তানভীর ও জাভীরা হেমসের লোকালয়ে প্রবেশ করলো। জাভীরার তখন হাঁটার মত কোন অবস্থা ছিল না। তানভীর তাকে আহত মানুষের মত কাঁধের উপর তুলে নিয়ে এগুচ্ছিল। রাস্তায় ওরা পান করার মত পানি পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু তাদের ভাগ্যে কোন খাবার জুটেনি। ফলে ক্ষুধায় মেয়েটি একেবারেই কাতর হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া মেয়েটি বড় হয়েছে অসম্ভব আদর যত্নে। দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দেয়ার কোন অভিজ্ঞতা তার ছিল না। তাই কিছু দূর যাওয়ার পরই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আস্তে ধীরে চলতে গিয়ে পথেই তাদের রাত হয়ে যায়। মেয়েটি যখন কিছুতেই আর হাঁটতে পারছিল না তখন তানভীর তাকে কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হয়। তানভীর রাত নামার আগেই হেমসে পৌঁছতে চাচ্ছিল। তাই মেয়েটি যখন এক টিলায় চড়তে গিয়ে অপারগতা প্রকাশ করে বসে পড়ল তখন তানভীর তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে এগুতে লাগল। তারপরও পথেই তাদের রাত হয়ে গেল।
কিন্তু তখন হেমস আর বেশী দূরে ছিল না। তানভীর কোথাও না থেমে সন্ধ্যার একটু পরে হেমসের জনবসতিতে প্রবেশ করলো।
নিজের বাড়ীর সামনে এসে সে মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ীর ভেতর ঢুকে গেল। সকালেই বাড়ীর সকলে খবর পেয়েছিল, তানভীর মারা গেছে। তারা তার ঘোড়াও পেয়েছিল। ফলে সবাই বিশ্বাসও করেছিল সে আসলেই মারা গেছে। এখন মেয়েটিসহ তাকে পেয়ে সবাই বিস্মিতও হলো আবার স্বস্তিও পেল। শোকের বদলে সবার চেহারায় আবার ঝলসে উঠল আনন্দের ঝিলিক। তানভীর সবাইকে তার দুর্যোগপূর্ণ সফরের কাহিনী খুলে বলতে লাগল।
জাভীরা জানতো, তার ঠিকানা হবে এক ইহুদী বণিকের বাড়ী। সে ওখানে পৌঁছেই সঙ্গে সঙ্গে সে ইহুদীর নাম বলে তাকে সেই বাড়ীতে পৌঁছে দিতে বলল।
বাড়ীর লোকজন তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করল। তানভীর বলল, ‘হাত-মুখ ধুয়ে চারটে মুখে দিয়ে নাও, আমি এখুনি তোমাকে সেই বাড়ীতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করছি।’
মেয়েটি খেতে বসে আবার বলল, ‘আমার মন বলছে, সম্ভবতঃ বাবা মারা যাননি। তিনি বেঁচে থাকলে এতক্ষণে ওখানে পৌঁছে গেছেন। আমাকে ওই বাড়ীতে পৌঁছে দাও।’
তাদের খাওয়া শেষ হলো। তানভীর তাকে সঙ্গে নিয়ে ইহুদীর বাড়ীর দিকে রওনা হলো।
ইহুদীর বাড়ীটি তাদের বাড়ী থেকে বেশী দূরে ছিল না। নাম শুনেই তারা চিনতে পেরেছিল বাড়ীটি।
পথটি ছিল বেশ অন্ধকার। জাভীরা কিছু দূর এগিয়েই হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। তানভীর বললো, “কি হলো, থামলে কেন?’
মেয়েটি এ প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তানভীর, আর কখনো আমাদের দেখা হবে না!’
সে কখনো তার মুখ তানভীরের বুকের মধ্যে ঘষতে লাগলো। আবার কখনও সরে গিয়ে তার হাতে চুমু দিতে লাগলো, আর বলতে লাগলো, ‘বলো তানভীর, এই কি আমাদের শেষ দেখা!’
তানভীর মেয়েটির এ ধরনের আচরণে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো। শেষে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললো, ‘দেখো মেয়ে, আমাদের দু’জনের পথ ও ঠিকানা সম্পূর্ণ পৃথক। তোমাকে তোমার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়াই আমার এখন একমাত্র কাজ। তারপর ভবিষ্যতে কি হবে না হবে তা নিয়ে আমি ভাবি না। ছাড়ো আমাকে। আমি এসব পছন্দ করি না।’ জাভীরা তাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে আবেগে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, ‘কিন্তু এমন কি হতে পারে না, দুটি কথা চলতে চলতে আবার এক মোহনায় মিলিত হয়ে গেলো। সেই মোড়ে আমরা পরস্পর সাক্ষাৎ করবো। আবার আমি তোমাকে এমনি করে জড়িয়ে ধরবো?’
তানভীর জোর করে মেয়েটির বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। বলল, ‘বললাম তো, ভবিষ্যত সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।’
‘আমি জানি। যখন তুমি তোমার প্রভুর কাছে দুহাত তুলে প্রার্থনা করছিলে, তখন আমার নব জন্ম হয়েছে। তখনই আমি আমার আত্মার সন্ধান পেয়েছি। যতদিন আমি বেঁচে থাকবো, তোমাকে ভুলতে পারবো না কোনদিন। ভালবাসা কি জিনিস আমার জানা ছিল না। তুমি শুধু এটুকু কথা দাও, আমাকে তুমি ভুলে যাবে না।’
‘না! জাভীরা, না! কথা দিচ্ছি, কখনও আমি তোমাকে ভুলে যাবো না।’ আবেগে তখন কাঁপছিল তানভীরের কণ্ঠও, ‘আমি তোমাকে ভুলতে পারবো না। তবে বলতে বাঁধা নেই, এখনো তোমার আর আমার পথ ভিন্ন। যদি কখনো এমন হয়, ইসলামের সুশীতল ছায়ায় বাস করতে রাজি হয়ে যাও তুমি, তবে তোমার কাঙ্খিত সেই মিলন মোহনায় আমাকে দেখতে পাবে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। আমার মনে এতদিন কোন মেয়ে প্রবেশ করেনি। তুমিই সে মেয়ে যে আমার মনে ভালবাসার বীজ ছড়িয়েছে। বিশ্বাস করো, আর কোন মেয়ে এ মনে প্রবেশ করতে পারবে না।’
‘তাহলে কথা দাও, আমি তো এখন থেকে তোমার কাছাকাছিই থাকবো, মাঝেমধ্যে আমার সাথে দেখা করবে? আমার থেকে দূরে সরে যাবে না!’
‘কথা দিলাম, আমরা পরষ্পর সাক্ষাত করবো। আর এমন জায়গায় আমাদের দেখা হবে, যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া কেউ থাকবে না।’
তানভীর তার আমানতের কোনই খেয়ানত করেনি। এই দীর্ঘ যাত্রা পথে মেয়েটি, সত্যি তার ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আর পরবর্তীতে মেয়েটিও তানভীরের প্রাণে গেঁথে গিয়েছিল। এখন সে তার বুকে পাষাণ চাপা দিয়ে মেয়েটিকে ইহুদীর হাতে তুলে দিয়ে আসতে যাচ্ছে।
ওরা ইহুদীর বাড়ী পৌঁছে গেল। তানভীর দেখতে পেল, ইহুদীর বাড়ীতে সেই বৃদ্ধ খৃস্টানও আছে যাকে জাভীরা তার বাবা বলে পরিচয় দিয়েছিল।
জাভীরাকে পেয়েই বৃদ্ধ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
ইহুদী বণিক তখন বাড়ী ছিল না। সে তখন সম্রাট বিলডনের সেনা ক্যাম্পের দিকে রওনা হয়ে গিয়েছিল। যদিও সেখানে যাওয়ার কথা ছিল বৃদ্ধের কিন্তু ইহুদী বললো, ‘আপনি এখানে আগন্তুক। স্বাভাবিকভাবেই আপনার পেছনে গোয়েন্দা লেগে যেতে পারে। কিন্তু আমরা স্থানীয় বলে আমাদের চলাচলে কেউ তেমন নজর দেবে না। তাই বলছিলাম কি, সম্রাট বিলডনের ক্যাম্পে আপনি না গিয়ে আমি গেলে কেমন হয়?’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন। রাস্তায় বহিরাগতদের কম বেরোনোই ভাল। তাহলে বিলডনের ক্যাম্পে আপনিই যান, আমি আপনার ফিরে আসার অপেক্ষা করবো।’
ইহুদী বিলডনের ক্যাম্পের উদ্দেশ্য রওনা দেয়ার খানিক পরই তানভীর জাভীরাকে নিয়ে ওই বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছে।
তানভীর জাভীরাকে পৌঁছে দিয়েই বিদায় নিল। বৃদ্ধ খৃস্টান তাকে বসার অনেক অনুরোধ করলেও সে ওখানে দাঁড়ালো না, বলল, ‘এখন নয়, আবার আসবো।’
ওখান থেকে বেরিয়েই সে সোজা মসজিদে চলে গেল। ইমাম সাহেবের কামরার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। সে দরজায় করাঘাত করলো। ইমাম সাহেব দরজা খুলে তাকে দেখে বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আরে, তুমি!’
সে এ প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে ভেতরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।
❀ ❀ ❀
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এক বছরের মধ্যেই তাঁর সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করে নিলেন। তিনি অভিযান পরিচালনার জন্য বেশী দিন অপেক্ষা করা ঠিক মনে করলেন না। যে রাতে হেমসের ইহুদী বণিক সম্রাট বিলডনের কাছে যাচ্ছিল হেমসের মুসলমানদেরকে ধ্বংস করে দেয়ার আবেদন নিয়ে, সে রাতেই সুলতান আইয়ুবীর সেনাবাহিনী কায়রো থেকে বের হয়ে পড়ে।
তাদের প্রথম ঠিকানা ছিল দামেশক। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে পথ চলার হুকুম দিয়েছিলেন সুলতান, তাই বাহিনী ক্ষিপ্র বেগে এগিয়ে যাচ্ছিল।
যুদ্ধের এ নতুন অভিযানে কোথাও সময় নষ্ট করতে চাচ্ছিলেন না সুলতান। তাঁর পরিকল্পনা ছিল দামেশক পৌঁছে তিনি সুলতান তকিউদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করবেন। তারপর কায়রো ও দামেশকের মিলিত সৈন্য নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন অভিযানে। তার সহযোগিতায় থাকবে তকিউদ্দিনের বাহিনী।
কিন্তু দেখা গেল, দামেশক পৌঁছার আগেই তিনি তার গতিপথ পরিবর্তন করে ফেললেন। এই গতিপথ পরিবর্তনের কারণ ছিল এক দূত।
দূত জানতো না সুলতান আইয়ুবী অভিযানে বেরিয়েছেন। সে সুলতান আইয়ুবীর নামে এক চিঠি নিয়ে কায়রো যাচ্ছিল। পথিমধ্যে সে দেখতে পেলো একদল সৈন্য এবং সেই বাহিনীর সামনে সুলতানের পতাকা। সুলতানের পতাকা দেখে সে ছুটে সেই বাহিনীর মুখে গিয়ে পড়লো।
দূতকে সাথে সাথে সুলতান আইয়ুবীর সামনে হাজির করা হলো। দূত সুলতান আইয়ুবীর হাতে ইয়াজুদ্দিনের পত্র তুলে দিল।
ইয়াজুদ্দিন সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর একজন উপদেষ্টা ও সহযোগী ছিলেন। তিনি সে সময় এক পরগণার শাসক পদে উন্নীত ছিলেন। ইয়াজুদ্দিন ছিলেন একজন মর্দে মুমীন। সে কারণে সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গী মৃত্যুর আগে তাকে হলবের একটি পরগণা ও কেল্লার দায়িত্ব অর্পণ করেন। সেই কেল্লার অধীনে বিশেষ বিশেষ কিছু অঞ্চল ছিল। তেমনি একটি অঞ্চল ছিল মালহাক। এলাকাটি খৃস্টান সীমান্তের নিকটবর্তী। খৃস্টানরা মাঝে মধ্যেই এ এলাকায় ঢুকে পড়ে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতো। আক্রমণ করে লুটপাট ও নির্যাতন চালাতো। ইয়াজুদ্দিনের ক্ষমতা ও শক্তি এমন ছিল না যে, একা তাদের মোকাবেলা করে। আবার তিনি হলব এবং মুশেলের কোন সাহায্যও নিতে পারছিলেন না। কারণ যখন থেকে হলব ও মুশেলের সরকার আল মালেকুল সালেহ ও সাইফুদ্দিনেরা সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে জোট গঠন করে, তখন থেকেই ইয়াজুদ্দিন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি সুলতান আইয়ুবীকে যে চিঠি পাঠান তা এরূপঃ
মহা সম্মানিত সুলতান, আইয়ুবী বিন নাজমুদ্দিন আইয়ুব। সম্মানিত সুলতানে মিশর ও সিরিয়া! আপনার উপরে ও ইসলামী রাজ্যের উপরে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আমার আনুগত্য সম্পর্কে আপনার কোন সন্দেহ থাকার কারণ নেই। আমি আল খালিদের দিক থেকে ক্রুসেডদের আক্রমণের পথ প্রতিরোধ করে রেখেছি। এদিকের সমস্ত এলাকার যুদ্ধ অভিযানের পথগুলো আমার কমান্ডো বাহিনীর দৃষ্টির গোচরে রয়েছে। তারা সব সময় সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। খৃস্টানরা আমাকে রাস্তা থেকে সরানোর জন্য ইবনে লাউনের সাথে গোপন চুক্তি করে জোট বেঁধেছে। আপনি ভাল করেই জানেন, আমার সীমান্ত সেই এলাকার সাথে মিশেছে, যে এলাকা প্রকৃতপক্ষে আর্মেনীয়দের এলাকা। সেই আর্মেনীয়রা আমার সীমান্ত এলাকায় আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। আপনি ভাল মতই জানেন যে, আমার সৈন্য সংখ্যা নেহায়েতই সামান্য। খৃস্টান ও আর্মেনীয়রা আমার কাছে দু’বার মোটা উপহার দিয়ে দূত পাঠিয়েছিল। তারা আমাকে আহবান জানাচ্ছে তাদের জোটে মিলিত হতে। তারা আমাকে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার দাওয়াত দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। আমার অস্বীকৃতি তাদেরকে আরো ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। তারা আমাকে আক্রমণের হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সীমান্তে হামলা করে আমাকে ভড়কে দেয়ার চেষ্টা করছে।
যদি আমার অন্তরে আল্লাহর ভয় না থাকতো তবে রাজ্য রক্ষার জন্য আমি তাদের আহবানে সাড়া দিতে দ্বিধা করতাম না। কিন্তু শাহাদাত ছাড়া আমার সামনে এখন আর কোন পথ খোলা নেই। আমি সে পথকেই আমার জন্য বেছে নিয়েছি। আমার জন্য আপনার কাছে কোন আবদার বা দাবী নেই। আমি পেরেশান এ অঞ্চলের সাধারণ মুসলমানদের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে। আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমি তাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নিয়েছি। আমার ক্ষুদ্র বাহিনী তাদের বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা সেভাবেই করছে, যেমনটি করা উচিত প্রকৃত মর্দে মুজাহিদদের। আমি সব বিপদকে মাথা পেতে নিয়েছি একমাত্র আল্লাহর ভরসায়। আমি আমার জীবন, এই কেল্লা এবং আমার এলাকা আল্লাহর পথে কুরবান করে দেবো, তবুও ক্রুসেডদের সঙ্গে জোট বাঁধবো না।
সম্মানিত সুলতান! আমি মরহুম নুরুদ্দিন জঙ্গীর আত্মার সামনে জবাবদিহী করবো আর আমি তার লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মার কাছেও জবাবদিহী করে বলবো, মুসলমানদের প্রথম কেবলা মসজিদুল আকসা মুক্ত করার যে সংগ্রাম আপনি করছেন তাতে বিঘ্ন ঘটাতে চাইনি বলেই আমি আপনাকে বিরক্ত করিনি। আমরা আমাদের রক্ত দিয়ে সেই পথ ধুয়ে মুছে সাফ করার চেষ্টা করেছি। আমি তাদের বলবো, আপনি আপনার সংকল্প থেকে বিন্দুমাত্র টলেননি, বরং সে জন্য আপনার অবিরাম চেষ্টা জারী রেখেছেন।
আমি জানি, রমলার ঘটনার পরে আপনি নতুন করে সেনা সংগঠন ও যুদ্ধ প্রস্তুতিতে খুবই ব্যস্ত আছেন। আমার এটাও জানা আছে, সম্মানিত সুলতান তকিউদ্দিনও বাস্তব কারণেই আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে পারছেন না। আমি আমার অবস্থা জানিয়ে আপনাকে সতর্ক করা প্রয়োজন বোধ করছি।
সম্মানিত সুলতান! আপনাকে নেতা মানি বলেই প্রকৃত অবস্থা আপনাকে জানাবো আমি জরুরী মনে করেছি। আমার পরিকল্পনা আপনি শুনেছেন, যদি আমার ব্যাপারে আপনার কোন আদেশ থাকে বাহককে জানাবেন। আমার ব্যাপারে আপনি যে ফয়সালা নেবেন সেটাই আমার ফয়সালা। ক্রুসেড বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করা ছাড়া আপনি যে হুকুমই আমাকে দান করবেন আমি তা নির্দ্বিধায় মেনে নেবো।
আপনি যদি বলেন আমার সব সৈন্য নিয়ে আপনার কাছে চলে আসতে, তাতেও আমি রাজি। আমার শুধু একটাই শর্ত, আমি কোন মূল্যেই ক্রুসেড ও আর্মেনিয়ানদের সাথে কোন আপোস করবো না।’
সুলতান আইয়ুবী চিঠিটি পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কাফেলার অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিয়ে সেনাপতি ও উপদেষ্টাদের জরুরী বৈঠক ডাকলেন। সবাই সমবেত হলে তিনি চিঠিটি এক সেনাপতির হাতে দিয়ে বললেন, ‘সবাইকে পড়ে শোনাও।’
চিঠি পড়া হয়ে গেলে তিনি সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার বলো তোমাদের পরামর্শ কি? এখন আমাদের কি করা উচিত?’
সঙ্গে সঙ্গে জবাব এলো, ইয়াজুদ্দিনের শাহাদাতের তামান্নার সাথে আপনি আমাদেরকেও শরীক হতে দিন। আল্লাহ শাহাদাত পিয়াসী বান্দাদের বার বার বিজয় দিয়েছেন। হয় আমরা সে ময়দানে শহীদ হয়ে যাবো নয়তো বিজয় এনে তুলে দেবে আপনার মোবারক হাতে।
সুলতান আইয়ুবী আর বিলম্ব করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আদেশ জারী করলেন, ‘অভিযানের দিক পরিবর্তন করো। আমাদের গতি হবে ইবনে লাউনের দিকে। ইয়াজুদ্দিনের ওপর আক্রমণকারীদের বুঝিয়ে দেয়া দরকার, মুসলমানদের দেহ একটাই। এর যে কোন অংশে আঘাত লাগলে তার প্রতিবিধানের জন্য মুসলমানরাই যথেষ্ট। আল্লাহ তার বান্দাদের অপমানিত হওয়ার জন্য দুনিয়ায় প্রেরণ করেননি।’
সুলতান আইয়ুবী একনায়কের মত কোন সিদ্ধান্ত নিতেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন তার পরিষদের সবার সাথে পরামর্শ করেই। তবে তিনি কি চান সেটাও সঙ্গীদের দৃষ্টির আড়ালে রাখতেন না। তাঁর ভাবাবেগ ও চেহারাই বলে দিত তিনি কি চান। আর তাঁর সঙ্গীরাও তাঁরই মত মন-মস্তিষ্ক ও আবেগ নিয়ে ঘটনার বিশ্লেষণ করতে পারতেন। যে কারণে দেখা যেতো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবাই সম্মিলিতভাবে একই রকম সিদ্ধান্তের প্রতি ঝুঁকে যেতেন। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই কাফেলা তার দিক পরিবর্তন করে ইবনে লাউনের দিকে যাত্রা করলো।
দূতের জন্য এটা ছিল এক অভাবনীয় ও অচিন্তনীয় ব্যাপার। দূত ইবনে লাউনের প্রকৃত অবস্থা জানতো, সেই সাথে এটাও জানতো, এই চিঠিতে কি লেখা আছে। তার প্রথম বিস্ময়ের কারণ ছিল, কায়রো পৌঁছার অনেক আগেই সুলতানকে পেয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় কারণ ছিল, তাঁর বাহিনীকে সম্পূর্ণ রণসাজে পাওয়া। তৃতীয় বিস্ময় হয়ে দেখা দিল, মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এ সশস্ত্র বাহিনীর দিক পরিবর্তনের ঘটনাটি। সামান্য এক পরগণার ক্ষুদ্র এক শাসকের ছোট্ট একটি চিঠির শক্তি দেখে সে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো। সে বিস্ময়ের ধাক্কা সামাল দিতে না পেরে মুখ ফসকে বলেই ফেললো, ‘মহামান্য সুলতান! সত্যি আপনি ইবনে লাউন যাবেন?’
‘কেন, তোমার কি সন্দেহ হচ্ছে? আমার উস্তাদ মরহুম নুরুদ্দিন জঙ্গীর এক শিষ্য ডাক দিয়েছে তার ভাইকে। ভাই কি সে ডাক ফেলতে পারে?’
‘তবু! এ অভিযানের ভালমন্দ খতিয়ে দেখা কি প্রয়োজন ছিল না? আমার তো মনে হলো, বাস্তবতা যাচাই না করেই আপনি আবেগের বশে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
পথ চলতে চলতেই কথা বলছিল কাসেদ। সুলতান তাকে ডেকে সঙ্গে নিয়েছিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ইবনে লাউনের সর্বশেষ অবস্থা বিস্তারিত জানার জন্য। কাসেদের কথা শুনে তিনি বললেন, ‘ভুল বললে মুজাহিদ। অবশ্যই আমি আবেগের মূল্য দেই। কিন্তু তাই বলে বাস্তবকে অস্বীকার করি এমন অভিযোগ তুমি করতে পারো না।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘ইয়াজুদ্দিনের উক্তিতে আমি আমার উস্তাদ নুরুদ্দিন জঙ্গীর ধ্বনিই যেনো শুনতে পেয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক এবং আমাদের সংকল্পও এক। যে আবেগ তাকে ক্ষমতা ও রাজ্যের লোভ থেকেই রক্ষা করেনি বরং সেই আবেগের জন্য নিজের জীবনটাও কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়েছে সেই একই আবেগ লালন করি আমিও। তার স্বপ্নের সাথে আমার স্বপ্ন ও সিদ্ধান্ত মিলে গেছে বলেই আমি দিক পরিবর্তন করে ইবনে লাউনের পথ ধরেছি এ কথা মনে করার কোন কারণ নেই। বরং সব দিক বিবেচনা করেই আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি।’
‘সম্মানিত সুলতান!’ কাসেদ বলল, ‘বেয়াদবী না নিলে জানতে চাই, কোন বাস্তবতা আপনাকে এই সিদ্ধান্তে আসতে সহায়তা করেছে?’
‘দুনিয়ার বর্তমান বাস্তবতাই আমাদেরকে এ সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেছে।’ বললেন সুলতান, ‘বাস্তবতা এখন এই যে, এখন আমরা দামেশকে গেলে খৃস্টানের সহযোগিতায় ইবনে লাউনের সৈন্য ইয়াজুদ্দিনের উপর আক্রমণ করে বসবে। আর তাদের আক্রমণ একা প্রতিরোধ করতে পারবে না ইয়াজুদ্দিন। ইবনে লাউনের সামনেই হলব রাজ্য। তোমরা সবাই আল মালেকুস সালেহকে জানো। তার উপদেষ্টাদেরকেও তোমরা ভাল করেই চেনো। সে বাধ্য হয়ে আমাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হলেও চুক্তি তো কোন লৌহ কপাট নয় যে তা ভাঙা যাবে না। যুদ্ধ শুরু হলে তাদের মাথা আবার বিগড়ে যেতে পারে। কোন লোভের টোপ দেখলেই তারা আমাদের সাথে সম্পর্কেচ্ছেদ করে ক্রুসেড বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে যাবে, এ সম্ভাবনাই বেশী। কিন্তু আমি ক্রুসেড বাহিনীকে হলবের সীমানায় আমন্ত্রণ জানাতে পারি না। এ জন্যই আমি ইয়াজুদ্দিনকে নিঃসঙ্গ রাখতে চাই না। কারণ সে হচ্ছে আমাদের সীমান্ত প্রহরী। এখানে কোন ফুটো তৈরী হলে সে ফুটো দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকবে। সেই পানির সাথে থাকবে কুমীর। ক্রুসেড কুমীরদের প্রতিরোধ করাই এখন বাস্তবতার দাবী। অতএব আমরা যা করছি, জেনে বুঝে ভেবেচিন্তেই করছি।’
সুলতান আইয়ুবী ইয়াজুদ্দিনের দূতকে বললেন, ‘তুমি ইয়াজুদ্দিনকে আমাদের আগমনের খবর দিয়ে বলবে, তিনি যেন আমরা আসার আগ পর্যন্ত দুশমনকে তার এলাকায় প্রবেশের কোন অধিকার না দেয়। প্রয়োজনে তাদের সাথে আপোষরফার কথাবার্তা চালাতে থাকে। তাকে শক্তি নয়, কৌশলে শত্রুর মোকাবেলা করতে বলবে। প্রয়োজনে তাকে এমন ভান করতে বলবে, যেন দুশমন তাকেও তাদেরই একজন ভাবতে পারে।’ তিনি বললেন, ‘তুমি যত দ্রুত সম্ভব ফিরে যাও। আমরা আসছি।’
ইয়াজুদ্দিনের দূত দ্রুত এ সংবাদ নিয়ে ছুটে চললো মালহাক অভিমুখে।
খৃস্টান গোয়েন্দারা সারা দেশ জুড়েই ছড়িয়েছিল। তারা সুলতান আইয়ুবীর গতিবিধি লক্ষ্য করে ক্রুসেড বাহিনীর কাছে নিয়মিতই রিপোর্ট পাঠাচ্ছিল। সুলতান আইয়ুবী বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়ার সাথে সাথেই তারা এ খবর পৌঁছে দিয়েছিল কেন্দ্রে। তারা জানিয়েছিল, সুলতান আইয়ুবী তার বাহিনী নিয়ে দ্রুত দমেশকের দিকে ছুটে চলেছে।
কিন্তু তারা ভালভাবেই জানতো, সুলতান আইয়ুবীর চাল বুঝে নেয়া কোন সহজ ব্যাপার নয়। তিনি আদৌ দামেশক যাবেন কিনা, এই নিয়েও তাদের মধ্যে সন্দেহ কাজ করছিল। তাই তারা সুলতানের গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখছিল।
সুলতানকে তার গতিপথ পরিবর্তন করতে দেখে তাই তারা বিস্মিত হলো না। সঙ্গে সঙ্গে তারা সুলতানের গতিপথ পরিবর্তনের খবর কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিল।
ক্রুসেড বাহিনীর সম্মিলিত হেড কোয়ার্টারে যখন গোয়েন্দাদের এই খবর পৌঁছলো যে, সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী দামেশকে যাওয়ার পরিবর্তে অভিযানের গতিপথ ইবনে লাউনের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন, খৃস্টান জেনারেলরা বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী তাঁর পরীক্ষিত ময়দান বেছে নিয়েই যুদ্ধে নামতে চাচ্ছে।’
❀ ❀ ❀
হেমসের সেই ইহুদী বণিক, যে হেমসের মুসলিম জনপদকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার আবেদন নিয়ে সম্রাট বিলডনের সেনা ক্যাম্পে গিয়েছিল, সে ফিরে এসেছে। সেখানে সে সম্রাট বিলডনের সাক্ষাৎ পায়নি। কারণ তখন তিনি তার খৃস্টান বন্ধুদের কাছে সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন।
বিলডনের জেনারেলরা ইহুদী বণিকের প্রস্তাব শুনে তাকে বলে দিয়েছে, ‘আপনার প্রস্তাব উত্তম। কিন্তু সম্রাটের আদেশ ছাড়া আমরা কোন অভিযান পরিচালনা করতে পারি না। তিনি ফিরে আসুক। তিনি এলে বিষয়টি অবশ্যই আমরা তার কাছে উত্থাপন করবো।’
ইহুদী ফিরে এসে দেখলো, জাভীরা জীবিত ফিরে এসেছে। সে অবাক হয়ে বললো, ‘তুমি! তবে যে সবাই বললো তুমি ডুবে মারা গেছো?’
‘তাই গিয়েছিলাম।’ জাভীরা বললো, ‘তানভীর নামের এক মুসলমান যুবক আমাকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে এসেছে।’
‘তানভীর! ওকে তো আমি চিনি। সে ওখানে কি করছিল! সে তো এই হেমসেরই যুবক!’
‘হ্যাঁ, সে হেমসেরই যুবক। আমাদের কাফেলার সাথেই সেও ওদিক থেকেই আসছিল। আমি যখন ডুবে যাচ্ছিলাম তখন সে আমাকে উদ্ধার করে। আমরা স্রোতের টানে অনেক ভাটির দিকে চলে গিয়েছিলাম, তাই কাফেলাকে খুঁজে পাইনি। রাত হয়ে গিয়েছিল। আমার হাঁটার মত কোন শক্তি ছিল না। তাই রাতটা আমরা এক পাহাড়ের গুহায় কাটিয়ে পরদিন যাত্রা করি।’
জাভীরার কথা শুনে চিন্তিত দেখালো ইহুদী বণিককে। সে বললো, ‘কিন্তু আমি ভাবছি, তানভীর ওদিকে কেন গিয়েছিল?’
পরদিন। ইহুদী বণিক তানভীরকে তার বাড়ীতে ডেকে পাঠাল। তানভীর এলে তাকে বললো, ‘আমি খুবই খুশী হয়েছি যে, তুমি আমার বন্ধু কন্যা জাভীরাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। তোমার এ কাজের বদলা দেয়ার কোন সাধ্য আমাদের নেই। শুধু কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে সামান্য উপহার। আশা করি তুমি আমার এ উপহার গ্রহণ করবে।’
তানভীর ইহুদীর দেয়া পুরস্কার নিতে অস্বীকার করে বললো, ‘একি বলছেন আপনি! আমি তো আমার মানবিক দায়িত্ব পালন করেছি শুধু। না, এর বিনিময়ে আমি আপনাদের কাছ থেকে কিছু নিতে পারবো না।’
‘কিন্তু বাবা, তুমি এত বড় উপকার করলে, আর আমরা তোমার জন্য কিছুই করতে পারবো না।’
‘কেন, আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন। আপনাদের নেক দৃষ্টিই আমার জন্য বিরাট পাওনা।’
‘তাহলে কথা দাও, মা মরা এই মেয়েটিকে মাঝে মধ্যে দেখতে আসবে?’
‘অবশ্যই আসবো। আপনারা আমাদের পড়শী। এক পড়শী আরেক পড়শীর ভাল-মন্দ খবর নেবে না, তাও কি হয়! নিশ্চয়ই আমি আসবো।’ তানভীর এই বলে সেখান থেকে বিদায় নিল।
এ ইহুদীর কাছে জাভীরার মত মেয়ের আর কোন প্রয়োজন ছিল না। কেননা সে হেমসের মুসলমানদের ধ্বংস করার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে। এখন খালি সম্রাট বিলডনের ফিরে আসার অপেক্ষা। তিনি নিশ্চয়ই এ প্রস্তাব খুশী চিত্তে লুফে নিবেন। তাই সে বৃদ্ধ খৃস্টানকে বললো, “জাভীরাকে এখন আর কি দরকার! আমি তো সম্রাট বিলডনের বাহিনীকে দাওয়াত করেই এসেছি।’
‘হ্যাঁ, একটা জটিল কাজ খুব সহজ হয়ে গেল। আমিও সে কথাই ভাবছিলাম।’
‘তাহলে জাভীরাকে আবার হেড কোয়ার্টারে ফেরত পাঠিয়ে দিলেই তো হয়!’
জাভীরাকে বলা হলো এ কথা। সে ছিল চতুর মেয়ে। সে চাচ্ছিল এখানে আরো কিছুদিন থেকে যেতে। বললো, ‘কোথাকার পানি কোথায় গড়ায় না দেখেই চলে যাওয়া কি ঠিক হবে? আর লড়াইয়ের সময়ও তো আমার দরকার হতে পারে। বিশেষ করে খতিবকে যদি আমি বাগে নিয়ে আসতে পারি তবে হয়তো লড়াইয়ের প্রয়োজনই হবে না।’
‘কিন্তু খতিবকে তুমি কিভাবে বাগে আনবে?’
‘সেটা আমার ব্যাপার। সেটা যদি তোমরাই পারতে তবে আমাদের মত মেয়েদের এত ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণের আর কি দরকার ছিল? তাছাড়া ভুলে যাচ্ছো কেন, এখানকার মুসলমানদের উদ্দেশ্য এবং সংকল্প জানতে হলেও আমার প্রয়োজন আছে। আমি তাদের মধ্যে পরম্পর শত্রুতা সৃষ্টি করে তাদের ঐক্য ধ্বংস করে দিতে পারবো। মুসলমানদের এ অনৈক্যই তোমাদের বিজয়কে নিশ্চিত করবে।’
জাভীরার যুক্তি ফেলে দেয়ার মত ছিল না। সুতরাং ইহুদী তার। প্রস্তাব ফিরিয়ে নিল এবং তাকে হেমসেই রাখার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু বৃদ্ধ খৃস্টান বা ইহুদী কেউ জানতেও পারলো না, জাভীরা শুধু তানভীরের জন্যই আরো কিছুদিন হেমসে থাকতে চাচ্ছিল।
জাভীরাকে তানভীর ইহুদীর বাড়ীতে রেখে আসা পর্যন্তই তার দায়িত্ব বলে জ্ঞান করেছিল। কিন্তু ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি। পরদিন ইহুদীর বাড়ীতে তার যে আলাপ হয় তাতে ইহুদীর বাড়ীতে তার যাতায়াত অবাধ অধিকার লাভ করেছিল। সেই অধিকার জাভীরা ও তানভীরকে এক নতুন পৃথিবীতে টেনে নিল। তাদের মধ্যে শুরু হলো নিয়মিত মেলামেশার খেলা। রাতের আঁধারে লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে খোলা মাঠে গিয়ে ওরা বসতো। গল্প করতো ঘন্টার পর ঘন্টা। দু’জনের দুই আলাদা পৃথিবী এক হয়ে মিশে যেতো সেই গল্পের ভূবনে।
খৃস্টান মেয়েটির মধ্যে ছিল রাজমহলের আভিজাত্য। বিলাসের বিচিত্র উপকরণ দিয়ে সেভাবেই তাকে গড়ে তোলা হয়েছে। তাকে শেখানো হয়েছে কিভাবে শাহজাদা বা আমীর ও বাদশাহদের কজা করতে হয়। সে তুলনায় তানভীর ছিল নিতান্তই এক গ্রাম্য যুবক। একে কব্জা করা মেয়েটির কাছে ছিল এক তুচ্ছ কাজ। কিন্তু এই তুচ্ছ কাজটিও জাভীরা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে করছিল।
দামেশকে তার প্রশিক্ষণের সময় এ মেয়ে দুই আমীরকে তার পদতলে বসিয়ে রাখতো। তাদের দিয়ে সে এমন ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তুলেছিল যে, সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলার জন্য স্বয়ং সুলতান আইয়ুবীকে দামেশকে ছুটে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তানভীরের সাথে তার মেলামেশাটা ছিল আসলেই আন্তরিক। দুর্যোগের বিভীষিকা এবং তানভীরের সে সময়কার কর্মকান্ডে মেয়েটি নিতান্তই অভিভূত হয়ে পড়েছিল। তানভীরের ব্যবহার তার সত্ত্বাকে এমনভাবে ধাক্কা দিয়েছিল যে, মেয়েটি নিজের মধ্যে অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করলো। তার মধ্যে জন্ম নিল আবেগপ্রবনতা। সে অনুভব করলো, তার অন্তরের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে থরো থরো প্রেমের লাল গোলাপ। দিনে দিনে সে গোলাপ সুবাস ছড়াতে শুরু করলো। কখন যে সে তার ভালবাসায় তানভীরকে সিক্ত করে ফেলল এবং নিজেও তানভীরের ভালবাসায় বিভোর হয়ে গেলো, নিজেও টের পেলো না। কিন্তু তারপরও মেয়েটি ছিল খৃষ্টানদের প্রশিক্ষণ এক গোয়েন্দা। তার একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল, ছিল সুস্পষ্ট এসাইনমেন্ট। সেই এ্যাসাইনমেন্টের কথা তো সে ভুলে যেতে পারে না। তাই সে একদিন কথায় কথায় তানভীরকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তানভীর, একটি কথা জিজ্ঞেস করব।’
‘কি কথা, বলো?’
‘খতিব এবং আরও যারা তোমাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তারা কি সবাই এখানকার, নাকি বাইরে থেকে এসেছে?’
তানজীর নাম ধরে ধরে তার উত্তর দিতে শুরু করলে জাভীরাই আবার বলে উঠলো, ‘থাক, এখন সে কথা। এখন সে খবর নিয়ে আমাদের কি লাভ, সে যা করার করুক। আমরা এমন সুন্দর রাত কেন যুদ্ধের কথা বলে নষ্ট করবো।’
এমনিভাবে সে দুদিকই সামাল দিতে লাগলো। অথবা বলা যায়, সে নিজেই দোদুল্যমানতায় ভুগতে লাগল। সে যখন তানভীরের সাথে থাকে তখন এক অবুঝ প্রেমিকা ছাড়া নিজেকে আর কিছুই ভাবতে পারে না। তার তখন এ কথাও মনে থাকে না যে, সে এক গোয়েন্দা। তাকে কায়রো থেকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এই জাভীরাই যখন ইহুদী বণিকের ঘরে যায় এবং তার অন্যান্য সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হয়, তখন সে তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের মত সমান তালে মুসলমানদের ধ্বংসের পরিকল্পনা নিয়ে মেতে উঠে।
এভাবে দেড়-দু’মাস অতীত হয়ে গেল। এক সন্ধ্যায় জাভীরা তানভীয়ের বাড়ী চলে এলো। সে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে লাগলো। এক সময় সে সুযোগ পেয়ে তানভীরকে ইশারায় কিছু বললো। তানভীর বুঝতে পারলো তার ইশারা। তারপর মেয়েটি তানভীরের আম্মাকে বললো, ‘রাত হয়ে যাচ্ছে খালা। আমি এখন যাই।’
মেয়েটি চলে গেলে তানভীরের আম্মা সান্ধ্য ব্যস্ততা ও মাগরিবের নামাজের জন্য ঘরে চলে গেলেন। তানভীরও মসজিদের জন্য পা বাড়াল।
সন্ধ্যার অন্ধকার একটু গভীর হতেই তানভীর সেই স্থানে চলে গেল, যেখানে তারা প্রতি রাতে মিলিত হয়। জাভীরাও ঠিক তখনই সেখানে গিয়ে হাজির হলো।
জায়গাটা ছিল লোকালয় থেকে দূরে। তানভীর লক্ষ্য করলো, জাভীরাকে খুব ভীত দেখাচ্ছে। তানভীর বললো, ‘কি ব্যাপার জাভীরা! তোমাকে এত ভীত দেখাচ্ছে কেন?’
জাভীরা এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বললো। জাভীরা ভয়ের কারণ কিছু না বললেও একটু পরেই তানভীর বুঝতে পারলো, তার ভয় অমূলক নয়। সে নিজেই শুনতে পেলো, কে যেন জাভীরাকে খুঁজছে এবং তাকে ডাকছে।
এবার তানভীরও খানিকটা ভয় পেল। আছে করে নাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এ লোক কে? কে তোমাকে ডাকছে?’
জাভীরা ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে তাকে সাবধান করে ভীত কণ্ঠে বললো, ‘চুপ, মনে হয় আমাকে কেউ দেখে ফেলেছে। হয়তো আমি আসার পথে কেউ আমাকে আসতে দেখে আমার পিছু নিয়েছিল, এখন হারিয়ে ফেলে আমাকে খুঁজছে। চলো আমরা আরও দূরে সরে যাই।’
তারা দুজন অন্ধকারের আড়াল নিয়ে সংগোপনে সেখানে থেকে সরে পড়লো এবং গ্রাম থেকে আরও অনেক দূরে চলে গেল। কিন্তু তখনও তারা শুনতে পাচ্ছিল, কে যেন ব্যাকুল কণ্ঠে বার বার ডাকছে, জাভীরা, জাভীরা…!’
‘এ শব্দে কান দিও না তানভীর।’ জাভীরা বললো, ’আমি তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবো, যেখানে অন্য কারো আওয়াজ পৌঁছবে না।’
সামনে একটি ছোট পাহাড় ছিল। জাভীরা তানভীরকে দ্রুত টানতে টানতে সেই পাহাড়ের আড়ালে নিয়ে গেল। তানভীর বিস্মিত হয়ে তার সাথে সাথে চলছিল। তারা এমন এক স্থানে গিয়ে থেমে গেল, যেখানে বাইরের আওয়াজ সহজে পৌঁছে না। ওখানে পৌঁছে জাভীরা বলল, এবার আর কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না।’
সহসা তানভীর চমকে উঠে বললো, ‘বাইরে খুব শোরগোল শোনা যাচ্ছে। তুমিও শুনতে চেষ্টা করো। মনে হচ্ছে কোথাও যেন ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। বহু মানুষের চিৎকার ও আর্তনাদ আর অশ্বের ছুটাছুটি শোনা যাচ্ছে!’
‘তোমার কানে এরকমই শোনা যাচ্ছে হয়তো।’ জাভীরা হেসে বললো, বাতাসের বেগ পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে এমন শব্দ বের হচ্ছে। এটা চতুর্মুখী বাতাসের আওয়াজ, তুমি অযথাই অন্য রকম ভাবছো।’
‘কি জানি, হতে পারে!’ চিন্তিত মনে বললো তানভীর।
জাভীরা তাকে তার বাহু বন্ধনে নিয়ে নিল। তার সুবাসিত কোমল চুলের স্পর্শ আর ঘ্রাণ তানভীরের চোখ, কান ও বিবেকের উপর আধিপত্য বিস্তার করে নিল। তানভীর শেষে মেনে নিতে বাধ্য হলো, এ শব্দ বাতাসেরই সৃষ্টি। নইলে এমন ভূতুড়ে চিৎকারের শব্দ কোথেকে আসবে? সে জাভীরার চুলের অরণ্যে মুখ বুজে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা চিৎকারের শব্দ ও ছুটন্ত ঘোড়ার পদধ্বনি শুনতে লাগল।
কিন্তু সে জানতে পারলো না, এ আওয়াজ তারই গ্রামের লোকদের করুণ আর্তনাদ, তারই আপনজনদের মর্মভেদী চিৎকারের আওয়াজ। সেখানে তখন সেই ধ্বংসলীলা শুরু হয়ে গিয়েছিল, যে ধ্বংসলীলা চালানোর আহবান নিয়ে ইহুদী বণিক গিয়েছিল সম্রাট বিলডনের বাহিনীর কাছে। জাভীরা এ ষড়যন্ত্রের সবকিছুই জানতো। সে চাচ্ছিল না, এ শব্দ তানভীরের কানে পৌঁছুক।
এ ব্যবস্থাটা হয়েছিল খুবই গোপনে। ইহুদী বণিক আর একবার সম্রাট বিলডনের কাছে গিয়েছিল। তখন সম্রাট বিলডনের সাথে তার সাক্ষাত হয়। এ সাক্ষাতেই হেমসের ধ্বংসের ব্যবস্থা পাকা করে এসেছিল ইহুদী। সে বিলডনকে মুসলমানরা কিভাবে সেখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি চালাচ্ছে তার বিবরণ দিয়ে বলেছিল, ‘যদি আপনি সেখানে অভিযান চালান তবে আমরা আপনাকে বলে দেবো, কিভাবে হামলা করলে আপনি সহজে বিজয় লাভ করতে পারবেন। কোথায় আপনি কেমন মোকাবেলার সম্মুখীন হবেন সে তথ্য আমরা আপনাকে সরবরাহ করবে, যাতে আপনি তার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারেন।’ সম্রাট বিলডনের এ প্রস্তাব খুবই পছন্দ হলো। তিনি ইহুদী বণিককে বললেন, ’আমি অভিযান চালাবো। তিনি তার সৈন্য বাহিনী কে রাতে গোপনে হেমসের উপর আক্রমণ চালাবে বলে দিয়ে তাকে বললেন, “এ কথা ইহুদী বা খৃষ্টান বাসিন্দাদেরও বলার দরকার নেই। তবে তোমাকে এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কোন খৃস্টান বা ইহুদী বাসিন্দা সে রাতে হেমসের গ্রামে না থাকে। যেন সন্ধ্যার পরপরই তারা গ্রাম থেকে সরে যায়। তারা দিনের বেলায় সরে গেলে মুসলমানরা সন্দেহ করবে।’
‘আপনি এ নিয়ে ভাববেন না। সে রাতে আমরা পাহাড়ের পাদদেশে ইহুদীদের জন্য নৈশ এবাদতের ব্যবস্থা করবো। আর খৃস্টানদের প্রতিটি বাড়ীর গেটে ক্রুশ ঝুলিয়ে রাখবো, যাতে আপনারা চিনতে পারেন ওটা খৃস্টানের ঘর। আর আমাদের যুবকদের একটা দল আপনাদের পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করবে।’
এভাবেই তিনি হেমসের মুসলমানদের ধ্বংসের পথ তৈরী করেন। ইহুদী ফিরে এলে তার পরিকল্পনা শুনে জাভীরা বললো, ‘আমি তানভীর ও তার পরিবারকে বাঁচাতে চাই।’
‘একে আমরা জাতির সাথে গাদ্দারী করা বলবো।’ বৃদ্ধ খৃস্টান বললো, ‘সাপের বাচ্চাকে বাঁচানো কি কোন বুদ্ধিমানের কাজ?’