» » গোপন বিদ্রোহী

বর্ণাকার
🕮

কায়রো থেকে রওনা দেয়ার তিন দিন পর।

সুলতানের জন্য আলীর দেয়া চিঠি নিয়ে সেনা কমান্ডার দামেশকে পৌঁছলেন। সুলতান আইয়ুবী তখন ‘আর রিস্তান’ এর পর্বতশৃঙ্গে সম্রাট রিমান্ডের ফিরতি বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করছেন।

ঠাণ্ডা একটু বেশিই পড়ছে আজ। তুষারপাত হচ্ছে, বরফ জমেছে পাহাড়ে। সুলতান ও তাঁর সৈন্যরা এরই মাঝে ওঁৎ পেতে বসে আছে।

কায়রো থেকে দামেশক পৌঁছার পথে সেনা অফিসার ও তার রক্ষীরা বলতে গেলে কোথাও তেমন বিশ্রাম নেয়নি। শীতের ঠাণ্ডা ছোট্ট দিন ও দীর্ঘ হিমেল রাতের অধিকাংশ সময় তাদের কেটেছে পথে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে।

দামেশকে যখন পৌঁছলো তখন তাদের জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে, মাথা ঘুরছে, ঘোড়া থেকে পড়ে যায় অবস্থা। তারা দ্রুত আইয়ুবীর কাছে পৌঁছতে চাচ্ছিল। দামেশকের কমান্ডার তাদেরকে জোর করে ধরে পানাহার করিয়ে ‘আর রিস্তানের’ পথ দেখিয়ে দিল।

আল মালেকুস সালেহকে সাহায্য করতে আসা ত্রিপলীর খৃষ্টান রাজা রিমান্ড-এর ফিরতি পথে সুলতান আইয়ুবী ওঁৎ পেতে বসে থাকায় তিনি অন্যপথে সেখান থেকে বেরিয়ে দেশে ফিরে গেলেন। সুলতান খবর পেয়েও রিমান্ডকে ধাওয়া করলেন না।

তিনি রিমান্ডের জন্য রসদপত্র নিয়ে আসা কাফেলার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। রিমান্ড যে ফিরে গেছে এ খবর তারা জানতো না। তারা অপেক্ষা করছিল, রিমান্ড এসে সুলতানের বাঁধা অপসারণ করে তাদের অগ্রযাত্রার পথ নিষ্কণ্টক করবে। কিন্তু কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও রিমান্ডের বাহিনীর কোন তৎপরতা দেখতে না পেয়ে তারা ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছিল। সুলতান আইয়ুবী রিমান্ডের ফিরতি পথে ধাওয়া না করে তার রসদপত্র ও মালসামান দখল বা ধ্বংস করার জন্য একদল কমান্ডোকে পাঠালেন।

শীতকালের বিচ্ছিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। খৃষ্টানদের রসদ সম্ভারের কাফেলা ছিল বিশাল। রাতের বেলা কাফেলার লোকজন ও প্রহরীরা ঠাণ্ডা বাতাস ও বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য রসদ বোজাই ঘোড়াগাড়ীর নিচে আশ্রয় নিল। কমান্ডার বললো, ‘রাতটা কাটুক, কাল ভোরেই আমরা ফিরতি পথ ধরবো।’

প্রহরী ও লোকজন ঘোড়াগাড়ীর নিচে ঘুমিয়েছিল। তারা জানতো না, দিন রাত চব্বিশ ঘন্টাই পাহাড়ের আড়াল থেকে কতকগুলো চোখ তাদের গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখছে। রাতের আঁধারে এই কনকনে ঠাণ্ডা, শীত ও বৃষ্টির মধ্যে কেউ তাদের উপর আক্রমন করবে, এমনটি তারা আশা করেনি।

মধ্য রাতের একটু পর। সহসা তাদের রসদ ক্যাম্পে খুব শোরগোল শোনা গেল। দেখা গেল, চারদিকে মশালের আলো। তাঁবু জ্বলছে।

সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী রাতের আঁধারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওদের ওপর। প্রথমে তারা ছোট মেনজানিক দিয়ে পেট্রোল ভেজা সলতে লাগানো অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করলো। সেই শিখার আলোতে তারা শুরু করলো তীর নিক্ষেপ। পাহাড়ের কোলে একদল দাঁড়িয়ে রইলো বর্শা ও তলোয়ার নিয়ে। তাঁবুতে আগুন লাগায় এবং রাতের অন্ধকারে অতর্কিত আক্রমনে পড়ে ভয়ে বহু খৃষ্টান প্রহরী ও লোকজন ছুটলো পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে লুকানোর জন্য। পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে থাকা আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী বর্শা ও তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের ওপর। এ আক্রমণে বহু প্রহরী হতাহত হলো। বাকীরা প্রাণ নিয়ে ফিরে গেল ময়দানে। পাহাড় থেকে তীর বর্ষণের ধারা অব্যাহত রইল। ময়দানে ফিরে গিয়েও তাই নিস্তার পেল না ওরা। বাধ্য হয়ে মালসামান ও গাড়ি ঘোড়ার আড়াল নিয়ে কেউ কেউ পাল্টা তীর নিক্ষেপ করতে লাগলো।

রাতভর চললো এ লড়াই। সকালে দেখা গেল, দেড় দুই মাইলের মধ্যে ছড়ানো ক্যাম্পে পোড়া তাঁবু, আধপোড়া রসদপত্র, বহু লাশ ও আহত লোক পড়ে আছে। লড়াই করার মত কেউ আর নেই সেখানে।

এ যুদ্ধে অগ্নি গোলার কবল থেকে বেঁচে যাওয়া বিপুল পরিমান রসদ, ঘোড়া ও ঘোড়াগাড়ী সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের হস্তগত হলো।

হলবের অবরোধ উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। সুলতান সেই গুরুত্বপূর্ণ শহরকে আরেকবার অবরোধ করার পরিকল্পনা করলেন।

পরদিন ভোরে কমান্ডো গ্রুপের কমান্ডার সুলতান আইয়ুবীকে যখন গত রাতের আক্রমনের রিপোর্ট দিচ্ছিল তখন তাঁবুতে প্রবেশ করলো এক প্রহরী। সালাম দিয়ে সুলতানকে বললো, ‘কায়রো থেকে একজন ফৌজি অফিসার এসেছেন। গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে এসেছেন তিনি। অবিলম্বে আপনার সাথে সাক্ষাত করার অনুমতি চাচ্ছেন।’

‘কি নাম তার?’

প্রহরী অফিসারের নাম বলতেই সুলতান আইয়ুবী দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন এবং ত্রস্ত পায়ে বাইরে যেতে যেতে বললেন, ‘কই সে?’

খীমার বাইরে দাঁড়িয়েছিল অফিসার। সুলতানকে দেখেই সে সালাম দিল। সুলতান বললেন, ‘কি খবর আরমান? তুমি কি সংবাদ নিয়ে এসেছো! সবকিছু ভাল তো?’

‘খবর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ কমান্ডার বললো, ‘আল্লাহ পাক আমাদের হেফাজত করুন। আলী বিন সুফিয়ান এই চিঠি দিয়েছেন আপনার জন্য।’

সুলতান দ্রুত হাত বাড়িয়ে চিঠি নিলেন এবং কমান্ডারকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। চিঠি পড়া শেষ করে সুলতান গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে গেলেন।

‘এখনও জানা যায়নি, সুদানী সৈন্যরা মিশরের কোথায় আত্মগোপন করে আছে?’ সুলতান আইয়ুবী জিজ্ঞেস করলেন।

‘তদন্ত ও অনুসন্ধানের জন্য চারদিকে সৈন্য পাঠানো হয়েছে। সীমান্তবর্তী পাহাড়ী অঞ্চলেও সৈন্য প্রেরণ করা হয়েছে। আলকিন্দির বেগমের ভাষ্যমতে নীলনদ পার হয়ে হাবশী সৈন্যরা দুর্গম অঞ্চলেই তাদের ঘাঁটি বানিয়েছে বলে মনে হয়।’ কমান্ডার উত্তর দিল।

‘আমার আশংকা ছিল, আমার অনুপস্থিতিতে কোন না কোন একটা বিশৃঙ্খলা ঘটবেই।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তকিউদ্দিনকে বলবে, সে যেন ভীত না হয়। কায়রোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেন আরও শক্তিশালী করে।’

সামান্য বিরতি নিয়ে তিনি আবার বললেন, ‘শুধু প্রতিরক্ষামূলক প্রস্তুতিই এর জন্য যথেষ্ট নয়। তাকে বলবে, সুদক্ষ একদল সৈন্যবাহিনী নিজের কাছে রেখে বাকী সেনা সদস্যদের যেন পাল্টা আক্রমন করার জন্য পৃথক করে ফেলে। তারা শহরেই থাকবে এবং আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ ও প্রতি আক্রমন করবে। এরা যেন বেশী নড়া চড়া না করে এবং শহরের মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি জাহির না করে। যেন শত্রুরা মনে করে আমাদের ফৌজ অপ্রস্তুত এবং তারা আক্রমন করলে সহজেই শহর দখল করতে পারবে।

শহরের বাইরের সেনা ছাউনিতে সৈন্যরা প্রস্তুত থাকবে। শত্রুদের দেখতে পেলেই আক্রমন করবে তাদের। কিছুতেই ওদের শহর অবরোধ করার সুযোগ দেবে না। অবরোধ করার আগেই পাল্টা আক্রমন করে বিতাড়িত করবে।

সবচেয়ে ভাল হয় শত্রুদের আড্ডা খুঁজে পেলে। যদি শত্রুদের আড্ডার সন্ধান পাও তবে অল্প সৈন্য নিয়ে কমান্ডো আক্রমনের মাধ্যমে ওদের ধ্বংস করে দেবে।

সীমান্তে সৈন্য সংখ্যা বাড়াতে বলবে, যাতে শত্রু সৈন্য পালাতে ও প্রবেশ করতে না পারে। আমি ভেবে পাচ্ছিনা, এত সৈন্য সীমান্তে সশস্ত্র প্রহরায় থাকতে কেমন করে সুদানী সৈন্য মিশরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো। কোন না কোন সীমান্ত ফাঁড়িতে ত্রুটি ও অবহেলা আছে। নইলে এমন হওয়া সম্ভব নয়। আলীকে বলবে, সে যেন ওই ফাঁক খুঁজে বের করে। আল্লাহ তোমাদের সফলতা দান করুন।

আরেকটি কথা, শত্রু সৈন্যরা খাদ্য ও সাহায্য ছাড়া যুদ্ধ করতে পারবে না। সীমান্তকে কঠোরভাবে সিল করে রাখবে। ব্যাপকভাবে যুদ্ধ বেঁধে গেলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করবে। তাতে শত্রুরা ক্ষুধায় মারা যাবে। খাদ্য এমন এক অস্ত্র, যার সাথে অন্য কোন অস্ত্রের তুলনাই হয় না।

অধিক সৈন্যের সাথে অধিক সৈন্য নিয়ে সামনাসামনি যুদ্ধ করা মোটেই উচিৎ হবে না।

আমার ধারনা ছিল না, আল কিন্দি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তবুও আমি আশ্চর্য হচ্ছি না, বিশ্বাসঘাতকতা ও বেইমানী করতে কোন সময় লাগে না। ক্ষমতা ও নেতৃত্বের লোভ এমন এক সাপ, যে সাপের ছোবল খেলে মুহূর্তে মানুষের ঈমান মারা যায়। ন্যায়-অন্যায় বোধ নিঃশেষ হয়ে সেখানে জন্ম নেয় প্রবল স্বার্থপরতা। এই লোভ এক ভয়ংকর জিনিস। এই সাপ ততক্ষণ মানুষকে দংশন করতে পারে না, যতক্ষণ কোরআনের আলোকে আলোকিত থাকে কারো হৃদয়। যখন মানুষ কুরআনকে বন্ধ করে নিজের বুদ্ধি বিবেক অনুযায়ী চলতে চায় তখন এমনি হাজারো ভ্রান্তির সাপ ছোবল হানে তার মগজে।

সবচেয়ে আফসোসের বিষয় কি জানো! কেউ একবার লোভের কবলে পড়ে বেঈমান হয়ে গেলে, কোরআনের খোলা পৃষ্ঠাও আর তাকে হেদায়াত দান করে না। সে তখন কোরআন হাতে নিয়েও ইসলামের অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এসব গাদ্দাররা কোরআন হাতে নিয়ে যখন মানুষকে প্রতারিত করে তখনও আল্লাহর ভয়ে, পরকালের ভয়ে তার হৃদয় কাপে না।

আল কিন্দির জন্য আমার বড় আফসোস হচ্ছে। ইসলামের ভবিষ্যত নিয়েও আমি খুবই পেরেশান। আমাদের ভাইয়েরা আজ সামান্য সুখ সুবিধার জন্য খৃষ্টানদের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। সাধারন মুসলমানদের এক বিরাট অংশের মধ্যে কোন চেতনাই নাই। তারা নামাজ পড়ে, রোজা করে অথচ এদিকে যে ইসলামের বারোটা বেজে যাচ্ছে সে খেয়ালই নেই তাদের। ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষায় তাদেরও কিছু করণীয় থাকতে পারে, এ অনুভূতিটুকু যদি ওদের থাকতো তবে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো না।

অন্যদিকে আছে ইসলামের মুখোশধারীদের দল। তারা রাতভর গাছের গোঁড়া কাটে, দিনভর পানি ঢালে সে গাছের গোঁড়ায়। একদিকে ইসলামের বারোটা বাজানোর জন্য শত্রুর ক্রীয়নক হয়ে কাজ করে, অন্যদিকে ভাব দেখায় তারা ইসলামের খুব ভক্ত। লোক দেখনো হাজী হয়, মাজারে সিজদা দিয়ে পড়ে থাকে আর সমস্ত অনৈতিক ও অপকর্মের নেতৃত্ব দিয়ে সমাজে সৃষ্টি করে ফেতনা ফাসাদ।

আজ আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে আমাদের ভাইদের বিরদ্ধে। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ, কিন্তু এই ফেতনার বিরুদ্ধে লড়াই করা সত্যি খুব কঠিন। খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে ডাক দিলে সমাজের প্রতিটি সচেতন মানুষ সে ডাকে সাড়া দেবে, কিন্তু আলকিন্দির বিরুদ্ধে যখন লড়াই করবে তখন ডাক দিলে দেখবে, কিছু মুসলমানের সমর্থন সেও পাবে। কারণ, সে তো আর কাফের নয়! কিন্তু তার এ বিদ্রোহ যে ইসলামের ধ্বংস ও বিনাশ ডেকে আনছে সে কথা অনেকেই বুঝতে পারবে না।

আমাদের নেতা ও সরদার সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গী এ দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেছেন। আমিও শীঘ্রই দুনিয়া থকে বিদায় নেব। তারপর কি হবে? এ প্রশ্নই আমাকে অধীর করে তুলছে।

একটি কথা সব সময় স্মরণ রাখবে, যতক্ষণ বেঁচে থাকবো ইসলামের জন্যই বেঁচে থাকবো, আর মরতে হলেও ইসলামের জন্যই মরবো, এই আমাদের শপথ, এই আমাদের পণ। এ শপথের কথা কখনো বিস্মৃত হয়ো না। নিয়মিত সব সংবাদ আমাকে পৌঁছে দিও। আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন।’ আলীর পাঠানো সামরিক অফিসার সুলতানের উপদেশ ও নির্দেশ নিয়ে বিদায় নিলেন।

মিশরের সৈন্যরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা হন্য হয়ে খুঁজে ফিরছিল শত্রুদের আড্ডা। তারা কায়রোর আশেপাশে শত্রুদের খোঁজে ফিরছে, সে সময় তাদের সীমান্ত ফাঁড়ির কমান্ডার শত্রুদের হাতে বন্দী, তার সঙ্গে বন্দী জোহরা নামের এক মেয়ে।

কয়েকদিন ধরে কমান্ডার নিখোঁজ। সহকারী কমান্ডার চিন্তায় পড়ে গেল। পাশের ফাঁড়ি ও আশেপাশে খোঁজ খবর করে কোনই হদিশ পেল না। এভাবে কাউকে কিছু না বলে কমান্ডার উধাও হয়ে যাওয়া কোন সাধারন ঘটনা নয়। সহকারী কমান্ডার দ্রুত এক সিপাইকে এ খবর দিয়ে কায়রো পাঠিয়ে দিল।

কাসেদ কায়রো গিয়ে জানালো, ‘আমাদের ফাঁড়ির কমান্ডার কয়েকদিন যাবৎ নিখোঁজ রয়েছেন।’ সে আরো জানালো, ‘কিছুদিন আগে আমাদের ফাঁড়িতে নাচ গানের আসর বসেছিল। এক নর্তকী কমান্ডারের তাঁবুতে রাত কাটায়। তারপর পাশের ফাঁড়িতেও তারা নাচ গানের আসর বসায়। সেখানে মেহমান হিসাবে গিয়েছিল আমাদের কমান্ডার।

এরপরও দুই রাত সেই নর্তকী আমাদের কমান্ডারের ওখানে আসে। সেই নর্তকীর সাথে এক রাতে কমান্ডার বেরিয়ে যায়, কিন্তু আর ফিরে আসেনি। কয়েকদিন হয়ে গেলো, কমান্ডারের কোন খোঁজ না পেয়ে সহকারী কমান্ডার আমাকে এ খবর দিয়ে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছে।’

এ সংবাদে সবার সন্দেহ হলো, নিশ্চয় কমান্ডার শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়েছে আর তারই সাহায্যে শত্রুরা মিশরে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছে।

আলী বিন সুফিয়ান বললো, ‘যেহেতু ফাঁড়িটি নদী পথ পাহারা দেয়ার জন্যই খোলা হয়েছে, এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, শত্রুরা নদী পথে জমা হয়েছে।’

সিদ্ধান্ত হলো, কোন এক দূরদর্শী ও চালাক কমান্ডারকে সেখানে পাঠানো হবে। তার সাথে যাবে একটি রক্ষী দল। ওরাই ওখানকার সীমান্ত পাহারার দায়িত্ব পালন করবে।

কমান্ডার ও জোহরাকে হাবশীদের ধর্মীয় নেতার হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। কার্যত তারা বন্দী থাকলেও ধর্মীয় নেতা তাদের সাথে খুবই সদয় ব্যবহার করছিল। হাবশীদের ব্যবহারে তারা যে বন্দী সেটা বুঝা যাচ্ছিল না।

তাদের পাখির রং-বেরংয়ের পালকে সাজানো পোশাক পরতে দেয়া হলো। ফুল ও পালক দিয়ে সাজানো হলো তাদের কামরাটি। উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হতো তাদের। হাবশীদের নেতা তাদের সামনে সিজদায় পড়ে গিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র পাঠ করতো। সাধারন হাবশীদের কোন সুযোগ ছিল না তাদের সামনে আসার।

একদিন তাদেরকে গাছের ডাল-পাতা দিয়ে বানানো পালকিতে করে নদীতে গোছল করাতে নিয়ে গেল। দু’জনই জানতো, কেন তাদের এত আদর যত্ন করা হচ্ছে। কিন্তু কবে তাদের ‘বলী’ দেয়া হবে এটা তাদের জানা ছিল না।

রাতে যখন তারা নির্জন কামরায় ঘুমিয়ে থাকতো তখনো বাইরে আট দশজন হাবশী পাহারায় থাকতো সে কামরার। কমান্ডার রাতে উঠে বাইরে তাকিয়ে দেখতো পালানোর কোন সুযোগ আছে কিনা। কিন্তু যতবারই সে বাইরে তাকিয়েছে ততবারই একরাশ হতাশা তার সব আশা আকাঙ্ক্ষা গুড়িয়ে দিয়েছে। পালানোর কোন সুযোগ বা সম্ভাবনা মোটেই ছিল না সেখানে।

এক রাতে হাবশীদের দু’জন ধর্মীয় নেতা কামরায় প্রবেশ করলো। কমান্ডার ও জোহরা দু’জনই তখন গভীর ঘুমে বিভোর। তাদেরকে ঘুম থেকে জাগানো হলো। তারা বুঝতে পারলো, তাদের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে।

ধর্মীয় নেতারা তাদের সামনে সিজদায় পড়ে গেল। সিজদা থেকে উঠে তাদেরকে নিয়ে গেল বাইরে। বাইরে দুটো সুসজ্জিত পালকি রাখা। ধর্মীয় নেতারা এক পালকিতে কমান্ডার ও অপর পালকিতে জোহরাকে বসিয়ে দিল।

চার বেহারার পালকি। কমান্ডার ও জোহরা পালকিতে চড়ে বসতেই বেহারারা গুন গুন করে গান গাচ্ছিল। প্রতিটি পালকির পেছনেই বর্শা হাতে চলছে দু’জন করে হাবশী প্রহরী।

কমান্ডার ও জোহরা একদম নীরব। সুবোধ বালকের মত ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশ মেনে চলছে।

পাহাড়ী এলাকা থেকে বের হয়ে পালকি যাচ্ছিল নদীর দিকে। কমান্ডার দেখলো, আকাশের চাঁদ পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে। বুঝলো, অর্ধেকের বেশী পার হয়ে গেছে রাত।

নদীর পাড়ে গিয়ে বেহারারা পালকি নামালো। ধর্মীয় নেতা পালকি থেকে কমান্ডার ও জোহরাকে নামিয়ে তাদের পোশাক পাল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সবাইকে নির্দেশ দিল, ‘পোশাক পাল্টাবার সময় কেউ ওদের দিকে তাকাবে না।’

চাঁদের আলোয় কমান্ডার দেখলো, বর্শাধারী দুই রক্ষী ও পালকির হাবশী বেহারারা তাদের দিকে পিছন ফিরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। ধর্মীয় নেতার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে তারা।

এই সুযোগ, কমান্ডার বাঘের মত লাফিয়ে চোখের পলকে এক হাবশীর বর্শা কেড়ে নিয়ে সেই বর্শা তার বুকে বিদ্ধ করলো। তারপর মুহূর্তের মধ্যেই তা টেনে বের করে আঘাত করলো পাশের বর্শাধারীকে।

মুহূর্তের মধ্যে দুই প্রহরী ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। এরপর কমান্ডার জোহরার রক্ষীদের একজনকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল বর্শা। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ‘জোহরা, পালাও।’

ঘটনা এত আকস্মিক ও অভাবিত ছিল যে, কেউ এরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। কমান্ডারের আচরণ ছিল খুবই স্বাভাবিক, হাবশীরা ধারনা ও করতে পারেনি, সে এমন মারমুখী হয়ে যাবে। তাই তারা কিছু বুঝে উঠার আগেই সে তিনজন প্রহরীকে ধরাশায়ী করে অন্য একটি বর্শা কুড়িয়ে নিতে গেল। একজন দক্ষ সৈনিক ও কমান্ডারের দক্ষতা, ক্ষীপ্রতা, সাহসিকতা ও বুদ্ধির দীপ্তি প্রকাশ পাচ্ছিল তার প্রতিটি নড়াচড়ায়।

কমান্ডারের চিৎকার শুনেই জোহরা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তার দিকে। একই সাথে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল অন্য সবাই। বর্শাধারী বর্শা উঁচিয়ে ছুটে গেল কমান্ডারকে আঘাত করতে। জোহরা তার পাশে পড়ে যাওয়া প্রহরীর বর্শা তুলে নিয়ে ছুটল প্রহরীর পেছনে। কমান্ডার বর্শা উঠিয়েই দেখতে পেল ওদের। সে হাতের বর্শা দিয়ে ঠেকিয়ে দিল প্রহরীর আঘাত। প্রহরী দ্বিতীয়বার আঘাত করার করার সুযোগ পেল না, জোহরার হাতের বর্শা প্রহরীর পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে বেরিয়ে গেল।

কমান্ডার বললো, ‘সাবাশ জোহরা সাবাশ! বর্শা হাতে তোমাকে এক মহীয়সী যোদ্ধার মতই লাগছে।’

যদিও ওরা মাত্র দু’জন এবং প্রতিপক্ষে এখনো দশজন জীবিত, কিন্তু ওই দশজনই নিরস্ত্র। অস্ত্রধারী চার প্রহরীর করুন মৃত্যুর বিভীষিকা তাদের চোখে মুখে।

ধর্মগুরু দু’জন চিৎকার দিয়ে বললো, ‘দেবতার দোহাই! ওদের পালাতে দিওনা। ধরো, ধরো ওদের!’

কিন্তু ওই চিৎকার পর্যন্তই, তারা নিজেরাও এগিয়ে এলো না, আর তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বেহারারাও এগিয়ে এলো না। একদিকে খালি হাতে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দশজন নিরস্ত্র মানুষ, অন্যদিকে বর্শা উঁচিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরুষ ও এক নারী।

কেউ কারো দিকে এগিয়ে গেল না, নিরাপদ দুরত্বে দুই দল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

কয়েকটি নিস্তব্ধ মুহূর্ত পার হলো ঘটনাবিহীন। হঠাৎ হাবশীদের ধর্মীয় দুই নেতা পিছন ফিরে দে ছুট। পড়িমড়ি করে পালাতে লাগলো ওরা। তাদের দেখাদেখি ছুটল বেহারারাও।

কমান্ডার তাদের বেশিদূর যেতে দিল না, বর্শা হাতে ছুটলো তাদের পিছনে। জোহরাও দৌড় দিল তার দেখাদেখি। দু’জন ধর্মীয় নেতাই নিহত হলো। মারা গেল বেহারাদের দু’জন। বাকীরা নদীর পাড়ে জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে পড়লো। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাদের পাওয়া গেল না। কমান্ডার দ্রুত জোহরাকে নিয়ে ছুটল তাদের ফাঁড়ির দিকে। কিছু দূর এগুতেই দেখতে পেল দুই টহল প্রহরী ঘোড়ার পিঠে চড়ে পাহারা দিতে দিতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। কমান্ডার চিৎকার করে বললো, ‘জলদী এদিকে এসো।’

প্রহরী কমান্ডারের ডাক চিনতে পারলো। দ্রুত ছুটে এলো ওরা। কমান্ডার ওদেরকে বললো, ‘তোমাদের ঘোড়া আমাদের দাও, আমরা এখান থেকেই কায়রো রওনা হয়ে যাবো। তোমরা দু’জন ফাঁড়িতে গিয়ে নতুন ঘোড়া নিয়ে এসো। কেউ খোঁজ করলে বলবে, তোমরা আমাদের দেখোনি।’ প্রহরী বললো, ‘এ কয়দিন কোথায় ছিলেন আপনারা? এদিকে আমরা আপনাদের খোঁজে হয়রান!’

‘এ সব কথা পরে শোনো। এখন ফাঁড়িতে ফিরে যাও।’

প্রহরী দু’জন পায়ে হেঁটে রওনা দিল ক্যাম্পের দিকে। কমান্ডার ও জোহরা আলাদা আলাদা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলো। কমান্ডার জোহরাকে বললো, ‘খুব দ্রুত ছুটতে হবে। ভয় পেয়ো না, ঘোড়া তোমাকে ফেলে দেবে না, ভয়ের কোন কারণ নেই।’

ঘোড়া তাড়া করলো কমান্ডার। কমান্ডারের ঘোড়া যখন প্রচণ্ড জোরে ছুটতে শুরু করলো, জোহরা সে ঘোড়ার গতি দেখেই ভয়ে চিৎকার করে উঠলো।

কমান্ডার ঘোড়া থামিয়ে ফিরে এলো জোহরার কাছে। তারপর জোহরাকে নিজের ঘোড়ার ওপর বসিয়ে জোহরার ঘোড়ার লাগাম তার ঘোড়ার সাথে বেঁধে নিল। জোহরাকে বললো, ‘শক্ত করে আমার কোমর ধরে থাকো।’

অশ্ব আবার পূর্ণ উদ্যমে ছুটে চললো। কমান্ডার পাহাড়ী এলাকা থেকে বহু দূরে দিয়ে ছুটে চললো কায়রোর দিকে। কায়রোর পথ তার নখদর্পণে। তখনো তারা দুই মাইল পথও অতিক্রম করেনি, একদিক থেকে আওয়াজ এলো, ‘দাঁড়াও থামো! তোমরা কে?’

কমান্ডার থামলো না, ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে ছুটলো আরো জোরে। সাথে সাথেই চারটি ঘোড়া তাদের পিছু নিলো। কমান্ডার তার ঘোড়ার গতি আরও বাড়িয়ে দিতে চাইল, কিন্তু ঘোড়া দুই সওয়ারী নিয়ে এরচেয়ে জোরে আর চলতে পারছিল না। কমান্ডার চেষ্টা করলো, অন্য ঘোড়ায় চড়ে বসতে। কারণ সে এতক্ষণ বাহন ছাড়া থাকায় কম ক্লান্ত ছিল। কিন্তু জোহরাকে নিয়ে অন্য ঘোড়ার পিঠে যাওয়াও সম্ভব ছিল না।

চাঁদ মাথার ওপর থেকে আরো হেলে পড়েছে। চাঁদের সেই ম্লান আলোতেও বহু দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। চারটি ঘোড়াই তাদের খুব কাছাকাছি চলে এলো।

দুটি তীর ছুটে এসে কমান্ডারের পাশ কেটে চলে গেল সামনে। সাথে সাথে আওয়াজ এলো, ‘যদি না থামো তো তীর তোমার মাথার মগজে ঢুকে যাবে।’

কমান্ডারের মাথায় তখন একটাই ভাবনা, যদি থামি তবে মৃত্যু অবধারিত। এ লোকেরা নিশ্চয়ই আমাদের হাবশীদের হাতে তুলে দেবে। হাবশীরা আমাদের হাতে পেলে আজ রাতেই বলী দিয়ে দেবে ওদের দেবতার সামনে। সুতরাং ধরা দেয়ার চাইতে পালানোই উত্তম। তাতে কিছুটা হলেও বাঁচার সম্ভাবনা থাকতে পারে।

সে ঘোড়া ডানে বায়ে ঘুরিয়ে চালাতে লাগলো যাতে তীর লক্ষ্যচুত হয়। কিন্তু এটা ছিল তার মস্তবড় ভুল। ধাওয়াকারীরা এর ফলে দ্রুত তাদের দুরত্ব কমিয়ে আনতে সক্ষম হলো। শেষে তারা এতটা কাছে এসে পড়লো যে, কমান্ডার ও জোহরা তাদের ঘেরের মধ্যে পড়ে গেল।

কমান্ডারের গায়ে তখনো বিভিন্ন রঙয়ের পাখীর পালকের বিচিত্র পোশাক। জোহরারও তাই।

ঘেরাওকারীরা ওদের এই বিচিত্র পোশাক দেখে অবাক হলো। ও যে মিশরীয় বাহিনীর এক কমান্ডার পোশাক দেখে তা বোঝার কোন উপায় ছিল না। ফলে কমান্ডারকে চিনতে পারল না ওরা।

একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা কে?’

অপরজন বললো, ‘কি জিজ্ঞেস করছো? দেখছোনা না এরা সুদানী, কেমন অদ্ভুত পোশাক পরে আছে?’

তাদের কোথায় ভুল ভাঙল কমান্ডারের। সে হেসে বললো, ‘বন্ধুগন, আমি তোমাদের বাহিনীর এক কমান্ডার।’

তারপর সে জোহরার পরিচয় দিলো এবং সমস্ত ঘটনা ওদের খুলে বললো।

এ চারজন মিশরীয় সৈন্য শত্রুসেনা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সুদানী সৈন্যরা কোথায় লুকিয়ে আছে এবং তাদের আস্তানা কোথায় তা খুঁজে বের করার জন্য যেসব দল চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদেরই একটা দল এরা। তারা কমান্ডার ও জোহরাকে সঙ্গে নিয়ে কায়রোর দিকে যাত্রা করলো।

দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম করে পরের দিন তারা কায়রো গিয়ে পৌঁছলো।

প্রথমেই তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো আলী বিন সুফিয়ানের কাছে। আলী কমান্ডারের কাছ থেকে পুরো কাহিনী শুনে ওদের নিয়ে গেলেন সুলতান তকিউদ্দিনের কাছে।

তকিউদ্দিন কে তারা জানালো, ‘প্রায় দশ হাজার সুদানী হাবশী সৈন্য আবু সাম্বালের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে লুকিয়ে আছে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে সেনাপতি আলকিন্দি।’

তকিউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে সেনা বাহিনীর একটি দলকে সেখানে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিলেন।

সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধ পদ্ধতি অনুযায়ী প্রথমে অশ্বারোহী বাহিনীকে রাখা হলো। এ বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কম। তাদের দুই পাশে ও পিছনে রাখা হলো আরো তিনটি দলকে। এদের পেছনে রাখা হলো মূল ফোর্স। সবার পেছনে সংরক্ষিত রিজার্ভ বাহিনী।

তাদের জানা ছিল, আবু সাম্বালের পাহাড়ী এলাকাটা বেশ বিস্তৃত। এলাকাটা কেবল দুর্গম নয়, অঞ্চলটা বেশ দুর্ভেদ্য। যাত্রার সময় তকিউদ্দিন সেনাবাহিনীকে বললেন, ‘কেল্লা অবরোধের মত তোমরা পুরো এলাকা ঘেরাও করে ফেলবে। সঙ্গে কমান্ডো বাহিনী নিয়ে রওনা হচ্ছি আমি। পাহাড়ের ওপর ওরাই উঠবে।’

কমান্ডো বাহিনীকে নিজের কমান্ডে নিয়ে আলকিন্দিকে শায়েস্তা করার জন্য রওনা হয়ে গেলেন সুলতান তকিউদ্দিন।

ভোর পর্যন্ত ভয়ে জঙ্গলে লুকানো ছয় বেহারার কেউ আর নড়াচড়া করার সাহস পায়নি। যখন ভোর হলো, জঙ্গল থেকে বের হয়ে ছুটল পাহাড়ের দিকে। ওখানে পৌঁছে সোজা গিয়ে ঢুকলো আলকিন্দির কামরায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো সব ঘটনা।

আল কিন্দি সঙ্গে সঙ্গে সুদানী ও খৃষ্টান উপদেষ্টাদের খবর দিল তার কামরায় আসার জন্য। সব শুনে খৃষ্টান উপদেষ্টারা বললো, ‘হাবশীদের কাছ থেকে এ খবর গোপন রাখতে হবে।’

তারপর উপদেষ্টাদের নিয়ে আলকিন্দি চললো ঘটনাস্থলে। সঙ্গে নিল সেই ছয় বেহারাকে। নদীর পাড়ে পৌঁছলো ক্ষুদ্র দলটি। দুই ধর্মীয় নেতা, চারজন প্রহরী ও দুই বেহারার লাশ পড়েছিল সেখানে।

সবাই লাশের দিকে তাকিয়ে আছে, এক বেহারা বললো, ‘কমান্ডার যে এমন বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের ওপর, আমরা কেউ তা ভাবতেও পারিনি।’

‘কমান্ডার! কোন কমান্ডার?’ আলকিন্দি বিস্মিত হয়ে বললো।

‘যাকে বলী দেয়ার জন্য আনা হয়েছিল, সে ওই পাশের ক্যাম্পের সেনা কমান্ডার। নর্তকীসহ তাকেই তো ধরেছিল আমাদের লোকেরা!’

‘এখন কোথায় সে?’

‘আমাদের প্রহরীর হাত থেকে বর্শা কেড়ে নিয়ে আটজন লোককে হত্যা করে মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’

ভীষণ চমকে উঠলো আলকিন্দি। বললো, ‘বলো কি! সে তো আমাকে দেখে ফেলেছে! আমি তাকে খেয়াল না করলেও সে নিশ্চয় আমাকে ভাল করে দেখেছে এবং আমাকে চিনে ফেলেছে। এখন উপায়?’

‘ঘাবড়াচ্ছেন কেন? এত মারামারির পর নিশ্চয়ই সে ক্লান্ত হয়ে কোথাও লুকিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমাদের যে শক্তি সে দেখেছে তাতে গর্ত থেকে সহসা সে মুখ বের করবে বলে মনে হয় না।’ বললো এক খৃষ্টান উপদেষ্টা।

‘আপনি তাকে চেনেন না! সে এক মুহূর্তও কোথাও বিশ্রাম নেবে না। সোজা ছুটে যাবে কায়রো। খোঁজ নিয়ে দেখুন, ইতিমধ্যে সে কায়রোর অনেক পথ এগিয়ে গেছে।’

‘ঠিক আছে, আপনার সন্দেহ কতটুকু সত্যি, ফাঁড়িতে খোঁজ নিলেই জানা যাবে।’

আল কিন্দি বললো, ‘এখন তাঁকে ফাঁড়িতে গিয়ে খোঁজ করা বৃথা। বেহুদা সময় নষ্ট করার কোন অবকাশ নেই আমাদের। আমরা সবার অজান্তে কায়রোতে আক্রমন চালানোর আশা করেছিলাম, কিন্তু আমরা বড্ড দেরী করে ফেলেছি। আক্রমণ করতে হলে এখনই করতে হবে, নইলে আমরা আমাদের অজান্তেই মারা পড়ে যাবো। আমি আমার সেনাবাহিনীর অবস্থা জানি, তারা আমাদের আস্তানার সন্ধান পেলে বাজপাখীর মত উড়ে এসে টুটে পড়বে আমাদের ওপর।’

উপদেষ্টারা বেহারা ছয়জনকে বললো, ‘তোমরা এক কাজ করো, দ্রুত হাবশীদের লাশগুলো নদীতে ভাসিয়ে দাও। যদি হাবশীরা জেনে যায় যে, তাদের ধর্মীয় নেতা ও তাদের রক্ষীরা মারা গেছে, তবে হাবশীরা কায়রো যাওয়ার পরিবর্তে সোজা খারতুম রওনা দেবে।’

আরেক উপদেষ্টা বললো, ‘আমরা এখান থেকে ফিরেই হাবশীদের সামনে ঘোষণা করবো, দেবতার নির্দেশে নীলনদের পাড়ে বলীদান অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। দেবতা হুকুম দিয়েছে, অবিলম্বে শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালাতে।’

তারা ছয় বেহারাকে বললো, ‘খবরদার! কোন হাবশী যদি আসল ঘটনা জানতে পাড়ে তবে তোমাদের গর্দান উড়িয়ে দেয়া হবে।’

অন্য একজন বললো, ‘উড়িয়ে দেয়া হবে কি, এখনি উড়িয়ে দাও, যাতে কোন ভয় না থাকে।’

বেহারারা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বললো, ‘আপনারা আমাদের মা-বাপ। দেবতার কসম, আমরা এ কথা কাউকে বলবো না। যদি বলি তো আমাদের এবং আমাদের বউ-বেটিদেরও আপনাদের হাওলা করে দেবো।’

আল কিন্দি উপদেষ্টাদের নিয়ে আস্তানায় ফিরে গেল। জরুরী সংকেত বাজিয়ে সব হাশীদের সমবেত করা হলো মাঠে। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আলকিন্দি ঘোষণা করলো, ‘দেবতার ইচ্ছামত কাল রাতে একজন পুরুষ ও একটি নারীকে নীলনদের পাড়ে বলী দেয়া হয়েছে। দেবতা সন্তুষ্ট হয়ে আজই আমাদেরকে যুদ্ধ যাত্রা করার নির্দেশ দিয়েছে। তোমাদেরকে একঘণ্টা সময় দেয়া হলো। যারা দেখতে চাও নদীর পাড়ে গিয়ে দেখে আসতে পারো দেবতা বলী গ্রহন করেছেন কি না। ওখান থেকে ফিরেই তোমরা যার যার হাতিয়ার নিয়ে নিজ নিজ দলে শামিল হয়ে যাবে যুদ্ধে রওনা হওয়ার জন্য।’