গুমাস্তগীন খাওয়া দাওয়া শেষে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। একটু পর সেখানে প্রবেশ করলো মান্নানের এক নিরাপত্তা প্রহরী। জিজ্ঞেস করলো, “আজ যে চারজন কমান্ডোকে ধরে আনা হয়েছে তাদের সম্পর্কে আপনার আদেশ কি?’
‘হারানের শাসক গুমাস্তগীন এসেছেন।’ শেখ মান্নান বললো, ‘তিনি তাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। তোমরা তাদের আহারাদি ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করো। কিন্তু তাদেরকে কোথায় পাঠানো হচ্ছে, তা ওদের বলার দরকার নেই।’
প্রহরী চলে গেল। সে আন নাসের ও তার সঙ্গীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করলো। খাবারের সামগ্রী তাদের সামনে দেয়ার পর আন নাসের খাবার খেতে অস্বীকার করে বললো, ‘এ খাবার আমরা গ্রহণ করবো না, নিশ্চয়ই এতে হাশিশ মিশানো আছে।’
আন নাসের ও তার সাথীদের এমন সন্দেহের সঙ্গত কারণও ছিল। কারণ তাদের সামনে যে খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল, তা ছিল উন্নতমানের শাহী খাবার। এমন খাবার সচরাচর সাধারণ লোকে খায় না। বন্দীদের জন্য এমন খাবারের ব্যবস্থা করার তো প্রশ্নই উঠে না।
প্রহরী অনেক কষ্টে তাদের বুঝলো যে, এতে কিছু মিশানো হয়নি। কেল্লায় শাহী মেহমান এসেছেন। তাদের সম্মানে এ রান্নার আয়োজন করা হয়। অনেক করে বুঝানোর পর আন নাসের ও তার সাথীরা এ খাবারই খেতে রাজি হয়ে গেল, কারণ এমনিতেই তারা ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছিল।
শেখ মান্নান কারিশমাকে বললো, ‘তুমি চলে যাও, লিজা এখানেই থাকুক।’
কারিশমা বললো, ‘সে গত তিন চার দিন অনবরত সফরে ছিল, এখন তার বিশ্রাম দরকার। আজকের মত ওকে তার কামরায় যেতে দিন।’
শেখ মান্নানের মধ্যে তখন পশুত্ব জেগে উঠেছে। সে কারিশমার আবদারের তোয়াক্কা না করে হাত বাড়ালো লিজার দিকে। তাকে ধরে টানা-হেঁচড়া করতে লাগলো। লিজার মনে পড়ে গেলো কারিশমার অনুরোধ, ফলে সে তেমন জোরালো ভাবে বাঁধা দিতে পারছিল না। সে একেবেঁকে তার কবল থেকে মুক্ত হওয়ার কৌশল খুঁজতে লাগলো।
মান্নান হাত দিয়ে টানাটানি করছে, পাশে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মত এই অসভ্যতা দেখছে কারিশমা। লিজার মেজাজ ও চেহারা বিগড়ে গেছে ক্ষোভে। হঠাৎ কামরার দরজা খুলে গেল। দারোয়ান বললো, ‘এক আগন্তুক আপনার সাথে দেখা করতে চায়।’
শেখ মান্নান রাগের সাথে বললো, ‘গর্দভ, এটা কি কারো সাথে সাক্ষাতের সময় ভাগো এখান …..।’
শেখ মান্নানের কথা তখনো শেষ হয়নি, দরজা ঠেলে অনুমতি ছাড়াই ভেতরে ঢুকলো এক আগন্তুক। দারোয়ানকে এক পাশে সরিয়ে মুখোমুখি হলো শেখ মান্নানের। বিস্মিত শেখ মান্নান, লিজা ও কারিশমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আগন্তুকের দিকে।
❀ ❀ ❀
সে লোকটি ছিল এক খৃষ্টান ক্রুসেডার। সে যেই মাত্র কামরায় প্রবেশ করলো সঙ্গে সঙ্গে শেখ মান্নান তাকে চিনতে পেরে তার নাম ধরে উৎসাহের সাথে বলে উঠলো, আরে তুমি!
আগন্তুক হাত বাড়িয়ে দিল, শেখ মান্নান সে হাত লুফে নিয়ে বললো, ‘কখন এলে?’
‘এই মাত্র।’
“ঠিক আছে। এখন তাহলে গিয়ে বিশ্রাম করো, সকালে তোমার সাথে আলাপ হবে।’
‘আমি হয়তো সকালেই আপনার সাথে দেখা করতাম।’ ক্রুসেডার বললো, ‘কিন্তু এখানে এসেই জানতে পারলাম, এখানে আমাদের দুটি মেয়ে এসেছে। তাদের সাথে আমার জরুরী আলাপ আছে। আমি ওদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এসেছি।’
‘ঠিক আছে তোমার লোক তুমি নেবে এতে আমার আপত্তির কি আছে। এখন গিয়ে বিশ্রাম করো, সকালে আমি ওদেরকে তোমার কাছে পৌঁছে দেবো।’
‘না।’ ক্রুসেডার প্রবল আপত্তি তুলে বললো, ‘ওদেরকে আমার এখনি দরকার।’
শেখ মান্নানের আঁতে ঘা লাগলো। সে এ কেল্লার সর্বাধিনায়কই শুধু নয়, সারা দেশের ফেদাইনদেরও নেতা। যে ফেদাইনদের নাম শুনলে শিউরে উঠে আমীর ওমরা ও অভিজাত মানুষের বুক। গুপ্তহত্যার মত নিষ্ঠুর কাজে যাদের কোন জুড়ি নেই। সে কিছুটা ক্ষোভের সাথেই বললো, ‘কি এমন জরুরী বিষয় যে, এখন, এই মুহূর্তেই তা বলতে হবে। যদি এতোই জরুরী হয় তাহলে এখানে বসেই আলাপ শুরু করো না কেন?’
খৃস্টান ক্রুসেডারদের তখন দাপটই ভিন্ন। ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যের শাসক বা ফেদাইনদের মত খুনী ও সন্ত্রাসীরা তাদের অনুকম্পার ভিখারী। সে শেখ মান্নানের কথা গায়ে না মেখে ক্ষমতার দাপট জাহির করে বললো, ‘শেখ মান্নান, তুমি ভাল করেই জানো আমি কি রকম ব্যস্ত। আর তুমি এ কথাও জানো, এই মেয়েদের দায়িত্ব কি? তোমার কোলের কাছে বসে থাকা এদের দায়িত্ব নয়। আমি ওদের সাথে কি আলাপ করতে চাই তা এ মুহূর্তে তোমার না জানলেও চলবে। এখন আমি এই দু’জনকে নিয়ে যাই। তোমার আর কিছু বলার আছে?’
শেষ মান্নানকে এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার সুযোগ না দিয়েই ক্রুসেডার মেয়ে দুটিকে বললো, ‘এসো তোমরা, চলো আমার সঙ্গে।’
লিজা ও কারিশমা দুজনেই দ্রুত আগন্তুকের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
“তুমি কি আমার সাথে শত্রুতা সৃষ্টি করতে চাও?’ শেখ মান্নান বললো, ‘তুমি এখনও আমার কেল্লার মধ্যে। আমি ইচ্ছে করলে তোমাকে অতিথি থেকে কয়েদী বানিয়ে দিতে পারি। তুমি কি তাই চাও? মেহমান না হয়ে বন্দী হতে চাচ্ছো তুমি?’ সে গর্জন করে বললো, ‘মেয়েটাকে আমার কাছে রেখে তুমি এখন বাইরে চলে যাও।’
‘মান্নান!’ খৃষ্টান লোকটি দাঁতে দাঁত চেপে রাগে গর্জন করে বললো, ‘তুমি কি আসলেই ভুলে গেছে, এ কেল্লা তোমাকে আমরাই উপহার দিয়েছিলাম? তুমি কি এই সত্যটুকুও ভুলে গেছে যে, আমরা যদি তোমাদের বাঁচিয়ে না রাখতাম তবে তুমি এবং তোমার ফেদাইন দলের অস্তিত্বই আজ বিলীন হয়ে যেতো?’
শেষ মান্নানের মাথায় তখন মদের নেশার সাথে কেল্লা প্রধানের গর্ব এবং অহংকারও চেপে বসেছিল। উত্তেজনা উস্কে দিয়েছিল তার অহংবোধকে। সে যে এক গোপন খুনী চক্রের নেতা, যারা যে কোন সময় মানুষের সন্দেহের উর্ধ্ব উঠে মানুষ খুন করতে পারে, এ চিন্তা ছড়িয়ে পড়েছিল তার মগজের কোষে কোষে।
তার মনে পড়ে গেল, অতীতে খৃষ্টান অফিসারদের হত্যার কথা। পারস্পরিক শক্রতার কারণে এক অফিসার অন্য অফিসারকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাইলে সহযোগিতা নিয়েছে তার। সামরিক অফিসার ছাড়া প্রভাবশালী সাধারণ খৃষ্টানরাও কখনো কেউ শক্রতার কারণে প্রতিদ্বন্দীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাইলে তারই শরণাপন্ন হতো। সে সব অভিযানের তুলনায় এক অর্বাচীন দেমাগী খৃষ্টানকে খুন করা তার কাছে কোন বিষয়ই ছিল না।
শেখ মান্নান ভাবছিল, এ লোকটি কি ভুলে গেছে, সে এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। এই সে আছিয়াত, যে দুর্গকে মানুষ জানে প্রেতাত্মার কেল্লা বলে। এ কেল্লার মধ্যে একজন দুজন মানুষের গুম হয়ে যাওয়া কোন অস্বাভাবিক ব্যাপারই নয়।
ফেদাইনরা ছিল আক্ষরিক অর্থেই নিরেট রক্তচোষা। দয়ামায়া বলে কোন কিছুর সাথে তাদের আদৌ পরিচয়ই ছিল না। খুন করা তাদের কাছে মুখের থুতু ফেলার সমতুল্য।
শেখ মান্নান তাকিয়েছিল দেয়ালের দিকে। এ কেল্লার দেয়াল ও কার্নিশ জুড়ে রং-বেরংয়ের কাঁচের নকশা, ঝাড়বাতির মায়াবী আলো। এ সব দেখে এখানে এলে মানুষ ভুলে যায়, এই কেল্লার ভেতরে এবং তার আশেপাশে কত শত নির্দয় ও নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটেছে। আর এসব সমুদয় ঘটনার নেপথ্য নায়ক শেখ মান্নান। তার সামান্য ইশারার কাছে মানুষ কত অসহায়, জানে মান্নান। মানুষের সেই অসহায়ত্ব দেখতে দেখতে তার মনে জন্ম নিয়েছিল এমন এক অহমিকা, যার কারণে আক্ষরিক অর্থেই সে ধরাকে সরা জ্ঞান করতো। পৃথিবীর দাম্ভিক সম্রাটদের চাইতেও নিজেকে অধিক ক্ষমতাবান ভাবতো সে। আর এ ভাবনার কারণেই তার মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছিল পশুত্ব ও বর্বরতা। বন্য জন্তুর মতই হিংস্রতা গ্রাস করে নিয়েছিল তাকে।
লিজার মত এমন সুন্দরী মেয়েকে হাতছাড়া করতে চাইল না সে। যতটা সম্ভব নিজেকে দমন করে খৃষ্টান প্রতিনিধিকে বললো, ‘আমি তোমাকে আবারও চিন্তা করার সুযোগ দিচ্ছি। এই কেল্লাতে আল্লাহ প্রেরিত ফেরেশতাও গুম হয়ে যায়। আর সে গুমের খবর আল্লাহ পর্যন্ত জানতে পারে না। আমি এই মেয়েকে কেল্লার বাইরে যেতে দেবো না। যদি তুমি জোর খাটাতে চাও তবে তুমিও কেল্লার বাইরে যেতে পারবে না।’
‘আমার এক সাথী এইমাত্র কেল্লার ফটক থেকে বিদায় নিল।’ খৃষ্টান লোকটি বললো, ‘সে জানে আমি এখানে দু’তিন দিন থাকবে। এরপর আমিও গিয়ে শরীক হবো তাদের সাথে। যদি আমি যথাসময়ে সেখানে না পৌঁছি, তাহলে আমি যে এখানে বন্দী এ কথা তাদের জানতে বাকী থাকবে না। এর পরিণতি কি হতে পারে তা তোমাকে বুঝিয়ে বলার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।’
সে আরও বললো, “আমি এখানে এসেছি এই অধিকার নিয়ে যে, এই কেল্লা আমাদেরই আশ্রয়স্থল ছিল। বিশেষ করে দূর পথের বিশ্রামাগার হিসাবে আমরা এটা ব্যবহার করতাম। তোমাকে অনুগ্রহ করে আমরা এই দুর্গ দান করেছি। কখনো ভাবিনি, এর ফলে অতিথি হিসাবে এখানে আমাদের আর কখনো জায়গা হবে না।’
‘স্বীকার করি, এ কেল্লা তোমরাই আমাকে দান করেছে। কিন্তু দান করার পরদিন থেকে এর মালিক আর তোমরা নও, আমি। আর আমি এটা তোমাদের কাছ থেকে এমনিতেই পাইনি, আমার অতীত কাজের পুরস্কার হিসাবেই এটা আমি পেয়েছি। তারপরও বরাবর আমি তোমাদের এখানে থাকতে দিয়েছি। কিন্তু তুমি অতিথির সীমা অতিক্রম করে কর্তৃত্ব ফলাতে চাইছো। তুমিই আমাকে বাধ্য করছে তোমার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে।’
‘যদি তুমি আমাদের হাড় শুদ্ধ গায়েব করে দাও তবুও তোমাকে জিজ্ঞেস করা হবে, এখানে আমাদের এক লোক ও দুটি মেয়ে ছিল, তারা কোথায়? এ প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হলে তার পরিণতি কখনো শুভ হবে না।’ আগন্তুক খৃস্টানটি বললো, ‘কিন্তু একটি সুযোগ তোমাকে দিতে পারি। যদি তুমি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে হত্যা করতে পারো, তবে তোমাকে শুধু এই মেয়েটি কেন, এরূপ এক ডজন সুন্দরী মেয়ে দান করা হবে।’
‘তুমি তো আমাদের দেয়া অর্থ, সোনা-দানা সব হজম করে বসে আছ অথচ চুক্তিমত এখনো সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে পারনি। তুমি বলেছ, তোমার চার ফেদাইন খুনীকে সুলতান আইয়ুবীর হত্যার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তার কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। আইয়ুবী এখনও বহাল তবিয়তে আছেন ও বিজয়ীর বেশে সামনে অগ্রসর হচ্ছেন।
‘আমি মিথ্যা বলিনি।’ শেখ মান্নান রাগ সামলে বললো, ‘আমি চার ফেদাইনকে সত্যি পাঠিয়ে দিয়েছি। আশা করি কয়েক দিনের মধ্যেই তোমরা এ সুসংবাদ পেয়ে যাবে যে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী নিহত হয়েছেন।’
তোমার এ আশা যদি সফল হয় তাহলে আমি অঙ্গীকার করছি, তোমাকে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে যে সব পুরস্কার দান করা হয়েছে এবং হবে, সে সব পুরস্কার ছাড়াও তোমাকে লিজার মত আরও দুটি মেয়ে আমার তরফ থেকে উপহার দেয়া হবে।’
‘আচ্ছা, সেটা সময় হলেই দেখা যাবে।’ শেখ মান্নানের কণ্ঠে আক্ষেপ ও আপোসের সুর, ‘হ্যাঁ, যাও একে নিয়ে যাও। আমি কেল্লার মধ্যে খৃষ্টানদের জন্য যে সব কামরা খালি করে রেখেছি, সে সব কামরাতে চলে যাও। সেখানে থাকো, খাও, পান করো আর আমোদ-স্কৃর্তি করে। কিন্তু চিন্তা করে উত্তর দিও, লিজাকে আমার কাছে রেখে যাবে কি না?’
‘ঠিক আছে আমি চিন্তা করে দেখবো।’ বললো খৃস্টান লোকটি, ‘তাহলে এবার আমরা যাই?’
‘যাও। কিন্তু আমার অনুরোধের কথাটা মনে রেখো। এই মেয়েটাকে তুমি আমার স্বপ্নপুরী থেকে বের করে নিয়ে যেও না। আমি তোমাকে পরিষ্কার করে বলে দিতে চাই, একে কেল্লা থেকে বের করে নেয়াটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না।’
খৃষ্টান অফিসার মেয়ে দুটিকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে গেল। এ লোক ছিল খৃস্টান গোয়েন্দা বিভাগের এক অফিসার। গোয়েন্দাবৃত্তি ছাড়াও নাশকতামূলক কাজে যারা ওস্তাদ ছিল, সেই বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তা ছিল সে। সে এবং তার অন্যান্য সঙ্গীরা মুসলিম এলাকায় ঘুরে ফিরে গোয়েন্দাগিরি করতো আর সুযোগ পেলেই লিপ্ত হতো নাশকতামূলক কাজে। আছিয়াত দুর্গ শেখ মান্নানকে দান করার পরও এ কেল্লায় খৃষ্টানদের ছিল অবাধ যাতায়াত। এখানে তাদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা ছিল। যখনই খৃষ্টানরা এখানে এসে থাকতে পারতো। সাধারণত এ কেল্লাকে ওরা ব্যবহার করতো বিশ্রামের ঘাঁটি হিসাবে।
গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরাই এখানে বেশী আসতো। কারিশমারও জানা ছিল এ খবর। সেই সুবাদেই লিজা এবং আন নাসেরদেরকে নিয়ে সে এখানে এসেছিল। সঙ্গীদের নিয়ে এখানে আশ্রয় নেয়ার সময় সে ভাবতেও পারেনি, এখানে এসে সে এক অনাকাঙ্খিত সমস্যায় জড়িয়ে পড়বে।
খৃষ্টান অফিসারটিরও জানা ছিল না, এখানে কারিশমা ও লিজারা এসেছে। মরুভূমির উত্তাপে ক্লান্ত হয়ে এখানে সে এসেছিল বিশ্রামের জন্য। ইচ্ছে ছিল, দু’একদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার সে তার পথ ধরবে। কেল্লায় প্রবেশের সময় দ্বার রক্ষীদের কাছ থেকেই সে জেনেছিল; এখানে দুটি খৃষ্টান মেয়ে এসেছে। কে হতে পারে? প্রশ্নটা মনে উদয় হতেই মেয়েদের দেখার আগ্রহটা জেঁকে বসলো তার মনে। খবর নিয়ে জানতে পারলো, তারা এখন শেষ মান্নানের কাছে আছে। মেয়ে দুটিকে দেখার আগ্রহ নিয়ে সে শেৰ মান্নানের মহলের ভেতরে প্রবেশ করলো। কিন্তু প্রহরী তাকে বাঁধা দিতেই জেদ চেপে বসলো মনে, প্রহরীকে অগ্রাহ্য করে সে ঢুকে পড়লো শেখ মান্নানের খাস কামরায়।
শেখ মান্নান তাকে চিনতো। তার সাথে শেখ মান্নানের ঝগড়া হবে এমন ভাবনা তার মনে কখনো উদয় হয়নি। কিন্তু কামরায় ঢুকেই সে এক অনভিপ্রেত পরিস্থিতির শিকার হয়ে গেল। ভাগ্য ভাল, ঝগড়া শেষ পর্যন্ত খারাপের দিকে মোড় নিতে গিয়েও আর নেয়নি। নিলে পরিস্থিতি তার জন্য খারাপই হতো। শেখ মান্নান তার স্বভাবের বিপরীতে আপোষ রফায় এসে বরং তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। যেভাবে কথা কাটাকাটি ও উচ্চবাচ্য চলছিল, শেখ মান্নান নত না হলে ভয়ংকর দিকে গড়াতে পারতো ঘটনা।
সে মেয়েদের নিয়ে বেরোতে বেরোতে বললো, ‘ইশ্বর মঙ্গলময়! আরেকটু হলে একটা খুনাখুনি হয়ে যেতো।’
মেয়েরা এর কোন জবাব দিল না। চুপচাপ তার সাথে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
ওরা বেরিয়ে গেলে শেখ মান্নান হাত তালি দিল। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উদয় হলো তার একান্ত নিজস্ব কিছু অনুচর। সে তাদের বললো, “এই খৃষ্টান ও মেয়ে দুটি আমাদের বন্দী নয়, তবে তাদেরকে ইচ্ছামত কেল্লা থেকে বের হওয়ার সুযোগ দেয়া যাবে না। ফটকে বলে দাও, আমার অনুমতি ছাড়া এদের যেন বাইরে যেতে দেয়া না হয়। যখন চাইবে বাইরে যাবে, যখন ইচ্ছা আসবে এ অধিকার তারা নিজেরাই হারিয়েছে। বন্দী হলেও কেল্লায় তাদের গতিবিধির ওপর কড়া দৃষ্টি রাখবে।’
অনুচররা বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো শেখ মান্নান তাদের ডেকে বললো, আর শোন, গুমাস্তগীন যখন চায় তার যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। মেয়ে দুটি সঙ্গে করে যে চার বন্দীকে নিয়ে এসেছে সে ওদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।
হাঁটতে হাঁটতে খৃষ্টান গোয়েন্দা অফিসারকে কারিশমা জানালো,‘ হারানের আমীর গুমাস্তগীন এখন এ কেরাতেই অবস্থান করছেন। তিনি সুলতান আইয়ুবীকে গোপনে হত্যা করার ব্যবস্থা করতে এখানে এসেছেন।’
তাকে আন নাসের ও তার সাথীদের সম্পর্কেও জানানো হলো।
খৃষ্টান অফিসার বললো, ‘আগে কামরায় চলো। ওখানে গিয়ে আলাপ করাটাই নিরাপদ। এ অবস্থায় আমাদের কি করণীয় তা খুব ভেবেচিন্তে ঠিক করতে হবে এবং আমাদের পরিকল্পনা শেখ মান্নানের লোকদের জানানো যাবে না।
সে মেয়ে দুটিকে কেল্লার এমন অংশে নিয়ে গেল, যেখানটা শুধু আগত খৃস্টান মেহমানদের জন্যই বিশেষভাবে নির্ধারিত ছিল। এ অংশটা খৃস্টানরাই নিয়ন্ত্রণ করতো এবং এ অংশটুকুই ছিল এ কেল্লায় তাদের নিরাপদ স্থল।
❀ ❀ ❀
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সাইফুদ্দিনের সেনাপতি মুজাফফরুদ্দিনের আক্রমণকে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করে তাদের পিছু সরতে বাধ্য করেছিলেন। লড়াইয়ের প্রচণ্ডতায় তারা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যে যেদিকে পারে পালিয়েছিল। বাকীরা হাতিয়ার ফেলে আত্মসমর্পন করেছিল।
কিন্তু মুজাফফরুদ্দিন এ যুদ্ধে নিহত বা ধৃত হয়নি। সে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। নিখোঁজ সেনাপতি কোথায় লুকিয়েছে আইয়ুবীর গোয়েন্দারা তখনও তার সন্ধানে চষে ফিরছে পাহাড়-প্রান্তর।
সুলতান আইয়ুবী যেসব সৈন্যদের বন্দী করেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিল সাইফুদ্দিনের বিশিষ্ট উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন জঙ্গী। এক সময় তিনি মুশেলের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন।
সুলতান আইয়ুবী ফখরুদ্দিন জঙ্গীকে সাধারণ বন্দীদের থেকে পৃথক করে তার তাঁবুতে নিয়ে এলেন এবং তাঁকে তাঁর যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিলেন।
গনিমতের মাল ভাগ করে সুলতান আইয়ুবী প্রথমেই এই সিদ্ধান্ত নিতে বসলেন, আরও অগ্রসর হবেন, নাকি পলাতকদের পিছু ধাওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে এ অভিযান। ঐতিহাসিকরা বলেছেন, এ সময় সুলতান আইয়ুবী দোটানায় ভুগছিলেন। কিন্তু ইসলামের ইতিহাস এই বীর মুজাহিদের সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও সিদ্ধান্তের সাক্ষ্য বহন করে। এটা সত্য, শত্রু সেনাদের বেধড়ক পিছু ধাওয়া করলে হয়তো তিনি শক্রদের আরো ব্যাপক ক্ষতি ও ধ্বংস সাধন কতে পারতেন কিন্তু এতে তাঁর নিজের বাহিনীও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতো।
তিনি সৈন্যদেরকে অধিক দূর পিছু অনুসরণ না করে ফিরে আসার হকুম জারি করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, মুজাফফরুদ্দিনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি যে মূল্য দিয়েছিলেন, তা যেন আর না বাড়ে। কারণ এ যুদ্ধে তার সৈন্য বাহিনীর অনেক চৌকস যোদ্ধাকে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছিল। আহতদের সংখ্যাও ছিল বেশ। এ জন্যই তিনি অভিযান চালাতে বা বেপরোয়া পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে চিন্তায় পড়েছিলেন।
তিনি পিছু ধাওয়া করলে, রিজার্ভ বাহিনীকে ব্যবহার করতে হতো। কিন্তু তিনি তা করতে রাজি ছিলেন না। আরও একটি কারণে অভিযান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কারণটি হলো, মুসলমানদের হাতে মুসলমানদের রক্তপাত তিনি বাড়াতে চাননি। জাতিকে এমন সংঘাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টাই ছিল তাঁর সারা জীবনের সাধনা।
সুলতান আইয়ুবী সাইফুদ্দিনের নিজস্ব তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই বিশাল তাঁবুটি ছিল মূল্যবান রেশমী কাপড়ের। রেশমী কাপড়ের সামিয়ানা ও পর্দা তখনো ঝলমল করছিল। মনে হচ্ছিল যুদ্ধের মাঠ নয়, কোন আলীশান মহলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
ইয়াজুদ্দিন নামে সাইফুদ্দিনের এক ভাতিজা সুলতান আইয়ুবীর সেনাদলের কমাণ্ডার ছিল। বিস্ময়কর হলেও সত্য, দ্বীনের খাতিরেই ভাতিজা চাচার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। শুধু ইয়াজুদ্দিন নয়, সৈনিকদের মধ্যে আরো অনেকেই ছিল, যারা তাদের রক্ত সম্পৰ্কীয় আত্মীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল এই সমরে।
সুলতান আইয়ুবী সাইফুদ্দিনের তাঁবুর শানশওকত দেখে তার ভাতিজা ইয়াজুদ্দিনকে ডাকলেন। ইয়াজুদ্দিন হাজির হলে তিনি একটু হেসে বললেন, “তোমার চাচার সম্পত্তির ওয়ারিশ এখন তুমি। এই তাঁবু আমি তোমাকেই দান করছি। এটা তুমি গুছিয়ে নাও।’
সুলতান আইয়ুবী হাসি মুখেই তাঁবুটি তাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু এ কথা শুনেই ইয়াজুদ্দিনের চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। আপন চাচার স্নেহ ও আদরের কথা মনে পড়ে গেল তার। চাচার পরাজয়ের কাহিনী তাকে লিখতে হচ্ছে নিজের তরবারী দিয়ে। এ কথা মনে হতেই আবেগে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো, ঝাপসা চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো ক’ফোটা অশ্রু।
সুলতান আইয়ুবী তার মনের আবেগ লক্ষ্য করে বললেন, ‘ইয়াজুদ্দিন! আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। আমি তোমাকে অপ্রস্তুত করার জন্য বা কষ্ট দেয়ার জন্য এখানে ডেকে আনিনি। এ সম্পদ তো আমাকে কাউকে না কাউকে দান করতেই হতো! ভাবলাম, গনিমতের এ অংশটুকু তোমারই প্রাপ্য। আমাকে ভুল বুঝো না, এ সম্পদ অন্যের ঘরে যাওয়ার চাইতে তোমার কাছে থাকাই ভাল।’
‘কিন্তু…’
‘না, এখানে ‘কিন্তু’র কোন অবকাশ নেই। চাচার প্রতি তুমি কোন জুলুম করোনি, বরং তোমার চাচা নিজেই তার নিজের প্রতি জুলুম করেছে। এ ঘটনায় তোমার দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। তুমি তো কেবল তোমার মালিক ও সৃষ্টিকর্তার হুকুম তামিল করেছো। কুরআনের নির্দেশের বাইরে নিজের খেয়াল খুশী মতো তুমি কিছুই করোনি।’
সুলতান আইয়ুবী তাকে শান্তনা দেয়ার জন্য আরো বললেন, ‘মনে রেখো, আমার সন্তান যদি জিহাদের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, প্রতিরোধ করতে চায় হকের অগ্রযাত্রা, সে বাঁধা দূর করতে আমার তলোয়ার তার শিরচ্ছেদ করতেও কুণ্ঠিত হবে না। আপন সন্তানের বুকে ছুরি চালাতে একটুও কাঁপবে না আমার হাত।
তুমি তোমার চাচার পরাজয়ের কথা স্মরণ করে অশ্রু বিসর্জন করছো। কিন্তু আমি আমার অপরাধী সন্তানের শিরচ্ছেদ করেও অশ্রু বিসর্জন করবো না।’
সুলতান আইয়ুবী তুর্কমানের এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কিছুটা দূরে দীর্ঘস্থায়ী এক ক্যাম্প করে সেখানে অবস্থান করা শুরু করলেন। জায়গাটি ছিল পাহাড় পরিবেষ্টিত। ইতিহাসে এলাকাটির নাম ‘কোহে সুলতান’ বলে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সেখান থেকে হলব শহর মাত্র পনেরো মাইল দূরে ছিল।
আল মালেকুস সালেহ তখনো হলব শহরকে তার রাজধানী বানিয়ে রেখেছিল। সম্মিলিত বাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিল এই হলব। আমরা আগেই জেনেছি, এই শহরের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে যে বাহিনী মোতায়েন ছিল, তারা সবাই ছিল সাহসী ও বীর যোদ্ধা। সবাই ছিল মুসলমান। সেখানে আইয়ুবী বিরোধী প্রচারণা এত তীব্র ছিল যে, তারা আইয়ুবীকেই মনে করতে ইসলামের দুশমন। হলবের সৈনিকরা আইয়ুবীকে মনে করতো রাজ্যলোভী। এই চেতনা ছিল বলেই তারা সুলতান আইয়ুবীর অবরোধকে ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিল। সবকিছু বুঝেও সুলতান আইয়ুবী এ জন্যই অবরোধ উঠিয়ে নিয়েছিলেন যে, নইলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতো এবং এর সবকটি প্রাণ ছিল মুসলমানের।
‘কোহে সুলতানে’ বসে সুলতান আইয়ুবী আর একবার এই শহর অবরোধ করবেন কিনা গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। পরিকল্পনা করছিলেন আগামী অভিযানের। তিনি চিন্তা করে দেখলে, বাহিনীকে আরো সুরক্ষিত ও দৃঢ় না করে সম্মুখে অগ্রসর না হওয়াই ভাল।
কারণ ব্যবধান অল্প হলেও এ পনের মাইল পথের মাঝেই পর পর রয়েছে দুটি সুরক্ষিত কেল্লা। আইয়ুবী সম্পূখ অগ্রযাত্রায় এ কে দুটি মস্তবড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এর একটি দুর্গের নাম মুমবাজ ও অপরটি বুজা। এই দুই কেল্লার অধিপতি ছিল দুই স্বাধীন মুসলিম আমীর। আশেপাশে আরও কয়েকটি কেল্লা এবং পরগনা ছিল যার শাসকও ছিল মুসলমানরা। কিন্তু খৃষ্টানদের ষড়যন্ত্রের ফলে এরা সবাই ছিল আইয়ুবীর বিরোধী এবং খৃষ্টানদের বরকন্দাজ। গোটা ইসলামী সাম্রাজ্য এভাবে খৃষ্টান ষড়যন্ত্রের খপ্পরে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছিল এবং ছোট ছোট কেল্লা, পরগণা ও জামিদারীতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল।
সুলতান আইয়ুবী এই বিভক্ত রাজ্যগুলোকে আবার একত্রিত করে এক শক্তিশালী ইসলামী সালতানাত গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন এবং সবাইকে একই খেলাফতের অধীনে আনার চেষ্টা করছিলেন। যুদ্ধের পাশাপাশি এ জন্য তার কুটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল এই যে, এসব কেল্লাধিপতি, জায়গীরদার ও আমীরদের কারো মনেই জাতির বৃহত্তর ও মহত্তর কল্যাণ চিন্তা ছিল না। তারা প্রত্যেকেই হিল ক্ষুদ্র মানসিকতা সম্পন্ন এবং নিজের পরগণা ও জমিদারী নিয়ে সন্তুষ্ট। নিজেদের আধিপত্য বহাল রাখা ও প্রতিরক্ষার জন্য তারা প্রত্যেকেই টানদের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
এমনি পরিস্থিতির মধ্যে সুলতান আইয়ুবী বুজার ও মুমবার আমীরের কাছে দূত পাঠালেন। সুলতানের চিঠি নিয়ে বুজার আমীরের কাছে গেলেন ইয়াজুদ্দিন এবং মুমবাজের আমীরের কাছে সাইফুদ্দিনের উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন।
ফখরুদ্দিন বন্দী হওয়ার পর সুলতান আইয়ুবীর আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু আনুগত্য স্বীকার করলেই সুলতান তাকে বিশ্বত মনে করবেন এবং তাকে নিজের অন্যতম সহকারী করে দূত হিসাবে বাইরে পাঠাবেন, এমনটি তিনি কনা করতে পারেননি।
আইয়ুবী তাকে নিজের বিশেষ দূত হিসেবে মুমবাজে প্রেরণ করেন। মুমবাজে পাঠানোর পূর্বে তিনি তাকে বললেন, ‘আপনাকে আমি আমার প্রতিনিধি করে মুমবাজ পাঠাচ্ছি। আপনি কেল্লার আনুগত্য লাভের জন্য নিজের মত করে তাদের বুঝাবেন। তাদের আনুগত্য লাভের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে আপনি তাদের আশ্বস্ত করবেন। আপনার দেয়া ওয়াদার যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করা হবে।’
তিনি যখন একান্ত আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে এসব কথা বলছিলেন, ফখরুদ্দিন তখন অপার বিস্ময় নিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের এক মহানায়ক সুলতান সবাহউদিন আইয়ুবীকে।
তার এ বিষ্ময় দৃষ্টি দেখে সুলতান আইয়ুবী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি এতো অবাক হচ্ছেন কেন? আপনি কি মুসলমান নন? এক মুসলমান কি আরেক মুসলমানের ওপর এতটুকু আস্থা রাখতে পারে না? তিনি আরো বললেন, আপনি আমাকে এমন বিস্ময় নিয়ে দেখছেন যেন আমি কোন অপরাধ করেছি। যেন আমি শত্রু বা বিধর্মীকে দূত হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘কিন্তু আমি তো আপনার শত্রুই! বন্দী হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আপনার বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। আপনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছি তো নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য। যখন বুঝতে পেরেছি, আপনার সাথে কুলিয়ে উঠার সাধ্য আর নেই আমাদের, আপনার আনুগত্য গ্রহণের মধ্যেই আমাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ, কেবল তখনই আপনার আনুগত্য কবুল করেছি। এরপরও আপনি আমাকে আপনার দূত করার যোগ্য মনে করছেন এবং সন্ধির শর্ত নির্ধারণের স্বাধীনতা দিচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ, দিচ্ছি। কারণ আপনাকে আমি বোকাও মনে করি না, অযোগ্যও ভাবি না। আর আপনার চাইতেও আপনাকে আমি বেশী বিশ্বাস করি।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি মুমবাজের কেল্লার আনুগত্য চাই। আপনি সেখানে তার আমীরের কাছে আমার পয়গাম পৌঁছে দেবেন ও বুঝাবেন যে, অযথা খুন-খারাবী থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে এটাই একমাত্র পথ। ওরা আমাদের সাথে হাত মেলালে আমাদের সম্মিলিত শক্তি আরো জোরদার হবে এবং আমাদের বিজয়ের অংশীদার হবে তারা। তাই ওদেরকে বুঝাবেন, ওদের সেনাবাহিনী আমাদের সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত করে দিতে।’
তিনি আরো বললেন, ‘আপনি একজন মুসলমান। এতদিন ইসলামের অগ্রযাত্রায় বাঁধা দিয়ে নিজের ওপর যে জুলুম করেছেন, এই দায়িত্ব পালন করে তার কাফফারা আদায় করুন। আপনার ওপর আমার আস্থা আছে, আপনিও নিজের ওপর আস্থা অর্জন করুন।’ ইয়াজুদ্দিন ও ফখরুদ্দিন উভয়েই নিজ নিজ মিশন নিয়ে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে গেল।
❀ ❀ ❀