» » হেমসের যোদ্ধা

বর্ণাকার
🕮

তার কণ্ঠস্বর আবেগে ভারাক্রান্ত হয়ে এলো। তিনি দুর্বল স্বরে বললেন, ‘মা কখনও সন্তানের জন্য বদ দোয়া করে না। কিন্তু মায়ের মনের ব্যথা আল্লাহ পাক ভুলে যান না। আমি হাশরের ময়দানে হাজার হাজার শহীদের মা, বিধবা স্ত্রী ও তাদের এতিম সন্তানদের সামনে লজ্জিত হতে চাই না। যে শহীদরা আমার ছেলের সৈন্যদের হাতে প্রাণ দিয়েছে এই ছেলের জন্য দোয়া করে আমি তাদের সামনে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবো? আমি আমার সমস্ত মমতা ও স্নেহ সেইসব শহীদদের স্মরণেই নিবেদন করছি।’

‘সে এখন তার পাপের ক্ষমা চাচ্ছে মা!’ মেয়ে মায়ের পা ধরে কেঁদে কেঁদে বললো।

‘এটাও আমার কাছে মনে হচ্ছে এক ধরনের ধোকা, প্রতারণা।’ মা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ’আমি জানি, সুলতান আইয়ুবী যখন হলব অধিকার করেছিলেন তখন সে তোমাকেই সুলতানের কাছে পাঠিয়েছিল এজাজ দুর্গ ভিক্ষা চেয়ে। আইয়ুবী এক মহান সুলতান! তাই তিনি তোমাকে তাঁর কন্যার মত স্নেহ করে দান করেছিল এজাজ দুর্গ। তখন মালেকুস সালেহ নিজে কেন সুলতানের সামনে গেল না? সে যখন পরাজিত হলো তখন তাকেই তার অপরাধের জন্য লজ্জিত হয়ে মাফ চেয়ে নেয়া উচিত ছিল। নিজে গিয়ে তার তলোয়ার আইয়ুবীর চরণে রাখা উচিত ছিল। সুলতান তার শত্রু নয়, সে তো তাঁকে শ্রদ্ধেয় মামুজান বলেই ডাকতো। সে তার ঈমান বিক্রি করেছিল বলেই ক্ষমা চাওয়ার সাহস করেনি। এমন লোক কাপুরুষ, কপট, ধোকাবাজ, বিলাসপরায়ণ। যুগে যুগে এমন লোকই বেঈমান ও গাদ্দারদের খাতায় নাম লেখায়।’

‘নিষ্ঠুর পাথর হয়ো না মা!’ শামসুন্নেসা মায়ের পায়ে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বললো।

‘শহীদদের মায়েরাও তো তাদের প্রাণ ও মন পাথর বানিয়ে রেখেছে!’ মা বললেন, ‘শহীদদের মায়েরাও বলতে লজ্জা পায় যে, তার ছেলে শত্রুর আঘাতের বদলে নিজের ভাইদের আঘাতে শেষ হয়ে গেল। এ রক্তের দায়িত্ব কে বহন করবে? আমার সন্তান! আল মালেকুস সালেহ!’

‘সে তো তখন খুব ছোট ছিল মা!’

‘তবে আমার কাছেই থাকতো!’ মা বললেন, ‘যখন তার চেতনা ফিরলো তখনও তো আমার কাছে আসতে পারতো। হলব সুলতান আইয়ুবীর দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে সে এখানে চলে এলে তার এমন কি অসুবিধা হতো? তুমি চলে যাও, আর এক্ষুণি যাও। যদি সব মুসলিম মাতা আমার মতই সাবধান ও আবেগশূন্য হয়ে উঠতে পারে তবে কারোর বেটাই আর শহীদ হবে না। সবাই হবে গাজী, সবাই হবে বিজয়ী বীর। আমি দয়া, মায়াকে হত্যা করেছি। আমার মমতা শহীদ হয়ে গেছে।’

‘মা, কখনও কি কেউ তার মেয়েকে এমনভাবে বিদায় করে?’

‘তবে আমার কাছেই থেকে যাও।’ মা বললেন, ‘কিন্তু এই শর্তে যে, তোমার ভাইয়ের নাম কখনও মুখে আনবে না।’

‘মা! এটা তো সম্ভব নয়!’ মেয়ে বললো, “যে ভাই আমাকে লালন পালন করে বড় করেছে তার নাম কি আমি না নিয়ে পারবো?’

‘তবে তার কাছেই চলে যাও।’ মা বললেন, ‘তুমিও খৃস্টানদের ছায়ায় প্রতিপালিত হয়েছো। চিন্তা চেতনায় তুমি তোমার ভাইয়ের থেকে আর কত উন্নত হবে! এখানকার মেয়েদের দেখো, তারা ইসলামের নামে জীবন কুরবানী করতে প্রস্তুত। আমি যখন ওদেরকে ট্রেনিং দেই এবং ওদের শাসন করি তখন ওরা ভয়ে কাঁপে। তুমি যদি এখানে থাকো তবে ওরা বলবে, আপনি এবার আপনার নিজের মেয়ের খবর নিন। তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে, আমার ছেলে খৃস্টানদের সাথে উঠা বসা করে না, মদ খায় না এবং তার পাশে কোন খৃস্টান বা ইহুদী মেয়ে থাকে না?’

শামসুন্নেসার মাথা নত হয়ে গেল। সে মায়ের কথার কোন উত্তর দিতে পারল না, চুপ করে দাঁড়িয়েই রইল।

মা বললেন, ‘নাও, বসো। যাওয়ার আগে মায়ের দেয়া আহারটুকু খেয়ে নাও। তারপর চলে যাও।’

শামসুন্নেসা মাথা নিচু করে এক তক্তপোসে বসে পড়ল। বাড়ির পুরনো চাকরানী তার সামনে কিছু নাস্তা-পানি দিল। মা বললেন, ‘যদি ফিরে গিয়ে দেখো আমার সন্তান বেঁচে আছে তবে তাকে বলবে, তোমার মা তোমার দুধের ঋণ মাফ দিয়েছে। কিন্তু তোমাদের হাতে শহীদ হওয়া শহীদদের খুনের ক্ষমা করেনি। তাকে আরও বলবে, যদি তোমার বুকে খৃস্টানদের তীর বিদ্ধ হতো আর তীরবিদ্ধ অবস্থায় ইসলামের পতাকা তলে এসে তুমি মারা যেতে তবে তোমার মা উড়ে গিয়ে তোমার লাশ বুকে তুলে নিয়ে দামেশকে নিয়ে আসতো। আর গর্ব ভরে সেই লাশ শহরের অলিগলিতে ঘুরিয়ে বলতো, ‘দেখো, দেখো! আমার ছেলে ইসলামের জন্য শহীদ হয়েছে। সেই লাশ শহরের কবরস্থানে দাফন করে সবাইকে বলে বেড়াতো, দেখো! এইখানে আমার বেটার কবর। আমার বেটা ইসলামের জন্য জীবন দিয়েছিল। কিন্তু এখন আমি কি বলব?’

শামসুন্নেসা মাথা নিচু করে চুপচাপ বসেছিল। মায়ের কথা যত শুনছিল ততই তার মাথা আরো নত হচ্ছিল। মায়ের কথা শেষ হলে সে মুখ তুলে চাইল মায়ের দিকে। দেখা গেল তার দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। সে অশ্রু তার গাল বেয়ে নেমে ভিজিয়ে দিচ্ছে গায়ের বসন। সে হাঁটু গেড়ে বসে মায়ের আচল ধরে চুমা দিল। তারপর সেই আচল তার চোখে মুখে লাগালো এবং উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘যাই মা। আমার ভাই আমার ছোট বেলার সাথী। এক সাথে এতদিন কাটিয়েছি। তার মরার সময় আমার কিছু দায়িত্ব কর্তব্য থেকেই যায়। আমি তার কাছেই যাচ্ছি। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, সে আর বাঁচবে না। আমি তার দাফন কাফন সেরে আবার আপনার খেদমতে এসে হাজির হবো।’

‘আবার কি জন্য আসবে?’ মা তিরষ্কারের কণ্ঠে বললেন।

মেয়ে এ তিরষ্কারে বিচলিত না হয়ে চোখের পানি মুছে বললো, ‘সেই সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য, যে আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হবে।’ মেয়ে মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনার ছেলের পরিবর্তে আমি আপনাকে এমন এক ছেলে দান করবো, যে শহীদ হলে আপনি বৃদ্ধা বয়সে তার কবরের সামনে বসে দুহাত তুলে দোয়া করতে পারেন। আপনি সেদিন গর্ব ভরে বলতে পারবেন, দেখো, দেখো, এটা আমার শহীদ ভাইয়ের মাজার! মা! আমি আবার আসবো! আবার আসবো! আমার জন্য বর দেখে রেখো। আমি চোখ বন্ধ করেই ছুটে এসেছিলাম তোমার কাছে। এখন আমার চোখ খুলে গেছে। সেই খোলা চোখ নিয়েই আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে শুধু এটুকু অনুমতি দাও মা, ভাইকে যেন নিজ হাতে কাফন পরাতে পারি। বিদায়! মা, বিদায়।’

মেয়েটি সীমাহীন শংকা ও ভয় মনে গেঁথে নিয়েই সারা পথ পাড়ি দিয়েছিল এবং ভয়-সঙ্কুচিত মন নিয়েই ধীর পদে মায়ের কাছে এসেছিল। কিন্তু এখন আর তার মনে কোন ভয় নেই। সে বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে বড় বড় পা ফেলে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল।

রাজিয়া খাতুন অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। দরজার বাইরে বেরিয়ে গেল মেয়ে। রাজিয়া খাতুন দুই বাহু বাড়িয়ে ছুটে এলেন দরজা পর্যন্ত। তার মুখ থেকে সহসাই। বেরিয়ে এলো আর্তধ্বনি, ‘আমার কন্যা! আমার বেটি!’

তিনি দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। গেটের বাইরে থেকে ভেসে এলো মেয়ের দরাজ কণ্ঠ, ‘বিন আজর! সকল আরোহীকে এক্ষুণি ডাকো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি হলব ফিরে যেতে চাই। জলদি করো।’

মা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছেন মেয়ের তৎপরতা। বাড়ির বাইরে গেটের কাছে এসে জমা হলো আটটি ঘোড়া। সব কটাতেই একজন করে আরোহী। মেয়ে তার সামনে দাঁড়ানো এক ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে পড়লো। তাকে এখন শাহজাদীর মত দেখাচ্ছে। সাথে সাথে ভেসে এলো তার কমান্ড, ‘চলো!’

সে তার ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। আটটি ঘোড়া তাকে অনুসরণ করে ছুটলো তার পিছু পিছু। রাজিয়া খাতুন দরজা বন্ধ করে দিলেন। চোখে তার টলোমলো অশ্রু। তাকালেন দাসীর দিকে। মমতা মাখানো সুরে বললেন, ‘ওরা না খেয়েই চলে গেল!’ মা ও মেয়ের এ সাক্ষাত ঘটেছিল ১১৮১ সালের নভেম্বর মাসে।

তার দু’বছর আগের ঘটনা। সুলতান আইয়ুবী ইবনে লাউনকে পরাজিত করে তার কেল্লা তারই সৈন্যদের দিয়ে ভেঙে মিসমার করে দিয়েছেন। তারপর সেই ধ্বংসস্তুপের আবর্জনা নদীতে ফেলে দিয়ে নিশ্চিহ্ন করেছেন তার স্মৃতি। এর পরপরই সুলতান আইয়ুবী সম্রাট বিলডনকে পরাজিত করেন। এ সফলতার মূলে ছিল জাভীরা নামের এক খৃস্টান যুবতী ও তানভীর নামের এক মুসলমান যুবক। এ যুবক যথাসময়ে পাহাড়ের উপর সম্রাট বিলডনের ওঁৎ পেতে থাকার খবর সুলতান আইয়ুবীকে পৌঁছে দেয়ার সুবাদেই সুলতান দ্বিতীয়বারের মত বিলডনকে পরাজিত করেন। এর আগে তিনি সুলতান আইয়ুবীর ভাই তকিউদ্দিনের হাতেও চরম মার খেয়েছিলেন।

এবার সুলতান আইয়ুবীর হাতে মার খাওয়াটা বিলডনের জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত। এমনিতেই তকিউদ্দিনের হাতে তার অর্ধেক বাহিনী নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠার আগেই সুলতানের হাতে আবার মার খেয়ে যথেষ্ট কাবু হয়ে গেলেন বিলডন। কিন্তু তিনি তো আর একাই খৃস্টান সম্রাট নন। অন্যান্য রাষ্ট্রে যারা খৃস্টান সম্রাট আছেন তারাও প্রত্যেকেই ইসলামের ব্যাপারে সমান মারমুখী। মুসলমানদের সাথে কোন একক খৃস্টান সম্রাট বা রাষ্ট্রের সংঘাত নয় বরং সংঘাত চলছিল খৃস্টবাদের সাথে ইসলামের। আর তাতে জড়িয়ে পড়েছিল সকল খৃস্ট সম্রাট এবং ইসলামী শক্তি। এই সম্মিলিত বাহিনীর সাথে ইসলামের সংঘাতের নামই ছিল ক্রুসেড। এ ক্রুসেড বাহিনী ছড়িয়েছিল বিস্তৃত আরব বিশ্বসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।

যদিও তাদের প্রত্যেকেই অন্যকে টেক্কা দিয়ে ক্ষমতা ও শক্তির দিক থেকে শীর্ষে পৌঁছার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতো কিন্তু ইসলামের সামনে সবাই এককাট্টা হয়ে যেতো। এ সুবিধাটুকুই নিতে চেয়েছিলেন সম্রাট বিলডন। তার সৈন্য, অস্ত্রবল এবং অর্থ সবই ছিল প্রচুর। আইয়ুবীকে পরাজিত করতে পারলে তিনিই হতেন খৃস্টান জগতের হিরো। এ আশা নিয়েই তিনি ইসলামী শক্তির মুখোমুখী হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, উন্নত অস্ত্র আর ঘোড়া তাকে বিজয় দিতে পারেনি। পরাজয়ের কলঙ্ক নিয়ে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে জীবন বাঁচাতে হলো তাকে।

এরপর কিছুকাল তার কেটে গেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করতে। কিন্তু সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করেও নতুন করে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সাহস তার হলো না। কারণ সুলতান আইয়ুবী ইবনে লাউনকে পরাজিত করায় এমনিতেই সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ইবনে লাউন আর্মেনিয়ান লোক হলেও খৃস্টানদের সে ছিল বন্ধু। তার পরাজয়ে বিলডন মনে দারুণ আঘাত পেয়েছিল।

আক্রমণের সময় সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যের সাথে ছিল আল মালেকুস সালেহের সৈন্য, তখন তা তাকে আরো ভাবিয়ে তুললো।

যদিও বিলডন এবং অন্যান্য খৃস্টান সম্রাটরা জানতো, সুলতান আইয়ুবী আল মালেকুস সালেহকে পরাজিত করে শর্তসাপেক্ষে তার রাজ্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তারা ভাল মতই জানতো, আল মালেকুস সালেহ চুক্তি মানার লোক নন। নেহায়েত বিপদে পড়েই তিনি চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছেন। আল মালেকুস সালেহ মূলতঃ তাদেরই লোক। কিন্তু আইয়ুবীর বাহিনীর সাথে সৈন্য প্রেরণ প্রমাণ করে, সে এখন আর খৃস্টানদের বন্ধু নেই। হয়তো তার মধ্যে সত্যি আইয়ুবীর প্রভাব পড়েছে।

বিলডন ভেবেছিলেন, আল মালেকুস সালেহ প্রকাশ্যে সুলতান আইয়ুবীর ভক্ত ও তাবেদার সাজলেও ভেতরে ভেতরে খৃস্টানদের বন্ধুই রয়ে গেছে। কিন্তু আইয়ুবীর বাহিনীকে আল মালেকুস সালেহ সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছে জানতে পেরে বিলডন ভীত হয়ে ওই অঞ্চল ছেড়ে সোজা জেরুজালেমের পথ ধরলেন। আক্রাতে ক্রুসেড বাহিনীর বিশাল ঘাঁটি থাকলেও জেরুজালেমই ছিল ক্রুসেড বাহিনীর হেডকোয়ার্টার। তিনি আপাততঃ যুদ্ধ বন্ধ রেখে সেই হেডকোয়ার্টারে গিয়ে উঠতে চাইলেন।

‘আপনারা কি জানেন, সুলতান আইয়ুবী আবার মুসলিম শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে?’ জেরুজালেমে বিলডন, খৃস্টান সম্রাট ও জেনারেলদের মিটিংয়ে বললেন, ‘আল মালেকুল সালেহকে আপনারা নিজেদের দলের লোক বলে মনে করেন। কিন্তু আপনারা কি জানেন, সে তার সৈন্য বাহিনী সুলতান আইয়ুবীর হাতে তুলে দিয়েছে?’

‘ইবনে লাউনের পরাজয় আমাদের নিজেদের পরাজয়।’ ফিলিপ আগাস্টাস বললেন, ‘যদি আপনি ওঁৎ পেতে থাকার চেয়ে ইবনে লাউনের সাহায্যে এগিয়ে যেতেন, আর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে পিছন থেকে আক্রমণ করতেন তবে পরাজয় তারই হতো।’

‘এখানে বসে বসে সমালোচনা করা যত সোজা, সুলতান আইয়ুবীর সাথে লড়াই করা তত সহজ নয়। কায়রো থেকে বেরোনোর পরপরই আমরা জেনেছিলাম সুলতান আইয়ুবীর সমর অভিযান কোন দিকে। কিন্তু তিনি যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করে ইবনে লাউনের দিকে যাত্রা করার খবর পেলেও তিনি যে ইবনে লাউনকেই আক্রমণ করে বসবেন তা আমি বুঝতে পারিনি।’

‘এই বুঝতে না পারার দায়িত্বটা আপনি কার ওপর চাপাবেন? গে অব লুজিনা বললেন, আমরা তার কাছ থেকে বহু দূরে ছিলাম। তিনি কখন কোন দিকে যান, কোন গতিতে যান আমাদের চাইতে আপনারই সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা উচিত ছিল। সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী আপনার পাশ দিয়ে গিয়ে ইবনে লাউনকে আক্রমণ করলো অথচ আপনি তার কিছুই জানতে পারলেন না, এতে বাহাদুরীর কিছু নেই। এটা আপনার গোয়েন্দা বিভাগের অদক্ষতা ও দুর্বলতাই প্রমাণ করে। ওভাবে ওঁৎ পেতে বসে থেকেই বা আপনি কি পেলেন? নিশ্চিত বিজয়কে পরাজয়ে রূপান্তরিত করে পালিয়ে এলেন এখানে, এই তো!’

‘আমি জানতাম না, আমার সাথে এক মুসলমান গোয়েন্দা রয়েছে। বিলডন বললেন, আমি তাকে এক অপদার্থ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারিনি। লোকটি আমার কয়েদীর চেয়ে বেশী ছিল না। কিন্তু যথাসময়ে সে পালিয়ে গিয়ে সুলতান আইয়ুবীকে সতর্ক করেছিল বলেই যুদ্ধের মোড় এভাবে পাল্টে গিয়েছিল। নইলে আমার ওঁৎ পেতে থাকার খবর তার জানার কথা ছিল না। যাক সে কথা, পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কি! তারচেয়ে বলো আইয়ুবী এবং আস সালেহের চুক্তির ধ্যে কেমন করে ফাটল ধরানো যায়।’

‘আপনি কি মুসলমানদের দুর্বলতা ভুলে গেছেন? নাকি উপেক্ষা করছেন?’ অন্য এক খৃস্টান সম্রাট বললেন, ‘যখন আমরা আস সালেহ, তার আমীর ও উজিরদের উপঢৌকন দিয়ে হাত করেছিলাম তখন আল মালেকুস সালেহ ছিল খুব ছোট, অবুঝ কিশোর। এখন সে পূর্ণ যৌবনে পা দিয়েছে। নব যৌবনে পদার্পনকারী একজন সামর্থবান পুরুষকে ঘায়েল করা কি খুবই কঠিন? আমার তো মনে হয় এখন তাকে হাতের মুঠোয় নেয়া আরও সহজ। যৌবনকে ঘায়েল করার উৎকৃষ্ট অস্ত্র ব্যবহার করুন। বিশেষ দূত মারফত লোভনীয় পুরস্কার ও উপহার সামগ্রী পাঠান। এ পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে তাকে আমাদের বন্ধু বানানোর চিন্তা বাদ দিন। এখনকার আসল কাজ গোপনেই সারতে হবে।’

“আপনি ঠিকই বলেছেন।’ বললেন আরেক সম্রাট, ‘তাকে এখন আর সামরিক জোটে আনা ঠিক হবে না। এমনটি কল্পনা করাও অন্যায় হবে। সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী ময়দানে অপেক্ষা করছে। তার ভাই তকিউদ্দিনও সসৈন্যে ময়দানে অবস্থান নিয়েছে। ওদিকে আস সালেহের কাছে তার নিজের বাহিনী ছাড়াও হারান এবং মুশেলের সৈন্য রয়েছে বলে আমাদের উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। সে যদি আমাদের পক্ষ নিতে যায় সুলতান আইয়ুবী সাথে সাথে হলব আক্রমণ করে তার সমস্ত সৈন্য নিজ কমান্ডে নিয়ে নেবেন। তারচে বড় যে ক্ষতি হবে তা হচ্ছে, একবার আল মালেকুস সালেই বিশ্বাসঘাতক প্রমাণিত হলে দ্বিতীয়বার সে সুলতানের অনুকম্পা আশা করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে আল মালেকুস সালেহকে চিরদিনের মত হারাতে হবে আমাদের। আর এ ক্ষতি অপুরণীয় ক্ষতি।’

‘কিন্তু যদি আমরা সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে আইয়ুবীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি? আপনারাই তো বললেন, আল মালেকুস সালেহ বিপদে পড়ে আইয়ুবীর পক্ষ নিয়েছে। আমরা বিশাল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলে সে কি আমাদের পক্ষ নেবে না?’

‘আপনার মাথা বিগড়ে গেছে। এমন সন্দেহ নিয়ে যুদ্ধ হয় না। আমাদের এখন বড় কাজ ফিলিস্তিনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা। আইয়ুবী আঘাত হানলেও যেনো ফিলিস্তিন আমরা ধরে রাখতে পারি সেটাই হবে এখনকার মূল পরিকল্পনা। ফিলিস্তিন অরক্ষিত রেখে আমরা কোথাও যেতে পারি না।’

‘সবার যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর যারা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদেরকে আমার সাহায্যে দিলে ওদের নিয়েই আমি আরেকবার আইয়ুবীর মুখখামুখী হতে চাই। বিপদের ঝুঁকি আমার অথচ শত্রু মরবে সকলের। আপনারা আমার এ প্রস্তাব গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখুন।’

‘আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর যারা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদেরকে আমরা এমনিতেই ওসব জায়গায় বসিয়ে রাখিনি। সুলতান আইয়ুবী কখন কোন দিকে রোখ করে, তার সংকল্প ও টার্গেট কি বুঝে নিয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্যই আমরা বিভিন্ন স্থানে সৈন্যদেরকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছি। এমতাবস্থায় এখন আমরা আপনাকে কোনই সাহায্য করতে পারবো না। আপনি কৌশলে আস সালেহকে মুঠোর মধ্যে রাখতে চেষ্টা করুন, তাতেই আপনার লাভ হবে।’

১১৮০ খৃস্টাব্দে মুসেলের আমীর সাইফুদ্দিন গাজী মৃত্যুবরণ করেন। তার স্থলে মুসেলের আমীর পদে অধিষ্ঠিত হন ইয়াজউদ্দিন মাসুদ। ঠিক একই সময়ে সুলতান আইয়ুবীর ভাই শামসুদ্দৌলা তুরান শাহ মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াতে ইন্তেকাল করেন। এ খবর পেয়ে সুলতান আইয়ুবী অভিযান মুলতবী রেখে মিশর ফিরে যাওয়া জরুরী মনে করলেন। তিনি তার বাহিনী তাঁর ভাই তকিউদ্দিনের কমাণ্ডে রেখে মিশর রওনা হয়ে গেলেন। ফলে সুলতানের সমস্ত পরিকল্পনা আবার উলটপালট হয়ে গেল।

জেরুজালেম থেকে সম্রাট বিলডন কোন সাহায্য না পাওয়ায় এবং সুলতান আইয়ুবী মিশর ফিরে গেছেন জানতে পেরে তিনিও নিজ সাম্রাজ্যে ফিরে গেলেন। এরপর তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তার সেনা ঘাটতি পূরণে। তিনি নতুন ভর্তি সৈন্যদের উপযুক্ত ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। সৈন্যদেরকে যুদ্ধের উপযোগী করে গড়ে তোলার সাথে সাথে তারা যেন সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের মোকাবেলা করতে পারে সে জন্য তিনি তার সৈন্যদেরকে সুলতান আইয়ুবীর রণকৌশল শিক্ষা দিতে লাগলেন।

একদিকে চলছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি অন্যদিকে কুটনৈতিক তৎপরতা। কুটনৈতিক তৎপরতা বলতে আল মালেকুস সালেহের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং তাকে হাতের মুঠোয় রাখার সম্ভাব্য ব্যবস্থা গ্রহণ।

আস সালেহ এখন শিশু নয় পরিপূর্ণ যুবক। রাজ্য শাসনের আইন কানুন এখন তিনি ভালই বুঝেন। বুঝেন পারিপার্শ্বিকতা এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বপরিস্থিতি। খৃস্টানদের সাথে দহরম মহরম যে মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর, এ কথাও যে বুঝেন না এমন নয়। খৃস্টানরা কেন গায়ে পড়ে তাকে সাহায্য করতে চায়, কেন তাকে নানা রকম উপঢৌকন পাঠিয়ে খুশি করতে ব্যতিব্যস্ত, এটাও তিনি ভালই বুঝতে পারেন।

সালাহউদ্দিন আইয়ুর কাছ থেকে রাজ্য ফিরে পাওয়ার পর কোন খৃষ্টানকে উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেয়ার কোন সুযোগ ছিল না। এমন চেষ্টাও তিনি করেননি। কিন্তু তার উপদেষ্টা এবং সেনাপতিদের অনেকেই গোপনে খৃস্টানদের সাথে যোগসাজস অব্যাহত রাখছিল। সুলতান আইয়ুবীর সাথে সন্ধি চুক্তি করার পর আস সালেহের দিনকাল ভালই কাটছিল। রাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও তাঁর হাতেই রয়েছে। কথায় বলে সুখে থাকলে ভুতে কিলায়। তাঁর দশাও হলো তাই। তার মনের মধ্যে আবার স্বাধীন সুলতান হওয়ার স্বপ্ন ধীরে ধীরে পাখা মেলতে শুরু করলো।

একদিন তিনি সংবাদ পেলেন, খৃস্টান সম্রাট বিলডনের এক দূত এসেছে তার সাথে দেখা করতে। তিনি তৎক্ষণাৎ তাকে ভেতরে ডেকে নিলেন।

এ দূত ছিল খুবই ধুরন্ধর এবং বাকপটু। মানুষের মানবিক দুর্বলতা সে সহজেই আবিষ্কার করতে পারতো এবং মানুষকে পটানোর ক্ষেত্রে ছিল ওস্তাদ। সে আল মালেকুস সালেহকে জানালো, ‘আমি মহামান্য সম্রাট বিলডনের পক্ষ থেকে হলবের সুযোগ্য শাসক সুলতান আল মালেকুস সালেহ-এর জন্য কিছু উপঢৌকন নিয়ে এসেছি।’

‘কি উপঢৌকন এনেছো?’

দূত তার সঙ্গে আনা একাধিক বাক্স আল মালেকুস সালেহ এর সামনে রেখে বললো, এর মধ্যে আছে মহা মূল্যবান হীরা জহরত ও সোনার টুকরো। আর এতে আছে স্বর্ণখচিত দুটি তলোয়ার। এ ছাড়া আপনার জন্য মহামান্য সম্রাট পঞ্চাশটি উন্নত জাতের ঘোড়া এবং একজন সুন্দরী সেবাদাসী পাঠিয়েছেন। ওগুলো বাইরে রেখে এসেছি।

আস সালেহ বাক্স খুলে হীরা জহরত ও সোনার টুকরাগুলো দেখলেন। এরপর বাইরে গিয়ে দেখলেন ঘোড়াগুলো। কিন্তু যে উপহারের প্রতি তার দৃষ্টি গিয়ে আটকে গেল সে এক অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে। তিনি অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটিকে প্রাণভরে দেখলেন। তার মধ্যে জন্ম নিল মানবিক দুর্বলতা। মেয়েটি যেন মুহূর্তে তাকে যাদুর মত আচ্ছন্ন করে ফেললো। বলা যায়, অতর্কিতেই সে মেয়ে তার জ্ঞান ও বুদ্ধির উপর আসন গেড়ে বসলো।

দূত আস সালেহের হাতে সম্রাট বিলডনের চিঠি তুলে দিল। চিঠিটি ছিল আরবীতে লেখা। আস সালেহ চিঠির পরিবর্তে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। সে তখন ভাবছিল, এত সুন্দর মানুষও খোদার দুনিয়ায় হয়! মেয়েটি তার কল্পনার চেয়েও বেশী সুন্দরী ছিল। অনেকক্ষণ পর আস সালেহ দূতের দিকে ফিরে বলল, ‘হ্যাঁ, কি যেন বলছিলে চিঠির কথা?’

‘জ্বি, মহামান্য সম্রাট আপনাকে একটি পত্র দিয়েছেন।’

‘কোথায় সে চিঠি? কি লিখেছেন তিনি?’

‘জ্বি, ওটাতো আপনার হাতে!’

এতক্ষণে সম্বিত ফিরল তার। দূতের দিকে ফিরে তার দিকে চিঠিটি বাড়িয়ে ধরে বলল, “কি লিখেছে পড়ো।’

দূত পত্রখানি খুলে পড়তে শুরু করলো। বলল, ‘সম্রাট বিলডন লিখেছেন, হলবের শাসক, প্রিয় আল মালেকুস সালেহ। আমি দূতের মাধ্যমে সামান্য উপঢৌকন পাঠালাম। আশা করি গ্রহণ করে আমার বন্ধুত্ব কবুল করে নেবেন। সুলতান আইয়ুবীর বশ্যতা স্বীকার করে নেয়ার পর আমি হলবে সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে পারতাম। কিন্তু আমি আপনার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করার প্রয়োজন বোধ করি না। আপনি আমার বন্ধু ও সন্তানের মত। যখন আপনি শিশু ছিলেন তখন আমি আপনাকে সাহায্য করেছিলাম। আমি জানি বাধ্য হয়েই আপনি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বশ্যতা কবুল করে নিয়েছেন। আমি বলবো, এটা আপনি ঠিকই করেছেন। এতে আপনার বুদ্ধিমত্তা ও দুরদর্শিতাই প্রমাণিত হয়েছে। একজন বিচক্ষণ শাসকের মতই যথাসময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আপনি। আমার দুঃখ হয় গুমাস্তগীন ও সাইফুদ্দিনের জন্য। তারা আপনার সঙ্গে প্রতারণা করেছিল। তারা এত ধূর্ততার সাথে প্রতারণা করেছিল যে, আমি নিজেও তা বুঝতে পারিনি। সেদিন যদি আপনি একা থাকতেন তবে আপনার সৈন্যদের পরাজয় স্বীকার করতে হতো না। গুমাস্তগীন কেমন ধরনের ধোকাবাজ আপনি সময় মত তা বুঝে ফেলেছিলেন বলেই শেষ পর্যন্ত আপনি রক্ষা পেয়ে গেলেন। তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে আপনি যে বিজ্ঞতার প্রমাণ দিলেন তা ইতিহাসে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।

আপনি সেদিন যথার্থই প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। আপনি তাকে হত্যা না করলে সেই আপনাকে খুন করে বসতো। সাইফুদ্দিনও আপনাকে বার বার ধোকা দিয়েছে। সে হলবের উপর আধিপত্য বিস্তার করার মানসেই আপনার সাথে হাত মিলিয়েছিল। আমি তা টের পেয়েই তাকে সাবধান করলাম এবং এমন সংকল্প থেকে দূরে থাকতে বললাম তাকে।

আপনি শেষে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে পরাজিত হলেন। যে কারণে আপনি তার আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। আপনি এতটাই নিরূপায় ছিলেন যে, আপনি ইবনে লাউনের উপর আক্রমণ করার জন্য তাকে সৈন্য দিতে পর্যন্ত বাধ্য হলেন। আমি ভাল করেই জানি, আপনার মত চিন্তাশীল ও বিচক্ষণ যোদ্ধা এমন অপমান সহ্য করতে পারে না।

কিন্তু আপনি ছিলেন একা এবং নিরূপায়। আমিও সর্বদা যুদ্ধে জড়িয়ে থাকার ফলে আপনাকে সাহায্যে করতে পারিনি। এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আইয়ুবী মিশর ফিরে যাওয়ায় আমি নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ পেয়েছি। এখন আমি আপনাকে সবরকম সাহায্য সহযোগিতা দেয়ার মত। অবস্থানে ফিরে এসেছি।

আপনি এমন চিন্তা করবেন না যে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আপনাকে বিনা স্বার্থে স্বায়ত্বশাসন দিয়ে রেখেছেন। এ স্বায়ত্বশাসনের অর্থ আসলে পরাধীনতা। তিনি ধীরে ধীরে আপনাকে গোলামে পরিণত করার চেষ্টা করছেন। আপনাকে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন তার উন্নতির সিড়ি হিসাবে। তিনি ইয়াজুদ্দিনকে সাহায্য করতে গিয়ে আর্মেনীয়দের পরাজিত করেছেন। এক লড়াই দিয়ে দু’জনকেই তিনি তাঁর করুণা পাশে আবদ্ধ করে নিয়েছেন। এভাবে সমস্ত ছোট ছোট রাজ্যের শাসকদের আনুগত্য তিনি আগেই আদায় করে নিয়েছেন এবং এখনো নিচ্ছেন। এখন তার দৃষ্টি হলব, হারান ও মুশেলের দিকে।

একটু চিন্তা করুণ, তিনি আমাদের ওপর বার বার এই বলে আঘাত হানছেন, আমরা তার ধর্মের শক্র। অথচ তিনি যে আল্লাহর এবাদত করেন আমরাও সেই আল্লাহরই উপাসনা করি। আপনিই বলুন, এটা কি জিহাদ না পররাজ্য গ্রাসের উদগ্র লালসা? তারপর ইবনে লাউনের কথা ধরুন। সে তো আর খৃস্টান নয়, তাহলে তার ওপর এ আক্রমণ কেন? আজ ইবনে লাউনের সাথে যুদ্ধ করার নাম করে আপনার আংশিক সৈন্য নিয়েছেন, কাল আমাদের সাথে লড়াই বাঁধলে আপনার সব সৈন্য তিনি চেয়ে বসবেন না এর নিশ্চয়তা কি? এভাবেই আপনার সমস্ত প্রতিরক্ষা শক্তি তিনি একদিন নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। তারপর কেড়ে নেবেন আপনার গদি।

তিনি ইবনে লাউনকে পরাজিত করে আবার মিশরে চলে গেছেন। তার এ চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য আমরা গোয়েন্দা মারফত জানতে পেরেছি। তিনি ইবনে লাউনের কাছ থেকে অফুরন্ত সম্পদ নিয়ে মিশরে ফিরে গেছেন। সেই সম্পদ তিনি তার নিজস্ব খাজানায় রেখে আবার ফিরে আসবেন নতুন করে লুটপাটের আশায়। তিনি আপনাকে কি দিয়েছেন? আপনার সৈন্যদেরকে গনিমতের মালের কত অংশ দিয়েছে। তিনি বার বার জেরুজালেম উদ্ধারের কথা বলেন। কিন্তু তিনি জেরুজালেমের দিকে অভিযান না চালিয়ে কেন ইবনে লাউনের দিকে চালালেন? আপনাকে কি কেউ বলেছে, আর্মেনীয়দের কতটি মেয়ে তিনি সঙ্গে নিয়ে গেছেন?

এ সব প্রশ্নগুলো আপনি ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর উদ্দেশ্য কি তা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করুন তাহলেই বুঝতে পারবেন এ ধুরন্ধর ব্যক্তির নিয়ত ও টার্গেট কি? আপনার সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। আমরা পরস্পর শান্তিতে বসবাস করতে চাই। কিন্তু আইয়ুবী বার বার আমাদের ওপর আঘাত করে আমাদের ঘুম হারাম করে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। কিন্তু আমরা জানি, তিনি কেবল আমাদেরই ক্ষমতাচ্যুত করতে চান না, আমাদের দুর্বল করতে পারলে তিনি কাউকেই রেহাই দেবেন না। রাজ্যলুলোপ এ ব্যক্তির থাবা থেকে আমি বা আপনি আমরা কেউ রেহাই পাবো না। আপাততঃ তিনি আপনাকেও অন্যান্য আমীরদের মত তার থলির বিড়াল বানিয়ে আমাদের সাথে আপনার বন্ধুত্ব খতম করে দিতে চান। আমার লাভের জন্য নয়, বরং আপনার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই বলছি, যদি নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চান তবে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার ব্যবস্থা করুন। নইলে সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন আপনার কোন অস্তিত্বই রাখবেন না তিনি। আমরা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার সকল ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে নিয়েছি। আমাদের দিক থেকে নিরাশ হয়ে গেলে তার পরবর্তী টার্গেট হবেন আপনারা।

যদি আপনি আমার কথা বুঝতে পেরে থাকেন তবে উত্তর দেবেন। যদি আপনি চান তবে আমি আমার উপদেষ্টা পাঠাবো আপনাকে সাহায্য করার জন্য। তিনি আপনার সাথে পরামর্শ করে আপনার প্রয়োজন অনুপাতে যুদ্ধের সামরিক ও আর্থিক সহযোগিতার বিষয়ে আমাকে জানাবেন। আমি উপহার হিসেবে যে ঘোড়াগুলো পাঠিয়েছি সেগুলো নমুনা স্বরূপ আপনাকে দেয়া হয়েছে। আমি আপনার বাহিনীর জন্য এমন শত শত ঘোড়া পাঠাতে পারি। ইউরোপ থেকে আমি নতুন অস্ত্র আমদানী করেছি। চাহিদা মোতাবেক সে অস্ত্রও আপনাকে দেয়া যাবে।

আরেকটি কথা! আপনি সালাহউদ্দিনের সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করবেন না। চুক্তি বহাল রেখে গোপনে আপনার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিন। যে কোন বিপদে এই বন্ধুর কথা স্মরণ রাখবেন। মনে রাখবেন, আমি সব সময় আপনার সঙ্গেই আছি।’

এ চিঠি আল মালেকুস সালেহের মত ক্ষমতালোভীদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। দূত তাকে উস্কে দেয়ার জন্য শোনাল সম্রাট বিলডনের ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর। নব উদ্দীপনায় টগবগ করে উঠল যুবক সালেহের প্রতিটি রক্তকণিকা। দূত তার দক্ষতা ও কৌশল একে একে প্রয়োগ করে চলল এই কল্পনাবিলাসী যুবকের ওপর।

ওদিকে নবীন যুবকের ওপর চলছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুন্দরী যুবতী বশীকরণ বাণ। আর সেই বাণে বিদ্ধ হচ্ছিল আল মালেকুস সালেহ।

আস সালেহ দূতের জন্য এমন আরাম ও আহারের ব্যবস্থা করলেন, যেন দূত নয় বিলডন নিজেই এসেছেন। তারপর নিজেকে সঁপে দিলেন সেই মেয়ের কাছে। তিনি এ মেয়ের মত লাস্যময়ী এবং পুরুষ ঘায়েল করা ছলাকলায় পারদর্শী মেয়ে জীবনে আর দেখেননি। যাদুর প্রভাবের মতই মেয়েটি তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলল। আস সালেহ এই মেয়ের অন্ধ ভক্ত হয়ে গেলেন।

রাতে তার স্বপ্নপুরীতে মেয়েটি যখন প্রবেশ করতো, তখন তার হাতে থাকতো মদের সুরাহী ও পিয়ালা। এগুলোও উপহার হিসাবেই পেয়েছিল সে। মেয়েটি তাকে বললো, ‘এই যে জীবনসুধা দেখছো এ সুধা এতই মূল্যবান যে, সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, ছোটখাট রাজা বাদশাহরাও কোনদিন দেখেনি। খৃস্টান সম্রাটদের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে এ সুধা তৈরী করা হয়। আমাকে সম্রাট বিলডন এ সুধা দিয়ে বললেন, বন্ধুকে বলো, আমার পক্ষ থেকে বন্ধুর জন্য এটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ উপহার!’

‘যাও! এটা শ্রেষ্ঠ উপহার হতে যাবে কেন? শ্রেষ্ঠ উপহার হচ্ছো তুমি।’

‘আমি তো আপনার এক সামান্য দাসী মাত্র। কিন্তু আপনি আপনার এ মহলকে প্রেতপুরী বানিয়ে রেখেছেন কেন? একে স্বপ্নপুরী বানিয়ে তুলুন। রাজ মহলে তো বয়ে যাবে আনন্দের বন্যা। থাকবে শত শত দাসদাসী। সুরম্য প্রাসাদে থাকবে রাণী মহারাণী!’

‘আমার হেরেমের জন্য তুমি একাই যথেষ্ট।’ আল মালেকুস সালেহ জড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘তোমাকে পেয়েই আমার হেরেম ঝলমল করছে। মনে হচ্ছে সর্বত্র আলোর ফোয়ারা ছুটছে।’

‘কি যে বলেন! আপনি অনুমতি দিলে আমি আমার মত মেয়ে দিয়ে আপনার অন্দর মহল পূর্ণ করে দেবো।’ মেয়েটি মদের পিয়ালা তার হাতে তুলে দিয়ে বললো, ‘এ কথা কি সত্যি যে, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর একটাই মাত্র স্ত্রী। তিনি তাঁর হেরেমে অন্য কোন নারীকে ঢুকার অনুমতি দেন না?’

‘হ্যাঁ!’ আস সালেহ উত্তর দিলেন, ‘তুমি ঠিকই শুনেছো। তিনি মদকেও হারাম করে রেখেছেন। নিজেও পান করেন না, অন্য কাউকে পানের অনুমতিও দেন না।’

‘আপনি জানেন কচু। আমার কাছ থেকে শুনুন। তাঁর হেরেমে একটি গোপন কক্ষ আছে। সেখানে অসংখ্য অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে তাঁর রক্ষিতা হিসাবে বসবাস করছে। সেখানে তিনি ছাড়া কারও প্রবেশের অনুমতি নেই। সেখানে মুসলমান মেয়ে যেমন আছে তেমনি আছে বহু ইহুদী ও খৃস্টান মেয়ে। আর মদের কথা বলছেন! সেখানে কোন সাধারণ মদ পাওয়া যায় না। সম্রাটদের জন্য যে বিশেষ সুধা তৈরী হয় তার একটি বড় চালান যথাসময়ে সেই হেরেমে পৌঁছে যায়।’

আল মালেকুস সালেহের মহল অপূর্ব সাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। রংবেরংয়ের বেলুন উড়ছে প্রজাপতির মত। কামরায় খেলা করছে হালকা নীল আলোর প্রস্রবন। ফ্রান্সের শাহী মদের মাতাল করা ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে কামরা। তার মাঝে এক পালঙ্কে পরীর মত বসে আছে এক মেয়ে। মুগ্ধ নয়নে সেদিকে তাকিয়ে আছে এক যুবক। মনে হচ্ছে মোহগ্রস্ত।

যুবক আল মালেকুস সালেহ এগিয়ে গেলেন মেয়েটির দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সোনালী চুলের গভীর অরণ্যে হারিয়ে গেলেন তিনি। পাপের রাত থেকে আবার সোনালী সকাল জন্ম নিল। তখন মেয়েটিকে আস সালেহ বললো, ‘এখানে আমার এক বোন আছে। তুমি কখনো তার সামনে যাবে না। আমি বিয়ে না করে কোন মেয়েকে কাছে রাখি, তা সে পছন্দ করবে না। সুযোগ মত আমি তাকে বলবো, তুমি মুসলমানের মেয়ে। আমার সাথে বিয়ের সম্পর্ক করতেই এসেছো।’

‘আপনার বোনকে স্বাধীনভাবে কেন ছেড়ে দেন না?’ মেয়েটি বললো, ‘তাকে পুরুষের সাথে উঠাবসা করতে দিন। তিনি তো শাহজাদী! আর আপনি বাদশাহ। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কি আপনাদের অন্তর থেকে সব উচ্চাশা ও আভিজাত্যের অনুভূতি কেড়ে নিয়েছেন? সে মেয়ে, তাতে কি হয়েছে? তাকে যদি আমরা কোন পরগণা আলাদা করে দিয়ে তার শাসক বানিয়ে দেই তবে সেও তো এক স্বাধীন সুলতানের মতই রাজ্য শাসন করতে পারবে।’

আল মালেকুস সালেহ এ কথা শুনে আপন খেয়ালেই বাদশাহ হয়ে গেলেন। ভুলে গেলেন সুলতান আইয়ুবীর সাথে তার শর্তের কথা। ভুলে গেলেন তিনি ইসলামী হুকুমতের অধীন এক রাজ্যের সামান্য শাসক মাত্র।

‘কি সংবাদ নিয়ে এসেছো দূত?’ বিলডন মদের নেশায় চুর হয়ে তার দূতকে জিজ্ঞেস করলেন।

‘আপনি কি মনে করেন, আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি।’ দূত বললো, “আল মালেকুস সালেহের মহলে আমি চার দিন রাজ অতিথি ছিলাম। এই চারদিনে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে আমি মনে করি আপনারা বেহুদাই মুসলমানদের ওপর সৈন্য পরিচালনা করেন। আপনাদের এত জীবন ক্ষয় ও ঘোড়া নষ্ট করার কোন কারণ আমার বুঝে আসে না। যে জাতির এক শাসককে মাত্র একটি সুন্দরী দিয়ে ঘায়েল করা যায়, তাদের ওপর এত তীর-ধনুক আর অস্ত্র ব্যবহারের দরকার কি?’

‘তুমি বলছো এক মেয়েতেই কেল্লা ফতেহ! সাবাস নওজোয়ান, সাবাস!’

‘আমার তো মনে হয় ওদেরকে ঘায়েল করতে জ্যান্ত মেয়ে মানুষেরও দরকার নেই। ওদের সামনে শুধু মেয়েদের কিছু বেআব্রু ছবি তুলে ধরতে পারলেই তারা পাপের রাজ্যে হাবুডুবু খেতে দ্বিধা করবে না।’

‘ছি! ছি! পূণ্যবান লোকদের সম্পর্কে এভাবে কথা বলতে নেই। তোমার তো দেখি ভদ্রতা জ্ঞানও লোপ পেয়েছে! কোথায় তোমাকে এক গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে পাঠালাম, এসে তার রিপোর্ট করবে, তা না, তুমি শুরু করলে হেঁয়ালী। আসল কথা বলো, তোমাকে যে কাজে পাঠিয়েছিলাম তার কি করে এসেছো? আমার চিঠির কি জবাব এনেছো?’

‘তিনি লিখিত কোন উত্তর দেননি।’ দূত বললো, ‘তিনি বলেছেন, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দারা চারপাশে ঘুরছে। এমনও হতে পারে, চিঠি ধরা পড়ে গেল, তখন কি হবে? তাই তিনি চিঠির লিখিত জবাব দেননি। তিনি আপনার সব কথা ও পরিকল্পনা মেনে নিয়েছেন। তিনি সালাহউদিন আইয়ুবীর সমর্থক নন বরং তার ভয়ে অনুগত, আপনার এ ধারনাই ঠিক। আইয়ুবীর মোকাবেলায় নিজেকে তিনি বড় একা ও নিঃসঙ্গ অনুভব করেন বলেই তিনি কোন রকম পদক্ষেপ নিতে সাহস করেননি। আপনার চিঠি তাকে যে সাহস ও হিম্মত জুগিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি উপদেষ্টা পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। কিন্তু তিনি আপনাকে এও বলতে বলেছেন, সেই উপদেষ্টা যেনো আরবী পোষাকে এবং বণিকের বেশে যায়। সেখানে তিনি যেন সকলকে বলেন, ‘আমি অমুক মুসলিম অঞ্চল থেকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে এসেছি। অন্যান্য উজির নাজিরদের সাথে তার যেসব কথা ও আলোচনা হবে তাতে ব্যবসায়িক আলোচনাই থাকবে প্রকাশ্যে, অন্য কিছু না। কেবল সুলতান আল মালেকুস সালেহের সাথে একান্ত আলাপের সময়ই তিনি আসল ব্যবসার কথা বলবেন।’

‘বাহবা! তোফা! আমার চিঠি পড়ে তো তার মধ্যে কোন সন্দেহের উদ্রেক হয়নি?’ বিলডন জিজ্ঞেস করলেন।

‘আপনি তাকে যে ইহুদী কন্যা উপহার পাঠিয়েছেন সেই মেয়ে তার মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশ রাখেনি।’ দূত তাকে বললো, আমি যে চারদিন সেখানে অবস্থান করেছিলাম, সে সময়ের মধ্যে আমি তার সেনাপতিদের কয়েকজনের সাথেই আলাদা আলাদা সাক্ষাত করেছি। প্রশাসনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অফিসারের সাথেও দেখা করেছি। তাদের অনেকেই সুলতান আইয়ুবীর সমর্থক। আমি তাদের মধ্য থেকে দু’জনকে বাছাই করে তাদেরকে সুলতান বানানোর প্রস্তাব দিয়েছি। সুলতান হওয়ার জন্য তারা আমাদের যে কোন ফরমায়েশ পালন করার জন্য এক পায়ে খাঁড়া। আমি তাদেরকে আপনার পক্ষ থেকে কিছু আগাম পুরস্কার দিয়ে এসেছি।’

‘সেখানে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দাদের তৎপরতা কেমন?’

‘সেখানে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দারা যথেষ্ট তৎপর। আল মালেকুস সালেহের সাবধানতা অমূলক নয়। আমিও তার সাথে একমত সেখানে কোন তৎপরতা চালাতে হলে তা খুবই গোপন চালাতে হবে।’

‘কিন্তু তুমি যে গেলে ধরা পড়লে না?’

‘তা তো পড়তামই! কিন্তু আমি তো সেখানে আপনার দূত হিসাবে যাইনি। সবাই জানে আমি একজন ঘোড়া ব্যবসায়ী। আল মালেকুস সালেহ চল্লিশটি ঘোড়ার অর্ডার দিয়েছিলেন, আমি সেই চালান পৌঁছে দিয়েছি।’

‘আর মেয়েটিকে কি করে তার হেরেমে ঢুকালে?’

‘মেয়ে কোথায়! ওতো ছিল আমার ঘোড়ার রাখালদের একজন। সেই তো ঘোড়াগুলো রাজমহলে নিয়ে গিয়েছিল।’

‘তাহলে তুমি কি মনে করো, আল মালেকুস সালেহ আমাদের সমর্থন করবেন?’

‘আমি নিশ্চিত। তা ছাড়া মেয়েটিকে আমি ওই দুই জেনারেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি, যাদের সাথে আমার আলাদা আলাদা চুক্তি ও কথা হয়েছে। তারাও আমাদের পক্ষে কাজ করবেন। আপনি আপনার লোক জলদি পাঠিয়ে দিন, বাকী কাজ উনিই সামলে নেবেন।’

এ দূত কেবল দূতই ছিল না, সে ছিল এক ঝানু গোয়েন্দা। মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে সম্যক পারদশী। মানুষের মন ভুলানোর উস্তাদ কারিগর। সে বললো, ‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তার অফিসারদের উপদেশ দেয়, ক্ষমতার মোহ, ধন সম্পদের লোভ এবং নারীর লালসা মানুষকে এমন পাপের সাগরে ডুবিয়ে দেয় যে, এর যে কোন একটি দুর্বলতায় কেউ আক্রান্ত হলে তার ঈমান আমল সবই বরবাদ হয়ে যায়। এ কথা তিনি কেবল তাঁর অফিসারদের বলেন না, সমগ্র মুসলিম সমাজে এ বাণী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি আলেম ও ইমামদেরকে সর্বদা নসিহত করেন। তার এ নসিহত মিথ্যা নয়। কিন্তু তিনি জানেন না, যখন এ তিন রোগের কোন একটি কাউকে ঘায়েল করার জন্য ছুটে যায় তখন সে ব্যক্তির আর সাধ্য থাকে না সুস্থ্য থাকার। সাধারণ মুসলমানের কথা বাদ দিন, যে মাওলানা ও আলেমরা সারাদিন এ ব্যাপারে ওয়াজ করে বেড়ায়, যদি তাদের সামনেও এর কোন একটির পথ খোলাসা করে দেয়া যায়, তখন তার মধ্যেও শুরু হয়ে যায় ভূমিকম্প। তার মজবুত ঈমান টলমল করতে থাকে। সামান্য সময় হয়তো তিনি দোদুল্যমানতায় ভুগতে পারেন। কিন্তু একটা সময় আসে যখন তিনিও সবার অলক্ষ্যে সেই খোলা পথে ছুটে যান। তখন শিকল পরিয়েও তাকে ফিরিয়ে রাখা যায় না। আমার কাছে এমন নজিরও আছে, দিনভর তিনি পর্দার ওয়াজ করেন, কিন্তু রাতের অন্ধকারে তিনিই হয়ে উঠেন অন্য মানুষ। তার ভাবখানা এমন, পৃথিবীর সব মানুষ তার ওয়াজ শুনে ভাল হয়ে যাক, শুধু তার জন্য একটু ভোলা থাক পাপের দরোজা।’

‘এ জন্যই তো সে মানুষ। নইলে ওই ব্যক্তি তো হয় ফেরেশতা হয়ে যেতো নয়তো শয়তান। মানুষের মন এমন এক জিনিস, ভাল হয়ে চলার জন্য তাকে সারাক্ষণ সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু খারাপ হওয়ার জন্য কোন কষ্টই করতে হয় না, শুধু একটু অসতর্ক হলেই চলে। তাহলেই জীবনভর শোনা ওয়াজ নসিহত মুহূর্তে বেকার ও মূল্যহীন হয়ে পড়ে।’ বললেন বিলডন।

এ আলোচনার পর বিলডন বেছে বেছে তিনজন উপদেষ্টা ঠিক করলেন। তাদেরকে বেশুমার বাণিজ্যিক মাল-সামান দিয়ে বহু উটের এক কাফেলা সাজিয়ে হলবের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। নির্দিষ্ট সময় পরে সে কাফেলা এসে হলবে পৌঁছলো। কাফেলা আল মালেকুস সালেহের মহল থেকে কিছু দূরে এক মাঠে তাঁবু গাড়ল। কাফেলার সাথে সেই তিনজন ছাড়াও অনেক কর্মচারী। তারা উটের পিঠ থেকে মাল-সামান নামানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বণিক তিনজনই ছিল আরবী পোষাক পরা। তারা মহলের দিকে যাত্রা করলো।

ফটকের দারোয়ান তাদেরকে থামিয়ে দিল। তারা বলল, ‘আমরা সুলতান আল মালেকুস সালেহ-এর সাথে দেখা করতে চাই।’

‘কেন?’

‘আমরা অমূল্য সব হীরা মানিক ও মূল্যবান তৈজসপত্র নিয়ে এসেছি। এমন মূল্যবান জিনিস রাজা বাদশাহ ছাড়া আর কেউ কিনতে পারে না। তা ছাড়া আমরা হলবের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করতে চাই। এ নিয়েও আমরা কথাবার্তা বলবো।’

গার্ডদের কমাণ্ডার ইবনে খতিব তাদেরকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করলো। তাদের কথায় আগ্রহ দেখিয়ে তাদের সাথে খোলামেলা আলোচনা শুরু করলো। আগন্তুক ব্যবসায়ীরা উৎসাহ সহকারে কমাণ্ডারের আগ্রহ আরে বাড়িয়ে তোলার জন্য তারা কি কি দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী এনেছে তার ফুলানো ফাঁপানো বর্ণনা দিতে শুরু করলো। কমাণ্ডার কথা বলার ছলে আসলে তাদের পরীক্ষা করছিল। সে খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখলো, আগন্তুকদের চোখের রং সবুজ মেশানো নীল। গায়ের রং এবং চেহারাও আরবীদের মত নয়। সে ভাল করেই জানতো, বাণিজ্যিক লেনদেনের ব্যাপারে আলোচনার জন্য সরকারী নিজস্ব বিভাগ আছে, বহিরাগত ব্যবসায়ীরা ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা সেখানেই সেরে নেয়। কখনও কোন উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল এলে সরকারী কর্মকর্তারা যদি মনে করেন সুলতানের সাথে তাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ করানো দরকার, তখনই কেবল তারা বাদশাহর সাথে তাদের দেখা করার ব্যবস্থা করেন। কমাণ্ডার তাদের কথা শুনে বলল, ’আপনারা আমার সাথে আসুন।’

আগন্তুকবৃন্দকে নিয়ে কমাণ্ডার সেন্ট্রিবক্সের ভেতরে এক কামরায় গিয়ে বসল। তারপর তাদের বসতে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এবার আপনারা আপনাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য বলুন!’

‘আমরা তো আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য আপনাকে আগেই খুলে বলেছি!’ এক ব্যবসায়ী বিস্মিত কণ্ঠে বলল।

‘তা বলেছেন। কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি, আপনারা জেরুজালেম থেকে এসেছেন, নাকি আক্রা থেকে?’ ইবনে খতিব জিজ্ঞেস করলো।

‘আমরা সওদাগর বণিক।’ একজন বললো, ‘আমরা প্রত্যেক দেশেই যাই। জেরুজালেমেও যাই, আক্রাতেও যাই। কিন্তু তুমি এভাবে আমাদের সাথে কথা বলছো কেন? মনে হচ্ছে তুমি আমাদের জেরা করছো?’

অন্য এক ব্যবসায়ী বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি কি আমাদের সন্দেহ করছো?’

‘সন্দেহ নয়!’ ইবনে খতিব বললো, ‘আমার বিশ্বাস, আমি আপনাদের তিনজনকে চিনি, কিন্তু আপনারা আমাকে চেনেন না। আমি আপনাদেরই লোক। এখানে আমার নাম ইবনে খতিব হলেও আমার আসল নাম অন্য কিছু। হরমন আমাকে ভালভাবেই জানেন।’

‘হরমন? এ লোক আবার কে?’ কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করে চোখ কপালে তুলল এক ব্যবসায়ী।