিল, ব্যবসায়ীও ছিল। কয়েকটি পরিবারও তাদের সহযাত্রী হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিল শিশু ও বৃদ্ধ। কয়েকটি কিশোরী এবং যুবতী মেয়েও ছিল কাফেলায়। উট ঘোড়ার সংখ্যাও ছিল অনেক। লোক সংখ্যা ছিল কমবেশী ছয়শোর মত।
কয়েকজনকে পাহারায় রেখে ওরা খেয়ে দেয়ে সবাই শুয়ে পড়লো। কোন দুর্ঘটনা ছাড়াই রাত পার হয়ে গেল। সকাল বেলা অন্ধকার থাকতেই জেগে উঠলো লোকজন। একজন আজান দিল, সবাই তায়াম্মুম করে জামাতের সাথে ফজরের নামাজ পড়লো।
যখন তারা যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন কোথা থেকে যেন ভেসে এলো কঠিন আওয়াজ, ‘সামানপত্র বেঁধো না, তোমরা সবাই একদিকে সরে দাঁড়াও। কেউ মোকাবেলা করতে চাইলে মৃত্যু অবধারিত।’
কাফেলার কেউ কেউ চিৎকার করে উঠলো, ‘ডাকাত! ডাকাত!’
ততোক্ষণে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। পূব তাকাশে উঁকি দিয়েছে সূর্য। সেই আলোয় কাফেলার লোকজন স্পষ্ট দেখতে পেলো, তাদের চারপাশে মরু পোষাকে সজ্জিত কয়েক শত লোক দাঁড়িয়ে আছে।
এতোক্ষণ তারা মরুভূমির সাথে মিশে বালিতে শুয়ে ছিল, কঠিন কণ্ঠস্বরটি শোনার সাথে সাথে তারা উঠে দাঁড়িয়েছে। তাদের কেউ কেউ অশ্বপৃষ্ঠে আরোহী। তাদের হাতে বর্শা ও নাঙ্গা তলোয়ার। তাদের মাথা ও মুখ সাদা রুমাল দিয়ে ঢাকা।
কাফেলার লোক সংখ্যা বেশী থাকায় তাদের ক্যাম্প ছড়ানো ছিটানো ও বিস্তৃত ছিল। ডাকাতরা তাদের ঘেরাও সংকীর্ণ করে আনতে লাগলো।
কাফেলার লোকেরা সবাই মুসলমান ছিল। নিরবে অস্ত্র সমর্পণ করা মুসলমানের স্বভাব নয়। তারা জানতো, মরুভূমিতে পথ চলতে গেলে কাফেলার উপর আক্রমণের সম্ভাবনা সব সময়ই থাকে। সে জন্য তারাও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল ও লড়াই করার জন্য প্রস্তুত ছিল।
‘নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের মাঝখানে বসিয়ে দাও।’ কাফেলার একজন অনুচ্চ কণ্ঠে বললো।
এ আদেশ নিরবে সবার কানে কানে পৌঁছে গেল। নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা কাফেলার মাঝখানে যেতে লাগলো। ডাকাতরাও, সামনে অগ্রসর হতে লাগলো। কাফেলার লোকজনও হাতে বর্শা এবং তলোয়ার তুলে নিল। ডাকাতদের মোকাবেলা করার জন্য দাঁড়িয়ে গেল কাফেলার সামর্থবান সবাই।
ডাকাতের দল কাফেলায় আক্রমণ করে বসলো। শুরু হলো তলোয়ারের ঝনঝনানি ও আহতদের আর্ত চিৎকার।
অসহায় শিশু ও মেয়েরা কান্না জুড়ে দিল। প্রলয়ের বিভীষিকায় ছেয়ে গেল কাফেলা। আহত নিহত হতে লাগলো উভয় পক্ষেই। সবার কান্নার স্বর একাকার হয়ে গেল।
ডাকাতের দল বেশীর ভাগই অশ্বারোহী। এ জন্য তাদের দিকেই পাল্লা ভারী হয়ে গেল। বিশেষ করে তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও পরীক্ষিত সৈনিক।
কাফেলার লোকেরাও প্রাণপণ লড়াই করছে। তারা ঐকবদ্ধভাবে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে লড়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই একটা সতর্কবানী শোনা যাচ্ছিল, ‘মেয়েদেরকে মাঝখানে রাখো। মেয়েরা যেন পৃথক হয়ে না যায়।’
এক মেয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘আমাদের জন্য চিন্তা করবে না। আমরা তোমাদের সাথেই আছি, শত্রুদের মোকাবেলা করো।’
কাফেলার লোকজন যদি ঘোড়ার উপর সওয়ার হওয়ার সুযোগ পেতো তবে তারা আরো ভালভাবে যুদ্ধ করতে পারতো। কিন্তু তাদের ঘোড়ায় জ্বীন আঁটা ছিল না। তাছাড়া ঘোড়ার কাছে যাওয়ার সময় সুযোগও পাচ্ছিল না তারা। তারা খৃষ্টান ডাকাতদের ঘোড়ার পায়ের তলে ক্ষত বিক্ষত হতে লাগলো।
ডাকাতদের কেউ কেউ কাফেলার লোকজনের আঘাতে অশ্বপৃষ্ঠে থেকে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ক্ষতি কাফেলার লোকদেরই বেশী হচ্ছিল। কারণ তাদের মধ্যে ছিল নারী, শিশু এবং বৃদ্ধও। সবাই যোদ্ধা ছিল না। ওরা লড়াই করছিল যে যার মত। কেউ কেউ মেয়েদের ঘিরে ওদের পাহারা দিচ্ছিল। যুদ্ধ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র।
কাফেলায় সাত আটজন যুবতী ছিল। এদের মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়ার এক নামকরা নর্তকীও ছিলো। তার নাম রায়াদী। সে তার পেশার প্রতি বিরক্ত হয়ে তওবার জন্য হজ্জ করতে যাচ্ছিল।
তার সাথে যে লোক ছিল সে তাকে খুব ভালবাসতো। তার সহযোগিতায়ই সে তার মালিকের নিকট থেকে পালিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে। তারা এখনও বিয়ে করেনি। দুজনেরই আশা ছিল তারা মক্কায় গিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে ও পরে হজ্জ পালন করবে।
রায়াদী নর্তকী হওয়ার কারণেই তার গতি ছিল চঞ্চল ও ক্ষিপ্র। লড়াই শুরু হওয়ার পর কিছুক্ষণ সে তার সঙ্গীর সাথেই ছিল। সঙ্গী তাকে নিয়ে বিশাল কাফেলার সাথে হজ্জে যাচ্ছিল বলে সঙ্গে কোন অস্ত্র বা তলোয়ার আনেনি। যদিও তখনকার দিনে মানুষ সফরে তলোয়ারকে পোষাকের মতই অপরিহার্য মনে করতো।
তবে তার কাছে একটা ছোরা বা খঞ্জর ছিল। সে সেই খঞ্জর হাতে রায়াদীর পাশে থেকে তাকে পাহারা দিচ্ছিল। রায়াদী তার মুখ ও মাথা এমন ভাবে ঢেকে রেখেছিল যাতে তার সৌন্দর্য ডাকাতদের চোখে না পড়ে।
এ সময় লড়াই করতে করতে এক ডাকাত তাদের কাছাকাছি এসে পড়ে। তার সাথী ডাকাতটির পিছন থেকে তার পিঠে খঞ্জর দিয়ে এমন জোরে আঘাত করলো যে, খঞ্জর সমুলে তার পিঠে বিধে গেলো।
সে খঞ্জর টেনে বের করতে চাইলো কিন্তু পারলো না। আহত ডাকাত ঘুরে পলকে তার বুকে তলোয়ারের মাথা বিদ্ধ করে দিল। দুজনেই মাটিতে পড়ে গেল।
এই ডাকাতের পিঠে তীর ভর্তি কোষ ছিল, আর তার কাঁধে ধনুক লটকানো ছিল। রায়াদী তার ধনুক ও তীর কোষ খুলে নিল।
রায়াদীর পাশেই কাফেলার কিছু জিনিষপত্র গাদা করে রাখা ছিল। তাতে ছিল নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী, কাপড় চোপর ও তাঁবু।
রায়াদী তীর ধনুক নিয়ে তাঁবুর স্তুপের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে গেল। খৃস্টান ডাকাতরা ঘোড়া ছুটিয়ে তার সামনে দিয়ে ছুটাছুটি করছে। রায়াদী ধনুকে তীর জুড়ে নির্দিষ্ট অশ্বারোহীকে টার্গেট করে তীর ছুঁড়তে শুরু করলো। তার নিশানা খুব ভাল ছিল। প্রতিটি তীরই লক্ষ্য ভেদ করতে লাগলো।
এভাবে সে বেশ কিছু ডাকাতকে ফেলে দিতে সক্ষম হলো। সে আরও তীর ছুঁড়লো এবং আরো দু’তিনক্ষকে ঘায়েল করলো। দু একটি তীর বিভিন্ন ঘোড়ার গায়েও বিদ্ধ হলো। একটি ঘোড়া তীর বিদ্ধ হয়ে পাগলের মত ছুটাছুটি করতে লাগলো।
রায়াদীকে কেউ দেখতে পাচ্ছিল না। সে আবার নিশানা ঠিক করলো এবং এক আরোহীর উপর তীর চালালো। তীরটা আরোহীর গায়ে না লেগে ঘোড়ার ঘাড়ে গিয়ে বিদ্ধ হলো। ঘোড়াটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে ঘোড়াটি তাঁবুর গাদার স্তুপের উপর এসে পড়লো।
এই স্তুপের আড়ালেই রায়াদী লুকিয়ে ছিল। ঘোড়া, জিনিষপত্রের উপর দিয়ে হুড়মুড় করে ছুটতে গিয়ে রায়াদীর গায়ের ওপর পড়লো।
আরোহী আগেই দূরে ছিটকে পড়েছিল। ঘোড়া রায়াদীর গায়ের ওপর পড়তেই গাদার মধ্য থেকে ছড়িয়ে পড়লো তার মরণ চিৎকার।
ঘোড়াটি যখন রায়াদীর গায়ের ওপর পড়ে তখন তার কাহিল অবস্থা। জঞ্জালের কারণে সে আর অগ্রসর হতে না পেরে ওখানেই ছটফট করতে লাগলো।
তখনও কেউ মারা যায়নি, না ঘোড়া, না রায়াদী। ঘোড়ার গলায় তীর বিদ্ধ হয়েছিল। স্তুপে কয়েক পল্টি খেয়ে সে আবার উঠে দাঁড়ালো এবং একদিকে ছুটে পালালো।
স্তুপের পাশে ছিটকে পড়া আরোহী উঠে বসলো। চিৎকারের শব্দ লক্ষ্য করে তাকালো স্তুপের দিকে। সেখানে গাদার মধ্যে একটি মাথা দেখতে পেল সে। মাথাটি কোন সুন্দরী নারীর বলেই মনে হলো তার।
আরোহী লোকটি উঠে দাঁড়ালো এবং স্তুপের জঞ্জাল সরিয়ে দেখতে পেলো সেখানে আহত এক সুন্দরী নারী। পাগলা ঘোড়ার পায়ের আঘাতে সে ক্ষতবিক্ষত। তার উঠে বসার মত অবস্থাও নেই।
তখনো রায়াদী জ্ঞান হারায়নি। খৃষ্টান লোকটি তাকে ধরে উঠালো। রায়াদী তখন কাৎরাচ্ছে।
এক সময় লড়াই শেষ হলো। ডাকাত দল অনেক ক্ষতি স্বীকার করার পরও তারাই জয়ী হলো। তারা কাফেলার মাল সামান একত্রিত করে কাফেলার বেঁচে যাওয়া লোকদের মাথায় তুলে দিয়ে আস্তানার দিকে রওনা দিল।
এ লড়াইয়ের দুইদিন পর। হিশামুদ্দিন নৌ বাহিনীর এক জাহাজের ক্যাবিনে বসেছিলেন। তার কেবিনের দরজায় আঘাত হলো। তিনি বললেন, ‘ভেতরে এসো।’
স্থল বাহিনীর কমাণ্ডোার দরজা খুলে ভেতরে এলো। তার সাথে এক লোক, লোকটির চেহারা এতই ফ্যাকাশে ও দুর্বল যে, একদম মরা মানুষের মত রক্ত শূন্য।
‘খৃষ্টান ডাকাতরা বিরাট এক কাফেলা লুট করেছে।’ বাহিনীর লিডার হিশামুদ্দিনকে বললো, ‘এই ব্যক্তি ডাকাতদের বন্দীদশা থেকে পালিয়ে এসেছে। অবশিষ্ট কাহিনী তার মুখেই শুনে নিন।’
সে লোক বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলো ঘটনা। কাফেলার ওপর কেমন করে আক্রমণ হয়েছে, কিভাবে কাফেলার লোকজন তাদের মোকাবেলা করেছে, সব বললো, আমরা বীরত্বের সাথেই মোকাবেলা করেছি। কিন্তু আমাদের ঘোড়ায় জ্বীন বাঁধা ছিল না। যদি আমরা ঘোড়র ওপর সওয়ার হতে পারতাম তবে শক্ররা সফল হতে পারতো না।’
লোকটি আরো বললো, ‘কাফেলার খুব কম সংখ্যক লোকই বাঁচতে পেরেছে। যারা শেষ পর্যন্ত বেঁচে আছে তারা এখন ডাকাতদের হাতে বন্দী। আমার মনে হয় তাদেরও এতক্ষণে হত্যা করা হয়েছে।’
লোকটি বললো, ‘আমিও তাদের হাতে বন্দী ছিলাম। আল্লাহর হয়তো ইচ্ছা ছিল কথাগুলো আপনার কাছে পৌঁছানো।
তাই হয়তো তিনি আমাকে সেখান থেকে বের করে এনেছেন।’
‘কাফেলার নারী ও শিশুদের কি অবস্থা হয়েছে?’
‘লজ্জার ব্যাপার হলেও না বলে পারছি না, পাঁচজন যুবতী ও দশ বারোজন কিশোরী তাদের কাছে বন্দী আছে। তাদের সাথে যে ব্যবহার করা হচ্ছে তা বলার মত নয়।’
সে বললো, ‘কাফেলার প্রচুর পরিমাণ মূল্যবান জিনিষপত্র, নগদ অর্থ সবই তারা লুটে নিয়েছে। নব্বইটা ঘোড়া ও প্রায় দেড় শ উটও হস্তগত করেছে তারা।’
‘ওরা এখন কোথায় আছে?’
‘এক ভয়ংকর ও দুর্গম পাহাড়ের আড়ালে। এমন ভীতিকর ও আতংকজনক স্থান আমি এর আগে জীবনেও দেখিনি।’
লোকটি পাহাড়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে বললো, ‘পাহাড়ের পর পাহাড়, টিলার পর টিলা। সেই পাহাড় ও টিলা পেরিয়ে যতই ভেতরে ঢোকা যাবে ততই দুর্গম হয়ে উঠবে পথ। এক সময় দেখা যাবে একেবারে সটান খাঁড়া কতগুলো টিলা আছে।’
লোকটি বললো, ‘এই টিলাগুলো পাহাড়ের অনেক ভেতরে। সেই টিলার আড়ালে ডাকাতরা গুহার ভেতর নিজেদের জন্য ছোট ছোট কামরা বানিয়ে নিয়েছে। পাহাড়ী ঝর্ণার একাধিক স্রোত আছে সেখানে। ফলে পানির কোন অভাব হয় না তাদের।
চারদিকে অনেক দূর পর্যন্ত পাহাড় থাকায় এলাকাটা তাদের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ। সেখানেই তারা তাদের শক্তিশালী আড্ডা বানিয়ে নিয়েছে। এলাকাটা বিরান হওয়ার পরও তাদের কারণেই সেই দুর্গম পাহাড়ের ভেতরটা আবাদ হয়ে গেছে।’
‘সেই পাহাড় এখান থেকে কত দূর হবে?’
‘যে স্থানের কথা বলছি সেটা সমুদ্র উপকুল থেকে প্রায় মাইল বিশেক দূরে হবে।’
‘তুমি পালিয়ে এলে কিভাবে?’
লোকটি বললো, ‘লড়াইয়ের সময় কিছু ডাকাত আমাদের আঘাতে মারা গেলেও শেষ পর্যন্ত আমরা টিকতে পারিনি। আমাদের অধিকাংশ সদস্য মারা গেলে আমরা হাতিয়ার ছেড়ে দিতে বাধ্য হই।
লড়াই শেষ হলে আমরা যারা জীবিত ছিলাম সবাইকে বন্দী করে তাদের সঙ্গে নিয়ে নিল। আমাদের মাল সামান আমাদের সমস্ত উট ও ঘোড়ার পিঠে তুলে দিল। কিছু কিছু দিল আমাদের মাথায়ও। সন্ধ্যা নাগাদ তাদের সাথে পথ চলে আমরা তাদের আস্তানায় এসে পৌঁছলাম।
ক্যাম্পে এসে তারা আমাদেরকে কয়েকটি গুহায় বন্দী করে দিল। লুট করে আনা মাল সামান সব গুছিয়ে রাখলো।
রাতে তারা মদ পান করে ফুর্তি করতে লাগলো। তাদের লিডার বললো, ‘দেখি আজ দামী দামী অলংকার ও কি কি জিনিস এসেছে?’
কয়েকজন গিয়ে আলাদা করে রাখা লুট করা মূল্যবান সামগ্রী এনে দলনেতার সামনে পেশ করলো। তারা সন্তুষ্টচিত্তে ওইসব মাল সামান দেখতে লাগলো। দলনেতা বললো, ‘আর মেয়ে মানুষ কেমন পাওয়া গেছে?’
এবার কয়েকজন গিয়ে আমাদের মেয়েদের ধরে এনে নেতার সামনে হাজির করলো। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। নিয়ে যাও। পরে এদেরকে আমি তোমাদের মধ্যে ভাগ করে দেবো।’
তারা খোলা চত্বরে মদের আসর জমিয়ে উল্লাস করছিল। সেখানে অনেক মশাল জ্বেলে এলাকাটা আলোকিত করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাতে তাদের কোন ভয় ছিল না, কারণ এ আলো দেখার মত কোন লোক অন্তত কয়েক মাইলের মধ্যে নেই এ কথা তারা ভাল করেই জানে।
আমাকে যে গুহায় রাখা হয়েছিল সেখানে আমার সঙ্গী অধিকাংশই ছিল আহত। আমি তাদের বললাম, তোমরা কি চাও আমি পালিয়ে যেতে চেষ্টা করি?