যে গুপ্তধনের সন্ধানে সুলতান আইয়ুবীর এত আপত্তি সেই গুপ্তধনের খোঁজে তারই এক জেনারেলের পাঠানো পঞ্চাশজনের এক অভিযাত্রীদল পৌঁছে গিয়েছিল ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবরের কাছে। মার্ক লী, ইসমাইল, কিন্তুরী ও এক খৃস্টান প্রথমে পৌঁছে যায় সেখানে। তাদের অন্যান্য সাথী, যারা পৃথক পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে যাত্রা করেছিল একই উদ্দেশ্যে, তারাও একে একে সেখানে এসে শামিল হতে লাগল। মধ্য রাতের একটু পরে মার্ক লী হাজিরা নিয়ে দেখল তার মিশনের পূর্ণ পঞ্চাশ জনই পৌঁছে গেছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
তারা এমন এক স্থানে মিলিত হলো, যার আশপাশ দিয়ে কোনদিন কোন পথিক চলাচল করেনি। স্থানটি দুৰ্গম এবং ভয়ংকর বলেই এদিকে আসে না কোন মরু-কাফেলা। এদিকে আসে না কখনো কোন টহল বাহিনী। সীমান্ত থেকে দূরে বলে এলাকাটা সীমান্ত প্রহরীদেরও আওতার বাইরে।
মার্ক লী রাতেই সকলকে পাহাড়ের এক ভয়ংকর খাঁজের মধ্যে এনে ঢুকালো যাতে বাইরে থেকে কেউ দেখতে না পায়। যদিও এই সতর্কতার কোন প্রয়োজন ছিল না, কারণ আশপাশে জনমানবের কোন চিহ্নও ছিল না, তবু হুশিয়ার মার্ক লী সদা সতর্কতার পরিচয় দিল এর মাধ্যমে। সবাই সেখানে পৌঁছে গেলে সে তাদের তাঁবু খাঁটিয়ে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলল। বলল, “যার যতক্ষণ ইচ্ছা শুয়ে থাকে, যতটা পারো বিশ্রাম নিয়ে নাও। কারণ এখান থেকে সবাইকে পায়ে হেঁটে এগুতে হবে।’ মার্ক লী সবাইকে আরাম করার অনুমতি দিয়ে কিন্তুরীকে নিয়ে নিজের তাঁবুতে ফিরে গেল।
পরদিন ভোর। সূর্যের উত্তাপ গায়ে লাগার পরে ঘুম থেকে জেগে উঠল তারা।
এ অভিযানে কি ধরনের অন্ত্রশস্ত্র ও জিনিসপত্র সঙ্গে আনতে হবে মার্ক লী তাদের আগেই বলে দিয়েছিল। সে অনুযায়ী তারা সবাই রশি, কোদাল, শাবল আর অন্ত্রশন্ত্রের মধ্যে তীর ধনুক ও তলোয়ার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
অভিযানে বেরোনোর জন্য প্রস্তুত হলো মার্ক লী। সাথীদের নিয়ে বসল। তাদের বলল রাস্তায় কোথায় কি ধরনের সমস্যা হতে পারে। পথের প্রতিটি বিপদ ও বাঁধা সম্পর্কে অভিযাত্রীদের একটি ধারনা দিল মার্ক লী। বিশদভাবে বুঝিয়ে বললো দুৰ্গম অঞ্চলগুলোর কথা। খাদের মধ্যে ভঙ্গুর ও পাতলা প্রাচীরের কথা বললো তাদের। অভিযাত্রীরা দুৰ্গম অঞ্চলে পা রাখার পূর্বেই এলাকা সম্পর্কে একটি ধারনা পেয়ে গেল এর ফলে।
সে তাদেরকে মানসিকভাবে আরো শক্ত করে গড়ে তোলার জন্য প্রাচীর থেকে পড়ে যাওয়া সাথীর গল্প শোনাল নির্বিকার চিত্তে। তাদেরকে বলল মঞ্চের মত উপত্যকার কান্নার শব্দের কথা।
সবাই অভিযানে বেরিয়ে পড়ার জন্য প্ৰস্তুত হলো। উটগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না বলে এগুলোর দেখাশুনা ও রাখালীর জন্য একজনকে রেখে যাওয়া প্রয়োজন। তার সাথে আপাতত কস্তুরীকেও এখানেই রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল মার্ক।
মার্ক লীর আশা, ভিতরে যাওয়ার কোন একটা সহজ রাস্তা সে অবশ্যই পেয়ে যাবে। তখন কস্তুরীকে সে সেই পথে ভিতরে নিয়ে যাবে। কিন্তু সে রকম কোন পথের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত তাকে এখানেই থাকতে হবে। সে কস্তুরীর দেখাশোনার জন্য ইসমাইলকে রেখে গেল তার সাথে।
মার্ক লী ইসমাইলকে বলল, ‘তুমি কস্তুরীকে দেখাশোনা করার জন্য এখানেই থাকবে। তার আরাম আয়োশের প্রতি খেয়াল রাখবে। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে এসে তোমাদের দু’জনকে নিয়ে যাব।’
মার্ক লী তার দলবল নিয়ে রওনা হয়ে গেলো। আগের পথ ধরেই পাহাড়ে প্রবেশ করল ওরা। তবে সরু রাস্তাটি উটের বদলে পার হলো পায়ে হেঁটে। আগের মত অনিশ্চিত অবস্থায় পা বাড়াতে হলো না তাদের। রাস্তাটি মার্ক লীর পূর্ব পরিচিত। আগে আগে নিৰ্ভয়ে হেঁটে গেলো ও, পুরো বাহিনী তার পিছনে তাকে অনুসরণ করল।
যতই লোকগুলো এগিয়ে যেতে লাগলো ততই ভয় ক্ৰমশ: বাড়তে লাগল তাদের। তারা জানতো পথটি দুৰ্গম, কিন্তু বিরান ও ভয়াবহ অঞ্চল বিকট পাহাড় ও টিলা তারা আগে কখনও দেখেনি। তারা যখন কান্না উপত্যকায় পৌঁছলো তখন সকলে আতংকিত চিত্তে এদিক ওদিকে দেখতে লাগলো। তারা বিশ্বাস করতে পারুল না, এটা স্রেফ বাতাসের খেলা। তাদের মনে হলো, নি:সন্দেহে একদল মেয়ে বা তাদের প্ৰেতাত্মা এখানে কান্নাকাটি করছে।
কাফেলার সবাই এ অঞ্চলের গল্প শুনেছিল মার্ক লীর কাছে। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বলচিত্তের, তারা ভাবল, তাদেরকে সাহস জোগানোর জন্যই মার্ক লী এ গল্প শুনিয়েছে। এ ভাবনা মনে হতেই তারা আরো আতংকিত হয়ে পড়ল। কিন্তু পুরষ্কারের লোভে এই আতংক ও ভয় দাবিয়ে রাখল ওরা তবে এদের মধ্যে যারা ক্রুসেডের বেতনভুক গোয়েন্দা ও কমাণ্ডো ছিল তারা ততটা ভীত হলো না। তারা তাদের অফিসার মার্ক লীর নির্দেশ তামিল করে ঠিকমতই এগিয়ে যাচ্ছিল। তাদের দেখাদেখি এবং পুরস্কারের লোভে বাকীরাও অগ্রসর হতে লাগল।
ভীত সন্ত্রস্ত চিত্তে একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে কোন রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই তারা সবাই এসে জড়ো হল কান্না উপত্যকায়।
সবচেয়ে বিপদজনক এবং কঠিন অঞ্চল এখন তাদের সামনে। সেই গহীন খাদ ও তার মাঝখান দিয়ে সংকীর্ণ ভঙ্গুর দেয়াল এবার পার হতে হবে অভিযাত্রীদের। অতল গহীন খাদ ও চিকন দেয়াল দেখে দলের সবাই খুব ভয় পেয়ে গেল।
মার্ক লী বেশ অসুবিধায় পড়ে গেলো ওদের নিয়ে। বলল, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি এর আগেও এ দেয়াল পার হয়েছি। একটু সাবধান ও সতর্ক থাকতে হবে, এই যা।”
মার্ক লীই সবার আগে পা রাখলে সেই প্রাচীরে। তার পিছনে পা বাড়ালো তার এক কমাণ্ডো। তাদের দেখাদেখি সকলেই সেই দেয়াল পার হওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো। একটু পর দেখা গেল, মার্ক লী দেয়াল পার হয়ে ওপারে চলে গেছে।
আরো কয়েকজন ওপারে পৌঁছে গেল। এখানো যারা দেয়ালে চড়ার সুযোগ পায়নি এ দৃশ্য দেখে তাদের সাহস বেড়ে গেল।
এমন সময় একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল, কেউ একজন দেয়াল থেকে ছিটকে পড়ে গেল অতল গহীন খাদের গভীরে। তার সাথে সাথে চিৎকারের ধ্বনিও নেমে গেল নিচের দিকে। এক সময় হারিয়ে গেল। সে বিকট চিৎকারের ধ্বনি।
এমনিভাবে কিছুক্ষণ পরপর একটি করে চিৎকার ভেসে আসতে লাগল এবং তা খাদের গভীরে হারিয়েও গেল। মার্ক লী গুণে দেখল, এ পর্যন্ত পাঁচটি চিৎকার ভেসে এসেছে। দলের সবাই যখন ওপারে গিয়ে একত্রিত হলো তখন দেখা গেল, তাদের পাঁচজন সাথী নেই।
মার্ক লী তাদের বললো, ‘সামনে আর এমন ভীতিকর পথ নেই। আমরা আমাদের লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি এসে গেছি। আশা করছি, এই পথে আর তোমাদের ফিরে যেতে হবে না। একটি সহজ সরল পথ নিশ্চয়ই পেয়ে যাবো।’
ওখান থেকে আবার ওরা রওনা হলো। ওদের গন্তব্য নিম্নাঞ্চলের দিকে। পাথুরে পাহাড় অতিক্রমের পর মার্ক লী সেদিনের মত যাত্রা বিরতি করল। বলল, “আজ দিনের মত এখানেই আমরা বিশ্রাম নেবো। এই ঢালু এলাকার শেষ প্রান্ত থেকেই শুরু হয়েছে সবুজ প্রান্তর। ওখানেই আছে ফেরাউনের সম্পদের পাহারাদার রক্ষীরা। রাতে ওখানে হানা দেবো আমরা।”
রাত গভীর হলো। মার্ক লী তার বাহিনী নিয়ে রওনা হলো আবার। উপত্যকার এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পাথুরে মূর্তি। ওরা সেগুলো অতিক্রম করে প্রান্তরের শেষ মাথায় এসে পৌঁছলো। এখান থেকেই শুরু হয়েছে শ্যামল সবুজ গভীর নিম্নাঞ্চল! মার্ক লী সেখান থেকে একটু দূরে সবাইকে লুকিয়ে থাকতে বলে মাত্র দু’জন লোককে সঙ্গে নিয়ে নিচে চলল। অন্যান্যদের বলে গেলো, “তোমরা রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়। দুজন পাহারায় থাকবে। আমরা ইঙ্গিত দিলে বাকীদের জাগিয়ে দেবে।’
নিচে তখন মৃত্যুর নিরবতা বিরাজ করছে। কোথাও কোন সামান্য আলোও দেখা যাচ্ছে না। তারা অনেক কষ্টে নিচে নেমে এল। তারপর এগিয়ে চলল সবুজ শ্যামল গ্রামের ভেতর। কিন্তু কিছু দূর এগুনোর পর কি হলো, মার্ক লী সঙ্গীদের বলল, “না, আজ আর যাবো না, অভিযানের আগে দিনের বেলায় এলাকাটা আরেকবার দেখে নিতে চাই।’
কস্তুরী পেশাদার নর্তকী, সব সময় আমোদ প্রমোদ ও মজলিশী মেজাজে থাকায় অভ্যস্থ। শরাব পান, আড্ডা দেয়া ও পানির মত টাকা খরচ করে সময় কাটানো তার অভ্যাস। মার্ক লীরা চলে যাওয়ায় সে বলতে গেলে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল। এই ভয়ানক নির্জনতায় মার্ক লী তাকে এমন একটি লোকের সাথে রেখে গেল যাকে সে চেনে না।
মশহুর নর্তকী হিসাবে অনেকের মত ইসমাইলও তাকে চিনতো, কিন্তু সে ইসমাইলকে চিনতো না বা তার সম্পর্কে তার কোন ধারনাও ছিল না। ইসমাইল অপরাধ জগতের লোক হলেও তার চেহারায় তার ছাপ ছিল না। তার চেহারা ছিল সুশ্ৰী ও সুন্দর। আচরণ ছিল ভদ্র ও মার্জিত। স্বাস্থ্য ছিল সুঠাম ও সুগঠিত। তাই অপরাধ জগতের লোক হওয়ার পরও বাইরে থেকে তাকে অভিযাত ঘরের সম্মানিত লোক বলে মনে হত। ফলে কস্তুরী তার আসল পরিচয় জানতে পারল না।
ইসমাইল কস্তুরীর সঙ্গে কথা বলতে ইতস্ততঃ করছিল। সারাদিন সে কস্তুরীর ভালমন্দের খেয়াল রাখলেও একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখল। কস্তুরীর মনে হল লোকটা অতিশয় ভদ্র। সন্ধ্যার পর সে কস্তুরীকে ভুনা মাংস গরম করে দিল। খাওয়ার পর উৎকৃষ্ট শরাব দিল পান করতে। বলল, “পানাহারের পর শুয়ে পড়ুন। যদি কোন প্রয়োজন হয় তাঁবুর মধ্য থেকে ডাক দিলেই আপনি আমাকে হাজির পাবেন।”
ইসমাইল বাইরে বেরিয়ে গেল। কস্তুরী খাওয়ার পর শরাবও পান করল, কিন্তু শোয়ার পর কিছুতেই তার ঘুম এল না। নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা তাকে ভীষণ রকম অস্থির করে তুললো।
কস্তুরী তার সৌন্দর্য্য এবং অভিনয় দক্ষতা নিয়ে গর্ব অনুভব করতো। নৃত্যপটিয়সী হিসাবে লোকজন তার প্রশংসা করলে অহংকারে ফুলে উঠত তার বুক। সে দেখেছে, পুরুষমাত্রই তার চারপাশে ঘুর ঘুর করে আনন্দ পায়। সবাই তার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করে। বিশেষ করে অভিজাত ঘরের লোকদের কাছে তার কদরই আলাদা। ফলে তার ধারণা ছিল, ইসমাইলও সে রকম কিছু চেষ্টা করবে। এই গর্ব ও অহংকার নিয়েই সে অপেক্ষা করছিল ইসমাইলের চাটুকারিতার। কিন্তু ইসমাইল তার ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ প্ৰকাশ করেনি দেখে কস্তুরীর আহমে আঘাত লাগল।
শুয়ে শুয়ে এ নিয়েই চিন্তা করছিল সে, কিন্তু এ চিন্তার কোন শেষ ছিল না। অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পরও যখন কস্তুরীর কিছুতেই ঘুম এল না তখন সে তাঁবু ছেড়ে বাইরে এল এবং ইসমাইলের তাঁবুতে এসে দেখল, সেও তখনো ঘুমায়নি। কস্তুরীর আগমনে ইসমাইল উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ব্যাপার, কোন অসুবিধা হচ্ছে?’
“এই নিশুতি রাতে নির্জন প্রান্তরে একটা মেয়ে একা একা থাকতে পারে বুঝি! তাঁর ভয় লাগে না?” সে তার কাছে বসে পড়ে বললে, “তুমি মনে হয় মুসলমান?”
“কি ব্যাপার! ধর্ম নিয়ে আবার মেতে উঠলে কেন?’ ইসমাইল উত্তর দিল, “তোমার আগ্রহ তো থাকার কথা শুধু অর্থের সাথে, সম্পদের সাথে, কোন ধর্মের সাথে নয়। আমার নাম ইসমাইল, তবে এখন আর আমার কোন ধর্ম নেই।”
কস্তুরী হেসে একটু বিস্মিত কণ্ঠে বললো, ‘কিন্তু কোন ইসমাইল তুমি? আহমদ দরবেশের বিশেষ পছন্দের কেউ?” সে প্রশ্ন করলো, “এই লোকটি কে, যে এ দলের নেতৃত্ব করছে? আমাকে সে তার নাম সুলায়মান সিকান্দার বলেছে, কিন্তু তাকে আমার মুসলমান বলে মনে হয় না।”
‘তোমার সন্দেহ অমূলক নয়, লোকটি আসলেই মুসলমান নয়।’
‘তাহলে বলো, লোকটা এ দেশেরও নয়”।
‘হ্যাঁ, এ ব্যক্তি মিশরীয় নয়, সুদানীও নয় এবং তার প্রকৃত নাম সুলায়মান সিকান্দারও নয়।”
‘তবে সে কে?” কিন্তুরী প্রশ্ন করলো, “তার আসল নাম কি? কোথাকার লোক?”
“আমি তার নাম ও পরিচয় তোমাকে বলতে পারবো না।” ইসমাইল বলল, ‘এই গোপনীয়তা রক্ষার জন্যই আমি মূল্য পাই। তোমার তো লোকটি কে, এ নিয়ে কোন আগ্রহ থাকার কথা নয়? তুমি তোমার দাবী মত মূল্য পেয়েই তাকে আনন্দ দান করতে এসেছে; আর এটাই তোমার পেশা। সে তোমাকে গুপ্তধনের কিছু অংশ দেয়ার অঙ্গীকার করে থাকলে হয়তো তাও পেয়ে যাবে। কিন্তু এ জন্য তার পরিচয় জানা তোমার জন্য জরুরী নয়।”
‘গুপ্তধন! সে তো আমার পাওনা!” কিন্তুরী বললো, “সে আমাকে যে মূল্য দিয়েছে, সে মূল্য এই ভয়াবহ মরু নির্জনে আসার জন্য অতি নগন্য। আমি তো গুপ্তধনের অংশ নিতেই তার সঙ্গে এসেছি!”
‘তুমি কি মনে করে, যে গুপ্তধন লাভের আশায় তুমি এখানে এসেছে, সেই কাংখিত গুপ্তধন এত সহজেই পাওয়া যাবে? আর তা পাওয়া গেলে তার অংশ সে তোমাকেও দান করবো?” ইসমাইল প্রশ্ন করলো।
‘কেন, তোমার এতে সন্দেহ আছে? মনে রেখো, আমি এমন মূল্যবান এক মেয়ে, লোকেরা যাকে গুপ্তধনের মূল্য দিয়েও কিনতে আগ্রহী।” কস্তুরী একটু অহংকারের স্বরেই বললো, “এই লোক আমার কি মূল্য আদায় করবে! আমি এমন সব আমীরজাদা, শাহজাদাদেরকে গোলাম বানিয়ে রাখি, সে তুলনায় এ তো কিছুই নয়।”
‘সে আর কত দিন?” ইসমাইল হেসে বললো, ‘খুব বেশী হলে আর দু’ বছর, চার বছর! তারপর তোমার কানাকড়ি মূল্যও থাকবে না। তুমি পাগলিনীর মত অলিতে গলিতে ছুটে বেড়ালেও কেউ জিজ্ঞেসও করবে না। যার কাছে গুপ্তধন আছে, তার কাছ থেকে এক কস্তুরী গেলে দশ কস্তুরী ছুটে আসবে। শোনো কিন্তুরী, বেশী অহংকার করো না।”
‘কেন করবো না?” কস্তুরী বললো, “এই লোক আমার রূপের যাদুতে এমন ফেসে গেছে যে, সে আমার কাছে কসম খেয়ে বলেছে, সে শুধু আমাকে পাওয়ার জন্যই গুপ্তধনের খোঁজে বেরিয়েছে। সে আমাকে আলেকজান্দ্ৰিয়া নিয়ে যাবে। সেখানে আমরা সাগর তীরে এক আলীশান মহল গড়বো।
তারপর আমি আর নর্তকী থাকবো না। এতেও কি তোমার সন্দেহ আছে?”
‘তাতে আমার কোন সন্দেহ করার দরকার নেই। তবে যে আশ্বাস তোমাকে সে দিয়েছে তাতে মস্ত বড় এক ফাঁক রয়ে গেছে।’ ইসমাইল বললে, “আমাকেও উপযুক্ত মূল্য দিয়েই এখানে পাঠিয়েছেন আহমদ দারিবীশ। তার কথাই আমার কাছে হুকুম। তিনি আমাকে বলেছেন, তুমি ওর সাথে যাও, তাই আমি এসেছি। এটাই আমার পেশা, আমি একজন ভাড়াটে খুনী। উপযুক্ত মূল্য পেলে আমি খুন করি, কিন্তু মিথ্যা কথা কখনও বলি না। আমি কখনও ধরা পড়ি না, কারণ আহমদ দরবেশ আমাকে বাঁচিয়ে দেন।
আমার মধ্যে আর একটি জিনিস আছে, সে হলো আমি নারীকে সম্মান দেই। আমি জানি না, কেন আমি এমনটি করি। নারী সে পর্দানশীল ভদ্র মহিলা হোক অথবা নর্তকী বা বিলাস সুন্দরী, আমি সকলকেই সম্মান করি। আমি কখনো কোন মেয়েকে ধোঁকা দেই না, তোমাকেও ধোঁকার মধ্যে রাখবো না। তোমাকে বলতে বাঁধা নেই, এ গুপ্তধন কারো মহল তৈরীর জন্য তালাশ করা হচ্ছে না, এর অর্থ মিশরের মূল উৎপাটনে ব্যবহার হবে। এ অর্থ দিয়ে এখানে খৃস্টীয় শাসন কায়েম করা হবে, মসজিদগুলোকে গীর্জা বানানো হবে। আর যদি তা সম্ভব না হয় তবে এ গুপ্তধন দেশের বাইরে চলে যাবে। আমি জানি, মিশরের প্রতি তোমার কোন ভালবাসা বা দরদ নেই, আমারও নেই। আমরা দু’জনেই পেশাদার! পাপ আমাদের পেশা।
আর একবার শুনে নাও! তোমার সৌন্দর্য ও যৌবনের কাল আর অল্পই বাকী আছে, আর এই লোক তোমাকে সাথে নিয়ে এসে শুধু আমোদ-স্ফুর্তি ও আরাম-আয়েশের জন্য। তার দৃষ্টিতে তুমি এক বিলাস কন্যা ছাড়া কিছু নও। যদি তোমার ওপর তার দয়া হয়, তবে দু’একটা হীরার টুকরো হয়তো দিতে পারে, কিন্তু কোন মহল তৈরি করবে না। সে যদি কোন মহল তৈরীই করে তবে তা তোমার জন্য নয়, সে এক নব যৌবনা রূপসীর জন্য; যে নব যৌবনা তুমি হতে পারবে না। তোমার চেহারায় এখনই ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। আজ হয়তো সে ভাঁজ সুন্দর লাগছে, কিন্তু আরেকটু গভীর হলে এ ভাঁজই তোমার সৌন্দর্যের চাহিদা শেষ করে দেবে।’
ইসমাইলের মুখে ছিল হাসি, ভঙ্গিতে ছিল আন্তরিকতার ছোঁয়া। সেখানে ধোঁকা বা মিথ্যার লেশ ছিল না। কস্তুরী কাউকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে এমনভাবে সত্যকে তুলে ধরতে আগে কখনও দেখেনি। তার ধারণা ছিল, ইসমাইল তার পিছনে দৌড়াতে শুরু করবে। কিন্তু তার পরিবর্তে সে তার যৌবনের ভাটির টানের কথা কি অবলীলায় বলে দিল! যে কস্তুরী তার সৌন্দর্যের প্রশংসা শোনায় অভ্যস্থ, যে নিজেকে মিশরের রাণী কল্পনা করতো, ইসমাইলের কথায় তার সে স্বপ্নের প্রাসাদ চূৰ্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। ইসমাইলের বলার ভঙ্গিতে যে যুক্তি ও বাস্তবতা ছিল, কস্তুরী তা অস্বীকার করতে পারল না। বরং সে সত্য অবলোকন করে তার অন্তরের অতল তলে হাহাকারের সুর বেজে উঠল।
নিস্তব্ধ নিরব রাত থমকে থাকল না, সে ক্রমশঃই এগিয়ে চলল। কস্তুরীর চোখে ঘুম এলো না। ইসমাইলের সাথে কথা বলেই রাত পার করে দিতে চাইল কিন্তুরী। সে তার এই মনোভাব গোপন রাখলো না। ইসমাইলও নিরাশ করলো না তাকে।
কথা বলতে বলতেই শেষ রাতের দিকে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল কস্তুরী। যখন ঘুম ভাঙল, দেখল, ইসমাইলের তাঁবুতে শুয়ে আছে সে।
ইসমাইল তাঁবুর বাইরে কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিল। তাকে ডেকে তুলে বললো, “আমি এক বিচিত্র স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে দেখলাম, কেউ একজন আমাকে বলছে, সুলায়মান সিকান্দারের গুপ্তধনের চেয়ে ইসমাইলের কথা অনেক দামী।”
সে হাসতে লাগলো। তার সে হাসিতে নর্তকীর কৃত্রিম অভিনয় ছিল না, ছিল এক ছোট্ট খুকীর সরলতা।
সূৰ্য উদয় হতে এখনো কিছু সময় বাকি। মার্ক লী নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী তার লোকদের একটি নিরাপদ ও উপযুক্ত স্থানে লুকিয়ে রাখল। সকাল যখন ফর্সা হয়ে গেল, তখন তারা সেই গোপন জায়গা থেকে নিচে বিবস্ত্ৰ নারী পুরুষকে চলাফেরা করতে দেখল। মার্ক লী তার দলের একজন সাহসী লোক নিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। সে তাকে বলল, “এই ঢাল দিয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে যাও৷”
দলনেতার নির্দেশ পেয়ে লোকটি জংলীগুলোর দৃষ্টি এড়িয়ে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে গেল এবং সমতল ভূমিতে গিয়ে পৌঁছলো। মার্ক লী তাকে ইঙ্গিতে সবুজ গাছপালার আড়ালে গা ঢাকা দিতে বলল। ইঙ্গিত পাওয়ামাত্র সে উঠে দাঁড়াল এবং গাছের আড়ালে গা ঢাকা দেয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করলো। এ সময় হঠাৎ করে তিন চারজন মানুষখেকো লোক তাকে দেখে ফেললো এবং তাকে ধরার জন্য দৌড়ে এলো। তারা আনন্দে চিৎকার করছিল। তাদের মনে পড়ে গেল, কদিন আগেই এ রকম একটি শিকার তারা পেয়েছিল এবং সবাই খুব তৃপ্তির সাথে ভোজনপর্ব সমাধা করেছিল সে রাতে।
তারা যখন লোকটার কাছে এসে তাকে ঘিরে ধরলো, তখন ওপর থেকে তাদেরকে তীরের নিশানা বানালো মার্ক লী ৷ জংলী লোকদের চিৎকার ধ্বনি শুনে আরও দু’জন দুটে এলো সেদিকে। তারাও তীরবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ল।
মার্ক লী উপরে এক পাথরের সাথে লম্বা রশি বাঁধতে বলল সঙ্গীদের। রাশি বাঁধা হলে সবাইকে বললো, “তোমরা একের পর এক রশি ধরে নিচে নেমে যাও।”
সবাই একে একে রশি বেয়ে নিচে নেমে গেল। মার্ক লী ওপর থেকে রশি খুলে নিচে ফেলে দিল এবং প্রথম জনের মত গড়িয়ে নিচে নেমে এল। তারপর সকলেই দল বেঁধে তলোয়ার উচিয়ে সামনের দিকে দৌড়ে গেল। কয়েকজন জংলী খালি হাতে অসুরের মত ছুটে এলো উদ্ধত তলোয়ারের সামনে, মুহুর্তে তাদের হত্যা করলো মার্ক লী ও তার বাহিনী। দূর থেকে আরো কিছু উলঙ্গ লোক ছুটে আসছিল তাদের সাহায্য করতে, কিন্তু তাদের নিহত হতে দেখে তারা ফিরে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
মাইলখানেক দীর্ঘ এ সবুজ উদ্যানটি কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। জংলীরা যেদিকে ছুটে গেল মার্ক লীর বাহিনী এবার ছুটিল সেদিকে। পলাতক লোকদের ধাওয়া করে তাদের তাড়িয়ে বেড়াতে চায় মার্ক লী। দেখতে চায় এখান থেকে বোরোনোর কোন গোপন পথে তারা প্ৰবেশ করে কি না।
জংলীদের চিৎকার ও ডাকাডাকির স্বর লক্ষ্য করে তাদের পিছু ধাওয়া করছে মার্ক লীরা। মার্ক লীর সামনে ছুটছে দুজন জংলী। সে তাদের অনুসরণ করে ছুটলো ওদের পিছু পিছু। মার্কালীর সামনে এখন দু’জন নয়, তিনজন জংলী ছুটে যাচ্ছে। ছুটতে ছুটতে জংলী তিনজন সবুজ উদ্যানের এক প্রান্তে এসে পৌঁছল এবং তিনজনই পড়িমরি করে এক পাহাড়ী উপত্যকায় উঠতে শুরু করলো।
মার্ক লী কিছুটা দূরত্ব রক্ষা করে তাদের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছিল। তিনজনই ছোট্ট উপত্যকাটি পেরিয়ে অপর দিকে নেমে গেল। মার্ক লী অনুসরণ করল তাদের। উপত্যকার পাহাড়ী অঞ্চল। সেখানে একটি পর্বত গহ্বরের মুখ ছিল, যার মধ্যে মাথা নত করে ঢুকে যাওয়া যেত। মার্ক লীর চোখের সামনে লোক তিনজন সেই পর্বত গহ্বরে প্রবেশ করল এবং তার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। মার্ক লী তলোয়ার হাতে সেই পর্বত গহ্বরের মুখে গিয়ে দাঁড়াল।
ভিতর দিকে গহ্বর ক্রমশ প্ৰশস্ত মনে হলো। মার্ক লী কালবিলম্ব না করে সেই গহ্বরে ঢুকে গেল। তার কানে এল জংলীদের দৌড়ানোর শব্দ। সেই শব্দ লক্ষ্য করে সাবধানে এগুতে শুরু করল মার্ক লী। এটা কোন প্রাকৃতিক সুড়ং নাকি ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্স মরার আগে এটা বানিয়ে ছিল স্পষ্ট বুঝা গেল না।
সুড়ঙ্গের পথ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, বাকের কাছে তা ঘুটঘুটে আঁধারের রূপ নিল। এভাবে কয়েকটি বাঁক পেরিয়ে আসার পর সামনের পথ কিছুটা আলোকিত মনে হল। মার্ক লী এখন আর লোক তিনজনকে দেখতে পাচ্ছিল না, তবে তাদের কথা বলার স্বর শুনতে পাচ্ছিল। সে দ্রুত এগিয়ে গেল এবং সামনেই জংলী তিনজনকে গুহার গোলাকার মুখ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে দেখল।
জংলী তিনজনকে সে হত্যা করতে চাইল না, কারণ তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এদের বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।
জংলী তিনজন গহ্বর থেকে বেরিয়ে গেলে মার্ক লীও গহ্বর থেকে বেরিয়ে এল। তিনজনের মধ্যে একজন আর ছুটতে পারছিল না, লোকটি পথের মাঝেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মার্কলী এগিয়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়াল। দেখলো, লোকটি ঐ বুড়ো, যাকে সেদিন সাপের ফনা যুক্ত লাঠি হাতে দেখেছিল। গতবার তার সাথী যখন মানুষ খেকোদের হাতে নিহত হয় তখন এ বুড়োই ওদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল।
এ লোক খুবই বৃদ্ধ ছিল, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার পর আর উঠে দাঁড়াতে পারলো না। গহ্বরের বাইরে টিলা ও পাহাড়ী পথ। এ পথ গিয়ে মিশেছে বালি এবং কাঁকড় বিছানো এক উঁচু উপত্যকায়। উপত্যকার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটু আগের দেখা কালো পাহাড়টি।
মার্ক লী বৃদ্ধকে ধরে উঠালো এবং তার পালিয়ে যাওয়া দুই সঙ্গীকে ডেকে থামতে ইশারা করলো। সে বৃদ্ধিকে বুঝাতে চেষ্টা করল, যেন তিনি তার দুই সঙ্গীকে ফিরে আসতে বলেন।
বৃদ্ধ তাদের ডাকলো। বৃদ্ধের ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল জংলী দু’জন। বৃদ্ধ তাদেরকে কাছে আসতে বললো। মার্ক লীকে সে মিশরীয় ভাষায় বলল, আমি তোমাদের ভাষা বলতে ও বুঝতে পারি, আমাকে হত্যা করে তোমার কোন লাভ নেই।’
মার্কলী মিশরী ভাষা ভালই বলতে ও বুঝতে পারতো। সে বৃদ্ধকে বললো, “আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই না। তোমার সঙ্গীদেরও হত্যা করব না। তোমরা শুধু বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা দেখাও।”
‘কেন, তোমরা কি এখান থেকে বের হতে পারছে না?” বৃদ্ধ প্রশ্ন করলো।
“হ্যাঁ!” মার্ক লী উত্তর দিল, “আমি তোমাদের রাজত্ব থেকে বের হয়ে যেতে চাই, কিন্তু পথ পাচ্ছি না।”
বৃদ্ধ তার দু’জন সাথীকে কিছু বললো, তারা দুজন খুব ভয় পেয়ে গেল বৃদ্ধের কথা শুনে। বৃদ্ধ মার্ক লীকে বললে, “এদের সাথে যাও, এরা তোমাকে বেরিয়ে যাওয়ার সোজা রাস্তা, দেখিয়ে দেবে।’
‘তুমিও আমার সাথে চলো, এরা আমাকে ভুল পথ দেখাতে পারে।” মার্ক লী বৃদ্ধকে বললো।
বৃদ্ধ তার সাথে যেতে বাধ্য হল। দুই পাশে দু’টো টিলার মধ্য দিয়ে সরু একটি পথ ধরে চলতে লাগলো তারা। কিছু দূর গিয়ে নতুন একটি টিলার ওপরে চড়ল। ওই টিলা পার হয়ে আঁকাবাকা পেঁচানো রাস্তা ধরে কিছুদূর এগুতেই খোলা মরুভূমিতে পৌঁছে গেল।
এমন জায়গা দিয়ে মরুভূমিতে পৌঁছল ওরা, কেউ ধারণাও করতে পারবে না এখানে কোন রাস্তা আছে, যা ভিতরের রহস্যময় গোপন পৃথিবীতে নিয়ে যেতে পারে।
বৃদ্ধ বলল, “তুমি এখন চলে যাও, নইলে খোদার অভিশাপে তুমি পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে।’
মার্ক লী বললো, ‘কিন্তু আমার সঙ্গীদের কি হবে? ওরা তো ভেতরে আটকা পড়ে আছে! ওদের ফেলে রেখে আমি কিছুতেই যেতে পারি না। ঠিক আছে, চলো, ভেতরে গিয়ে ওদের খুঁজে বের করি। তারপর ওদের নিয়ে চলে যাবো আমি।”
আমরা ওদেরকেও তোমার মত বেরিয়ে যাওয়ার পথ চিনিয়ে দেবো। তুমি না হয় এখানেই অপেক্ষা করো, আমরা ওদেৱ পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“কিন্তু ওরা তোমাদেরকে সে সুযোগ নাও দিতে পারে। এই অভিশপ্ত পাহাড়ে আটকা পড়ে ওরা পাগল হয়ে গেছে। ওরা তোমাদের হত্যা করে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তারচেয়ে আমাকে নিয়ে চল, তাতেই তোমাদের লাভ।’
অগত্যা তাকে সঙ্গে নিয়ে উলঙ্গ তিন জংলী আবার সেই পথে ফিরে চলল। ফেরার পথে মার্ক লী রাস্তার প্রতিটি বাঁক ও চড়াই উতরাই ভালমত দেখে নিল। আবার ওরা গর্তের মুখে এসে পৌঁছল এবং গুহাপথে হেঁটে সেই ভয়ংকর সবুজ প্রান্তরে প্রবেশ করলো। বৃদ্ধ তাকে সেখানে নিয়ে গেল, যেখানে মার্ক লীর সঙ্গীকে তারা আগুনে ভুনে খেয়েছিল।
মার্ক লীর সাথীরা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কয়েকজন জংলীর লাশ পড়ে থাকতে দেখল ওরা। শিশুদের লাশও ছিল তার মধ্যে। বৃদ্ধ এমন গণহত্যা আগে আর কখনও দেখেনি। তার চেহারা কঠিন হয়ে গেল। থমকে দাঁড়িয়ে সে খুব ধৈর্যের সাথে মার্ক লীকে জিজ্ঞেস করলে, “এই নিষ্পাপ শিশুদের তোমরা কেন হত্যা করলে?’
“তোমরা আমার সাথীকে আগুনে পুড়িয়ে খেয়েছিলে।” মার্ক লী জিজ্ঞেস করলে, “সে তোমাদের কি ক্ষতি করেছিল?’
‘সে পাপ-দুনিয়ার লোক ছিল। বৃদ্ধ বললো, “সে আমাদের পবিত্র ভূমিতে এসে এখানকার মাটিকে নষ্ট ও নাপাক করেছিল।”
“তোমরা এখানে কেন থাকো?” মার্ক লী জিজ্ঞেস করলো।
‘আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।” বৃদ্ধ বললো।
মার্ক লী তার লোকদের বলল, “এদের নারীদের ধরে নিয়ে এসো।’ আক্রমণের আগেই সে সবাইকে বলে দিয়েছিল, তারা যেন কোন নারীকে হত্যা না করে এবং তাদের লাঞ্ছিতও না করে। তাদেরকে শুধু নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে রাখে।
মার্ক লীর সাথীরা দশ বারোজন নারীকে নিয়ে এলো সেখানে। তাদের মধ্যে দু তিনজন বৃদ্ধা আর সব যুবতী। কিশোরী ও শিশু বালিকাও ছিল। এরা সবাই ছিল বস্ত্ৰহীন উলঙ্গ। কিন্তু এ জন্য কারো মধ্যে কোন সঙ্কোচ ছিল না। তাদের গায়ের রঙ গমের মত উজ্জ্বল ফর্সা। শরীরের গঠন সুঠাম সুডৌল, মুখের আকৃতি সুশ্ৰী ও সুন্দর! মাথার চুল তাদের কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল। মেদহীন নিটোল অবয়বগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মার্ক লী!
“তোমরা কি চাও, তোমাদের নারীদেরকে তোমাদের সামনেই অপমানিত ও হত্যা করি।” মার্ক লী বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলো।
“তার আগে কি তুমি আমাকে হত্যা করবে না?” বৃদ্ধ বললো।
‘না।” মার্ক লীর সোজা উত্তর।
“শোন পাপিষ্ঠরা!” বৃদ্ধ বললো, “তোমাদের নারীরা কাপড়ের আবরণে দেহ ঢেকে রাখে, কিন্তু মনের ওপর কোন আবরণ দেয় না। পর্দার মধ্যে লুকিয়ে থেকেও তারা হয় নির্লজ্জ ও বেহায়া। তাদের নিয়ে তোমরা নাচের আসর বসাও, গানের জলসা করে আর হৃদয়কে করো কলুষিত। নারীদের দেখলেই তোমাদের চোখে জাগে কামের নেশা, ভোগের আগুন। নারীর জন্য তোমরা খুনোখুনি করো, রাজ্য ত্যাগ করো। নারী হয় তোমাদের ধ্বংসের কারণ।
কিন্তু আমাদের নারীরা উলঙ্গ থাকে কিন্তু বেহেয়াপনা করে না। কোন পুরুষ তার জন্য নির্ধারিত নারী ছাড়া অন্য স্ত্রীলোকের দিকে কামের নজরে তাকায় না। নারীরা আমাদের পবিত্রতা ও সৌভাগ্যের প্রতীক। তোমরা আমাদের খোদা রিম্যান্সের সব গুপ্তধন নিয়ে যাও কিন্তু আমার অনুরোধ, আমাদের বউ-বেটির গায়ে হাত দিও না।’
‘গুপ্তধন পাওয়ার রহস্য বলে দিলে আমরা তোমাদের কোন নারীর অসম্মান করবো না, তোমাদের কারো ওপর কোন অত্যাচারও করবো না। যত তাড়াতাড়ি পারি আমরা গুপ্তধন নিয়ে এখান থেকে চলে যাবো, আর কোনদিন এ পথে পা বাড়াবো না।”
‘ভালোই বলেছ হে ডাকাত সর্দার! কিন্তু দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় কান দিতে নিষেধ আছে আমাদের আইনে। ডাকাতের কোন কথা বা অঙ্গীকারে বিশ্বাস করি না আমরা।’