কস্তুরী তাঁর ঐ প্রশ্নে খুবই বিব্রত অবস্থায় পড়ে গেল। সে এ প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে ভিতরে ভিতরে ঘেমে নেয়ে উঠল। বৃদ্ধ তাকে নিরুত্তর দেখে বলল, ‘তুমি তোমার অনুপম সৌন্দর্য এবং ফুটন্ত যৌবনের জন্য নিজেকে খোদা মনে করো। আর তোমাকে পাওয়ার আশায় যারা চেয়ে থাকে তারাও তোমাকে খোদা মনে করে। আমাকে বন্য ও পশু মনে করো না। আমার কাছে কাপড় আছে, সে কাপড় পরে কখনো কখনো আমি কায়রো যাই। তোমাদের সভ্য দুনিয়া ও সমাজকে চেয়ে দেখি। তারপরে আবার নির্জন ও সরল পৃথিবীতে ফিরে এসে কাপড় খুলে রাখি।
আমি তোমাদের সভ্য দুনিয়ার পালকী গাড়িতে রাজকন্যাকে ভ্রমণ করতে দেখেছি! তোমার মতই রূপসী শাহজাদী দেখেছি। নাচগান করা নর্তকী ও গায়িকাকে দেখেছি। আর তাদের যারা নাচায় ও গান করায় তাদেরকেও দেখেছি।
আমি ফেরাউনের যুগের কথাও শুনেছি আর আজকের ফেরাউনদের কর্মকাণ্ডও দেখছি। আমি এ সকল লোকদের পরিণামও দেখেছি। তোমাদের পরিণাম এখন তোমাদের চোখে পড়ছে না, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি।
তোমরা গুপ্তধন লাভের লালসায় এতগুলো নিরপরাধ লোকদেরকে হত্যা করলে এ পাপের প্রায়শ্চিত্য তোমাকে করতেই হবে। এর থেকে কখনও রেহাই পাবে না। যে ফেরাউন গরীবদের অত্যাচার করে খোদা হয়ে বসেছিল সে ফেরাউনরাও কেউ অমর হয়নি। তারাও আসল খোদার হুকুমে কবরে যেতে বাধ্য হয়েছে। তোমরাও কেউ বাঁচবে না, সময় তোমাদের কবরে নিয়ে যাবে।
তোমরা চাইলে কাল সকালে আমি তোমাদের গুপ্তধনের ভাণ্ডারের কাছে নিয়ে যাবো। সেখানে তোমরা ফেরাউনের পরিণাম স্বচক্ষে দেখতে পাবে। তারা যদি খোদাই হত তাহলে তাদের এ পরিণাম হত না। আসল খোদা তিনিই, যিনি এই সকল পরিণতি ঘটান। অথচ তাঁর কখনো এ রকম পরিণতি ঘটে না।
তুমি জানতে চাচ্ছিলে, আমি এখনও ফেরাউনদের খোদা মানি কি না। যদি সঠিক ও সত্য খবর শুনতে চাও, তাহলে বলবো, আমি ঐ লোকদের কখনও খোদা মানি না, যারা পাহাড়ের নিচে হাড়-হাড্ডির স্তুপ হয়ে পড়ে থাকে।
আমি ও আমার কবিলার লোকেরা দুনিয়ার লালসা থেকে বাঁচার জন্য নিজস্ব একটি মতবাদ ও বিশ্বাস সৃষ্টি করে নিয়েছি। আমরা সেই বিশ্বাসেরই অনুসরণ করে থাকি।”
বৃদ্ধ থেমে থেমে ধীরস্থির কণ্ঠে কথা বলছিল। কস্তুরী তাকে দেখছিল আর বৃদ্ধের কথার মধ্যে তার জীবনের পরিণতি অনুসন্ধান করছিল। মার্ক লীর ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখায় তিরষ্কারের আভাস প্রকাশ পাচ্ছিল। সে শরাব পান করছিল আর বৃদ্ধের কথা শুনছিল।
বৃদ্ধ থামলে সে বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বললো, “তুমি এখন তোমার নারীর কাছে চলে যাও। সকালে একটু আগেই উঠবে, আমাদের ভেতরে যেতে হবে।’
বৃদ্ধ চলে গেলে মার্ক লী কস্তুরীকে বললে, ‘এসো, আমরাও শুয়ে পড়ি।”
‘না, আমি তোমার সাথে যাবো না। আমি আজ আলাদা শোব।” কস্তুরী বললো।
মার্ক লী তার দিকে ঝুঁকে এলো। কস্তুরী পিছনে সরে গেল। মার্ক লী তাকে ধমক দিল। তখন ইসমাইল এসে তাদের দু’জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল, কিন্তু মুখে কিছু বললো না। মার্ক লী তার চোখের দিকে তাকাল এবং সে চোখে দেখতে পেল ভয়ংকর খুনের নেশা জ্বলজ্বল করছে সেখানে।
মার্ক লী আর কথা না বাড়িয়ে পিছনে সরে গেল। সে যখন চলে গেল, কস্তুরী ইসমাইলের বুকে মাথা গুজে শিশুর মত কেঁদে উঠলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মার্ক লী গুহায় প্রবেশের জন্য অস্থির হয়ে উঠল। সে বৃদ্ধকে ভোরেই চলে আসার জন্য বলেছিল, কিন্তু বেলা উঠার পরও বৃদ্ধের দেখা মিলল না। অস্থিরতা দমন করতে না পেরে সে বৃদ্ধকে খুঁজতে বেরোলো, কিন্তু আশেপাশে কোথাও বৃদ্ধকে দেখতে পেল না।
সে তখন বৃদ্ধকে ডাকতে শুরু করল, কিন্তু কোথাও থেকে কোন প্রতিউত্তর এল না।
আশংকা ও উত্তেজনায় মার্ক লীর চেহারা বিভৎসরূপ ধারন করলো। যেখানে সে জংলী নারী ও পুরুষদের বন্দী করে রেখেছিল সেখানে ছুটে গেল মার্ক লী। কিন্তু এ কী, মার্ক লী অবাক হয়ে দেখল, সেখানে কোন মানুষের চিহ্ন নেই। তারা সবাই পালিয়ে গেছে।
গ্রামের এক প্রান্ত-থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত মার্ক লী তাদের খুঁজে বেড়ালো। অনেক ডাকাডাকি করল, কিন্তু সবই বৃথা চেষ্টা। লোকগুলো গ্ৰাম থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে।
এবার ভয় ঢুকলো দুঃসাহসী মার্ক লীর মনেও। লোকগুলোকে সে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু ওরা কি তাকে দেখছে? ওরা কি এমন কোন গোপন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে, যেখান থেকে ওরা তাকে দেখতে পাবে কিন্তু সে তাদের দেখতে পাবে না? সে এখন একা, ওরা কি এই সুজোগ নিয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করবে? এক অনিশ্চিত যন্ত্রনা এসে ঘিরে ধরল তাকে।
হয়রান পেরেশান হয়ে সে আবার ফিরে এল তাঁবুর কাছে। নিজেকে সংযত ও সংহত করার চেষ্টা করল। মনে মনে ভাবল, ওদের আর আমার এখন কি দরকার? কবরের মুখ তো খোলাই আছে। বৃদ্ধ না থাকলেও ভেতরে প্রবেশ করতে তো এখন আর কোন বাঁধা নেই।
তার আরও মনে হল তার হাতে যে নকশা আছে সেখানে ভেতরে কোথায় কি আছে সব বর্ণনা করা আছে। এ নকশা দেখে সে সব গুপ্তধন খুঁজে পেতে পারবে।
মার্ক লী ইসমাইল ও কস্তুরীকে বলল, “চলো ভেতরে ঢুকে দেখি।’
ইসমাইল নিরাসক্ত কন্ঠে বলল, ‘চলো।’
অগত্যা কস্তুরীকেও তাদের সঙ্গী হতে হল। তিনজন এক সঙ্গে উঠে এল উপত্যকায়। কবরের খোলা মুখের পাশে এসে দাঁড়াল তিনজন।
মার্ক লীই প্রথমে সে মুখ গহ্বর দিয়ে নিচে এলো। এটা একটা সুড়ং পথ। এ পথ কোথা দিয়ে কতদূর গেছে জানা নেই তার। ভেতরে বেশ অন্ধকার। মার্ক লী ওদের দিকে মুখ তুলে বলল, ‘ভেতরে অন্ধকার। মশাল- জ্বেলে তোমরাও চলে এস। সবাই মিলে এক সঙ্গে এগিয়ে যাব।’
মশাল জ্বেলে ইসমাইল এবং কস্তুরীও নেমে এল নিচে। তিনজন রওনা হলো সে সুরঙ্গ পথ ধরে। কিছু দূর গিয়েই ওরা দেখতে পেল সুড়ং পথ বন্ধ।
মার্ক লীর কোমড়ে ঝুলছিল তলোয়ার, হাতে শাবল। সে শাবল দিয়ে আঘাত করলো বন্ধ পথে, ফাঁপা শব্দ হলো তাতে। মার্কালী বলল, “এটা একটা পাথরের দরজা। ওপাশটা ফাঁকা।’
পাথরের এ দরজা ভাঙার জন্য মার্ক লী ক্রমাগত আঘাত করতে লাগল এর উপর। এক পাশে সামান্য ফুটা সৃষ্টি হল। ইসমাইল শুরু করল হাতুড়ী পেটা।
হাতুড়ী ও শাবলের সাহায্যে এক সময় পাথরের এই ছোট্ট দরজার এক পাশ ভেঙ্গে ফেললো ওরা। এবার অন্য পাশে মনযোগ দিল ওরা। অনেক পরিশ্রম ও কষ্টের পর দরজা ভেঙে উল্টো দিকে পড়ে গেল।
দরজাটি ছিল নিরেট পাথরের এবং অসম্ভব ভারী। উল্টো দিকে ভেঙে পড়ার সাথে সাথে ভূমিকম্পের মত কেঁপে উঠলো পুরো গুহা।
ভেতর থেকে পনেরশ, ষোলশ বছরের আটকে থাকা গ্যাস ও দুৰ্গন্ধ এসে ঝাপটা দিল ওদের নাকে মুখে। সে গন্ধের চাপ সইতে না পেরে ইসমাইল ও কস্তুরী পিছন সরে গেল। কিন্তু মার্ক লী নাকে মুখে কাপড় জড়িয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
একটু পর গ্যাস বেরিয়ে গেলে ওরা এসে শামিল হলো মার্ক লীর সাথে। কয়েক কদম অগ্রসর হওয়ার পর নিচে নামার একটি সিঁড়ি পড়ল ওদের সামনে। কোন কথা না বলে ঘাড় ফিরিয়ে, চোখে নিচে নামার ইঙ্গিত করে মার্ক লী পা বাড়াল সিঁড়ির দিকে।
সিঁড়ির ওপরে মানুষের মাথার খুলি, হাড়-হাড্ডি ও কংকাল পড়ে থাকতে দেখলো। তার সাথে দেখলো বর্শা ও ঢাল তলোয়ার পড়ে আছে। বুঝা যায়, এগুলো প্রহরীদের হাড় ও কংকাল। জীবন্ত অবস্থায় এদেরকে পাহারায় রেখেই এই বিশাল কবরের মুখে পাথর চাপা দেয়া হয়েছিল।
সিঁড়ি ভেঙে অনেক নিচে নেমে এল ওরা। প্রবেশ করল চারদিকে নিরেট পাথরের দেয়াল ঘেরা এক বিশাল হলরুমে। হলরুমটি এমন সুন্দর ভাবে আস্তর ও পালিশ করা যে, এখনো ঝকঝক তকতক করছে। মনে হয়, গতকালই এতে নতুন করে রঙ করা হয়েছে। কারিগররা কত দীর্ঘ সময় ও কাল ধরে পাথর কেটে এই বিশাল হলরুম বানিয়েছে ভাবতে গিয়ে কোন থৈ পেল না তারা।
মার্ক লী অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল হল রুমে রাখা একটি সুন্দর নৌকার দিকে। নৌকার সাথে মাল্লাদের বেঁধে রাখা হয়েছিল যাতে ওরা পালিয়ে যেতে না পারে। এখনো নৌকায় ওদের মাথার খুলি ও কংকাল পড়ে আছে।
ইসমাইল ও কস্তুরী বিস্মিত হয়ে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল এর কারুকাজ। হলরুমের একপাশে একটি অন্ধকার দরজা দেখতে পেল ওরা। ইসমাইল বলল, “মার্ক লী, ওই যে দরজা!”
ওরা সেই অন্ধকার দরজা দিয়ে করিডোরে পা রাখল। করিডোরের মেঝে অসম্ভব মসৃন৷ করিডোর ধরে ওরা অন্য একটি কামরায় এসে পৌঁছল। এ কামরায় ওরা দেখতে পেল অপূর্ব সুন্দর ও সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ী। গাড়ীর সামনে আটটি ঘোড়ার মাথার খুলি ও হাড় বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। গাড়ীর পালকি ও চালকের আসনেও মানুষের হাড় ও মাথার খুলি পড়েছিল।
ওরা এ কামরা অতিক্রম করে আরো সামনে বাড়ল। কিছুদূর এগুতেই একটি অপূর্ব সুন্দর কামরায় প্রবেশ করল ওরা। এটি সেই শিশমহল, যার দেয়াল কাচের মত মসৃণ ও স্বচ্ছ। এর মনোমুগ্ধকর নকশা ও ছবি। একপাশে একটি মঞ্চ। মঞ্চে উঠার জন্য কয়েক ধাপ সিড়ি।
সেই সিঁড়ি বেয়ে ওরা মঞ্চের ওপর উঠে এল। মঞ্চের ওপর শ্বেত পাথরের কারুকার্যময় বিশাল চেয়ার। দু’পাশের হাতলের মাথায় কেশর ফোলানো সিংহ মূর্তি। সেই বিশাল চেয়ারের ওপরে রিম্যান্সের মূর্তি বসানো, মূর্তিটিও মূল্যবান পাথরে গড়া।
তার পাশে একই রকম আরেকটি চেয়ার। চেয়ারটির কাছে এগিয়ে গেল ওরা। সেই চেয়ারে মাথার খুলি ও কংকাল পড়ে আছে।
কস্তুরী সেই মাথার খুলির দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালো। দেখলো, সেই খুলির সাথে পড়ে আছে মহামূল্য মতির হার। হারে নীলা ও হীরার জ্যোতির্ময় পাথর বসানো। শুধু হার নয়, কানের বহুমূল্য গহনা এবং হাতের আংটিও পড়ে আছে চেয়ারে। মূল্যবান হীরা জহরত ও পান্নার পাথরগুলো চমকাচ্ছে তখনো।
মার্ক লী একটি হার হাত দিয়ে উঠালো। কয়েক হাজার বছর অতীত হওয়ার পরও হীরা ও মতির চমক বিন্দুমাত্র নষ্ট হয়নি। মশালের আলোয় হীরার দ্যুতি চমকাচ্ছিল।
মার্ক লী হারটি কস্তুরীর গলায় পরিয়ে দিতে গেল, কিন্তুরী চিৎকার করে ইসমাইলের পিছনে গিয়ে লুকালো।
মার্ক লী হো হো করে হেসে উঠে বললো, “আমি তো তোমাকে বলেই ছিলাম, আমি তোমাকে রানী ক্লিওপেট্রা বানাবো। ভয় পেয়ো না কস্তুরী! এসব হার সবই তোমার।”
“না।” কস্তুরী থরে থরো কম্পিত কণ্ঠে বললে, “না, আমি এই কংকাল ও খুলির মধ্যে আমার জীবনের পরিণাম দেখতে পাচ্ছি। এরাও তো আমার মতই জৌলুস ভরা জীবনের অধিকারী ছিল। কিন্তু কোথায় আজ সেই জৌলুস?
এটা তো সেই মিথ্যা খোদার দাবীদার অহংকারী এক বাদশাহর প্ৰেয়সীর কণ্ঠের মালা, যে খোদা আজ কংকাল হয়ে এখানে পড়ে আছে শত শত বছর ধরে। আমি এদের পরিণাম থেকে শিক্ষা নিয়েছি, যাদেরকে তাদের অহংকার খোদা বানিয়ে নিয়েছিল। আমিও আমার অন্তরের অহংকারী খোদাকে দেখতে পাচ্ছি।”
কস্তুরী ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের গুহায় প্রবেশের পর থেকেই ভয় পাচ্ছিল। এই কংকাল ও অলংকারাদি দেখার পর এমন মারাত্মকভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল যে, সে ইসমাইলের হাত ধরে তাকে টেনে হেচড়ে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে চাইল। কী এক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছিল সে।
টানতে টানতে কস্তুরী ইসমাইলকে অস্থির কন্ঠে বলছিল, “আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো! চলো আমরা বেরিয়ে যাই! আমিও এই হাড়ের কংকাল ছাড়া আর কিছু নই!’
সে তার গলার বহুমূল্য হার টান মেরে ছিড়ে ফেলল এবং চোখ বন্ধ করে একদিকে ছুড়ে মারল। হারটি কংকালের মধ্যে গিয়ে পড়লো। সে তার আঙ্গুলের অমূল্য আংটিও খুলে ফেলে দিল আর চিৎকার করতে থাকলে, “আমি আমার পরিণতি দেখতে পাচ্ছি। আমি মিথ্যা খোদাদেরও দেখে নিয়েছি। আমার আর কিছু দেখার নেই, এখান থেকে আমার কিছু নেয়ারও নেই। চলো, আমাকে এখান থেকে বাইরে নিয়ে চলো। এই গুহায় আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি মরে যাবো। আমিও কংকাল হয়ে যাবো এখানে থাকলে। চলো, জলদি চলো, আমাকে বাইরে নিয়ে চলো।”
তার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ছিল সীমাহীন আকুতি ও কান্না।
সে ইসমাইলকে টানতে টানতে রুমের বাইরে বারান্দায় নিয়ে এল।
ইসমাইল কস্তুরীকে সান্তনা দিতে চাইল। বললো, “তুমি শান্ত হও, কস্তুরী, স্বাভাবিক হও। আমরা চলে গেলে তো সবকিছু এই খৃস্টান একাই নিয়ে যাবে!’
কথা বলতে বলতে ইসমাইলের নজরে পড়ল আরেকটি দরজা। মশালটি ইসমাইলের হাতেই ছিল, সে কস্তুরীকে নিয়ে সেদিকে গেল এবং দরজা দিয়ে ঢুকে একটি খোলা কামরায় প্ৰবেশ করলো।
এ কামরার মাঝখানেও একটি মঞ্চ। মঞ্চের ওপরে শবদেহের কফিন রাখা। শবদেহের মুখটা খোলা।
এই সে ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের শবদেহ, যার সামনে লোকেরা একদিন সিজদা করতো। তার লাশ সুগন্ধি মশলা ও অন্যান্য দুষ্প্রাপ্য মূল্যবান আরক দিয়ে এমন জমাটবদ্ধ করা ছিল যে আজ পনেরো শ’ বছর পরও তার চেহারা অবিকল ও অবিকৃত ছিল।
দু’জনই মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়েছিল সে লাশের দিকে। সাধারণত মানুষ মারা গেলে তার চোখ বন্ধ করে দেয়া হয়, কিন্তু ফেরাউনের চোখ দুটো ছিল খোলা। ইসমাইল সেই চেহারার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল। কস্তুরীও। কারো মুখে কোন কথা নেই, যেন বোবা হয়ে গেছে তারা।
অনেকক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ যেন সন্বিত ফিরে এল উভয়ের, একই সাথে একে অপরের দিকে তাকালো ওরা। কিন্তু সে কেবল ক্ষণিকের, আবার ফেরাউনের চেহারায় ছুটে গেল ওদের দৃষ্টি। তারপর সে দৃষ্টি কফিন থেকে নেমে কামরার এদিক-ওদিক দুটাছুটি করতে লাগলো। চারদিকে কংকালের অজস্র হাড়।
ওরা কামরার ভেতর ঢাকনাবদ্ধ কফিনের মত আরো কয়েকটি কারুকার্য খচিত বাক্স দেখতে পেল। একটি বাক্সের ঢাকনা খোলা।
ইসমাইল এগিয়ে গেল বাক্সটির কাছে। চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। মশালের আলোয় দু’জনেই অবাক চোখে দেখলো, বাক্সটি হীরা-জহরত ও সোনার গহনায় পরিপূর্ণ। তার ওপর একটি মানুষের হাতের কংকাল পড়ে আছে, অপর হাতের কংকাল পড়ে আছে বাক্সের বাইরে। একজন মানুষের মাথার খুলি ও কঙ্কালের হাড়গুলোও পড়ে আছে বাক্সের পাশে।
‘হায়রে মানুষ!” ইসমাইল বললো, “এই লোকটি মরার আগেও গহনা ও হীরার টুকরো উঠাতে চেষ্টা করছিল। তার হয়তো আশা ছিল, এইসব ধনরত্ব নিয়ে সে এখান থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয়নি, তার আগেই তার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এবং লোকটি এই গুপ্তধনের উপরেই পড়ে মারা যায়।”
কন্তুরী বলল, “বৃদ্ধ ঠিকই বলেছিল, মানুষের দুশমন ক্ষুধা নয়, মানুষের দুশমন তার সীমাহীন লোভ লালসা।”
ইসমাইল সে বাক্সের উপর হাত রেখে বললে, ‘কস্তুরী, তুমিও তো লোভে পড়েই এসেছ, কিছু এখান থেকে নিয়ে যাও।”
“আমার লোভ মরে গেছে। আর সে কস্তুরীও মারা গেছে।”
ইসমাইল আবারও বাক্সের দিকে হাত বাড়ালো। কস্তুরী চিৎকার দিয়ে বললে, “বাঁচো! ইসমাইল বাঁচো!”
তার এ চিৎকারে এমন কিছু ছিল যা মানুষের ইন্দ্রিয় রাজ্যে আঘাত হানে। ইসমাইল ছিল সদাসতর্ক ও উস্তাদ এক খুনী। কস্তুরীর আচমকা এ কানফাটা চিৎকার তাকে সতর্ক করে দিল। সেই চিৎকারের মর্ম বুঝতে পেরে সে মুহূর্তে একদিকে কাত হয়ে সরে পড়লো এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলো, মার্ক লী উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে তাকে আক্রমণ করে বসেছে।
আঘাত গিয়ে পড়লো বাক্সের ওপরে। মার্ক লী চিৎকার করে বলে উঠলো, “এই গুপ্তধন আমার!’
ইসমাইলের কাছে ছিল খঞ্জর। খঞ্জর দিয়ে তলোয়ারের আঘাত ঠেকাতে পারবে না, জানে ইসমাইল।
সে দেখলো কস্তুরীর পাশেই একটি বর্শা পড়ে আছে। সে দ্রুত ছুটে গেল বর্শার পাশে এবং চকিতে তা উঠিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। মার্ক লী ইসমাইলের ওপর আবার আঘাত হানার জন্য। ঘুরে দাঁড়িয়ে তলোয়ার তুলল, ইসমাইল বর্শা দিয়ে সে আঘাত ঠেকালো।
ইসমাইলের হাত থেকে মশাল পড়ে গিয়েছিল, কস্তুরী ছুটে গিয়ে মশাল তুলে নিল হাতে।
মার্ক লী আবারো ইসমাইলের উপর বেপরোয়া আক্রমণ চালালো, যেন সে গুপ্তধনের লোভে অন্ধ বা পাগল হয়ে গেছে।
ইসমাইল একদিকে সরে গিয়ে সে আঘাত থেকে আত্মরক্ষা করল এবং মার্ক লীকে আর আঘাত করার সুযোগ না দিয়ে পাশ থেকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বর্শা দিয়ে আঘাত করল মার্ক লীকে।
মার্ক লী পড়ে গেল। হাত থেকে তার ছিটকে গেল তলোয়ার। ইসমাইল মার্ক লীর শরীর থেকে বর্শা টেনে বের করে আবার আঘাত করলো। এ আঘাত মার্ক লীর বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল।
তার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল মরণ চিৎকার। সে চিৎকার বদ্ধ ঘরে ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে যতক্ষণ বাজলো ততক্ষণ কস্তুরী ও ইসমাইল পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
চিৎকারের রেশ থামতেই সচকিত হলো ইসমাইল। কস্তুরীর হাত টেনে ধরে দৌড় দিল বাইরের দিকে।
গুপ্তধনের লোভে পড়ে কস্তুরী অংশ নিয়েছিল এই দুঃসাহসিক অভিযানে। এখন সেই গুপ্তধনের ভারে নিজের মূল্যবান কণ্ঠহার, হীরার আংটি, কানের দুল সব ফেলে দিয়ে ইসমাইলের সাথে ছুটছে এই অভিশপ্ত গুহা থেকে বের হওয়ার জন্য।
ছুটতে ছুটতে তারা গহ্বরের মুখে এসে পড়ল। ইসমাইল হাতের জ্বলন্ত মশাল ভিতরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গুহা মুখের প্রান্ত ধরে লাফিয়ে উঠে এল উপরে। তারপর গুহা, মুখের বাইরে শুয়ে পড়ে হাত বাড়িয়ে দিল ভেতরে। কস্তুরী সে হাত আঁকড়ে ধরে পড়িমড়ি উঠে এল উপরে। এরপর তারা দু’জনই সেখানে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল।
কিছুটা সুস্থির হওয়ার পর তারা একজন অন্য জনের দিকে তাকাল। দু’জনের চোখেই কেমন উদভ্রান্ত দৃষ্টি। কস্তুরী সেই চোখের দিকে তাকিয়ে ইসমাইলকে বললো, “আমরা কোথায়? তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো? বল তো আমি কে?”
“আমিও ঠিক তাই ভাবছি।” ইসমাইল বললো, “আমার মনে হয় এইমাত্র আমি পৃথিবীতে এসেছি। আমার কোন অতীত নেই।”
“আমারও কোন অতীত নেই। যে কস্তুরী অর্থের লোভে মানুষের মনােরঞ্জন করতো ওই গুহার ভেতর আমি তাকে কবর দিয়ে এসেছি।”
“যে ইসমাইল অর্থের বিনিময়ে মানুষ খুন করতো আমিও একটু আগে তাকে কবর দিয়ে এসেছি শক্ত এক সম্রাটের পাশে।”
“হ্যাঁ, আমরা দুজনই আমাদের সমস্ত অতীত, সমস্ত গোনাহ ও পাপ ওই গুহায় ফেলে এসেছি। সমস্ত লোভ ও অপরাধ প্রবণতাকে গলা টিপে হত্যা করে রেখে এসেছি ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবরে।”
“হ্যাঁ, ওরা সজ্ঞানে কবরে ফেলে এসেছিল সামান্য কিছু গহনাপত্র, কিন্তু নিজের অজ্ঞাতসারে তাদের আজন্ম লালিত স্বপ্ন, বোধ ও বিশ্বাস ওই কবরে ফেলে এসেছিল চিরদিনের জন্য।
এই অদ্ভুত ও ভয়ংকর এলাকা থেকে বের হবার পথ তাদের জানাই ছিল। তারা সহজেই তাদের পরিচিত পথ ধরে বেরিয়ে এলো সেই অভিশপ্ত অঞ্চল থেকে।
বাইরে মাত্র কয়েকটি উট দাঁড়িয়ে ছিল। অন্য উটগুলো কোথায় গেছে জানার কোন চেষ্টা করল না ওরা। দু’জনে দু’টি উটের পিঠে উঠে কায়রাের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল।
সে দিনই মধ্য রাতের একটু পর।
কস্তুরী ও ইসমাইলের কাছ থেকে অভিযানের বিস্ময়কর কাহিনী শুনছিলেন গিয়াস বিলকিস। সমস্ত কাহিনী বিস্তারিতভাবে মনযোগ দিয়ে শুনলেন তিনি।
তাদের বক্তব্য শেষ হলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এখন আমার কাছে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কথাই সঠিক মনে হচ্ছে। তিনি এই গুপ্তধন থেকে দূরে থাকতে বলেছিলেন আমাদের।’
কায়রো শহরের পুলিশ সুপার গিয়াস বিলকিস। ইসমাইল ও কস্তুরী সম্পর্কে ভাল করেই জানা ছিল তার।
এরা তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে এসেছে তার কাছে। মরুভূমি থেকে ফিরে আহমদ দারবীশের কাছে যাওয়া বাদ দিয়ে ওরা গিয়াস বিলকিসের কাছে চলে এসেছে। তার কাছে পুরো কাহিনী বর্ণনা করে বললো, এই ঘটনার মূলে আছে সেনা অফিসার আহমদ দারবীশ। তারই ষড়যন্ত্রে ও যোগসূত্রে মার্ক লী এই অভিযানে বেরিয়েছিল। প্রকাশ্যে মার্ক লী অভিযান পরিচালনা করলেও নেপথ্যের নিয়ন্ত্রক ছিল আহমদ দরবীশ।
গিয়াস বিলকিস সঙ্গে সঙ্গে এই খবর জানালেন আলী বিন সুফিয়ানকে। আলী বিন সুফিয়ান খবর পাওয়ার সাথে সাথে ছুটে এলেন গিয়াস বিলকিসের কাছে। কস্তুরী ও ইসমাইলের কাছ থেকে নিজ কানে শুনলেন এই অভিযানের সমস্ত কাহিনী ও ঘটনা।
আহমদ দরবীশ কোন সাধারণ পদ মর্যাদার লোক ছিলেন। তারা দু’জন রাতেই ছুটে গেলেন সুলতান আইয়ুবীর কাছে। সুলতানকে জানালেন আহমদ দাবীশের ষড়যন্ত্র ও অভিযানের কথা!
‘সুলতান, এই মুহূর্তে তাকে গ্রেফতার করার অনুমতি চাই।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
সুলতান আইয়ুবী অনুমতি দিলেন। গিয়াস বিলকিস ও আলী বিন সুফিয়ান সেই অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে এলেন আইয়ুবীর মহল থেকে।
আলীর কমান্ডো বাহিনী পুলিশের ছত্রছায়ায় সে রাতেই অতর্কিতে আহমদ দারবীশের বাড়ীতে হানা দিল। গ্রেফতার করা হলো আহমদ দরবীশকে।
সমস্ত বাড়ীতে ব্যাপক তল্লাসী চালানো হলো। তল্লাশীর ফলে বেরিয়ে এল সেই সব নকশা ও কাগজপত্র, যা পুরাতন কাগজপত্রের ফাইল থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।
খুব সকালে আলী বিন সুফিয়ান ও গিয়াস বিলকিসের পরামর্শে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সেনাবাহিনীর একটি বড় দলকে ‘মৃত্যু উপত্যকা’ বলে পরিচিত সেই রহস্যময় এলাকায় পাঠিয়ে দিলেন, যে ভয়ংকর মরু পাহাড়ের অভ্যন্তরে ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবর ছিল।
রওনা হওয়ার সময় সুলতান আইয়ুবী বাহিনীর সালারকে বললেন, ‘কবরের মুখ আগে যেমন ছিল ঠিক তেমন করে বন্ধ করে দেবে। কাউকে গুহার ভেতর যেতে দেবে না। ওখান থেকে গুপ্তধন আনা তো দূরের কথা, আমি চাই না কেউ সে ধনরত্ন চোখে দেখুক।’
ইসমাইল তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল সেই পাহাড়ী উপত্যকায়। ভয়ংকর জটিল পথ ব্যবহারের কোন দরকার হলো না তাদের। বৃদ্ধের দেখানো সোজা সরল পথেই বাহিনী গিয়ে পৌঁছলো সবুজ উদ্যানে। বাহিনীর লোকদেরকে ইসমাইল শোনালো এখানে দুদিন আগে কি লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল।
কবরের গুহামুখে পৌঁছলো সেনাবাহিনী। অবাক বিস্ময়ে তারা দেখল ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবরের সুবিশাল গুহামুখ।
এই মুখ দিয়ে ঢুকে কিছু দূর অগ্রসর হলেই তারা দেখতে পাবে সম্রাটের মমি, তার বিপুল ধনরত্ন, যা পনেরোশ’ বছর ধরে পড়ে আছে এই কঠিন শিলাদৃঢ় পাথরের অন্ধকার গুহার ভেতর। হাত বাড়ালেই ওরা এখন পেতে পারে অবিশ্বাস্য ধনরত্নের বিশাল ভাণ্ডার। কারো মনের গহীনে তেমন কোন লোভ আদৌ জাগল কিনা বলা মুশকিল, তবে কেউ সে ধনরত্ন উদ্ধার জন্য এগিয়ে গেল না।
সেনাবাহিনীর জওয়ানরা শিকল ও দড়ি বেঁধে টেনে সেই বিশাল ছাদের মত পাথর উপরে নিয়ে যথাস্থানে লাগিয়ে দিল। ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবর ও বিপুল ধনরত্ন আবার এই পৃথিবীর মানুষের চোখের আড়াল হয়ে গেল। তবে তার আগে নতুন করে আরেকজন পাপীর কাফনহীন লাশও অদৃশ্য হলো সেই গুহার ভেতর।