সে উঠে ওজু করলো। কামরার দরজা বন্ধ করে দিল এ জন্য যে, খৃস্টানদের দুনিয়ায় সে মুসলমান নয়, সেও এক খৃস্টান। বৈরুতে সে হাসান ইদরিস নয়, গিলবার্ট জ্যাকব।
ছোট্ট একটি কামরায় সে একাই থাকতো। সেখানে সুন্দর করে সাজানো ছিল হযরত ইসা (আঃ)-এর মুর্তি ও ক্রুশ। তার গলায়ও লটকানো থাকতো ক্রুশের প্রতীক। দেয়ালে লটকানো ছিল হযরত মরিয়মের কাল্পনিক আঁকা ছবি। এসবই সে খুলে খাটের নিচে রেখে দিল। তারপর দরজায় খিল এঁটে কেবলার দিকে মুখ করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল।
সে প্রতিদিনই লুকিয়ে এমনিভাবে নামাজ পড়তো। তবে সব ওয়াক্ত পড়তে পারতো না। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে অনেক সময়ই তাকে নামাজ কাজা করতে হতো।
আজ নামাজে দাঁড়ানোর পর তার হৃদয়তন্ত্রীতে যে আবেগের ঝড় উঠলো অতীতে এমন অবস্থা আর কখনো হয়নি। তার মনে হলো সে মহামহিম আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেই মহান আল্লাহ, যিনি সব পারেন। মানুষের এমন কোন সমস্যা নেই যা তিনি সমাধা করতে পারেন না। তিনিই মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। তিনিই শোনেন দুর্বলের ফরিয়াদ। অসহায় বান্দার আরজু তিনিই মঞ্জুর করেন।
হাসানের দু’চোখ অশ্রুতে ভরে উঠল। তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ইয়াকানা’বুদু ওয়া ইয়াকা নাসতাইন- হে আল্লাহ, আমরা তোমারই ইবাদত করি আর তোমারই সাহায্য চাই।’
শব্দগুলো যখন সে উচ্চারণ করছিল তখন তার মনে হচ্ছিলো, আল্লাহ যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এত কাছে, সন্তানের মাথায় স্নেহের হাত বুলানোর সময় পিতা যেমন কাছে থাকে।
সে নামাজ শেষ করে দোয়ার জন্য হাত উঠালো। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। তার মুখ থেকে নির্গত হতে থাকলো বিগলিত অনুনয় ধ্বনি, হে প্রথম কেবলার খোদা! আজ তোমার নামের তারিফ করার, তোমার প্রিয় রাসূলের শানে দরুদ পড়ার পরিবেশটুকুও বিলীন হয়ে গেছে। খৃস্টানদের ভয়ে তোমার প্রিয় বান্দারা আজ মসজিদুল আকসায় দু’রাকাত নামাজ পড়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত।
তোমার প্রিয় রাসুলের যারা উম্মত তারা আজ আত্মকলহে লিপ্ত। অশ্লীলতার বন্যায় ভেসে যাচ্ছে সময়ের সাহসী সন্তানেরা। ক্ষমতার লোভে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে জাতির নেতৃবৃন্দ আমীর ও শাসকরা।
হে রাব্বুল আলামীন, যে মসজিদ তোমার প্রিয় হাবীবের পদস্পর্শে পাক ও পবিত্র হয়েছিল সেখানে কর্তৃত্ব করছে বিধর্মীরা। সেখানে এখন ক্রুশের কালো ছায়া আসন পেড়ে আছে। যে বনী ইসরাইলীদের অহমিকা তোমার বিধানকেও অস্বীকার করেছিল, সেই জাতি আজ তোমার প্রথম কেবলায় হযরত সোলায়মানের বিরাট মুর্তি বানিয়ে পুজা করছে।
হে আমার আল্লাহ! তুমি তোমার শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ দেখাও। তুমি তোমার কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব দেখাও। তোমার প্রিয় রাসুলের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দাও।’
কাতর কণ্ঠে মোনাজাত করে চলেছে হাসান ইদরিস, ‘হে আল্লাহ, আমাকে তুমি সেই শক্তি দান করো যেন আমি তোমার ও তোমার রাসুলের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পারি। যেন আমি কোরআনের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেখাতে পারি। ইহুদী ও খৃষ্টানদের নাগপাশ থেকে যেন আমি তোমার প্রিয় হাবীবের স্মৃতিমাখা মসজিদুল আকসাকে উদ্ধার করতে পারি।
এই বৈরুতে নাসারাদের যে আধিপত্য বিরাজ করছে আমি যেন তা ভেঙ্গে মিসমার করে দিতে পারি। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এই শক্তি ও সাহস দাও।’
হাসান ইদরিস কাঁদছে আর প্রার্থনা করছে, ‘হে আমার রব, বায়তুল মুকাদ্দাস ও সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মাঝে যে বাঁধা সৃষ্টি হয়ে আছে তা অপসারণ করার শক্তি আমাকে দাও। আমাকে তুমি অন্ধকারে আলোর পথ দেখা। আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে তুমি আমার সহায় হয়ে যাও।
তুমি আমাকে এমন কঠিন পরীক্ষায় ফেলো না যে পরীক্ষায় পাশ করার সাধ্য আমার নেই। আমি তোমার পথে জীবন কোরবানী করতে পারি, কিন্তু হে আল্লাহ, তুমি ওয়াদা করো। যেন আমার কোরবানী বৃথা না যায়।
হে আল্লাহ! তোমার নামের ওপর শহীদ হওয়া সৈনিকদের এতিম সন্তানের কসম! আমাকে তুমি শক্তি, সাহস ও বল দান করো। আমাকে মদদ দাও যেন এই এতিমদের পিতার রক্তের প্রতিটি কণার প্রতিশোধ নিতে পারি।’
ভূমধ্যসাগরের বাতাসের মতই হু করে সময় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই হাসানের। সে কাতর কণ্ঠে তখনো আল্লাহকে বলছে, ‘তোমার রাসুলের উম্মতের সেই মায়েদের কসম, যে সব মেয়েদের সম্ভ্রম তোমার মসজিদুল আকসার মুক্তি ও পবিত্রতার জন্য লুষ্ঠিত হয়েছে। আমাকে সাহস দাও যেন কাফেরদের প্রতিটি কেল্লা মিসমার করে দিতে পারি।
তোমার পথের লড়াকু বীর মুজাহিদ গাজীদের কাতারে আমাকে শামিল করো। হেজাযের বীর বাসিন্দাদের সাহস ও হিম্মত দাও আমায়। আমাদের ভবিষ্যত বংশধররা যেন বলতে পারে, ন্যায়, সত্য ও সততার জন্য আমরা লড়াই করিনি। তোমার দ্বীনের জন্য আমাদের অন্তরে আবেগ ও ভালবাসা ছিল না।
প্রভু হে, আজ খৃস্টানদের বানানো মুর্তিগুলো তোমাকে উপহাস করছে। আমাকে সেই বীরত্ব দান করো যেন আমি পাথরের মূর্তিগুলো পদদলিত ও মিসমার করে প্রাণ খুলে হাসতে পারি।
হে আমার প্রভু! যদি তুমি এটাও করতে না পারো তবে আমার রক্তকে ঠাণ্ডোা ও নিষ্ক্রিয় করে দাও। আমাকে এমন নির্লজ্জ অনুভুতিহীন বানিয়ে দাও যেন বুঝতে না পারি লজ্জা কি জিনিস। আমার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে নাও। আমি আর ইসলামের অপমান এবং মুসলিম মা-বোনদের সম্ভ্রম লুট হওয়া দেখতে চাই না। আমার কানকে তুমি স্তব্ধ করে দাও যেন আমি মজলুম মুসলমানদের ফরিয়াদ শুনতে না পাই।’
হাসানের আওয়াজ আস্তে আস্তে জোরালো হতে লাগলো। এক সময় তার কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে এলো আর্তচিৎকার, ‘হে আল্লাহ, তুমি কোথায়? বলো হে আল্লাহ, আমাকে ভাষা দানকারী খোদা তুমি নিজেই বলো, কোরআন সত্য নাকি ক্রুশ? কুরআন যদি তোমারই কথা হয়ে থাকে তবে সে কোরআনের জন্য আমাকে কবুল করে নাও।’
মোনাজাত তখনো শেষ হয়নি, হাসানের মনে হতে লাগল, বাইরে ভয়াবহ ঝড় বইছে। প্রচণ্ডো শব্দে যেন ছাদ ফেটে যেতে চাচ্ছে। মাটি কাঁপছে। সঙ্গে বিজলী ও বজ্রের কড়কড় শব্দ। যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে হাসানের কামরা। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিজলীর চমক।
হাসান আরো জোরে জোরে বলতে লাগলো, এই বিজলী দিয়ে আমাকে পুড়িয়ে দাও! আকসা মসজিদটাও পুড়িয়ে দাও, গুড়িয়ে দাও। যেন সেখানে কোন মুসাফির না থাকে, মঞ্জিলও না থাকে। বিজলী যেন তারই উপর পড়ে যার স্বামী তোমার নামে শেষ হয়েছে। তোমার নামের উপর যারা এতিম হয়েছে তাদের উপর বিজলী বর্ষণ করো। তোমার রাসুলের উম্মতের উপর বিজলী বর্ষণ করে, যাতে কেউ তোমার কাছে কোন অভিযোগ করতে না পারে।’
ক্লান্ত হাসানের কণ্ঠ কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে এলো। সে বলতে লাগলো, ‘আমাকে ক্ষমা করে দাও আল্লাহ। যদি আমি কোন ভুল আবেদন করে থাকি সংশোধন করে দাও। যে আবেদন আমার করা উচিত সেই আবেদন এনে দাও আমার কণ্ঠে।’
বিজলী আবারও চমকে উঠলো। তারপর শুরু হলো মেঘের গর্জন ও বর্ষণ। হাসানের ওখান থেকে বৈরুতের সাগর তীর বেশী দূরে নয়। এ সময় সমুদ্র সাধারণতঃ নিরবই থাকে। কিন্তু তার মনে হলো সমুদ্র যেন রাগে ফুলে উঠেছে। ঢেউয়ের ভীষণ গর্জন যেন শুনতে পাচ্ছে হাসান।
ভূমধ্যসাগরের ক্রুদ্ধ তরঙ্গমালা যেন তার কামরায় এসে আঘাত হানছে। মেঘের গর্জন, বিজলীর চমক, বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালার অশান্ত দাপাদাপিতে যেন কিয়ামতের প্রলয় শুরু হয়ে গেছে। এক সময় হাসান অনুভব করলো, প্রকৃতিতে নয়, এ প্রলয় শুরু হয়েছে তার অন্তরে।
সে তার ফরিয়াদের ভাষাকে আরো উচ্চকিত করলো। বলতে লাগলো, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার মধ্যে জযবার এমন তুফান দাও যেন আমি কাফেরদের সব চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি। আমার রক্তের স্রোত দিয়ে মসজিদুল আকসার আঙ্গিনা ধুয়ে মুছে পবিত্র করে দাও।
আমি বড়ই লজ্জিত খোদা, তোমার প্রথম কেবলার ভক্ত সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এখানে তার বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আফসোস, আমরা তাকে সতর্ক ও সাহায্য করতে পারিনি। তাকে বলতে পারিনি, বৈরুতে আপনার আগমন বার্তা আগেই পৌঁছে গেছে। তারা আপনাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ব্যাপক রণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। আপনি বৈরুত থেকে দূরে থাকুন। এখানে কাফেররা আপনার জন্য ফাঁদ তৈরী করে রেখেছে।
সুলতানকে এ খবর পৌঁছাতে না পারাটা আমাদের দুর্বলতা, আমাদের অপরাধ। হে আল্লাহ, তুমি শক্তি ও সাহস দাও যাতে সে অপরাধের কাফফারা আদায় করতে পারি। নইলে এই মূর্তি ও ক্রুশ আমার আত্মাকেও অভিশাপ দেবে। এই মূর্তির সামনে তুমি আমাকে লজ্জিত করো না। তুমি শহীদদের আত্মার কাছে আমাকে লজ্জিত করো না। যদি আমার দোয়া কবুল না করো তবে আমাকে হাশরের ময়দানে জীবিত করো না।
হে খোদা! তোমার সামনে তোমার নামে অবিচারের অভিযোগ নিয়ে আমি দাঁড়াতে চাই না। সমস্ত মানুষ ও মাখলুকের সামনে বলতে চাই না, এই খোদা তার প্রিয় রাসুলের সম্মান রক্ষা করেনি। এই খোদা রাসুলের অনুসারীদেরকে অসহায় ছেড়ে দিয়েছিল। তার বান্দারা যখন তার প্রথম কেবলাকে পবিত্র করার জন্য ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন তিনি তাদের সাহায্য করেননি।’
হাসানের মনে হচ্ছিল, বিজলী ও বজ্র এমন ভাবে চমকাচ্ছে ও গর্জন করছে যেন হাসানের কামরার ছাদ, দরজা জানালার পাল্লা জোরে খটখট করছে। ছাদের উপর দিয়ে যেন ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। মুসলধারে বৃষ্টি ও ঝড় বইছে। প্রলয় তুফানে আকাশ পাতাল কাঁপছে।
হাসানের মনে এবার ভয় ঢুকে গেলো। তার এমন আশংকা হতে লাগলো, যেন সে কঠিন এক দুর্যোগের আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে। আবার মনে হলো, সে স্বপ্নের মাঝে ডুবে আছে, স্বপ্নের ঘোরেই আবোল তাবোল বকছে।
সে জীবনে আল্লাহর কাছে এমন অভিযোগের স্বরে আর কোন দিন কথা বলেনি। চুপচাপ নামাজ পড়তো, সংক্ষিপ্তভাবে নামাজ শেষ করে আবার সে হাসান থেকে জ্যাকব হয়ে যেতো।
রাতে হাতেম আলীকে রিপোর্ট করে আসার পর থেকেই আবেগে সে খুব অস্থির ছিল। তার চোখে ঘুমের ভাবও ছিল না। দুশ্চিন্তায় পাগলের মত হয়ে যাচ্ছিল। মোনাজাত শেষ হতেই এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করলো সে। কিভাবে এ সমস্যার সমাধান হবে জানা নেই তার, তবু মনে হলো, সমাধানের কোন না কোন পথ বেরিয়েই আসবে। সে মাথা থেকে দুশ্চিন্তা দূর করে দিল।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বা আলী বিন সুফিয়ান কেউ এখনো জানেন না, ইয়াজউদ্দিনের দূত বিলডনের সাথে কি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অথচ এ তথ্য জানা আইয়ুবীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সম্রাট বিলডনের দরবারে কি ঘটে, এখানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র হয় এসব তথ্য সংগ্রহের জন্যই উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে তাকে এখানে নিয়োগ করা হয়েছে। এ জন্য তাকে নিয়মিত বেতন দেয়া হয়। সেই বেতনের টাকা সে বাড়ীতে তার মা বাবার জন্য পাঠিয়ে দেয়। বেতনের টাকা ছাড়াও বিদেশ বিয়ে গোয়েন্দাগিরী করতে গিয়ে উপরি আয় হয়। যেমন এখানে সম্রাট বিলডনের কোষাগার থেকেও সে বেতন পাচ্ছে। খরচবাদে সব টাকাই সে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়।
বৈরুতে সে ভাল পজিশনেই ছিল। সুখ স্বাচ্ছন্দে দিন কাটছিল তার। কিন্তু সে এক ঈমানদার মানুষ। নিজের দায়িত্বকে সে নামাজ রোজার মতই ফরজ মনে করে।
সে বিশ্বাস করতো, নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে আঞ্জাম না দিলে তার সব আয়ই হারাম কামাই হয়ে যাবে। দায়িত্বে অবহেলাকে সে অপরাধ মনে করতো।
সে বিশ্বাস করতো, দায়িত্বে অবহেলাই একটি জাতির পরাজয়কে অনিবার্য করে তোলে। তাই সে আপন দায়িত্বের ব্যাপারে এতটা অস্থির হয়ে পড়েছিল।
সারারাত নিঘুম কাটানোর ফলে ফজরের নামাজ ও মোনাজাতের পর যখন তার মনে স্বস্তি ফিরে এলো তখন প্রচণ্ডো ঘুম পেল তার। সে জায়নামাজের উপরই ঘুমিয়ে পড়লো।
এভাবে ঘুমিয়ে পড়াটা তার উচিত হয়নি। স্বাভাবিক অবস্থায় সে এমনটি করতোও না। সে আগে জায়নামাজ লুকাতো। তারপর খাটের নিচে রাখা মেরীর মূর্তি, ছবি ও ক্রুশ যথাস্থানে রেখে জ্যাকবের সঠিক রূপ ধারণ করে তবে অন্য কাজে মন দিত।
কিন্তু আজ সারা রাতের দুশ্চিন্তা তাকে এতটাই কাবু করে ফেলেছিল যে, সে এসব গুছানোর কথা চিন্তাও করতে পারল না। নিজের অজান্তেই সে ঘুমের অতলে হারিয়ে গেল।
ঘুমের ঘোরে সে চলে গেল স্বপ্নের জগতে। তার সামনে মসজিদুল আকসা। এই মসজিদ সে একবার দেখেছিল যখন সে বায়তুল মুকাদ্দাসে গোয়েন্দা মিশনে গিয়েছিল।
মসজিদটি ছিল তখন তালাবদ্ধ, বিরান। একদিকের একটি খোলা দরজা নামাজীদের পথ পানে চেয়েছিল। কিন্তু মুসলমানরা দূরের ছোট ছোট মসজিদ বা তাদের নিজ গৃহে নামাজ আদায় করতো।
খৃস্টান ও ইহুদী শিশুরা মসজিদের আঙ্গিনায় খেলা করছে। অসংখ্য ছেলে জুতা পায়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। খৃস্টানদের ভয়ে সেখানকার ভীত সন্ত্রস্ত মুসলমানরা মসজিদুল আকসার ধারেকাছেও যেতো না। হাসানের হৃদয়টা এ দৃশ্য দেখে হাহাকার করে উঠেছিল। হায়! মুসলমানদের প্রথম কেবলার আজ একি অবস্থা! মসজিদুল আকসার পবিত্রতা এভাবে নষ্ট হচ্ছে?
আজ সে বৈরুতে। স্বপ্নের ঘোরে চলে গেছে বায়তুল মুকাদ্দাসে। সেখানে সে দেখতে পাচ্ছে নয়নাভিরাম বায়তুল মুকাদ্দাস। মসজিদের গম্বুজের উপর অসংখ্য কবুতর ও পাখীর ঝাঁক বসে আছে।
যদি একটি কবুতর আকাশে উড়াল দেয় সঙ্গে সঙ্গে কবুতরের ঝাঁক সঙ্গী হয় তার। মসজিদের গম্বুজ ঢেকে যায় কোমল ছায়ায়। এই ঝাঁক মসজিদের আশেপাশে চক্কর দিয়ে আবার এসে গম্বুজে বসে। হাসান ঘুমের ঘোরে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখে এ নয়নাভিরাম দৃশ্য।
মুহূর্তে মিলিয়ে যায় এ দৃশ্য। হাসান দেখতে পায় মসজিদের ভেতর থেকে একদল খৃস্টান ও ইহুদী হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসছে। তাদের সবার কাপড়ে দাউ দাউ আগুন। তারা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে, চিৎকার ও আহাজারী করছে কিন্তু কারো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। আকাশে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ উড়ে বেড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিভিন্ন রংয়ের পাখি হয়ে গেল। তারা উড়ে উড়ে একে একে মসজিদের সবুজ গম্বুজের উপর বসতে লাগলো।
হাসান মসজিদে প্রবেশ করলো। এখন সেখানে কোন খৃষ্টান বা ইহুদীর চিহ্নও নেই। হাসান মসজিদের দেয়ালগুলোর দিকে তাকালো।
দেয়ালগুলো যেন নীলের সামিয়ানা। জানালা পথে চোখ ফেলল বাইরে। কি সুন্দর নীলাকাশ। দিনের আলো নীল।
প্রকৃতির ছায়া নীল। মসজিদের দরজা দিয়ে গলে পড়ছে নীল আলো। সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে তাতে। চারদিকে যেন নীলের উৎসব।
স্বপ্নের মাঝে স্বপ্ন এলো। এই স্বপ্নের মাঝেই হাসানের ঘুম ভেঙে গেল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ওভাবেই পড়ে রইল হাসান। মনে করতে চেষ্টা করলো সে এখন কোথায়। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, সে ফজরের নামাজ শেষে মোনাজাত কছিল। কিন্তু ঘুম তাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল যে, সে জায়নামাজ থেকে উঠারও সময় পায়নি, জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়েছে।’
তার মাথায় তখনো আগুনের গোলা, পাখির উড়াউড়ি আর নীল আলোর ঝলকানি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। চোখ খুললো সে। খুলেই আবার চোখ বন্ধ করে নিল। আবার খুললো। কোথায় নীল আলোর ঝলক, কোথায় আগুন, কোথায় পাখিদের উড়াউড়ি, সামনে শুধু এক নারী, সারা। তার ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে একটুকরো মিষ্টি হাসি।
হাসান বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। আপাদমস্তক চাঁদের মতু উজ্জ্বল সাদা পোষাকে দাঁড়িয়ে আছে সারা। শুধু তার মুখ ও দুটি হাত দেখা যাচ্ছে। তার মুচকি হাসিটি বড় হলো। ঠোটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলো সাদা দাঁত, সে দাঁত এতই উজ্জ্বল যেন মুক্তোর মত ঝকমক করছে।
সারা তার একটি হাত সামনে প্রসারিত করে বললো, ‘আমার হাত ধরো। আর কত ঘুমোবে? এসো, মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করি। মসজিদুল আকসা এখন আমাদের।’
হাসানের কানে তার সঙ্গীতময় কণ্ঠ বাজতে লাগল। সারা বলছে, ‘এখন থেকে এই মসজিদে যে কাফের প্রবেশ করবে তার ওপর আকাশ অগ্নি বর্ষণ করবে। আর যে মুসলমান এ মসজিদের পবিত্রতা ভুলে গেছে তাদের উপরও অগ্নি বর্ষণ করবে। আমি এর আঙ্গিনা ও বারান্দা জমজম পানি দিয়ে ধুয়ে দিয়েছি। আমি মসজিদুল আকসাকে পাক-পবিত্র করে নিয়েছি।’
হাসান আবার চোখ খুললো। আবার বন্ধ করে নিল। কারণ সে এ মধুর স্বপ্ন থেকে বঞ্চিত হতে চাচ্ছিল না। কিন্তু চোখ বন্ধ করায় শুধু অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছিল না এবার। বুঝলো, এবার সে বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে এসেছে।
ছাদের উপর ও আশপাশে তখনো মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির শব্দ অপূর্ব সুর মাধুরী ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেন কুশলী শিল্পীর ঐকতানের বাদন চলছে। সেই সাথে ভেসে আসছে সমুদ্রের অর্কেস্ট্রা। গুরুগম্ভীর শব্দের তুর্যনাদ।
ঝড়বৃষ্টি ও ভূমধ্যসাগরের তোলপাড়ের শব্দ ছাপিয়ে নতুন শব্দ এলো হাসানের কানে। তার মনে হলো কেউ দরজার কড়া নাড়ছে।
দরজার আঘাতটাকে সে তার মনের কল্পনা মনে করলো। তবু সে জায়নামাজ থেকে উঠে দাঁড়ালো। প্রথমে খাটের নিচ থেকে ক্রুশ, মুর্তি ও ছবি উঠিয়ে সব কিছু স্ব-স্ব স্থানে রাখলো। দরজার করাঘাত আরো জোরালো হলো। হাসান জায়নামাজ গুটিয়ে বালিশের নিচে রেখে দরজা খুললো।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সারা। তার মুখে একটু আগে স্বপ্নে দেখা সেই মধুর হাসি। ঝড় বৃষ্টির দরুণ সারা ভিজে চুপসে গেছে। তার কাপড় ও চুল থেকে টপ টপ করে পানি ঝরছে।
‘একি! সারা! তুমি এই ঝড় তুফানের মধ্যে কি জন্য এসেছো?’ হাসান দরজা থেকে সরে গিয়ে তাকে ভেতরে ঢুকতে দিল।
‘আমি তোমার কাছে আসিনি, অন্য একজনের কাছে গিয়েছিলাম। তাকে পেলাম না, সে গভীর ঘুমে ডুবে আছে। সারা রাত মদ পান ও অপকর্ম করে ক্লান্ত। সন্ধ্যায় জাগবে। আমি কিছুক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করে নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম। এই ঝড় তুফান কি সামনে এগুতে দেয়? তখন তোমার কথা মনে পড়লো। দিনের বেলা তোমার কাছে আসতে তো কোন বাঁধা নেই।’
হাসান একটি শুকনো কাপড় সারার হাতে তুলে দিল। সারা তা দিয়ে নিজের মাথা ও শরীর মুছে নিল। তারপর কাপড়টি দিয়ে নিজের চুলগুলো পেঁচিয়ে নিল। হাসান তাকে একটা চাদর এগিয়ে দিয়ে বললো, আমি মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি, তুমি ভেজা কাপড় পাল্টে চাদরটা পরে নাও।’
সারা ভেজা কাপড় বদলাচ্ছিল আর চিন্তা করছিল, জ্যাকব মানুষটা সত্যি খুব ভাল। তার মধ্যে একটা সুন্দর মন আছে। মানুষকে শ্রদ্ধা করার মত উদারতা আছে। আমার এই সুন্দর দেহের প্রতি তার কোন লোভ নেই। যেখানে পুরুষরা এই দেহকে হা করে গিলতে থাকে সেখানে সে কি সুন্দর করে বললো, আমি মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি, তুমি ভেজা কাপড় পাল্টে চাদরটা পরে নাও।’
কাপড় বদলানো হয়ে গেলে সারা বললো, ‘সাহেব, আর উল্টো মুখে বসে থাকার দরকার নেই। এবার সোজা হয়ে বসতে পারেন।’ হাসান মুখ ফিরিয়ে বসলো। সারা দরজা খুলে তার কাপড় চিপে এনে মেলে দিল ঘরে।
‘এখন বলো তুমি কোথায় গিয়েছিলে?’ হাসান জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি পালিয়ে আসার পর বলো কি হয়েছিল? সে মহিলা কি ভেতরে এসেছিল?’
সেই কারণেই তো এদিকে এসেছিলাম। সারা বললো, ‘মহিলা কামরায় প্রবেশ করেই জানতে চাইল ঘরে কে এসেছিল। আমি যতই তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে, ঘরে কেউ আসেনি, কিছুতেই সে তা বিশ্বাস করলো না। সে আমাকে কয়েকটি শর্ত দিয়ে বললো, যদি বাঁচতে চাও তবে আমার শর্ত মেনে নাও। তাহলে আমি আর কোনদিনও জানতে চাইবো না, তোমার ঘরে কে এসেছিল।
আমি তাকে টাকা পয়সা দিতে চাইলাম, কিন্তু সে তা প্রত্যাখ্যান করে বললো, না, টাকা পয়সা কিছুই চাই না আমি, আমি চাই তুমি আমার শর্ত মেনে নাও।’
‘তুমি কি বলেছো আমি তোমার কামরায় গিয়েছিলাম?’
‘না, আমি তা বলিনি। তার শর্তগুলো কি? তুমি কি তার শর্ত মেনে নিয়েছো?”
‘শর্তগুলো এ মুহূর্তে তোমাকে বলতে চাই না। আমি শুধু এ জন্য তার শর্ত মেনে নিলাম, যাতে তুমি নিরাপদ থাকো। আমার ভয় হচ্ছিল, যদি আমি তোমার নাম বলে দেই তবে তুমি কঠিন বিপদে পড়ে যাবে। ভয়াবহ শাস্তি নেমে আসবে তোমার জীবনে।
তুমি হয়তো ভাবতে পারো, আমি কোন পবিত্র মেয়ে নই। তবু তোমাকে বলছি, আমি মুশেলের মেহমান, অথবা অন্য কারো প্রমোদ কামরায় যেতে পছন্দ করি না। আমি অবশ্যই নর্তকী, কিন্তু আমি কারো খেলনা হতে চাই না। আমার নিজেরও তো কিছু পছন্দ ও অপছন্দ আছে, আমি তা নিয়ে বাঁচতে চাই।’
‘কিন্তু শর্তগুলো যে আমাকে জানতেই হবে। তুমি কি বুঝ না, শর্তগুলো না জানা পর্যন্ত আমার হৃদয় কিছুতেই শান্ত হবে না? তুমি কি আমাকে এভাবে কষ্ট দেবে?’
‘শোন জ্যাকব, জীবনে আমি অনেক পাপ করেছি ঠিক; কিন্তু কখনো নষ্ট জীবনে পা দেইনি। বুড়ি আমাকে সেই নষ্ট জীবনে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। সেই মহিলা আমাকে পাপের রাজ্যে হারিয়ে গেলে অঢেল সম্পদের লোভ দেখিয়েছে। বলেছে, গোপন কারবারে রাজি হলে ভাল মূল্য দেবে!
সে আমাকে মূল্যের কাঙালী মনে করেছে। আমি তাকে বলে দিয়েছি, শুধু এক রাত আমি তার ইচ্ছা পূরণ করবো। সে আজ রাতে আমাকে মুশেলের দূতের কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমিও ছাড়বো না মহিলাকে, আমি সরকারকে জানাবো মহিলার গোপন কারবারের খবর।’
‘আর সেও বলে দেবে, রাতে তোমার রুমেও মানুষ যায়।’ হাসান বললো।
‘বলে বলুক!’ সারা বললো, ‘আমি তো এখন শান্তি গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়েই আছি। প্রয়োজনে আমি আত্মহত্যা করবো, তবে তার আগে আমি সেই মহিলার গোপন কারবারের কথা ফাঁস করে দিয়ে যাবো। আমি নর্তকী, তাই বলে বারবনিতা হতে পারবো না।’
‘অামি নিজেই সেই মহিলাকে বলে দেই না কেন, আমি তোমার কামরায় কেন গিয়েছিলাম?’ হাসান বললো, ‘আমি বলবো, তোমার সাথে আমার দৈহিক কোন সম্পর্ক নেই। আমাদের মাঝে যা আছে তা স্রেফ ভালবাসা, শুধুই আত্মার বন্ধন?’
‘যদি এ কথা বলার মতো হতো এবং বললে মহিলা তা বিশ্বাস করতো তবে একথা আমিই বলে দিতে পারতাম।’ সারা বললো, ‘কিন্তু এ কথা সে বিশ্বাস করবে না। বরং এ কথা বলার মানে হবে ঘোড়ার পেছনে নিজেকে বেঁধে অন্যকে ঘোড়া দৌড়ানোর জন্য বলা। তোমার মত এক যুবক রাতের আঁধারে আমার কামরায় যাও আর তাতে যৌবনের তাড়না থাকে না, থাকে শুধু ভালবাসা, এ কথা কেউ মানবে না, কেউ বিশ্বাস করবে না।’
‘আমি কসম কেটে বলবো।’ ‘লাভ হবে না জ্যাকব। মানুষ ভালবাসার আবেগ বোঝে না, তাদের কাছে সবই দৈহিক সম্পর্কের ব্যাপার। তুমি এলবার্টকে তো জানো, ইটালীর লোক। অফিসার হলেও সে সৎ ও কোমল হৃদয়ের মানুষ। সম্রাট বিলডনও তাকে বিশেষভাবে সমীহের চোখে দেখেন।
বিলডনের দরবারে এই একজনই অফিসার আছেন যিনি আমাদেরকে মানুষ মনে করেন। আর সবাই আমাদেরকে মনে করেন খেলনা পুতুল। আমি তার কাছেই যাবো এবং তার কাছে আমার সম্ভ্রম বাঁচানোর আবেদন করবো।
যদি আমার এ চেষ্টা ব্যর্থ হয় তবে আমি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবো। যদি সাগর আমার লাশ ভাসিয়ে কুলে নিয়ে আসে তবে হয়তো দেখতে পাবে আমার লাশ। নতুবা লাশও দেখতে পাবে না, শুধু ভূমধ্যসাগরের মাছ যখন খাবে তখন আমার দেহের গন্ধ পাবে।’
‘সারা!’ হাসান বললে, ‘তুমি খৃস্টান নও। তোমার সাথে যেসব মেয়েরা থাকে তাদের একজনও যৌবনের আমোদ ফুর্তিকে অস্বীকার করে না।
তুমি আজ পর্যন্ত আমার সঙ্গে যে সব কথা বলেছে তাতে আমার মনে এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে গেড়ে বসেছে যে, তোমার শিরায় মুসলমানের রক্ত প্রবাহিত। কোন দুর্বিপাকে হয়তো তুমি খৃস্টানদের খপ্পরে পড়ে গেছে। পরে সময়ের চক্রে ঘুরতে ঘুরতে এই পাপের চোরাবালিতে এসে পড়েছে। বলো, আমি কি মিথ্যা বলছি?’
সারা তার দিকে গভীরভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো, ‘শোন জ্যাকব।’
‘আমি জ্যাকব নই সারা!’ হাসান বললো, ‘আমার নাম হাসান ইদরিস! আর দেশ সিরিয়া! এখানে আমার নাম গিলবার্ট জ্যাকব।’
‘গোয়েন্দাগিরী করো?’
অন্য কোন কারণও হতে পারে। হাসান বললো, “শুধু গোয়েন্দাগিরীই কারণ নয়। যেভাবে আমরা দুজন একে অপরের মনের সাথে একাত্ম হয়ে গেছি তাতেই প্রমাণ হয়, আমরা দু’জনই মুসলমানের সন্তান।’
সে বালিশের নিচ থেকে জায়নামাজ বের করলো এবং দেয়ালের গায়ে সাঁটানো একটি ছবি সরিয়ে সেখানকার একটা পাথর নামালো। তারপর ভেতরে হাত ঢুকিয়ে সেখান থেকে বের করে আনলো একটি ছোট্ট কোরআন। সারাকে দেখিয়ে বললো, ‘এগুলো ছাড়া আমি থাকতে পারি না। এই মুর্তি, ছবি ও ক্রুশ চিহ্ন এ সবই রাখা হয়েছে কেবল কৌশলগত কারণে।’
‘আমি যদি কাউকে বলে দেই যে, তুমি খৃস্টন নও, তুমি মুসলমান তখন কি করবে?’ সারা হেসে বললো, ‘তুমি মোটেও গোয়েন্দা নও। গোয়েন্দা কখনো কারো কাছে এভাবে নিজেকে প্রকাশ করে না।’
‘হ্যাঁ, বলে দেখতে পারো।’ হাসান বললো, ‘আমি তোমার চোখের সামনেই এই ঝড় ও তুফানের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাবো। সত্যি, গোয়েন্দারা কখনো আমার মত নিজেই নিজেকে। এমনভাবে প্রকাশ করে না। প্রকাশ হয়ে গেলেও সে এতো সহজে ধরা দেয় না, যেমন তুমি পেয়েছো। কিন্তু সারা! আমার বিশ্বাস তুমি কাউকে বলবে না।’
হাসান সামনে এগিয়ে সারার চোখে চোখ রেখে ধীর অথচ আকর্ষণীয় কণ্ঠে বললো, ‘আমি জানি তুমি কখনও বলবে না, আমি জ্যাকব নই, আমি হাসান। তুমি বলতে চাইলেও তোমার মুখ এ কথা প্রকাশ করতে দেবে না। কারণ তোমার শিরায় রয়েছে রাসুল প্রেমীর রক্ত। এ রক্ত কখনো তার ফোটাকে ছলনা করতে পারে না।’
হাসানের চোখ যেন সম্মোহিত করে রেখেছে সারাকে। সে অনুভব করলো, হাসানের চোখে আটকে আছে তার চোখ। হাসান তার দিকে তাকিয়েই বললো, “তুমি নাচের জন্য জন্ম গ্রহণ করোনি, তুমি জন্ম গ্রহণ করেছে বাইতুল মুকাদ্দাসকে কাফেরদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য। আল্লাহ আমাকে স্বপ্নে এ সুসংবাদ দিয়েছেন। পারলে এখন বলো তুমি মুসলমান নও। আমি জানি তুমি তা বলতে পারবে না।’