» » ভণ্ডপীর

বর্ণাকার

আইয়ুবীর গোয়েন্দারা বুঝলো, এ লোক এক ভাড়াটে খুনী মাত্র, টাকার লোভে খুন করতে এসে ফেঁসে গেছে। ফলে তাদেরকে দেয়ার মত কোন তথ্য তার কাছে নেই।

দরবেশের ছদ্মবেশধারী লোকটি তার সঙ্গীদের দিকে তাকালো। তিনজনের মাঝে চোখে চোখে কথা হলো। এ কথার কিছুই বুঝলো না আততায়ী কিন্তু ততক্ষণে তার ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে।

দরবেশধারী লোকটির চোখের ভাষা পড়ে দলের একজন উঠলো এবং তাঁবুর এক কোণা থেকে এক টুকরো রশি নিয়ে আততায়ীর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভাড়াটে খুনী কিছু বুঝে উঠার আগেই সে পিছন থেকে দ্রুত তার গলায় শক্ত করে রশি পেঁচিয়ে ধরে টান দিল। লোকটি কিছুক্ষণ ছটফট করে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো চিরদিনের মত।

পরেরদিন।

আহমদ বিন উমরু ও মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিন মহলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। আহমদ বিন উমরুর চেহারা থেকে অস্থিরতা ও পেরেশানী ঝরে পড়ছিল আর ইয়াজউদ্দিনের চেহারায় খেলা করছিল রাগ ও ভয়।

আহমদ বিন উমরুর হাতে একটি কাগজের টুকরো কাগজটি সে পেয়েছে তার পাঠানো সৈনিকের লাশের সাথে। লাশটি উমরুর বাড়ীর ফটকে পড়েছিল। লাশের গলায় রশি বাধা, আর সে রশির সাথে আটকানো ছিল এই চিঠি।

চিঠিটি হাতে নিয়ে ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘তুমি বলছো, নিহত লোকটি মহলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন সৈনিক ছিল? এই সৈনিককে তুমি নতুন দরবেশকে গোপনে রাতের অন্ধকারে হত্যা করার জন্য পাঠিয়েছিলে?’

বিন উমরু মাথা নত করে বললো, “সারা রাত আমি এই সৈন্যের জন্য না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। সকালে খবর পেলাম, আমার বাড়ীর ফটকের সামনে একটি লাশ পড়ে আছে। আমি দ্রুত বাইরে এসে মাটিতে এই সৈনিকের লাশ দেখতে পাই। লাশের চোখ ছিল বিস্ফারিত এবং তার জিহ্বা বের হয়ে এসেছিল। গলার ফাঁস দেয়া রশির সাথে আটকানো ছিল এই চিঠি।’

‘তুমি পড়েছে এতে কি লেখা আছে?’ ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললেন ইয়াজউদ্দিন।

‘অবশ্যই মহামান্য আমীর! তাই তো আমি সঙ্গে সঙ্গে আপনার কাছে ছুটে এসেছি।’

এই চিঠিতে লেখা ছিল, ‘মুশেলের সম্মানিত আমীর ইয়াজউদ্দিন মাসুদ! আপনার এক বড় অফিসার ও উপদেষ্টা আহমদ বিন উমরু এ লোককে পাঠিয়েছিল আমাকে খুন করতে। আমি তার লাশ স্বসম্মানে ও যত্নসহকারে আহমদ বিন উমরুর বাড়ীর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছি। এই হতভাগা সৈনিক আমাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে, এটা তার দোষ নয়। আমরা এতটাই সতর্ক যে, এ ধরনের হামলার জন্য আমরা সব সময়ই প্রস্তুত থাকি। তাই খুব ঝানু ও আমাদের চেয়ে অভিজ্ঞ কাউকে না পাঠালে এ ধরনের ব্যর্থতা ছাড়া তারা আপনাকে কিছুই দিতে পারবেনা।

সম্মানিত আমীর! আপনার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই বলছি, আপনি তো সেই হতভাগাদের একজন, যারা সকাল সন্ধ্যা সুলতান আইয়ুবীর ক্ষতির স্বপ্ন দেখে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টারও কোন ক্রটি করে না। কিন্তু অতীতে যেমন আপনার স্বপ্ন সফল হয়নি তেমনি ভবিষ্যতেও আপনি বা আপনার মত বেঈমানরা ইনশাআল্লাহ তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

সম্মানিত আমীর! মনযোগ দিয়ে আমার কথা শুনুন। কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব আপনাকে অপমান ও লাঞ্ছনা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না। আরও জেনে রাখুন, এখন থেকে আমরাও আর আপনাকে শান্তিতে থাকতে দেবো না।

আপনার লোকেরা আমাদের লাশ করার জন্য যখন আমাদের ওপর আঘাত হেনেছে তখন আপনিও জেনে রাখুন, এখন থেকে আমরাও আপনাকে লাশ বানানোর জন্য প্রস্তুত হবো। যেভাবে আপনার উপদেষ্টার পাঠানো সৈনিকের লাশ পড়েছিল রক্তপিপাসু উপদেষ্টার বাড়ীর ফটকে, তেমনি কোনদিন হয়তো দেখবেন আপনার লাশ পড়ে আছে আপনার আরামদায়ক নরম বিছানায়।

তবে আমরা আপনাকে একটা সুযোগ দিতে চাই। আমরা জানি কারা খৃষ্টানদের বন্ধু। আহমদ বিন উমরুর মত খৃষ্টানদের যারা বন্ধু তাদেরকে উপদেষ্টা বানিয়ে আপনি বাঁচতে পারবেন না। এখনও সময় আছে, আপনার অফিসারের মধ্যে যারা খৃস্টানদের বন্ধু তাদের সংশ্রব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিন। খৃস্টানদের বন্ধু তোষামোদী চাটুকারের দল কখনও আপনার কল্যাণকামী ও অনুগত হতে পারে না। এরাই আপনার ধ্বংসের কারণ হবে।

আমাদের শক্তি সম্পর্কে কোন ভুল ধারনায় থাকা ঠিক হবে না আপনার। আপনার সামরিক উপদেষ্টা ও বন্ধু এহতেশাম উদ্দিনকে আপনি বৈরুত পাঠিয়েছিলেন খৃষ্টানদের সাথে গোপন চুক্তি করতে। কিন্তু আমরা তাকে উধাও করে দিয়েছি। এখন তিনি সুলতান আইয়ুবীর কাছে আছেন।

আপনার খৃষ্টান বন্ধুরা পাহাড়ের গুহায় যে বিশাল যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম ও আগ্নেয়াস্ত্র পুঞ্জিভূত করে রেখেছিল, আমরা তার সবটাই ধ্বংস করে দিয়েছি। পুঞ্জিভূত সমরাস্ত্র জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করতে গিয়ে আমরা না চাইলেও পাহাড় ধ্বস ও ভূমিকম্পের যে ধাক্কা খেয়েছে মুশেলবাসী তাতে তারা আতঙ্কিত। এখনো খৃস্টানদের এই অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আপনার প্রশ্রয় ও সহযোগিতার কথা মুশেলবাসীকে বিস্তারিত আমরা জানাইনি। যদি মুশেলবাসী আপনার কুকর্মের কথা জানতে পারে তাহলে আপনার অবস্থা কি হবে এটুকু বুঝার মত বুদ্ধিও কি আল্লাহ আপনাকে দেয়নি?

শুনে রাখুন সম্মানিত আমীর! আপনাদের পাঠানো খুনীদের লাশ আমরা আপনার হুশ ফিরিয়ে আনার জন্য আপনার লোকদের হাতে এবার তুলে দিলেও ভবিষ্যতে এতটা কষ্ট করার সময় ও সুযোগ আমাদের হবে না। এখন থেকে আমরা অশরীরি জ্বীন ভুতের মতই আপনার চার পাশ পাহারা দেবো। আপনারা আমাদের দেখতে পাবেন না, কিন্তু আমরা আপনার প্রতিটি নিঃশ্বাসের খবরও আপনাকে বলে দিতে পারবো।

সম্মানিত আমীর! অাপনার ধ্বংসের প্রক্রিয়া কেবল শুরু হয়েছে। যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার শখ না থাকে তবে সুলতান আইয়ুবীর আনুগত্য মেনে নিয়ে তার হাতে আপনার সৈন্যদের তুলে দিন। এই আত্মসমর্পনে আপনার অপমান বোধ করার কোন কারণ নেই। বরং অতীত পাপের কাফফারা আদায়ের এই সুযোগকে লুফে নিতে পারায় আপনার গর্ব করা উচিত।

সম্মানিত আমীর! মুসলমানদের প্রথম কেবলা মুক্ত করার জন্য যে মুজাহিদরা মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধেছে তাদের পথ রোধ করার ফন্দিফিকির বাদ না দিলে তার পরিণতির জন্য আমরা নই, আপনিই দায়ী থাকবেন। এই দুনিয়ার বাদশাহী ও শান শাওকত ত্যাগ করে যে দ্বীনের খাদেম হতে পেরেছে জীবন তো কেবল তারই সফল হয়। রাজ্য ও সিংহাসন কখনো করো সঙ্গে যায় না এ কথাটি মনে রাখলে খুশী হবো।

ইতি আপনার মঙ্গলাকাঙ্খী অচেনা পথিক।

আহমদ বিন উমরু লাশটি তার ঘরের সামনে থেকে সরিয়ে ইয়াজউদ্দিনের মহলের সামনে নিয়ে এসেছিল। ইয়াজউদ্দিন এই চরমপত্র পড়ে পত্রটি বিন উমরুর হাতে দিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। বিন উমরুর চেহারায় তখনো খেলা করছিল রাগ, কিন্তু ইয়াজউদ্দিনের রাগ, ক্ষোভ ও উদ্দীপনা সবই শিথিল হয়ে গিয়েছিল।

‘আমি সংবাদ পেয়েছি, মসজিদে মসজিদে এই নতুন দরবেশকে নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে।’ বিন উমরু ইয়াজউদ্দিনকে লক্ষ্য করে বললো, ‘এই লেখায় প্রমাণ হয়ে গেল, এ লোক কোন দরবেশ নয় বরং সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কোন জাঁদরেল গোয়েন্দা।’

সে কাগজটি মুড়ে লাশের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, ‘আমি তাকে খুঁজে বের করবো এবং সর্ব সাধারণের সামনে প্রকাশ্যে তাকে হত্যা করবো। এতে জনতা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। আপনার ব্যাপারে কোন বাঁকা মন্তব্য করার আগে দশবার ভাবতে হবে এ ধরনের লোককে।’

‘সস্তা উত্তেজনা প্রকাশের সময় এটা নয় বিন উমরু। ফালতু আবেগ রেখে ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু চিন্তা করতে হবে।’ ইয়াজউদ্দিন মাসুদ বললেন, ‘তুমি বড়জোর ঐ একটি লোককে হত্যা করতে পারবে। তাতে সুলতান আইয়ুবীর কি ক্ষতি হবে? কিছুই না। আমাকে নতুন করে সবকিছু চিন্তা করতে হবে।’

‘এহতেশামউদ্দিন আমাদের সাথে গাদ্দারী করেছে। সে খৃস্টানদের সাথে আপনার পক্ষে সন্ধি না করে আইয়ুবীর কাছে চলে গেছে। এ জন্যই ওদের এত সাহস বেড়ে গেছে। আপনি আমাকে সুযোগ দিন। আমি সম্রাট বিলডনের কাছে যাবো। তাকে বলবো আইয়ুবীর ওপর এখনই আঘাত হানতে। বিনিময়ে তার সব শর্ত আমি মেনে নিতে প্রস্তুত।’

‘আমি তো চেয়েছিলাম খৃস্টানরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর উপর আক্রমণ করুক। কিন্তু জানিনা কেন তারা অগ্রসর হচ্ছে না। তাদের তৎপরতায় মনে হচ্ছে, তারা চায়, আমি সালাহউদ্দিনের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি। তখন তারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে। তারা এমনভাবে সাহায্য করবে, যাতে তাদের কমাণ্ডো বাহিনী সালাহউদ্দিনের পার্শ্বদেশ ও পিছন থেকে আক্রমণ করে তাকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। তারা আইয়ুবীর রসদ সামগ্রী রাতের আঁধারে ধ্বংস করতে এগিয়ে যাবে কিন্তু প্রকাশ্য ময়দানে আইয়ুবীর বাহিনীর সামনে আমাকেই লড়াই করতে হবে। এটা অসম্ভব। যদি তারা সরাসরি যুদ্ধে নামতো তবে না হয় কথা ছিল।’

‘তারা প্রকাশ্যেই যুদ্ধে নামবে। আমাকে সুযোগ দিন, সে ব্যবস্থা আমিই করবো।’ বিন উমরু চোখে মুখে দৃঢ়তা ফুটিয়ে বললো।

ইয়াজউদ্দিনের ঠোঁটে দেখা দিল তিক্ত হাসি। তিনি বিন উমরুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই চিঠিতে একটা সত্য কথা লিখেছে। বলেছে, তুমি একজন তোষামোদী।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘আমি এক মহা সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছি আর তুমি আমাকে খুশী করার জন্য শিশুর মত কথা বলছো। তুমি কি এরচেয়ে ভাল কোন পরামর্শ দিতে পারো না?

তিনি থামলেন এবং তালি বাজালেন। মহলের এক রক্ষী দৌড়ে এলো তার কাছে। মাথা নুইয়ে বললো, “জাঁহাপনা! ’

ইয়াজউদ্দিন তাকে বললেন, ‘দারোয়ানকে বলো, লাশটি এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে কোথাও দাফন করে আসুক।’

এই কথা বলে তিনি তার খাস কামরার দিকে হাঁটা ধরলেন।

আহমদ বিন উমরু কি করবে ভেবে না পেয়ে ইয়াজউদ্দিনের পিছন পিছন চলতে লাগলো।

তিনি খাস কামরায় ঢুকে দাসীকে বললেন, ‘মদের সুরাহী ও পিয়ালা নিয়ে এসো, দারোয়ানকে বলো যেন কেউ এদিকে না আসতে পারে।’

আহমদ বিন উমরু ইয়াজউদ্দিনের খাস কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো।

দাসী দারোয়ানকে খবর দেয়ার জন্য কামরা থেকে বেরিয়েই লাশটি দেখে ভয় পেয়ে গেল। তার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো লাশের পাশে পড়ে থাকা দোমড়ানো মোচড়ানো কাগজটির উপর।

দাসী আরবী পড়তে পারতো, সে কাগজটি তুলে দু’লাইন পড়েই তা আঁচলের নিচে লুকিয়ে ফেললো এবং দ্রুত আবার কামরার মদের ভাঁড়ারের দিকে চলে গেল। সে ইয়াজউদ্দিনের হাতে মদের পেয়ালা তুলে দিয়ে দৌড়ে আবার বাইরে এলো। দারোয়ানকে বললো, ‘লাশ উঠিয়ে দাফন করে দাও।’ বলেই সে আবার খাস কামরায় ঢুকে গেল।

‘আরমেনিয়ার শাহ আরমান আমার চিঠির উত্তর দিয়েছে।’ ইয়াজউদ্দিন বিন উমরুকে বললেন, ‘তিনি আমাকে তার রাজধানী আল খালিদে সাক্ষাতের পরিবর্তে হারজামে দাওয়াত করেছেন। তিনি আল খালিদ থেকে যাত্রা করেছেন। আমিও তার সাথে সাক্ষাতের জন্য দু’এক দিনের মধ্যেই রওনা করতে। চাচ্ছি।

দাসী পিয়ালায় মদ ঢালার পরিবর্তে মনোযোগ দিয়ে পিয়ালা মুছতে লাগলো। তার কান ইয়াজউদ্দিনের কথার দিকে নিমগ্ন। ‘আমার মনে হয় আরমেনিয়ার শাহ আরমান আল খালিদ থেকে হারজাম যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভীষণ ভুল করছে।’ বিন উমরু বললো, ‘আমি খবর পেয়েছি, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আল খালিদের দিকে অভিযান চালাচ্ছেন।’

ইয়াজউদ্দিন মাসুদ বললেন, ‘তুমি কি এই ভয় পাচ্ছে যে, শাহ আরমানের অনুপস্থিতিতে সুলতান আইয়ুবী আল খালিদ অবরোধ করে দখল করে নেবে? আমার মনে হয়, এমনটি হবে না। আর যদি তাই ঘটে, তবে আমরা সম্মিলিতভাবে সালাহউদ্দিনের সেনাবাহিনীর উপর পিছন থেকে চড়াও হবো।

আমরা যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে খৃষ্টানদের সংবাদ পাঠাবো। এ অবস্থায় তারা সালাহউদ্দিনের উপর আক্রমণ চালাতে দ্বিধা করবে না। আমার বিশ্বাস, ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে সালাহউদ্দিনের সেনাবাহিনী একদম পিষে যাবে।’

‘আপনি কবে যাচ্ছেন?’ বিন উমরু প্রশ্ন করলো।

‘পরশু নাগাদ রওনা করতে চাই।’ ইয়াজউদ্দিন উত্তর দিলেন।

দাসী পিয়ালায় মদ ঢেলে দুজনকেই তা পরিবেশন করলো। মদ পরিবেশন শেষ হলে ইয়াজউদ্দিন তাকে বললো, ‘এবার তুমি একটু বাইরে যাও।’

সে মদের বোতলের মুখ বন্ধ করে পাশের কামরায় চলে গেল। জানালা দিয়ে দেখতে পেলো কয়েকজন সৈনিক ধরাধরি করে বারান্দা থেকে লাশটি উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

দাসী তার কামরা থেকে সরে যেতে পারছিল না। কারণ এখন সে ডিউটিতে আছে। যে কোন সময় ইয়াজউদ্দিন তাকে ডেকে বসতে পারে। সে সেখানেই বসে থাকলো এবং চিন্তা করতে লাগলো।

হঠাৎ তার মুখ থেকে “উহ্ শব্দ বের হলো। সে দুই হাতে পেট চেপে ধরে কাতরাতে লাগলো। ব্যথার চোটে সে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পেট চেপে ধরে বসে পড়লো। দারোয়ান ও অন্যান্য দাসী চাকররা দৌড়ে এলো। দাসী চেহারায় চরম কষ্ট ফুটিয়ে তুলে বললো, “পেটে ভীষণ ব্যথা হচ্ছে।’

ডিউটিতে অন্য দাসীকে বসিয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। চিকিৎসক তাকে ঔষুধ দিয়ে বললো, ‘এখন তুমি ডিউটি করার যোগ্য নও। আমি লিখে দিচ্ছি, তুমি দু’দিনের জন্য ছুটি নাও।’

কিছুক্ষণ পর তার পেটের ব্যথা সামান্য কমলো। ডাক্তারের দেয়া কাগজ দেখিয়ে সে দু’দিনের ছুটি চাইলো। তার ছুটি মঞ্জুর করা হলো সে ডিউটি রুম থেকে বেরিয়ে বাড়ী যাওয়ার পরিবর্তে ইয়াজউদ্দিনের বিবি রাজিয়া খাতুনের কামরার দিকে হাঁটা ধরলো।

রাজিয়া খাতুন সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর স্মৃতি বুকে নিয়ে ইয়াজউদ্দিনের ঘর করছিলেন। কিন্তু যে আশা নিয়ে তিনি ইয়াজউদ্দিনের মহলে এসেছিলেন তার সে আশা পূরণ হয়নি। ইয়াজউদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর বন্ধু ও সাথী না হয়ে শক্রই রয়ে গেল।

মুসলমান আমীরদের ঐক্যবদ্ধ করে ফিলিস্তিন থেকে খৃষ্টানদের বিতাড়িত করার যে স্বপ্ন নুরুদ্দিন জঙ্গী দেখেছিলেন এবং এখন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী দেখছেন, তা আর বাস্তবায়িত হলো না। ইয়াজউদ্দিন রাজিয়া খাতুনকে বিয়ে করেছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। দামেশক ও বাগদাদে রাজিয়া খাতুনের যে প্রভাব ছিল তাকে নিজের পক্ষে ব্যবহার করাই ছিল তার মূল টার্গেট।

ইয়াজউদ্দিনের ভয় ছিল, এই মহিয়সী নারীকে কব্জা করতে না পারলে তাকে সুলতান আইয়ুবী ব্যবহার করবে। তাতে সুলতানের শক্তি ও প্রভাব অনেক বেড়ে যাবে। আর যদি তাকে বিয়ে করে একবার মহলে ঢুকানো যায় তবে দামেশক ও বাগদাদের লোকজন তার নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হবে।

রাজিয়া খাতুন বিয়ের পর পরই তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন। প্রথমে তিনি বিদ্রোহ করলেও পরে তিনি তার কৌশল পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। তিনি বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন, ইয়াজউদ্দিনের আস্থা অর্জন করে তিনি আইয়ুবীর পক্ষে গোয়েন্দাগিরী করতে শুরু করেন।

মুশেলে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দাদের সাথে যোগাযোগ করে তিনি গোপনে মহলের সব গোপন খবর তাদের সরবরাহ করতে লাগলেন। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করতে লাগলো তার পূর্ব স্বামী নুরুদ্দিন জঙ্গীর কন্যা শামুসুন নেসা।

মা ও মেয়ে উভয়েই সুলতান আইয়ুবীর কাছে অতি মূল্যবান গোপন তথ্য পাঠাতে লাগলো। সেই সঙ্গে রাজিয়া খাতুন ইয়াজউদ্দিনের দুই সেনাপতি ও একজন উপদেষ্টাকেও নিজের সহযোগী বানিয়ে নিলেন।

ইয়াজউদ্দিনের সাথে তার মতভেদ ও বিবাদ বাঁধলে ইয়াজউদ্দিন তাকে গৃহবন্দী করে ফেলেন। ফলে তিনি ইয়াজউদ্দিনকে এ আশ্বাস দিতে বাধ্য হন যে, তিনি সুলতান আইয়ুবীর পক্ষে আর কথা বলবেন না।

রাজিয়া খাতুন ছিলেন মধ্য বয়সী সুন্দরী মহিলা। তিনি ইয়াজউদ্দিনকে মিষ্টি কথায় তুষ্ট করে তাঁর মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিলেন। এরপর তিনি মনযোগ দিলেন মহলের ভেতরে আইয়ুবীর সপক্ষে গোয়েন্দা দল তৈরী করতে।

রাজিয়া খাতুন তার কামরাতেই বসেছিলেন। ইয়াজউদ্দিনের দাসী প্রবেশ করলো কামরায়। বললো, ‘পেটের ব্যথার ছলনা করে এখানে এসেছি। ডাক্তার আমাকে দু’দিনের ছুটি নিতে বলেছে। ছুটি নিয়েই আমি আপনার কাছে ছুটে এসেছি।’

“কি ব্যাপার! কোন জরুরী খবর?’ রাজিয়া খাতুন উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলেন।

দাসী তার জামার মধ্য থেকে কাগজের সেই চিঠিটা সের করলো যেটা সে লাশের পাশে পেয়েছিল। চিঠিটি রাজিয়া খাতুনের হাতে দিতে দিতে বললো, “এই চিঠিটি এ সৈনিকের লাশের সাথে বাঁধা ছিল।’

রাজিয়া খাতুন চিঠিটা পড়লেন ও বললেন, ‘সাবাস! আমাদের মুজাহিদরা ভালই কাজ করছে। খুশীর কথা হলো, এই হতভাগা আমাদের লোকদের হত্যা করতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। আমি খবর পেয়েছি, আমাদের দরবেশ জনগণের মন থেকে খৃষ্টান দরবেশের আতংক ও গুজবের ভীতি দূর করতে সক্ষম হয়েছে।’

‘এ লেখা তারই।’ দাসী বললো, ‘আমি তার হাতের লেখা চিনি।

রাজিয়া খাতুন হেসে বললেন, ‘আমি জানি তুমি শুধু তার হাতের লেখাই চেনো না, মনের ভাবও পড়তে জানো। কিন্তু সাবধান! তাকে তোমার মনের জালে বন্দী করতে যেও না। আগে নিজের দায়িত্ব পালন করো এবং তাকেও তার দায়িত্ব পালন করতে দাও।’

রাজিয়া খাতুনের এ কথায় দাসী লজ্জা পেলো। সে লাজ রক্তিম কণ্ঠে বললো, ‘না, এখনও ফরজ কাজের চেয়ে মনের আবেগকে প্রাধান্য দেইনি। আমি ফাহাদকেও সে কথা বলেছি, ‘তোমার প্রতি আমার অন্তরের যে টান আছে তার চাইতে আমাদের দায়িত্ব অনেক বড়। আমাকে পেতে হলে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করো।’

ফাহাদ সেই তরুণ যুবকের নাম, যে নতুন দরবেশের রূপ ধারণ করে ইতিমধ্যেই ইয়াজউদ্দিনের অন্তরে ভীতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এই যুবক বাগদদের বাসিন্দা। তার মধ্যে গোয়েন্দগিরীর গুণাবলী ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক। এই সুদর্শন যুবক, দুই বছর ধরে মুশেলে বসবাস করছে এবং সফলতার সাথে গোয়েন্দাগিরীর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, কণ্ঠের যাদু। সে অত্যন্ত সহজে ও মনোমুগ্ধকর ভাষায় ইসলামের বিভিন্ন বিষয় মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারতো। এ ক্ষেত্রে সে তার সঙ্গীদের চেয়েও এগিয়ে ছিল।

এই গোয়েন্দাগিরী কাজের সূত্র ধরেই ইয়াজউদ্দিনের এক সুন্দরী দাসীর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। তারপর কখন কিভাবে যে একে অপরের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে নিজেরাই জানে না।

দাসী এই শহরেরই বাসিন্দা। কিন্তু তার অধিকাংশ সময় মহলের কাজেই অতিবাহিত হয়ে যায়। ইদানিং গোয়েন্দাগিরীর গোপন কাজ ছাড়াও ফাহাদের সাথে তার মাঝেমধ্যেই সাক্ষাৎ হতে থাকে।

‘আমি যে সংবাদ নিয়ে এসেছি তা তো বলাই হয়নি।’ দাসী রাজিয়া খাতুনকে বললো, ‘ইয়াজউদ্দিন আগামী পরশু শাহ আরমানের সাথে দেখা করার জন্য হারজাম যাচ্ছেন।’

‘তুমি কেমন করে জানলে এ খবর?’

‘আমি মদ পরিবেশন করার সময় তার মুখে এই কথা শুনেছি। তিনি আহমদ বিন উমরুকে বলছিলেন, শাহ আরমান আমার চিঠির জবাব দিয়েছে। তিনি আমাকে তার রাজধানী আল খালিদে দাওয়াত না দিয়ে হারজাম যেতে বলেছেন। আগামী পরশু আমি হারামের দিকে রওনা করবো।’

এ খবর আপনাকে জানানোর জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু আমি সেখান থেকে বের হতে পারছিলাম না। শেষে পেটের ব্যথার ভান করে ছুটি নিয়ে আপনার কাছে চলে এলাম।

রাজিয়া খাতুন খুশীতে হাততালি দিয়ে উঠলেন। বললেন, ‘সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এখন আল খালিদের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। আমি জানি না আল খালিদে নিজেদের কোন গোয়েন্দা আছে কিনা এবং তারা এ সংবাদ সুলতানকে দিয়েছে কিনা। কিন্তু আমি মনে করি, এ সংবাদ সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে এখনি পৌঁছা দরকার। তাতে সুবিধা হবে, এ খবর পেলে সুলতান আইয়ুবী দু’জনকেই হারজামে ধরে ফেলতে পারবেন। তুমি এক কাজ করো। ফাহাদ কিংবা তার কোন সাথীকে এ খবর পৌঁছে দাও। তাদেরকে বলো, সুলতান আইয়ুবী এখন আল খালিদের পথে। তারা যেন এ খবর সুলতানকে পৌঁছে দেয়।

তিনি দাসীকে তাড়া দিয়ে বললেন, ‘যাও, দেরী করো না, এক্ষুণি যাও।’

দাসী সেখান থেকে বিদায় নিল। দাসী বিদায় নেয়ার কিছুক্ষণ পরই ইয়াজউদ্দিন মাসুদ রাজিয়া খাতুনের কামরায় প্রবেশ করলেন। তার চোখে মুখে ভয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। রাজিয়া খাতুন একটু আগে দাসীর মুখে যে খবর শুনেছেন তার ভয় ও অস্থিরতার সেটাই যে কারণ বুঝতে পারলেন তিনি। তবুও নিজেকে আড়াল করে তিনি তাকে এই অস্থিরতার কারণ জিজ্ঞেস করলেন।

‘আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর শত্রুতা আর খৃষ্টানদের বন্ধুত্বের যাঁতাকলে পিষে মরছি।’ ইয়াজউদ্দিন মাসুদ অসহায়ের মত কথাগুলো বলেই ধপ করে এক আসনে বসে পড়লেন।

‘আমার যাবতীয় আনন্দ ও খুশী শুধু আপনার সাথে।’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘কিন্তু আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পক্ষে কথা বললে আপনি সন্দেহ করেন, আমি বুঝি তার পক্ষে আর আপনার বিরুদ্ধে।

এ জন্যই এখন আর রাজনীতি নিয়ে আমি আপনাকে কিছু বলি না। কিন্তু আমার মনে হয়, আপনার পেরেশানীর কারণ এটা নয় যে, সালাহউদ্দিনের সাথে আপনার শক্রতা সৃষ্টি হয়েছে। আসল কারণ হচ্ছে, আপনি সেই জাতিকে বন্ধু মনে করছেন, যে জাতি আপনার বন্ধু হতে পারে না।

আপনি তাদের বন্ধু ভাবলেও তারা আগেও মুসলমানকে বন্ধু ভাবেনি, এখনো ভাবছে না এবং ভবিষ্যতে ভাববে এমন কোন সম্ভাবনা আমি দেখছি না। খৃষ্টানরা তাদের পরিকল্পনা ও প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবে কিন্তু আপনাকে তারা ধোঁকা দেবে। আপনি এক বিপদজনক শত্রুকে বন্ধু ভেবে বসে আছেন।’

‘তবে কি আমি সালাহউদ্দিনের পায়ের তলে তলোয়ার রেখে দিয়ে বলবো, আমাকে একটু আশ্রয় দিন?’ ইয়াজউদ্দিন বিরক্তি নিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘আমি এমনটা করলে মানুষের কাছে আমি মুখ দেখাবো কেমন করে? আমার সৈন্যবাহিনী তার হাতে তুলে দিয়ে কেমন করে আমি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো?’

‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আপনাকে প্রজা বানাতে চান না। তিনি বরাবরই আপনাকে তার জোটভুক্ত হতে আহবান জানিয়েছেন। রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘আইয়ুবীর সাথে জোটবদ্ধ হলে তাতে তো আপনার সম্মানহানির কিছু দেখি না আমি।’

‘তুমি তার মনের ভাব জানো না।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘তিনি ইসলামী সাম্রাজ্যের কথা বলে নিজেই এক সাম্রাজ্যের মালিক হতে চান।’

‘এর অর্থ হলো, আপনি তার সাথে যুদ্ধ করবেন।’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘যদি এটাই হয় আপনার ইচ্ছা তবে পেরেশান হওয়ার পরিবর্তে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন। নিজের সৈন্যবাহিনীতে আরও সৈন্য বৃদ্ধি করুন। তাদেরকে উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধের উপযোগী করে গড়ে তুলুন। বীর কখনো পেরেশান হয় না, নিজের যোগ্যতা ও সাহস নিয়ে লড়াই করে।’

‘আমার অশান্তি শুধু এই যে, সুলতান সালাহউদ্দিনের গোয়েন্দারা এই মুশেলেও তাদের জাল বিছিয়ে রেখেছে।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘তুমি তো জানো আমার সামরিক উপদেষ্টা এহতেশামুদ্দিন বৈরুতে সম্রাট বিলডনের সাথে চুক্তি করতে গিয়েছিল, কিন্তু সে সেখান থেকেই অদৃশ্য হয়ে যায়। পরে আমি সংবাদ পেয়েছি, সে এখন সালাহউদ্দিনের কাছে।

আমার যাবতীয় গোপন তথ্য তার কাছে রয়েছে। আমি খৃষ্টানদের কাছ থেকে যে অস্ত্রশস্ত্র, পেট্রোল, তেলের মটকা ও বিভিন্ন সাজ সরঞ্জামের ভাণ্ডার এনে আমার কাছে জমা করেছিলাম, সেগুলো তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। আজ আমার রক্ষী বাহিনীর এক সৈন্যের লাশ আমার কাছে এসেছে।’

‘তাকে কেউ হত্যা করেছে?’ রাজিয়া খাতুন না জানার ভান করে প্রশ্ন করলো।

‘হ্যাঁ।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, “তাকে কেউ হত্যা করেছে। তাকে একটা বিশেষ কাজে পাঠানো হয়েছিল। তাকে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কোন কমাণ্ডো হত্যা করেছে।’

সে লাশের সাথে ফাহাদের লেখা যে চিঠি ছিল ইয়াজউদ্দিন জানতো না সে চিঠি এখন রাজিয়া খাতুনের কাছে। রাজিয়া খাতুন চিন্তা করলেন, ইয়াজউদ্দিন এখন যথেষ্ট ভীত ও আতংকগ্রস্ত। তাকে আরো ভীত সন্ত্রস্ত করা উচিত।

‘আপনি তো ভাল করেই জানেন, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী শুধু যুদ্ধের ময়দানেই লড়াই করেন না।’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘তিনি যখন তার তাঁবুতে শুয়ে থাকেন তখনও তার শত্রুরা মনে করে তিনি তাদের মাথার উপর বসে আছেন। এখন তো তিনি আল খালিদের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি মুশেলেই বসে আছেন এবং তার নির্দেশেই কমাণ্ডোরা এই ধ্বংসাত্মক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

খৃস্টানদের সৈন্য সংখ্যা হিসাব করুন, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যের দশগুণেরও বেশী হবে। কিন্তু খৃষ্টানরা তবু আগে তাকে আক্রমণ করার সাহস পাচ্ছে না। খৃষ্টানদের তুলনায় আপনার কি পরিমাণ সৈন্য আছে তা তো আপনিই ভাল জানেন। আমার ভয় হয়, আপনার বাহিনীর সেনাপতি ও কমাণ্ডাররা সবাই আপনার অনুগত ও বাধ্য নয়। তাদের মধ্যেও আইয়ুবীর লোক আছে। তারা চূড়ান্ত সময় এলে আপনাকে ধোঁকা দিয়ে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করবে। এমনকি দল বদল করে আইয়ুবীর বাহিনীতেও শামিল হয়ে যেতে পারে। এসব সম্ভাবনা আপনি উড়িয়ে দিতে পারেন না। যুদ্ধে জিততে হলে সব সময় কোন কোন দিক থেকে বিপদ আসতে পারে তা জানা থাকতে হয় একজন সেনাপতির। তাহলেই তো কেবল তিনি তার মোকাবেলা করতে পারেন।’

ইয়াউদ্দিন এ কথায় সত্যি সত্যি আরও ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন, ‘আমি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছি যেখান থেকে সহজে ফিরে আসা সম্ভব নয়। আমি পরশু মুশেল থেকে একটু বাইরে যাবো। যদি অবস্থা আমার অনুকূলে থাকে তবে হয়তো সফল হবো।’ তিনি থামলেন এবং গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘রাজিয়া! তোমার কাছে আমার একটি জিনিস চাইবার আছে।’

‘কি জিনিস!’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘আপনি আমার কাছে যা চাবেন, তাই পাবেন। যদি আপনি আমাকে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে কোন কাজ করতে বলেন, তাও আমি করতে পারবো। আমি এখন আপনার এক সন্তানের মা। আমার ভাগ্য এখন আপনার সাথে একাকার হয়ে গেছে। আপনি বলুন আমাকে কি করতে হবে? আপনার সব আশা আমি পূরণ করে দেবো।’

‘আমি বাইরে যাচ্ছি।’ ইয়াজউদ্দিন বললেন, ‘আমাকে জিজ্ঞেস করো না, আমি কোথায় যাচ্ছি এ কথা এখন গোপন রাখাই ভাল। তবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে তৎপরতা চালানোর অভিপ্রায় নিয়েই যাচ্ছি আমি।

যদি আমার এ চেষ্টা ব্যর্থ হয় তবে আমি তোমার কাছে আশা করবো, তুমি আমার পক্ষ থেকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে যাবে এবং তার সাথে আমার বিরোধ মীমাংসা করে দেবে। এমনও হতে পারে, আমি একা গেলে তিনি আমার সাথে দেখাও করবেন না। তাই তোমাকেই আগে পাঠাতে চাই।’

রাজিয়া খাতুন তাকে পরামর্শ দিলেন, ‘যদি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে আপনি আপোষই করতে চান তবে তার বিরুদ্ধে আর কোন তৎপরতা না চালানোই ভাল। সুলতানের গোয়েন্দাদের চোখ কান সব সময় খোলা থাকে। এসব তৎপরতা তাদের দৃষ্টির বাইরে থাকবে না। কেন অনর্থক তাদের কুনজরে পড়তে যাবেন?’

তিনি ইয়াজউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ যদিও রাজিয়া খাতুন সবই জানতেন। একটু আগে দাসী তাকে সবই জানিয়ে গেছে।