খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো মেহেদী আল হাসান। আলী বিন সুফিয়ান তাকে কাছে পেয়েই বললেন, ‘যুবক, তোমাকে একটি জটিল দায়িত্ব দিতে চাই। আশা করি তুমি সানন্দে তা গ্রহণ করবে।’
“আপনি আমাকে কোন দায়িত্ব দেয়ার যোগ্য মনে করেছেন, এতেই আমি খুশী। আপনি যে কোন কঠিন দায়িত্ব আমাকে দিতে পারেন। জাতির স্বার্থে ইসলামের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।’
আলী বিন সুফিয়ান তাকে অভিযানের গুরুত্ব বুঝিয়ে বললেন। এ পর্যন্ত যা ঘটেছে সব তাকে খুলে বলে বললেন, “সেই পাহাড়ী এলাকায়ই শুধু আমাদের দুই গোয়েন্দা নিখোঁজ হয়েছে। তাই আমার মনে হচ্ছে, সেখানে ওদের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। প্রথমে আমি তোমাকে সে এলাকায়ই পাঠাতে চাই।’ মেহেদী আল হাসান সানন্দে এ দায়িত্ব কবুল করে বিদায় নিল আলী বিন সুফিয়ানের কাছ থেকে।
সেই দুর্গম এলাকায় যাতায়াতের মাত্র একটিই রাস্তা। রাস্তাটি চলে গেছে নীল নদের পাশ ঘেঁষে। রাস্তার অপর পাশে পাহাড়ী তৃণভূমি। মাঝে মাঝে উপত্যকা ও ময়দান। ছোট বড় নানা আকারের পাহাড়ের চূড়া মাইলের পর মাইল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরের দিকে সবুজ ঘাস এবং গাছপালাও আছে। কোথাও কোথাও পানির ঝিলও আছে, যার চারপাশে পাড়ের মত খাঁড়া বা আধ-খাঁড়া পাহাড়।
মেহেদী আল হাসান সে অঞ্চলে পা দিয়েই টের পেল এলাকায় সন্দেহজনক লোকের যাতায়াত আছে।
নীল নদের পাড় ধরে এগিয়ে চলল মেহেদী আল হাসান। কোথাও রাস্তা নীল নদের একদম পাশ ঘেষে এগিয়েছে, কোথাও জঙ্গল বা পাহাড়ের বেশ ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ঘোড়ায় চড়ে স্বাভাবিক গতিতে এগুচ্ছে সে। কোথাও ফেরাউনের কোন মহলের ধ্বংসাবশেষ এখনো তার নজরে পড়েনি। ফেরাউনের মহলের ধ্বংসাবশেষ এখানে আদৌ আছে কিনা তাই সন্দেহ। অন্তত রাস্তা থেকে কেউ কোনদিন ফেরাউনের ধ্বংসাবশেষ দেখেছে বলে জানা যায়নি। কিন্তু এ বিশ্বাস সবারই ছিল, পাহাড়ের মধ্যে ফেরাউন কিছু না কিছু বানিয়ে রেখেছে যা এখনও অক্ষত আছে। তবে সে অঞ্চলে পৌঁছতে হলে রাস্তা ছেড়ে তাকে দুর্গম অঞ্চলের গভীরে ঢুকতে হবে। সে অঞ্চল এমন নির্জন যে, দুষ্কৃতকারীদের গোপন আড্ডা হওয়ার উপযুক্ত জায়গাই বটে।
মেহেদী আল হাসান সে অঞ্চলের বেশ গভীর পর্যন্ত ঢুকে আবার ফিরে এল। পরদিন দু’টো উট, কিছু মেষ ও বকরি নিয়ে জংলী রাখাল সেজে সেখানে গেল। পাহাড়ী অঞ্চলের বেশ গভীরে ঢুকে পশুগুলোকে ছেড়ে দিল। পশুগুলো আপন মনে চরে বেড়িয়ে ঘাস খেতে লাগল। আর সে মরু বেদুইনদের মত পাহাড়ী এলাকায় সজাগ দৃষ্টি রেখে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
ঘুরতে ঘুরতে সে এই বিজন পাহাড়ী অঞ্চলের আরো গভীরে ঢুকে যেতে লাগল। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই তার দৃষ্টিতে পড়ল না। আরও অগ্রসর হয়ে সম্মুখে একটি পাহাড় দেখতে পেল। সমতল ক্ষেত্র থেকে বিশ-পঁচিশ ফুট উপরে সে পাহাড়ে একটা প্রাকৃতিক সুড়ংয়ের মুখ হা করে আছে। মেহেদী আল হাসান সেই সুড়ংয়ের মুখে এসে দাঁড়াল।
বিশাল সুড়ং। সুড়ংটা এতই প্রশস্ত যে, তার মধ্য দিয়ে উট চালিয়ে নেয়া যাবে। পাহাড়ের ভেতরে কতদূর চলে গেছে এ সুড়ং বুঝার উপায় নেই। কারণ ভেতরটা অন্ধকার। মেহেদী আল হাসান পাহাড়ের চূড়া টপকে অপর দিকে গেল। সেখানে সে দেখতে পেল সংকীর্ণ মাঠ। কিন্তু কোন মানুষের ছায়াও নেই সেখানে।
হতাশ হল মেহেদী আল হাসান। দুশমনের আজ্ঞা খুঁজে বের করার জন্য সে এই পাহাড়ের রাজ্যে এসেছে। কিন্তু কোথায় দুশমন? কোথায় তাদের আস্তানা বা আড়? সে আবার এসে দাঁড়াল সুড়ংয়ের মুখে। আস্তে করে পা রাখল সুড়ংয়ে। সুড়ংটা খুব দীর্ঘ। অন্ধকার প্রথম দিকে বেশী জমাট নয়, হালকা হালকা ফিকে ভাব। ডান ও বায়ের দেয়ালে অনেক গহর। সেখানে বড় বড় পাথর বসানো। এত বড় পাথর যে, একটা মানুষ অনায়াসে সেখানে লুকিয়ে বসে থাকতে পারবে।
মেহেদী আল হাসান সেই সুড়ং ধরে অনেক দূর এগোলো। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেল না। এভাবে কয়েকদিন ঘুরে ফিরে কিছুই না পেয়ে মেহেদী আল হাসান মিশরের গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ানকে রিপোর্ট দিল, ‘যত দূর দৃষ্টি যায় ঘুরে ফিরে দেখেছি। সন্দেহজনক কিছুই আমার চোখে পড়েনি। একটা বিশাল সুড়ং পেয়েছি। কিন্তু এত দিনেও সে সুড়ং পথে কোন লোককে ভেতরে যেতে আসতে দেখা যায়নি।’
আলী বিন সুফিয়ান বললো, ‘তুমি সারাদিন কোন গোপন জায়গায় বসে সুড়ংয়ের মুখে নজর রাখো। ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করো না। তাতে ধরা পড়া ও মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
আলী বিন সুফিয়ান তাকে আরো বললো, ‘মাঝে মাঝে উটের উপর চড়ে রাতেও সেখানে গিয়ে খোঁজ নিও। যদি কোন লোকের দেখা পাও এবং তাদের হাতে ধরা পড়ে যাও, বলবে, আমি কায়রো যাচ্ছি। নিজেকে কৃষক হিসাবে পরিচয় দিও।’
এই নির্দেশ অনুযায়ী মেহেদী আল হাসান রাতেও সেখানে ডিউটি দিতে লাগল। এক রাতে সেখানে কারো পদধ্বনি শুনতে পেল। এই পদধ্বনি কোন জংলী পশুর না মানুষের তা নিশ্চিত হতে পারল না মেহেদী আল হাসান। সে পদধ্বনির পিছনে তাড়া না করে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো, পরে সে রাতের মত ফিরে এলো নিজের আস্তানায়।
পরের দিন। সূর্য উদয়ের আগেই দু’টি উট, কিছু মেষ ও ছাগল নিয়ে সেখানে চলে গেল মেহেদী আল হাসান। পশুর পাল মুক্ত মাঠে ছেড়ে দিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলো সে। এক জায়গায় পৌঁছে দেখতে পেল লম্বা লম্বা ঘাস, ঝোপঝাড় ও তৃণলতা জড়াজড়ি করে আছে সেখানে। তার মাঝে জংলী ফুলের চারায় ফুটে আছে অজস্র ফুল। সেই ফুলের দিকে ঝুঁকে আছে একটি লোক। লোকটির পরণে দামী কাপড়। মুখে লম্বা দাড়ি, মাথায় দামী পাগড়িও আছে।
মেহেদী আল হাসান লোকটির দিকে এগিয়ে গেল। তার পায়ের আওয়াজ পেয়েই সম্ভবত দাড়িওয়ালা লোকটি তার দিকে মুখ তুলে তাকালো। মেহেদী আল হাসানের সাথে চোখাচোখি হল সে লোকের। ধীরে ধীরে হেঁটে ওই দামী পোষাক পরা লোকটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
জোব্বা পরা লোকটির হাতে একটা থলে ছিল। থলের মধ্যে লতাপাতা রাখা। তার অন্য হাতে একটি জংলী চারার ডাল।
‘আপনি কি খুঁজে বেড়াচ্ছেন?” মেহেদী আল হাসান বোকার মত হেসে বললো, ‘কোন জিনিস হারিয়ে গেলে বলুন, আমিও খুঁজে দেখি?’
‘আমি কবিরাজ!’ লোকটি বললো, ‘জরি, বুটি খুঁজে বেড়াচ্ছি। এগুলো দিয়ে ঔষুধ বানানো হবে।’
মেহেদী আল হাসান এবার লোকটির মুখের দিকে ভাল করে তাকাল। তাকিয়েই সে তাকে চিনতে পারলো। তিনি কায়রোর প্রসিদ্ধ হেকিম। চিকিৎসক হিবে তার যথেষ্ট খ্যাতি ও নাম-ডাক আছে।
মেহেদী আল হাসান সরল মনেই বিশ্বাস করল লোকটির উত্তর। সত্যি তো, একজন হেকিম হিসাবে তিনি জরি বুটি অনুসন্ধান করতেই পারেন। আর জরি বুটি সংগ্রহের উত্তম স্থানও এটাই। হেকিম তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি এখানে কি করছো?’
‘এখান থেকে একটু দূরেই থাকি আমরা। এখানে পশুর পাল নিয়ে এসেছি চরাতে ও পানি পান করাতে।’ আগন্তুকের প্রশ্নের জবাব দিয়ে মেহেদী আল হাসান আবার প্রশ্ন করল, ‘এই জরি বুটি দিয়ে আপনি কি রোগের ঔষুধ বানাবেন?”
‘তুমি সে রোগের নাম জান না, আর বললেও বুঝবে না।’ হেকিম উত্তর দিল, ‘কিছু কিছু রোগ এমন আছে, রুগী নিজেও টের পায় না তার কি হলো। শুধু এক ধরনের অস্বস্তি ও অশান্তি অনুভব করে। অথচ সে এমন মারাত্মক অসুখে ভুগছে যে, সময় মত ঔষধ না পড়লে একটু পর লোকটি মারা যাবে।’
এ হেকিম খুবই নামকরা ডাক্তার ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে তার কাছে রুগীরা আসতো। মেহেদী আল হাসান তাকে এখানে পেয়ে গেছে, এটা তার সৌভাগ্য।
মানুষের একটা সহজাত দুর্বলতা এই যে, হাতের কাছে ডাক্তার পেলেই তার মনে নানা রকম অসুখের কথা উদয় হয়। ডাক্তার কাছে পেলে সে তার অসুখের কথা বলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
মেহেদী আল হাসানেরও কিছু শারিরীক অসুবিধা ছিল। সে সেই অসুবিধার কথা হেকিমকে জানালো। হেকিম তার হাতের পালস পরীক্ষা করলো। পরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে চমকে উঠলো, যেন তার চোখ কোন আশ্চর্য জিনিস দেখতে পেয়েছে। হেকিম মেহেদী আল হাসানের হাত ছেড়ে দিয়ে তাকে আপাদমস্তক ভাল করে নজর বুলিয়ে দেখলো। হেকিমের চেহারায় আশ্চর্যের ভাষ দেখে মেহেদী আল হাসানও কিছুটা অবাক হলো। সে প্রশ্ন করলো, ‘কি ব্যাপার! আপনি এমন অবাক হয়ে কি দেখছেন?”
‘তুমি আমার দাওয়াখানায় আসবে?’ হাকিম তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো।
‘আমি খুব গরীব মানুষ!’ মেহেদী আল হাসান বললো, ‘আপনাকে টাকা দেব কোথেকে।’
‘টাকার কথা পরে ভেবো। সে নিয়ে তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। তুমি বরং এক্ষুণি আমার সাথে চলো।’
‘কি বলছেন আপনি!’ মেহেদী আল হাসান অবাক হয়ে বললো, “আমার উট চরছে, মেষ ও ছাগল চরছে। এগুলো ফেলে আমি কোথায় যাবো?’
‘তোমার উট, ছাগল তুমি নিয়ে চলো। ওগুলো সামলে রেখেই আমার সাথে শহরে যাবে। তোমার কাছ থেকে আমি কোন টাকা নেব না। আমাকে ধনী লোকেরা অনেক টাকা পয়সা দিয়ে যায়। গরীবদের চিকিৎসা আমি বিনা পয়সায় করে থাকি। তোমার অসুখ তো এখন সাধারণ পর্যায়ে আছে, হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। তোমার রোগ নিয়ে আমার অন্য রকম সন্দেহ আছে।’
মেহেদী আল হাসান তখন ডিউটিতে ছিল। এই সামান্য অসুখের জন্য ডিউটি ত্যাগ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে হেকিমকে বললো, ‘আমার অসুখ কি খুব খারাপ? ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন, সন্ধ্যার পর আমি আপনার দাওয়াখানায় পৌঁছে যাবে। আপনি দয়া করে আপনার ঠিকানা ও রাস্তা বলে দিয়ে যান, কোথায় যেতে হবে।’
যদিও মেহেদী আল হাসান হেকিম সাহেবের ঠিকানা ভাল করেই জানতো, তবু সে এমন একটা ভাব করলো, যেন সে ওই ঠিকানা সম্পর্কে কিছুই জানে না। হেকিম সাহেব তাকে ঠিকানা ও সেখানে পৌঁছার রাস্তা ভাল করে বুঝিয়ে বললেন। মেহেদী আল হাসান বললো, ‘সন্ধ্যার পর পরই আমি আপনার ঠিকানায় পৌঁছে যাবো ইনশাআল্লাহ।’
মেহেদী আল হাসান সন্ধ্যার পর ঠিক সেই রাখালের পোষাকেই হেকিমের দাওয়াখানায় গিয়ে পৌঁছলো। সে তার উট সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল, যাতে হেকিমের মনে কোন রকম সন্দেহ না জাগে। সে জানতো, হেকিমরা ঔষুধের গাছ গাছড়া খুঁজে বেড়ায় এবং তাদের ঔষধে রোগ-ব্যাধি ভালও হয়। তার যেটাকে সাধারণ রোগ বলে মনে হচ্ছে সেটা কোন ভয়াবহ রোগও হতে পারে। হেকিম সাহেব যখন এটাকে গুরুতর মনে করছেন তখন তাকে হালকাভাবে দেখা ঠিক নয়।
সে হেকিম সাহেবকে সালাম দিলে হেকিম সাহেব খুব উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, ‘তাহলে তুমি এসে পড়েছো? ঠিক আছে, বসো।’
হেকিম সাহেব তাকে খুব ভাল করে দেখলেন। তার নাড়ী পরীক্ষা করলেন, চোখ দেখলেন, জিহবা দেখলেন, বলেন, “ঠিক আছে, আমি তোমাকে ঔষুধ দিয়ে দিচ্ছি। যদি এতে উপশম না হয় তবে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তিন দিন পর তুমি আবার আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে। যদি দেখি এ ঔষধে কাজ হয়নি, তখন বুঝবো, আমি যা সন্দেহ করেছি তাই ঠিক। তখন অন্য ঔষধ দিতে হবে।’
মেহেদী আল হাসান কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কি সন্দেহ করছেন?”
‘আল্লাহ না করুন, আমার সন্দেহটা যেন সত্য না হয়।’ হেকিম সাহেব বললেন, ‘তুমি একে তো খুব সুন্দর যুবক, তাতে ওই বিরাণ মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াও। যে স্থানে তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, সে জায়গাটা ভাল নয়। সেখানে প্রেতাত্মারা বসবাস করে। এই প্রেতাত্মাদের মধ্যে ফেরাউন যুগের সেরা সুন্দরী মেয়েদের আত্মাও রয়েছে। তাদেরকে ফেরাউন জোরপূর্বক তার কাছে রেখেছিলেন আমোদ-ফূর্তির জন্য। শেষে তাদেরকে সেখানেই হত্যা করা হয়, যাতে তারা অন্য কারো হাতে না পড়ে। মানুষের আত্মা কখনো বৃদ্ধ হয় না, সব সময় যৌবন অবস্থায় থাকে। যেসব সুন্দরী মেয়েদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের আত্মা এই সবুজ বিয়াবানে বিভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায়।
আমার সন্দেহ হচ্ছে, ফেরাউন যুগের মেয়েদের খপ্পরে তুমি পড়ে গেলে কিনা। তোমার মত সুন্দর যুবককে দেখতে পেলে ওরা সহজেই তোমাকে ভালবেসে ফেলবে। তুমি একাকী সেই মরু বিয়াবানে চলাফেরা করো। সেই সুন্দরী মেয়েদের আত্মাগুলোর সাথে তোমার আত্মার যোগাযোগ হয়ে গেলে তুমি আর তাদের খপ্পর থেকে বেরোতে পারবে না।’
‘ওরা আমার কোন ক্ষতি তো করবে না?’ মেহেদী আল হাসান হকিমের কথায় প্রভাবিত হয়ে বললো, ‘প্রেতাত্মার ভালবাসা পাওয়া তো কোন ভাল কথা নয়। আপনি কি ঐ প্রেতাত্মার কবল থেকে আমাকে মুক্ত করতে পারবেন?’
‘আমার ধারণা ভুলও হতে পারে, আগে ঔষুধপত্র দিয়ে দেখি।’ হেকিম বললেন, ‘যদি উপশম না হয়, তবে প্রেতাত্মার নজর দূর করতে অন্য ব্যবস্থা নেবো। আমার কাছে তারও চিকিৎসা আছে। দোয়া তাবিজ দেব, কিছু আমলও বাতলে দেবো। যদি প্রয়োজন পড়ে, তবে সে আত্মাকে এখানে হাজির করে তোমাকে ছেড়ে যেতে বলবো। প্রেতাত্মার কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যা যা করণীয় সব করবো আমি। ভয় নেই, প্রেতাত্মারা তোমার কোন ক্ষতি করবে না।’
মেহেদী আল হাসান ছিল হুশিয়ার গোয়েন্দা। কিন্তু সে আলেম ছিল না। জাতির প্রতিটি ব্যক্তির মত সেও জ্বীন, ভূত ও প্রেতাত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিল। সে জ্বীন পরীদের নিয়ে যত গল্প কাহিনী শুনেছে, সেগুলোকে সত্য বলেই মনে হয়েছে তার। তাই সেগুলো সে বিশ্বাসও করেছে।’
হেকিম সাহেবের প্রতিটি কথা ও শব্দ তার মনে দৃঢ় হয়ে বসে গেল। তার মনের ওপর প্রেতাত্মার ভয় আরও বেশী করে চেপে বসলো। সে হেকিমের কাছে গোয়েন্দাগিরী করতে নয়, বরং চিকিৎসার জন্যই গিয়েছিল। হেকিম তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল, ‘ভয় নেই যুবক। প্রেতাত্মারা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি কোন চিন্তা করো না। তেমন কিছু হলে আমি তারও চিকিৎসা করবো।’
কিন্তু হেকিম সাহেব যত আশ্বাসই দিক না কেন, তার দুশ্চিন্তা এতে আরো বেড়ে গেল। হেকিম তাকে ঔষুধের একটি মাত্র পুরিয়া দিয়েছিল, আর বলেছিল, রাতে শোয়ার আগে খেয়ে শুয়ে পড়বে।
সে শোয়ার আগে ঔষধ খেয়ে নিল। সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম এসে গেল। এর আগে তার কোন দিন এত জলদি ঘুম আসেনি। সকালে যখন চোখ খুললো, তখন সে অনুভব করলো, তার শরীর অসম্ভব রকম দুর্বল।
সে সেই দুর্বল শরীর নিয়েই আলী বিন সুফিয়ানের কাছে গেল। কিন্তু তাঁকে হেকিমের পাহাড়ী এলাকা থেকে গাছ গাছড়া বা জরি বুটি সংগ্রহের কথা কিছুই বলল না। তার কাছে এটা বলার মত কোন কথা নয়, কেননা হেকিম সাহেব কোন সন্দেহজনক ব্যক্তি নন। তিনি কায়রোর এক প্রসিদ্ধ হেকিম। সামরিক ও প্রশাসন বিভাগের বড় বড় অফিসাররা তার রোগী। তার সম্পর্কে এ কথাও প্রসিদ্ধ ছিল যে, তিনি দোয়া-তাবিজ দিয়ে জ্বীন-পরী বশে রাখেন।
আলী বিন সুফিয়ান মেহেদী আল হাসানকে বললেন, ‘তুমি তোমার নির্ধারিত জায়গায় ডিউটি দেয়া অব্যাহত রাখো। একদিন না একদিন সন্দেহজনক লোক সেখানে তুমি দেখতে পাবেই।’
আলী বিন সুফিয়ান দুষ্কৃতকারীদের গোপন আড্ডার সন্ধানে তাকে আবার সেই দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে ডিউটিতে পাঠিয়ে দিলেন।
মেহেদী আল হাসান ডিউটিতে যাওয়ার আগে হেকিমের সাথে দেখা করল। সে তখনো রাখালের বেশেই ছিল। হেকিমকে সে বললো, ‘এত সকালে অনেক দূর থেকে শুধু এ কথা বলার জন্য আমি ছুটে এসেছি যে, রাতে আমার গভীর ঘুম এসেছিল এবং এখন আমি এতই দুর্বল বোধ করছি যে, জীবনে কখনও এমন দুর্বল বোধ করিনি।’
‘ যদি সন্ধ্যা পর্যন্ত তুমি এমন অবস্থায়ই থাকো, তবে তোমার ওপর জ্বীন-পরীর কোন আত্মার আছর হয়নি মনে করবে। হেকিম বললেন, সন্ধ্যায় তুমি আবার এসো। আমি তোমাকে, দুর্বলতা দূর করার ঔষধ দিয়ে দেবো।’
মেহেদী আল হাসান উটের উপর আরোহণ করল এবং সোজা তার কর্তব্য স্থলে চলে গেল।
বেশ কিছু দিন হয়ে গেল সেই সবুজ প্রান্তরে নিয়মিত যাতায়াত করছে মেহেদী আল হাসান। সমস্ত দিন সে সেখানেই কাটিয়ে দেয়, কখনো রাতেও সেখানে যায়। আগে রাতের বেলা এই বিজন প্রান্তরে ঘুরতে গিয়ে সে মোটেও ভয় পেতো না। কিন্তু হেকিমের কাছ থেকে জ্বীন-পরীর কাহিনী শোনার পর থেকে তার ইদানিং কেমন যেন একটু ভয় ভয় করছে। হেকিম যদিও তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছে, প্রেতাত্মারা তার কোন ক্ষতি করবে না, তবু প্রেতাত্মার কথা মনে হলেই তয়ের একটা শিহরণ পায়ের পাতা থেকে মাথায় লাফিয়ে ওঠে। সে যদিও ভীতু স্বভাবের লোক নয়, তবুও এই অদেখা রহস্যময় সৃষ্টি তার মনে কেমন যেন কাঁপন জাগায়। রাতে পথ চলতে গেলেই তার মনে হয়, তার আশেপাশে যেন প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। একদিকে ডিউটির তাগিদ অন্য দিকে হেকিমের আশ্বাসের কারণে সে নিজের মনকে প্রবোধ দিচ্ছিল, ভয়ের কিছু নেই। এখানে কোন জ্বীন-পরী নেই। আর থাকলেও হেকিম তো বলেই দিয়েছে, তারা আমার কোন ক্ষতি করবে না।’
এভাবে সে নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছিল আর সেই সাহসে ভর করে রাতেও পাহাড় প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে ডিউটি দিচ্ছিল।
এই ডিউটিরত অবস্থায় হঠাৎ তার মনে হলো, তার অবস্থা আগের চেয়ে বেশী শোচনীয়। তার মধ্যে হঠাৎ করেই অস্থিরতা দেখা দিল এবং তার মনে হতে লাগল, তার রোগটি যেন অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গেছে।
তার অন্তরে হঠাৎ করেই ভয়ের কাঁপন শুরু হয়ে গেল এবং রাত যত বাড়তে লাগল ততই ভয়ও বেড়ে চললো তার। সে নিজেকে সামলে নেয়ার অনেক চেষ্টা করলো, কিন্তু তার মনে ভয় বেড়েই চললো। সে হেকিমকে তার যে কষ্টের কথা বলেছিল সেই কষ্ট যেন আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেল।
তার ইচ্ছা করছিল সে ছুটে হেকিমের কাছে চলে যায়। কিন্তু তার দায়িত্ববোধ তাকে ডিউটি ফেলে কোথাও যেতে নিষেধ করলো। এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার সাধ্য তার ছিল না, তাই সে ওই স্থান ত্যাগ করতে পারল না। সে তার কষ্ট ও অসুবিধা সহ্য করেই ডিউটি অব্যাহত রাখল। অনেকক্ষণ পর ধীরে ধীরে তার এই অবস্থা কেটে যেতে লাগল এবং এক সময় সে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে এল। তার মন আবার ভয়শূন্য হয়ে গেল, যেমন ঔষুধ খাওয়ার আগে ছিল, ঠিক সে অবস্থায় ফিরে এল মেহেদী আল হাসান। তার মনে হলো, এতক্ষণ সে একটি ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছে। হয়তো এই ঘোর লাগাকেই বলে প্রেতাত্মার প্রভাব।
রাত শেষ হয়ে এল। সে ফিরে এল তার ডেরায়। সামান্য একটু ঘুমিয়ে নিয়ে সে ছুটলো হেকিমের কাছে। রাতে তার যে অবস্থা হয়েছিল সব তাকে খুলে বলল। হেকিম তাকে বলল, “এতক্ষণে নিশ্চিত হওয়া গেল, সত্যি তোমার ওপর প্রেতাত্মারা ভর করেছে। তুমি এখন চলে যাও, সন্ধ্যায় এসে ঔষধ নিয়ে যেও।’
সে আবার উট, মেষ ও বকরীর পাল গুছিয়ে সেই প্রান্তরে গেল। সারাদিন সেখানে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে এল বাড়ীতে। তারপর এক উটের পিঠে সওয়ার হয়ে চলে এল শহরে, হেকিমের কাছে। হেকিম তাকে আরও একদিন ঔষধ খেতে বললেন। তিনি তাকে ঔষুধ দিয়ে বিদায় দিলেন। মেহেদী আল হাসান রাতে শোয়ার আগে ঔষধটুকু খেয়ে নিল। গত রাতের মত তার শীঘ্রই গভীর ঘুম এসে গেল। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখল, তার সব ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়ে গেছে। সে শরীরে নতুন কর্মস্পৃহা ও সতেজতা অনুভব করল। প্রফুল্ল চিত্তে সে প্রতিদিনের মত আলী বিন সুফিয়ানের কাছে গেল, রুটিন রিপোর্ট সেরে সে চলে গেল ডিউটিতে।
প্রফুল্ল মনে সে সেই পাহাড়ী বিজন প্রান্তরে একাকী ঘুরে বেড়াতে লাগল। দুপুর পর্যন্ত ভালই কাটল তার, কিন্তু দুপুরের পর থেকে তার মনে প্রেতাত্মার চিন্তা চেপে বসল। তার শরীরের স্ফূর্তি ও শক্তি কমতে লাগলো। সন্ধ্যায় ক্লান্তি ও অবসাদের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল সে। বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিবর্তে তার মনে এসে বাসা বাঁধল ভয় ও শংকা। উদাসিনতায় ছেয়ে গেল ভার হৃদয়-মন। সে এই হতাশা দূর করার জন্য এটা-সেটা ভাবার চেষ্টা করল। ক্লান্তি দূর করার জন্য পায়চারী করতে লাগল। এভাবে চেষ্টা করতে করতে এক সময় মনের ভাব স্বাভাবিক হয়ে গেল।
ততক্ষণে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে। আকাশে চাঁদ নেই। অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। বাড়ী ফেরার তাড়া অনুভব করল মেহেদী আল হাসান। পশুগুলোকে জড়ো করে বাড়ীর পথ ধরতে যাবে, সহসা তার কানে ভেসে এলো দূরে কারো কান্নার স্বর। থমকে দাঁড়াল হাসান। কান পাতল কান্নার দিকে। পাহাড়ের দিক থেকে ভেসে আসছে কান্না। কোন মেয়ে গভীর বেদনায় ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে।
দীর্ঘক্ষণ এ কান্নার ধ্বনি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে শুনল হাসান। কান্নার শব্দ কমতে কমতে এক সময় একেবারে থেমে গেল। মেহেদী আল হাসান যেখানে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। ভাবলো, এটা কোন প্রেতাত্মার কান্না, যে প্রেতাত্মার কথা হেকিম সাহেব বলেছেন। মেহেদী আল হাসানের মন আবার হঠাৎ অজানা ভয়ে সংকোচিত হয়ে পড়ল। কিন্তু সে ভয়-ভীতি তাড়িয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করল।
একবার তার মনে হলো, আচ্ছা! এই প্রেতাত্মার সাথে কথা বললে কেমন হয়? সে ভাবল, যদি এই কান্না অন্য কোন সময় এবং স্বাভাবিক পরিবেশে হতো তাহলে আমি কি করতাম? নিশ্চয়ই কোন মেয়ের কান্না শোনার সাথে সাথে দৌড়ে তার সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতাম। কিন্তু এখানে কারো সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। কারণ এই নির্জন পাহাড়ী অঞ্চলে কোন জীবন্তু মেয়ে এসে এভাবে কাঁদবে, এটা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এটা ফেরাউনের যুগের কোন অশরীরি প্রেতাত্মার কান্নার ধ্বনি।
রাত একটু বেশী হওয়ার পরও সে গত দিনের মত হেকিমের কাছে গেল এবং তার কাছে নিজের অবস্থা সবিস্তারে বর্ণনা করল। তার অবস্থা ও কান্নার কথা শুনে হেকিম যেন গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে রইল। পরে মাথা তুলে বললো, ‘এটা প্রেতাত্মারই কান্না। তবে ভয় পাবার কোন কারণ নেই। আমি এক্ষুণি একটি তাবিজ দিচ্ছি। এটা সাথে রাখলে সে তোমার কোন অনিষ্ট করতে পারবে না। রাতে আমি প্রেতাত্মাকে ডেকে পাঠাব। ওর কাছে জানতে চাইব, সে তোমার কাছে কি চায়? তার জওয়াবের ওপর ভিত্তি করে আমি পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো। কিন্তু তোমাকে একটি কথা বলে রাখি, তোমাকে ভয় করলে চলবে না। এই প্রেতাত্মা তোমাকে ভালবেসে ফেলেছে, তাই সে তোমার কোন ক্ষতি করবে না। কিন্তু তুমি যদি প্রেতাত্মা থেকে পালানোর চেষ্টা করো, তবে তোমার ক্ষতির সম্ভাবনা আছে।’
হেকিম তাকে একটি তাবিজ দিল। সে ওই তাবিজ তার বাম হাতের বাহুতে সযত্নে বেঁধে নিল। ‘আমি রাতে তোমার জন্য আমল করবো।’ হেকিম বললো, ‘আগামী কাল সকালে তুমি আবার এখানে এসো। তখন তোমাকে বলে দেব, প্রেতাত্মা তোমার কাছে কি চায়? যে প্রেতাত্মা তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, সে শয়তান নয়। সে তোমার অনিষ্ট চাইলে গত রাতেই তোমার ক্ষতি করতে পারতো। তবুও আমি চেষ্টা করবো যেন তুমি এর প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে যাও।’
হেকিমের কথায় মেহেদী আল হাসান মনে মনে দারুণ ভয় পেল। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সীমাহীন দুশ্চিন্তা নিয়ে সে রাতের অন্ধকারে বাইরে পা রাখল। তার চোখের সামনে নাচতে লাগল একশ একটা ভয়াল আজদাহা। ভীতি ও আশংকার দোদুল্যমানতায় দুলতে লাগল তার হৃদয়।
পরের দিন মেহেদী আল হাসান আলী বিন সুফিয়ানের কাছ থেকে কিছু নির্দেশ পেল। সে তড়িঘড়ি করে হেকিমের নিকট গেল। হেকিম তার অপেক্ষাতেই বসেছিলেন। তিনি তাকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলেন ও তাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন।
“সে তোমার সাথে একবার দেখা করতে চায়।’ হেকিম তাকে বললেন, “সে তোমার সামনে আসবে, তোমার আসল রূপ দেখবে। তুমিও তাকে দেখতে পাবে। হয়ত সে প্রথম সাক্ষাতে তোমার সামনে এসে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। সে তো অন্য জগতের সৃষ্টি। সে এই জগতের লোকের সাথে দেখা করতে ইতস্তত করতে পারে। যদি সে এমন ব্যবহার করে তবে তুমি পরের দিন সেখানে যাবে।’
‘সে কোথায়?” মেহেদী জিজ্ঞেস করলো।
‘সেখানেই, যেখানে তুমি প্রতিদিন যাতায়াত করো।’ হেকিম বললেন, ‘যেখানে তুমি আমাকে প্রথম দেখেছিলে, তুমি আজ রাতে সেখানে যাবে।’
‘আপনিও কি আমার সাথে থাকবেন?”
‘না!’ হেকিম উত্তরে বললেন, “সে আত্মা শুধু তার সাথেই দেখা দেয়, যাকে সে ভালবাসে। যদি কোন প্রেতাত্মার নজরে কোন মানুষ পড়ে যায়, সেই মানুষকে সে হত্যা করে। এ প্রেতাত্মা তোমার সাথে দেখা করতে চায়, সে খুবই ভাল মনের অধিকারী। তার কান্না শুনলেই তুমি বুঝতে পারবে, সে এক মজলুম মেয়ের কান্না। সে ভালবাসার কাঙাল। আমি যখন তাকে রাতে হাজির করলাম, সে শুধু অঝোরে কাঁদলো। আমাকে বিনয়ের সাথে বললো, ঐ যুবককে কিছুক্ষণের জন্য আমার কাছে পাঠিয়ে দিন, আমি চিরদিনের জন্য বিদায় হয়ে যাবো।’
এই কথা যদি অন্য কেউ বলতো, তবে মেহেদী আল হাসান এতটা প্রভাবিত হতো না। কিন্তু শহরের নামকরা হেকিম ও কবিরাজের কথা সে অবিশ্বাস করে কি করে! সবাই জানে, তিনি জ্বীন-ভুত বশীভুত করতে পারেন। নিশ্চয়ই তিনি যা বলছেন তা সত্য। সেই মেয়ের কান্না আমি শুনেছি, হেকিম তো শুনেননি! তাহলে তিনি কি করে জানলেন, এ এক মজলুম মেয়ের কান্না! নিশ্চয়ই তিনি কাল রাতে সেই মেয়েকে ডাকিয়ে ছিলেন।
এই হেকিম যেমন বড় চিকিৎসক তেমনি মশহুর আলেম। তার বলার ভঙ্গী এমন চমৎকার যে, লোকেরা তার কথা মুগ্ধ হয়ে শোনে এবং বিশ্বাসও করে। মেহেদী আল হাসানও হেকিমের সব কথা বিশ্বাস করল। হেকিম তাকে আরো বলল, ‘রাতে ঐ প্রেতাত্মার সাথে সাক্ষাৎ করার মধ্যে ভয়ের কিছু নেই। বরং এতে ক্ষতির পরিবর্তে তোমার লাভের সম্ভাবনাই বেশী।’
‘আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। নিশ্চয়ই আমি তার সাথে দেখা করবো। রাতে যথা সময়ে আমি সেখানে চলে যাবো। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন।’ বলল মেহেদী আল হাসান।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই আমি তোমার মঙ্গলের জন্য দোয়া করবো। তবে একটা ব্যাপারে তোমাকে সাবধান করা দরকার মনে করছি।’
“কি?’ ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করল মেহেদী আল হাসান।
‘কারো সাথে এই প্রেতাত্মার সাক্ষাতের বিষয় নিয়ে আলাপ করবে না। যদি তুমি এই গোপন বিষয় ফাঁস করে দাও, ত তোমার ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। তুমি মাটির মানুষকে ধোঁকা দিতে পারো। কিন্তু অদৃশ্যলোকের কোন আত্মার গোপন কথা যদি ফাঁস করে দাও তবে আমি বলতে পারি না, তোমার শরীরের কোন দুটি অঙ্গ চিরদিনের জন্য অকেজো হয়ে যাবে। দুটি পা অবশ হয়ে যেতে পারে অথবা দু’টি হাত কিংবা দুটি চোখ থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হয়ে যাবে তুমি।’
মেহেদী আল হাসান ভয়ে একেবারে সংকুচিত হয়ে গেল। বলল, ‘না, এ কথা আমি কাউকে বলব না। আমি চিরদিনের জন্য পঙ্গু হতে চাই না।’
মানুষের এই এক দোষ। সে তার মনের মধ্যে কথা গোপন রাখতে পারে না। যদি পারতো তবে অহেতুক বিপদে জড়িয়ে পড়তে হতো না তাকে। তোমাকে তাহলে একটা গোপন তথ্য বলেই ফেলি। হয়তো এর থেকে তুমি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। এখানে দু’জন সামরিক অফিসার রাতের বেলায় অজ্ঞাতে মারা গেছে, শুনেছো নিশ্চয়ই। কেউ বলতে পারে না, তারা কেমন করে মারা গেছে। কাল রাতে যে প্রেতাত্মা এসেছিল সে আমাকে বলেছে, তাদের দুজনকে নাকি প্রেতাত্মারাই হত্যা করেছে। কারণ তারা নাকি প্রেতাত্মাদের গোপন ভেদ খুলে দিতে চেয়েছিল। এবার বুঝ অবস্থা!’
‘সেটা কেমন করে? অদৃশ্য জগতের খবর অফিসাররা জানবে কেমন করে?’ মেহেদী আল হাসান মুখ রাখালের মতই প্রশ্ন করে বসলো।
কিন্তু সামরিক অফিসারদের প্রসঙ্গ আসার সাথে সাথেই মেহেদী আল হাসান সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। এতক্ষণের সরলতা ও ভক্তি-বিশ্বাসের জায়গায় এসে আসন নিয়েছিল বিচক্ষণ গোয়েন্দার প্রজ্ঞা। সে এই তথ্যের জন্যই তো এতদিন ধরে পাহাড় অরণ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হেকিমের এ কথায় মুহূর্তে সে একজন রোগী থেকে গোয়েন্দায় পরিণত হয়ে গেল। বুঝতে পারল, সে আসল জায়গাতেই এসেছে।
দুই কমাণ্ডারের মৃত্যুর গোপন তথ্য উদ্ধারের জন্য সে হেকিমের কাছে প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে মারতে শুরু করল।
“আমি এ গোপন রহস্য কাউকে বলতে পারি না।’ হেকিম বললো, “যেটুকু বলার ছিল তাই বললাম। তুমি কিন্তু সম্পূর্ণ নীরব থাকবে। তুমি এই গোপন তথ্য কাউকে বলবে না।’
‘জ্বী না, বলব না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আমি কাউকে বলব না বলার পরও কেন আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমার কি প্রাণের মায়া নেই?’
‘দেখো, তোমাকে সতর্ক করার জন্যই এত কথা বললাম আমি। জ্বীন-ভুত বশীভূত করা বড় ভয়ংকর কাজ। এদের সাথে গড়বড় করলে ওরা কাউকে ছাড়ে না। তোমাকে যে এত করে সতর্ক করুছি, তা কেবল তোমার স্বার্থে নয়, এর পিছনে আমার নিজেরও স্বার্থ রয়েছে। কারণ আমি এই সব প্রেতাত্মার ইচ্ছা ও অনিচ্ছার সাথে জড়িয়ে পড়েছি। যদি আমি তাদের অসন্তুষ্ট করি, তবে আমার এ বিদ্যা অকেজো হয়ে যাবে। প্রেতাত্মারা আমাকেও সেই শাস্তি দিবে, যেমন শাস্তি দেয় তারা নিজ শত্রুকে। তুমি কোন ভুল বা বেয়াদবী করলে সেই রাগে ওরা যদি তোমার সাথে আমাকেও শাস্তিযোগ্য ভাবে, তবে এমন কোন আদালত নেই যেখানে গিয়ে আমি সুবিচার প্রার্থনা করতে পারবো। তাই আমি চাই তুমি সহিসালামতে তাদের ইচ্ছা পূর্ণ করে নিজে বাঁচো এবং আমাকেও বিপদের হাত থেকে রক্ষা করো।’
‘ওদের ইচ্ছাটা কি?’
‘যে আত্মা তোমার জন্য কেঁদেছে, সে আমাকে বলেছে, নির্জনে কিছুক্ষণের জন্য সে তোমার সাক্ষাৎ চায়। আমি যদি তার ইচ্ছা পূরণ করি তবে সেও আমার আশা পূরণ করবে।’
‘যদি আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করি, তবে কি হবে?’
‘সে প্রেতাত্মা তোমার আত্মার উপরে ছায়া হয়ে বিস্তার করবে।’ হেকিম উত্তর দিল, “তুমি আমাকে যে অসুবিধার কথা বলেছ, তা কোন শারীরিক অসুবিধা নয়। এটা রূহানী বা আধ্যাত্মিক সমস্যা। সে তোমার উপর এখনও পূর্ণভাবে প্রভাব বিস্তার করেনি। কারণ তুমি অতিশয় ভাল লোক। যদি তুমি ভালো লোক হও, তবে তোমার ভালোর পরিণাম ফল তোমারই কাজে আসবে। তুমি আমার কাছে সেই অসুবিধার কথা বলেছ, আল্লাহ জাল্লে শানুহু যার উপরে রহমত বর্ষণ করতে চান, তার জন্য আল্লাহ কোন লোককে মাধ্যম বা অছিলা বানিয়ে নেন। এই কেরামতি আল্লাহর নিজস্ব ব্যাপার। তাই তুমি আমাকে সেখানে দেখতে পেয়েছিলে এবং আমরা পরস্পর পরিচিত হলাম। এই কল্যাণকর কাজে ভয় পেও না। যদি তুমি এই প্রেতাত্মার সঙ্গে সাক্ষাৎ করো, তবে সে তোমাকে এই দুনিয়াতে অনেক উপকার করবে। একটা উপকার এটাও হতে পারে যে, সে কোন সুন্দরী মেয়ের রূপ ধরে সশরীরে জীবন্ত মানুষের মত তুমি যখন চাইবে তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। তখন তুমি তাকে নিয়ে স্ত্রীর মত সংসার জীবন-যাপন করতে পারবে। যদি সে তোমার উপর আরও বেশী সদয় হয়, তবে বিশ্বাস করো, ফেরাউনের কবর থেকে গুপ্তধন এনে দেবে। অথবা এমনও হতে পারে, তুমি সেই গুপ্তধন নিয়ে মিশর থেকে দূরে কোথাও চলে যাবে। সেখানে বাদশাহর মত মহল বানিয়ে শান্তিময় জীবন কাটাবে।’
‘কবে তার সাক্ষাৎ পাবো?’ মেহেদী উদগ্রীব কণ্ঠে জানতে চাইল।
‘আজ রাতেই। মধ্য রাতের একটু আগে বা পরে তাকে তুমি সেখানে পাবে!’ হেকিম বললেন।
হেকিম তার গলায় আরও একটি তাবিজ বেঁধে দিলেন এবং মাথা ও শরীরে হাত বুলিয়ে ঝাড়ফুঁক করলেন।
মেহেদী আল হাসান অপূর্ব অনুভূতি নিয়ে সেখান থেকে উঠলো। তারপর প্রতিদিনের মত ডিউটিতে চলে গেল সে। বিকেল পর্যন্ত সেখানেই কাটিয়ে দিল। কিন্তু সূর্য অস্ত যাওয়ার বেশ আগেই সে তার ঠিকানায় ফিরে এল।
রাত গভীর হলো। মেহেদী আল হাসান মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে পৌঁছে গেল সেই কাংখিত জায়গায়। কিন্তু এখন সে ডিউটিতে আসেনি, এসেছে তার স্বপ্নের নারী আত্মার সাথে দেখা করতে।
অন্ধকার রাত। চারদিকে সুনসান নির্জনতা! জঙ্গলের পাশে পাহাড়ের এক টিলায় চড়ে বসল মেহেদী। আশেপাশে কোন জনমানব নেই। থাকার কথাও নয়। অন্ধকার এমন গাঢ় যে আশেপাশে কিছুই দেখা যায় না। গা ছমছম করা ভূতুড়ে পরিবেশ। স্বাভাবিকভাবেই এমন পরিবেশ মানুষের অন্তরে ভয় ধরিয়ে দেয়। কিন্তু মেহেদীর মোটেও ভয় লাগছিল না। হেকিমের কথা তার মনে সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার বাহুতে এখনও ঝুলছে হেকিমের বেঁধে দেয়া তাবিজ। যে তাবিজ তাকে সব রকম বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা করবে বলে বিশ্বাস করে মেহেদী। তাছাড়া সে আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী যুবক হিসাবেই সবার কাছে পরিচিত।
সময় গড়িয়ে চলল। হেকিমের নির্দেশিত জায়গায় বসে আছে মেহেদী। এখনো কারো সাড়াশব্দ পায়নি সে। উদগ্রীব হয়ে সে অপেক্ষা করছিল, কখন সেই নারী আত্মা মনুষ্য মূর্তি ধরে তার সামনে আবির্ভূত হবে।
সে যেখানে বসে আছে তার পিছনেই বিরাট এক পাহাড় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে ঝাঁকড়াচুলো বড় বড় বৃক্ষ। বাঁ দিক থেকে শুরু হয়েছে দুর্গম অরণ্যাঞ্চল। কেবল ডানপাশটাই যা একটু খোলামেলা। বাতাস বইছে। সেই বাতাসের ঝাপটায় দুলছে বৃক্ষের ডালপালা। বাঁ দিক থেকে শনশন, মড়মড় আওয়াজ আসছে বাতাসের ঝাপটায় জঙ্গলের বৃক্ষরাজির দোলা থেকে। সামনের গাছগুলো এমনভাবে নড়ছে, যেন হেলেদুলে এগিয়ে আসছে কোন সুবিশাল ভূত। বাতাসের এই শব্দ ও বৃক্ষের নড়াচড়া দেখে মেহেদী আল হাসানের মত বীর যোদ্ধার অন্তরও ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল।
বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে উঠল মেহেদী আল হাসান। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল এবং খানিকক্ষণ পায়চারী করল। এমন সময় সেই কান্নার সুর ভেসে এলো, যে সুর সে আগে একবার শুনেছিল। সে সেই কান্নার শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। কয়েক কদম এগুনোর পর হঠাৎ করেই কান্না আবার থেমে গেল। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল আল মেহেদী। কিছুক্ষণ নীরব থাকলো। শুনতে চেষ্টা করল কোথাও কোন আওয়াজ হয় কিনা। কিন্তু না, চারদিক সুনসান, নিশ্চুপ। সে একটু এগিয়ে গিয়েই আবার থেমে গেল কারণ হঠাৎ কবেই সেই কান্নার সুর আবার ভেসে এলো। তবে এবার সামনে থেকে নয়, আওয়াজটা এলো পিছন থেকে।