‘এই পেশা ছেড়ে আমি কোথায় যাব? আমার যে পালিয়ে যাওয়ার কোন জায়গা নেই।’
জ্যাকব বললো, ‘জায়গা পেলে তুমি কি এখান থেকে পালিয়ে যেতে?’
‘কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো? কে আমাকে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেবে?’ সারা বললো, ‘আজ যদি এখান থেকে পালাই তবে দেখা যাবে কোন দালালের খপ্পরে পড়ে আমার ঠাই হয়েছে কোন অন্ধগলিতে। তুমি কি চাও আমি এখান থেকে পালিয়ে কোন পতিতালয়ে নিক্ষিপ্ত হই?’
‘না, তা চাইবো কেন? আমি শুধু জানতে চাচ্ছিলাম বর্তমান পেশায় তুমি সন্তুষ্ট কি না? সন্তুষ্ট না হলে কতটুকু মর্মপীড়া অন্তরে লালন করছো? যে পরিবেশকে তুমি পছন্দ করো না সেখান থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য তুমি কতটা ঝুঁকি নিতে সস্তুত?’
‘জ্যাকব!’ সারা অন্তরঙ্গ স্বরে বললো, ‘তুমি কি আমাকে পছন্দ করো, নাকি আমার নাচকে?’
‘আমি সেই সারাকে পছন্দ করি যে এই পেশাকে ঘৃণা করে আর এ জন্য পেরেশান ও উদাস থাকে।’ জ্যাকব বললো, ‘কেন, আমি তোমাকে বলিনি, এই বেশে তুমি আল্লাহকে অপমান করছো?’
‘তুমি এই সেনাদলে ভর্তি হলে কি করে?’ সারা বললো, ‘তোমার তো কোন শহরের গীর্জার পাদরী হওয়া উচিত ছিল। আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও তো, তুমি দৈনিক কি পরিমাণ মদ পান করো?’
‘আমি মদের গন্ধটাও ঘৃণা করি।’
‘তবে তো তুমি মুসলমান!’ সারা দৃঢ়তার সাথে বললো, ‘যদি তুমি তা না হও তবে তোমার বাবা মুসলমান ছিলেন। তুমি নারীদের পর্দায় দেখতে চাও, তোমার নাচ পছন্দ নয়, তুমি মদের গন্ধও সহ্য করতে পারো না। এর মানে কি? কোন খৃস্টান কি এসব ঘৃণা করে?’
প্রশ্ন শুনে জ্যাকব যেন বোবা হয়ে গেল। সে এর কি জবাব দেবে? সে ফ্যালফ্যাল করে সারার দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘জ্যাকব!’ সারা বললো, ‘কিছু মনে করো না। তুমি যদি মুসলমানও হও তবু তোমার কাছে আমার একটি প্রশ্ন থেকেই যাবে, তুমি কি আমাকে ভালবাসো? কারণ তোমাকে নিয়ে আমি বড় বিভ্রান্তির মধ্যে আছি।
আমাকে দেখলেই প্রেম নিবেদন করার জন্য দুনিয়ার মানুষ হামলে পড়ে অথচ তুমি কোনদিন মুখ ফুটে কিছু বলেনি। কিন্তু কেউ যেখানে আমার মনের হদিস নিতে চায় না সেখানে তুমি কেন আমার ব্যথায় ব্যথিত হও? কেন জানতে চাও আমি এই পেশা ছেড়ে দেয়ার জন্য ঝুঁকি নিতে চাই কিনা?’
‘সারা, এ প্রশ্নের আমি কি জবাব দেবো!’ জ্যাকব বললো, ‘তোমার বেদনা যে আমার হৃদয় অনুভব করে। আমি যে তোমার মঙ্গল চাই। কেন যে চাই আমি নিজেও জানি না।’
এই সাক্ষাতের পর তারা পরস্পরের প্রতি আরও তীব্র আকর্ষণ বোধ করতে থাকে। মনের দুঃখ লাঘব করার জন্য সারা ছুটে যায় জ্যাকবের কাছে। জ্যাকবও সুযোগ পেলেই দেখা করে সারার সাথে।
তাদের মধ্যে ভালমন্দ নানা রকম কথা হয়। একে অন্যের কাছে খুলে দেয় হৃদয়ের অর্গল। এভাবেই সারা ও জ্যাকবের মাঝে মন দেয়া নেয়া চলতে থাকে। সারা জ্যাকবকে বলে, ‘তোমার চালচলন ও ধ্যান ধারণা একেবারে মুসলমানদের মত।
জ্যাকবের মনেও প্রশ্ন জাগে, সারা কি মুসলমান? নইলে মুসলিম আচারের প্রতি তার এত শ্রদ্ধা কেন? সে সারার কাছে একাধিকবার জানতে চেয়েছে, মুসলমানদের সে এত বেশী ভাল মনে করে কেন? সে কি মুসলমান? কিন্তু সারার কাছ থেকে এ প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর সে পায়নি।
মোটের উপর দু’জনই যে মুসলমানদের ভালবাসে এটা ওরা কেউ গোপন করতে পারেনি। এক সময় ওরা অনুভব করে, চিন্তার এ ঐক্যই তাদেরকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে এবং তারা একে অপরকে ভালবেসে ফেলেছে।
সেই রাতে জ্যাকব যখন ডিউটি থেকে ফিরে সারার অনুপস্থিতির কারণ জানার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল তখন তার মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল এইসব স্মৃতি ও ভাবনাগুলো। তার মনে প্রশ্ন জাগছিল, সারা কি অসুস্থ নাকি সে পালিয়ে গেছে এই পঙ্কিলতার জগত থেকে এমন তো সচরাচর হয় না, বাইরের মেহমান এলো অথচ নাচার জন্য তার ডাক পড়েনি।
সারা এবং তার সঙ্গী মেয়েরা যে বাড়ীতে থাকে সেখানে সাধারণের যাতায়াত নিষিদ্ধ। এমনকি ডিউটি ছাড়া সৈনিকদেরও কারো সেই বাড়ীতে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। তবু জ্যাকব সে বাড়ীতে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েছিল এ জন্য যে, সে জানতো, মহলের মেয়েরা এখনো সম্রাটের দরবারে জলসায় ব্যস্ত। আর যারা মাহফিলে যায়নি এতক্ষণে তাদের ঘুমিয়ে পড়ার কথা।
জ্যাকব নির্বিঘ্নে সেই বাড়ীর চার দেয়ালের সীমানায় পৌঁছে গেল। মূল গেট দিয়ে না ঢুকে দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। যাতে কারো নজরে না পড়ে সে জন্য অন্ধকারে পা টিপে টিপে সে সারার কামরার দরজায় পৌঁছে গেল।
দরজায় টোকা না দিয়ে সে আস্তে করে হাত দিয়ে ভেতরের দিকে মৃদু চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা।
বসার কামরা পেরিয়ে সে ভেতরের কামরায় চলে গেল। সেখানে ছোট একটি প্রদীপ জ্বলছে। তার ক্ষীণ আলোতে সে দেখতে পেল সারা বিছানায় শুয়ে আছে। তার দু’চোখ বন্ধ। বাচ্চা শিশুর মত অঘোরে ঘুমুচ্ছে।
তার ছড়ানো চুলগুলোর পাশে পড়ে আছে একটি হাত। খোলা জানালা দিয়ে কামরায় প্রবেশ করছে ভূমধ্যসাগরের শীতল হাওয়া। সেই হাওয়ায় তার এলোমেলো চুলগুলো সামান্য নড়ছে।
ঘুমের অতল তলে ডুবেছিল সারা। জ্যাকবের উপস্থিতি টের পায়নি। জ্যাকব তার হাত সারার কপালে রাখলো। কপালটা একটু গরম। না জ্বর নয়, যুবতী মেয়েদের শরীরে এমন উত্তাপ থাকাই স্বাভাবিক। জ্যাকব আশ্বস্ত হলো, সারার শরীর খারাপ নয়।
সারা, প্রেম কাননের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটি তুমি, যে ফুল সম্রাটদের হাতে পড়ে শুকিয়ে যায়। জ্যাকব মনে মনেই বললো, “তুমি প্রভাতের সেই তারা, দিনের সূর্যতাপে যা নিভে যায়, কিন্তু রাতের আঁধারে আবার তা চমকাতে থাকে।
সারা, আফসোস! তোমার জীবনটা রাতের আঁধারেই কেটে যাচ্ছে। এ আঁধারের গণ্ডোি থেকে বেরিয়ে আসার কি কোন উপায় নেই। তোমাকে আমার এত ভাল লাগার কারণ কি? তুমি আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করেছে আমি মুসলমান কিনা? একই প্রশ্ন তো আমারও।
তুমি কোন মুসলমান মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া শিশু নওতো? তোমার শিরায় তো কোন মুসলমান পিতার রক্ত প্রবাহিত নেই? কে এই রহস্যের পর্দা উন্মোচন করবে? আমি যেমন তোমার কাছে রহস্যময় তেমনি তুমিও আমার জন্য এক অপার রহস্য হয়েই রইলে।’
জ্যাকবের জানা ছিল, খৃস্টান সৈন্যরা মুসলমান কাফেলায় হানা দিয়ে লুটপাট করার সময় কেবল ধন সম্পদই লুট করে না, যুবতী মেয়ে এবং সুন্দরী শিশু কন্যাদেরও অপহরণ করে নিয়ে আসে। সেই শিশুদের তারা নিজেদের মত করে গড়ে নেয়। তাদের ট্রেনিং দিয়ে গোয়েন্দা বানায়। বেহায়াপনা ও নাচ-গানের শিক্ষা দিয়ে তাদের ব্যবহার করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে।
জ্যাকবের মনে প্রশ্ন জাগে, সারাও কি এমনি হতভাগীদের একজন? নইলে দীর্ঘদিন এ জাতির মধ্যে লালিত পালিত হওয়ার পরও তার আবেগ ও প্রেরণায় বেহায়াপনার প্রতি ঘৃণা থাকবে কেন? কেন মুসলিম আচারের প্রতি থাকবে হৃদয়ের টান?
জ্যাকব তার ভাবনায় এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে, সে ভুলেই গিয়েছিল কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। যে মহলে কোন পুরুষের আসার অনুমতি নেই সেখানে এই গভীর রাতে তার দাঁড়িয়ে থাকাটা যে অন্যায় এ চিন্তাও তার মাথায় ছিল না। সারা তার অন্তরে এমনভাবে স্থান করে নিয়েছিল যে, সব বিপদ তুচ্ছ করে সে সারার কথাই ভাবছিল।
এক সময় তার সম্বিত ফিরে এলো। সে প্রদীপটা নিভিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সারাও জেগে উঠলো।
‘কে?’
জ্যাকব তার ভীতিমাখা কম্পিত স্বর শুনতে পেয়ে বলল, ‘আমি জ্যাকব!’
‘এই সময় এখানে তুমি! এত রাতে কেন এসেছে এখানে?’ সারার স্বরে ক্রোধ বা রাগ নয়, ছিল ভীতি ও ভালবাসা। সহানুভূতির স্বরে সে বললো, ‘এখানে কেউ তোমাকে দেখতে পেলে কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছো?
সোজা তোমাকে জেলখানায় পাঠিয়ে দেবে। আমাকে বাইরে ডেকে নিতে।’
‘কোন গুরুত্বপূর্ণ মেহমান এলে সেই জলসায় অবশ্যই তোমার ডাক পড়ে। আজ নাচের আসরে তোমাকে না দেখে ভাবলাম তুমি অসুস্থ। এই দুশ্চিন্তাই আমাকে এই বিপদের মধ্যে টেনে এনেছে। তুমি অসুস্থ নওতো?’
জ্যাকব অন্ধকারে তার পালংকে বসতে বসতে বললো, ‘আলোটা এ জন্য নিভিয়ে দিলাম যাতে কেউ দেখে না ফেলে আমি এখানে। বিশ্বাস করো, এ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই আমার।’
‘আমার আত্মা অসুস্থ জ্যাকব।’ সারা বললো, আমি যখনই কোন অনুষ্ঠানে নাচি তখন আমার মন ও আত্মা আমার সাথে থাকে না। আমার দেহটাই শুধু নাচে, আত্মা মরে যায়।
আজ যখন আমাকে বলা হলো, মুশেল থেকে দু’জন উঁচুদরের মেহমান এসেছে তখন আমার আত্মার সাথে দেহটাও অবশ ও প্রাণহীন হয়ে গেল। আমার মাথা ঘুরে গেল। বমি আসতে লাগলো।
সারা বললো, “রাজরাজরার যুদ্ধ বিগ্রহের বিষয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই। তাদের নিরাপত্তা, বন্ধুত্ব, চুক্তি এসব ব্যাপারেও আমার কোন উৎসাহ নেই।
কিন্তু যখন আমার কানে এলো, মুশেল থেকে গুরুত্বপূর্ণ মেহমান এসেছে তখন আমার মনে এক অদ্ভুত ভাবনার উদয় হলো। আমার মনে হতে লাগলো, এই মুসলমানদের কারো সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।
আমার অনুভূতিতে বিচিত্র ভাব জেগে উঠতে লাগলো। মন বলতে লাগলো, তুমি এই মাহফিলে নাচতে পারবে না, তুমি আজকের জলসায় যেয়ো না। এই মেহমানরা তোমাকে দেখলে পালিয়ে যাবে।’
’কেন?’ জ্যাকব প্রশ্ন করলো, ‘মুশেলবাসীদের সাথে তোমার কি সম্পর্ক।’
‘সে কথা আমি বলতে পারবো না।’ সারা বললো, “আমি নিজেই তো নিজেকে বলতে ভয় পাচ্ছি, মুশেলবাসীদের সাথে আমার কি সম্পর্ক রয়েছে।’
‘সারা!’ জ্যাকব সারার হাত তার হাতের মধ্যে নিয়ে বললো, ‘তুমি কেন নিজেকে আমার কাছে গোপন করছো? আমাকে বিশ্বাস করো। তোমাকে কি কোন কাফেলা থেকে ধরে এনেছে? তুমি কি কোন মুসলমান পিতার সন্তান?’
সারা এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিলো না। জ্যাকবের প্রশ্ন শেষ হলে মুহূর্তে নিরবতা গ্রাস করে নিলো অন্ধকার কক্ষটি। হঠাৎ দু’জনেই চমকে উঠলো। জানালার দিকে মুখ করে বসেছিল দু’জন। খোলা জানালায় একটি ছায়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। সারা জ্যাকবের কানে কানে বললো, ‘জলদি পালংকের মিচে যাও।’
জ্যাকব অন্ধকারে পালংকের নিচে চলে গেল। সারাও নিরবে শুয়ে পড়লো।
‘সারা।’ জানালার কাছে দাঁড়ানো ছায়ার কণ্ঠ। কণ্ঠটি বুড়ি সর্দারনীর।
এখানে যারা থাকে তাদের দেখাশোনা করে এ বুড়ি। রাতে নাচের মাহফিলে সবাই গিয়েছে কিনা, মেয়েরা গান বাজনার চর্চা ঠিক মত করে কিনা, কোন মেয়ে পুরুষ বন্ধুকে অসময়ে ঘরে নিয়ে আসে কিনা এসবই দেখভাল করার দায়িত্ব এ বুড়ির।
সারা এ ডাকের কোন উত্তর দিল না। বুড়ি তাকে আরেকবার ডাকলো। সারা এবারও কোন জবাব দিল না। বুড়ী এবার আদেশের সুরে বললো, “সারা, আমি জানি তুমি ঘুমাওনি। উত্তর দাও প্রদীপ কেন নিভে গেছে।’
সারা মুখ থেকে এমন শব্দ বের করলো যেন কোন আওয়াজ পেয়ে এইমাত্র ঘুম ভাঙল তার। সে হুড়মুড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো এবং ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো, ‘কে, কে তুমি?’
‘সারা, আমি।’ বুড়ি বললো, ‘তোমার বাতি নেভানো কেন?’
‘কি জানি, হয়তো বাতাসে নিভে গেছে।’
বুড়ি জানালা থেকে সরে দরজার দিকে এগুতে এগুতে বললো, ‘দাঁড়াও, আমি দেখছি।’
সারা তাড়াতাড়ি ঝুঁকে জ্যাকবকে বললো, ‘ও সামনের দিকে গেছে, দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকবে। তুমি বেরিয়ে এসো এবং দ্রুত জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালাও।’
‘না!’ জ্যাকব নিচ থেকে বেরিয়ে এসে বললো, “আমি তাকে জানি, তাকে আসতে দাও। আমি তার গরম ভাব নরম করে দেবো। সে বাধ্য হয়ে মুখ বুজে চলে যাবে।’
‘এ মহিলা জঘন্যতম, তুমি তাকে চেনো না।’ সারা বললো, ‘এ মহিলা গোপনে মেয়েদের দালালী করে। তুমি জলদি এখান থেকে পালাও। নইলে আমার মিথ্যা আমাকেই আহত করবে। তুমি যাও, আমি তাকে সামলে নিতে পারবো।’
মহিলাটি ততক্ষণে দরজার কাছে এসে গেছে। সারার অনুনয় দাগ কাটলো জ্যাকবের হৃদয়ে। সে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে গেল।
সারা বিছানা থেকে নেমে বাতি জ্বাললো। মহিলা প্রবেশ করলো কামরার ভেতরে।
এ মহিলা বড় জাদরেল নারী। নারীসুলভ কমনীয়তার পরিবর্তে পুরুষের মত কর্কশ কন্ঠে সে বললো, ‘বলো এ ঘরে কে এসেছিল?’
সারা যতই তাকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করলো যে তার কামরায় কেউ আসেনি ততই তার মেজাজ আরো তিরিক্ষে হয়ে উঠলো। সে সারার উপর বজ্রের মত আক্রোশ ঢেলে বললো, ‘আমি নিজের চোখে কি ভুল দেখলাম?’
‘হয়তো অন্ধকারে আপনার চোখ ধাঁধা দেখেছে।’
‘চোখ না হয় ধাঁধা দেখলে কিন্তু কানে যে শুনলাম? সে শব্দ তো কোন নারীর কণ্ঠ নয়।’
মহিলা বাতি নিয়ে ঘরের চারদিকে দেখতে লাগলো। পালংকের নিচে ঝুঁকে সেখান থেকে একটা রুমাল বের করে বললো, ‘এটা কি?’
রুমালটা দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় এক গজ। অনেকটা গামছার মত। সাধারণত পুরুষরা গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এ ধরনের রুমাল ব্যবহার করে।
‘এটা কার? এটাতো তারই যে তোমার কাছে এসেছিল। বলো সে কে? আর তুমি তার কাছ থেকে কত মূল্য আদায় করেছো?’
‘দেখো আমি পতিতা নই।’ সারাও এবার রেগে গেল। ‘তুমি ভাল করেই জানো আমি নর্তকী হলেও কোন পুরুষের সাথে সম্পর্ক রাখি না।’
‘সারা, শুনে নাও!’ বুড়ী তার আরও কাছ ঘেঁষে তার কাঁধের উপর হাত রেখে বললো, ‘এটা আমি ভাল করেই জানি, তুমি এক নর্তকী। কিন্তু তুমি হয়তো জানো না, নর্তকীরা কোন দিন সেনাবাহিনীর জেনারেল হতে পারে না কিংবা কোন দেশের শাসকও হয় না।
আমি শুধু তোমাকে এটুকুই বলবো, রাতে তোমার কাছে যে লোক এসেছিল সে বৈরুতের পতিতালয়ের কোন নামকরা খদ্দেরের চেয়ে বড় কেউ নয়। তুমি তার পরিচয় বলে দিলে আমি তাকে যখন তখন কারাগারে বন্দী করতে পারি। তুমি রাজ দরবারের একজন নামী দামী নর্তকী। কিন্তু এটাও তুমি ভাল করেই জানো, এখানে তোমার নিজস্ব কোন ঠিকানা নেই।’
‘বুঝলাম, এখন তুমি তোমার মনের কথা বলো।’ সারা বললো, ‘তুমি আমার উপর যে দয়া করতে চাও তার বিনিময়ে কি নিতে চাও? আমি এখনই সে মূল্য পরিশোধ করবো।’
‘আমি তোমার কাছ থেকে কিছুই চাই না। তুমি দিলেও আমি তা নেবো না। বখরা আমি নেই ঠিকই, তবে সবার কাছ থেকে নয়। বরং তুমি যদি চাও তবে আমিই তোমাকে মূল্যবান উপঢৌকন দিতে পারি।’
‘তাহলে তুমি কি চাও? তোমার আসল মতলবটি দয়া করে আমাকে খুলে বলে।
‘বলবো, সবই বলবো। না বললে চলবে কেন? আমি এমন এক সুখবর তোমাকে দেবো, যাতে আর কোনদিন সামান্য পুরুষের হাতে তোমাকে পড়তে না হয়।’
সারা তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলো। বাইরে থেকে যেসব শাহী মেহমান আসে তাদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করে এই মহিলা। এই মেহমানদের মধ্যে খৃস্টানও আছে, মুসলমানও আছে। এই সব মেহমানদের মনোরঞ্জনের জন্য নির্দিষ্ট মেয়েরা প্রস্তুত হয়েই থাকে।
কিন্তু এই মেহমানদের সাথে যে রক্ষী ও অন্যান্যরা থাকে তাদের সে রকম আমোদ ফুর্তির জোগাড় হয় না। এই মহিলা তাদের সাথে দেখা করে তাদের কাছে পছন্দ মত মেয়ে সরবরাহ করে প্রচুর অর্থ পায়। এটা তার গোপন কারবার।
বিভিন্ন শাহী মেহমান এমনও থাকে যে, সরকারীভাবে দেয়া মেয়েদের দ্বারা তৃপ্ত হয় না। এই মহিলা গোপনে তাদের সাথেও যোগাযোগ করে।
এ জন্য মহলের চাকর চাকরানীদের নিয়ে আছে তার একটি নিজস্ব বাহিনী। এ চক্রের মাধ্যমে সে মেহমানদের অভাব পূরণ করে দিয়ে যথোচিত পুরস্কার লাভ করে।
সারাকে এ চক্রে কোনদিন টানতে পারেনি মহিলা। এখন সুযোগ বুঝে সে ফাঁদেই তাকে ফেলতে চালে বুড়ি।
সারা ভাবছে, এখন যদি সে বলে, আমার কাছে জ্যাকব এসেছিল, তার সাথে আমার সম্পর্ক খুব পবিত্র, সে কথা এ দালাল মহিলা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। এর ফল হবে ভয়ানক খারাপ। জ্যাকবকে কারাগারে পাঠিয়ে তার উপর চালানো হবে কঠিন অত্যাচার ও জুলুম। চাই কি এ অত্যাচারে সে মারাও যেতে পারে।
‘সারা!’ মহিলাটি বললো, ‘যদি তুমি ভয়াবহ পরিণাম থেকে বাঁচতে চাও তবে আমার কথা মেনে নাও। বাইরে থেকে দু’জন মেহমান এসেছেন। তারা খুবই ধনী লোক। পরশু থেকে তারা চাকরদের বলে আসছে, তাদের জন্য যেন খুব ভাল মাল আমদানী করা হয়।
এটা মাতালদের স্বভাব। এরা তাদের হেরেমে বিশ ত্রিশটা মেয়ে একত্রিত করেও তৃপ্ত হয় না। তারা চায়, নিত্য নতুন রূপসীরা তাদের সামনে দিয়ে আনাগোনা করুক। কাল তুমি এদের একজনের কাছে যাবে।’
‘সে জন কে সারা জিজ্ঞেস করলো, যদি মুসলমান হয় তবে তার কাছে আমি যাবো না।’
‘তবে কারাগারে যাও।’ মহিলা বললো, “এখনও ভেবে দেখো। তুমি তোমার নিজের অবস্থান চিন্তা করো। তুমি কি তোমার পেশাটা কি! এখানে ভদ্র পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করবে না। আমার প্রস্তাব মেনে নাও। সে লোক তোমাকে মন খুলে পুরস্কার দেবেন। তার মধ্যে আমারও কিছু অংশ থাকবে।’
‘যদি ধরা পড়ে যাই তখন কি হবে?’
‘যারা ধরবে তাদের মুখ আমি বন্ধ করে দেবো।’ মহিলা বললো, “আগামীকাল রাতে প্রস্তুত থাকবে। তোমাকে আর কখনও জিজ্ঞেস করবো না, তোমার কাছে আজ রাতে কে এসেছিল।’
মহিলাটি এই বলে চলে গেল। পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল হয়ে বিছানায় বসে রইল সারা। তার দু’চোখ বেয়ে তখন অশ্রুর বন্যা বইছে।
জ্যাকব পালিয়ে যাবার মত লোক ছিল না। কিন্তু সারার অনুনয়ে এই ভয়ে সে বের হয়ে গিয়েছিল যে, সারার উপর যেন কোন বিপদ না আসে। তার আশা ছিল, সারা তো এই পচা ডোবারই মেয়ে, সে মহিলাটিকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারবে।
জ্যাক ফিরে যাচ্ছিল। তবে তার মন জুড়ে ছিল সারার ছবি। সে বুঝতে পারছিল, সারার সাথে তার এই আন্তরিক ভালবাসাকে অস্বীকার করার সাধ্য তার নেই। আর সে এটাও বুঝতে পারছিল, সারা কোন মুসলমানেরই কন্যা।
সে যেতে যেতে শহরের এক সংকীর্ণ গলির মধ্যে প্রবেশ করলো। গলির মোড় ঘুরে সামান্য এগিয়ে এক বাড়ীর সামনে গিয়ে থামলো জ্যাকব। নির্দিষ্ট সংকেত অনুযায়ী দরজায় করাঘাত করলো। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে কেউ একজন বললো, ‘কে?’
‘আমি হাসান!’ জ্যাকব উত্তর দিল।
‘এত রাতে!’ বিস্মিত হয়ে দরজায় দাঁড়ানো লোকটি বললো, ‘কোন খারাপ খবর! জলদি ভেতরে এসো। কেউ দেখে ফেলেনি তো?’
‘না।’ জ্যাকব উত্তর দিল, ‘সম্রাটের দরবার থেকে একটু আগে ছুটি পেলাম। একটি জরুরী খবর নিয়ে এসেছি।’
সে ভেতরে ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দিল লোকটি। সে এখন আর জ্যাকব নয়, হাসান ইদরিস সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এক জানবাজ গোয়েন্দা। এক বছর আগে নিজের নাম পরিবর্তন করে খৃষ্টান নাম গ্রহণ করেছিল সে। গিলবার্ট জ্যাকব নাম নিয়ে ভর্তি হয়েছিল খৃষ্টান সৈন্য বিভাগে।