মেয়েদের সরদার সেই মহিলা আজ এতই খুশী যে, তার খুশী যেন আর ধরে না। সে আজ এক বড় গ্রাহক পেয়েছে। আর যে মেয়েকে এতদিন বশ মানানো যায়নি আজ তাকে বশ মানানো গেছে। সে মনে ফুর্তি নিয়েই এক সময় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেলো। সে জানতো, সকাল হলেই সারা আসবে। তার সাথে আসবে দামী উপহার আর মূল্য।
বাপ মেয়ের কান্নাকাটিতে কেটে গেল রাত। ভোর হলো। সারা পিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বুড়ির কাছে যাওয়ার পরিবর্তে ছুটে গেল হাসান ইদরিসের কাছে।
হাসান আজও সারা রাত ঘুমোতে পারেনি দুশ্চিন্তায়। ফজর পড়ে সারার জন্য অপেক্ষা করছিল। সারা তার কামরায় ঢুকলো। মুখে বিষাদ নয় আনন্দের ছটা। হাসান বললো, ‘তোমার কোন ক্ষতি হয়নি তো? খবর কিছু সংগ্রহ করতে পেরেছো?’
‘না, আমার কোন বিপদ হয়নি। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে। এই দূত আর কেউ নয়, আমার জন্মদাতা পিতা।’
হাসানের মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। বললো, ‘বলো কি!’
‘হ্যাঁ, হাসান। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! কন্যার গ্রাহক ছিল আপন পিতা।’ সারার কণ্ঠে বিষন্নতা।
এরপর সে হাসানকে শোনালো তার জীবন কাহিনী। কেমন করে বাবা তাদের বাড়ীটাকে পাপের আড্ডাখানা বানিয়ে রেখেছিল। কেমন করে সেই পাপের ভক্ত অনুরাগী হয়ে এক খৃষ্টানের সাথে বাড়ী থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। তারপর কেমন করে এখন পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে সব খুলে বললো তাকে।
এরপর সারা বললো, ‘কাল রাতে আমাকে তাঁর কামরায় দেখে মনে হয় আব্বার হুশ ফিরে এসেছে। আমি তার অনুশোচনার কান্না দেখেছি। আব্বা এখন সুলতান আইয়ুবীর কাছে যেতেও প্রস্তুত। এবার বলো এখন কি করা যায়।’
হাসান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তার মাথা নিচের দিকে। একটু পর মুখ তুলে বললো, ‘কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পৃথিবীটা কেমন উলট পালট মনে হচ্ছে। আমি তোমাকে বলেছিলাম, তুমি এক পবিত্র উদ্দেশ্য নিয়ে যাচ্ছো, আমি আশা করি, আল্লাহ তোমার ইজ্জতের হেফাজত করবেন। আল্লাহ আমার আশা পূরণ করে দিয়েছেন।
এখন আমি তোমার বাবার সাথে দেখা করবো। তার সাথে আলাপ করে বুঝতে চেষ্টা করবো, সত্যি তার মধ্যে কোন পরিবর্তন এসেছে নাকি মেয়েকে এক অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখে আবেগের বশে তিনি এ কথা বলেছেন। যদি সত্যি তিনি মন পরিবর্তন করে থাকেন তবে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আমিই তাকে সব বলে দেবো।’
সেদিনই হাসান সারার বাবার সাথে দেখা করলো। লজ্জা ও অনুতাপে লোকটি একেবারে ম্রিয়মান হয়ে আছে। লজ্জায় কথাও বলতে পারছিল না। হাসান বললো, ‘আপনি সহজ হন। পাপের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া অবশ্যই দরকার। তার চেয়েও বেশী দরকার তওবা করে সেই পাপের কাফফারা আদায় করা।’
‘আমি এখন সেই কাফফারাই আদায় করতে চাই। তুমি আমাকে পথ দেখাও।’
তারপর তাদের মধ্যে অনেক গোপন আলাপ আলোচনা হলো। হাসান তাকে সেখান থেকে বের হওয়ার উপায় বাতলে দিল। বললো, ‘অস্থির হওয়ার দরকার নেই। সহজ স্বাভাবিক থাকুন। চেহারার মালিন্য দূর করুন আর আমি যেভাবে বলেছি সেভাবে কাজ করে যান। ইনশাআল্লাহ আমরা সফল হবো।’
তার সাথে কথা শেষ করে সে সারার সাথে দেখা করলো। তাকে বললো সমস্ত পরিকল্পনা। বললো, ‘তুমি প্রস্তুতি নিয়ে সময় মত নির্দিষ্ট জায়গায় হাজির হয়ে যেয়ো।’
সেদিনই বিকেল বেলা। বৈরুতের জনবহুল এলাকার বাইরে এক নিরাপদ স্থানে মিলিত হলো হাসান ও সায়েরা। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তাই নিয়ে কথা বলতে লাগলো ওরা।
সায়েরার বাবা তার খাদেমদের বললো, ‘বিকেলে ঘরে বসে থাকলে অলস হয়ে যাবো। একটা ঘোড়া দাও, একটু ব্যায়ামও হোক, ভ্রমণও হোক।’
খাদেম শাহী আস্তাবল থেকে একটি তাজাদম ঘোড়া এনে দিল তাকে। সে তার সাথী দূতকে বললো, ‘তুমি আরাম করো, আমি একটু ঘুরে আসি। সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসবো।’
অশ্বপৃষ্ঠে আরোহন করে রাস্তায় নেমে এলেন তিনি। ঘোড়া চালিয়ে চলে এলেন শহরের বাইরে। হাসানের নির্দেশ মত নিরাপদ জায়গায় এসে পেয়ে গেলেন হাসানকে। দেখলেন সেখানে তার কন্যাও হাজির।
হাসান বললো, ’সায়েরা, তুমি তোমার পিতার পেছনে ঘোড়ায় চড়ে বসো।’
সায়েরা দেরী না করে পিতার পেছনে ঘোড়ায় চেপে বসলো। ওরা আর সেখানে অপেক্ষা করলো না, সবাই নাসিবার দিকে যাত্রা শুরু করলো।
খুব সাবধানতার সাথে পথ চলছিল ওরা। ঘোড়া চালাচ্ছিল স্বাভাবিক গতিতে, যেন তাদের গতি দেখে কেউ কোন রকম সন্দেহ না করে।
অনেক দূর চলে এলো তারা। পার হয়ে এলো বৈরুতের নগর সীমানা। সূর্য ডুবে গেছে। সামনে মরুময় প্রান্তর। তারই মাঝে কোথাও কোথাও ছোটখাট বস্তি ও জনপদ। এবার তারা নির্ভয়ে তীব্র গতিতে অশ্ব ছুটিয়ে দিল।
ওদের যাত্রা পথ ছিল খুব দীর্ঘ। একদিন একরাত লাগলো ওদের গন্তব্যে পৌঁছতে।
বৈরুতের গোয়েন্দা বিভাগের উপর সম্রাট বিলডন। আক্রোশে ফেটে পড়লেন। একদিকে মুশেলের এক দূত নিখোঁজ হয়ে গেছে, সেই সাথে নিখোঁজ সম্রাটের সবচেয়ে প্রিয় শাহী নর্তকী আর গিলবার্ট জ্যাকব নামের এক রক্ষী।
সম্রাট তাদের তিনজনকে খুঁজে বের করার হুকুম জারি করেছেন। কিন্তু এই তিনজনের কারোরই কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েদের তত্ত্বাবধায়ক মহিলা সরদারের মুখ একেবারেই বন্ধ। সে কাউকে বলতে ভয় পাচ্ছে যে, সে নিখোঁজ দূতের কামরায় সারাকে পাঠিয়েছিল। খৃস্টান গোয়েন্দা বিভাগ বৈরুত চষে ফেললো ওদের খোঁজে। কিন্তু কোথাও তাদের নাম নিশানাও নেই।
বৈরুতের মাত্র একজন জানতো তারা কোথায় গেছে। সে লোকের নাম হাতেম আলী। কিন্তু হাতেম এক অখ্যাত ব্যক্তি, যার কাজ ঘোড়ার পায়ে নাল লাগানো। যারা ঘোড়ার পায়ে নাল লাগায় তারাই শুধু তাকে চিনে।
এমন কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই গরীব লোকটি, যে ঘোড়ার পায়ে নাল লাগায় সে বৈরুতে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হতে পারে। ফলে কেউ তাকে সন্দেহের তালিকায়ও নিল না। সম্রাট বিলডনের গোয়েন্দা বাহিনী বৈরুত তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাই তাদের কোন হদিস বের করতে পারলো না।
হাসান ইদরিস, সায়েরা ও সায়েরার বাবা সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। সুলতান আইয়ুবী অভ্যাস অনুয়ায়ী তাঁবুর মধ্যে পায়চারী করছিলেন। সারার বাবা সুলতানকে খুলে বললেন সম্রাট বিলডনের সাথে তাদের কি চুক্তি হয়েছে এবং সম্রাট বিলডন ও ইয়াজউদ্দিন কি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সুলতান সঙ্গে সঙ্গে তার সেনাপতিদের ডাকলেন। তারপর যুদ্ধের নকশা মেলে ওদের বলতে লাগলেন, খৃস্টানদের পরিকল্পনা কি এবং এখন এর বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নিতে হবে।
এই সংবাদ সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মধ্যে কোন বিস্ময় সৃষ্টি করলো না যে, হলব ও মুশেলের শাসক ইমামউদ্দিন ও ইয়াজউদ্দিন গোপনে খৃস্টানদের সাথে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে ও জোটবদ্ধ হয়েছে। এটা তো সে যুগের প্রথা হয়ে গিয়েছিল। রাজনীতিতে প্রতারণা ও মিথ্যাচার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো। ছোট বড় মুসলমান আমীর ও শাসকরা খৃস্টানদের সাথে গোপনে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতো। তাদের সাথে গোপন আঁতাত করে রাজনৈতিক জোট গঠন করতো।
তাদের এই প্রচেষ্টার কারণ ছিল, সুলতান আইয়ুবী সকল মুসলিম শাসকদের ঐক্যবদ্ধ করে এক জাতিতে পরিণত করতে চাচ্ছিলেন।
এতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমীররা তাদের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হবে বলে ভয় পাচ্ছিল। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পৃথক সুলতান বা শাসক হয়ে থাকতেই বেশী আগ্রহী ছিল। তারা মনে করতো খৃস্টানদের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধন থাকলে তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে এবং সুলতান আইয়ুবী মুসলিম শক্তির যে ঐক্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
এই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের মধ্যে হলব ও মুশেল ছিল তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী। হলবের প্রধান ইমামউদ্দিন ও মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিনের রাজ্য ছিল বিস্তৃত, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ছিল জোরদার। এসব কারণে তাদের সামরিক শক্তির গুরুত্ব ছিল।
খৃষ্টানরা খুব চেষ্টায় ছিল যে, মুসলমানদের এ দুটি রাজ্য যেন তাদের কব্জায় থাকে। তারা এ দুটি রাজ্য দখল না করে তাদের তাবেদার হিসাবে পেতে চেয়েছিল। তারা চেষ্টা করছিল, যেন এরা সুলতান আইয়ুবীর কব্জায় ও অধিকারে চলে না যায়।
এ দুটি রাজ্য সুলতান আইয়ুবীর কব্জায় চলে গেলে তিনি রসদপত্র আমদানী ও সৈন্য বৃদ্ধির বিরাট সুযোগ পেয়ে যাবেন। এতে তিনি এমন শক্তি সঞ্চয় করে ফেলতে পারবেন যাতে সহজেই বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের উপর সামরিক অভিযান চালানো যায়।
‘কাবার প্রভুর কসম, আমি হলব ও মুশেলের উপর আধিপত্য করতে চাই না। সুলতান আইয়ুবী বহুবার এ কথা বলেছেন। আমি কোন মুসলমান রাজ্যের মধ্য দিয়ে সৈন্য অভিযান চালাতে চাই না। আমার অভিপ্রায় শুধু এটুকুই, এই মুসলমান আমীররা খৃস্টানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাক এবং বাগদাদের খেলাফতের অধীনস্ত হয়ে থাক। ইসলামী খেলাফতের অধীন থাকার হুকুম কোরআনই দিয়েছে। আমি তাদের অধীনস্ত করবো না। আমি খলিফা নই। আমি তো নিজেই খলিফার অনুসারী ও তাবেদার।‘
তিনি বললেন, ‘কিন্তু আমার এ চাওয়াটুকু কেন পূরণ হয় না? কারণ খেলাফতের অধীনে এলে এসব আমীরদের একটা ভয় থেকেই যাবে, খেলাফত কখনোই তাদের অবৈধ আমোদ ফুর্তি ও অপকর্ম অনুমোদন করবে না। আর খৃস্টানদের উপহার, অর্থ, নারী ও মদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। যে শাসক দুনিয়ার মিথ্যা চমক, বাহাদুরী ও আমোদ ফুর্তিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, ইসলাম কখনোই তাদের এ কাজকে অনুমোদন করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে এমন সাম্রাজ্যের কোন মূল্য নেই।’
১১৮৩ সালের প্রথম দিকে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী নাসিবাতে সেনা ছাউনি করেছিলেন। এখান থেকেই বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু তিনি মুসলমান শাসকদের সহযোগিতার সম্ভাবনা মোটেই দেখতে পাচ্ছিলেন না।
তিনি বুঝতে পারছিলেন, হলব ও মুশেলের শাসকরা গোপনে ষড়যন্ত্র করছে ও খৃস্টানদের সাথে আঁতাত করছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য তার কাছে ছিল না। বৈরুতে নিয়োজিত তার গোয়েন্দা হাসান ইদরিসের আগমন তার সন্দেহকেই বাস্তবে প্রমাণ করলো।
সুলতান তার ওপর এ জন্য খুশী যে, এই গোয়েন্দা একটা বিরাট কাজ করেছে। সে ইয়াজউদ্দিনের একজন সামরিক উপদেষ্টা ও তার কন্যা, যে বাড়ী থেকে পালিয়ে গিয়ে বৈরুতে খৃস্টানদের নর্তকী হয়েছিল, তাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
ইয়াজউদ্দিনের যে দূত খৃস্টানদের কাছে সাহায্য নিতে বৈরুত গিয়েছিল তার নাম এহতেশাম উদ্দিন। এক কয়েদীর অনুভূতি নিয়েই তিনি সুলতান আইয়ুবীর দরবারে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাকে সসম্মানে তার সেনাপতিদের পাশেই বসতে দিলেন।
এহতেশাম উদ্দিনকে সকল সেনাপতিই ভাল মত চিনতেন। সেনাপতিদের কেউ তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখছিল আবার কারো মুখে ছিল হাসির চিহ্ন। কারণ তারা তাকে একজন বন্দী হিসাবেই মনে করছিল।
সুলতান আইয়ুবী সেনাপতিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘এতক্ষণ আমি তোমাদের কাছে যে পরিকল্পনা পেশ করলাম এবার সে সম্পর্কে তোমাদের অভিমত শুনবো। তবে তার আগে তোমরা হাসান ইদরিসের রিপোর্ট শুনে নাও।’
হাসান ইদরিস সেনাপতিদের সামনে আবার তার রিপোর্ট পেশ করলো। হাসান ইদরিসের কথা শেষ হলে সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি আশা করি, আমার বন্ধু এহতেশাম উদ্দিন নিজেই সমস্ত কথা খুলে বলবেন আপনাদের সামনে। তিনি ইয়াজউদ্দিন ও ইমামউদ্দিনের দূত হিসাবে সম্রাট বিলডনের দরবারে গিয়েছিলেন। সেখানে কি চুক্তি হয়েছে এবং ইয়াজউদ্দিন ও ইমামউদ্দিনের নিয়তটা কি তোমরা তার বক্তব্য থেকে জানতে পারবে।’
‘সম্মানিত সুলতান!’ এক সেনাপতি বললো, ‘আমি আশা করি তার আগে আপনি আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেবেন।’
‘কি বলতে চাও?’
‘এক গাদ্দার ও বন্দীকে আপনি বন্ধু বলছেন এবং যে সম্মান দিচ্ছেন তার কারণ আমাদের বোধগম্য নয়। আর তার রিপোর্ট কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য তাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে।’
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি এহতেশাম উদ্দিনের উপর কোন দোষারোপ করছি না, যদিও তিনি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য খৃস্টানদের কাছে সামরিক সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন। মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন তাকে এ কাজে পাঠিয়েছিল, দোষ করলে সে করেছে, এহতেশাম উদ্দিন তো তার চাকরী করে মাত্র।’
‘কিন্তু সুলতান।’ বললো সেই সেনাপতি, ‘এহতেশাম উদ্দিন ইয়াজউদ্দিনের শাসন বিভাগের কোন সাধারণ অফিসার নন। ইনি তার সামরিক উপদেষ্টা ও সেনাপতি। তার তো ইয়াজউদ্দিনকে পরামর্শ দেয়া উচিত ছিল, যাতে তিনি খৃষ্টানদের কাছ থেকে সাহায্য না নেন?’
‘আমাকে আদেশ করা হয়েছিল।’ এহতেশাম উদ্দিন বললেন, ’যদি আমি তার আদেশ অমান্য করতাম, তবে আমাকে সে জল্লাদের হাতে সমর্পন করে দিতো।’
অন্য এক সেনাপতি বললো, ‘আপনি নিজের মৃত্যুর ভয়ে এক গাদ্দার শাসকের এমন আদেশ পালন করেছেন, যাতে আপনার জাতি ও ধর্মের মৃত্যুর পথ পরিষ্কার হয়। নিজের জীবনকে আপনি এতই মূল্যবান মনে করেন?
আমরা আমাদের বাড়ী থেকে দূরে, নিজের সন্তান-পরিজন সম্পর্কে বেখবর হয়ে কিসের জন্য এখানে পড়ে আছি? আমরা আমাদের সারাটি জীবন কিসের জন্য এই পাহাড় ও মরুভূমিতে কাটিয়ে দিলাম? কিসের জন্য এত কষ্ট করছি?
রাতে পাথরের ওপর শয়ন করি, আর আপনি হলরের মহলে শাহজাদার মত জীবন কাটান। আপনি মদ পান করে নেশায় বিভোর হন। ইহুদী ও খৃস্টান নর্তকী নিয়ে মনোরঞ্জন করেন। এমনকি মুসলমান মেয়েরাও রেহাই পায় না অপনার ছোবল থেকে।
আপনি নরম গদীতে বসেন আর মখমলের পালংকে শয়ন করেন। অথচ আপনি আমি আমরা সবাই মুসলমান। ঈমানের দাবী আদায়ের জন্য আমরা মরতে এসেছি।’
অন্য এক সেনাপতি বললো, ‘আমাদের বন্ধুদের লাশগুলো আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। হয়তো সে লাশ মাটিতে মিশে গেছে। তাদের হাড়গুলো যখন তোমার সামনে পড়ে তুমি পশুর হাড় ভেবে তা মাড়িয়ে যাও। শহীদের রক্তের কোন মূল্য নেই তোমার কাছে। ভাইকে তুমি শত্রু আর শত্রুকে বন্ধু বানিয়ে রেখেছে। আমরা যদি মরতে এসে থাকি তবে তোমাদের বাঁচার কি অধিকার আছে।’
‘চুপ করো।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এহতেশাম উদ্দিন আমার কাছে এসে তার ভুল ও গোনাহের কাফফারা আদায় করেছে। তাকে কেউ গ্রেফতার করে বন্দী হিসাবে এখানে আনেনি, তিনি স্বেচ্ছায় আমার কাছে এসেছেন। যদি তাকে তিরস্কার করার প্রয়োজন হতো তবে আমিই তাকে তিরস্কার করতাম।’
‘আজিমুশ্বান সুলতান!’ অন্য এক সেনাপতি বললো।
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আল্লাহর ওয়াতে আমাকে শুধু সুলতান বলো। আমাকে শান শওকত থেকে দূরে থাকতে দাও। আমাকে বাদশাহ বানানোর চেষ্টা করো না। আমি সৈনিক, আমাকে সৈনিকই থাকতে দাও। এখন বলো তুমি কি বলতে চাও?’
‘আমি এহতেশাম উদ্দিন ও আমার অস্ত্রধারী ভাই, যারা এখানে উপস্থিত আছেন তাদের সবাইকে বলতে চাই, সেনাপতি ও সৈনিকরা জাতির ইজ্জত ও সম্মানের রক্ষক। সরকারের আদেশ তারা পালন করবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য।
যদি সরকার কোন ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যে সিদ্ধান্ত দেশ ও জাতির ক্ষতি বয়ে আনতে পারে, সে ব্যাপারে সরকারকে অবহিত ও সজাগ করা উচিত তাদের। যদি সৈনিকরা কোন ব্যক্তির গোলাম হয়ে যায়, তাকে খুশী করার জন্য তার ভুল আদেশও মেনে নেয়, তাতে জাতির অমঙ্গল করা হয়।
আমি বলতে চাই, জাতির সম্মানের রক্ষক আমরা। দেশের মালিক কোন বাদশাহ না সুলতান হতে পারে না। মালিক হলো দেশের জনগণ। এখন আমরা এমন একটা সময় অতিবাহিত করছি, যাকে বলা যায় সামরিক শক্তির যুগ। আর মুসলমানদের জন্য এটা জিহাদের যুগ।
যদি খলিফা বা সুলতান দেশ ও জাতিকে সঠিক পথে না চালায় তবে আল্লাহর সৈনিক তাকে নিজেদের এমন শত্রু মনে করবে, যেমন ইহুদী, খৃস্টান ও মুশরেকদের মনে করে। যখন আল্লাহর সৈনিকরা এহতেশাম উদ্দিনের মত সুলতান ও বাদশাহ হওয়ার নেশায় পড়ে যাবে তখন দ্বীনের লাশের উপর গীর্জা ও মন্দিরের ঘন্টা বাজতে থাকবে।’ থামলো সেনাপতি।
‘যুগের বিবর্তনে ইসলামের অবিনাশী চেতনার বিনাশ হয় না।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যতদিন পর্যন্ত ইসলাম জীবিত থাকবে ততদিন কাফেররা ইসলামের ঘোর শত্রু হয়েই থাকবে। আজ আমাদের সেনাপতিদের মনে যে শক্তি ও চেতনা বিরাজ করছে যতদিন তা টিকে থাকবে ততদিন ইসলামের কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু যদি তাদের মনে ক্ষমতার মোহ দানা বেঁধে উঠে তবে যে কোন সময় তারা ইসলাম নিয়েই ডুববে।
কিন্তু আমার বিশ্বাস, ইসলাম জীবিত থাকবে। জীবিত থাকবে মানুষের অফুরন্ত সুখ, শান্তি ও কল্যাণের উৎস হয়ে। কারণ এ বিধান আল্লাহর দেয়া। মানুষ কখনোই নিজের কল্যাণের জন্য এর চাইতে উৎকৃষ্ট বিধান বানাতে পারবে না। এ বিধানের যারা অনুসারী হবে কোন ভয়-ভীতি আর লোভ লালসাই তাদেরকে কাবু করতে পারবে না। নিজের কল্যাণ নয়, তারা চিন্তা করবে সমগ্র মানবতার কল্যাণ। সভ্যতার কল্যাণ। কোন সংকীর্ণতা তাদের স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু এই চেতনা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
আমরা এখন কি দেখছি? বাদশাহ হওয়ার জন্য ক্ষমতাধরদের মনে জন্ম হয়েছে লোভ। লোভ আর ভয় সহোদর। তাই বাঘ এখন ছাগল ভেড়া দেখেও ভয় পায়। মুসলমান কাফেরের আঙ্গুলের ইশারায় নাচে। এমনটি অব্যাহত থাকলে একদিন দেখা যাবে, আল্লাহর সৈনিকরা দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু তাদের হাতে অস্ত্র নেই। যদি তলোয়ার থাকেও তা কোন খৃস্টানের দেয়া অস্ত্র, সে অস্ত্র ব্যবহারের জন্য আবার তাকে খৃষ্টানদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।’
সুলতান আইয়ুবী বলতে বলতে চুপ হয়ে গেলেন। তিনি দৃষ্টি ঘুরিয়ে চারদিকে দেখলেন। উপস্থিত সেনাপতিদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, ‘আমিও কথায় আটকে গিয়েছি হে। আমার বন্ধুগণ। আমাদের এখন কাজ করতে হবে। এ অবস্থার জন্য কে দোষী আর কে নির্দোষ সে বিতর্কে আটকে গেলে আমরা শুধু কথাই বলে যাবো। কার গোনাহ কতখানি আর কে সত্য কে মিথ্যা সেই আলোচনা করে সময় অপচয় করার মত অবস্থা এটা নয়।
এহতেশামুদ্দিনের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। তিনি জানেন হলব ও মুশেলের সরকারের সাথে খৃস্টানদের কি চুক্তি হয়েছে। আপনারা তার কাছ থেকে সেই তথ্য শুনুন এবং নির্ধারণ করুন এখন আমাদের করণীয় কি? শত্রুদের সাথে কোন ময়দানে আমরা কেমন করে যুদ্ধ করবে।’
এহতেশাম উদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন এবং উপস্থিত সবার দিকে একবার নজর বুলিয়ে বললেন, ‘হে আমার বন্ধুগণ! আমি তোমাদের সবার চোখে অবজ্ঞা ও অভিশাপ দেখতে পাচ্ছি।
তোমাদের দৃষ্টিতে এটাই সঠিক যে, তোমরা আমাকে মৃত্যুদণ্ডো দিতে চাও। কিন্তু আমি তোমাদের কাছে একটি শিক্ষণীয় বিষয়। এটা সত্য যে, আমি মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিনের সন্তুষ্টি বিধানে আমার ঈমান বিক্রি করেছিলাম।
তার দূত হয়ে আমি বৈরুত গিয়েছিলাম এবং খৃষ্টান সম্রাটের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, মহান আল্লাহ আমার ওপর অপরিসীম দয়া ও রহমত করেছেন। তিনি অলৌকিক ক্ষমতাবলে আমার জ্ঞান চক্ষু খুলে দিয়ে আমার ঈমানকে রক্ষা করেছেন। যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পড়ে আমার বিবেক বুদ্ধি সত্যের পথে ফিরে এসেছে তেমন পরিস্থিতিতে পড়লে, তোমরা কেউ বাঁচতে কিনা আমার সন্দেহ আছে।
বন্ধুরা, তোমাদের মধ্যে অনেক সেনাপতি ও অফিসার কি গাদ্দারী করেনি? বেঈমানীর অপরাধে অনেকে কি ধরা পড়েনি। তাদের অনেকের অবস্থা এমন ছিল, যাদের উপর সুলতানের ছিল অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস। যাদের ওপর তিনি ভরসা করতেন তেমন বিশ্বাসভাজনরাই তাঁর সাথে বেঈমানী ও গাদ্দারী করেছে।
তাই আমি তোমাদের বলতে চাই, মানুষের প্রকৃতি ও স্বভাবে এমন এক দুর্বলতা রয়েছে যা মানুষকে বিলাস ও আরামের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আর যেখানে রাতদিন পাপের পথ উন্মুক্ত থাকে সেখানে একজন দরবেশ লোকও আমোদ ফুর্তিতে গা ভাসিয়ে দিয়ে পাপের কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে।
গাদ্দার নির্মূলের জন্য আগে পাপের রাস্তাগুলো বন্ধ করা দরকার। যেখানে এখন প্রতিটি শাসক ও আমীর আরো ক্ষমতাশালী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে আর অভিজাত শ্রেণীর লোক, সরকারী বড় কর্মচারী, সেনাবাহিনীর অফিসার শাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে সেখানে গাদ্দার তৈরীর কার্যক্রম চলতেই থাকবে।
আমাকে যদি তোমরা এতই পাপিষ্ঠ মনে করো তবে আমার এই তলোয়ার নাও, আমার মাথাটা দেহচ্যুত করো। আমি বিশ্বাস করি, তাতে আমার পাপ কিছুটা হলেও লাঘব হবে। আর যদি তওবার সুযোগ দাও তবে ইসলামের গৌরব বৃদ্ধির জন্য, ইসলামের খেদমতের জন্য, বিশেষ করে তোমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার অঙ্গীকার করছি আমি।’
এহতেশাম উদ্দিন বললেন, ‘খৃস্টানরা সম্ভবত তোমাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে কখনও আসবে না। তারা আমাদের নিজের অস্ত্র দিয়েই আমাদেরকে শেষ করার ব্যবস্থা নিচ্ছে। তাদের এখন সৈন্য ক্ষয় করার কোন প্রয়োজন নেই। তারা মুসলমানদেরকে মারার জন্য মুসলমানদেরকেই সাহায্য ও উস্কানী দিয়ে যাচ্ছে।
এখানে ছোট বড় রাজ্য, যেগুলো বাগদাদের খেলাফতের অধীনে আছে বলে তোমরা জানো তাদের সকল রাজ্য ও প্রদেশের শাসকরা গোপনে খৃস্টানদের গোলাম হয়ে গেছে এবং নিজেদের স্বাধীন বলে মনে করছে।
নিজেদের কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন শুধু সেই থাকতে পারে যে শক্রর সাথে হাত মিলায় এবং তার সাহায্য সহযোগিতা গ্রহণ করে। এভাবেই ভাইকে শত্রু আর শত্রুকে ভাই বানিয়ে নেয় তারা।
কোন দেশে গৃহযুদ্ধ লাগলে সেখানে শুধু একটি দলই সঠিক ও দেশপ্রেমিক হয়। অন্যান্য দলগুলো শক্রদের বন্ধু হয়। শক্ত কখনো খুশী মনে ও সরল অন্তকরণে সাহায্য দান করে না বরং তারা নিজেদের স্বার্থে ও তাদের পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সাহায্য দান করে।
খৃষ্টানরা আমাদের দেহের বিরুদ্ধে অঙ্গকে সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা মুশেলকে তাদের কমাণ্ডোো বা গুপ্ত বাহিনীর আড্ডা বানিয়ে নিয়েছে। তারা বেশ কিছুকাল ধরেই সেখান থেকে গেরিলা আক্রমণ ও কমাণ্ডোো অভিযান চালাচ্ছে।
এমনিভাবে হলব ও অন্যান্য ছোট ছোট রাজ্যেও তারা তাদের কমাণ্ডোো বাহিনী পাঠিয়ে সেখানে তাদের আখড়া তৈরীর চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের একমাত্র টার্গেট সুলতান আইয়ুবী ও তার আপোষহীন বাহিনী। এখন থেকে মুসলিম অঞ্চলে থেকেই তারা আপনাদের ওপর আক্রমণ চালাবে।
আমি বৈরুতে গিয়ে জানতে পারলাম, খৃস্টানরা মুশেল থেকে একটু দূরে কোন এক পাহাড়ী এলাকায় অসংখ্য অস্ত্র ও সামান জমা করেছে। এসব অস্ত্র তারা জমা করেছে তাদের কমাণ্ডোো বাহিনীর জন্য। পরে প্রকাশ্য যুদ্ধের সময়ও তারা এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে।
তারা প্রকাশ্য যুদ্ধও করবে মুসলিম শাসক শ্রেণীর আড়ালে থেকে। তারা তাদের বাহিনীর বড় অংশই মুসলিম বাহিনীর সাথে একাকার করে দেবে। যুদ্ধ করবে তারা কিন্তু নাম হবে গাদ্দার মুসলিম শাসকদের। তারা জনগণের মাঝে প্রচার করবে দেশের স্বাধীনতা ও অখণ্ডোতার জন্যই তারা আগ্রাসী আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়ছে। ফলে দেশের যুব সমাজ ও জনগণ তাদের পক্ষে থাকবে বলেই তারা আশা করছে।
আমি এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি, তারা কোন পাহাড়ের আড়ালে তাদের অস্ত্রশস্ত্র জমা করেছে। তবে আমার তথ্য সঠিক। আপনাদের গোয়েন্দা বিভাগ একটু অনুসন্ধান করলেই সে ঠিকানা পেয়ে যাবে বলে আমি আশাবাদী।’
কথা শেষ করলেন এহতেশাম উদ্দিন। সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতিদের মতামত জানলেন। তারপর তাদের ছুটি দিয়ে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হাসান বিন আবদুল্লাহ ও কমাণ্ডোো বাহিনীর সেনাপতি সালেম মিশরীকে নিয়ে বসলেন জরুরী কাজে।
‘আমার সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, আমার ধারনা ছিল, ‘খৃস্টানরা মুশেল ও হলবে গোপনে নিজেদের আস্তানা তৈরী করে নিতে চেষ্টা চালাবে। আর এটাও আমার সন্দেহ ছিল যে, আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা তাদের পুরো সহযোগিতা করবে।
তোমরা এহতেশাম উদ্দিনের মুখে সব শুনেছো। সম্রাট বিলডনের কমাণ্ডোো বাহিনী মুশেলের অদূরে যুদ্ধের অস্ত্রপাতি ও রসদপত্রের ভাণ্ডোার জমা করেছে। এ কাজ শুধু তারাই করেনি, আমরাও করেছি। এখন এই দুই অস্ত্রভাণ্ডোারের কোন একটির ধ্বংস মানেই অপর পক্ষের বিরাট বিজয়। এদের মধ্যে যাদের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র ধ্বংস হয়ে যাবে তাদেরকে অর্ধেক পরাজয় মেনে নিতেই হবে।
আমাদের কিছু কমাণ্ডোো সৈন্য মুশেল ও হলবের মাঝামাঝি অবস্থান নিয়ে আছে। তাদেরকে সেখানে বসিয়েছি ইয়াজউদ্দিন ও ইমামউদ্দিনের মধ্যে পরস্পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য। এখন বৈরুত ও তাদের দু’জনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। করতে হবে।’
‘আপনার হুকুম পেলে এখনই আমি এর ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ বললো সালেম মিশরী।
‘এ কাজটা একটু জটিল হবে। বৈরুতে যাওয়ার একাধিক পথ আছে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে। বিশেষ করে গোয়েন্দারা সাধারণ পথ ছেড়ে দুর্গম পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পথ চলতেই বেশী পছন্দ করবে। ফলে এ মিশনে যাদের পাঠাবে তাদের ভয়াবহ দুর্গম অঞ্চলে ঢুকে যেতে হবে। ছড়িয়ে পড়তে হবে দূর দূরান্তে।’
‘সেভাবেই ব্যবস্থা নেবো আমি। কারণ আমিও জানি, গোয়েন্দারা নিজেদের নিরাপদ করার জন্য নির্দিষ্ট পথ ছেড়ে দূরে দূরান্তের দুর্গম পথেই চলাচল করে।’
‘সৈন্যদের একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিও, তাদের ওপর যে ফরজ অর্পিত হয়েছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজে কঠোর গোপনীয়তা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।’
‘জ্বি, তাই করবো। আর কিছু?’
‘কোন কাফেলা দেখতে পেলে তাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে হবে।‘ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘অনুসন্ধানকারী দলকে অনুসন্ধানে লাগিয়ে রাখো। আর এ কাজের জন্য আলাদা কমাণ্ডোো গ্রুপ মোতায়েন করো। যদি বাঁধা আসে তবে তাদের বীরের মত যুদ্ধ করতে বলবে। কিছুতেই তাদের আগে বাড়তে দেয়া যাবে না।
তবে এখানেও আমাদের যুদ্ধনীতি অব্যাহত থাকবে। আমরা অহেতুক মৃত্যুর হার না বাড়িয়ে যত অধিক সংখ্যক তাদের জীবিত ধরার চেষ্টা করবো। যুদ্ধের ময়দানে লাশের চেয়ে কয়েদীরা বেশী মূল্যবান।’