চিঠি পড়ে সুলতান আইয়ুবী তাকালেন সালেহের পাঠানো দুই সেনাপতির দিকে। বললেন, ‘তোমরা এই মেয়েটাকে কেন এখানে নিয়ে এসেছো? তোমরা কি এই পয়গাম নিজেরাই পৌঁছে দিতে পারতে না?’
সেনাপতি দুজন এ প্রশ্নের কি জবাব দেবে বুঝতে পারল না। তারা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল। শেষে দু’জনেই তাকালো মেয়েটার দিকে। তখন মেয়েটিই এ প্রশ্নের জবাব দিল। বলল, ‘মামুজান! এদের কোন দোষ নেই। আমাকে ভাইয়াই পাঠিয়েছেন।’
“কেন, সে কি চায় আমার কাছে? তোমাকে কিছু বলেছে?
‘আপনি যদি এজাজ দুর্গটি ভাইয়ার হেফাজতে রাখেন এবং হলব শহরে তাকে থাকার অনুমতি দেন তাহলে ভাল হয়। ভাইয়া বলেছে, সে আর কোনদিন আপনার বিরুদ্ধে লড়াই করবে না।’
সুলতান আইয়ুবী দুই সেনাপতির দিকে রাগতঃ দৃষ্টিতে তাকালেন। তার এ চাহনীর মানে হচ্ছে, তোমরা এসব শর্ত হাজির করার জন্য এ ছোট্ট মেয়েটিকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার না করলেও পারতে! অতীতে আমি যেসব কেল্লা ও রাজ্য জয় করেছি, তার শাসকদের ওপর কি আমি জুলুম করেছি? আমি কি তাদেরকে উপযুক্ত মর্যাদা ও সম্মান দেইনি?”
‘আমি এজাজ দুর্গ, হলব শহর এবং এ রাজ্য তোমাকেই দিয়ে যাচ্ছি শামসুন নেছা।’ সুলতান আইয়ুবী ছোট মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘যাও, তোমার ভাইকে গিয়ে এ সুসংবাদ দাও।’
সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে আদেশ জারী করলেন, ‘এজাজ দুর্গ থেকে সব সৈন্য বের করে নাও এবং হলব শহরের অবরোধ উঠিয়ে নাও।’
এরপর তিনি হলবের সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি এজাজ দুর্গ এবং হলব রাজ্য ও শহর এই মাসুম মেয়েটাকেই শুধু দিয়ে যাচ্ছি। তোমরা কাপুরুষ, নির্লজ্জ ও গাদ্দার। তোমাদের আর সেনাবাহিনীতে থাকার অধিকার নেই।’
২৪শে জুন ১১৭৬ মুতাবেক ১৪ই জিলহজ্ব ৫৭১ হিজরী। আল মালেকুস সালেহের সাথে সুলতান আইয়ুবীর চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হলো। এই চুক্তিপত্রের বলে এজাজ দুর্গ ও হলব রাজ্য ইসলামী হুকুমাতের অধীন হয়ে গেল। হলবে আল মালেকুস সালেহকে সুলতানের অধীন শাসক হিসেবে গণ্য করা হলো।
এ চুক্তিপত্রের সময় মুশেলের আমীর সাইফুদ্দিন হলবেই ছিলেন। তিনিও সুলতান আইয়ুবীর আনুগত্য কবুল করে নিয়ে নিজের রাজ্য ইসলামী হুকুমাতের অধীন করে দিলেন।
এজাজ দুর্গের পতন, আল মালেকুস সালেহ ও সাইফুদ্দিনের আনুগত্য স্বীকার এবং গুমাস্তগীনের হত্যার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিরোধ ছিল তার অবসান হল। নিজেদের মধ্যে যুদ্ধের যুগ শেষ হয়ে আপোস যুগের সূচনা হল। কিন্তু তাই বলে মুসলিম জাতির বুক থেকে ঈমান বিক্রয়কারী গাদ্দাররা নিঃশেষ হয়ে গেলো, এ কথা বলার অবকাশ তখনো তৈরী হয়নি। এক গাদ্দারের পরাজয় ও নিস্ক্রিয়তার শূন্যতা পূরণের জন্য, দশ গাদ্দার দাঁড়িয়ে গেল। খৃস্টানদের ঈমান ক্রয়ের প্রয়োজন ও তৎপরতা আরো বেড়ে গেল। ষড়যন্ত্রের নিত্য-নতুন ক্ষেত্র তৈরীর জন্য মরিয়া হয়ে কাজে নামল ক্রুসেড বাহিনী।
❀ ❀ ❀
হলবের একটি কবরস্থান। গোরস্তানটি অনেক বিস্তৃত। বিশাল মাঠ জুড়ে সারি সারি কবর। এর অধিকাংশ কবরই এখনও নতুন। কবরের উপরে যে মাটি ফেলা হয়েছে সে মাটিগুলোতে কোন যত্নের ছাপ নেই। এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সে মাটি। কোনটা উঁচু, কোনটা নিচু। কোনটা অন্যটার সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। কোন যুদ্ধের পর মৃত সৈনিকদের কবরগুলোর দশা ঠিক এমনটিই হয়।
হিম্মাত থেকে হলব পর্যন্ত এমন বিরাট আকারের আরো দুটি গোরস্তান রয়েছে। তিনটি গোরস্তানেরই দশা ঠিক একই রকম। সদ্য দাফন করা শত শত লাশের সারি শুয়ে আছে নিশ্চুপ। এর ভেতরে যেসব লোকেরা শুয়ে আছে আজ আর তাদের কোন কাজ নেই। অথচ দুদিন আগেও তাদের দাপটে পৃথিবীর মাটি কাঁপতো। হিংসা, দ্বেষ, হানাহানির জগত থেকে চির বিদায় ঘটেছে তাদের। দুনিয়ায় তারা যতটুকু ভাল ব মন্দ কাজ করেছে সেটুকুই আজ তার একমাত্র সম্বল। আমল তার সঙ্গ ছাড়েনি, তার সাথে সাথে তার কবরে গিয়ে ঢুকেছে।
হিম্মাতের ধূসর প্রান্তর আজ ছেয়ে আছে উদাসীনতায়। সেখানকার মাটি ও বাতাসে রক্তের গন্ধ। গন্ধ পচা-গলা লাশের। সেই দুর্গন্ধে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। যেখানে সবসময় পাখির কিচির-মিচির ও সুমিষ্ট স্বর ভেসে বেড়াতে, সেখানে আজ শোনা যাচ্ছে শকুন ও শিয়ালের বিশ্রি চিৎকার।
এমনি একটি করবস্থান ছিল হলব শহরের বর্ধিত এলাকা এজাজ দুর্গের পাশে। কবরের মাটি তখনও নতুন এবং ভেজা। কয়েকজন মুসল্লিসহ একজন ইমাম সেখানে দাঁড়িয়ে মৃতদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছিল। মোনাজাত শেষে তিনি যখন হাত মুখের উপর রাখলেন তখন দেখতে পেলেন, অশ্রুতে তার দাড়ি ভিজে একাকার হয়ে গেছে।
তিনি সমবেত মুসল্লিদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘এ অঞ্চল এখন অনাবাদী ও বিরাণ হয়ে যাবে। যেখানে একই কালেমা ও কুরআন পাঠকারীরা পুরস্পর ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, সেখানে আল্লাহর গজব নেমে আসে। সেখানে একই রাসূলের অনুসারীরা পরস্পর খুনী সেজে বসে। যে মাটিতে ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের রক্ত ঝরে, সে মাটি বিরাণ ও মরুভূমি হয়ে যায়।’
মুসল্লিদের চেহারাগুলোতে বিষাদবিন্দু খেলা করছিল। সেই বেদনাবিধুর চেহারাগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন, ‘এখানে দুদিন আগেও তোমরা অহংকারের গর্জন ধ্বনি শুনেছ। অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনেছ। সেই সংঘাতে যারা জড়িয়ে পড়েছিল, তারা সবাই ছিল মুসলমান। এই যুদ্ধে যারা ইসলামের খাতিরে সত্যের প্রতি সমর্থন করে মারা গেছে, তারা শহীদের মর্যাদা ও সম্মান লাভ করবে। আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম মেহমান হিসাবে গণ্য হবে তারা। কিন্তু যারা বাতিলের সমর্থক হয়ে, কোন রাজা বা শাসকের আধিপত্য রক্ষার জন্য অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছে, তারা কখনোই এই মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী হতে পারে না। এদেরকে যখন হাশরের ময়দানে উঠানো হবে তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদেরকে অবশ্যই এই রক্তপাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। তিনি যখন জানতে চাইবেন, তোমরা একই রাসূলের উম্মত হয়ে কেন একে অন্যের রক্ত প্রবাহিত করেছিলে? এই রক্ত যদি তোমরা ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে কুরবানী করতে তবে শুধু ফিলিস্তিন কেন, ইউরোপের স্পেন পর্যন্ত তোমরা পৌঁছে যেতে পারতে। ইউরোপ আবার তোমাদের ঠিকানা হয়ে যেত। অথচ তোমরা তোমাদের জীবন ও রক্ত সব বৃথাই ব্যয় করলে?’
ইমাম সাহেব কথা বলছিলেন, এ সময় অনেক অশ্বের মিলিত পদধ্বনি শোনা গেল। ইমামের পাশে দাঁড়ানো কোন একজন বলে উঠলো, ‘আমাদের সুলতান আসছেন।’
ইমাম সাহেব ঘুরে তাকালেন, দেখলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আসছেন। তার সঙ্গে কয়েকজন সেনাপতি ও ছয়জন দেহরক্ষী অশ্বারোহী। গোরস্তানের কাছে এসে সুলতান আইয়ুবী অশ্ব থামালেন এবং অশ্বপৃষ্ঠ থেকে লাফিয়ে নেমে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে তার সাথে মুছাফেহা করলেন।
‘মুহতারাম সুলতান!’ ইমাম সাহেব সুলতান আইয়ুবীকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘এ কথা সত্য যে, এখানে আপনার বিরুদ্ধে যারা লড়াই করেছে তারা সবাই মুসলমান ছিল। কিন্তু আমি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনার যোগ্য মনে করি না। এদেরকে শহীদদের সাথে দাফন করা উচিত হয়নি আপনার। আমাদের মুজাহিদরা সত্যের জন্য যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে আপনি খুনীদের সাথে দাফন করলেন?”
‘আমি তাদেরকেও শহীদ মনে করি, যারা বাতিলের পক্ষে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, “এরা তাদের সরকারের ধোঁকায় পড়ে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে। আমি আমার সৈন্যদেরকে আল্লাহর পথে লড়াই করার আহবান জানিয়েছিলাম। আমাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছে তাদের সরকার সৈন্যদেরকে মিথ্যা শুনিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। আমাকে ইসলামের দুশমন হিসাবে চিত্রিত করে পেশ করেছে তাদের সামনে। বলেছে, আমি সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য লড়াই করছি। তারা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকারী ইমামদের ব্যবহার করেছে। তারা আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছে। সেই মিথ্যা নসিহত শুনে এই সরলপ্রাণ সৈন্যরা প্রতারিত হয়েছে। সরকারী ইমামরা পুরস্কার ও অর্থের লোভে সৈন্যদেরকে বিভ্রান্ত করেছে বলেই তারা আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে সত্যের সৈনিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। আমি তাদের লাশের অপমান করতে পারি না। সে লাশগুলোকে একই গর্তে ফেলে গণকবর দিতে পরি না অথবা কোথায়ও জঙ্গল বা নদীতে ফেলে এসব লাশের আমি অবমাননা করতে পারি না। এদের মধ্যে যারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে তারা আমাদের সঙ্গে মিশে গেছে। কিন্তু যারা মারা গেছে তাদের কাছে সুত্যের আলো পৌঁছাবার সুযোগ হয়নি আমাদের। তাদের সরকার তাদের চোখে যে পট্টি বেঁধে অন্ধ করে রেখেছিল সে পট্টি আমরা খুলে দিতে পারিনি। এ ব্যর্থতা আমাদের। তাই আমি তাদের জন্যও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। হয়তো বেঁচে থাকার সুযোগ পেলে তারা একদিন সত্যের কাফেলারই সৈনিক হয়ে যেতো।’
‘কিন্তু সুলতান!’ ইমাম সাহেব আবেগঘন কণ্ঠে বললেন, ‘তারা তো আপনার শত্রু হয়ে গিয়েছিল। তারা কেন্দ্রীয় খেলাফাতের অধীন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। নূরুদ্দিন জঙ্গীর ছেলে আল মালেকুস সালেহ, মুশেলের আমীর সাইফুদ্দিন ও হারানের কেল্লাধিপতি গুমাস্তগীন- এরা সবাই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ঐক্যজোট করেছিল। শুধু তাই নয়, সামরিক জোট গঠন করে যুক্ত কমাণ্ডের অধীনে তারা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এই যুদ্ধে ইসলামের দুশমন খৃস্টানরা তাদের পূর্ণ সাহায্য সহযোগিতা করেছে। খৃস্টানদের এই সাহায্য-সহযোগিতার উদ্দেশ্য ছিল, মুসলমানরা যেন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে দুর্বল ও ধ্বংস হয়ে যায়। যাতে মুসলমানরা খৃষ্টানদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে অথবা এমন দূর্বল হয়ে থাকে যাতে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে আর যুদ্ধ করতে না পারে। এত কিছুর পরও আপনি তাদের ক্ষমার যোগ্য মনে করেন?’
‘এ জন্য দায়ী ক্ষমতালোভী শাসকরা, সাধারণ সৈনিকরা নয়। খৃস্টানরা মুসলমানদের মধ্যে ব্যক্তিগত ক্ষমতার লোভ সৃষ্টি করেছে, আর্থিক সাহায্য দিয়েছে, যুদ্ধের উপকরণ সরবরাহ করেছে, মদ ও সুন্দরী নারী দিয়ে মুসলমান আমীরদের অন্ধ করে রেখেছে। তাদের এ ষড়যন্ত্রের কারণেই নূরুদ্দীন জঙ্গীর ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে এরা ইসলামের অগ্রযাত্রার পথে বাধা, হয়ে দাঁড়ালো। আমি মিশর থেকে এ সংকল্প নিয়েই বের হয়েছিলাম, এ ষড়যন্ত্রের আমি মূলোৎপাটন করবো। খৃষ্টানদের কবল থেকে আমাদের প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাস ইসলামী হুকুমাতে শামিল করবো। আলহামদুলিল্লাহ, সে পথেই আমরা অগ্রসর হচ্ছি। কিন্তু পরিপূর্ণ বিজয় ছিনিয়ে আনতে হলে আমাদের এ কাফেলায় আরো মুজাহিদ শামিল করতে হবে। সেই মুজাহিদ আমি কোথায় পাবো? বিভিন্ন মুসলিম শাসকদের হাতে যে সৈন্যবল আছে তারাই হবে আমাদের সৈনিক। তাদেরকে যদি আপনি কোনভাবে একবার শুধু এটুকু বুঝতে পারেন যে, ইসলামের জন্য আজ তাদের রক্ত দরকার, তাহলে দেখবেন, তারা দলে দলে এ জেহাদে শামিল হয়ে যাবে। এদের অপরাধ ক্ষমার চোখে না দেখলে কি করে তারা দ্বীনের মুজাহিদদের কাফেলায় শামিল হবে?’
ইমাম সাহেব মাথা নিচু করলেন। এই মহান মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধায় তার মাথা নত হয়ে এলো। তিনি ধরা গলায় বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করুন। বিষয়টি আমি কখনো এভাবে ভেবে দেখিনি।’
‘না, এতে আপনার লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। আপনার চিন্তা ভুল, এ কথা আমি বলছি না। বাহ্যত আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু একজন মুজাহিদের জন্য চর্মচক্ষুই যথেষ্ট নয়, তার চাই গভীর অন্তর্দৃষ্টি। যে দৃষ্টি দিয়ে সে দেখবে অতীতের ঘটনাবলী, দেখবে ভবিষ্যতের সমাজ ও রাষ্ট্র। আপনি জানেন, আজ কয়েক বছর ধরে হিম্মাত থেকে হলব পর্যন্ত এই শস্য শ্যামল প্রান্তরে মুসলমানের রক্ত বয়ে চলেছে অবিরাম ধারায়। শেষ পর্যন্ত বিজয় সত্যেরই হলো। খৃস্টানদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে যারা পা দিয়েছিল, সেখান থেকে সরে আসতে বাধ্য হলো তারা। বিদ্রোহী সব কজন মুসলমান শাসকই আমাদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু এতে আমার মনে সামান্যতম আনন্দ বা উফুল্লতা সৃষ্টি হয়নি। কারণ ভ্রাতৃঘাতি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এ জাতির সামরিক শক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। আপনারা হয়তো ভাবছেন, এ লড়াইয়ে আমরা জিতেছি। কিন্তু আমার হিসাব মতে, এ লড়াইয়ে খৃস্টানদের কূটনৈতিক তৎপরতারই বিজয় হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে খৃস্টানদের কূটনৈতিক চাল, কারণ তারা আমাদেরকে দিয়ে আমাদের ভাইদের হত্যা করাতে সমর্থ হয়েছে। অবস্থা এখন এতটাই নাজুক যে, নতুন করে সৈন্য সংগ্রহ না করে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে অগ্রসর হওয়ার কোন উপায় নেই আমাদের। তাই আপনি দোয়া করুন, আল্লাহ যেন বিপথগামী সৈনিকদেরকে হকের পথে আসার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন।’
সুলতান আইয়ুবী এজাজ দুর্গের কাছে বিস্তৃত এক গোরস্তানের পাশে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলছিলেন। সে সময় তাঁর চেহারায় খেলা করছিল মালিন্য ও দুশ্চিন্তার ছাপ। তিনি ইমাম সাহেবকে আরো বললেন, ‘আপনি প্রতি নামাজের পর এই দোয়াই করুন, আল্লাহ গাফুরুর রাহীম যেন এদের ক্ষমা করে দেন, যাঁরা বিভ্রান্তির কারণে বিপথগামী হয়েছিল। আর যারা জেনে বুঝে চোখে অন্ধত্বের পট্টি বেঁধে ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের জন্য বদ দোয়া না করে তাদের বিষয়টি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিন।
সুলতান আইয়ুবী অশ্বপৃষ্ঠে আরোহন করলেন। কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘আল্লাহ, এত রক্তের হিসাব কে দেবে? অন্তর্যামী, তুমি সাক্ষী, আমার ব্যক্তিগত লাভের জন্য আমি এক ফোঁটা রক্তও বইতে দেইনি।’
তিনি তাঁর সেনাপতিদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘চলো।’
ইমাম সাহেব দ্রুত তাঁর ঘোড়ার সামনে এসে বললেন, “আপনার কাফেলায় শরীক হয়ে কোরবান হোক আমাদের সন্তানগুলো। আপনি কি যাওয়ার আগে আমাকে আরো কিছু নসিহত করে যাবেন?’
‘আমাদের জাতি এখনও আত্মহত্যার পথে এগিয়ে চলেছে। কাফেররা রাসূলের উম্মতের শক্তি, সাহস ও আবেগ দেখে ভীত ও সন্ত্রস্ত। তারা এই শক্তিকে দুর্বল করার জন্য ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে দূরে বসে তামাশা দেখছে। বিচিত্র লোভের ফাঁদ পেতে তারা আমাদের ভাইদের মাথা ও বিবেক কিনে নিচ্ছে। না বুঝেই অনেকে তাদের কৌশলের জালে ধরা দিচ্ছে। পরিণতিতে ইতিহাস প্রত্যক্ষ করছে নিস্ফল গৃহযুদ্ধের অনাকাঙ্খিত অধ্যায়। আমরা যদি এখানেই এর গতিরোধ না করতে পারি, তবে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে দুঃসহ ভবিষ্যত। এই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া আর আত্মহত্যার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। উম্মতে মোহাম্মদীর ধ্বংস ও অধপতনের জন্য এই গৃহযুদ্ধই যথেষ্ট। কাফেররা বর্তমান যুগের মত ভবিষ্যতেও মুসলিম জাতি থেকে গাদ্দারদের খুঁজে নেবে। তাদেরকে অর্থ ও যুদ্ধ উপকরণ সাহায্য দিয়ে এ জাতির ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করতে সচেষ্ট থাকবে। আজকের মতই মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে তারা দূরে বসে তামাশা দেখবে। গুটি কয়েক লোক, গদি ও ক্ষমতা লাভের জন্য উন্মাদের মত কাড়াকাড়ি করবে। সাধারণ মানুষকে তারা বানাবে বলির পাঠা। তাদের ঘাড়ে পা দিয়ে বসবে গিয়ে সিংহাসনে। জাতির সৎ ও কর্মঠ লোকগুলো অকেজো হয়ে যাবে। তাদের মাথার ওপর দিয়ে ছড়ি ঘুরাবে দুষ্টের দল। ইমামরা হালুয়া-রুটির ভাগ পেয়ে অসৎ শাসকের সপক্ষে সাফাই গাইবে। যখন এ অবস্থা হবে তখন এ জাতির ডুবতে আর বাকি থাকবে না। ক্ষমতা লাভের নেশায় কুচক্রীরা জাতির রক্ত এমন ভাবে বইয়ে দেবে যে, মানুষের মৃত্যুর হিসাব রাখাও সম্ভব হবে না। গ্রামের পর গ্রাম গোরস্তানে পরিণত হবে। যদি পারেন এই বিষয়গুলো আপনার মুসল্লি ও সন্তানদের বুঝাতে চেষ্টা করুন। তাদের ঈমানকে, সতেজ ও সজীব করে গড়ে তুলুন। তাদেরকে কোরানের সে কথা ভাল করে বুঝিয়ে দিন, যেখানে বলা হয়েছে, যে জাতি তার নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে না আল্লাহও তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেন না। আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা, ঐক্য, সংহতি ও দৃঢ় ঈমানই জাতি হিসাবে তাদেরকে পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখবে।’
সুলতান তাঁর কথা শেষ করে চলতে শুরু করলেন। তাঁর সঙ্গের সেনাপতিরাও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে চলতে লাগলেন সুলতানের সাথে।
‘গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা এখন শেষ হয়ে গেছে, সুলতান।’ একজন সেনাপতি সুলতানের পাশাপাশি তার ঘোড়া নিয়ে বললো, ‘এখন সামনের চিন্তা করুন। আমাদের বায়তুল মুকাদ্দাস ডাকছে। আমাদের প্রথম কেবলা অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের জন্য।’
“কিন্তু ওদিকে যে মিশরও আমায় ডাকছে।’ সুলতান আইয়ুবী চলতে চলতেই বললেন, ‘এদিক থেকে খুব আশংকাজনক, সংবাদ আসছে। সেখানে আমার দায়িত্ব পালন করছে আমার ছোট ভাই। সে আমাকে দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচানোর জন্য কঠিন অবস্থার সংবাদ গোপন করছে। আলী বিন সুফিয়ান এবং পুলিশ সুপার গিয়াস বিলকিসও আমাকে বিস্তারিত কিছু জানাচ্ছে না। শুধু এইটুকু সংবাদ পেয়েছি, শত্রুদের গোপন তৎপরতা এখন বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, শেখ মান্নানকে আছিয়াত থেকে বিতাড়িত করাটা ভুল হয়েছে। উচিত ছিল তাকে এবং তার দলকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া। তাহলে তার খুনী দলটা আজ মিশরে অপতৎপরতা চালাতে পারতো না। সম্প্রতি আমাদের দুজন কমাণ্ডার অত্যন্ত গোপনে আততায়ীর হাতে নিহত হয়। তাদের শরীরে কোন ক্ষতচিহ্ন বা আঘাতের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মরার পর লাশের ময়না তদন্তে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, তাদের বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে। আমার অনুমান, এদেরকে বিশেষ এক ধরনের হিরোইন জাতীয় নেশার দ্রব্য প্রয়োগ করে খুন করা হয়েছে। এ ধরনের নেশার দ্রব্য কেবল ফেদাইন খুনীচক্রই ব্যবহার করে।’
‘আপনি কি তবে শিঘ্রই মিশর যেতে চান?’ চিন্তান্বিত কণ্ঠে বললো সেই সেনাপতি, ‘সৈন্যদেরকে কি এখানেই রেখে যাবেন, না সঙ্গে নিয়ে যাবেন?’
‘এ সম্পর্কে আমি এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেইনি।’ সুলতান সালাহউদ্দিন বললেন, ‘হয়তো কিছু রক্ষী সঙ্গে নিতে পারি। সৈন্যের প্রয়োজন এখানেই বেশী। খৃস্টান শত্রুরা মিশরে ধ্বংসাত্মক কাজ এ জন্য বাড়িয়ে দিয়েছে, যাতে আমি ফিলিস্তিনের দিকে অগ্রসর না হয়ে মিশরে ফিরে যাই। আমি তাদের এ উদ্দেশ্য পূরণ হতে দিতে পারি না। কিন্তু মিশরের সমস্যাও আমি এড়িয়ে যেতে পারবো না। আমাকে অবশ্যই মিশর যেতে হবে, তবে আমি ফিলিস্তিনের দিকে আমার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবো।’
সুলতান আইয়ুবীর সন্দেহ ভিত্তিহীন ছিল না। খৃস্টানদের বুদ্ধি ও কৌশল তার চেয়ে কেউ বেশী বোঝেন না। যখন তিনি করবস্থানে ফাতেহা পাঠ করে তার সামরিক হেড কোয়ার্টারে যাচ্ছিলেন, তখন শেখ মান্নান ত্রিপলী পৌঁছে গিয়েছিল। হাসান বিন সাবাহের পর এই দলের মুরশিদ রূপে আবির্ভূত হয় শেখ মান্নান। এই ব্যক্তিই এখন ফেদাইন খুনীচক্রের দলনেতা।
সুলতান আইয়ুবী খৃস্টান ও তাদের পদলেহী মুসলিম গাদ্দারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে ফাঁক তালে সে তার দলকে আরো মজবুত ও সক্রিয় করে তোলে। কারণ আইয়ুবী ও খৃস্টান পক্ষ মুখোমুখি হওয়ায় তার দিকে নজর দেয়ার মত সময় কারো ছিল না। এই সময় এ ভাড়াটে খুনীর দল শেখ মান্নানের নেতৃত্বে সুসংহত ও তৎপর হয়ে উঠে। তারা খৃস্টান ও তার সহযোগীদের কাছ থেকে পয়সা পেয়ে সুলতান আইয়ুবীর উপর বহু বার আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই তাঁকে হত্যা করার পরিবর্তে নিজেরাই খুন হয়ে গেছে। যারা খুনের হাত থেকে বাঁচতে পেরেছে, তারা হয়েছে বন্দী।
খৃস্টানরা শেখ মান্নানকে আছিয়াত দুর্গটি উপহার দিয়েছিল আইয়ুবীকে হত্যা করার শর্তে। দুর্গটি ১১৭৬ সালের মে মাসে সুলতান আইয়ুৰী দখল করে নেন। শেখ মান্নানকে দলবলসহ নিরস্ত্র অবস্থায় কেল্লা থেকে বেরিয়ে যাওয়ারও সুযোগ দিলে ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায় তারা। এই ক্ষমাই যেন আইয়ুবীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল, অন্তত এখন আইয়ুবীর তাই মনে হচ্ছে।
শেখ মান্নান ১১৭৬ সালের জুন মাসে ত্রিপলী গিয়ে উপস্থিত হয়। তার সাথে তার বাহিনী এবং সাঙ্গ-পাঙ্গরাও ছিল। ত্রিপলী (বর্তমান লেবানন) ও তার আশপাশের বিস্তৃত এলাকা খৃস্টান রাজা রিমাণ্ডের অধিকারে ছিল। শেখ মান্নান তার কাছে গিয়ে আশ্রয় চাইল।
শেখ মান্নানকে পেয়ে খুশী হল রিমাণ্ড। সে অনতিবিলম্বে অন্যান্য খৃস্টান সম্রাট ও ক্রুসেড নেতাদের ত্রিপলী ডেকে পাঠালো। উদ্দেশ্য, সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত ও অপ্রতিরোধ্য যুদ্ধের কর্মসূচী গ্রহণ করা।
খৃস্টান গোয়েন্দা সংস্থার অভিজ্ঞ পরিচালক জার্মান বংশোদ্ভূত হরমনও সেই সভায় উপস্থিত হল। সবাই আসন গ্রহণ করার পর শেখ মান্নান বলতে শুরু করল, ‘আপনারা আমাকে এই বলে অভিযুক্ত করতে পারেন যে, আমি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে পরাজিত হয়ে এখানে এসেছি। আপনারা জানেন, আমরা সৈন্যদের মত সম্মুখ লড়াইয়ে পারদর্শী নই। সুলতান আইয়ুবীর মোকাবেলা করতে গিয়ে যেখানে আপনাদের বিশাল বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে আমরা মুষ্টিমেয় ফেদাইন কেমন করে সাফল্যের আশা করতে পারি। আমার তো মনে হয়, আপনারা আপনাদের মুসলমান বন্ধুদের সৈন্য সাহায্য দান করলেও সুলতান আইয়ুবীর মোকাবেলায় তারা সফল হতে পারবে না।’
‘শেখ মান্নান! গর্জে উঠল রাজা রিমাণ্ড, ‘এ বিষয়টি আমাদের মধ্যেই আলোচনা করতে দাও। আমরা সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো সেটা আমাদের ব্যাপার। আমরা কি পারি না পারি, সে পর্যালোচনা করতে আমরা তোমাকে ডেকে পাঠাইনি। আমরা তোমাকে বলতে চাই, তুমি সুলতানকে হত্যা করার কথা বলে বার বার আমাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছ। কিন্তু প্রতিবারই তোমার লোক ব্যর্থতা বরণ করেছে। শেষ বার যে চারজনকে পাঠিয়েছিলে, তারাও ব্যর্থ হয়েছে। আইয়ুবীকে খুন করার পরিবর্তে নিজেরাই খুন হয়ে গেছে তারা। সুলতান আইয়ুবীর ওপর তোমার একটি অভিযানও সফল হয়নি। এতে কি প্রমাণ হয় না, তুমি অযোগ্য ব্যক্তিদের পাঠিয়েছিলে? তারা মারা যাক অথবা গ্রেফতার হোক, তাতে তোমার কিছু যায় আসে না? আমরা তোমাকে যে মূল্য দিয়েছি সেগুলো সবই বৃথা গেছে?”
‘শুধু এক সালাহউদ্দিনকে হত্যা করা যায়নি বলে আপনাদের সব অর্থ বৃথা গেছে, এই যদি হয় আপনার বক্তব্য, তাহলে আমি বলবো, আপনি ঠিক বলেননি।’ শেখ মান্নান বললো, ‘আমি মিশরে সুলতান আইয়ুবীর যে দু’জন চৌকস সেনা অফিসারকে হত্যা করিয়েছি, তার মূল্যটা হিসাবে ধরবেন না? আপনার তিন শক্তিশালী শত্রু সুদানে ছিল, তাদেরকে আমি কবরে নামিয়েছি। এর ফলে সেখানে আপনার প্রবেশের রাস্তা বাঁধা মুক্ত হয়েছে, এর মূল্যটা কি আপনি ধরবেন না? আপনার ইঙ্গিতে আমি মিশরে গুপ্তহত্যা শুরু করে দিয়েছি। আপনি কি সে কাজকেও ব্যর্থ বলবেন?”
‘আইয়ুবী কবে নিহত হবে?’ ফ্রান্সের ক্রুসেড নেতা গে অব লুজিনান টেবিলে থাবা মেরে বললো, ‘তুমি নূরুদ্দিন জঙ্গীকে বিষ দিয়েছিলে, তেমন করে কবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে বিষ দিয়ে হত্যা করতে পারবে?”
‘সে কথা এখন আমি কেমন করে বলবো? এখন তো বাতাস সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর অনুকূলে বইছে। আপনাদের সহায়তায় যে সব মুসলমান তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, তারাই এখন সুলতান আইয়ুবীর সমর্থক ও অনুগত হয়ে গেছে। হলবের আল মালেকুস সালেহ ও তার সহযোগী সাইফুদ্দিন আইয়ুবীর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। তার বিরোধী গুমাস্তগীন খুন হয়েছে। এ অবস্থায় তাকে হত্যা করা সহজ হবে না। তবে আমি আপনাদের কথা দিতে পারি, যেদিন সেই ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হবে, তাকে আমি অবশ্যই খুন করবো।’
‘সেই ধরনের অবস্থা বলতে তুমি কি বুঝাতে চাচ্ছো? আইয়ুবী কি স্বেচ্ছায় তোমার তলোয়ারের নিচে এসে মাথা পেতে দেবে?’
‘না, তা দেবেন কেন? তবে যেমন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল নূরুদ্দিন জঙ্গীর সময়, তেমন সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে ঘায়েল করা সম্ভব নয়।’ শেখ মান্নান বললো, ‘নূরুদ্দিন জঙ্গী ভুমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় এমন বেকারার হয়ে দৌড়ঝাঁপ করতেন, অন্য কোন দিকেই তার খেয়াল ছিল না। তার নাওয়া-খাওয়ার কোন সময় ছিল না। কে তার রান্না করছে, কে খাওয়াচ্ছে, এসব দিকে নজর দেয়ার সময়ও ছিল না তার। এই সুযোগটাই গ্রহণ করেছিল আমার খুনীরা। তারা এমন বিষ খাদ্যের মধ্যে মিশ্রিত করে দিয়েছিল, যাতে তার গলার ভেতর ক্ষত হয়ে যায় এবং গলা ফুলে যায়। সেই খাবার গ্রহণের পর তিনি শয্যাশায়ী হতে বাধ্য হন। চিকিৎসকরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার রোগের কারণ খুঁজে বের করতে পারেনি। তিনি তিন-চারদিন বিছানায় শুয়ে ছটফট করে কাটান। পঞ্চম দিন অত্যধিক গলা ফোলার কারণে তাঁর নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এবং তিনি মারা যান। তাঁর ব্যক্তিগত হাকীম মৃত্যুর পর যে ডাক্তারী রিপোর্ট লেখেন তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, নূরুদ্দিন জঙ্গী ‘গলা ফোলা’ রোগে মারা গেছেন। কিন্তু সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর অবস্থা ভিন্ন। তার বিশ্বস্ত ও নির্ধারিত বাবুর্চি ছাড়া অন্য কেউ তার খাদ্য দ্রব্যের কাছেও যেতে পারে না।’
‘তুমি কি সে বাবুর্চিকে কিনতে পারো না?’ এক কমাণ্ডার প্রশ্ন করল।
‘এ প্রশ্নের উত্তর আমার চেয়ে আমাদের বন্ধু হরমন ভাল দিতে পারবেন।’ শেখ মান্নান হরমনের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
❀ ❀ ❀
হরমন। গোয়েন্দা জগতের এক অমূল্য প্রতিভা। ব্যক্তিগতভাবে তিনি জার্মানীর নাগরিক হলেও সমগ্র খৃস্ট জগতে রয়েছে তার অবাধ যাতায়াত। আলী বিন সুফিয়ানের মতই গোয়েন্দাগিরীতে লোকটি অসামান্য দক্ষ। তার চোখের অনুসন্ধানী দৃষ্টি মানুষের বুকের হাড় অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকে যায়। চরিত্র হনন ও ধ্বংসাত্মক কাজে তিনি সমান পারদর্শী।
অতীতে মিশরে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যে কয়টি ষড়যন্ত্র কিছুটা কার্যকর হয়েছিল তার পরিকল্পনা তিনিই করেছিলেন। সুলতান আইয়ুবীর কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারকে তিনি তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। অথচ তারা আইয়ুবীর খুবই বিশ্বস্ত ছিল। তিনি মুসলমান আমীর ও অফিসারদের মনস্তাত্ত্বিক দিক ভাল বুঝতেন। তাকে কাজে লাগানোর কৌশলও ভাল জানতেন তিনি। খৃস্টান রাজা ফিলিপ অগাস্টাস তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। লোকটির মেধা ও যোগ্যতা, এমন ঈর্ষণীয় ছিল যে, তিনি সুদান, মিশর ও আরবের সব এলাকার স্থানীয় ভাষা হুবহু সেই ভাবেই উচ্চারণ করতে পারতেন। ফলে যে অঞ্চলে তিনি যেতেন, লোকেরা তাকে সে অঞ্চলেরই একজন মনে করতো।
‘শেখ মান্নান ঠিকই বলেছে।’ হরমন বললো, ‘এর উত্তর আমারই দেয়া উচিত। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বাবুর্চিকে কেন কেনা যায় না তা আমার চাইতে কেউ বেশী জানে না। ব্যাপারটি যদি শুধু সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর হতো, তবে তিনি বিষ পান করে কবেই মারা যেতেন। কারণ তিনি তার নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে কখনো চিন্তা করেন না। তার খাবার কেউ পরীক্ষা করলো কি না, এ খবর তিনি কোনদিনই নেননি। তিনি তার জীবন ও প্রাণ আল্লাহর হেফাজতে ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, আল্লাহ তাঁর মৃত্যু যে দিন লিখে রেখেছেন সে দিনই হবে।
তার দেহরক্ষী দলের কমাণ্ডার, ইন্টেলিজেন্সের এক দায়িত্বশীল অফিসার এবং আলী বিন সুফিয়ানের নিয়োজিত আরো এক ব্যক্তি তার খাবার পরীক্ষা করে ভাল ভাবে দেখেশুনে তবে তার সামনে পরিবেশন করে। কখনও কখনও সুলতানের ব্যক্তিগত ডাক্তারও এসে তাঁর বাবার চেক করে যায়।’
এতসব কড়া তত্ত্বাবধান ছাড়া আরও একটি অসুবিধা হলো, তার বাবুর্চি ও চাকর-বাকররা সবাই তার মুরীদ। তাদের অন্তরে তার জন্য রয়েছে অন্ধ ভক্তি, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা ভালবাসা। কারণ আইয়ুবী তাদেরকে চাকর মনে করে না। তাদের সাথে ভাই অথবা বন্ধুর মত ব্যবহার করে। আমরা বিষয়টি গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এই বিশ্বস্তু দলের মধ্য থেকে কাউকে কেনা যেমন কঠিন, তার মধ্যে অন্য কাউকে ঢোকানোও কঠিন। তার চারপাশে যে সব ব্যক্তিবর্গ আছে, তারা তার চারপাশে নিচ্ছিদ্র প্রাচীর খাঁড়া করে রেখেছে। বিশেষ করে আলী বিন সুফিয়ান, গিয়াস বিলকিস, হাসান বিন আব্দুল্লাহ ও জাহেদানের চোখ এড়িয়ে তার কাছে পৌঁছা কিছুতেই সম্ভব নয়। ওরা সবাই বিচক্ষণ ও অনুসন্ধানী দৃষ্টির অধিকারী। ওরা মানুষের চোখের ভাষা যেমন পড়তে পারে, তেমনি মানুষের অন্তরের গোপন গহীনে লুকিয়ে রাখা ইচ্ছা এবং স্বপ্নগুলোও পড়ে ফেলতে পারে। তাই কোন খুনী আইয়ুবীর কাছে পৌঁছতে পারে না।’
‘ইসলামের সমাপ্তি!’ ফিলিপ অগাস্টাস বললো, ‘আমি শতবার বলেছি যে, আমাদের কাজ হলো, ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা। এ এমন এক ধর্ম, যা মানুষকে বশীভূত করে ফেলে। এ ধর্ম মানুষের দেহকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি তার আত্মাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। যে ব্যক্তি ইসলামকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে, দুনিয়ার কোন শক্তিই তাকে পরাজিত করতে পারে না। আপনারা দেখেছেন, সুলতান আইয়ুবীর পাশে যে সব মুসলমান আছে, তারা কট্টর ধর্ম বিশ্বাসী। ধর্মের প্রতি তাদের এমনি অটল বিশ্বাস যে, অর্থ-সম্পদ, হীরা-জহরত ও সেরা সুন্দরী দিয়েও ধর্মের সাথে তাদের আত্মার বন্ধন ছিন্ন করা যায় না। তোমরা যাদের খরিদ করতে পারো, তারা দুর্বল ঈমানের মুসলমান। তারা ইসলামকে অন্তরে গভীরভাবে গ্রহণ করেনি বলেই তোমরা তাদের পাকড়াও করতে পারছে। তোমরা দেখেছো, আমাদের বিশাল বাহিনীকে সুলতান আইয়ুবীর অই সংখ্যক সৈন্য কেমন করে পরাস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করে। যেখানে আমাদের সৈন্য ও অশ্বগুলো পিপাসায় ক্লান্ত হয়ে যায় সেখানে সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা পিপাসা ও ক্লান্তি থেকে থাকে একেবারে নির্বিকার। এই ধৈর্যকেই তারা বলে ঈমান। আমাদের প্রথম কাজ হলো তাদের এই ঈমানকে দুর্বল করা। হরমন তাদের দু’চার জন উচ্চ অফিসার ও আমীরকে কৌশলে মুঠোর মধ্যে নিয়েছে, এটা অবশ্যই প্রশংসার কাজ। এর দ্বারা আমরা অনেক উপকার পাব। কিন্তু এখন এমন পথ অবলম্বন করতে হবে, যাতে এ জাতির মন থেকে ধর্মের নেশা কেটে যায়। যাতে ধর্মের বিরুদ্ধে একটা অসন্তোষ ওদের মনেই দানা বেঁধে ওঠে। বয়স্কদের কাছে ইসলামের বিরুদ্ধে বলে তাদের মন পরিবর্তন করা সহজ ব্যাপার নয়। তাই তাদের বংশধর ও নতুন প্রজন্মের সামনে বিভ্রান্তির জাল বিস্তার করতে হবে। তাদেরকে তোমাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করো। তাদের কাঁচা মনে যে কোন মতবাদ কার্যকরী হবে। তাদের মধ্যে পশু প্রবৃত্তি ও ধ্বংসাত্মক কাজের প্রেরণা দান কৱো।’
‘ইহুদীরা এ কাজে বেশী পারদর্শী।’ হরমন বললো, ‘তারাই এখন রণাঙ্গণে এ দায়িত্ব পালন করছে। আমিও চেষ্টা করছি। আমাদের প্রচেষ্টার ফল ক্রমশ ফলতে শুরু করেছে। একদিনে বা কয়েকদিনে আপনি কোন মতবাদ ও বিশ্বাস পরিবর্তন করতে পারবেন না। এমন কাজে অনেক সময়ের প্রয়োজন, এর পিছনে যুগ যুগ কেটে যায়।’
‘এ কাজ চালিয়ে যেতে হবে।’ ফিলিপ অগাস্টাস বললেন, ‘আমরা এ আশা করবো না যে, পরিণাম ফল আমাদের জীবনেই সফল হয়ে যাবে। আমার পূর্ণ বিশ্বাস, যদি আমরা চরিত্র হননের এই কাজে তৎপর থাকি, সেদিন বেশী দূরে নয়, মুসলমান শুধু নামকাওয়াস্তে মুসলমান থাকবে। তাদের সামনে ধর্মীয় দায়িত্ব শুধু সামাজিক নিয়ম ও প্রথা হিসেবেই থেকে যাবে। তাদের উপরে ধীরে ধীরে খৃস্টানী চাল-চলন চালু হয়ে যাবে। তাদের চিন্তাধারায় খৃষ্টান জগত প্রাধান্য পাবে।’
‘শেখ মান্নান!’ রাজা রিমাণ্ড বললেন, ‘যদি তুমি আছিয়াত দুর্গের পরিবর্তে অন্য কোন দুর্গ চাও, তবে আমরা এক্ষুণি সে দাবী পুরণ করতে পারবো না। আমাদের চুক্তি ঠিকই থাকবে। কেল্লার শর্ত ছাড়া অন্যান্য শর্ত বহাল থাকবে। তুমি যথা নিয়মে তোমার প্রাপ্য পেতে থাকবে। যদি তুমি আর্থিক অনুদান ও সাহায্য ঠিক মত পেতে চাও, তবে কায়রোসহ সমস্ত মিশরে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সেনাবাহিনী ও সরকারী গুরুত্বপূর্ণ লোকদের হত্যা করার কর্মসূচী অব্যাহত রাখবে। আর সেই সাথে সুযোগ মত সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করার চেষ্টাও জারী রাখবে।’
‘সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করার বিষয়ে আমি স্পষ্ট বলতে চাই, আমি তার পিছনে আর কোন লোক ক্ষয় করতে চাই মা।’ শেখ মান্নান বললো, ‘তাকে হত্যা করা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। তার পিছনে লেলিয়ে দিয়ে আমি আমার সবচেয়ে দামী ও দক্ষ ফেদাইনদের শেষ করেছি। আমার বলতে দ্বিধা নেই, সুলতান আইয়ুবী আমাকে নতুন জীবন দান করেছে। আমি যখন তার সামনে অস্ত্র সমর্পণ করলাম, তখন ভেবেছিলাম, আমি তার ওপর যে হত্যা প্রচেষ্টা চালিয়েছি তাতে তিনি আমাকে তো হত্যা করবেনই সেই সাথে নেতৃস্থানীয় সকল ফেদাইনকে নির্মূল করবেন। কিন্তু তিনি আমাকে ও আমার সঙ্গীদের সকলকেই ক্ষমা করলেন। তিনি নিজ মুখে ক্ষমা ঘোষণা করার পরও আমি তা বিশ্বাস করতে পারিনি। ভেবেছিলাম, তিনি আমাদের সাথে তামাশা করছেন। তিনি যে আমাদের ধোঁকা দিচ্ছেন না, এ কথা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, আমরা যখনই যাওয়ার জন্য ফিরে দাঁড়াবো সঙ্গে সঙ্গে তার তীরন্দাজরা আমাদের পিঠে তীর বিদ্ধ করে হত্যা করবে বা আমাদের উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দেবে। কিন্তু আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, আমি এবং আমার সঙ্গী-সাথীরা সবাই বহাল তবিয়তে আপনাদের সামনে এসে উপস্থিত হতে পেরেছি। আপনারা আমাকে সাহায্য দেয়া বন্ধ করলেও আমি আর সুলতান আইয়ুবীকে হত্যার কোন চেষ্টা করবো না। কিন্তু কায়রোতে আমার ফেদাইন কর্মীরা আপনাদের নিরাশ করবে না। কায়রোতে এমন অবস্থার সৃষ্টি করা হবে, সুলতান আইয়ুবী তার অগ্রাভিযান বন্ধ রেখে কায়রো ফিরে আসতে বাধ্য হবে।’
হরমন বলল, ‘হ্যাঁ, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমিও ভেবে রেখেছি, খুব শীঘ্রই সুদানীদের দিয়ে মিশরের সীমান্ত চৌঁকিতে আবার আক্রমণ চালাবো। তবে এ মুহূর্তে মিশরের ওপর কোন বড় রকমের আক্রমণ চালানোর প্রয়োজন নেই। আক্রমণের এমন পায়তারা করতে হবে, যাতে সুলতান আইয়ুবী সিরিয়া থেকে মিশরে ফিরতে বাধ্য হন।
হরমন ছিল গোয়েন্দাগিরী ও কূটচালে বিশেষ দক্ষ ব্যক্তি। কিন্তু সেও জানতো না, এই কনফারেন্সে এমন ব্যক্তি উপস্থিত আছে, যার মাধ্যমে সুলতান আইয়ুবী তাদের সকল তৎপরতার খবর পেয়ে যাবে। লোকটি এখানকার পানশালার এক কর্মচারী। অফিসারদের মদ ও আহারের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত। নাম ভিক্টর। ফ্রান্সের নাগরিক। সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা হিসাবে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে।
তার এক সঙ্গী আছে রাশেদ চেঙ্গিস। তুর্কী মুসলমান। সে নিজেকে গ্রীকের এক খৃষ্টান নাগরিক পরিচয় দিয়ে এখানে চাকরীতে ঢুকেছে। এই রাশেদও সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা।
এদেরকে অনেক যাচাই বাছাই করার পর এখানে ডিউটি দিয়েছে খৃস্টানরা। কারণ এখানকার কনফারেন্সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকের সমাগম ঘটে। অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তিরা আসেন এখানে। আসেন বিভিন্ন দেশের রাজা ও সম্রাটগণ, আসেন সমরবিদ ও সেনাপতিরা, কূটনৈতিক মিশনের উচ্চপদস্থ অফিসার, প্রশাসনের বড় বড় দায়িত্বশীলগণ।
এদের মিটিংয়ে উপস্থিত থেকে আহার ও পানীয় সরবরাহ করার জন্য যাদের নিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ভিক্টর এবং রাশেদও ছিল।
আমরা জানি, সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারা সর্বত্র জালের মত ছড়িয়ে আছে। খৃস্টানদের ভেতরের তথ্য ও সংবাদ জানার জন্য সেখানেও ঢুকে পড়েছিল আইয়ুবীর গোয়েন্দারা। তাদেরই দুইজন ভিক্টর ও রাশেদ। শেখ মান্নানের সাথে খৃষ্টান সম্রাটদের কি কি কথা হল, সবই শুনে নিল এই দুই গোয়েন্দা। এর বিস্তারিত রিপোর্ট দু’একদিনের মধ্যেই সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে যাবে।
❀ ❀ ❀
কায়রোতে তখন ধ্বংসাত্মক তৎপরতা পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। একদিন মিশরীয় বাহিনীর এক কমাণ্ডারের লাশ পাওয়া গেল শহরের বাইরে। সন্ধ্যার পরে সে বাড়ীর বাইরে গিয়েছিল ব্যক্তিগত কাজে। সারা রাত বাড়ীতে না ফেরায় বাড়ীর লোকজন চিন্তিত হল। সকাল বেলা তার লাশ পাওয়া গেল শহরের বাইরে। তার শরীরে কোন ক্ষতচিহ্ন ছিল না। সামান্য আঘাতের চিহ্নও পাওয়া যায়নি কোথাও। লাশের ময়না তদন্ত হল। তদন্তকারী দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করল। তারা সেখানে শুধু তার পায়ের চিহ্নই দেখতে পেল। কমাণ্ডারের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হল। সবাই তার চরিত্র ও চাল-চলন সম্পর্কে ভাল মন্তব্য করল। নিন্দার পরিবর্তে সকলেই তার প্রশংসা করল। কোন সন্দেহভাজন লোকের সাথে তার মেলামেশা ছিল বলে জানা গেল না। তার স্ত্রীর জবানবন্দী নেয়া হল। স্ত্রী তাকে সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি বলে উল্লেখ করল। সে আরো জানাল, কমাণ্ডার খুবই কর্তব্যপরায়ণ ও হাসি খুশী দীলখোলা প্রকৃতির লোক ছিল।
এটা যে একটা খুন এ ব্যাপারে তদন্তকারী দলের কোন সন্দেহ ছিল না, কিন্তু শত অনুসন্ধান করেও খুনীর কোন সন্ধান পেল না তারা। এমনকি অনুসন্ধানের জন্য কোন প্রমাণ বা সূত্রও তারা উদ্ধার করতে পারল না।
তিন চার দিন পরের ঘটনা। সে যে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল তার মৃত্যুর পর অন্য এক কমাণ্ডারের ওপর সে দায়িত্ব অর্পন করা হয়। দায়িত্ব পাওয়ার তিন দিনের মাথায় একই পরিণতি ঘটে তার। সারাদিন ডিউটি শেষে রাতে সে তার কামরায় ঘুমিয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে না উঠায় সঙ্গীরা তাকে ডাকাডাকি করল, কিন্তু ঘুম ভাঙল না তার। শেষে কামরার দরজা ভেঙে দেখা গেল সেই সেনা কমাণ্ডার তার নিজের কামরায় মৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
সেনা ব্যারাকে সে একা এক কামরায় থাকতো। তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হল। সকলেই তার সম্পর্কে খুব ভাল রিপোর্ট দিল। তার বন্ধু মহল শোকাতুর কণ্ঠে জানাল, তার সাথে কারো কোন বিবাদ বা মননামালিন্য ছিল না। হত্যার স্পষ্ট কোন কারণ ছিল না। বাহ্যত এটাকে খুন বলার কোন অবকাশ নেই। কারণ তার শরীরে কোন আঘাত বা ক্ষতচিহ্ন ছিল না। এমনকি সামান্য আঁচড়ের দাগও নেই শরীরের কোথাও।
সরকারী ডাক্তার লাশ দেখলেন। লাশের ঠোঁটের কোণে সামান্য একটু শুকনো ফেনা মত ছিল। তিনি সেই ফেনা কাঠি দিয়ে উঠিয়ে একটি পাত্রে রাখলেন। তারপর তিনি একটি কুকুর আনালেন। ফেনাটুকু এক টুকরো মাংসের সাথে লাগিয়ে মাংসের টুকরাটি কুকুরকে খেতে দিলেন।
তিনি কুকুরটি তার বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। ঘরে বসে লক্ষ্য রাখা যায় এমন একটি জায়গায় কুকুরটি বেঁধে রেখে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। কুকুরটা কোন রকম অস্বাভাবিক আচরণ করল না। অযথা ছুটাছুটি বা চিৎকার করলো না। তাকে যে খাবার দেয়া হলো সেগুলো সে স্বাভাবিক ভাবেই খেয়ে নিল। ডাক্তার সারা রাত জেগে থেকে কুকুরটির প্রতি লক্ষ্য রাখলো। মাঝ রাতের পর কুকুরটি দড়ি টানতে শুরু করল। যত সময় যেত লাগল ততই তার ছুটাছুটি বাড়তে লাগল। অনেক্ষণ ছুটাছুটির পর কুকুরটি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে তার দৌড়াদেড়ি বন্ধ হয়ে গেল এবং দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে কুকুরটা হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
ডাক্তার বাইরে এলেন। কুকুরটির কাছে গিয়ে দেখলেন, কুকুরটি মারা গেছে। ডাক্তার রিপোর্ট দিলেন, কমাণ্ডার দু’জনকে এমন বিষ প্রয়োগ করে মারা হয়েছে, যে বিষ প্রয়োগ করার সাথে সাথেই আক্রান্ত ব্যক্তি তা টের পায় না। একটা বিশেষ সময় পরে সে বিষের ক্রিয়া শুরু হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি কিছু বুঝে উঠার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বিষ রোগীর কেবলমাত্র হার্টে আঘাত করে এবং ওখানেই জমাটবদ্ধ হয়ে থাকে। ফলে সারা শরীরের আর কোথাও তার প্রভাব পড়ে না। এ জন্যই কমাণ্ডার দু’জনের রক্ত ও গোশত পরীক্ষা করে আমরা কোন বিষের সন্ধান পাইনি।
ডাক্তারের রিপোর্ট পাওয়ার পর গোয়েন্দা বিভাগ ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। এই অভিনব পদ্ধতিতে এর আগে আর কোন খুনের ঘটনা এখানে ঘটেনি। তাদের মনে হলো, যুদ্ধের একটি নতুন সেক্টর খুলে বসেছে দুশমন। তারা ব্যাপারটা আলী বিন সুফিয়ানকে জানাল।
আলী বিন সুফিয়ানও বিষয়টি জানতে পেরে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি। কিন্তু শত্রুকে এখনি পাকড়াও করতে না পারলে ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। একজন দুজন নয়, হাজার হাজার সৈন্য সহজেই শিকার হতে পারে এ বিষের। কেবল সৈন্যরা নয়, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ অফিসার, আমীর-ওমরা, সেনাপতি, এদের যে কেউ যে কোন সময় আক্রান্ত হতে পারে।
আলী বিন সুফিয়ান এই খুনী চক্রের হোতাদের খুঁজে বের করার জন্য কঠিন সংকল্প গ্রহণ করলেন। মরার আগে এই কমাণ্ডাররা কার কার সাথে সাক্ষাৎ করেছে, কোথায় গিয়েছে, কার সাথে খানা খেয়েছে, এসব খোঁজখবর নেয়া শুরু করলেন তিনি। কিন্তু এর থেকে সন্দেহভাজন এমন কাউকে খুঁজে পেলেন না, যার পিছনে লেগে এ ষড়যন্ত্রের সুরাহা করা যেতে পারে।
কমাণ্ডারের স্ত্রীকে ডেকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো, কিন্তু তার কাছ থেকেও কোন তথ্যই এমন পাওয়া গেল না, যাকে অবলম্বন করে সামনে অগ্রসর হওয়া যায়।
কমাণ্ডার দু’জনই খাঁটি মুসলমান ছিল, নিষ্ঠাবান মুজাহিদ ছিল। যুদ্ধের ময়দানে এ দুই কমাণ্ডারের বীরত্ব ও সাহসিকতা দেখে স্বয়ং সুলতান আইয়ুবীও তাদের প্রশংসা করেছেন। এরা দু’জনই সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করেছে। তাদের সময় কোন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বর্ডার অতিক্রম করতে পারেনি। সুদানী অনুপ্রবেশকারীরা বহু বার তাদের হাতে ধরা পড়েছে। সুদানীরা মোটা অংকের ঘুষ দিতে চেয়েও কখনোই তা দিতে পারেনি এবং গ্রেফতার এড়াতে পারেনি। লোভ এবং ভয় দু’টোই তারা জয় করে নিয়েছিল। তাদের তৎপরতায় খুশী হয়ে সরকার তাদের পদোন্নতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শীঘ্রই এ দুই কমাণ্ডারকে সহ-সেনাপতি পদে পদোন্নতি দেয়ার ঘোষণা জানানো হতো। কিন্তু আফসোস, ঘোষণা শোনার আগেই দুশমনের মরণ বিষ কেড়ে নিল তাদের জীবন।
ঘটনার আকস্মিকতায় আলী বিন সুফিয়ান গোয়েন্দা বাহিনীর কমাণ্ডারদের সম্মেলন ডাকতে বাধ্য হলেন। তিনি ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে সমবেত কমাণ্ডারদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমি নিশ্চিত, এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড দু’টি ক্রুসেড দুষ্কৃতকারীরা ঘটিয়েছে, আর তাদের হয়ে এ কাজ আঞ্জাম দিয়েছে খুনী ফেদাইন চক্র।’ তিনি আরো বললেন, শত্রুরা এখন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যার কাজ শুরু করে দিয়েছে। তাই সেনাবাহিনীর সমস্ত কমাণ্ডার ও অফিসারদের সতর্ক থাকতে হবে। কোন অজানা লোক ও সন্দেহভাজন ব্যক্তির দেয়া কোন কিছু খাওয়া যাবে না। বরং এমন অচেনা ও সন্দেহজনক লোককে চোখে চোখে রাখতে হবে। প্রয়োজনে তাদের গ্রেফতার করতে হবে।’
দ্বিতীয় কমাণ্ডার হত্যার আট দিন পরের ঘটনা। এক রাতে সৈন্যরা ক্যাম্পে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়েছিল। ক্যাম্প প্রহরীরা যথারীতি পাহারা দিচ্ছিল ক্যাম্প, হঠাৎ ক্যাম্পে আগুন লেগে গেল। আগুনটা লাগল ক্যাম্পের গুদাম ঘরে। এক জায়গায় হাজার হাজার তাঁবু স্তুপ করে রাখা ছিল। স্তুপের ওপর ছিল তাঁবুর ছাউনি। সেখানে রোজকার মত সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছিল, তবুও সেখানে কেমন করে যেন আগুন লেগে গেল।
এই অগ্নি সংযোগের ব্যাপারটা আলী বিন সুফিয়ানকে নতুনভাবে ভাবিয়ে তুলল। এটা যে শত্রুদের নাশকতামূলক কাজেরই একটা অংশ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ এখানে হঠাৎ করে আগুন লাগার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। এর আশেপাশে রান্নাবান্না বা অন্য কোন কারণে কখনো আগুন জ্বালানোর প্রয়োজন পড়ে না।
একদিকে অচেনা বিষের ছোবল, অন্যদিকে খোদ সেনা ছাউনীতে আগুন দেয়ার বিষয়টি যেমন আলী বিন সুফিয়ানকে চিন্তাগ্রস্ত করে তুলল, তেমনি আরো একটি সমস্যা পেরেশান করে তুলল আলী বিন সুফিয়ানকে। ইদানিং সীমান্ত ফাড়িগুলো থেকে যে সংবাদ আসছে তাতে দেখা যাচ্ছে, সুদানের বর্ডার দিয়ে চোরের মত গোপনে বর্ডার পার হওয়ার প্রবণতা খুব বেড়ে গেছে। সীমান্ত ফাঁড়িগুলোকে এ ব্যাপারে সাবধান ও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। অবশ্য সীমান্ত প্রহরীরা যথেষ্ট সজাগ ও সতর্ক। তাই ইদানিং গ্রেফতারের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সুদানীদের এই অনুপ্রবেশের পিছনে নিশ্চয়ই কোন কুমতলব কাজ করছে। সব মিলিয়ে অবস্থা বেশ নাজুক ও জটিল হয়ে গেছে। এ অবস্থায় কি করা যায় ভেবে কোন কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না আলী বিন সুফিয়ান। বিষয়টি তিনি গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে জানানোর তীব্র তাগিদ অনুভব করলেন।
আলী বিন সুফিয়ান তার গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা আরও বাড়িয়ে দিলেন। আগের চেয়ে বেশী সাবধানতা অবলম্বন করার নির্দেশ দিলেন গোয়েন্দা কর্মীদের।
❀ ❀ ❀
কায়রো থেকে দূরে নীলনদের পাশে এক পাহাড়ী এলাকা। সেই বিরান পাহাড়ী অঞ্চলে ফেরাউন যুগের কিছু ধ্বংসাবশেষ ছিল। ক্রুসেডার ও সুদানীরা এই ধ্বংসাবশেষের ভেতর গোপন আড্ডা বানিয়ে এখান থেকে তাদের অভিযান পরিচালনা করতো।
কেবল সে পাহাড়ী অঞ্চল নয়, মিশরে এমন পুরাতন ধ্বংসাবশেষ অনেক অঞ্চলেই ছিল। এই সব পাহাড়ী এলাকায় কড়া দৃষ্টি রাখার জন্য আলী বিন সুফিয়ান তার গোয়েন্দাদের মধ্য থেকে একদল কমাণ্ডোকে বাছাই করলেন। তাদেরকে বিশেষ কিছু নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সে সব অঞ্চলে। দুর্গম পাহাড়ী এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়লো আলীর পাঠানো গোয়েন্দা বাহিনী। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই সেসব এলাকা থেকে আলীর কাছে ফিরে এলো দুঃসংবাদ।
এই এক মাসের মধ্যেই আলী বিন সুফিয়ানের পাঁচ জন গোয়েন্দা ময়দান থেকে একদম হাওয়া হয়ে গেল। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার, কোন একটি বিশেষ এলাকা থেকে নয়, কায়রোর আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এরা নিখোঁজ হয়েছে। আলীর কাছে আরো খবর এল, এরা কেউ বিশ্রামের সময় নয়, বরং গায়েব হয়েছে ডিউটিরত অবস্থায়।
এরা এমন গোয়েন্দা ছিল, যারা ক্রুসেড গোয়েন্দাদের গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে অতীতে পারদর্শীতা দেখিয়েছে। কিন্তু আজ তারা নিজেরাই নিখোঁজ হয়ে গেছে। হয়তো গ্রেফতার হয়েছে নতুবা মারা গেছে। যাই ঘটুক, আলীর জন্য কোনটাই শুভ সংবাদ নয়। মৃত্যুর চেয়ে গ্রেফতার হওয়াটাই বরং বেশী ভয়ের। কারণ, তারা ধরা পড়লে ক্রুসেড বাহিনী তাদের কাছ থেকে তথ্য আদায় করবে। এরপর তাদেরকে হাশিশ প্রয়োগ করে নেশাগ্রস্ত করবে। তারপর নেশার ঘোরের মধ্যে ফেলে তাদের সম্মাহন করবে। সমোহিত এইসব সৈন্যরা তখন মিশরের সেনাবাহিনী ও সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে অবলীলায়। কারণ তারা যে শত্রুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, এই বোধ তখন আর তাদের মধ্যে কাজ করবে না। বরং যে তাদের ক্ষমা করবে তাকেই তারা তাদের কমাণ্ডার মনে করবে।
বিপদ এখানেই শেষ নয়। আলী, বিন সুফিয়ানের সামনে আসল বিপদ হয়ে দেখা দিল অন্য বিষয়। শক্রর গোয়েন্দারা যে আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দাদের চিনে ফেলেছে, এটিকেই তিনি সবচে বড় বিপদ বলে গণ্য করলেন। গোয়েন্দাগিরীর ক্ষেত্রে নিজেকে আড়াল করাই হলো গোয়েন্দাদের প্রথম ও প্রধান কাজ। এ জন্য যে কোন ধরনের ছদ্মবেশ ধারণে তাদেরকে পারঙ্গম হতে হয়। যে গোয়েন্দা নিজের পরিচয় গোপন করতে পারে না, তার পক্ষে গোয়েন্দা কাজ করা মোটেও সম্ভব নয়।
গোয়েন্দা জগতে আলী বিন সুফিয়ানের একটি সুনাম ছিল। তাঁর কাছে ট্রেনিং পাওয়া গোয়েন্দাদের একটা মর্যাদা ছিল সর্ব মহলে। কিন্তু সে মর্যাদা ও সম্মান আজ যেন ধুলায় মিশে গেল। এক জন নয়, দু’জন নয়, এক মাসে পাঁচজন গোয়েন্দা ধরা পড়ে গেল দুশমনের হাতে! তাহলে এতদিন তিনি তাদের কি শিখিয়েছেন। তাঁর বাছাই করা গোয়েন্দারাই যদি দুশমনকে পাকড়াও করার পরিবর্তে নিজেরা ধরাশায়ী হয়ে পড়ে তাহলে সাধারণ গোয়েন্দাদের অবস্থা কি দাঁড়াবে? এসব প্রশ্ন এসে আলী বিন সুফিয়ানকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল।
সারা রাত আলী বিন সুফিয়ানের কোন ঘুম হলো না। তিনি রাতভর জেগে কাটালেন এবং চিন্তা করলেন। ফজরের আজান হলো। তিনি সৈনিকদের সাথে একত্রে জামায়াতে নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে তিনি একজন কাসেদকে ডাকলেন। কাসেদ হাজির হলে তাকে বললেন, ‘আমি একজন লোককে এই মুহুর্তে আমার কাছে পেতে চাই। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাকে আমার সাথে দেখা করার জন্য খবর দাও।’ তারপর তিনি লোকটির নাম ও ঠিকানা দিয়ে কাসেদকে বিদায় করে দিলেন।
আলী বিন সুফিয়ান একজন যোগ্য গোয়েন্দাকে খুঁজছিলেন, যার ওপর তিনি এই কাজের দায়িত্ব অর্পণ করবেন। এ সময় তার মানসপটে ভেসে উঠল একটি নাম- মেহেদী আল হাসান। মেহেদী আল হাসান জেরুজালেম ও ত্রিপলীতে খুব সফলতার সাথে গোয়েন্দাগিরী করে এসেছে। এ যুবক খুবই বীর ও সাহসী। সবচে বড় কথা, সে অসম্ভব রকম দূরদর্শী। এখনকার মিশন সফল করতে হলে এরকম দূরদর্শী লোকেরই প্রয়োজন।