» » পাপের ফল

বর্ণাকার

দারোগা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো আশে পাশে কেউ নেই। তারপরও মুখ গরাদের একদম কাছে নিয়ে নিচু কন্ঠে বললো, ‘আপনাকে পালিয়ে যেতে বললো। বললো, মুশাল থেকে আপনারা পালিয়ে যেতে চাইলে আমি যেনো সাহায্য করি। আপনি যদি সাহস করেন আমি আপনাকে সর্বোতভাবে সাহায্য করবো।’

‘আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই হবে। মুমিনের কখনো সাহসের অভাব হয় না।’ খতীব বললেন, ‘কিন্তু তোমার সাহায্য নিয়ে আমি পালাতে চাই না। তোমাকে বিপদে ফেলার চেয়ে এখানে মরে যাবো, তাও ভালো।’

‘কেন?’ দারোগা বিস্মিত হয়ে বললো, ‘আমি গোনাহগার বলে কি আমার সাহায্য নিতে আপনার এ আপত্তি?’

‘না।’ খতীব বললেন, ‘আমি তোমার সাহায্য এ জন্য নেবো না যে, তুমি একজন সরল ও নিষ্পাপ লোক। আমি তোমার সাহায্য নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবো, কিন্তু তুমি তো পালানোর সুযোগ পাবে না! তুমি ধরা পড়ে গেলে আমার অপরাধের সমস্ত শাস্তি তোমার ওপর পড়বে, সেই সাথে তোমার অপরাধের শাস্তি তো আছেই। তুমি কল্পনা করতে পারো, দ্বিগুণ শাস্তি তোমার ওপর পড়লে কি ভীষন অবস্থা হবে?’

‘আমি আপনার সাথেই যাবো।’ দারোগা বললো, ‘আপনার গত রাতের কথাগুলো আমার চোখ খুলে দিয়েছে। এই জাহান্নামে আমি আর থাকতে চাই না। এই পরিবেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য আমার মন ছটফট করছে। আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সেনা দলে ভর্তি হতে চাই। আমি এখানে বন্দী নই। ফলে সহজে এবং বিনা বাঁধায় আমি এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারবো। কিন্তু আমি একা এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবো? আপনি জানেন, এ দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। আমার অন্তরে কি জ্বালা সে কথাও আপনার অজানা নয়। এ জ্বালাকে শীতল করতে আমি আপনার সঙ্গী হতে চাই।’

‘হ্যাঁ, এ অবস্থায় আমি তোমার সাহায্য গ্রহণ করতে পারি।’

‘সায়েকা বলেছিল, সে মুশালের আমীর সাইফুদ্দিনের কাছে আপনার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি চাইতে যাবে। সে আপনার সাথে দেখা করতে আসেনি?’

‘না।’ খতীব ভীত কন্ঠে বললেন, ‘সাইফুদ্দিনের মত শয়তানের সামনে তার যাওয়া মোটেই ঠিক হবে না। তুমি তাকে গিয়ে নিষেধ করে বলো, সে যেন কিছুতেই ওখানে না যায়!’

‘ঠিক আছে, কাল ভোরেই আমি ওকে নিষেধ করে আসবো।’ বললো দারোগা। খতীবের কামরার সামনে থেকে সরে গেল দারোগা।

খতীব কোরআন শরীফে চুমু দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরলেন। আপন মনেই বললেন, ‘এখন আমি আর এই কামরায় একা নই।’

তিনি গেলাফ খুলে বাতির সামনে বসে পড়ে কোরআন শরীফের পাতা উল্টালেন। কোরআনের মধ্য থেকে একটি ছোট্ট চিঠি বের হয়ে পড়লো। সায়েকা লিখেছে, ‘আল্লাহ আমার সঙ্গে আছেন, আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনার ভক্ত জ্বীনেরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। আর পয়গাম বাহকের খবর সঠিক, আমার ঈমান সতেজ আছে!’ খতীবের মুখ খুশীতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তিনি কাগজের টুকরাটি প্রদীপের শিখায় ধরে পুড়িয়ে ফেললেন। পয়গাম বাহক বলতে যে দারোগাকে বুঝানো হয়েছে বুঝলেন তিনি। জ্বীনেরা বলতে বুঝানো হয়েছে দারোগার নিজস্ব লোকদের। যে সময় খতীব কাগজের টুকরাটি পুড়ছিলেন, ঠিক সে সময় সায়েকার দরজায় এসে নক করলো কেউ।

সায়েকা দরজা খুললো, তার হাতে প্রদীপ। বাইরে যে লোক দাঁড়িয়ে ছিল, সায়েকা তাকে চিনতে পারলো। সকালে সে তাকে দেখেছিল সাইফুদ্দিনের ওখানে। এ লোকই সাইফুদ্দিনের বডিগার্ড।

লোকটি সায়েকাকে বললো, ‘আমি আপনাকে আপনার বাবার সাথে দেখা করার জন্য নিয়ে যেতে এসেছি।’

‘কিন্তু এত রাতে আমি আবার ফিরবো কি করে?’

‘আমিই আবার আপনাকে বাড়ীতে এনে পৌঁছে দিয়ে যাবো।’

সায়েকা প্রস্তুত হয়েই ছিল, সে ওর সাথে বাড়ী থেকে রাস্তায় নেমে এলো।

বডিগার্ড বললো, ‘তুমি শুধু বাবার কুশলাদি সম্পর্কে কথা বলতে পারবে। পারিবারিক বিষয় ছাড়া অন্য কোন আলাপ করার অনুমতি নেই। তোমার আব্বার সাথে কথা বলার সময় দরোজা থেকে অন্ততঃ দুইগজ দূরে থাকবে। আর এমন কোন কথা বলবে না, যে কথা মুশালের আমীরের বিরুদ্ধে যায়।’

বডিগার্ড আগে আগে যাচ্ছিল। সায়েকা তার দুই তিনগজ পিছনে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে। অন্ধকার রাত। তারা অন্ধকার এক গলি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি মোড় ঘুরে হঠাৎ বডিগার্ড থেমে গেল।

সায়েকা জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ব্যাপার?’

সে পিছনে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি কি পিছনে কারো পায়ের শব্দ শুনতে পাওনি?’

‘না তো!’ সায়েকা বললো, ‘আমিই তো তোমার পিছন পিছন যাচ্ছি!’

‘না, আমার মনে হলো, আরও কারো পায়ের শব্দ আমি শুনতে পেয়েছি।’ বডিগার্ড আস্তে করে বললো এবং ভীত ও সন্ত্রস্তভাবে সামনে অগ্রসর হতে লাগলো।

‘এতে ভয়ের কি আছে?’ সায়েকা বললো, ‘যদি কেউ পিছে পিছে আসে তো আসুক না, সাথী হবে।’

বডিগার্ড কোন উত্তর করলো না। গলিটা শেষ হয়ে এলো। সামনে কোন বসতি নেই। ফাঁকা ময়দান ও অসমান উঁচু নিচু মাঠ। মাঠের ওপাশ থেকেই শুরু হয়েছে আবার লোকালয়। মাঠের মধ্যে ছোট্ট একটি নালা। নালার পাড় ধরে এগিয়ে চললো ওরা। ওখান থেকে কারাগার তখনো বেশ দূরে। দু’জনেই নালার পাশ দিয়ে সাবধানে এগিয়ে যাচ্ছে। নালার পাশে এখানে ওখানে ঝোপ-ঝাড় ও গাছপালা। বডিগার্ড আবারও থেমে গেল এবং পিছনে লক্ষ্য করলো। পিছনে তখনও কারো পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। সে তলোয়ার হতে পিছনে চলে গেল। দু তিনটি ঝোঁপ-ঝাড় ও তার আশেপাশে খুঁজে দেখলো, কিন্তু সেখানে কাউকেই দেখতে পেল না।

‘এবার তো তুমি পিছনে কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছো।’ বডিগার্ড সায়েকাকে জিজ্ঞেস করলো।

এবারের শব্দটা সায়েকা স্পষ্টই শুনতে পেয়েছিল। কিন্তু সায়েকা এবারও অস্বীকার করে বললো, ‘তুমি তো আচ্ছা ভীতু! কোথায় কোন খরগোশ বা জংলী প্রাণী একটু নড়াচড়া করলো আর অমনি তুমি এমন ভাব করছো, যেন ডাকাতের পাল্লায় পড়েছো।’

‘আমি যে কারনে ভয় করছি, সংকোচের কারণে সে কথা তোমাকে বলতে পারছি না।’

‘কেন কিসের ভয়? আমাকে বলতেই বা তোমার অসুবিধা কি?’

‘কোন অসুবিধা নেই।’ বডিগার্ড বললো, ‘তুমি শুধু অসামান্য সুন্দরীই নও, সেই সাথে যৌবন সুষমায় সুশোভিত এক পরিপূর্ণ যুবতী। তোমার মূল্য তুমি হয়তো নিজে বুঝতে পারছো না। পারলে এতটা নিরুদ্বিগ্ন হতে পারতে না। তোমাকে কেউ ছিনতাই করে নিয়ে গিয়ে কোন আমীরের কাছে বিক্রি করতে পারলে সে প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হয়ে যাবে। তুমি এখন আমার জিম্মায় রয়েছো। এ মুহূর্তে তুমি কিডন্যাপ হয়ে গেলে মুশালের আমীর আমাকে খুন করে ফেলবে। তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকো, পিছনে থেকো না।’

সায়েকা তার কাছে এগিয়ে গিয়ে পাশাপাশি চলতে লাগলো। মাঠ শেষে আবার পায়ে চলা পথ শুরু হলো। সংকীর্ণ পায়ে চলা পথ। এ চিকন পথ ধরেই এগুতে লাগলো ওরা। আরেকটু সামনে এগুলেই পথটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে দু’দিকে চলে গেছে।

বডিগার্ড সায়েকাকে নিয়ে দু’পথের মোড়ে পৌঁছলো। এ সময় মনে হলো পিছন থেকে কেউ দৌড়ে আসছে। ওরা আবারও থমকে দাঁড়ালো। এক লোক পিছন থেকে দৌড়ে ওদের পাশ কেটে ডান দিকের রাস্তা ধরে ছুটে গেল। বডিগার্ড তলোয়ার হাতে নিয়ে ওর দিকে মাত্র দু’কদম এগিয়েছে, হঠাৎ কেউ পিছন থেকে সায়েকাকে জাপটে ধরলো। লোকটি সায়েকার কন্ঠ রোধ করার আগে সে কোনমতে ছোট্ট একটি চিৎকার শুধু দিতে পেরেছিল।

বডিগার্ড পিছন ফিরে দেখলো, এক লোক সায়েকাকে জাপটে ধরেছে, আরেক লোক তার মুখে কাপড় গুজে দিয়ে তাকে বস্তার মত মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলেছে। বডিগার্ড সায়েকার দু’পাশে দুই লোকের ছায়া দেখে যেই সেদিকে এগুতে যাবে, ছুটে যাওয়া লোকটি ফিরে পিছন থেকে তাকে জাপটে ধরলো।

সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো আরেক লোক। সে ছুটে এসে বডিগার্ডের মুখে কাপড় গুজে দিয়ে তাকেও বস্তার ভেতর ঢুকিয়ে দিলো।

এ বডিগার্ড ছিল বেশ স্বাস্থ্যবান ও শক্তিমান। কিন্তু তাকে যারা ধরে রেখেছে, তারা সংখায় অধিক এবং তারাও শক্তিশালী হওয়ায় সে তাদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারলো না।

ওদিকে সায়েকাকে যারা ধরেছিল তারা তাকে বস্তায় পুরে বস্তার মুখ বেঁধে ফেললো। অল্পক্ষণের মধ্যে বডিগার্ডকেও অনুরূপভাবে বস্তায় পুরে বস্তার মুখ বন্ধ করে দিল।

এই অতর্কিত ও কমান্ডো স্টাইলের হামলায় দু’জনেই ধরাশায়ী হলে কমান্ডোরা তাদেরকে পিঠে তুলো নিলো।

একটুপর ওরা বড় রাস্তায় উঠে এলো। কাঁধ থেকে বস্তাবন্দী দু’জনকে মাথায় তুলে নিয়ে এগিয়ে চললো ওরা।

রাস্তায় লোক চলাচল তেমন ছিল না। যে দু’একজন অন্ধকারে ওদের পাশ কেটে গেলো তারা বুঝতেই পারলো না, মাথায় করে ওরা কি নিয়ে যাচ্ছে।

সবার অলক্ষ্যে দু’জন মানুষকে ছিনতাই করে ওরা কিছুদূর গিয়ে এক অন্ধকার গলির মধ্যে ঢুকে পড়লো।

অন্ধকার গলিপথে কিছু দূর এগিয়ে এক সংকীর্ণ বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো ওরা।

বাড়ির মধ্যে ভূতুড়ে অন্ধকার। ওরা সেই অন্ধকারের মধ্যেই ভিতরে গিয়ে সায়েকাকে এক কামরায় এবং বডিগার্ডকে কামরায় একটি কামরায় নিয়ে গেলো।

সায়েকার বস্তার মুখ খুলে দেয়া হলো। বের করে নেয়া হলো তার মুখে গুজে দেয়া কাপড়। এক লোক দ্রুত হাতে প্রদীপ জ্বালালো।

কামরার অন্ধকার দূর হয়ে গেলে সায়েকা দেখতে পেলো তার সামনে দু’জন লোক দাঁড়ানো। সায়েকা রাগে কাঁপতে কাঁপতে অনুচ্চ কন্ঠে কিন্তু দৃঢ় স্বরে বললো, ‘তোমরা একি বিশ্রী পদ্ধতি গ্রহণ করেছো?’

‘এটিই নিরাপদ পদ্ধতি।’ পাশে দাঁড়ানো দু’জনের একজন বললো, ‘রাস্তায় তোমাকে কেউ দেখে ফেললে বিপদ হতো তার চেয়ে গোপন করে আনাই সবচেয়ে নিরাপদ ও জরুরী ছিল।’

‘আমাকে আগে কেন বলোনি, তোমারা এমন পদ্ধতি গ্রহন করবে?’ সায়েকা প্রশ্ন করলো, ‘আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, এ আবার কোন ডাকাত দলের হাতে পড়লাম!’

‘কমান্ডোদের নিয়ম কানুন এমটিই হয়। আগে থেকে সবকিছু পরিষ্কার করে বলা যায় না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়।’ অন্যজন বললো।

‘তোমরা কি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলে যে, সে আমাকে কারাগারে না নিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল?’ সায়েকা প্রশ্ন করলো।

‘তুমি যখন সাইফুদ্দিনের বাড়ী থেকে বের হয়ে এসে জানিয়েছিলে দিনের বেলা নয়, রাতে তোমাকে দেখা করার সুযোগ দেবে, তখনই আমাদের মনে সন্দেহ জেগেছিল। আর সে যখন তোমাকে সোজা পথে না নিয়ে অন্ধকার ও সংকীর্ণ পথে রওনা দিলো তখন তো সন্দেহের কোন অবকাশই রইলো না।’ অন্য জন উত্তর দিল।

‘যদি সে তোমাকে সত্যিই কারাগারের দিকে নিয়ে যেতে চাইতো তবে সে এই বিজন মাঠের নালার পাশের চিকন রাস্তা ধরে এগুতো না। সে তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরেই আমাদেরকে এ পদ্ধতি গ্রহন করতে হয়েছ।’

‘সে কয়েকবারই তোমাদের পায়ের শব্দ শুনেছিল।’ সায়েকা বললো, ‘এমন অসাবধান হওয়া উচিত হয়নি তোমাদের।’

‘অন্ধকারের কারণে দূরত্ব বেশী হলে তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় ছিল। সে জন্য তোমাদের বেশী দূরে থাকার রিস্ক নিতে পারছিলাম না। তাছাড়া বাজে রাস্তা শুকনো ঘাস-পাতায় ভরা ছিল বলে সাবধানতার পরও পুরোপুরি নিঃশব্দে এগুনো সম্ভব হয়নি।’

সায়েকার চেহারা থেকে অস্থিরতার ভাব দূর হলো। সেখানে নেমে এলো স্বাভাবিক শান্তি ও স্বস্তির ভাব।

সে ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে বললো, ‘আল্লাহর হাজার শোকর, তোমাদের কারণে দুরাচার বডিগার্ডের হাতে অপহৃত ও লাঞ্ছিত হতে হয়নি। আল্লাহ তার নেক বান্দাদের এভাবেই অপমানের হাত থেকে রক্ষা করেন। তোমাদেরকে আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’

অন্য এক কামরায় বডিগার্ডকে বস্তার ভিতর থেকে বের করা হলো। তার মুখের কাপড় সরিয়ে দিলে সে দেখলো, তার সামনে তিনজন মুখোশধারী দাঁড়িয়ে আছে। তার তলোয়ারটি এক মুখোশধারীর হাতে।

‘কে তোমরা?’ বডিগার্ড খুব দাপটের সাথে জিজ্ঞেস করলো, ‘জানো, আমি মুশালের আমীরের স্পেশাল বডিগার্ড! তোমাদের এ বেয়াদবীর জন্য কঠিন শাস্তি পেতে হবে। ডাকাতি করার আর জায়গা পাও না?’

‘মুশালের আমীরের বডিগার্ড!’ এক মুখোশধারী হেসে বললো, ‘আল্লাহ কারো মৃত্যুর ফায়সালা করলে কেউ তা ঠেকাতে পারে না। আমীরকে রক্ষা করার চিন্তা বাদ দিয়ে এখন নিজেকে রক্ষা করার কথা ভাবো। সত্যি করে বলো, এই মেয়েটাকে ভাগিয়ে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলে?’

‘কারাগারে তার বাবার সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাচ্ছিলাম।’ বডিগার্ড উত্তর দিল, ‘এ মেয়েকে অপহরণ করে তোমরা কিছুতেই হজম করতে পারবে না। তোমরা জানো না, এ মেয়ে খতীব ইবনে মাখদুমের কন্যা। মুশালের আমীর গাজী সাইফুদ্দিন তার জন্য নিজের ব্যক্তিগত বডিগার্ডকে পাঠিয়েছেন। তোমরা একটু চিন্তা করে দেখো, এ মেয়ে নিখোঁজ হয়ে গেলে মুশালের আমীর প্রতিটি ঘরে ঘরে তল্লাশী চালাবে। তোমরা ওকে নিয়ে শহর থেকে বের হতে পারবে না। একটু পরই এ মেয়ে ও আমার নিখোঁজ সংবাদ জেনে যাবেন মুশালের আমীর। যখন সারা শহর ঘেরাও করে তাকে উদ্ধার করা হবে তখন তোমাদের কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছো?’

‘শোন বন্ধু!’ এক মুখোশধারী বললো, ‘এ মেয়েকে কেউ অপহরণ করেনি। সে নিখোঁজও হয়নি, বরং নিখোঁজ হওয়া থেকে বেঁচে গেছে। আমারা জানি, এ মেয়ে মুশালের আমীর সাইফুদ্দিনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এও জানি, তার অনুসন্ধানে প্রয়োজনে মুশালের আমীর কেবল নিরাপত্তা বাহিনীকে নয়, সেনাবাহিনীকেও ব্যবহার করবে। কারণ এ মেয়ে অসাধারণ সুন্দরী এবং পরিপূর্ণ যুবতী। আর কোন সুন্দরীর প্রতি তার চোখ পড়লে সে মেয়ের নিস্তার নেই।’

‘এ মেয়ে নিখোঁজ হওয়া থেকে বেঁচে গেছে বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছো তোমরা?’

‘আমারা জানি, তার বাবা কারাগারে বন্দী। সাইফুদ্দিনকে তিনি ধিক্কার দিয়েছিলেন বলেই তাঁর আজ এ অবস্থা। সাইফুদ্দিন বড় ধুরন্ধর ব্যক্তি। বাবাকে কারারুদ্ধ করে মেয়েকে তিনি বাবার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছেন শর্ত সাপেক্ষে। বলেছেন, তাকে কারাগারে নিয়ে যাবে তাঁরই পাঠানো বডিগার্ড।’

‘হ্যাঁ, বলেছেন। এতে অন্যায়টা কি হলো? একজন যুবতী মেয়ে রাতের অন্ধকারে একলা চলাফেরা করবে, এটা তিনি ঠিক মনে করেননি বলেই আমাকে পাঠিয়েছেন। একজন প্রজা, তাও আবার অবলা নারী! তার নিরাপত্তার চিন্তা করা অপরাধ?’

‘না, তা অপরাধ নয়। কিন্তু তিনি সাক্ষাতের সময়টি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন রাতে! তুমি কি বলতে পারো, সাক্ষাতের সময় দিনে কেন করা হয়নি?’

চুপ করে রইলো বডিগার্ড, এ প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না।

এক মুখোশধারী বললো, ‘আমরা যখন শুনতে পারলাম খতীব মাখদুমের কন্যাকে রাতের বেলা বাবার সাথে দেখা করার অনুমতি দিয়েছে সাইফুদ্দিন এবং তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠাবে, তখনই আমাদের সন্দেহ হয়, এর মধ্যে কোন ঘাপলা আছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা তার হেফাজতের জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করে নিলাম।

তুমি প্রথমেই তাকে নিয়ে ভুল রাস্তায় রওনা দিয়েছিলে। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের পিছু নিই। তুমি দু’তিনবার পিছনে যে পদধ্বনি শুনেছো, সেগুলো আমাদেরই ছিল। তুমি যাদের ঝোঁপ-ঝাড়ে খুঁজেছিলে, সে লোকই আমরা। তুমি জানো না, আমরা দিনের আলোতেও কারো দৃষ্টিগোচর হই না।’

‘এটা তোমাদের অমূলক সন্দেহ।’ বডিগার্ড বললো, ‘আমি তাকে তার বাবার কাছেই নিয়ে যাচ্ছিলাম। তোমরা বস্তাবন্দী করে ধরে এনে মেয়েটির ওপর খুব অত্যাচার করেছো!’

‘মিথ্যে কথা, তুমি ধোঁকা দিয়ে ওকে ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলে!’ এক মুখোশধারী তার গর্দানে তলোয়ার ঠেকিয়ে বললো, ‘তুমি তাকে সাইফুদ্দিনের জন্য চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলে না? আমরা জানি, তোমার মালিক কেমন মানব দরদী লোক! যে ব্যক্তি খতীবের মত সৎ ও আল্লাহ ভীরু লোককে কারাগারে পাঠাতে পারে, রাতের অন্ধকারে সে কোন মহৎ উদ্দেশ্যে তার কন্যাকে ঘর থেকে বের করেছে, তা বুঝবো না, এতটা আহম্মক নই আমরা।

তুমি ভাল করেই জানো, খতীবকে কেন বন্দী করা হয়েছে। কিন্তু জানো না, খতীব একাই জেহাদের এই প্রেরণার ধারক নন, মুশালের অসংখ্য মুজাহিদের অন্তরে দাউ দাউ করে জ্বলছে জেহাদের আগুন।

তোমরা মনে করেছো, তিনি কারাগারে, অতএব তার মেয়ে একা। তোমাদের এ ধারনাও ভুল। আমি তোমাকে আরো জানিয়ে দিতে চাই, ইসলামের অগ্রযাত্রায় বাঁধা দিতে এলে আমারা সাইফুদ্দিনের সাধের গদি উল্টে দিতেও দ্বিধা করবো না।

তার পতনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমরা তাকে যে কোন মুহুর্তেই হত্যা করতে পারি। কিন্তু সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আমাদের কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন, হাসান বিন সাব্বাহের ফেদাইনদের মত গোপনে চোরের মত কাউকে হত্যা করো না। তিনি গুপ্তহত্যা পছন্দ করেন না বলেই তোমরা এখনো বেঁচে আছো।’

‘বুঝেছি, তোমরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গুপ্তচর!’ বডিগার্ড বললো।

‘হ্যাঁ!’ মুখোশধারী উত্তর দিল, ‘আমরা তার কমান্ডো বাহিনী!’ সে তলোয়ারের মাথা তার গর্দানে একটু দাবিয়ে ধরলো, বডিগার্ড পিছাতে পিছাতে দেয়ালের সাথে গিয়ে ঠেকলো।

মুখোশধারী বললো, ‘তুমি সাইফুদ্দিনের স্পেশাল বডিগার্ড, আর সব সময় তার সাথেই থাকো। তুমি তার সমস্ত গোপন তথ্য জানো। আমরা জানি, মেয়েদেরকে ভাগিয়ে নিয়ে তুমি সাইফুদ্দিনের হাতে তুলে দাও।

বাঁচতে চাইলে বলো, সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সে কি কি পরিকল্পনা করেছে? যদি বলতে অস্বীকার করো, বা যদি বলো আমি তার কিছুই জানি না, তবে তোমার অবস্থা ঠিক তাই হবে, যেমন সাইফুদ্দিনের কারাগারে কয়েদীদের অবস্থা হয়।’

‘যদি তোমরা প্রকৃতই সৈনিক হয়ে থাকো, তবে ভাল মতই জানো, বাদশা ও আমীরের কাছে একজন সাধারণ সৈনিকের কি মূল্য মূল্য থাকে।’ বডিগার্ড বললো, ‘আমি কোন সেনাপতি বা কমান্ডার নই, তার পরিকল্পনার কথা আমি কেমন করে জানবো?’

এক মুখোশধারী তার মাথার ক্যাপ ফেলে দিয়ে মাথার চুল ধরে জোরে টান মারলো। একদিকে কাত হয়ে পড়লো বডিগার্ড, অন্যজন তার পা ধরে এমন জোরে টান মারলো, সে সটান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো।

মুখোশধারীদের একজন তার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে গেল এবং বুকে এমন জোরে লাথি মারতে লাগলো, বডিগার্ডের দাঁতে দাঁত বাড়ি খেলো। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে থামলো লোকটি।

একটু দম ফেলার ফুসরত পেতেই বডিগার্ড বলে উঠলো, ‘বলবো, বলবো! আমি যা জানি সব তোমাদের বলে দেবো। আমাকে একটু সুযোগ দাও, উঠে বসতে দাও আমাকে!’ তার কন্ঠে কাতর অনুনয়। তাকে ধরে বসানো হলো।

মুখোশারীদের একজন বললো, ‘বলো, তুমি কি বলতে চাও? সাইফুদ্দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে যা জানো সব খুলে বলো।’

বডিগার্ড বললো, ‘সাইফুদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর সাথে লড়াই করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’

‘এটা কোন গোপন তথ্য হলো না।’ এক মুখোশধারী বললো, ‘আমারা জানতে চাচ্ছি, কবে ও কিভাবে সে যুদ্ধ যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে? সে কি হলব ও হারানের সাথে ঐক্যজোটে যোগ দিচ্ছে, নাকি একাই যুদ্ধ করবে?’

‘তিনি ওদের সাথে যোগ দেবেন।’ বডিগার্ড বললো, ‘কিন্তু তিনি এমন চালে যুদ্ধ করবেন, তার বাহিনীকে তিনি আলাদা রাখবেন এবং বিজয়ের পর তার বাহিনীর দখলে যেটুকু এলাকা থাকবে তার কর্তৃত্ব তিনি নিজ হাতে গ্রহণ করবেন। হলব ও হারানের লোকদের ওপর তার কোন ভরসা নেই, তিনি তার বাহিনীকে ওদের সাথে একাকার হতে দেবেন না।’

‘তার সেনাপতিদের তিনি কি নির্দেশ দিয়েছেন?’ এক মুখোশধারী জিজ্ঞেস করলো।

‘তিনি পরিকল্পনা নিয়েছেন, সুলতান আইয়ুবীকে তিনি পাহাড়ী অঞ্চলেই অবরোধ করবেন।’ বডিগার্ড উত্তর দিলো।

‘কোন রাস্তা ধরে অভিযানে বেরুবে সেনাবাহিনী?’

‘হিম্মাতের পর্বত শৃঙ্গ দিয়ে।’

‘তিনি কি খৃস্টানদের সাথে এ ব্যাপারে কোন চুক্তি করেছেন?’

‘হ্যাঁ, খৃস্টানদের সাথেও তার চুক্তি হয়েছে।’ বডিগার্ড উত্তর দিল, ‘তবে সাইফুদ্দিন তাদেরও প্রবঞ্চিত করবে বলে মনে হয়।’

‘কোন খৃস্টান সৈন্য বা উপদেষ্টা কি তার ওখানে আছে?’

‘হ্যাঁ, ক্রুসেডদের কয়েকজন কমান্ডার তার সেনাবাহিনীকে ট্রেনিং দিচ্ছে।’

পাশের অন্য এক কামরায় সায়েকার সাথে কথা বলছিল সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী গোয়েন্দা বাহিনীর দুই লোক। খতীব ইবনুল মাখদুমের সাথে তাদের আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল।

দৃশ্যঃত তিনি মুশালের খতীব হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন তাদের নেতা। তাঁরই নির্দেশনায় এ দলটি এখানে গোয়েন্দা কাজে লিপ্ত ছিল এবং এদের প্রত্যেকেই কমান্ডো ট্রেনিংপ্রাপ্ত।

এরাই ছিল সুলতান আইয়ুবীর চোখ ও কান। এদের মাধ্যমে দুশমনের প্রতিটি নড়াচড়া তিনি দেখতে পেতেন।

মুশাল থেকে সব সংবাদ ওরা দ্রুত সুলতান আইয়ুবীর সামরিক হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে দিত।

প্রকাশ্যে ওরা মুশালে চাকরী, দোকানদারী এবং এ ধরনের নানা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।

খতীব কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই ওরা পালা করে দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা খতীবের বাড়ীতে পাহারা দিতে শুরু করে। যে মেয়েরা রাতে সায়েকাকে একা ভেবে তার বাড়ীতে থাকতে এসেছিল এবং রাতে ঘরের বাইরে এসে তারা যাদের ছায়া নড়াচড়া করতে দেখেছিল, সায়েকা তাদের জ্বীন বলে পরিচয় দিলেও ওরা ছিল আসলে এই কমান্ডো বাহিনীর সদস্য।

এরা সমস্ত সংবাদ রাখতো। সায়েকা যে তার বাবার সাথে দেখা করার অনুমতি নিতে সাইফুদ্দিনের কাছে গিয়েছিল এটা যেমন জানতো, তেমনি সায়েকা ফিরে আসার পর তার কাছ থেকে ওরা জেনেছিল, সাইফুদ্দিন তার সাথে অশালীন কথা বলেছে এবং তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে।

কমান্ডোরা বুঝতে পেরেছিল, রাতে সায়েকাকে বাড়ী থেকে বের করতে পারলে ওরা তাকে অন্য কোন দিকে নিয়ে গিয়ে গায়েব করে দেবে।

সুতরাং তারা পাঁচজন সন্ধ্যার পর সায়েকার বাড়ীর পাশে এসে ওঁৎ পেতে থাকে। সায়েকা সাইফুদ্দিনের বডিগার্ডের সাথে রওনা দিলে ওরা তাদের পিছু নেয়।

কিছুদূর এগুনোর পর তাদের সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হলো। ওরা সময় নষ্ট না করে অত্যন্ত সাফল্যের সাথেই সায়েকাকে উদ্ধার করে এ গোপন আস্তানায় নিয়ে এসেছে।

বাড়তি লাভ হিসাবে পেয়েছে বডিগার্ডকে। কারণ এ বডিগার্ড সাইফুদ্দিনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী এবং সকল অপকর্মের দোসর। সাইফুদ্দিনের গোপন বিষয় সে যতটুকু জানে, দুনিয়ার আর কেউ ততটা জানে না।

তারা একের পর এক প্রশ্ন করে বডিগার্ডের কাছ থেকে আরো অনেক গোপন তথ্য আদায় করে নিলো। তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্যটি মনে হলো, তাহলো, সাইফুদ্দিন তার সেনাবাহিনীকে দু’ভাগে বিভক্ত করে এক অংশ নিজের নেতৃত্বে রেখেছে, আর অপর অংশ তার ভাই আজীম উদ্দিনের নেতৃত্বে দিয়েছে।

সৈন্যদের এ দলটি মূল দলের সাথে না থেকে আলাদা থাকবে এবং প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করে প্রয়োজনের সময় অতর্কিতে তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবে।

আক্রমণের নেতৃত্ব দেবে সাইফুদ্দিন নিজে এবং তিনিই প্রথম আক্রমণ করবেন।

গার্ড আরো জানালো, ‘হলব থেকে গুমাস্তগীন ও সাইফুদ্দিনের কাছে দূত এসেছে। তিন বাহিনীর সম্মিলিত কমান্ড গড়ে তোলার জন্য আহবান জানিয়েছে খলিফা আল মালেকুস সালেহ। তারা খৃস্টানদের সহযোগিতা নেবে ঠিকই, কিন্তু তাদের ওপর বেশী ভরসা ও নির্ভর করবে না।’

বডিগার্ড এ সকল তথ্য অনর্গল বলে গেল শুধু মুক্তি পাওয়ার আশায়। কিন্তু আইয়ুবীর কমান্ডোরা তাকে মুক্তি দেয়ার পরিবর্তে তাকে তার রুমে আটকে রেখে সবাই এসে জড়ো হলো সায়েকার কামরায়।

সায়েকা বললো, ‘এখন কি করতে চাও?’

কমান্ডোদের দলনেতা বললো, ‘আপাততঃ তুমি এখানেই থাকো। এখন কোন মতেই তোমার বাড়ী যাওয়া উচিৎ হবে না।’

কমান্ডোরা সায়েকাকে এবং বডিগার্ডকে যার যার কামরায় রেখে বাইরে দিয়ে দরজা আটকে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।