পরের দিন ফাতেমাকে দামেশকে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তার সাথে পাঠানো হলো গুমাস্তগীনের দরবারে আল মালেকুস সালেহ প্রেরিত মেয়ে দু’টিকে। তাদের সঙ্গী হলো সেনাপতি শামস বখত ও সাদ বখতের পাঠানো তাদের সঙ্গী সেই দুই ব্যক্তি।
তারা সুলতান আইয়ুবীকে হারানে কি ঘটেছে তা সবিস্তারে বললেও তাদের জানা ছিল না, তাদের দুই প্রিয় সেনাপতি ধরা পড়েছে এবং তারা এখন গুমাস্তগীনের কারাগারে বন্দী।
মেয়ে দু’জন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিল সুলতানকে। তারা খৃস্টানদের পরিকল্পনা, খলিফা আল মালেকুস সালেহের দরবারে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে কি তৎপরতা চলছে তার বিশদ বিবরণ তুলে ধরলো সুলতানের কাছে।
‘আপনি কি জানেন, ফিলিস্তিনের মুসলমানরা আপনার পথ পানে চেয়ে আছে?’ একটি মেয়ে বললো, ‘সেখানে মেয়েরা আপনার নামে গান গায়। মসজিদে আপনার সাফল্যের জন্য দোয়া করা হয়।’
তারা খৃস্টান অধিকৃত এলাকার মুসলমানদের দুর্দশার মর্মন্তুদ বর্ণনা দিয়ে বললো, ‘খৃস্টানরা তাদের বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে। তাদের জন্য দেশটাকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছে।’
‘সেখানে আমাদের সম্ভ্রমই শুধু বিপন্ন নয়, আমাদের শিশুদের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন।’ অন্য মেয়েটি বললো।
‘আমাদের দুর্ভাগ্যের জন্য আমি শুধু ওদেরই দায়ী করবো না, আমি বলবো, আমাদের জাতির মান সম্মান ও জাতীয় চেতনা বিনষ্ট করছে আমাদের আমীর ওমরাগণ! আমি আমাদের আমীরেরই প্রেরিত উপহার!
আমি তাদেরকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলেছিলাম, আমরা আপনার জাত বোন, আপনার মতই আরেক মুসলমানের কন্যা। কিন্তু তিনি একটি কথাও শুনলো না। তারা আমাদেরকে বাজারের পণ্য সামগ্রীর মত এক অন্যের কাছে উপহার পাঠাতে লাগলো।’ মেয়েটি বললো, ‘ফিলিস্তিনের মুক্তির পথেও তারাই আসল বাধাঁ।’
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি ফিলিস্তিন পৌঁছার জন্যই তো বের হয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভাইয়েরাই আমার রাস্তা বন্ধ করে বসে আছে!’
তিনি আরো বললেন, ‘তোমরা এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ! এখানে একটি মেয়ে এসেছে। তাকে দামেশকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমরাও তার সঙ্গে দামেশকে চলে যাও।’
‘আমি আমার ইজ্জত লুন্ঠনের বদলা নেবো!’ এক মেয়ে বললো, ‘আপনার কাছে আমার আকুল আবেদন, দয়া করে আমাকে দামেশকে পাঠাবেন না। আমাকে এখানেই রেখে দিন আর আমাকে কোন কাজ দিন। কোন হেরেমে কিংবা বাড়ীতে গিয়ে দুঃসহ স্মৃতির দহনে ধুকে ধুকে মরত চাই না আমি।’
‘এখনও আমরা বেঁচে আছি!’ সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বললেন, ‘তুমি দামেশকে চলে যাও। সেখানে তোমাকে কেউ অবজ্ঞা বা অসম্মান করবে না। সেখানে মেয়েরা ইসলামের স্বপক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তাদের সে কাজ ও দোয়া আমাদের অগ্রযাত্রায় বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে। ইসলামের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন কেবল সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিপ্লব। প্রয়োজন ইসলামের সঠিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার। তুমি সেখানে চলে যাও, কোন না কোন দায়িত্ব তুমি অবশ্যই পেয়ে যাবে।’
মেয়েরা বিদায় নিল সুলতানের কাছ থেকে। আইয়ুবী বেদনামাখা চোখে তাকিয়ে রইলেন ওদের গমন পথের দিকে।
মেয়েরা বিদায় হয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবীর কানে তখনো বাজছে মেয়েদের বলে যাওয়া করুণ কাহিনীর অসহ্য বিলাপ ধ্বনি। মেয়ে দুটির হৃদয়ের রক্তক্ষরণ তিনি যেন চাক্ষুস দেখতে পাচ্ছেন!
বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। অস্থিরভাবে পায়চারী করতে লাগলেন এদিক-ওদিক।
হাসান বিন আবদুল্লাহ বেদনার্ত চোখে তাকিয়েছিলেন সুলতানের দিকে। সুলতানের কষ্ট ও মর্মযাতনা তিনি বুঝতে পারছিলেন, কিন্তু চুপ করে দেখে যাওয়া ছাড়া তার আর করার কিছুই ছিল না।
এক সময় পায়চারী থামিয়ে হাসানের কাছে এসে বললেন, ‘বসো হাসান। বলো কি বলতে চাও?’
উভয়ে মুখোমুখি বসলেন। সুলতান আইয়ুবীর দিকে তাকিয়ে হাসান বললো, ‘মিশর থেকে এখনও কোন সাহায্য এসে পৌঁছালো না! যদি তিনটি বাহিনী এক সাথে আক্রমণ করে বসে তবে আমাদের বিপদ হয়ে যাবে। মনে হয়, শত্রুরা জানে না, আমাদের সৈন্য সংখ্যা কম, আর আমরা সাহায্যের আশায় বসে আছি!’
‘আল্লাহই মুমীনদের মুহাফিজ। এই কঠিন শীতে বরফের রাজ্যে পাহাড় চূড়ায় কি জন্য বসে আছি আমরা? একমাত্র তার দ্বীনের বিজয়ের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ তার মুখলেছ বান্দাদের কখনো নিরাশ করেন না। নিশ্চয় মিশর থেকে সাহায্য চলে আসবে। তকিউদ্দিন একটু আবেগী, কিন্তু দায়িত্বহীন নয়। আচ্ছা, তুমি ঠিক করে বলো তো, পথে কোন বাঁধা নেই তো!’
‘না সুলতান, আমি জানি, শত্রুরা কোথাও ওঁৎ পেতে বসে নেই। গোয়েন্দারা জানিয়েছে, আমাদের ফৌজ আসার পথে কোথাও কোন বাধা নেই।’ বললো হাসান বিন আবদুল্লাহ।
ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, এই অসহনীয় সংকটময় মুহূর্তে সুলতান আইয়ুবী খুবই উৎকন্ঠা ও পেরেশানীর মধ্যে সময় কাটাচ্ছিলেন। তিনি প্রতিটি মুহূর্ত কাটাচ্ছিলেন মিশর থেকে সৈন্য সাহায্য আসার অপেক্ষায়।
যদি সে সময় আল মালেকুস সালেহ, সাইফুদ্দিন ও গুমাস্তগীনের সম্মিলিত বাহিনী তার ওপর আক্রমণ করে বসতো, তবে বলা যায় না, হয়তো তারা তাঁকে পরাজিত করতে পারতো। কারণ তাঁর কাছে সৈন্য ছিল নিতান্তই কম। মরুভূমিতে যেভাবে ঝটিকা আক্রমণ করা যায় পার্বত্য অঞ্চলে সে চাল চালানোও ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু শত্রুরা তাঁর এ অবস্থা হয়তো জানতো না।
খৃস্টানরা তাঁর ওপর আক্রমণ করার পরিবর্তে মুসলিম শাসকদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের দিয়ে যুদ্ধ চালানোর পাঁয়তারা করছিল।
সুলতান আইয়ুবী এ সকল অবস্থায় আল্লাহর কাছে কায়মানোবাক্যে কেবল এ দোয়াই করছিলেন, ‘আয় আল্লাহ, তোমার গায়েবী মদদ দিয়ে আমাদের সাহায্য করো। এই সংকটময় অবস্থায় যেন শত্রুরা আক্রমণ করে না বসে তুমি সে ব্যবস্থা করে দাও।’
মনে হয় আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করছিলেন। শত্রুরা তখনো কেবল প্রস্তুতিই নিচ্ছিল, কিন্তু হামলা করতে কেউ এগিয়ে এলো না।
সুলতান আইয়ুবীর অস্থিরতা এতো বেড়ে গিয়েছিল যে, তিনি রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারতেন না। যেসব জায়গায় তিনি তাঁর সৈন্য সমাবেশ করে রেখেছিলেন, রাতেও সে সব স্থানে টহল দিয়ে বেড়াতেন। লক্ষ্য করতেন, তাঁর এই অল্প সংখ্যক সৈন্য কেমন সতর্ক ও সাহসিকতার সাথে ডিউটি করছে। তাদের দেখে তাঁর মনে এই আশা ও বিশ্বাস জাগতো, সৈন্য কম হলেও এই বাহিনী শত্রুদের গতি রোধ করে দিতে পারবে।
কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ লিখেছেন, ‘সুলতান ইউসুফ সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ওপর তখন চরম বিপদ আপতিত। যদি আল্লাহ শত্রুদের সফলতা মঞ্জুর করতেন, তবে শত্রুর দল সালহউদ্দিন আইয়ুবীকে অসহায় অবস্থার মধ্যে আক্রমণ করে বসতো। কিন্তু আল্লাহ যাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করতে চান সে অবশ্যই লাঞ্ছিত হবে (আল-কোরআন-৮/৪৩)।
তারা সুলতান আইয়ুবীকে এমন সময় সুযোগ দিয়ে রেখেছিল যে, মিশর থেকে নিরাপদেই আইয়ুবীর সৈন্য সাহায্য এসে পৌঁছলো। সুলতান আইয়ুবী সেই সৈন্যদের নিজের বাহিনীর সঙ্গে একীভুত করে নিলেন। তাদেরকে যুদ্ধের নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করলেন। নতুন পরিবেশে যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও কৌশল শিখিয়ে দিলেন।
হিম্মাত পর্বত শ্রেণীর মাঝে দু’টি শৃঙ্গ দানবের মত দু’দিক খাড়া ছিল। আইয়ুবী তাকে শত্রুদের জন্য একটি ফাঁদ বানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এর দ্বারা শুধু প্রতিরক্ষা করা সম্ভব ছিল, আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। শত্রুদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার পর পরই যে প্রতি আক্রমণ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে সে সুযোগ তাঁর চোখে পড়ছে না।
তাঁর গোয়েন্দা বিভাগ তাঁকে জানিয়ে দিয়েছে, খৃস্টানরা চেষ্টা করছে, নিজেরা আক্রমণে না এসে মুসলমান শাসকদের ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাতে।
তারা যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী করতে আগ্রহী। তারা চাচ্ছে, সুলতান আইয়ুবীকে পাহাড়ী এলাকায় অবরোধের মধ্যে আটকে রাখতে। সুলতান যেন আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হন।
কিন্তু গোয়েন্দা বিভাগের কাছ থেকে তিনি এ সংবাদ পাননি, নয়জন ফেদাইন গুপ্তঘাতক তাঁকে হত্যা করতে আসছে।
তাঁর দৃষ্টি সব সময় যুদ্ধর ময়দানের দিকেই ছিল। নিজের প্রাণের মায়া তার কখনোই ছিল না, নিজেকে রক্ষার কোন খেয়ালও ছিল না তার। তিনি পরিস্থিতি দেখার জন্য দূর দূরান্ত পর্যন্ত লোক পাঠিয়ে রেখেছিলেন।
দু’দিন পর। হারান থেকে সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা এলো। সে এসে সংবাদ দিল, সেনাপতি শামস বখত ও সেনাপতি সাদ বখত ধরা পড়ে গেছে এবং এখন তারা গুমাস্তগীনের কারাগারে বন্দী। তাঁরা কাজী ইবনুল খাশিবকে হত্যা করেছে।’
‘কাজীকে ওরা হত্যা করলো কেন?’ জানতে চাইলেন সুলতান।
কাজীকে কেন ওরা খুন করলো সে কারণ গোয়েন্দা বলতে পারলো না।
সুলতান আইয়ুবীর চেহারার রং ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন গূঢ় কারণ আছে!’
এ দুই ভাইয়ের সাথে সুলতানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তিনি তাঁদের নিয়ে অনেক আশা করতেন। তিনি জানতেন, গুমাস্তগীনের বাহিনীর কমান্ড ওঁদের দুই ভাইয়ের হাতেই থাকবে আর তাদের বাহিনী ময়দানে এসে যুদ্ধ করার পরিবর্তে আত্মসমর্পণ করে ফেলবে।
তিনি গোয়েন্দাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে এখন গুমাস্তগীনের বাহিনীর কমান্ড করবে কে?’
গোয়েন্দা জানালো, ‘সম্মিলিত বাহিনীর আওতায় এখন গুমাস্তগীনের সৈন্যদের কমান্ড তিনি নিজেই করবেন।’
‘হাসান বিন আবদুল্লাহ!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এ দুই ভাইকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনতে হবে। বর্তমানে হারানে কি পরিমান স্পাই আছে ভাল করে খোঁজ নাও। তারা কি সেনাপতি দুই ভাইকে কারামুক্ত করে আনতে পারবে?’
তিনি আরো বললেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে, গুমাস্তগীন এদের মৃত্যুদন্ড দিয়ে দেবে। কারণ, সে তো জেনেই গেছে, এ দুই ভাই আমার গোয়েন্দা! আমার ইচ্ছে হচ্ছে, আমি এক্ষুণি গিয়ে হারান অবরোধ করি এবং কেল্লা অধিকার করে তাদেরকে মুক্ত করে আনি।
এ দুই সেনাপতিকে বাঁচানোর জন্য যদি দু’শো কমান্ডোও শহীদ হয়ে যায়, তাতেও আমার আপত্তি নেই। হারানে যদি আমাদের লোক সংখ্যা কম থাকে তবে এখান থেকে কমান্ডোদের জলদি পাঠিয়ে দাও। মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার আগেই ওদের মুক্ত করে আনতে হবে।’
‘অবশ্যই। আমি এখুনি সে ব্যবস্থা নিচ্ছি!’ বললো হাসান বিন আবদুল্লাহ।
হলব প্রদেশ সুলতান আইয়ুবীর বিরোধীদের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়েছিল। সে কারণে খৃস্টানদের পাঠানো তীর-ধনুক, গোলা-বারুদ ও ঘোড়ার বহর সাহায্য হিসেবে হলবেই গিয়ে পৌঁছতে লাগলো।
খৃস্টানরা হলববাসীদের মধ্যে যে আবেগ অনুভূতি দেখেছিল, হলববাসী সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যেভাবে প্রাণপণ লড়াই করে সুলতান আইয়ুবীর অবরোধের মোকাবেলা করেছিল, তাতে তারা ছিল উৎফুল্ল। তাছাড়া ভৌগলিকভাবেও হলব ছিল বিরোধী মহলের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি।
এদিকে মুশালে সাইফুদ্দিন ও হারানে গুমাস্তগীনকেও খৃস্টানরা রসদ সামগ্রী পাঠালো সাহায্য হিসাবে। সবাইকে খবর পাঠালো জলদি হলবে গিয়ে একত্রিত হতে।
তিন বাহিনী হলব শহরের বাইরে এক মুক্ত মাঠে একত্রিত হলো। তিন বাহিনী প্রধানের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হলো, তবে তার কোন লিখিত রূপ ছিল না। চুক্তির একমাত্র স্বাক্ষী ছিল খৃস্টান উপদেষ্টারা।
সে রাতে মুশালের কারাগারে খতীব ইবনুল মাখদুম প্রদীপের আলোয় বসে কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন।
তার মেয়ে সায়েকা তখনো সেই কামরায়, যেখানে তাকে বস্তাবন্দী করে এনে রাখা হয়েছিল। বাড়ীতে মাত্র ওরা দু’জন, সায়েকা ও গুমাস্তগীনের সেই বডিগার্ড, যে তাকে গুমাস্তগীনের নির্দেশে উঠিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিল।
যারা তাদেরকে ধরে এখানে নিয়ে এসেছে সেই কমান্ডোদের দু’জন বাড়ির পাহারায় রইলো, বাকীরা বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।
অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ওরা গিয়ে পৌঁছলো কারাগারের ওখানে। কারাগারের দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়ালো কমান্ডোরা।
কারাগারের দেয়াল যথেষ্ট উঁচু এবং প্রশস্ত। গেটে প্রহরী মোতায়েন। প্রাচীরের উপরেও প্রহরীরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে, যদিও তাদের সংখ্যা বেশী নয়।
কারাগারের সেই দারোগা, যে খতীবকে মুক্ত করে দিতে অঙ্গীকার করেছিল, সে প্রাচীরের উপরে চলে গেল। প্রহরীদের ডিউটি চেক করার উসিলায় প্রহরীদেরকে ডেকে একদিকে সরিয়ে নিয়ে গেল। তারপর দারোগা টহলরত প্রহরীদের সাথে আলাপ জুড়ে দিল।
এই ফাঁকে নিচে লুকিয়ে থাকা কমান্ডোরা রশি ছুঁড়ে দিল প্রাচীরের ওপর। রশির এক মাথায় লোহার আংটা বাঁধা ছিল। কিন্ত তাতে জড়ানো ছিল কাপড়, যাতে প্রাচীরে আঘাত লেগে বেশী শব্দ না হয়। আংটা উপরে গিয়ে কোথাও আটকে গেল। একে তো অন্ধকার, অন্যদিকে দারোগা প্রহরীদেরকে ডেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ওরা কিছুই টের পেলো না।
চারজন কমান্ডো রশি বেয়ে উপরে উঠে গেল। উপরে উঠে রশি টেনে তুলে ভেতরের দিকে ফেলে সেই রশি ধরে তর তর করে নেমে গেল নিচে।
দারোগা আগেই তাদের হাতে কারাগারের অভ্যন্তরের নকশা এঁকে দিয়েছিল। প্রাচীরের পর বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা। তারপর কারাগারের অফিস কক্ষ, বন্দীদের থাকার কামরা, নির্যাতন সেল এইসব।
অফিসের সামনে এবং আরো বেশ কয়েকটি জায়গায় মশাল জ্বলছিল। এতে কারাগারের ভেতরটায় নজর বুলানো এবং চলাচল সহজ হয়ে গেল ওদের জন্য।
মশালের চাপ চাপ আলো-আঁধারীর ভেতর দিয়ে বন্দীখানার দিকে এগিয়ে চললো চারজন। সকলেই হাতে খঞ্জর বের করে নিয়েছে। লাইন ধরে এগিয়ে গেল ওরা এবং বন্দীখানার বারান্দায় পৌঁছে গেল।
ওখানে পৌঁছেই ওরা দেখতে পেলো, একজন প্রহরী টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। চারজনই দেয়ালের সাথে সেঁটে গিয়ে অন্ধকারে নিজেদের লুকিয়ে ফেললো।
প্রহরী বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাদের কাছে চলে এলো। প্রহরী হয়তো তাদের পার হয়েই চলে যেতো, কিন্তু শেষ মাথায় যে কমান্ডো ছিল সে তার সামনে এগিয়ে এসে বললো, ‘এদিকে এসো তো ভাই!’
হঠাৎ অন্ধকার থেকে একজন লোককে তার সামনে আসতে দেখে সে প্রথমে মনে করলো অন্য কোন প্রহরী কোন কাজে এদিকে এসেছে।
সে ‘কি ব্যাপার?’ বলে সবে একটি পা তুলেছে তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, পেছন থেকে দু’জন এসে জাপটে ধরলো তাকে এবং সে কিছু বুঝে উঠার আগেই দু’টি খঞ্জর আমুল ঢুকে গেল তার বুকে। খঞ্জর দু’টি এমন জায়গায় বিদ্ধ হলো, অবাক হওয়ারও সময় পেল না লোকটি, তার আগেই মারা গেল।
চারজনই দ্রুত সামনে অগ্রসর হলো। একজন আগে, বাকীরা তার পিছনে।
তারা অগ্রসর হতে হতে কারাগারের অন্য একটি অংশে এসে গেল। সামনে একটি গোল চত্বর, তারপর আবার শুরু হয়েছে বন্দীদের থাকার কামরা।
এ গোল চত্বরটি পার হওয়ার পর যে কামরাগুলো শুরু হয়েছে তারই তৃতীয় কামরাটিতে আছেন খতীব।
সামনের কমান্ডো কামরার কাছে পৌঁছে গেল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো, তিনি কোরআন তেলাওয়াত করছেন।
সে ছোট্ট করে একটু গলা খাকারি দিল। খতীব কোরআন পাঠ বন্ধ করে তাকালেন জানালা পথে। দেখলেন ওখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি কোরআন গুটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
দারোগার মাধ্যমে সেলের একটি ডুপ্লিকেট চাবি কমান্ডোরা আগেই সংগ্রহ করে রেখেছিল। সে তাড়াতাড়ি তালায় চাবি ঢুকিয়ে চাপ দিল, সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল তালা। খতীব খোলা দরজা দিয়ে কামরার বাইরে এসে দাঁড়ালেন।
এ সময় কারো দৌড়ে আসার পদধ্বনি শোনা গেল। শোনা গেল লোকটির হাঁক, ‘কে ওখানে?’
এদিক থেকেও বলা হলো, ‘দেখে যাও বন্ধু!’
লোকটি ওখানে এসে পৌঁছতেই সহসা একটি খঞ্জর এসে তার বুকে বিঁধে গেল।
লোকটি এই অতর্কিত আক্রমণের প্রত্যাশা করেনি, সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যেই চিৎকার করতে যাবে, পিছন থেকে এক কমান্ডো তার মুখ চেপে ধরে তার হাতের খঞ্জর চালালো লোকটির বুকে। কলিজা ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গেল সে খঞ্জর।
লোকটির ছটফটানি ঠান্ডা হতেই ওকে আস্তে করে বারান্দায় নামিয়ে রেখে খতীবের হাত ধরে ছুটলো ওরা, লক্ষ্য, রেখে আসা রশি পর্যন্ত পৌঁছানো।
কোন রকম বাঁধাবিঘ্ন ছাড়াই ওরা কারা প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হলো। এক কমান্ডো রশি বেয়ে উঠে গেলো উপরে।
সে উপরে উঠে রশিতে ঝাকুনি দিয়ে ইশারা করলো, একজন কমান্ডো খতীবকে বললো, ‘এবার আপানার পালা। দয়া করে চেষ্টা করুন। দেরী করবেন না, যে কোন মুহূর্তে বিপদে পড়ে যেতে পারি আমরা!’
খতীব রশি বেয়ে উঠা শুরু করলেন। বুড়ো মানুষ, তার ওপর কমান্ডোদের মত ট্রেনিং নেই তার, ফলে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো তাকে উপরে উঠতে। এরপর একে একে উঠে এলো সব কমান্ডোরা।
দারোগা প্রহরীদের তখনো আটকে রেখেছিল।
সবাই উপরে উঠে এলে রশি টেনে বাইরের দিকে ঝুলিয়ে দিল এক কমান্ডার। নিরাপদেই একে একে নিচে নেমে এলো সবাই।
দারোগা কারাগারের বাইরে শেয়ালের ডাক শুনতে পেলো। বুঝলো কমান্ডোরা নিরাপদেই বেরিয়ে যেতে পেরেছে।
যেখানে রশি ঝুলছিল তার উল্টো দিকে প্রহরীদের ডিউটিতে পাঠিয়ে দিয়ে দারোগা রওনা দিলো রশির দিকে।
দ্রুত রশির কাছে পৌঁছে রশি বেয়ে নিচে নেমে এলো দারোগা নিজেও। তারপর সবাই মিলে রওনা দিল যেখানে সায়েকাকে রেখে এসেছিল, সেখানে।
ওরা যখন সেখানে পৌঁছলো, সায়েকা তার বাবাকে দেখে আবেগ সামলাতে পারলো না, ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়লো বাপের বুকে।
‘সায়েকা কিছুটাক্ষণ অবস্থান করা যাবে না। ভোর হওয়ার আগেই শহর থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে পড়তে হবে আপনাদের। বাইরে ঘোড়া রেডি। আপনারা রওনা করুন, সাথে পথ প্রদর্শক হিসাবে থাকবে আমাদের এক ভাই।’
ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটে গেল রাত। যখন ভোর হলো তখন মুশাল থেকে কয়েক মাইল দূর দিয়ে চারটি ঘোড়া ছুটছিল প্রাণপণে। একটির উপরে খতীব, দ্বিতয়টিতে সায়েকা, তৃতীয়টির উপর দারোগা এবং চতুর্থটিতে ছিল তাদের পথ পদর্শক এক কমান্ডো।
এই কমান্ডো সুলতান আইয়ুবীর জন্য নিয়ে যাচ্ছিল গুমাস্তগীনের বডিগার্ডের কাছ থেকে সংগ্রহ করা মূল্যবান তথ্য।
মুশাল থেকে বহু দূরে চলে এসেছে এই ছোট্ট কাফেলা।
গুমাস্তগীনের বডিগার্ডের লাশ সেই গোপন কক্ষের ভেতর দাফন করা হয়ে গেছে। রাতে তারা পালিয়ে আসার পর ওখানকার কমান্ডোরা বডিগার্ডকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলে।
ওরা যখন বডিগার্ডের লাশ গুম করছিল সে সময় কারাগারের অভ্যন্তরে চলছিল হুলুস্থুল ব্যাপার। ভয়াবহ কিয়ামত শুরু হয়ে গিয়েছিল সেখানে।
এরা বেরিয়ে আসার কিছুক্ষণ পর। এক প্রহরীরর চোখে পড়লো খতীবের কামরার দরজা খোলা, ভেতরে প্রদীপ জ্বলছে। প্রহরী ব্যাপার কি দেখার জন্য এগিয়ে যেতেই দেখতো পেলো বারান্দায় এক প্রহরীর লাশ পড়ে আছে। সে চিৎকার জুড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো আরো কয়েকজন পাহারাদার।
মুহূর্তে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র কারাগারে। দু’জন প্রহরীর লাশ ও খতীবের পলায়নের খবর দেয়ার জন্য প্রহরীরা ছুটলো জেল দারোগার কাছে। অফিসে দারোগাকে পাওয়া গেল না। প্রাচীরের ওপর, কারাগারের ভেতর সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও দারোগাকে না পেয়ে সহকারী দারোগা বুঝলো তিনিও পালিয়েছেন।
এক প্রহরী এসে খবর দিল, ‘প্রাচীরের বাইরে রশি ঝুলছে। নিশ্চয়ই দারোগার যোগসাজশে খতীবকে কোন কমান্ডো বাহিনী এ পথে বাইরে নিয়ে গেছে। সেই সাথে পালিয়েছে দারোগা।’
রাতের শেষ প্রহর। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও দারোগাকে না পেয়ে রিপোর্ট করার জন্য সহকারী দারোগা ছুটলো মুশালের শাসক সাইফুদ্দিনের প্রাসাদে।
শহরে তখন ফজরের আজান হচ্ছিল। সহকারী দারোগা ফটকে পৌঁছে প্রহরীকে বললো, ‘খুবই জরুরী সংবাদ আছে, এখুনি বাদশাহর কাছে এ খবর পৌঁছাতে হবে।’ তার চেহারায় ত্রস্ততা ও পেরেশানীর ছাপ।
প্রহরী তাড়াতাড়ি গেট খুলে দিল, ভেতরে ঢুকলো সহকারী দারোগা।
মুশালের শাসক সাইফুদ্দিন সারারাত ঘুমাননি। সায়েকাকে আনার জন্য সেই যে তিনি বিশ্বস্ত বডিগার্ডকে পাঠিয়েছেন, সেই থেকে অপেক্ষা করছেন তার ফিরে আসার।
যতই সময় যাচ্ছে ততই অস্থিরতা ও পেরেশানী বাড়তে লাগলো তার। শেষ রাতে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন, বডিগার্ড বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মেয়েটির রূপ যৌবনে মুগ্ধ হয়ে বডিগার্ড লোভ সামলাতে পারেনি, নিজেই তাকে ভাগিয়ে নিয়ে হয়তো কোথাও পালিয়ে গেছে।
কিন্তু তারপরও তিনি ঘুমাতে পারলেন না, মেয়েটিকে নিয়ে বডিগার্ড ফিরে আসবে এই আশাও তিনি একেবারে ত্যাগ করতে পারলেন না।
কখনো ভাবছেন, সায়েকাকে নিয়ে হয়তো এখনি ফিরে আসবে বডিগার্ড। আবার আক্রোশে ফেটে পড়ছেন, যদি নিয়ত খারাপ ও সত্যি ভেগে গিয়ে থাকে তবে দুনিয়ার শেষ মাথা পর্যন্ত ধাওয়া করে হলেও তাকে ধরে এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা তিনি করবেন।
কিন্তু তিনি কল্পনাও করতে পারলেন না, সায়েকা ও তার বডিগার্ডকে কেউ অপহরণ করতে পারে এবং বডিগার্ডকে খুন করে ওরা সায়েকাকে নিয়ে শহর থেকে পালিয়ে যেতে পারে। সাইফুদ্দিন যখন এমনি অস্থিরতায় ছাটফট করছিলেন তখুনি সেখানে পৌঁছলো সহকারী দারোগা।
সাইফুদ্দিন তখন উৎকর্ণ এবং বার বার গেটের দিকে তাকাচ্ছিলেন। গেট খোলার আওয়াজ হতেই তিনি ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। সহকারী দারোগা ঢুকেই তার মুখে পড়ে গেল।
সাইফুদ্দিন তাকে দেখেই গর্জে উঠলেন, ‘এ অসময়ে তুমি এখানে কেন? কি চাও তুমি?’
দারোগা কাচুমাচু হয়ে বললো, ‘ভয়ংকর দুঃসংবাদ হুজুর। খতীবকে কারা যেন কারাগার থেকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে।’
‘কি বললে!’ এ অবিশ্বাস্য সংবাদ যেনো তার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তিনি ধমকের সুরেই বললেন, ‘খতীবকে কারাগারের সুরক্ষিত কক্ষ থেকে অপহরণ করেছে, তোমরা ওখানে কি করতে আছো?’
‘এটা কোন কমান্ডো বাহিনীর কাজ। সমস্ত ঘটনা ঘটেছে আমাদের অলক্ষে। আমরা কিছুই টের পাইনি। আমাদের দু’জন প্রহরীকেও ওরা খুন করে ফেলে রেখে গেছে।’
‘সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা হচ্ছে, আমাদের দারোগাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো তাকেও অপহরণ করা হয়েছে, অথবা তিনিও এ ঘটনার সাথে জড়িত। তারই জোগসাজসে এ ঘটনা ঘটেছে এবং খতীবকে পার করার পর তিনি নিজেও পালিয়ে গেছেন।’
সাইফুদ্দিনের জবান বন্ধ হয়ে গেল। তিনি সহকারী দারোগার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। শহরে ফজরের আজানের রেশ ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে। পূর্বাকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে একটু একটু করে।
হারানের কারাগারে সেনাপতি শামস বখত ও সেনাপতি সাদ বখত তখনো বন্দী। সুলতান আইয়ুবী হাসানকে আদেশ দিয়েছেন, সেখান থেকে তাদেরকে যে কোন মূল্যে বের করে আনতে হবে।
হারানে আইয়ুবীর যেসব গোয়েন্দা ছিল তারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে হলেও এ দুই সেনাপতিকে মুক্ত করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরে এবং প্রতিটি বিভাগে এ দুই ভাই দু’একজন করে নিজস্ব লোক আগে থেকেই সেট করে রেখেছিলেন।
কিন্তু গুমাস্তগীনের কারাগার থেকে সেনাপতিদের উদ্ধার করা ছিল খুব কঠিন ব্যাপার। কারণ তাদেরকে রাখা হয়েছিল কারাগারের দুর্ভেদ্য গোপন কক্ষে। সেখান থেকে তাদেরকে কি করে বের করে আনা যায় তার কোন পথই বের করতে পারছিল না ওরা।
আল্লাহই তাদেরকে সাহায্য করলেন। হলব থেকে গুমাস্তগীনের জরুরী ডাক আসলো, তিনি তার উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার, উপদেষ্টা ও দেহরক্ষীসহ সেখানে চলে গেলেন।