» » পাল্টা ধাওয়া

বর্ণাকার
🕮

চেঙ্গিস ভালবাসার নেশায় উন্মত্ত হয়ে গেল। সে খৃস্টানদের পরিকল্পনা জানার জন্য যে পরিমাণ অধীর ছিল তার চেয়েও বেশী অশান্ত ছিল মেয়েটার সাথে দেখা করার জন্য। সে নিজেই অনুভব করছিল, তার চিন্তা রাজ্যে এবং দৈনন্দিন জীবনের গতি ধারায় ভীষণ পরিবর্তন এসে গেছে। প্রথম যখন সে মদ পান করেছিল, তখন সে খুব অনুতপ্ত ছিল। কিন্তু গত রাতে সে নিজের মর্জিতেই মদের পিয়ালা হাতে তুলে নিয়েছিল। এখন আর তার কোন অনুশোচনা নেই। এক মুমীনের জন্য এটা এক বিরাট পরিবর্তন।

সে দিন সন্ধ্যায় তাকে বলা হলো, ‘কয়েকজন খৃস্টান সম্রাট ও তাদের সেনাবাহিনীর হাইকমাণ্ড এখানে আসছেন। সম্রাট রিমাণ্ড তাদের নৈশ ভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।’

রাতে মেহমানরা আসতে লাগলো। ভিক্টররা ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাদের সেবায়। কিন্তু এ দিন আগের মত তেমন ভীড় ছিল না। মাত্র সামান্য কয়েকজন বিশিষ্ট মেহমান। চুড়ান্ত পরিকল্পনার জন্য তারা এক গোপন বৈঠকে বসেছিল।

ভিক্টর ও চেঙ্গিস মহা ব্যস্ত। এই বৈঠকে উপস্থিত বিশিষ্ট মেহমানদের আহারাদির জন্য স্পেশাল বাবুর্চি ডাকা হলো। আয়োজন করা হলো রাজকীয় বিশেষ ডিনার।

এ মিটিংয়ে ক্রুসেড ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের প্রধান হরমন উপস্থিত আছেন। শুরুতেই মেহমানদেরকে স্পেশাল মদ দিয়ে আপ্যায়িত করা হলো। মেহমানরা যুদ্ধের খুঁটিনাটি পরিকল্পনা ও অভিযানের কথা আলাপ করতে লাগলো। এ আলোচনা কোন বাদানুবাদের আলোচনা ছিল না, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণের আলোচনা ছিল। এতে প্ল্যানের একটা নকশা ও আক্রমণের খসড়া পরিকল্পনা হাজির করা হলো। তাদের আলোচনা থেকে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিল, খুব শীঘ্রই তারা অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে।

হরমনকে তার গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বললেন, ‘যে সব জায়গায় ক্রুসেড বাহিনী আছে, সেখানে গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ক্রুসেড বাহিনীর অগ্রাভিযানের প্রতিটি পথে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে গোয়েন্দা কর্মীদের। তারা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দাদেরকে চিরুনী অভিযান চালিয়ে তালাশ করছে। অনুসন্ধান করে যাদের পাওয়া যাচ্ছে তাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।’

‘ত্রিপলীর কি অবস্থা?’ জানতে চাইলেন এক সম্রাট।

‘ত্রিপলীতে যেহেতু ক্রুসেড বাহিনী সবচেয়ে বিশাল সমাবেশ করছে, সে জন্য এখানেও গোয়েন্দা বিভাগ বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। এখানে শক্রর গোয়েন্দা ধরার জন্য জোর প্রচেষ্টা চলছে। আমি এখানেও শত্রুর গোয়েন্দা বাহিনীর গন্ধ পেয়েছি। এই গন্ধ শুকে এঁকে অগ্রসর হচ্ছে আমাদের বাহিনী। সন্দেহভাজনদের তৎপরতার ওপর বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। যদি এখানে একটি গোয়েন্দাও পাওয়া যায়, তবে তার সূত্র ধরেই আমরা পুরো দলটিকে গ্রেফতার করতে পারবো।’

‘আর কায়রোর অবস্থা?’ জানতে চাইলেন আরেক সম্রাট।

‘কায়রোতেও আমাদের গোয়েন্দারা পরিপূর্ণ সক্রিয় রয়েছে। তাদেরকে আরো সতর্ক ও সজাগ থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে গতকাল আমাদের এক বাহক এসেছে। সে বলেছে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সেখানে নতুন সৈন্য ভর্তি ও তাদের ট্রেনিং দেয়ার কাজ জোরেশোরে শুরু করেছে। জেরুজালেম আক্রমণের চিন্তা সে এখনো মাথা থেকে বাদ দেয়নি। এই কথা সে ওখানে জোরেশোরেই প্রচার করছে।’

খৃষ্টানদের এই বৈঠক থেকে চেঙ্গিস ও ভিক্টর যেটুকু জানতে পেরেছিল, যদি সেইটুকুই কায়রো পৌঁছে দেয়া যেত, তবে সুলতান আইয়ুবীর জন্য যথেষ্ট উপকার হতো। তার কাছে এ সংবাদ আরও আগেই পৌঁছানো উচিত ছিল যে, ক্রুসেড বাহিনী শীঘ্রই অভিযান চালাচ্ছে আর তাদের অভিযান হবে হারান ও হলব অভিমুখে।

বৈঠক শেষ হলো মাঝ রাতেরও পর। মেহমানদের বিদায় দিয়ে অনেক রাত্রে চেঙ্গিস ও ভিক্টর সেখান থেকে বিদায় পেলো। কামরায় আসার পথেই ভিক্টর চেঙ্গিসকে বললো, ‘তাড়াতাড়ি ইমাম সাহেবের কাছ যাও।’

রাশেদ চেঙ্গিস প্রতিদিনের মত পোষাক পাল্টে কৃত্রিম দাড়ি পরে দেরী না করেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। যেহেতু আজ অনেক রাত হয়ে গেছে, সে জন্য মেয়েটা তাকে রাস্তায় আটকাবে এমন কোন ভয় ছিল না তার। সে প্রশান্ত মনেই কামরা থেকে বের হয়ে গেল।

তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হলো। সে যখন সেই সবুজ শ্যামল বাগানে গিয়ে পৌঁছল, মেয়েটি তাকে থামিয়ে দিল। চেঙ্গিস তখনও এ কথা জিজ্ঞেস করলো না বা চিন্তাও করলো যে, মেয়েটা থাকে কোথায় এবং সে তাকে এই অন্ধকারেও কেমন করে দেখতে পায়।

মেয়েটির হাবভাবে মনে হয়, সে সব সময় এমনকি চব্বিশটা ঘন্টাই তার পাশেপাশে থাকে। সে চেঙ্গিসের প্রতিটি পদক্ষেপ ও পদধ্বনি শুনতে পায়। দিনের বেলা তো বটেই, এমনকি অন্ধকার রাতেও।

চেঙ্গিস মেয়েটিকে দেখতে পেয়েই তার দায়িত্বের কথা ভুলে গেল। প্রতিদিনের মতই তারা বাগানের ভেতর অভিসারে মেতে উঠল। এদিকে কেমন করে সময় গড়িয়ে গিয়ে সকাল হলো সেদিকে কোন খেয়ালই করলো না।

এসব দিকে লক্ষ্য করার তার সময় কোথায়? সে তো এক মেয়ের প্রেমে মজে আছে। তার মন-মগজ আচ্ছন্ন করে বসে আছে এই মেয়ে। সে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে সেখানেই পড়ে রইল, আজ রাতেও ইমাম সাহেবের কাছে যেতে পারলো না।

এ জন্য তার মনে যে খুব দুঃখ বা আফসোস হলো, তাও না। কারণ মেয়েটা তার দুঃখের কাহিনী এমন ভাবে প্রকাশ করতে শুরু করলো যে, সে কথা শুনতে শুনতেই চেঙ্গিসের রাত কাবার হয়ে গেল।

‘আমাকে তোমার আশ্রয়ে নিয়ে নাও।’ মেয়েটি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, “দেখে তো আমাকে সবাই রাজকন্যা বলে, রাণী মনে করে। কিন্তু আমার জীবনটা এমন নরকময়! তুমি যদি আমাকে কাছ থেকে দেখতে হবে তোমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিউরে উঠতো। তোমার কাছে সত্য প্রকাশ করতে আজ আর আমার কোন দ্বিধা নেই। কারণ আমি চাই না আমার পরিচয় গোপন করে তোমাকে প্রতারিত করি। তুমি ইচ্ছা করলে আমাকে ঘৃণা করতে পারো, কারণ আমি তোমার ধর্মের লোক নই।

আমি এক মুসলমান মা-বাবার আদরের কন্যা। হরিণের সুস্বাদু গোশতই তার দুশমন। কারণ, হরিণের গোশত সুস্বাদু না হলে কেউ তাকে শিকার করতো না। তেমনি আমার সৌন্দর্যই আমার কষ্টের কারণ। আর এ যাতনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে, শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। পনেরো বছর বয়সে আমার বাবা আমাকে এক আরব বণিকের কাছে বিক্রি করে দেয়।

আমার বাবা গরীব লোক ছিল না, কিন্তু লোভী ছিল। আমরা ছিলাম ছয় বোন। সে মেয়েদের প্রতি মোটেই দরদী ছিল না। আমার বড় দুই বোন পিতার ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে তাদের প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়। এই দুঃখে বাবা, আমাকে বিক্রি করে দেয়। এক বছর পর বণিক এক খৃস্টান সামরিক অফিসারের কাছে আমাকে উপহার স্বরূপ পাঠায়। কিছুদিন পর সে অফিসার যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যায়। তখন আমি সেই অফিসারের বাস থেকে পালিয়ে আসি। কিন্তু পালিয়ে আমি যাবো কোথায়?

এক খৃস্টান আমাকে আশ্রয় দিল কিন্তু আমার দেহটাকে তার রুজি ও উপার্জনের উৎস বানিয়ে নিল। আমি কোন নিচু দরে নিশিকন্যা ছিলাম না। সে আমাকে ক্রুসেড বাহিনীর উঁচু দরের অফিসার ও কমাণ্ডারদের কাছে কিছু দিনের জন্য পাঠিতে দিত। আমি সেই অফিসার বা কমাণ্ডারের কাছে রাণীর মত থাকতাম। তারা আমাকে খুশী করার জন্য অলংকার বানিয়ে দিত, মাঝে মধ্যে নগদ অর্থও দিত। আমার সর্বপ্রকার আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করতো। মোট কথা, সেখানে আমি রাণীর হালেই থাকতাম।

কিন্তু তবু আমার মনে কোন শান্তি ছিল না। এই পেশাতে বড় বড় সামরিক অফিসারের সাথে আমার মেলামেশার সুযোগ হলো। আমি জন্ম থেকেই বুদ্ধিমতি ও বিচক্ষণ মেয়ে হিসাবে সবার প্রিয় ছিলাম। শীঘ্রই আমি শাসকশ্রেণী, এমনকি রাজা বাদশাহর সাথেও পরিচিত হয়ে উঠলাম। তারা আমাকে গোয়েন্দাগিরীর প্রশিক্ষণ দিয়ে গোয়েন্দা কাজে ব্যবহার করতে লাগলো।

একবার আমাকে বাগদাদে পাঠানো হলো। সেখানে নূরুদ্দিন জঙ্গীর এক সেনাপতিকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জড়াতে গিয়েছিলাম। আমি সেখানে খুবই সাফল্য লাভ করি এবং অত্যন্ত নিপূণভাবে আমার দায়িত্ব সমাধা করি। এতে গোয়েন্দা মহলে আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ গোয়েন্দাদের চোখে আমি শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠি। এরপর আমার ওপর আরো বড় বড় দায়িত্ব অর্পিত হয় এবং আমি কুশলী হাতেই সে সব দায়িত্ব পালন করি।

আমি যদি এখন তোমাকে আমার গোয়েন্দা কর্মের ফিরিস্তি শোনাতে শুরু করি, তবে তুমি আশ্চর্য হয়ে যাবে। হয়তো সব কথা বিশ্বাসও করবে না। সেই লম্বা কাহিনী রেখে এবার আসল কথায় আসি।

এক সময় আমার দায়িত্ব এই জেনারেলের হাতে পড়ে। তিনি আমাকে তার আশ্রিতা হিসেবে রেখে দেন। এই জেনারেল একজন প্রবীণ ও বৃদ্ধ মানুষ। তিনি আমাকে সুখে শান্তিতে রাখতে চেষ্টার কোন জটি করছেন না। তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে খুব গর্বের সাথে চলাফেরা করেন। লোকদেরকে এই বলে ধোঁকা দিতে চান, তিনি বৃদ্ধ নন। তিনি যুবতী মেয়েদেরকেও পরিপূর্ণ আনন্দ ও তৃপ্তি দানে সক্ষম।

এই বুড়ো আমার সকল আবদার পূরণ করে। এতদিন আমি তার সঙ্গে আক্রাতে ছিলাম। সেখানে হঠাৎ আমার সঙ্গে এক মুসলমান গোয়েন্দার সাক্ষাৎ হলো। সে গোয়েন্দা দামেশক থেকে এসেছিল।’

‘তার নাম কি?’ চেঙ্গিস প্রশ্ন করলো।

‘তার নাম শুনে তোমার কি লাভ?’ মেয়েটি বললো, ‘তুমি তো আর তাকে চেনো না। এখন আমার কথা শোন। তোমার ভালবাসা আমার মুখের বাঁধন খুলে দিয়েছে। বলতে পারো আমার হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিয়েছে। আমি তোমার সামনে এমন গোপন তথ্য ফাঁস করছি, যার পরিণাম সোজা কারাগারে যাওয়া। যেখানে মানুষ অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে করতে এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কিন্তু আমার ইচ্ছা, আমি তোমার কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করি।’

চেঙ্গিস কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে মেয়েটি বললল, “আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। দামেশকের সেই গোয়েন্দা ধরা পড়েছিল। গ্রেফতার করার পর তাকে কারাগারের গোপন কক্ষে পাঠিয়ে দেয়া হলো।

আমি ছিলাম ক্ষমতাধর এক জেনারেলের প্রিয় আশ্রিতা। আমি আমার মুনীবের কাছে সেই গোয়েন্দাকে দেখার আবদার করলাম। যথারীতি সে আবদার মঞ্জুর হলো। গোয়েন্দার তামাশা দেখার জন্য আমি কারাগারের গোপন কক্ষে গেলাম। তাকে এমন কঠিন ও বর্বরোচিত শাস্তি দান করা হচ্ছিল যে, দেখে আমার মূৰ্ছা যাওয়ার দশা। তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল, তার অন্য সাথীরা কোথায়, আর সে এ যাবত কি কি তথ্য যোগাড় করেছে।

তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। চেহারা নীল হয়ে উঠেছিল। তবুও সে বলছিল, আমার শরীরে এক মুসলমান পিতার রক্ত বইছে। আমাকে মেরে ফেলতে পারবে, কিন্তু আমি গাদ্দারী করতে পারবো না।

সহসা আমার যেন কি হয়ে গেল। এতদিন পর হঠাৎ করেই আমারও মনে পড়ে গেল, আমার শিরায়ও তো এক মুসলিম পিতারই রক্ত বইছে! আর এ কথা মনে হতেই জেগে উঠলো আমার আপন সত্ত্বা। আমার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। গোয়েন্দার গায়ের প্রতিটি আঘাত মনে হলো আমারই শরীরে পড়ছে। লজ্জায়, ক্ষোভে, দুঃখে, আমি কাঁপতে লাগলাম। সবাই ভাবল, আমি দুর্বল চিত্তের মেয়ে মানুষ। সে কারণে আমি ওই অত্যাচার দেখে ভয় পেয়েছি।

ওরা আমাকে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরিয়ে নিল। কিন্তু তখন আমার প্রতিটি রক্ত কণিকায় যেন ভূমিকম্প হচ্ছিল। মরু সাইমুমের মত তোলপাড় করছিল হৃদয়। আমি সংকল্প করলাম, যে করেই হোক, এই মুসলমান গোয়েন্দাকে আমি কারাগার থেকে মুক্ত করবোই।

আমি আমার সবটুকু বুদ্ধি ও বিচক্ষণতাকে একত্রিত করলাম। আমার মালিকের পদমর্যাদা ও ক্ষমতাকে কাজে লাগালাম। আমার রূপ ও সৌন্দর্যের যাদু ব্যবহার করলাম। আর কয়েক টুকরো সোনা ব্যবহার করলাম তার মুক্তির জন্য।

তারপর একদিন সকালে আমার মালিকের মুখে শুনতে পেলাম, কারাগারের গোপন কক্ষ থেকে সেই মুসলমান গোয়েন্দা পালিয়েছে।

আসলে সে তখনো কারাগার থেকে পালাতে পারেনি। আমি তাকে সেখান থেকে বের করে উপরের গুদাম ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলাম। তারপর শহরে তাকে খোঁজাখুজি শেষ হলে আমি আমার এক মুসলমান চাকর দিয়ে গোপনে তাকে ওখান থেকে বের করে আনি।

তার অবস্থা তখন খুবই কাহিল ছিল। আমি তাকে শহরেই এক জায়গায় লুকিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করলাম।

সেও তোমার মত এক সুন্দর যুবক ছিল। কয়েদখানা তাকে লাশ বানিয়ে দিয়েছিল। আমি তার চিকিৎসার জন্য এক ডাক্তার নিয়োগ করলাম। ডাক্তার তার ক্ষতগুলো ধুয়ে সেখানে পট্টি বেধে দিল। তাকে শক্তি ও বল ফিরে পাওয়ার ঔষধ দিল। আমি রাতে গোপনে তার কাছে যেতাম। তার জন্য ভাল ভাল খাবার ও ফলমূল নিয়ে যেতাম।

সেই যুবক জানতে চাইল, ‘কেন তুমি আমার জন্য এতসব করছো?”

তখন আমি তাকে বললাম, ‘আমিও এক মুসলমানের মেয়ে। আমার ঈমানই আমাকে এই দুঃসাহসিক কাজে প্রেরণা জুগিয়েছে।’

আমার জবাব শুনে সেই যুবক আমার ঈমানের প্রদীপকে আরো প্রজ্জ্বলিত করে দিল। সে আমাকে শোনালো বিবি খাওলা ও আরো মহিয়সী মহিলাদের ত্যাগের কাহিনী।

আমিও আমার জীবন ইতিহাস তাকে শুনিয়ে দিলাম, যেমন আজ তোমাকে শুনাচ্ছি। সে আমাকে বলল, ‘আমার সাথে চলো।’

‘আমি তাকে বললাম, না, তুমি আমাকে দোয়া করো, গোয়েন্দাগিরীর যে বিদ্যা আমি শিখেছি তা যেন আমার জাতি ও ধর্মের জন্য কাজে লাগাতে পারি।’

তখন সে আমাকে আক্রার তিন জন লোকের নাম বলল। বলল, ‘যদি কখনো বিপদে পড়ো এই তিনজনের যে কারো কাছে খবরটা দিও। আর কোন খবর থাকলে, তাও ওদের কাছে পাঠাতে পারো।

পরে সে ওই তিনজনের সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থাও করেছিল। এই গোয়েন্দা যখন সুস্থ্য হয়ে উঠলো, তখন সে শহর থেকে বেরিয়ে গেল।

তার যাওয়ার পর আমি গোপনে তার সাথীদের সাথে দেখা করতে লাগলাম। তারা আমাকে গোয়েন্দাগিরীর আরো কায়দা কানুন শিখিয়ে দিতে লাগলো। এভাবেই আমি তাদের দলে শামিল হয়ে গেলাম এবং তাদেরই একজন হয়ে কাজ করতে লাগলাম।

আমার মালিক এক উঁচু সামরিক অফিসার ছিল বলে সহজেই আমি শহরের অভিজাত মহল এবং বড় বড় আমীর ও অফিসারদের সাথে মিশতে পারতাম। তাছাড়া আমার অনুপম সৌন্দর্য ও যৌবনের আকর্ষণে সকলেই আমার সাথে সখ্যতা করতে আগ্রহী ছিল। সতীত্ব আমি আরো আগেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। এবার চোখের ইশারায় বড় বড় রথী মহারথীদের ঘায়েল করার কাজে নেমে পড়লাম আমি।

পাপিষ্ঠদের আঙ্গুলের ইশারায় নাচিয়ে আমি ওদের বন্দী করতে লাগলাম আমার রূপের জালে। কাউকে কাউকে আশ্বাস দিলাম, মালিককে বলে তাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করে দেবো। এভাবে সখ্যতা গড়ে তাদের কাছ থেকে অনেক মুল্যবান ও গোপন তথ্য আমি বের করে আনতাম আর তা পাঠিয়ে দিতাম সেই তিন মুসলিম গোয়েন্দার কাছে।

তারা আমাকে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সম্পর্কে নানা কথা শুনাতো। তাদের কাছ থেকে আইয়ুবীর গল্প শুনে আমার মনে হতো, লোকটা মানুষ নয়, ফেরেশতা।

আমার অন্তর সেই ফেরেশতাকে এক নজর দেখার জন্য আনচান করতে লাগল। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, তাকে এক নজর চোখের দেখা দেখার সৌভাগ্য আমার হলো না। তিনি জানতেও পারলেন না, জাতির জন্য তিনি একাই লড়ছেন না, আমার মত পাপিষ্ঠারাও সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে।

তারপর আমি আমার মালিকের সাথে এখানে এসে গেলাম। জানতে পারলাম, ক্রুসেড বাহিনী সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মুসলমানদের উপর সামরিক অভিযান চালানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

আমার মালিক এই জেনারেলের কাছ থেকে তাদের সমস্ত গোপন তথ্য জেনে নিলাম। এসব তথ্য এখন কায়রো পাঠানো দরকার। কিন্তু এখানে আইয়ুবীর কোন গোয়েন্দার সাথে আমার পরিচয় নেই। তাই আমি নিজেই এসব তথ্য নিয়ে কায়রো ছুটে যেতে চাই। তোমার কাছে আমার ভালবাসার দোহাই, তুমি শুধু একবার আমাকে এখান থেকে বেরানোর সুযোগ করে দাও। এর বিনিময়ে তুমি আমার কাছে যা চাবে, তাই পাবে। সারা জীবন আমি তোমার কেনা বাঁদী হয়ে থাকবে। আর কোনদিন আমি গোয়েন্দাগিরী করবো না। তোমার কাছেওয়াদা করছি, সারা জনম আমি তোমার সেবাদাসী হয়ে কাটাবো। শুধু একবার তুমি আমাকে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর দরবারে পৌঁছার সুযোগ করে দাও।’

মেয়েটির কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ছিল সীমাহীন অনুনয়। স্তব্ধ হয়ে বসেছিল রাশেদ চেঙ্গিস।

“তুমি এই গোপন তথ্য কোন সাহসে ফাঁস করে দিলে?’ চেঙ্গিস বললো, ‘যদি তুমি সত্যিই গোয়েন্দা হয়ে থাকো তবে তুমি এক আনাড়ী গোয়েন্দা। তুমি এক যুবকের ভালবাসার উপরে ভরসা করে এমন কাজ করেছে, যা কোন গোয়েন্দা করে না। যদি আমি তোমাকে বলি, আমি তোমার চেয়ে ক্রুশকেই বেশী ভালবাসি, আর আমার আনুগত্য ক্রুসেড বাহিনীর ওপর, তখন তুমি কি করবে? বুদ্ধিমান গোয়েন্দা তার দায়িত্বের ওপর সন্তানের ভালবাসাকেও কোরবানী করে।’

‘আমি যদি তোমার কাছে সত্য কথা প্রকাশ করে দেই, তবে কি তুমি মানবে, আমি আনাড়ী নই?’ মেয়েটি বললো, ‘আমি প্রথম থেকেই বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম, তুমি খৃস্টান নও। তুমি মুসলমান এবং মিশরের গোয়েন্দা।’

রাশেদ চেঙ্গিস এমন আঁৎকে উঠলো, যেন গোখরো সাপে তাকে দংশন করেছে। তার চোখ থেকে মদের নেশা আর ভালবাসার আবেগ সবই উড়ে গেল। সেখানে এসে জমাট বাঁধল ভয় ও শঙ্কার পাহাড়। সেই পাহাড়ের নিচে তলিয়ে গেল রাশেদ চেঙ্গিস নামের এক গোয়েন্দা। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে চোখে সে তাকাল মেয়েটির দিকে। কিছু বলার চেষ্টা করলো, কিন্তু অনুভব করলো, তার জবান বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুই বলতে পারছে না সে।

মেয়েটির চাপা হাসির শব্দ শুনতে পেল সে। হাসি থামিয়ে মেয়েটি বললো, ‘আমি কি আনাড়ী?”

এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব ছিল না চেঙ্গিসের পক্ষে। মেয়েটি যদি সত্যিই মুসলমান হয়ে থাকে তবে তার কাছে পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়াটা তেমন ভয়ের নয়। কিন্তু যদি মেয়েটি মিথ্যে বলে থাকে, তবে এই মেয়ের কাছে পরিচয় দেয়া, বা না দেয়া কোন ব্যাপার নয়। ব্যাপার হলো, সে নিজে এতটাই আনাড়ী যে, দুশমন পক্ষের এক নারীর কাছে সে ধরা খেয়ে গেল।

যদি মেয়েটি মিশরের গোয়েন্দা হয়ে থাকে তবে তো তারা একই দলের লোক। সে ক্ষেত্রে এই মেয়ে তার কাছে অপরিচিত থাকার কথা নয়। কিন্তু মেয়েটির সাথে তার সে রকম কোন পরিচয় তো হয়নি।

মেয়েটি যে দলেরই হোক, সে যে এক ঝানু গোয়েন্দা, এ কথা অস্বীকারের কোন উপায় ছিল না চেঙ্গিসের। তার ভয় হলো, এ মেয়ে তো আবার দু’মুখো সাপ নয়! মেয়েটি দুদিকের চর হয়ে দুদিকেই খেলছে, এমনও তো হতে পারে। সে ভাল করেই জানতো, সুলতান আইয়ুবী গুপ্তচরবৃত্তিতে কোন নারীকে ব্যবহার করতে কড়া ভাবে নিষেধ করেছেন। মুসলিম গোয়েন্দারা বড়জোর বিশেষ প্রয়োজনে কোন নারীর সহযোগিতা নিয়েছে, এর বেশী নয়।

এমনও তো হতে পারে, মেয়েটা তার নিজ স্বার্থেই গোয়েন্দগিরী করছে। যদি তাই হয় তাহলে তো এ মেয়ে কাল নাগিনীর চেয়েও বিষাক্ত! সাপকে হয়তো পোষ মানানো যাবে, কিন্তু দু’মুখো সাপের স্বভাব মেয়েকে কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না। এরা যখন তখন এবং যে কোন দিকে ছোবল হানতে পারে।

‘চুপ হয়ে গেলে যে!’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, ‘বলো, আমি কি মিথ্যা বলেছি?’

‘হ্যাঁ। তুমি সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেছে। চেঙ্গিস উত্তর দিল, ‘তুমি আমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছো।’

‘কেমন বিপদ?’ মেয়েটি বললো।

‘ভাবছি তোমাকে কি ধরিয়ে দেবো, নাকি ভালবাসার খাতিরে চুপ থাকবো।’ চেঙ্গিস বললো, ‘আমি জাত খৃস্টান এবং কট্টর ক্রুসেডার। যে কোন মূল্যে আমি ক্রুসেড বাহিনীর বিজয় চাই।’

তারা বাগানে ঘাসের ওপর বসে কথা বলছিল। মেয়েটি তার উরুর নিচ থেকে কিছু একটা বের করে চেঙ্গিসের দিকে মেলে ধরে বললো, “এই নাও তোমার দাড়ি। কাল রাতেও যখন নেশায় ছিলে, তখন তোমার পকেটে দেখেছিলাম। আজ ভাবলাম, আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য যদি দরকার হয়, তাই বের করে নিয়েছি।’

চেঙ্গিস মেয়েটির রূপের ফাঁদে আটকে গিয়ে নিজেকেই হারিয়ে বসেছিল। তাই মেয়েটি তাকে মদের নেশায় ডুবিয়ে দিয়ে তাকে আবিস্কারের জন্য কতদূর এগিয়ে গিয়েছিল, কিছুই সে টের পায়নি।

‘আমি তোমার মুখে এক রাতে এই দাড়ি দেখেছিলাম।’ মেয়েটি বললো, ‘তুমি এই দাড়ি লাগিয়েই তোমার কামরা থেকে বের হয়েছিলে। আমি তোমাকে এই বাগানে এসে থামিয়ে দিলাম। তুমি তাড়াতাড়ি দাড়ি লুকিয়ে আমার সামনে এসেছিলে। আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে তোমার জোব্বার দুই পকেটেই হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ছিলাম, তুমি খেয়াল করতে পারেনি। তখনই আমি তোমার এই দাড়ির অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম।’

‘কৃত্রিম দাড়িতে লেখা নেই যে, আমি এক গোয়েন্দা। তুমি কি করে আমাকে এক গোয়েন্দা ভাবতে পারলে?’

“তুমি যেমন করে আমার কাছে সৈন্যদের সম্পর্কে জানতে চাইলে, কেবল কোন গোয়েন্দাই তা চাইতে পারে।’ মেয়েটি বললো, ‘তুমি যেসব প্রশ্ন আমার কাছে করেছিলে, কোন গোয়েন্দা ছাড়া এসব জানার জন্য কেউ ব্যতিব্যস্ত হয় না। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, কোন সৈনিকের মনেও এসব প্রশ্ন আসতে পারে না। আর মদ পান নিয়ে তুমি যে অভিনয় করলে, তাও কেবল কোন মুসলমানই করতে পারে। কোন খৃস্টানই মদ পান করাকে খারাপ জানে না, একমাত্র মুসলমানরাই তাকে হারাম জানে ও মানে।’

কথা বলতে বলতে মেয়েটি হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। সে চেঙ্গিসের চোখে চোখ রেখে তাকাল তার দিকে। তারপর দুবাহু বাড়িয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো? তোমার কি এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি এক মুসলমান? আমি কেমন করে তোমাকে আমার মন খুলে দেখাবো যে, আমরা দুজন একই পথের যাত্রী। আমি তোমাকে শুধু সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা হিসেবেই আপন ভাবিনি। আমি জানি না, তোমাকে দেখার পর আমার মন কেন এমন উতলা হয়ে উঠলো। আমি তোমার সাথে সম্পর্ক গড়ার জন্য পাগল হয়ে গেলাম। যখন তোমার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় তখন তোমাকে আমি খৃস্টানই মনে করেছিলাম। কিন্তু যখন টের পেলাম তুমি মুসলমান, আমার আনন্দের কোন সীমা রইল না। আমি আল্লাহর কাছে হাজার কোটি বার শুকরিয়া জানালাম।

রাশেদ, আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমাদের আত্মা এক সাথে আকাশে উড়ছে। আর এখন এই মাটিতেও আমাদের আত্মা একাকার হয়ে আছে। আমি বিশ্বাস করি, কিয়ামতের দিনও আমাদের আত্মা আল্লাহ এক সাথে উঠাবেন এবং এক সাথে হাশর-নাশর করবেন। বলতো, তোমাকে গোয়েন্দা প্রমাণ করার জন্য আর কতটি প্রমাণ উপস্থিত করবো?”

চেঙ্গিস পাথরের মূর্তির মত শক্ত হয়ে বসে রইল। মেয়েটির এ আবেগময় কথার পরও তার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না। মেয়েটিই আবার মুখ খুলল, ‘আমি তোমাকে রক্ষার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। আমি মনে করি, আজ এবং এখুনি এ স্থান আমাদের ত্যাগ করা দরকার। নইলে দু’জনের ওপরই বিপদ নেমে আসতে পারে।

আমাদের কাছে এখন যে তথ্য আছে সেগুলো মহা মূল্যবান সম্পদ। যদি এই সংবাদ সঠিক সময় কায়রোতে পৌঁছাতে না পারি তবে হারান, হলব, হিম্মত, দামেশক ও বাগদাদ ক্রুসেড বাহিনীর আক্রমণের প্লাবনে ভেসে যাবে। তখন মিশরকে রক্ষা করাও অসাধ্য হয়ে পড়বে।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এসব খবর কিছুই জানেন না। সময় আর বেশী নষ্ট করার উপায় নেই। আমি এখান থেকে একা বেরোনোর সাহস পাচ্ছি না। পেলে তোমাকে আমি পীড়াপীড়ি করতাম না।

রাশেদ, তুমি বুঝতে চেষ্টা করো, তোমার সঙ্গ আমার কেন বিশেষ প্রয়োজন। আমি শহর থেকে বেরোনোর বুদ্ধিও চিন্তা করে রেখেছি। আমি তোমাকে নিয়ে শহরের বাইরে ভ্রমণে যাবো। তুমি হবে আমার রক্ষী। তখন কেউ আর আমাদের সন্দেহ করতে পারবে না।’

রাশেদ চেঙ্গিস নীরব ও নিথর হয়ে বসেছিল। মেয়েটি তার পিয়ালায় মদ ঢেলে পিয়ালাটি তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আবেগ মাখা কণ্ঠে বলল, ‘তুমি খুব ভয় পেয়ে গেছে। নাও, পান করে নাও। এটাই যেন তোমার জীবনের শেষ পিয়ালা হয়। এর পর আমরা তওবা করে ফিরে আসব এই পাপকর্ম থেকে।’

মেয়েটি পিয়ালা তার ঠোঁটে তুলে ধরলো। মদের নেশায় চুর হয়ে চেঙ্গিস বলে উঠলো, ‘তুমি সত্যি এক অসামান্যা গুপ্তচর! নতুবা আজ দেড় বছর ধরে আমি ক্রুসেড গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হরমনের ছায়ায় কাটিয়ে দিলাম, কিন্তু তিনি আমাকে চেনা তো দূরের কথা, সামান্য সন্দেহও করতে পারলেন না। আমি তোমার এই বিচক্ষণতার প্রশংসা করি। তুমি ঠিকই বলেছে, আমরা দুজন একই লক্ষ্য পথের যাত্রী। তুমি সত্যি আমার সাথে কায়রো যাবে?’

‘আমি তো সে কথাই তোমাকে বলছি। কখন রওনা করতে চাও?”

‘আজ এবং এখুনি।’

‘না, রাতের বেলা চোরের মত শহর ছাড়লে আমরা দুশমনের সন্দেহের তালিকায় পড়ে যাবো। আমি আমার মনীবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিই। তারপর তাকে বলবো, আমার একজন রক্ষীর প্রয়োজন। আমি রক্ষী হিসাবে তোমাকে আমার সাথে দেয়ার আবদার করবো। আমার মনীব কখনো আমার আবদার ফেলে না, আশা করি, কালও ফেলবে না। দিনের বেলা আমি গোছগাছে সময় কাটিয়ে দেব। তারপর রাত নামলে, যখন সবাই আনন্দ অভিসারে বেরোবে, ঠিক সেই ফাঁকে আমরা শহর ত্যাগ করবো। কাল সন্ধ্যার পর তুমি এখানেই চলে এসো। আমি এর মধ্যে আরও কোন নতুন খবর নেয়া যায় কিনা চেষ্টা করে দেখবো।’

রাতের শেষ প্রহরে রাশেদ চেঙ্গিস তার কামরায় পৌঁছলো। সে ভিক্টরকে আর জাগালো না। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই তাকে রাতের কাহিনী শোনাবে বলে মনস্থির করলো।

এটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় রাত। এক দিকে তার চিন্তার রাজ্যে বিভীষিকা সৃষ্টি হয়েছিল মেয়েটির হাতে ধরা পড়ে গিয়ে। অন্যদিকে সে পরম আনন্দ ও খুশী অনুভব করছিল এই ভেবে, এক অসামান্যা মেয়ে তাকে ভালবেসে ফেলেছে। মেয়েটি কেবল বুদ্ধিমতিই নয়, তার মতই এক গুপ্তচর এবং সে এক মুসলিম বাপের কন্যা।

বিছানায় শুয়ে সে স্বপ্ন দেখতে লাগল আগামী কাল সকালের। কাল সূর্য উঠবে তার জীবনে নতুন খুশীর খবর নিয়ে। কি পরম সৌভাগ্য তার, কাল সে ত্রিপলী থেকে এক অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে সুখস্বপ্ন দেখল রাশেদ চেঙ্গিস। তার মনে হলো, এখনি এ শুভ সংবাদটা ভিক্টরকে দেয়া দরকার। অধীর আগ্রহে সে তৎক্ষণাৎ ভিক্টরের কামরায় গিয়ে হাজির হলো।

ভিক্টর তাকে দেখতে পেয়েই তড়িঘড়ি বিছানায় উঠে বসলো। বললো, ‘কি ব্যাপার, কোন দুঃসংবাদ?”

রাশেদ আনন্দে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘না বন্ধু, বলো পরম সুসংবাদ আছে।’

বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাল ভিক্টর। ‘বলো, কি সুসংবাদ, শুনি?’

রাশেদ ভিক্টরকে মেয়েটির সাথে তার কথোপকথন এবং সমস্ত ঘটনাই বিস্তারিত জানালো।

‘তুমি কি তাকে বলেছ, তুমি একজন গোয়েন্দা?’ ভিক্টর জিজ্ঞেস করলো।

‘হ্যাঁ!’ চেঙ্গিস উত্তর দিল, আমাকে তা বলতেই হলো।’

‘আমার সম্পর্কে কি কিছু বলেছো?’

‘না।’ চেঙ্গিস উত্তর দিল, ‘তোমার সম্পর্কে কোন কথাই হয়নি।’