» » ফেরাউনের গুপ্তধন

বর্ণাকার
🕮

সঙ্গীর মরণ চিৎকার তখনও কানে বাজছিল ওদের, আতংক গ্রাস করে ফেলেছিল ওদের চিন্তা চেতনা। পড়ন্ত বিকেলের স্নান আলোয় মার্কলী ও তার সঙ্গীটি সেই ভয়ানক খাদের মধ্যে সংকীর্ণ ভঙ্গুর দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে বোবা চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইল।

“তুমি আমাকে সাথে সাথে রেখো মার্ক লী।” তার এখনকার একমাত্র সঙ্গীটি বলল, “আমি এমন মৃত্যু চাই না।’ ভয়ে তার গলা কাঁপছিল।

তার মনোবল বাড়ানো ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না। সে বলল, “সামনে আর কোন বিপদজনক ভাঙা চোখে পড়ছে না। মনে হয় বাকী পথ নিরাপদেই যেতে পারবো।”

মার্ক লী আবার এগিয়ে যেতে শুরু করলো। তার প্রায় গা ঘেষে চলল তার সঙ্গী। দমকা বাতাসের বেগ আগের চেয়েও তীব্র আকার ধারণ করল। শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে পথ চলা কঠিন হয়ে দাঁড়াল ওদের পক্ষে। বাধ্য হয়ে আবার বসে পড়ল মার্ক লী। দু’জন ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলো।

এখানে দেয়াল আরেকটু চওড়া। মার্ক লী উঠে দাঁড়াল এবং ঘুরে সঙ্গীর হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। দেয়াল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। প্ৰাণে আশার আলো জ্বলে উঠল ওদের; দুই টিলার মাঝখান দিয়ে সংকীর্ণ একটি রাস্তার মুখে শেষ হয়েছে দেয়াল। ওরা দু’জন সেই সংকীর্ণ রাস্তায় প্রবেশ করলো।

মার্ক লীর সঙ্গী বললো, “জেফ্রে হয়ত মরে গেছে। তার পরিণতির কথা ও অন্তিম চিৎকার আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না।”

মার্ক লী তার দিকে তাকাল, দেখল, তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। কিছু না বলে সে সঙ্গীর কাঁধে হাত রাখল এবং তাকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলো।

সংকীর্ণ পথ আস্তে আস্তে চওড়া হতে লাগলো। মার্ক লী তার সাথীকে বললো, “আমাদেব ভাগ্য ভাল, যে দিকেই যাই একটাই রাস্তা সামনে পড়ে। একাধিক রাস্তা হলে বিভ্ৰান্তির মধ্যে পড়ে যেতাম।”

এক সময় গলিপথ শেষ হয়ে এল। প্রশস্ত হতে হতে একবারে মুক্ত ময়দানে এসে পড়ল ওরা। ময়দান পার হয়ে পাহাড়ের ঢালে উঠে এল। ঢালটি ক্রমশ উপর দিকে উঠে গেছে। বাতাস তখনও বেগে প্রবাহিত হচ্ছিল।

এই ভয়াবহ এলাকার কতটুকু গভীরে ওরা চলে এসেছে। এ নিয়ে মাক লীর কোন দুশ্চিন্তা ছিল না। সে জানতো, দুনিয়ার লোকসমাজ থেকে ওরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অসম্ভব জেনেও সে এ পথে পা বাড়িয়েছে। হয়তো তার সামনে আরো অসংখ্য বিপদ ওঁৎ পেতে আছে। তবু এর শেষ কোথায় সে দেখতে চায়।

জাতির প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেই এ বিপদসঙ্কল পথে পা বাড়িয়েছে সে। নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজন নয়, ফেরাউনের এ গুপ্তধন প্রয়োজন তার জাতির জন্য। এখান থেকে উদ্ধারকৃত মহামূল্য সম্পদ সে ব্যবহার করবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড়ে করে দেবে এ ধনরত্ব। ধূলায় মিশিয়ে দেবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর স্বপ্নসাধ। বিশ্বব্যাপী কায়েম হবে খৃস্টান সাম্রাজ্য। এ উদ্দেশ্যেই সে এই অভিযানে বেরিয়েছে।

সে তার ভীতিসন্ত্রস্ত সঙ্গীকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। সামনের দিক থেকে বাতাস আসছিল। পাহাড়টি আগেরগুলোর মত কন্টকাকীর্ণ ও বিপদসংকুল ছিল না। এর চড়াইগুলোও ছিল সহনীয়।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা পাহাড়ের প্রায় চূড়ায় উঠে এল। উপরের দিকে তাকাল মার্ক লী। নির্মেঘ আকাশ দেখা যাচ্ছে, সে একটু দাঁড়াল। লম্বা করে শ্বাস টেনে বাতাসের গন্ধ নিল। বললো, ‘শুঁকে দেখো, বাতাসে এখন আর মরুভূমির রুক্ষতার গন্ধ নেই।’

“তোমার আসলে মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’ তার সাথী বললো, ‘মরুভূমিতে মরুভূমির গন্ধ থাকবে না তো কিসের গন্ধ থাকবে? তুমি কি বাতাসে এখন ঝর্ণা, সবুজ ঘাস ও সোঁদা মাটির গন্ধ পাচ্ছে?”

মার্ক লী চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস টেনে গভীর মনযোগের সাথে বাতাসের ঘ্রাণ নিচ্ছিল। আর বলছিল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, এ রকম ঊষর মরুভূমিতে পানির আশা করা যায় না। আমি হয়ত আন্দাজেই খেজুরের বাগান, সবুজ ঘাস ও পানির ঘ্রাণ নিচ্ছি। হয়তো আমার ঘ্রাণ নেয়ার অনুভূতি আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে। নইলে এই জাহান্নামে পানির ঘ্রাণ আমি পাবো কেন! কিন্তু আমার ঘ্রাণশক্তি প্ৰবল এবং এই ঘ্রাণ আমার পরীক্ষিত।’

‘মার্ক লী!” সাথী তার হাত টেনে ধরে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, ‘আমিও একটি স্বাণ পাচ্ছি, সেটি মৃত্যুর ঘ্ৰাণ। আমার কেবলি মনে হচ্ছে, মৃত্যু দ্রুত এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। এসো বন্ধু, আমরা যেদিক দিয়ে এসেছি, আবার সে পথে ফিরে যাই। যদি তুমি আমাকে ভীরু ও কাপুরুষ ভেবে থাকো, তবে আমাকে যুদ্ধের মাঠে পাঠিয়ে দাও। দেখবে, মরার আগে আমি অন্তত একশ মুসলমানকে হত্যা করেছি।”

মার্ক লী সঙ্গীর মনের অবস্থা বেশ বুঝতে পারছিল। এ অবস্থায় তাকে কিছু বলা সমীচিন মনে করল না। সে সঙ্গীর কাঁধে হাত রেখে একটু হেসে বললো, ‘অতো ভয় পাচ্ছে কেন? জানো না, ভীরুরাই আগে মরে! জেফ্রে যদি অতো ভয় না পেতো, তবে মরতো না। যত বেশী সাহসী হবে ততই বাঁচার সম্ভাবনা বাড়বে। পৃথিবীতে যখন এসেছি মরতে আমাদের হবেই। মরার আগে এসো কিছু বড় কাজ করে যাই। যদি কোনদিন ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবর আবিষ্কৃত হয়, আমাদের ওরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। আমি একশ নয় হাজার মুসলমান কাটব কিন্তু মরব না। আমার সাথে আসো।”

সে সঙ্গীকে নিয়ে আবার পাহাড়ের গা বয়ে উঠতে লাগলো। পাহাড়ের চূড়া বেশী উঁচুতে ছিল না। ক্লান্ত পায়ে সেই চূড়ার দিকে এগিয়ে চলল ওরা। উঠতে উঠতে এক সময় চূড়ায় পৌঁছে গেল।

বালিতে তাদের চোেখ মুখ একাকার হয়ে গিয়েছিল। মার্ক লী চোখ মুখ মুছে টিলার উপর বসে পড়লো। সঙ্গীও বসলো তার পাশে।

মার্কলী বললো, “তোমার যদি মরুভূমি সম্পর্কে ভাল রকম অভিজ্ঞতা থাকে তবে সামনে মরিচিকা আছে কি না বুঝতে পারবে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখো, বলে এটা কি মরীচিকা?”

সঙ্গী তার দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে দেখল। তারপর সে চোখ বন্ধ করলো এবং আবার খুললো। এবারও গভীর ভাবে লক্ষ্য করে বললো, ‘না, এটাকে মরীচিকা মনে হচ্ছে না।’

সত্যি এটা কোন মরীচিকা ছিল না। তাদের চোখের সামনে ছিল খেজুরের কয়েকটি বাগান। গাছের পাতাগুলো সবুজ ছিল। গাছগুলো ছিল নিম্নাঞ্চলে এবং বেশ দূরে।

মার্ক লী উঠে দাঁড়াল। সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল তার সঙ্গীও। সবুজ উদ্যান দেখার সাথে সাথে ক্লান্তি ও ভয় দূর হয়ে গিয়েছিল ওদের।

হাঁটতে গিয়ে পায়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ওরা তখন দৌড়াতে শুরু করেছে। আগে আগে দৌড়াচ্ছে মার্ক লী, পেছনে তার সাথী। তাদের চলার পথে অদ্ভুত দর্শন টিলা পড়ছিল। কোনটা বড় আবার কোনটা ছোট। কোনটা এমন যেন কোন লোক হাঁটুতে মাথা গুজে বসে আছে। মার্ক লী এ সবের মধ্য দিয়ে রাস্তা খুঁজে দৌড়াচ্ছে।

সূৰ্য প্রায় ডুবতে বসেছে। মার্ক লীর শ্বাস-প্রশ্বাস জোরে বইছিল, বুক উঠানামা করছিল তার। সঙ্গীর অবস্থাও সঙ্গীন। পা টেনে টেনে চলছিল সে। মার্ক লী আচমকা থমকে দাঁড়াল এবং সন্তৰ্পন ধীরে ধীরে পিছনে সরে আসতে লাগলো। বুঝা যায়, কোন কিছু দেখে সে ভয় পেয়েছে। তার সাথী থমকে দাঁড়িয়ে বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

এখান থেকে হঠাৎ করেই একটি নিম্নাঞ্চল শুরু হয়েছে। কম করেও এক মাইল বিস্তৃত। তার চারপাশে মাটি ও বালির প্রাকৃতিক দেয়াল। অঞ্চলটি গভীর এবং শস্য শ্যামলে পরিপূর্ণ।

সেখানে খেজুরের ছোট বড় অনেক গাছ। স্পষ্টই বুঝা যায়, সেখানে অনেক পানি আছে। এমন কঠিন জাহান্নামে এমন শস্য শ্যামল প্রান্তর কল্পনার অতীত। অভিভূত হয়ে দু’জনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেই প্রান্তরের দিকে।

এই সেই প্রান্তর, একটু আগে পাহাড় চূড়া থেকে ওরা যা দেখেছিল এবং যার ঘ্রাণ পেয়েছিল মার্ক লী। এ এক অদ্ভুত এলাকা। একটু আগে ছিল নিরেট পাথুরে পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চল, হঠাৎ করেই সে দুর্ভেদ্য পাহাড়শ্রেণী শেষ হয়ে গেল। এরপর দেখা গেল মাটি ও বালি মিশ্রিত উপত্যকা, যেখানে হাঁটুতে মাথা খুঁজে বসে আছে অসংখ্য পাথরের মূর্তি।

হঠাৎ করেই আবার এ অঞ্চল শেষ হয়ে শুরু হয়েছে শস্য শ্যামল সবুজ প্রান্তর। অথচ এক জায়গা থেকে আরেক অঞ্চলের সামান্য আঁচও পাওয়া যায় না, সামান্য কল্পনায়ও আসে না।

মার্ক লী ভয় পেয়েছিল অন্য কারণে। কয়েক কদম পিছিয়ে সে দ্রুত বসে পড়েছিল এবং তার সাথীকেও হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়েছিল। তার চোখের সামনে ধরা পড়েছিল আশ্চর্য দৃশ্য।

ওখানে দু’জন মানুষকে সে এদিকেই হেঁটে আসতে দেখল। লোক দু’জন সম্পূর্ণ উলঙ্গ এবং তাদের গায়ের রং ছিল ঘন বাদামী। তাদের শারীরিক গঠন বেশ সুঠাম ও বলিষ্ঠ।

মার্ক লী তাকিয়ে থাকল। সেই উদ্যানের দিকে। দেখতে পেল, একজন মেয়ে মানুষ খেজুর গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বাগানের ভেতর দিয়ে আরেক দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভেনাসের মূর্তির মত সেও ছিল আপাদমস্তক নগ্ন।

তার মাথার চুল কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। চেহারা সুরতে এদের হাবশী বা জঙ্গলী মনে হচ্ছিল না।

‘এরা সব প্ৰেতাত্মার দল!” মার্ক লীর সাথী বললো, ‘এরা কখনও মানুষ হতে পারে না! মার্ক লী, সূর্য ডুবে যাচ্ছে, উঠো, এখনো সময় আছে, চলো আমরা পিছনে পালিয়ে যাই। রাতে এরা আমাদেরকে জীবিত রাখবে না?”

মার্ক লী এদের প্ৰেতাত্মা ভাবতে পারছিল না। সে বলল, ‘এরা প্ৰেতাত্মা নয়, আমার মনে হয়। এরাও মানুষ।”

কিন্তু তার কণ্ঠে তেমন জোর ছিল না। সে তখন ভাবছিল, এরা আবার কোন জাতি! এরা তো বাতাসে উড়ছে না, মানুষের মত মাটিতেই হাঁটছে। কৌতুহলের বশে ওরা আবার উঁকি দিল সবুজ প্রান্তরে। দেখল দূরে তিনটি শিশু দৌড়াদৌড়ি খেলছে। একেবারেই মানব শিশুর মত অবয়ব, ও কার্যকলাপ ওদের।

মার্ক লী হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল প্ৰান্তরের কিনারা পর্যন্ত। গিয়েই শুয়ে পড়লো। তার সাথীও তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। তারা যেখানে শুয়ে দেখছিল, সেখানকার দেয়াল তেমন খাঁড়া ছিল না। কিছুটা ঢালু হয়ে তা সবুজ প্ৰান্তরের সাথে মিশে গিয়েছিল এবং তা ছিল বালি ভর্তি।

মার্ক লীর সাথী আরও একটু অগ্রসর হয়ে ঝুঁকে নিচে দেখার চেষ্টা করলো। হঠাৎ বালি নিচের দিকে গড়িয়ে গেল এবং সে একেবারে নিচে গিয়ে পৌঁছলো।

সে সেখান থেকে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করলো। কিন্তু যতবার সে বালিতে পা রাখে, ততবারই সেখানকার বালি হড়কে যায় এবং সে আবারো গড়িয়ে পড়ে।

আতঙ্কে সে যেন পাগল হয়ে গেল, সে এখানে ওখানে পাগলের মত বালি খামচাতে লাগল। তার হাত পা অসাড় ও অবশ হয়ে হয়ে পড়ল। অবশেষে নেতিয়ে পড়ে হাল ছেড়ে দিয়ে সেই বালির ওপরই মুখ থুবড়ে পড়ে রইল সে।

মার্ক লী সঙ্গীকে পড়ে যেতে দেখেই জলদি পিছনে সরে গিয়ে একটি ঢিবির আড়ালে আশ্রয় নিল। সেখান থেকে গলা বাড়িয়ে সে নিচে সবই দেখতে পাচ্ছিল।

তার সাথী খৃষ্টান লোকটি গড়িয়ে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ গজ নিচে পড়ে গিয়েছিল। মার্ক লী তার সাথীকে উঠতে দেখলে এবং উপরে উঠার জন্য তার প্রাণপণ চেষ্টা অবলোকন করলো। কিন্তু মার্ক লী তাকে কোন সাহায্যই করতে পারল না।

দুজন উলঙ্গ লোক এদিকে আসছিল। তারা বালিতে মুখ থুবড়ে একটি লোককে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে সেখানে ছুটে এলো। মার্ক লী উপর থেকে তাদের দেখতে লাগলো।

তার সাথী তাকে দেখতে পাচ্ছিল না, মার্ক লীও ডেকে তাকে সতর্ক করতে পারছিল না। কারণ, সে চাচ্ছিল না, এখানে আরও কেউ আছে জেনে যাক ওই লোকগুলো।

লোক দু’জন এসে মার্ক লীর সাথীকে পিছন থেকে চেপে ধরলো।

তার কাছে খঞ্জর ও একটি ছোট তলোয়ার ছিল। কিন্তু অস্ত্ৰ বের করার সুযোগ সে পেল না। ঐ দুই লোক তাকে নিচে শুইয়ে দিল। সেই মহিলা, যাকে সে একটু আগে দেখেছিল এবং সেই শিশুরা, যাদের সে খেলতে দেখেছিল, দূর থেকে এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে তারাও সেখানে ছুটে এল।

তারা তাদের ভাষায় কাউকে ডাকলে। বাগান থেকে দশ বারোজন লোক ছুটে এল সে ডাক শুনে।

একজন মাটিতে পড়ে থাকা খৃস্টান লোকটির কোমর থেকে তলোয়ার বের করে নিল। আরেকজন তাকে শুইয়ে দিল।

মার্ক লী দেখলো, একজন তাঁর সঙ্গীর ঘাড়ের শাহরগে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং অন্যেরা আনন্দে নাচছে। নৃত্যরত লোকগুলো তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচছে আর হাত তালি দিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় গান গাইছে।

ইতিমধ্যে একজন বুড়োমত লোক এসে হাজির হলো। তার হাতে দেহ সমান লাঠি। তাকে দেখে সবাই একদিকে সরে গেল।

বৃদ্ধের লাঠির মাথায় ফনা তোলা দুইটি সাপের মাথা। ফেরাউনের প্রতি সম্মানের নিদর্শন স্বরূপ এই প্ৰতীক ব্যবহার করা হতো।

বৃদ্ধ মার্ক লীর সাথীর গায়ে হাত দিল। সে এখন আর ছটফট করছিল না। লোকটির পায়ের চাপে এরই মধ্যে সে মারা গিয়েছিল।

বৃদ্ধ এক হাত শূন্যে উঁচু করলো এবং আকাশের দিকে, তাকিয়ে কিছু বললো। নারী ও শিশুসহ উলঙ্গ মানুষগুলো সিজদায় পড়ে গেল।

কিছুক্ষণ ওভাবেই পড়ে থাকল লোকগুলো। বৃদ্ধ আবার হাত উপরে তুলল এবং কিছু বলল, সকলেই সিজদা থেকে উঠে দাঁড়ালো।

মার্ক লীর সাথী যেদিক দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল। সে দিকে হাত ইশারা করে একজন বৃদ্ধকে কিছু বলল। মার্ক লী অনুমান করল, লোকটি বলেছে, “এই মানুষটি উপর থেকে এদিক দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে।”

বৃদ্ধের আদেশে লোকেরা মার্ক লীর সাথীর লাশটি উঠিয়ে নিয়ে গেল। মার্ক লীর ভয় হলো, এই বন্য লোকেরা ওর সাথীদের খুঁজতে না উপরে উঠে আসে।

সে কিছুক্ষণ ওখানেই বসে থেকে নিচের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলো।

সূর্য ডুবে গেল। নিঃসঙ্গ মার্ক লী ভাবছিল এখন কি করবেঃ বন্ধুর অসহায় মৃত্যুর কথা মনে হলো তার। লোকগুলো তাকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করেনি, জানতে চায়নি কোথেকে কেন এসেছে সে? কিভাবে এসেছে? বরং ওকে হাতের নাগালের মধ্যে পাওয়ার সাথে সাথে তাকে হত্যা করেছে। কোন বিচারের ধার ধারেনি, এমনকি সরদার আসার জন্যও অপেক্ষা করেনি। তার মানে ওদের হাতে ধরা পড়া মানেই মৃত্যু।

আবার ভাবছিল, কঠিন জেনেই এ অভিযানের দায়িত্ব কবুল করেছিল সে। এই রহস্যময় লোকগুলো কারা, এখানে ওরা কি করছে, ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবরের সাথে ওদের কোন সম্পর্ক আছে কিনা, এই সব রহস্য উদঘাটন না করে ফিরে যাওয়া মানেই অভিযানের ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতা সে মেনে নিতে পারে না। যে অভিযানে তার দুই সাথী প্ৰাণ দিয়েছে, সে অভিযানে হয় সে সফল হবে নয়তো বন্ধুদের মত সেও দেশ ও জাতির নামে প্ৰাণ বিসর্জন দেবে, কিন্তু কিছুতেই ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে না।

রাতের আঁধার গ্রাস করে ফেলেছিল পাহাড়, মরুভূমি, উপত্যকা, প্রান্তর, সমস্ত চরাচর। নিশুতির নিরবতা নেমে এসেছিল উপত্যকার ঢালে, মার্ক লীর চতুর্পাশে। পেছনের বিকটদৰ্শন পাহাড়ের অবয়ব যেমন অদৃশ্য হয়েছিল সে আধাঁরের কোলে, তেমনি খর্জুর বিথীর সবুজ প্রান্তরের লোভাতুর দৃশ্যও উধাও হয়ে গেছে অনেক আগেই।

নিঃসঙ্গ মার্ক লী সাথীদের রক্তের কসম খেয়ে উঠে দাঁড়াল। তার এক হাতে খঞ্জর ও অন্য হাতে তলোয়ার। এদিকে ওদিক তাকিয়ে দেখলে সে। তারপর যাত্রা করল অসম্ভব এক অভিযানে, ভয়ংকর মৃত্যুর পথে।

মার্ক লী সেই পথে পা বাড়ােল যে দিকে তারা তার সাথীকে নিয়ে গেছে। প্রথমে সে এক পা রাখল বালিয়াড়িতে তারপর উবু হয়ে তলোয়ার ও খঞ্জর বালিতে গাঁথলো। এরপর দ্বিতীয় পা টেনে সামনে বাড়িয়ে তলোয়ার ও খঞ্জর তুলে এনে আবার সামনে গাঁথলো। এইভাবে তলোয়ার ও খঞ্জারে ভর দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে অন্ধকারে পা টিপে টিপে সমতলে পৌঁছতে তার আধা ঘন্টা পেরিয়ে গেল।

সবুজ প্ৰান্তরে নেমে এল মার্ক লী। সেখানে বিরাজ করছিল কবরের নিস্তব্ধ নিরবতা। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পথ চলছিল সে। ডানে-বামে ও পিছনে লক্ষ্য করছিল বারবার। কোথাও কোন শব্দ নেই। সেই সুনসান নিরবতার ভেতর দিয়ে পদে পদে মৃত্যুর ভয় নিয়ে এগুচ্ছিল সে। খেজুর বাগানের পাশ দিয়ে পথটি চলে গছে পশ্চিম দিকে।

মিনিট পনেরো এভাবে চলার পর দূর থেকে অস্পষ্ট গানের স্বর ভেসে এলে তার কানে। আস্তে আস্তে সে শব্দ জোরালো হলো। এখন পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, কোথাও গানের আসর বসেছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে নাচ-গানের সুমিষ্ট সুর।

সে ওই আওয়াজ লক্ষ্য করে খুব সাবধানে এগিয়ে গেল। একটু এগুতেই বাদিকে এক বিস্তৃত নিম্নভূমিতে সে দেখতে পেল কয়েকটি মশাল জ্বলছে। সেই মশালকে ঘিরে কম করেও বিশ-পঁচিশ জন নারী, পুরুষ ও শিশু বসে আছে। তারা নাচ দেখছে আর গান গাইছে। পাশেই আরেক জায়গায় অনেক কাঠখড় দিয়ে একটি অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয়েছে। সেই অগ্নিকুণ্ডে পোড়ানো হচ্ছে একটি মানুষের লাশ। লাশটির পা ও মাথা বেঁধে আগুনের ওপর ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। কয়েকজন তার পাশে দাঁড়িয়ে লাশটি। এদিক ওদিক ঘুরাচ্ছে যাতে ঠিকমত ঝলসালো হয়। এই লাশটি ছিল মার্ক লীর সেই হতভাগ্য সাথীর।

মার্ক লী এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখছিল আর ভাবছিল নিজের পরিণতির কথা। মানুষ-পোড়া মাংশের গন্ধে ভুরভুর করছিল এলাকাটা। দুর্গন্ধে তার বমি আসার উপক্রম। সে দেখলো, একদল তরুনী সেখান থেকে মাংশ কেটে সকলকে পরিবেশন করা শুরু করল।

মার্ক লীর মনে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো। তার কঠিন হৃদয়েও ফাটল ধরল। দুঃসাহসের পাহাড় চূৰ্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। ভীত চকিত হরিণীর মত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল তার সিংহ হৃদয়। তার অটল সংকল্প ও জাতিপ্ৰেম ভেসে গেল ভয়ের স্রোতে। সে আর এক মুহুৰ্তও সেখান দাঁড়াল না। সোজা ফিরে চলল যে পথে এসেছিল সেই পথে।

সে খুব সতর্ক হয়ে পথ চলছিল। সবুজ প্ৰান্তরের শেষ সীমান্তে এসে পৌঁছে গেল সে। উপত্যকার সেই ঢালের নিচে সে এখন দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে পড়ে যাওয়ার পর তার সাথী খুন হয়েছিল। নামার সময় তলোয়ার ও খঞ্জরের সাহায্য নিয়ে অনেক কসরত করে নেমেছিল সে কিন্তু কি করে এবার উপরে উঠবে ভেবে পেল না। কিছুক্ষণ সে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইল।

দূর থেকে একাধিক পাহাড়ী জন্তুর চাপা গর্জনের শব্দ ভেসে এল। তার মনে পড়ে গেল খাদে পড়ে যাওয়া দুৰ্ভাগা সাথীর কথা। হয়তো মরুভূমির শৃগাল এখন তাকে খাচ্ছে। আর অন্য সাথীকে তো খাচ্ছে মানুষই। অভিযানে বেরিয়েছিল ওরা তিনজন। দু’জন চিরবিদায় নিয়েছে, এবার কি তার পালা? কোন দিক থেকে আসবে মৃত্যু? কখন আসবে? কেমন করে আসবে? ভয়ের সাথে হতাশা ও অস্থিরতা ঘিরে ধরুল তাকে।

যেভাবে উপত্যকা থেকে নেমেছিল মার্ক লী, সেভাবেই অতি সাবধানে উপরে উঠতে শুরু করল সে। রাতের শেষ প্রহরে সে ঐ জায়গায় গিয়ে পৌঁছলো, যেখানে তাদের উট তিনটি বসেছিল। ওখানে সে এক মুহুৰ্তও দেরী করলো না। উটের গলায় বাঁধা পানি থেকে কয়েক ঢোক পান করে সে একটি উটের পিঠে উঠে বসলো। অন্য দুটি উট তার সঙ্গে পিছনে পিছনে চললো।

পর দিন সন্ধ্যা। মার্ক লী এক সম্মানিত মিশরীয় বণিকের বেশে আহমদ দরবেশের গৃহে প্রবেশ করল। আহমদ দরবেশ তাকে দেখেই প্রশ্ন করলে, “তুমি একা যে? ওরা দু’জন কোথায়?”

মার্কালী এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। সে ক্লান্ত ও অসহায় ভঙ্গিতে আহমদ দরবেশের সামনে বসে পড়লো। তার জ্ঞান বুদ্ধি তখনও ঠিক মত কাজ করছিল না।

“কি ব্যাপার! তোমাকে এমন বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন?”

“আমাকে একটু গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ দিন। সব কথাই বলবো আপনাকে৷”

মুখোমুখি বসলো দু’জন। গুছিয়ে নিয়ে কথা শুরু করল মার্ক লী। প্রতিটি ঘটনা ও কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করলো। বর্ণনার সাথে সাথে আহমদ দারবীশের চেহারার রঙ পাল্টে যাচ্ছিল। মার্ক লীর এক সাথীর করুণ মৃত্যুর বিবরণ শুনে আফসোস করলেন তিনি। কিন্তু তাকে যখন শোনানো হল দ্বিতীয় সাথীর মৃত্যুর কাহিনী এবং বলা হলো, “তাকে একদল মানুষ খেকো উলঙ্গ লোক খেয়ে ফেলেছে, তখন আহমদ দারবীশ দু:খ করার পরিবর্তে খুশীতে নেচে উঠলো।

‘তুমি কি সচক্ষে দেখেছে, তাদের কারো গায়ে কোন কাপড় ছিল না?”

“আমার কথায় আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না”

‘না, আমি তোমাকে অবিশ্বাস করছি না।” পুলকিত চিত্তে বললেন আহমদ দরবেশ, ‘তবু শুনতে চাচ্ছি, তুমি কি ভাল করে দেখেছো, বৃদ্ধের লাঠির উপর দুই ফনা তোলা সাপ? তুমি কি শিওর যে, সে লোকেরা তোমার সঙ্গীর গোস্ত খেয়েছে?’

‘আলবৎ শিওর! আমি কোন স্বপ্নের বর্ণনা দিতে বসিনি আপনার সামনে।” মার্ক লী বিরক্ত হয়ে বললো, “আমাদের ওপর দিয়ে যা ঘটে গেছে আমি শুধু তাই শুনাচ্ছি আপনাকে। আর আমি যা বলছি তা নিজ চোখে দেখেই বলছি।”

‘ফেরাউনও এ কথাই বলে গেছে, যা তুমি বর্ণনা করেছে।” আহমদ দরবেশ উঠে মার্ক লীর কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলেন এবং আনন্দের আতিশয্যে তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “তুমি রহস্য উদঘাটন করে ফেলেছো মার্ক লী! এই সেই লোক, যাদের আমরা অনুসন্ধান করছি। এই কবিলা সেখানে ষোলশ’ বছর ধরে বাস করে আসছে। এই লোকেরা চিন্তাও করেনি যে, সময় তাদেরকে মানুষের মাংস খেতে বাধ্য করবে। তুমি নকশার যে লেখাগুলো উদ্ধার করতে পারেনি। আমি তা করে ফেলেছি। এতে লেখা আছে, সাধারণত গুপ্তধনের রক্ষায় সাপের পাহারা বসানো হয়। কিন্তু আমার ধন ও কবরের হেফাজত করবে মানুষ। তাদের হাতে থাকবে ফনা তোলা সাপের আশা (লাঠি)। শত শত বছর পরে তারা নিজেরাই হিংস্ৰ পশু ও সাপের স্বভাব পেয়ে যাবে।

আমাদের সীমানায় যারা আসবে তাদের আমার রক্ষীরা খেয়ে ফেলবে। সভ্যতার সাথে এই রক্ষীদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। যুগ যুগ ধরে তারা এখানে উলঙ্গ জীবন যাপন করবে। বাইরের কোন লোক তাদের নারীদের ওপর কুদৃষ্টি দিতে পারবে না। যে দেবে সে এখান থেকে জীবিত ফিরে যেতে পারবে না।

“আমি জীবিত ফিরে এসেছি।’ বলল মার্ক লী।

‘তুমি নিচে ওদের কাছে যাওনি এবং আমি নিশ্চিত, তুমি কারো দিকে কুনজরে তাকাওনি, তাই তুমি ওখান থেকে জীবিত ফিরে আসতে পেরেছো৷’’ বললেন দরবেশ আহমদ। ‘তুমি যে কালো রংয়ের পাথুরে পাহাড়ের কথা উল্লেখ করেছে। সে পাহাড়ের কোন এক প্রান্তে ফেরাউন রিম্যান্সের আরক দেয়া লাশ ও তার পূঞ্জিভুত গুপ্তধন লুকানো আছে। যুগ যুগ ধরে এই বিবস্ত্ৰ মানুষেরা সে ধন পাহারা দিয়ে আসছে।’

‘তার মানে ফেরাউন রিম্যান্সের সময় থেকে তারা বংশানুক্রমে পাহারা দিয়ে আসছে!’ মার্কালীর বিস্মিত কণ্ঠ।

‘হ্যাঁ, ষোল শ’ বছর ধরে এ দায়িত্ব পালন করে আসছে তারা।”

“কিন্তু তারা আজো বেঁচে আছে কি করে?”

‘জানিনা তারা কি করে বেঁচে আছে। মনে হয় হিংস্র পশুর মত মরুভূমির পাখি ও পশু শিকার করে খায় তারা। তাছাড়া তুমিই তো বললে, সেখানে পানি ও খেজুরের অভাব নেই। এই পানি ও খেজুর তাদের বাঁচিয়ে রাখলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।”

“কিন্তু এই দুৰ্গম অঞ্চল থেকে তারা সভ্য জগতে ফিরে আসেনা না কেন?’ ‘তারা আজও ফেরাউনকে খোদা মান্য করে। যদি তাদের বিশ্বাসে চিড় ধরতো। তবে তারা অন্য কোথাও চলে যেতো। তুমি তাদের কাছে কোন অস্ত্রশস্ত্র দেখেছ?”

‘না, দেখিনি।’

‘তাদের সংখ্যা কত, অনুমান?”

‘রাতে যখন তারা একত্রিত ছিল তখন পঁচিশ ত্ৰিশজন দেখেছি।”

‘তারা তার চেয়ে বেশী নাও হতে পারে।’ আহমদ দারবীশ বললো, “তুমি তাদের কাছে কোন পশু দেখোনি?’

‘হ্যাঁ, দেখেছি।’ মার্কালী বললে, “আমি তাদের কাছে দুটি উট দেখেছি। হয়ত উট আরো বেশী আছে, কিন্তু আমি দুটিই দেখেছি।”

“হ্যাঁ, এ উট তারা বাইরে আসার কাজে ব্যবহার করে।’ আহমদ দরবেশ বললো, “শোন মার্ক লী। তুমি মনোযোগ দিয়ে শোন। পথিকদের শিকার করার জন্য ওরা বাইরে আসে। নিশ্চয়ই সেখানে কোন সোজা রাস্তা আছে যে পথ দিয়ে তারা বাইরে আসা যাওয়া করে। কোন গোপন রাস্তা, যা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। আমি তোমাকে যে রাস্তা বলে দিয়েছিলাম সে রাস্তা চলাচলের সহজ রাস্তা নয়। সেখানে অবশ্যই কোন সহজ রাস্তা আছে যা ঐ উলঙ্গ লোকদের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।’

আমি সে পদ্ধতিও চিন্তা করে ফেলেছি। পদ্ধতি হলো, সেখানে সুযোগ মত আক্রমণ করতে হবে। এতে দেয়াল পার হতে গিয়ে তোমার যে সাথী পড়ে মারা গেছে, হয়ত তার মত আরও কিছু লোককে জীবন দিতে হবে। কিন্তু এ, কুরবানী আমাদের দিতেই হবে। বলো, পঁচিশ-ত্রিশ জন জংলী মানুষ, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও আছে, এদের মারতে বা জীবিত ধরতে তোমার কতজন লোকের প্রয়োজন? মোটের উপর একটি সংখ্যা বলো। তুমিই হবে সেই বাহিনীর নেতা।”

‘আমি আপনার পরিকল্পনা বুঝতে পেরেছি।” মার্ক লী বললে, “এ পদ্ধতিতে আমরা হয়তো তাদের হত্যা করতে পারবো, হয়তো দু’একজনকে জীবিতও ধরতে পারবো। কিন্তু তারা আমাদেরকে গুপ্তধন পাওয়ার সমস্ত রহস্য বলে দেবে এ নিশ্চয়তা আমি আপনাকে দিতে পারবো না। কবিলার একজনকে মরতে দেখলে সকলেই মরতে প্ৰস্তুত হয়ে যেতে পারে। যাদের ধরে আনবো তারা আমাদের বিভ্ৰান্ত করতে পারে, ভুল তথ্য দিতে পারে। আবার এমনও বলতে পারে, এখানে কিছুই নেই, আর থাকলেও আমরা কিছু জানি না। বরং তাদের কিছু লোককে যদি পালানোর সুযোগ করে দিই তবে আমরা তাদের পিছু ধাওয়া করতে পারবো এবং এতে করে সহজ রাস্তা আমাদের জানা হয়ে যাবে।”

“তুমি খুব বুদ্ধিমান মার্ক লী।’ আহমদ দরবেশ বললেন, ‘বলো কতজন লোক দেব?”

‘পঞ্চাশ জন।’ মার্ক লী বললো, “অধিকাংশ লোক আমার নির্বাচিত হতে হবে। আমিই তাদের খুঁজে নেবো। মিশন শুরুর আগেই আমি এর নিশ্চয়তা চাই।’

“এ ধরনের শর্ত আরোপ করার দরকার কি মার্ক লী? তারচেয়ে তোমার দাবী মত পুরস্কার পাবে- তুমি।” আহমদ দরবীশ বললেন।

“আমাকে গুপ্তধনের অংশ দিতে হবে।” মার্ক লী বললো, “এত বড় ভয়ঙ্কর মিশন আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। গুপ্তধনের অনুসন্ধান করা একজন কমাণ্ডো বা গোয়েন্দার কাজ নয়। আমাকে গুপ্তধনের অনুসন্ধান বিভাগে চাকরী দেয়া হয়নি। এটা আপনার নিজস্ব মিশন। আপনার সম্মতি ছাড়া আমি দাবী করে কোন অংশ নিতে পারব না। যদি আপনার পরিকল্পনা সফল হয়ে যায়, তবে আপনি হবেন রাজ্যের শাসক, আমাকে আমার গোয়েন্দা বিভাগেই চাকরী করতে হবে।’

“এই মিশন ও পরিকল্পনা কারো ব্যক্তিগত নয়।’ আহমদ দরবেশ বললেন, “বাহ্যত এটা মিশর সরকারের পরিকল্পনা। কিন্তু তুমি ভাল করেই জানো, এটা ক্রুসেডরত সম্মিলিত খৃস্টান সম্প্রদায়ের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা।”