পরদিন সকালে মানুষের ঢল নামলো সেখানে। সেই গ্রাম এবং আশপাশের অন্যান্য গ্রামের লোকেরা চারণভূমির দিকে ছুটে আসতে লাগলো দলে দলে। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল নির্জন চারণভূমি।
সতেরোটি উট মন্থর পায়ে এগিয়ে আসছে চারণভূমির দিকে। প্রত্যেক উটের পিঠে সুন্দর করে সাজানো পালকি। প্রত্যেক পালকিতে রেশমী কাপড়ের পর্দা ও সোনালী-রূপালী ঝালর লাগানো। এই সতেরো পালকির কোন একটাতে আছেন সেই মশহুর পীর।
মিছিলের অগ্রভাগে শানাই ও ঢোল বাজছে। পীরের খাদেম ও ভক্তকুল উটের সারির আগে পিছে মিছিল করে এগিয়ে চলেছে। ভাবগম্ভীর ভাবে গুণ গুণ করে দোয়া কালাম পড়ছে ওরা। উটগুলোর লম্বা গলায় ঝুলানো ঘণ্টার ধ্বনি ঐকতানে ঝংকৃত হয়ে অপূর্ব সুরের লহর তুলছে। ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে উট ও মানুষের বিশাল কাফেলা। কিন্তু কোন বিশৃংখলা নেই, শোরগোল বা হই হট্টগোল নেই। একটি পবিত্র ভাবগম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করছে মিছিলের সর্বত্র।
লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এ শানদার মিছিলের দিকে। পীর সাহেবকে কেউ দেখতে পেলো না, তবে তার খাদেমবৃন্দ এবং একান্ত বিশ্বস্ত ভক্ত ও অনুরুক্ত মুরিদদের দেখেই অভিভূত হয়ে গেল সবাই।
মিছিলকারীদের পরণে ঢিলেঢালা শাদা আলখেল্লা। তাদের ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল, এরা এই ধুলির ধরণীর কেউ নয়।
কাফেলা সেই সবুজ প্রান্তরে চলে এল। সেখানে টিলার ফাঁকে ফাঁকে অনেক সমান্তরাল ভূমি। তারই একটি সমান্তরাল স্থানে তাবু টানিয়ে পীরের জন্য থাকার আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তার চারপাশে বসে গেল গ্রাম্য মেলা।
উটের আরোহীরা তাবুগুলোর কাছে গিয়ে থামলো। লোকজন ঘেরাও করা সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল তাদের। শাদা চাদরের ঘেরাও দিয়ে আরোহীদের পালকি থেকে নামানো হলো। ফলে, কে কে নামলো এবং কে কোন তাবুতে আশ্রয় নিল জনগণ তা দেখতে পেল না।
উটের বহরের সাথে হেঁটে আসা মুরিদরা সীমানার বাইরে বসে পড়লো। গ্রামের লোকেরা মুরিদদের কাছ থেকে পীরের কেরামতি ও মোজেজার গল্প শুনতে ঘিরে ধরল ওদের |
রহস্যময় বিষয়ে মানুষের যে সহজাত কৌতুহল থাকে সে কৌতুহলে আন্দোলিত উপস্থিত লোকজন। পীর সাহেব ও তার সঙ্গী সাখীরা মানুষের এই সহজাত প্রবণতাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে অতিশয় পারঙ্গম। ফলে এক ধরনের রহস্যময়তা কাজ করছিল সেখানে।
ইমাম সাহেব জনতার ভিড়ের মাঝে মিশে গিয়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন। গভীর মনযোগ দিয়ে তিনি লক্ষ্য করছিলেন জনগণের মতিগতি। তার সাথে ছিল মাহমুদও। মাহমুদের বিশ্বাসের ভীতে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছিল, তাই সে পীর সাহেবের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কোন মন্তব্য করলো না।
সে কায়রো থেকে নির্দেশ পেয়েছে, সীমান্ত এলাকায় মানুষের মাঝে যে নতুন বিশ্বাস ছড়ানো হচ্ছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাও। সেখানে কি হচ্ছে জানার জন্য কেন্দ্র উদগ্রীব। কারা এগুলো করছে এবং কিভাবে করছে। বিস্তারিত জানাবে। কায়রোতে এখনও এ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ কোন রিপোর্ট আসেনি।
কায়রোতে কেন এখনো কোন রিপোর্ট যায়নি মাহমুদ তা জানে। পীর সাহেবের রহস্যময় তৎপরতায় সাধারণ লোকের মত এখানকার গোয়েন্দারাও অভিভূত হয়ে অনেকেই তার ভক্ত হয়ে গেছে। যারা ভক্ত হয়নি তারাও ভয়ে পীরের বিরুদ্ধে কোন রিপোর্ট দিতে সাহস পায়নি। এ জন্যই সীমান্ত থেকে পীরদের তৎপরতা সম্পর্কে কেন্দ্ৰ আজো সঠিক রিপোর্ট পায়নি।
এখন এর পুরো দায়িত্ব চাপলো ইমাম সাহেবের ওপর। এ জন্যই তিনি মাহমুদকে নিয়ে এখানে এসেছেন। তাঁর বিশ্বাস, পীর সাহেব যাদু বা ভিলকিবাজি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
ইমাম সাহেব দেখলেন, অধিকাংশ লোক মুরিদদের মুখে পীরের প্রশংসা শুনেই তার বশীভূত হয়ে যাচ্ছে।
তারা পীরের কেরামতি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। কেউ ওখান থেকে সরতে নারাজ, পাছে কেরামতি দেখার সৌভাগ্য থেকে যদি বঞ্চিত হতে হয়!
সাদিয়ার অপহরণের খবর এখনো জানেন না ইমাম সাহেব ও মাহমুদ। হঠাৎ সাদিয়ার বাবা তাদের দেখতে পেয়ে। ছুটে এল সেখানে। সাদিয়ার বাপের বিপন্ন ও বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে অজানা আশংকায় কেপে উঠল মাহমুদের হৃদয়। ইমাম সাহেব ত্রস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “কি ব্যাপার, কি হয়েছে তোমার? তার কণ্ঠে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
সাদিয়ার পিতা ম্লান চোখে তাদের দিকে চাইল। সে চোখে বেদনার অথৈ সাগর। বললো, সাদিয়া গত রাতে বাড়ী ফেরেনি। গ্রামের মেয়েরা বললো, রাতে সাদিয়া তাদের সাথে এখানেই ছিল। হঠাৎ চার পাঁচ জন লোক এসে তাদের তাড়া করে। সবাই হুলুস্কুল করে পালিয়ে যায়, কিন্তু তারপরে আর সাদিয়ার সাথে তাদের দেখা হয়নি। তার কি হয়েছে তারা কেউ জানে না।’
সকাল থেকেই সাদিয়ার পিতা পাগলের মত মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আশপাশের বাড়িতে খোঁজ নেয়ার পর মেয়েকে না পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন মসজিদে। ওখানে ইমাম সাহেব বা মাহমুদ কাউকে না পেয়ে ছুটে এসেছেন এখানে।
হঠাৎ করে এ দুঃসংবাদ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ইমাম সাহেব। মেয়ে হারানোর বেদনায় শোকার্ত পিতাকে কি বলে শান্তনা দেবেন ভেবে পেলেন না। মাহমুদও চুপচাপ। কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন ইমাম সাহেব, তার আগেই মেয়ের খোঁজে ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল সাদিয়ার পিতা।
সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদ পিছু নিল তার। দু’জনেই ভীড়ের মধ্যে সাদিয়াকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু এই ভীড়ের মধ্যে সাদিয়া থাকলে তো তাকে খুঁজে পাবে তারা পুরো এলাকা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো, কিন্তু সাদিয়াকে কোথায় পাওয়া গেল না। তবুও বাপের মন বুঝ মানে না, সে এদিক ওদিক ঘুরতেই থাকে। তার পিছু পিছু ঘুরতে থাকে মাহমুদও।
তাদেরকে এখানে ওখানে উকিঝুকি মারতে দেখে এক অচেনা লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কি কাউকে খুঁজছো?
‘গত রাত থেকে আমার মেয়ের খোজ পাচ্ছি না। গাঁয়ের মেয়েদের সাথে এখানেই ছিল সে কাল রাতে। কিন্তু সবাই বাড়ি ফিরলেও সে বাড়ি যায়নি।”
‘অ, তুমিই মেয়েটির বাবা! লোকটি সাদিয়ার বাপকে না। এখন হয়তো তারা মিশরের সীমানা পার হয়ে অনেক দূরে চলে গেছে।’
কি বলছে তুমি? আমার মেয়ে কেন মিশর ছেড়ে যাবে?’। তার আমি কি জানি!’ লোকটি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘গতকাল সন্ধ্যায় আমি এক ঘোড়সওয়ারকে দেখলাম মেয়েদের দিকে এগিয়ে যেতে। তার চলাফেরায় কেমন একটা সতর্ক ভাব। লোকটার আচরণে সন্দেহ হওয়ায় আমার কৌতুহল হলো। দেখলাম, ঘোড়সওয়ার মেয়েদের জটলা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
এসে ঘোড়সওয়ারের পাশে দাঁড়ালো। ওরা নিচু স্বরে কি কথা বলেছে আমি শুনতে পাইনি। এরপর দেখলাম, মেয়েটি এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেই আরোহীর সামনে উঠে বসলো। তারপর আরোহী ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল ওখান থেকে। আমি দেখছিলাম আর চিন্তা করছিলাম, আল্লাহ জানে এ মেয়েটি কার! নিশ্চয়ই সে বাপ-মাকে ফাঁকি দিয়ে পালাচ্ছে।”
লোকটির কথা শুনে পাশে দাঁড়ানো একজন বলে উঠলো, তুমি কেমন বাপ হে! নিজের মেয়ে কার সাথে প্রেম করে বেড়ায় খবর রাখো না? এখন বসে বসে কপাল চাপড়াও, অযথা আর তাকে খোজার বৃথা চেষ্টা করো না।’
লোকটি চলে গেল। সাদিয়ার বাবার চোখে নেমে এল অশ্রুর ধারা। কিন্তু মাহমুদের প্রতিক্রিয়া হলো অন্য রকম। কারণ সে ছিল গোয়েন্দা। সে চিন্তা করে দেখলো, এ লোক যা বলেছে তা ডাহা মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। তার বর্ণনায় একবিন্দু সত্য থাকতে পারে না। কেমন করে সে বলতে পারল, সাদিয়া এক ঘোড়সওয়ারের সাথে পালিয়ে গেছে! এত ভীড়ের মধ্যে সে একাই এ ঘটনা দেখতে পেলো আর কেউ কিছু টের পেল না! অসম্ভব, এ হতেই পারে না।
কারো কথা যাচাই বাছাই না করে চট করে বিশ্বাস করা গোয়েন্দাদের প্রশিক্ষণের পরিপন্থী। গোয়েন্দা ট্রেনিংয়ের মূল কথা হলো, কারো কথা চট করে বিশ্বাসও করবে না, অবিশ্বাসও করবে না। আগে খতিয়ে দেখবে যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে। সম্ভব হলে সরেজমিনে তদন্ত করবে। তারপর নিরূপণ করবে তার কথা সত্য না মিথ্যা। গোয়েন্দাদের সন্দেহপ্রবণতা ও বিশ্বাসের বিশেষ মানদণ্ড আছে, সবকিছুই তারা সেই চোখ দিয়ে দেখে। মাহমুদ ঐ অচেনা লোকটির পিছনে লেগে গেল।
লোকটি হাঁটতে হাঁটতে ভীড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে টিলার দিকে এগিয়ে গেল। মাহমুদ দূর থেকে ফলো করে এগিয়ে গেল সেই টিলার দিকে। টিলার পেছনে পীর সাহেব ও তার খাদেমদের তাবুর সারি। মাহমুদ টিলায় চড়ে লোকটাকে আর দেখতে পেল না। নিশ্চয়ই টিলা থেকে নেমে সে এই তাবুর সারির কোন একটিতে ঢুকে পড়েছে।
লোকটা তাবুর সারির মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় মাহমুদের বিশ্বাস হল নিশ্চয়ই সাদিয়া এখানেই কোন এই তাবুতে আছে। তাকে অপহরণ করার পেছনেও এ লোক জড়িত।
লোকটা সাদিয়ার খরিদ্দারের কেউ নয়তো। সাদিয়ার বাবাকে হুমকি দিয়ে রাজি করিয়েছিল ওরা হঠাৎ অপহরণের সুযোগ পেয়ে টাকা খরচের হাত থেকে বাঁচার জন্য এ কাজ করেনি তো ওরা!
চিন্তাটা মাহমুদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল, টিলা থেকে নেমে এল মাহমুদ। দেখা যাচ্ছে, সাদিয়ার বাবা লোকটিকে না চিনলেও তারা তাকে ভাল করেই চেনে। মাহমুদ নিশ্চিন্ত, সাদিয়ার বাবাকে মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত করার জন্যই লোকটি এই কাহিনী বানিয়েছে, যেন তিনি তার মেয়েকে এখানে আর খুঁজে না বেড়ান।
মাহমুদ বিন আহমদের মনে সাদিয়ার জন্য ছিল গভীর ভালবাসা। সাদিয়াও তাকে ভালবাসে, আর ভালবাসে বলেই এখান থেকে তাকে নিয়ে সরে পড়তে চেয়েছিল। সে ভালবাসার পরীক্ষায় পড়ল মাহমুদ। এ পরীক্ষায় তাকে যে উত্তীর্ণ হতেই হবে!
মাহমুদ ইমাম সাহেবকে খুজে বের করে তাকে সন্দেহের কথা বললো। ইমাম সাহেব একজন বিচক্ষণ গোয়েন্দা কমাণ্ডার। তিনি মাহমুদের সাথে এক মত হয়ে বললেন, ‘ঠিকই ধরেছ তুমি, সাদিয়ার বাবাকে ধোকা দেয়ার জন্যই তার মেয়ে অন্য কারো সাথে পালিয়ে গেছে বলে প্রচারণা চালানো হয়েছে।’
মাহমুদ বলল তাহলে তাকে উদ্ধার করার জন্য আমাদের এখনি কিছু করা দরকার।’
হ্যাঁ, তুমি এক কাজ করো, ভীড়ের মধ্যে আমাদের আরো যে দুজন সহকারী আছে তাদের খুঁজে বের করো। ওদের সাথে আলাপ করেই তাকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেবো আমরা ”
মাহমুদ ওদের খুঁজে বের করলো। তারপর জটলা থেকে দূরে এক টিলার আড়ালে ওরা পরামর্শ সভায় বসলো।
মাহমুদ সব খুলে বললো ওদের। সবাই সাদিয়াকে উদ্ধার করার ব্যাপারে একমত হলো। কিন্তু কাজটি এত সহজ ছিল না। পীরের আস্তানা এবং তার লাগোয়া তাবুগুলোর কাছে কারো যাওয়ার অনুমতি ছিল না। এমনকি পীরের খাস মুরিদরা ছাড়া আশেপাশের টিলা মাড়িয়ে সেই সমতল ভুমিতে নামারও অনুমতি ছিল না কারো। পীরের মুরিদরা চারদিক থেকে এলাকাটা ঘিরে রেখেছিল। চাইলেই তাদের অনুমতি পাওয়া যাবে এমন নয়, আবার তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে সেখানে প্রবেশ করাও ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার।
নূরুদ্দিন জঙ্গী ক্রাক অবরোধে সৈন্যদের লাগিয়ে দিয়ে দুর্গ ভাঙ্গার কৌশল চিন্তা করছিলেন। যুদ্ধের অবস্থা জটিল। প্রথম দিনই তিনি বুঝেছিলেন, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যে দুর্গের পতন ঘটাতে পারেননি তার পতন ঘটানো কোন সহজ ব্যাপার নয়। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, কিন্তু সে ক্রাকের পতন ঘটাতে পারেনি। এতেই এ যুদ্ধের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
নুরুদ্দিন জঙ্গির ভরসা সালাউদ্দিন আইয়ুবীর দেয়া কিছু তথ্য। তিনি তাঁর সালারদের বললেন, এ দুর্গের পতন ঘটানোর সম্ভাব্য কৌশল সে-ই আমাকে বলে গেছে। সে আমাকে বলেছে, এ দুর্গের অভ্যন্তরে কোথায় কি আছে এবং আমরা কি ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হবো। কোথায় রসদ আছে, কোথায় যুদ্ধের বাহন ঘোড়া আর উট, কোথায় সেনাবাহিনীর ব্যারাক, সব সে বলেছে আমাকে। শহরের খৃষ্টান প্রধান আবাসিক এলাকা এবং মুসলিম প্রধান আবাসিক এলাকাও সে আমাকে চিনিয়ে দিয়ে গেছে। তার জানবাজ গোয়েন্দারা এসব তথ্য খুব নিখুঁত ও যত্ন সহকারে সংগ্ৰহ করেছে বলেই আমার বিশ্বাস। আমাদের অভিযানে এ সব তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।” –
তিনি দুর্গের মধ্যে অগ্নি বর্ষণ করার কথা চিন্তা করছিলেন। কিন্তু তার মেনজানিক ছিল ছোট এবং কম শক্তিসম্পন্ন। ক্রুসেডদের ছিল ভারী মেনজানিক। এর সাহায্যে ওরা বহু দূর পর্যন্ত অগ্নিগোলা ছুড়ে মারতে পারতো। সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর মেনজানিকের ক্ষমতা কম বলে এ চিন্তা তিনি মাথা থেকে বিদায় করলেন।
আইয়ুবীর মুজাহিদরা যেখান দিয়ে দেয়াল ভাঙ্গার চেষ্টা করেছিল আর ক্রুসেডাররা দেয়ালের ওপর থেকে ড্রামের আড়াল নিয়ে জ্বলন্ত কাঠ নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মেরেছিল মুজাহিদদের, জঙ্গী অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন। সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের ডাকলেন।
সবাই এসে পৌছলে তিনি বললেন, যত কঠিনই হোক, দুর্গ আমাদের দখল করতেই হবে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বলে গেছে, শক্তিশালী ও বড় ধরনের মেনজানিক ব্যবহার করতে পারলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। আমি তার সাথে একমত, কিন্তু তাতে ভেতরের মুসলমানদের ক্ষতি হওয়ার আশংকা আছে। এতে একজন সাধারণ মুসলমান মারা গেলেও তা হরে আত্মঘাতি অপারেশন। সারা জীবন এ জন্য আমাকে অনুতপ্ত থাকতে হবে।
একজন অফিসার বললেন, আমি মনে করি আইয়ুবীর চিন্তা ও পরিকল্পনা আবার নতুন করে খতিয়ে দেখা দরকার। আমি ইচ্ছে করলে বড় ও শক্তিশালী মেনজানিক বানানোর ব্যবস্থা করতে পারি।
কিন্তু তাতে মুসলমানদের ক্ষতির আশংকা থেকেই যায়, বললেন আরেক অফিসার।
নুরুদ্দিন জঙ্গি বললেন, ‘বন্ধুরা আমার তোমরা যদি ভিতরের মুসলমানদের অবস্থা জানতে তাহলে বলতে তাদের জন্য এখন মরণও ভাল। কারণ, সেখানকার কোন মুসলমানেরই জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু এখন আর নিরাপদ নেই। মুসলমান নারী ও শিশুরা খৃস্টানদের করুণার শিকার।। আর যুবক ও পুরুষেরা তাদের জেলখানায় পড়ে থেকে বেগার হয় আমাদের মুক্ত করো না হয় মৃত্যু দাও।”
মাননীয় সুলতান! একজন কমাণ্ডার আবেগদীপ্ত কণ্ঠে বলল, আমাদের অবরোধ যত দীর্ঘ হবে ততই তাদের দুঃখ দুর্দশা বাড়বে। আমরা যদি অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করি তবে সব মুসলমান পুড়ে যাবে এমন নয়। যদি কেউ মারা যায় তবে জীবন কুরবান করে শাহাদাতের গৌরবে ধন্য হয়েছে। আমরা কেন এই রণাঙ্গণে মরতে এসেছি? এসেছি এ জন্য যে, ইসলামকে জিন্দা রাখতে হলে কিছু জীবন সব সময় কুরবানীর জন্য প্রস্তুত রাখতে হয়। আমি আপনাদের সামনে এই পরামর্শ রাখতে চাই, দুর্গ অধিকারের জন্য কিছু নিরপরাধ মুসলমানের জীবনের ঝুঁকি নিতে হলে আমাদের তাও নেয়া উচিত।
আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করেন না।” এক সেনাপতি বললো, আমরা এখানে এসেছি এখানকার মুসলমানদেরকে জালিমের হাত থেকে রক্ষা করতে। এই ফিলিস্তিন মুসলমানদের আবাসভূমি। এখানেই আমাদের প্রথম কেবলা অবস্থিত। আজ সে কেবলা দুশমনের কজায়। আমরা এখানে আবার দ্বীনের পতাকা উড়াতে চাই। আমাদের প্রথম কেবলাকে খৃস্টান ও ইহুদীদের কবল থেকে মুক্ত করতে চাই। কয়েকটি প্রাণের রিনিময়ে আপনি যদি জাতির এ স্বপ্ন সফল করতে পারেন জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে আপনার কথা স্মরণ করবে এবং আপনার জন্য দোয়া করবে।’
ফিলিস্তিন ইহুদীদের জন্মভূমি, এ দাবী কখনও বরদাশত করার মত নয়। অন্য একজন বললেন, আমরা সবাই তাদের এ দাবী মিথ্যা প্রমাণ করতে জীবন বাজি রেখেছি, প্রয়োজনে আমাদের সন্তানদেরও কুরবানী দিতে প্রস্তুত আছি।
নূরুদিন জঙ্গীর মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো, সে হাসি আনন্দের না বেদনার ঠিক বুঝা গেল না। তিনি বললেন, আমি তোমাদের এ আবেগ ও চেতনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ক্ষমতা ও যুদ্ধের কৌশল। তারা ফিলিস্তিনে তাদের আধিপত্য করেছে। এ জন্য তারা তাদের সব সম্পদ এবং এমনকি তারা কেবল অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ করছে না, তাদের সম্পদ এবং কোমলমতি মেয়েদেরও ব্যবহার করছে আমাদের বিরুদ্ধে।
তারা এই ধন সম্পদ ও মেয়েদের দিয়ে আমাদের দলের মধ্যে গাদ্দার সৃষ্টি করছে। তাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও মিশর। মিশরের বড় বড় শহরে এই সব নির্লজ্জ মেয়েদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বড়ই অনুতাপের বিষয়, মুসলিম নেতৃবৃন্দ, শাসকবর্গ ও ধনী বণিকেরা ইহুদী খৃস্টানদের এই জালে আটকে পড়েছে। তারা আমাদের মধ্যে বিভেদ ও মতপার্থক্য সৃষ্টি করছে। এর পরিণতি কত ভয়াবহ তা ভাবলেও আমার গা শিউরে উঠে। তারা এমন একটি দিনের আশায় কাজ করছে, যখন তাদের আর আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে না, বরং আমরাই ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করে পরম্পর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। অত্যন্ত সুকৌশলে এবং সুক্ষ্মভাবে এ কাজ করছে তারা। আফসোস, আমাদের জাতির কর্ণধার ও প্রভাবশালী লোকজন এ ব্যাপারে উদাসীন। এ উদাসীনতা না কাটলে এ জাতির ধ্বংস ও বরবাদী কেউ ঠেকাতে পারবে না !
যদি আমরা এখনও সজাগ না হই তবে ইহুদীরা একদিন ফিলিস্তিনের মাটি থেকে মুসলমানদেরকে উচ্ছেদ করবে। তাদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে দেবে, ভেড়ার পালের মত হাঁকিয়ে নিয়ে তুলবে উদ্বাস্তু শিবিরে। আর ফিলিস্তিনকে বানিয়ে নেবে নিজেদের মাতৃভূমি। আমাদের প্রথম কেবলা আল আকসা’কে তাদের আস্তাবল বানাবে।
মুসলিম দেশগুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করতে থাকবে। অথচ এ কথা কেউ ভাববে না, এই যুদ্ধের পিছনে রয়েছে ইহুদী ও খৃষ্টানদের গোপন চক্রান্ত।
অর্থ, নারী ও শরাব দিয়ে ওরা যুদ্ধে বিজয়ী হতে চায়। আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের আলোকিত জীবন নিশ্চিত করতে হলে আমাদের বর্তমান প্রজনকে এ লড়াইয়ে জিততেই হবে।
আমি চাই, আকাশে যখন নতুন মাসের চাদ উঠবে তখন যেন সে ক্রাবের দুর্গে আর খৃস্টানের পতাকা দেখতে না পায়।
তার আগেই আমি ক্রাক অধিকার করতে চাই। আমাদের এ অগ্রযাত্রায় যদি দুর্গের পাঁচিল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সে পাঁচিল আমরা গুড়িয়ে দেবো। যদি আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়ায় খৃষ্টান ফৌজ, আমরা লাশের স্তুপ মাড়িয়ে কেল্লায় ইসলামের ফটক খুলে দেবে সে জন্য আমরা আর অপেক্ষা করবো না। প্রয়োজনে ক্রুসেডদের লাশগুলো আমরা ভূমধ্যসাগরে ডুবিয়ে দিয়ে এই মাটিকে পবিত্র করবো। এরপর আমরা নজর দেবো আমরা গাদ্দার ও খৃস্টানদের হাতে ভূলুষ্ঠিত হতে দেবো না।
সুলতান নূরুদ্দিনের সেনাবাহিনীতে ছিল কুশলী অস্ত্র কারিগর। তিনি হুকুম করলেন খেজুরের বড় বড় বৃক্ষ কেটে মেনজানিক তৈরী করো।’
কারিগররা রাতদিন পরিশ্রম করে মেনজানিক তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সৈনিকরা সেই সব মেনজানিক দিয়ে ছুড়ে মারার জন্য ভারী ও বড় বড় পাথর জমা করতে লাগল। তাদের কাছে ছিল সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর রেখে যাওয়া বারুদের স্তুপ। সৈনিকরা সেই বারুদ দিয়ে গোলা তৈরী করতে লাগল।
ইতিমধ্যে মিশর থেকে সুলতান আইয়ুবীর পাঠানো সেনাবাহিনী এসে রিপোর্ট করল নূরুদ্দিন জঙ্গীর কাছে। এই সৈন্যদের সম্পর্কে বলা হয়েছিল এরা সেনাবিদ্রোহের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সুলতান জঙ্গী এদের মধ্যে বিদ্রোহের কোন আলামত দেখতে পেলেন না। বরং তিনি দেখতে পেলেন তাদের চোখে মুখে জেহাদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
সুলতান জঙ্গীও সুলতান আইয়ুবীর মত দুরদশী ও বিচক্ষণ সেনানায়ক ছিলেন। তিনি সৈন্যদের সামনে আরো আবেগময় বক্তব্য দিয়ে তাদের সে আগুনকে আরো উস্কে দিলেন।
সূর্য অস্ত গিয়ে রাত নেমেছে ক্রাকের দুর্গে। ক্রুসেড বাহিনীর সেনানায়করা দুর্গের মধ্যে এক গোপন সম্মেলনে বসেছে। তাদের মধ্যে উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠার কোন ছাপ নেই। খোশ মেজাজে কথা বলছে সবাই। বুঝা যাচ্ছে, এ অবরোধে তাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তাদের এ খুশির কারণ সালাউদ্দিন আইয়ুবি ময়দান ছেড়ে মিশরে চলে গেছে। শুধু সে একাই যায়নি, সেই সাথে তার পুরো বাহিনীও সে মিশর ফেরত নিয়ে গেছে। তার বদলে এখন অবরোধে নেতৃত্ব দিচ্ছে সুলতান নূরুদিন জঙ্গী এবং তার বাহিনীই এখন লড়াই চালাচ্ছে।
আইয়ুবী চলে যাওয়ায় স্বস্তি ও আনন্দ ফিরে আসে দুর্গের অভ্যন্তরে। আইয়ুবী বিদায় নেয়ার পরপরই ক্রুসেড নেতাদের কানে এ সংবাদ পৌছে। দু’তিন দিন পর তাদের কাছে খবর পৌছে, মিশর থেকে একদল নতুন সৈন্য এসেছে। যদিও এখনো তারা ময়দানে নামেনি তবু এই নতুন সৈন্যের আগমনে পরিস্থিতির কোন রকম হেরফের হয় কিনা দেখার বিষয়। এ ব্যাপারে আলোচনার জন্যই এ সভা ডাকা হয়েছে।
সবেমাত্র আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে, হঠাৎ বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো হলঘর। কোথাও বাড়ীঘর ধ্বসে পড়ার মত আওয়াজ হলো। বাইরে থেকে ভেসে এলো শোরগোল।
ক্রুসেড কমাণ্ডাররা সকলেই দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। শহরের ভেতরের দিকে যাচ্ছে। তারা পাঁচিলের দিকে এগিয়ে গেল। পাঁচিল থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক বাড়ির ছাদ ফেটে গেছে। পাঁচিল টপকে একটি ভারী পাথর এসে আঘাত করেছে সে ছাদে। অবশ্য ঘরের দেয়ালে কোন ফাটল ধরেনি।
খৃস্টান সেনাপতি ও সালাররা ঘটনাস্থলে পৌছে জটলা করে ক্ষয়ক্ষতি দেখছিল, অকস্মাৎ তাদের একদম কাছে এসে বিস্ফোরিত হলো আর একটি বড় পাথর। পড়িমরি করে সেখান থেকে পালিয়ে গেল খৃস্টান কমাণ্ডাররা। তারা বুঝতে পারলো, মুসলমানরা বড় ধরনের মেনজানিক দিয়ে পাথর বর্ষণ করছে। তারা নিজ নিজ বাহিনীর কাছে গেল এবং তারা তেমন কিছুই দেখতে পেল না। এটা ছিল সুলতান নূরুদিন জঙ্গীর তৈরী বড় ধরনের নজানিকের পরীক্ষামূলক ব্যবহার। এটা চালানো খুবই কঠিন, তবে দূর পাল্লার অস্ত্র হিসাবে এর জুড়ি মেলা ভার। সমস্যা হতো দড়ি কেটে গেলে তখন দড়ি আবার গিরা দিয়ে বাঁধতে বা নতুন দড়ি লাগাতে হতো। দ্বিতীয় অসুবিধা হতো, আটটি ঘোড়ার প্রচন্ড টানে দড়ি ছিড়ে গেলে ঘোড়াগুলি হুমড়ি খেয়ে পড়তো। এতে ঘোড়াগুলো পায়ে এমন আঘাত পেতো যে তা আর যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হতো না। ঘোড়ার সওয়াররাও আঘাত পেতো।
সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী মধ্য রাত পর্যন্ত এই মেনজানিক নিক্ষেপ অব্যাহত রাখলেন। এতে খৃষ্টানদের হেডকোয়ার্টারের দুটি ছাদ ভেঙ্গে গেল এবং বেশ কয়েকটি ঘরের দেয়াল ফুটো হয়ে গেল।
এই ক্ষতি তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও এতে ক্রুসেডদের সাহস ও মনোবলে যে ফাটল ধরলো তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিল। হেডকোয়ার্টারের দেয়াল ছিদ্র হওয়ায় সেখানকার রক্ষীরা ভয়ে ডিউটি ফেলে পালিয়ে গেলো। সেনা ব্যারাক এবং সমস্ত শহরে বোমা আতংক ছড়িয়ে পড়লো। মধ্যরাতে বোমা নিক্ষেপ বন্ধ হলেও বোমাতঙ্ক বন্ধ হলো না, বরং তা বেড়েই চললো।
মধ্যরাত পর্যন্ত মেনজানিক চালানোর পর হঠাৎ করে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ ছিল মেনজানিক অকেজো হয়ে যাওয়া। পাথর নিক্ষেপের প্রবল চাপ সইতে না পেরে তার একটি অংশ ভেঙ্গে গিয়েছিল। ফলে পাথর দুর্গের মধ্যে পড়ার পরিবর্তে দুর্গের বাইরে পড়তে শুরু করলে সুলতান জঙ্গী পাথর নিক্ষেপ বন্ধ করে দেন। কিন্তু এ পরীক্ষা ব্যর্থ হয়নি। কুশলী কারিগররা এর প্রধান প্রধান ক্রটিগুলো সনাক্ত করে একে ক্রটিমুক্ত করার জন্য উঠে পড়ে লাগল। তারা গবেষণা করতে লাগল, কি করে দড়ি কাটা ছাড়াই পাথর নিক্ষেপ করা যায়।
নুরুদ্দিন জঙ্গি বললেন, ‘তোমরা যাই করো আর সময় নষ্ট না করে জলদি করো ’।
তারা কাজ আরম্ভ করে দিল।
যারা তীর ধনুক বানাতে পারদশী নূরুদ্দিন জঙ্গী তাদের বললেন তোমরা দূর নিক্ষেপযোগ্য ধনুক তৈরি করো।’
তিনি কমান্ডারদের নির্দেশ দিলেন তোমরা গায়ে গতরে শক্ত পোক্ত জওয়ানদের বাছাই করে পৃথক করো, যারা বিরাট ধনুক দিয়ে তীর নিক্ষেপ করতে পারবে।’
সাদিয়ার গ্রামের বাইরে যেখানে সে বকরী ও উট কাটাতো, সেই নির্জন প্রান্তর এখন একেবারে অন্য রকম। সারাটা সময় লোকজনে গমগম করছে। রাতে এমন রহস্যময় আলো-আঁধারীর খেলা শুরু হয় যা দেখে সেখানকার বাসিন্দারা হতবাক হয়ে যায়। তাদের মনে হয়, এসব কিছু এই মাটির পৃথিবীর নয়, সব আকাশ থেকে অবতীর্ণ হচ্ছে।
দিন কেটে রাত এল। অমানিশার ঘোর অন্ধকার ভরা রাত। অন্ধকার ভাল করে জেকে বসার পর মানুষকে টিলার মধ্যে নির্দিষ্ট অঞ্চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো। এ অঞ্চল পীরের তাবু থেকে সামান্য দূরে।
এ অঞ্চলও ভাল করে ঘেরাও দেয়া। তাদেরকে সেখানে বসার আদেশ দেয়া হল তবে কাউকেই পীরের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো না। বসার পর সেখান থেকে কারো উঠে যাওয়ারও কোন অনুমতি ছিল না।
সবাইকে বলা হলো চুপ করতে, আরো বলা হলো, তিনি যদি কারো ক্রটির জন্য সামান্য অসন্তুষ্ট হন তবে সকলের উপরেই গজব নাজিল হবে।’
লোকজন আদবের সাথে বসে গেল সেখানে। তাদের সামনে সুন্দর করে মঞ্চ সাজানো। মঞ্চের ওপর মখমলের গালিচা, পিছনে লম্বা পর্দা টাঙ্গানো | পর্দার ওপরে সোনালী রংয়ের তারকা চমকাচ্ছে। মশাল ও মোমবাতির আলোয় ওগুলি যেন চমকায় সে জন্য বিশেষ ভাবে তা সাজানো হয়েছে।
পর্দার পিছনে সমান্তরাল জায়গায় অচেনা লোকেরা গর্ত খুড়েছিল। টিলার পিছনে কিছুটা জায়গা সমান, সেখানে রংবেরংয়ের নানা আকৃতির তাবু টানানো। দর্শকদের মধ্যে এমন ভাব গাম্ভীর্য বিরাজ করছিল যে, কেউ কারো সাথে কানাঘুষা করতেও ভয় পাচ্ছিল।
যে রাতে সাদিয়া নিখোজ হয়েছিল এটা তার পরের রাত। সামনের পর্দা ধীরে ধীরে নড়ে উঠলো। পর্দার তারাগুলো আকাশের তারকার মত চমকাচ্ছিল। এমন মৃদু ও মোহন সুরে বাজনা বেজে উঠল, যে মধুর সুরের সাথে কারো পরিচয় ছিল না। কেউ এ সুরের নাম জানে না এবং এমন সম্মোহনী সুর তারা কেউ কোনদিন শোনেওনি। এ সুরের গুঞ্জনে ছিল যাদুর প্রভাব। মরুভূমির নিঝুম রাতে এই মিহি সুরের প্রভাব বড়ই মর্মস্পশী ও অন্তরভেদী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এই সুরের ঢেউ শ্রোতাদের ওপর দিয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে।
দর্শকরা মঞ্চে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না, শুধু শুনতে পাচ্ছে হৃদয় পাগল করা অলৌকিক সুর। দর্শকবৃন্দ বার বার এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে, কখনোবা অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে, কোথেকে ভেসে আসছে এই সুর। কিন্তু তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
বাজনার সাথে এবার যুক্ত হলো আরেক ধরনের শব্দ। মনে হচ্ছে অসংখ্য লোক মিলিত কষ্ঠে একই সুর গুণ গুণ করছে। এর মধ্যে মেয়েদের কণ্ঠও শোনা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে সেই শব্দ জোরালো হলো। সেই সাথে দুলতে শুরু করল সামনে রহস্যময় মঞ্চের বড় পর্দা।
উপস্থিত দর্শকরা এই বিশ্ব সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ঘর, সংসার, সমাজ, সভ্যতা সবকিছুর কথা ভুলে গিয়ে তারা এখন এক ধ্যানে, এক মনে নিরব নিস্তব্ধ আকাশের তলে অপূর্ব সম্মোহনী পরিবেশে,তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল সেই দোলায়মান পর্দার দিকে, যেখানে আকাশের তারার মতই শোভা পাচ্ছিল ঝিকিমিকি তারার মেলা।
সমস্ত মানুষ মন্ত্ৰমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। সহসা কোথা থেকে যেন গুঞ্জন উঠলো, তিনি আসছেন, যাকে আল্লাহ আকাশ থেকে পাঠিয়েছেন তিনি আসছেন! তিনি তোমাদের অন্তরে ও মগজে খোদার সত্য বাণী নাজিল করবেন।
মঞ্চের পর্দা সরিয়ে ভেতর থেকে একজন মানুষ এগিয়ে এলো মঞ্চে। সে একজন রক্ত মাংশের মানুষ হলেও এই তাকে মনে হলো অন্য কোন অপার্থিব জগতের বাসিন্দা। তার মাথায় হালকা সোনালী রংয়ের লম্বা চুল। সে চুল তার কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। মুখমণ্ডল গোলগাল, নিটোল ও সজীব। চেহারায় দুধে-আলতা রঙ মেশানো। দাড়ি পরিপাটি করে ছাটা এবং আঁচড়ানো। দাড়ির রঙও চুলের মত সোনালী।
লোকটা বেশি লম্বাও না, খাটােও না, মাঝারি আকৃতির। গায়ে সবুজ রংয়ের মাঝে সোনালী জরির আলখেল্লা। মশালের আলোয় সে জরির নকশা চমকাচ্ছিল। তার চোখে ছিল অন্তভেদী দৃষ্টি। আপাদমস্তক তিনি এমন আকর্ষণীয় ছিলেন যে, দর্শকদের তাক লেগে গেল।
বাজনার তালে তালে মানুষের গুণ গুণ ধ্বনি অপূর্ব মোহময় আবেশ তৈরী করল। তিনি এতকাল তার অপূর্ব মোজেজার কাহিনী প্রচার করে মানুষকে আগে থেকেই বিমোহিত করে রেখেছিলেন, এবার উপস্থিত জনতার চিন্তা চেতনায় শিহরণ তুলে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। দর্শকরা তাকে দেখে প্রথমে মাথা নত করল এবং মজলিশের আদব অনুযায়ী পেটের ওপর হাত রেখে এমন ভাবে দাঁড়ালো যেন নামাজে দাঁড়িয়েছে।
সেই রহস্যময় লোক পর্দার সামনে এসে দাড়িয়ে হাত তুলে বললো, তোমাদের ওপর সেই খোদার রহমত বর্ষিত তোমাদেরকে চোখ দিয়েছেন দেখার জন্য, কান দিয়েছেন শোনার জন্য। তিনি তোমাদের বুদ্ধি দিয়েছেন যাতে তোমরা চিন্তা করতে পারো, জবান দিয়েছেন যাতে কথা বলতে পারো। কিন্তু তোমাদের মতই একদল মানুষ যাদের চোখ আছে, কান আছে, তোমাদের মত করে তারা কথাও বলে, অথচ তারা তোমাদেরকে গোলাম বানিয়ে খোদার নেয়ামত থেকে, দুনিয়ার আরাম আয়েশ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে।
এখন তোমাদের অবস্থা এমন, তোমাদের চোখ আছে কিন্তু তোমরা কিছুই দেখতে পাও না। তোমাদের কান আছে কিন্তু সত্য কথা শুনতে পাও না। তোমাদের মাথায় বুদ্ধি আছে কিন্তু চিন্তা করো না বলে সেখানে সন্দেহ ও মিথ্যা ধারণা বাসা বেঁধে আছে। তোমাদের জিহবা কথা বলতে পারে কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে তোমরা একটি কথাও বলতে পারো না, যারা তোমাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছে।
তারা তোমাদের ঘোড়া, উট এমনকি তোমাদের যুবক ছেলেগুলোকে কিনে নিয়েছে। তারা তোমাদের সন্তানদের দিয়ে এমন ভাবে যুদ্ধ করায় যেমন কুকুরেরা লড়াই করে। তাদের লাশগুলো মরুভূমিতে ফেলে রাখে যেন লাশগুলো শেয়াল, কুকুর ও শকুনে খেয়ে যেতে পারে।
আমি সেই চোখ নিয়ে এসেছি, যে চোখ ভবিষ্যতের দৃশ্য দেখতে পারে আর মানুষের মনে কি আছে সে কথা শুনতে পারে। আর আমার যে কান আছে সে কান খোদার আওয়াজও শুনতে পায়। আমি আমার বুদ্ধি বিবেক দিয়ে শুধু মানব জাতির কল্যাণ ও মঙ্গলই চিন্তা করি। আমি মানুষকে শোনাই খোদার পায়গাম, খোদার কণ্ঠের ধ্বনিই প্রতিধ্বনি করি আমি |
তুমি কি অবিনশ্বর, তোমার কি মৃত্যু নেই? দর্শকদের মধ্যে থেকে কেউ একজন ভরাট গলায় প্রশ্ন করলো। মুহূর্ত কালের জন্য খামোশ হয়ে গেলেন পীর সাহেব। এমন ভাব করলেন, যেন, কেউ তার সাথে এ ধরনের বেয়াদবী করতে পারে, এ কথা তিনি কল্পনাও করেননি। লোকজনও খামোশ মেরে গেল। সবাই চুপচাপ, ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। এই বেয়াদবীর পরিণামে কি ধরনের গজব নেমে আসতে পারে তাদের ওপর এ চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ল লোকজন।
পীর সাহেব ধাতস্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি পরীক্ষা করে নাও! আমার বুকে তীর মারো, দেখো সে তীর আমার বুকে বিদ্ধ হয় কিনা?
তার কথা বলার ভঙ্গিতে দৃঢ় প্রত্যয় ও এমন এক বলিষ্ঠতা ছিল, লোকজনের মধ্যে তা যাদুর মত প্রভাব ফেলল। পীর সাহেব আবার বললেন, ‘এখানে কোন তীরন্দাজ আছে? থাকলে আমার বুকে তীর চালাও।
ভীড়ের মধ্যে নিরবতা আরও বেড়ে গেল। পীর সাহেব আরও বলিষ্ঠ ও রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি আদেশ দিচ্ছি, কারো কাছে তীর থাকলে সে যেন সামনে আসে ও তীর চালায়।”
দর্শকদের মধ্য থেকে চারজন অচেনা তীরন্দাজ উঠে দাঁড়াল এবং মঞ্চের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে এল। এরা কেউ সাদিয়ার গ্রামের লোক নয়। লোকজন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল।