হারজাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি জায়গা। চারদিকে সবুজের সমারোহ। বালিয়াড়ির পরিবর্তে মাঠ জুড়ে আদিগন্ত সবুজ। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিছু পাহাড় আছে, পাহাড়গুলোও সবুজে ঢাকা।
পাহাড় থেকে নেমে এসেছে সুপেয় পানির ঝরনা। পাহাড়ের পাদদেশে বৃক্ষরাজিতে ভরা প্রান্তর। সবুজে ঢাকা পাহাড়ী অঞ্চলের পাশেই মনোরম ও অভিজাত জনবসতি।
আল্লাহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরে দিয়েছিলেন হারজাম অঞ্চলটি। আরমেনিয়ার শাহ একে আরও সুশোভিত করে গড়ে তুলেছিলেন। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তুলেছিলেন সুরম্য ও নিরাপদ বাগানবাড়ি।
মহলের সামনে খোলা চত্বরে সামিয়ানা টানিয়ে ইয়াজউদ্দিনকে অভ্যর্থনার আয়োজন করছেন শাহ আরমান। সামিয়ানার ওপর দেয়া হয়েছে মোটা ত্রিপলের কাপড়, যাতে রোদ ও বৃষ্টিতে সবাই নিরাপদ থাকতে পারে। সেখানে রঙিন ঝাড়বাতি দিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মহলের সামনে ছয়টি ঘোড়ার গাড়ীতে সুসজ্জিত রাজকীয় রক্ষী বাহিনী অবস্থান নিয়েছে ইয়াজউদ্দিনকে গার্ড অব অনার দেয়ার জন্য। তাদের পেছনে পদাতিক ও অশ্বারোহী দল। চারদিকে সাজ সাজ রব। সত্যি এক বর্ণাঢ্য আয়োজন।
মহলের ভেতরের অবস্থা আরো মনোরম। নাচ গান ও বাজনার জন্য নামী দামী শিল্পীদের এনে জড়ো করা হয়েছে মহলে। আরমেনিয়ার শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ও নর্তকীদের পদচারণায় মুখর মহলের জলসাঘর। হেরেমের বাছাই করা সুন্দরী দাসীদের রাখা হয়েছে পৃথক কামরায়।
আরমেনিয়ার শাহ ইয়াজউদ্দিনকে ছাড়াও এখানে দাওয়াত দিয়েছে মারবীনের আমীরকে। মারবীন হারজামের পার্শ্ববর্তী একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল। এর আমীর কুতুবুদ্দিন গাজী। মেহমানদের জন্য টানানো সুন্দর সামিয়ানা থেকে সামান্য দূরে পাহাড়ের সবুজ ঢালে অবস্থান নিয়েছে শাহ আরমানের দুই ডিভিশন সৈন্য।
ইয়াজউদ্দিন তখনো এসে পৌঁছেননি। শাহ আরমান মারবীনের আমীর কুতুবুদ্দিন গাজীর সাথে দু’তিন দিন শিকার করে কাটালেন। একদিন তিনি খবর পেলেন মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিন হারজামের সীমানায় প্রবেশ করেছেন।
মহলের বাইরে গিয়ে আরমেনিয়ার শাহ এবং মারবীনের আমীর কুতুবুদ্দিন গাজী ইয়াজউদ্দিনকে অভ্যর্থনা জানালেন। আরমেনিয়ার সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করলো। তিনি নিজের সঙ্গে আনা তিন ডিভিশন সৈন্য বাইরে রেখে মহলে প্রবেশ করলেন।
রাতে সম্মানিত অতিথিবৃন্দের সম্মানে জমজমাট নাচ ও গানের জলসার আয়োজন করা হলো। দেশের শ্রেষ্ঠ সরোদবাদক ওস্তাদ জামশেদের আগের দিন আর নেই। বয়সের ভারে কাবু হয়ে গেছেন। তবু তিনি এলেন এবং অতিথিদের মোহিত করলেন নিজের সরোদ বাজিয়ে।
রাত বাড়তে লাগলো। একে একে শূন্য হতে লাগলো মদের পাত্রগুলো। উর্বশী মেয়েরা বাজনার তালে তালে নেচে চললো। যুবতী মেয়েরা মেহমানদের হাতে তুলে দিতে লাগলো মদের পেয়ালা।
ইসলাম মদকে হারাম করেছে, পরনারীর সাথে মেলামেশা নিষিদ্ধ করেছে। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার কোন অবকাশ নেই ইসলামে। কিন্তু এখানে সবই চলছিল। অথচ এরা শুধু মুসলমানই নয়, মুসলিম সমাজের নেতা।
নারী ও মদ তাদেরকে ভিন্ন এক দুনিয়ায় নিয়ে গেল। নিজের ঈমান ও আকীদার কথা ভুলে গেল ওরা। ভুলে গেল ওরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম নবীর উম্মত, শ্রেষ্ঠতম জাতি। ভুলে গেল তারা দুনিয়ায় এসেছে কেবল ভোগের জন্য নয়, এসেছে দুনিয়াকে আবাদ করতে, দুনিয়াকে মানুষের বাসযোগ্য করতে। এভাবেই তারা তাদের শরীর থেকে মুসলমানিত্বের নাম নিশানা তুলে দিচ্ছিল।
রাতটি তাদের খুব আনন্দ ফুর্তিতেই কেটে গেল। পরের দিন বলতে গেলে তারা সারাদিনই ঘুমিয়ে কাটালো।
যে রাতে তারা মদ ও নারী নিয়ে রঙিন ঝাড়বাতির নিচে মাতাল অবস্থায় মত্ত ছিল, সে রাতে সুলতান আইয়ুবী সেখান থেকে দুই আড়াই মাইল দূরে এক পাহাড়ের আড়ালে তাঁর কমাণ্ডো বাহিনী নিয়ে পাথরযুক্ত মাটিতে শুয়ে ছিলেন।
তিনি ছোট ছাতার মত তাঁবু সাথে এনেছিলেন যেন সেগুলো অল্প সময়ে টানানো যায় ও উঠানো যায়। তিনি সেখানে সুলতান নয় কমাণ্ডো বাহিনীর এক কমাণ্ডার হয়ে এসেছিলেন।
পরদিন ভোরে যখন ক্লান্ত মেহমানরা ঘুমোতে গেল তখন তিনি তার গোয়েন্দাদের বললেন, ‘ওদিকের খবর জানা দরকার, তারা এখন কি করছে?’
সুলতানের গোয়েন্দা বাহিনীর কমাণ্ডার কয়েকজনকে পাঠিয়ে দিলেন সেই রাজকীয় প্রমোদ ভবনের খবর সংগ্রহ করতে। গোয়েন্দারা সঙ্গে সঙ্গে মরু যাযাবরের ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়লো। তাদের বলা হলো, প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য নিয়ে তারপর ফিরে আসবে।’
এই গোয়েন্দা দলের মধ্যে ফাহাদও ছিল। সে ছিন্ন মলিন কাপড় পরে শাহ আরমানের সেনা ক্যাম্পের কাছে পৌঁছে গেল। তার সঙ্গীরাও কেউ রাখালের বেশে, কেউ ব্যবসায়ীর বেশে পৌঁছে গেল সেখানে। স্থানীয় লোকদের সাথে মিশে অনায়াসে তারা সেখানে ঘুরাঘুরি করতে লাগলো। সৈন্যরা তাদেরকে সেখান থেকে চলে যেতে বললে দুই গোয়েন্দা ভিক্ষুকের বেশে তাদের কাছে হাত বাড়িয়ে ভিক্ষা চাইতে লাগলো।
ফাহাদ মহলের বাইরে আগন্তুক মেহমানদের সফরসঙ্গী ও রাজকর্মচারীদের থাকার জন্য যে সামিয়ানা ও তাঁবু টানানো হয়েছিল সেখানে গেল। সে ইয়াজউদ্দিনের সাথে আসা কর্মচারীদের মধ্যে তাদের কোন গোয়েন্দা আছে কিনা জানতে চাচ্ছিল। এমন সময় সে দেখতে পেলো, রাজিয়া খাতুনের পাঠানো খবর সুলতানকে পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ নিয়ে যে খাদেমা মুশেলে তার সাথে দেখা করেছিল সেই মেয়ে এক তাঁবু থেকে বেরিয়ে আরেক তাঁবুর দিকে হেঁটে যাচ্ছে।
মেয়েটিকে দেখেই চিনতে পারলো ফাহাদ। সঙ্গে সঙ্গে তার মন্তরে খুশির ঝর্ণা বয়ে গেল। এই মেয়ে ছিল ইয়াজউদ্দিনের খুবই বিশ্বস্ত ও পছন্দনীয় দাসী। তাই তিনি তাকে তার এ সফরেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।
ফাহাদ ভিক্ষুকের মত শব্দ করে এর ওর কাছে ভিক্ষা চাইতে লাগলো। তার চোখ ছিল সেই মেয়েটির দিকে এবং এক সময় তার কাছে গিয়ে বললো, ‘শাহজাদী! আল্লাহ আপনার মঙ্গল করবেন। দয়া করে মুসাফিরকে কিছু খাবার দেবেন?’
‘ভাগো এখান থেকে। আমরাই এখানে মেহমান, তোমাকে খাবার দেবো কোথেকে?’
‘দয়া করুন শাহজাদী, আমি তো আপনার এক গোলাম। আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেবেন না। আপনার দয়ার শরীর, আপনার কাছ থেকে আমি কি খালি হাতে ফিরতে পারি?’
‘বেশী বাড়াবাড়ি করলে তোমাকে সৈন্যদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হবো। যাও এখান থেকে, নইলে সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দেবো।’
“ফাহাদকে মুশেলেও কেউ ধরতে পারেনি, তুমি এখানে তাকে ধরিয়ে দেবে?’ ফাহাদ তার আসল কণ্ঠস্বরে কথা বললো এবার।
“ওহ!’ মেয়েটি চমকে এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললো, ‘তাহলে তুমি চলে এসেছে! দেখো, আমার সংবাদ তো মিথ্যে হয়নি। কিন্তু তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। জলদি সরে পড়ো এখান থেকে। রাতে তুমি কোথায় থাকবে? রাতে আমি তাড়াতাড়ি মাহফিল থেকে বিদায় নিয়ে তোমার কাছে চলে যাবো। তখন অনেক কথা বলতে পারবো তোমার সাথে। এখন যাও, নইলে বিপদে পড়ে যাবে!’ মেয়েটি সতর্ক কণ্ঠে তাকে চলে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল।
‘তুমিই তো বলেছিলে দায়িত্বের উপর আবেগকে প্রশ্রয় দিও না।’ ফাহাদ বললো, ‘আমি এখন ডিউটিতে আছি। রাতে কখন কোথায় থাকবো আমি নিজেও জানি না। যদি বেঁচে থাকি আবার দেখা হবে। সময় মতো আমিই তোমাকে খুঁজে নেবো।’
‘ঠিক আছে, নতুন কোন খবর পেলে তোমার জন্য জমা করে রাখবো।’ মেয়েটি প্রশ্ন করলো, ‘সুলতান এখন কোথায়?’
‘সুলতান সময় মত হাজির হয়ে যাবে। তুমি চোখ কান খোলা রেখো।’
মেয়েটি আস্তে বললো, “ঠিক আছে।’ তারপর গলা চড়িয়ে বললো, ‘এখানে কি তোমার জন্য লংকরখানা খোলা হয়েছে। নাকি? যাও ভাগো এখান থেকে। যত্তোসব। বেড়াতে এসেও এই ভিক্ষুকদের যন্ত্রণায় একটু শান্তিতে থাকার উপায় নেই।’
মেয়েটি ফাহাদকে তিরস্কার করতে শুরু করলে ফাহাদ সেখানে আর না দাঁড়িয়ে একদিকে হাঁটা ধরলো। মেয়েটি গজর গজর করতে করতে ঢুকে গেল এক তাঁবুতে।
তাঁবুতে ঢুকে মেয়েটি পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইলো ফাহাদের গমন পথের দিকে। তার চোখ দুটি পানিতে ভরে গেল। হায়, কি কঠিন দায়িত্ব ফাহাদের! কত কষ্টকর কাজ! পদে পদে বিপদ। ভয়ংকর মৃত্যুর হাতছানি চারদিকে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। বিরাট দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে পথে পথে ঘুরে মরছে।
মেয়েটি এই সুদর্শন ও স্বাস্থ্যবান যুবককে মনে প্রাণে ভালবাসে। কিন্তু সে যখন লুকিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করে তখন সে তার আবেগকে কখনোই প্রকাশ করতে পারে না। সে তখন তার দায়িত্বের বিষয় নিয়েই তার সাথে কথা বলে।
সুলতানের সৈন্যরা যেসব যুদ্ধে সফলতা লাভ করে তার বিজয়ের মূলে আছে ফাহাদ ও এই মেয়েটির মত গোয়েন্দাদের সীমাহীন ত্যাগ। এরা শত্রুর দুর্গে বসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করে যায় অনবরত। এদের জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি সর্বদা দাঁড়িয়ে থাকে। সব জেনে বুঝেও যারা এই কঠিন জীবন বেছে নেয় প্রকৃত মুজাহিদ তো তারাই।
মেয়েটি মনে মনে বলছিল, যদি এ দায়িত্ব ঈমানী দায়িত্ব না হতো তবে আমি ফাহাদকে এভাবে ভবঘুরের মত বিপদ মাথায় নিয়ে ঘুরতে দিতাম না। হয়তো দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ফাহাদের রাত কাটবে পাথরে মাথা রেখে উন্মুক্ত আকাশের নিচে। যদি দুনিয়ায় তাকে না পাই আমি কাল হাশরের মাঠে আল্লাহকে বলবো, আল্লাহ আমি তাকে ভালবাসি। দুনিয়ায় তাকে আমি পাইনি খোদা, এখন তাকে আমি চাই।’
ফাহাদ দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। মেয়েটি তাঁবুর পর্দা ছেড়ে ভেতরে মাথা নিল।
রাতের প্রথম প্রহর। আজ রাতে হারজামের শাহী ক্যাম্পে কোন গান বাজনার আয়োজন করা হয়নি। শাহ আরমান, ইয়াজউদ্দিন এবং মারবীনের আমীর কুতুবুদ্দিন গাজী মুখোমুখি বসেছিলেন।
সবার চেহারায় চিন্তার রেখা। ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তার রাজ্য সীমা ক্রমান্বয়ে বাড়িয়েই চলেছে। দিন দিন তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছে। এ অবস্থায় আমরা চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না। তার সাথে আমাদের যে কোন একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতেই হবে। হয় তার বন্ধু হতে হবে, নয়তো শত্রু। এখন কোন পথ আমরা বেছে নেবো তাই আমাদের ঠিক করতে হবে।’
‘যদি আমরা তাঁর সাথে যুক্ত হই তিনি আমাদেরকে তার অধীনস্ত বানিয়ে নেবেন।’ বললো শাহ আরমান, “আমরা তখন আর স্বাধীন শাসক থাকতে পারবো না।’
‘আমিও সে কথাই বলি।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘বর্তমানে তিনি মুসলমানদের কয়েকটি কেল্লা দখল করে সেখানে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার সামরিক শক্তিতে ভীত হয়ে সে সব কেল্লার অধিপতিরা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। যদি আমরা তাকে বাঁধা না দেই তবে তিনি শুধু মশেলের উপর নয় হলবের উপরও আধিপত্য বিস্তার করতে চেষ্টা করবেন।’
‘এ কথা আপনি বলবেন কেন, তিনি নিজেই তো সে ঘোষণা দিয়ে বসে আছেন। আমার গোয়েন্দারা জানিয়েছে, তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিন অভিযানে যারা আমার সহযোগী হবে না তাদের আমি স্বাধীন থাকতে দেবো না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ও কেল্লা দখল করে তিনি তার ঘোষণার বাস্তবায়ন শুরু করেছেন।’ চিন্তিত মুখে বললেন শাহ আরমান।
‘সে ক্ষেত্রে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়া কোন গতি নেই। কিন্তু আমি একা তার বিরুদ্ধে লড়ে সফল হতে পারবো না। আমাদের কারোরই এমন শক্তি নেই যে, একা একা তার মোকাবেলা করবো।
ইমাদুদ্দিন আমার সাথে আছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তার বাহিনী হলব ত্যাগ করতে পারছে না। কারণ সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তার সৈন্য বাহিনীকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছেন। যে কোন মুহূর্তে তিনি ইমাদুদ্দিনের বাহিনীর ওপর চড়াও হয়ে যেতে পারেন। কারণ হলব তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এ জন্যই হলবের বাহিনীর বাইরে বের হওয়া ঠিক হবে না। হলবের প্রতিরক্ষার দিকেই তাদের বিশেষ নজর রাখতে হচ্ছে।’
‘তা আমি জানি।’ শাহ আরমান বললেন, ‘খৃস্টানদের দৃষ্টিও হলবেই পড়ে আছে। হলব সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। আইয়ুবী বলুন আর খৃস্টান বলুন, সবারই দৃষ্টি এখন হলবের দিকে।’
‘সে কারণেই আমি প্রকাশ্যে খৃষ্টানদের সাথে কোন চুক্তি বা জোট করতে ভয় পাই।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘তারা যদি আমাকে সাহায্য করে তার বিনিময়ে তারা চাইবে, আমি যেন হলব অধিকারে তাদের সহযোগী হই।’
‘হ্যাঁ, এটা তারা অবশ্যই চাইবে।’ কুতুবুদ্দিন গাজী বললেন, ‘আমি সবচেয়ে উত্তম মনে করি, আমাদের নিজেদের মধ্যে একটা চুক্তি সম্পাদন করা। আমার বিশ্বাস, আপনাদের দুজনের সৈন্য মিলিত হলে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে পরাজিত করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে আমিও আমার ক্ষুদ্র শক্তি আপনাদের সাথে জুড়ে দিতে প্রস্তুত।’
‘আমি জানতে পেরেছি, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বাহিনী আল খালিদের দিকে যাত্রা করেছে। ফলে আমাদের মধ্যে শাহ আরমানই এখন সবচেয়ে বিপদ ও ঝুঁকির মধ্যে আছেন।’ ইয়াজউদ্দিন শাহ আরমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি কি জানেন এ খবর?’
বিচলিত শাহ আরমান বললেন, ‘আমার তো তার সাথে কোন শক্রতা নেই। তিনি কেন আমাকে আক্রমণ করতে যাবেন?’
শাহ আরমান আরো বললেন, ‘আমার ধারণা তিনি আমার সীমানা থেকে দূরে থাকবেন। হয়তো তাঁর অভিযানের লক্ষ্য অন্য কোথাও, দুশমনকে বিভ্রান্ত করার জন্যই তিনি আল খালিদের দিকে যাচ্ছেন। হয়তো তার টার্গেট খৃস্টান বাহিনী। আমার রাজ্যের পাশে তারা শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। হয়তো সে খবর পেয়েই তিনি সেদিকে তার বাহিনী ছুটিয়েছেন। আপনি বিষয়টি খৃষ্টানদের জানাননি?’
“না, খৃষ্টানদের প্রতি আমার কোন বিশ্বাস নেই।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘তারা আমাকে সর্বপ্রকার সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। সেই সাহায্য তারা দিচ্ছেও। কিন্তু তাদের নিয়ত আমার কাছে পরিষ্কার নয়।
তারা সমরাস্ত্র ও উপদেষ্টা দিতে আমাকে কার্পণ্য করেনি। কিন্তু আমি যখন তাদের বললাম, আপনারা দামেশক ও বাগদাদে অভিযান চালিয়ে শহর দুটো দখল করে নিন, কারণ সুলতান এখন সেই শহর দুটো থেকে অনেক দূরে। আর তার কাছে এ দুটো শহর হচ্ছে তার হৃদপিণ্ড। আপনারা এ দুটো দখল করলে তার হৃদপিণ্ড আপনাতেই স্তব্ধ হয়ে যাবে।’
‘তারা আমার প্রস্তাব গ্রহণ না করে বললো, যদি আইয়ুবী তা উদ্ধার করতে ছুটে আসে? কারণ আমরা যেমন জানি, তিনিও তেমন জানেন দামেশক ও বাগদাদ তার হৃদপিণ্ড। তিনি কিছুতেই তা হারাতে চাইবেন না। জেনেশুনে কেন আমরা সাপের লেজে পা রাখতে যাবো।’
আমি বললাম, ‘সালাহউদ্দিনকে আমরা সে সুযোগ দেবো না। তিনি রওনা হওয়ার সাথে সাথে আমার এবং হলবের বাহিনী তার ওপর কমাণ্ডো অভিযান চালিয়ে তাকে অকেজো করে দেবো। তিনি যখন আপনাদের কাছে গিয়ে পৌঁছবেন তখন দেখবেন তার হাত-পা সবই পঙ্গু হয়ে গেছে। তার চোখের আক্রোশ ছাড়া আর কিছুই আপনাদের আঘাত করতে পারবে না। কিন্তু তারা তাতে রাজি হলো না। আমি বুঝে পাই না, আইয়ুবীকে পরাজিত করার এমন একটা মওকা তারা কেন গ্রহণ করলো না।’
“তারা আপনার পরামর্শ গ্রহণ করলে আইয়ুবী আমাদের রেখে তাদের দিকেই ধাবিত হবে, এই সহজ কথাটা তাদের না বুঝার কথা নয়। তারা দামেশক ও বাগদাদের দিকে অভিযান চালালে বাধ্য হয়েই আইয়ুবীকে আমাদের এলাকা ছাড়তে হবে। কিন্তু খৃস্টানরা তা চায় না। তারা চায় আইয়ুবীর সাথে লড়াইটা যেন আমরাই করি। তাহলে আইয়ুবীর সাথে আমাদেরও শক্তি ক্ষয় হবে।’ শাহ আরমান বললেন।
‘তারা আমাদের সকলকেই অধীনস্ত করতে চায়।’ কুতুবুদ্দিন গাজী বললেন, ‘সুলতান আইয়ুবী যদি না থাকতো এতদিনে তারা আমাদের সবাইকে গিলে ফেলতো। আমি আমীর ইয়াজউদ্দিনের সাথে একমত, তাদের ওপর নির্ভর করা আমাদের কখনো উচিত হবে না।’
‘এ জন্যই আমি বলি, আপনারা আমাকে সাহায্য করুন।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘আমি অগ্রসর হয়ে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে যুদ্ধ শুরু করলে আপনারা তার ওপর পিছন থেকে আক্রমণ চালান।’
এই নিয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা হলো। শেষে শাহ আরমান শর্ত আরোপ করলেন, তার সৈন্য ও ঘোড়াগুলোর আহার ও যত্নের দায়িত্ব ইয়াজউদ্দিনকে নিতে হবে।
ইয়াজউদ্দিন এই শর্ত মেনে নিলেন। সিদ্ধান্ত হলো, ইয়াজউদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর সামনা সামনি যুদ্ধ করবেন, শাহ আরমানের বাহিনী পিছন থেকে আক্রমণ চালাবেন সুলতান আইয়ুবীর উপর।
ইয়াজউদ্দিন একজন দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধা। তিনি বৈঠক শেষ করে সেই রাতেই যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে বসলেন। শাহ আরমানও বসলেন তার সাথে। দুই যুদ্ধবাজ তখনো আইয়ুবীকে পরাজিত করার পরিকল্পনা করছেন। রাত তখন প্রায় অর্ধেক পার হয়ে গেছে।
মধ্য রাতের একটু পর। ইয়াজউদ্দিন ও শাহ আরমান যুদ্ধের পরিকল্পনায় ব্যস্ত, হঠাৎ অশ্ব পদধ্বনিতে রাতের প্রহর কেঁপে উঠলো। শাহ আরমান প্রহরীকে ডেকে রাগের সাথে বললেন, ‘এখন যে আরোহী ঘোড়া খুলে পালাচ্ছে সকালে তাদের এখানে ধরে নিয়ে আসবে। আমি বেটাদের শুলে চড়াবো।’
কিন্তু ঘোড়ার এ আরোহীরা তার সৈন্য ছিল না। এরা ছিল সুলতান আইয়ুবীর কমাণ্ডো বাহিনীর অশ্বারোহী দল। সংখ্যায় মাত্র চল্লিশ পঞ্চাশজন।
এটা ছিল তাদের রাতের দুর্ধর্ষ এক অতর্কিত আক্রমণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই মহলের বাইরে সেনা ছাউনিতে কিয়ামত সৃষ্টি হয়ে গেল। সুলতানের কমাণ্ডো বাহিনী দুই দলে বিভক্ত হয়ে ঝড়ের মত ওদের তাঁবুগুলোর এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে গেল। তাদের হাতে ছিল জ্বলন্ত মশাল। তারা সেখানে সৈন্যদের তাঁবুগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিল। মুহূর্তে জ্বলে উঠলো ঘুমন্ত সৈন্যদের তাঁবুগুলো।
আগুনের উত্তাপ, ঘোড়ার খুরের দাপাদাপি, সঙ্গীদের হাক ডাক ও চিৎকারে ঘুমন্ত সৈন্যরা হুড়মুড় করে উঠে বসলো। তারা ভয়, আতংক ও প্রাণের মায়ায় আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য পড়িমরি করে বের হলো তাঁবুগুলো থেকে। হাতিয়ার হাতে নেয়ার কোন অবকাশই পেলো না তারা।
এ সময়ই এলো দ্বিতীয় আঘাত। আইয়ুবীর অশ্বারোহীদের দ্বিতীয় দলটি বর্শা ও তলোয়ার নিয়ে তরঙ্গের মত ছুটে এলো হতবিহবল সৈন্যদের দিকে। সামনে যাকে পেলো তাকেই শুইয়ে দিল চিরদিনের মত। কেউ লুটিয়ে পড়লো কমাণ্ডোদের তলোয়ারের আঘাতে, কেউ বর্শায় বিদ্ধ হয়ে।
ঝড়ের মত এসে ঝড়ের বেগেই আবার তারা চলে গেল। এরপর শুরু হলো জ্বলন্ত তাঁবুর আলোয় ছুটে বেড়ানোে সৈন্যদের লক্ষ্য করে তীর বর্ষণ। এই তীরের মধ্যে সলতেওয়ালা জ্বলন্ত তীরও ছিল।
আরেক দল কমাণ্ডো গেল আস্তাবলের দিকে। তারা বাঁধা ঘোড়া ও উটগুলোর রশি আলগা করে আগুন লাগিয়ে দিল আস্তাবলে। শুরু হলো ভয়ার্ত পশুদের ছুটোছুটি। একদল অশ্বারোহী তাদের তাড়িয়ে দিল সৈন্যদের তাঁবুর দিকে।
ছুটন্ত ঘোড়া ও উটের পায়ের নিচে পিষে যেতে লাগলো সৈন্যদের লাশ। রাতের নিরবতা খান খান হয়ে গেল আহত পশু ও মানুষের মরণ চিৎকারে। এই শোরগোল, দাউ দাউ আগুনের শিখার আতংক, আহতদের আর্ত চিৎকার, ঘোড়া ও উটের ছুটাছুটিতে ক্যাম্পের আশপাশের পরিবেশ বিভীষিকাময় হয়ে উঠলো।
এ সময় অন্ধকার থেকে ভেসে এলো গুরুগম্ভীর এক কণ্ঠস্বর, ‘বাঁচতে চাও তো অস্ত্র সমর্পন করো। ইয়াজউদ্দিন ও শাহ আরমান আমাদের সামনে এসো। শাহ আরমান, তোমার রাজধানী আল খালিদে তুমি আর কোনদিন ফিরে যেতে পারবে না। আল খালিদ এখন আমাদের সৈন্যরা ঘিরে রেখেছে। তুমি আল খালিদে নেই, তোমার সৈন্যরা আমাদের অবরোধের মধ্যে পড়ে ভয়ে বিবর্ণ হয়ে আছে। জলদি করো, তাড়াতাড়ি এসে আত্মসমর্পন করো। নইলে পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য আমাদের দায়ী করতে পারবে না।’
ইয়াজউদ্দিন ও শাহ আরমান কেউ এই বিভীষিকার মধ্যে সামনে আসার সাহস পেল না। ইয়াজউদ্দিন তার এক বিশ্বস্ত কমাণ্ডারকে বললেন, ‘তুমি আমাকে যেভাবেই পারো একটা ঘোড়া জোগাড় করে দাও।’
কমাণ্ডার অনেক কষ্টে কোন মতে একটি ঘোড়া এনে তাকে। দিল। তিনি ঘোড়ায় আরোহণ করে এলোমেলো ও বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য থেকে বের হয়ে গেলেন। পেছনে পড়ে রইলো তার বিশাল বাহিনী, তার নিজস্ব অফিসারবৃন্দ ও তার সঙ্গে আসা দাসদাসী সব। এদের কারো কথা স্মরণ করারও অবকাশ পেলেন না তিনি। নিজের জীবন নিয়ে একাকী পালিয়ে গেলেন, এমনকি সেই কমাণ্ডারকেও সঙ্গে নিলেন না।
বর্ণনাকারীদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, সুলতান আইয়ুবী চাইলে তার অবরোধ এমন কঠিন করতে পারতেন যে, কেউ সেই অবরোধ ভেঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেতো না। কিন্তু তিনি তা করেননি। এর কারণ হিসাবে ঐতিহাসিকরা বলেছেন, তিনি গাদ্দার শাসকদেরকে তার দলভুক্ত করার পরিবর্তে তাদের সৈন্যদেরকে নিজের বাহিনীর সঙ্গে শামিল করতে চাচ্ছিলেন। কারণ ফিলিস্তিন উদ্ধার করতে অনেক সৈন্যের প্রয়োজন ছিল।
১১৮৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের এই যুদ্ধে সুলতান আইয়ুবী শুধু কমাণ্ডো বাহিনীর সহায়তায় এমন বিজয় লাভ করলেন যে, তিনি সামনে এগিয়ে কাউকে গ্রেফতার করারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই কমাণ্ডো বাহিনীর কমাণ্ড করেছিলেন তিনি নিজে।
শাহ আরমান এই ঘটনায় এতটাই বিহবল হয়ে পড়লেন যে, তিনি পালাবার কথাও চিন্তা করতে পারলেন না। তিনি পাথরের মূর্তির মত ঠাঁয় বসে রইলেন তার কামরায়।
সৈন্যরা ঘোষণা শোনার পর হাতিয়ার তুলে নেয়ার পরিবর্তে আত্মসমর্পন করাই শ্রেয় মনে করলো। তারা কোন রকম প্রতিরোধ না গড়ে আত্মসমর্পন করলো।
মাত্র পঞ্চাশজন কমাণ্ডোর কাছে আত্মসমর্পন করলো ইয়াজউদ্দিনের দুই ডিভিশন এবং শাহ আরমানের তিন ডিভিশন সৈন্য। কমাণ্ডোরা তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বুঝে নিয়ে উধাও হয়ে গেল।
এই ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে গেল রাত। সকাল হলো। ইয়াজউদ্দিন ও শাহ আরমানের সৈন্যরা তাকালো তাদের ক্যাম্পের দিকে। তাঁবুগুলো সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নিহত সৈনিকদের লাশ। যারা কমাণ্ডোদের তলোয়ার, তীর বা বর্শার আঘাতে আহত হয়েছিল কিন্তু তখনো মরেনি, তারা ছটফট করছিল। তারা আশপাশে তাকিয়ে দেখলো, মুক্ত ঘোড়া ও উটগুলো এদিক ওদিক চরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কাছেপিঠে আক্রমণকারীদের কেউ নেই।
এতে তারা সত্যি খুব বিস্মিত হলো। তারা বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে শাহ আরমানকে জানালো। এক কমাণ্ডার শাহ আরমানকে গিয়ে বললো, “জানিনা কাল রাতে আমাদের ওপর ভূতেরা হামলা করেছিল কিনা? আইয়ুবীর কোন সৈন্যই আশপাশে নেই।’
শাহ আরমান জানতেন, সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা এখানেই আশেপাশে কোথাও আছে। তিনি বললেন, ‘গর্দভ, বাজে চিন্তা বাদ দিয়ে সুলতান আইয়ুবী কোথায় আছে জানতে চেষ্টা করো।’
কমাণ্ডার সরে গেল সেখান থেকে। তিনি সুলতান আইয়ুবীকে কোথায় পাওয়া যায় চিন্তা করতে লাগলেন। এক সময় তিনি দেখতে পেলেন, দূর থেকে দুই অশ্বারোহী মহলের দিকেই ছুটে আসছে। তিনি বারান্দায় বসে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
অশ্বারোহী দুজন শাহ আরমানের সামনে এসে নেমে পড়লো ঘোড়া থেকে। তারপর এগিয়ে তাকে সালাম করে বললো, ‘আমরা সুলতান আইয়ুবীর পক্ষ থেকে এসেছি। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আপনাকে সালাম জানিয়েছেন।’
তিনি সালামের জবাব দিয়ে তাদের বসতে বললেন। আগন্তুক অশ্বারোহীদের একজন বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী কাউকে গ্রেফতার করতে চান না। তিনি বলেছেন, ইয়াজউদ্দিন ইচ্ছে করলে মুশেলে চলে যেতে পারে। তবে যে কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগে তিনি যেন ভালভাবে চিন্তা ভাবনা করে নেন। আর আপনার ব্যাপারে সম্মানিত সুলতান একটি চিঠি দিয়েছেন।’
এক অশ্বারোহী এগিয়ে শাহ আরমানের হাতে চিঠি হস্তান্তর করলো। চিঠিতে তিনি শাহ আরমানকে জানিয়েছেন, আমার সৈন্যবাহিনী ইতিমধ্যে আল খালিদের কাছে পৌঁছে গেছে। সন্ধ্যা নাগাদ এ ব্যাপারে আপনি আপনার লোকদের কাছ থেকেই খবর পেয়ে যাবেন।
আপনার আল খালিদে পৌঁছার আগেই আপনার রাজধানী আমার অধীনে চলে আসবে। যদি আপনি মিশর ও সিরিয়ার সুলতানের শর্ত মেনে নেন তবে আল খালিদ থেকে আমার সৈন্য আমি প্রত্যাহার করে নেবো। আর যদি আপনি যুদ্ধ করতে চান তবে তার পরিণতি সম্পর্কে ভাল করে চিন্তা ভাবনা করে নেবেন।
আমি আপনার কাছ থেকে এ চিঠির জবাবের অপেক্ষা করছি। আপনি এখন আমার অবরোধের মধ্যে থাকলেও আমি আপনার ওপর কোন কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। তাই আপনার সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করবে আমার পরবর্তী পদক্ষেপ।’
‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে আমার সালাম বলবেন।’ শাহ আরমান বললেন, ‘আমি আমার এক উজিরকে সন্ধ্যার আগেই সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দেবো। তিনি এখন কোথায় অবস্থান করছেন?’
‘আপনি আপনার উজিরকে বলবেন, তিনি যেন রওনা হয়ে সোজা পূর্ব দিকে আধা ঘন্টা এগিয়ে যান। আমাদের লোক এ সময়ের মধ্যেই তাঁর কাছে পৌঁছে যাবে। তারাই তাঁকে সুলতানের কাছে পৌঁছে দেবেন।’
অশ্বারোহী দু’জন চলে গেল। শাহ আরমান তার বিশ্বস্ত মন্ত্রী বোকতামিয়াকে ডেকে পাঠালেন।
মন্ত্রী বোকতামিয়া এলে তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি সুলতান আইয়ুবীকে বলবে, আপনার বিরুদ্ধে কোন রকম শত্রুতায় আমরা আর নেই। বিভিন্ন আমীরদের প্ররোচনায় যে ভুল আমরা করেছি তাতে আপনি যদি আমাদের রাজধানী দখল করে নিতেন বা শাহ আরমানকে গ্রেফতার করে এনে তাকে হত্যা করতেন তবু আমাদের করার কিছু ছিল না। কিন্তু এটা আপনার অপরিসীম মেহেরবানী ও দয়া যে, আপনি এর কোনটাই করেননি।
যদিও আমাদের রাজধানী আল খালিদ আপনার অবরোধের মধ্যে পড়ে আছে আর আমরাও এখানে আপনার বেষ্টনীর মধ্যে আছি তবু আপনি আমাদের ওপর যে রহম করেছেন তার বদলা আমরা দিতে চাই। আপনি যদি সে সুযোগ আমাদের দেন, আমরা ওয়াদা করছি, আমরা আর কখনো আপনার বিরোধী পক্ষের ফাঁদে পা দেবো না।
আপনি বলেছেন, আপনার শর্ত মেনে নিলে আপনি আল খালিদ থেকে আপনার সৈন্য সরিয়ে নেবেন। শাহ আরমান আপনার শর্ত মেনে নিয়েছেন। তিনি ওয়াদা করেছেন, আপনার কোন শক্রকে তিনি আশ্রয় দেবেন না এবং তাদের সাথে কোন প্রকার চুক্তিও করবেন না। আপনার শত্রুদের সাথে সামরিক জোট গঠন করার কোন অভিপ্রায়ও তার নেই।’
বোকতামিয়া ছিলেন বুদ্ধিমান উজির। তিনি সুলতান আইয়ুবীর সাথে দেখা করলেন। তাকে জানালেন শাহ আরমানের অভিপ্রায়। সুলতান আইয়ুবীও কঠিন শর্ত আরোপ করে বললেন, ‘তিনি কি আপনাকে আমার সাথে যে কোন শর্তে সন্ধি করার ক্ষমতা দিয়েছেন?’
বোকতামিয়া সুলতানকে শাহ আরমানের পক্ষ থেকে লিখিত ক্ষমতাপত্র দেখিয়ে বললেন, ‘আপনার যে কোন শর্ত মেনে নিয়ে সন্ধি করার লিখিত অনুমতি তিনি আমাকে দিয়েছেন।’
সুলতান অনুমতিপত্রটি দেখলেন এবং বললেন, ‘তাহলে আপনাকেও লিখিত অঙ্গীকারনামার সই করতে হবে।
উজির বোকতামিয়া লিখিত অঙ্গীকারনামায় সই করে সুলতান আইয়ুবীর সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হলেন। সন্ধির মূল শর্ত ছিল, শাহ আরমান আর কখনোই সুলতানের শত্রুদের সাথে গোপনে বা প্রকাশ্যে যোগাযোগ করবেন না এবং তারা যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি তাদের প্রশ্রয় দেবেন না।