» » ফেরাউনের গুপ্তধন

বর্ণাকার

এসব কথায় মার্ক লী মোটেই প্রভাবিত হলো না। সে তার সিদ্ধান্তে অটল। আহমদ দরবেশ নিরূপায় হয়ে গেল। কারণ সে জানতো, মার্ক লীর নেতৃত্ব ছাড়া রিম্যান্সের কবর পর্যন্ত যাওয়া অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। সুতরাং তার পরিকল্পনা মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই আহমদ দরবেশের। মার্ক লীকে সম্মত করাতে না পেরে অবশেষে তিনি তার প্রস্তাব মেনে নিলেন।

“আমি জানি না আমাকে কতদিন মরুভূমিতে পড়ে থাকতে হবে। আমি শুষ্ক ও কঠিন খাদ্যে অভ্যন্ত নই। আমাকে কয়েকটা বাড়তি উট দেয়া হোক, যাতে আমি ও আমার সঙ্গীরা খেয়ে বাঁচতে পারি।”

“বাড়তি উট তুমি পাবে, বলো আর কি চাই তোমার?”

“এ অভিযানে আমাদের সাথে কস্তুরীকে দেয়া হোক।”

‘কস্তুরী!” আহমদ দরবেশ বিস্মিত হলেন। বললেন, “এমন একজন কোমল নর্তকীর কি প্রয়োজন তোমার? এমন ভয়ংকর এক মিশনে কি করে তাকে পাঠাবো আমি? সে তো এ ধরনের প্ৰস্তাবে রাজীই হবে না?”

‘রাজী সে অবশ্যই হবে। হয়তো এ জন্য আপনাকে একটু চড়া মূল্য দিতে হবে। টাকায় বাঘের চোখ মেলে। আর আপনি সামান্য একটা নর্তকী জোগাড় করতে পারবেন না?” মার্ক লী বললো, “আমি তার জন্য এমন ব্যবস্থা করব, সে যে মরুভূমিতে এবং ভয়াবহ মিশনের সাথে রয়েছে। এ কথা সে অনুভবই করবে না। আমি তার সম্মান ও মূল্য বুঝি।’

এটা সেই যুগের ঘটনা, যখন কোন ধনী বণিক ও আমীর সফরে তার সুন্দরী স্ত্রীকে সঙ্গে রাখতো। কিন্তু স্ত্রীকে যদি তার ভাল না লাগতো তবে সে তার পছন্দমত নর্তকী ও গায়িকাকে সফর সঙ্গিনী, করে নিত৷ এই সব নর্তকী ও গায়িকারা চাহিদামত অর্থ পেলে আর কিছুই চাইতো না।

সামরিক কমান্ডাররা যুদ্ধের মাঠে সুন্দরী স্ত্রীকে সাথে না রাখতে পারলে ভাড়া করা বিলাস কন্যা সাথে রাখতো। সোনা রূপার মতই সুন্দরী নারীরা ছিল পুরুষের জন্য মূল্যবান অলংকারের মত। ইহুদী ও খৃস্টানরা মুসলিম সাম্রাজ্য ধ্বংস করার জন্য সব সময় এ ধরনের-সুন্দরী যুবতী বিলাস কন্যাদের ব্যবহার করতো।

মার্ক লী যে বিপদজনক অভিযানে যাচ্ছে তাতে কোন নর্তকী নেয়া স্বাভাবিক না হলেও মানসিক টেনশন দূর করার জন্য যদি সে দু’একজন নর্তকী সাথে রাখার ইচ্ছা পোষণ করে তবে আহমদ দরবেশ তাতে হয়তো আপত্তি করতো না। কিন্তু আহমদ দরবেশ আপত্তি তুলেছিল কস্তুরীর ব্যাপারে। কিন্তু কস্তুরী কোন সাধারণ নর্তকী ছিল না। সে ছিল কায়রোর সেরা সুন্দরীদের একজন। শুধু ধনী আমীর ও বিত্তবান সওদাগরদেরই মনোরঞ্জন করতো সে।

সুদানের বাসিন্দা এই মুসলিম যুবতী কেবল অসাধারণ সুন্দরীই ছিল না, তার নাচ এবং অভিনয়েও ছিল যাদু। যে একবার তার অভিনয় দেখতো তারই মাথা ঘুরে যেত। এই দরবেশ এ কথা কল্পনাও করতে পারছে না। এদিকে মার্ক লীও গো ধরে বসে আছে। কস্তুরীকে ছাড়া সে এই অভিযানে যেতে কিছুতেই রাজী হচ্ছে না। এবারও আহমদ দরবেশের হার হলো, কস্তুরীকে তার সাথে পাঠানোর চেষ্টা করবে বলে ওয়াদা করল আহমদ দরবেশ।

বাছাই করা পঞ্চাশ জন লোক সংগ্রহের কাজ শুরু হল। কায়রোতে ক্রুসেডদের গোয়েন্দা ও কমান্ডোর সংখ্যা কম ছিল না। মার্ক লীই ছিল তাদের নেতা। তাই, মার্ক লী তাদের নিয়েই এ গোপন অভিযানে যেতে চাচ্ছিল। কারণ এরা সবাই তার বিশ্বাসী ও আস্থাভাজন ছিল। আহমদ দরবেশেরও কিছু নিজস্ব লোক ছিল, যাদের সে এই অভিযাত্রী দলে শামিল করতে চাচ্ছিল। মার্ক লীর সাথে চুক্তি হয়ে যাওয়ার পরও সে এই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।

সুলতান আইয়ুবীর সেনানায়ক আহমদ দরবেশের বাহিনীর সবাই ছিল মুসলমান। কিন্তু ক্রুসেডরত খৃষ্টানদের প্রয়োজন ও স্বাৰ্থ রক্ষায় এরা ছিল নিবেদিতপ্রাণ। সুচতুর আহমদ দরবেশ নিজের ঈমান বিক্রি করার পর এসব মুসলমান কমান্ডোদেরও গাদ্দার বানিয়ে নিয়েছিল। এরা সবাই সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছ থেকে বেতন নিত কিন্তু হুকুম তামিল করতো খৃস্টানদের। বিশেষ করে ফেদাইন দলের নেতা হাসান বিন সাবাহ এর সাথে গড়ে উঠেছিল ঘনিষ্ট যোগাযোগ।

আহমদ দরবেশের পত্র নিয়ে কস্তুরীর কাছে মার্ক লী নিজেই গেল। আহমদ কোন সাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিল না, সে ছিল সামরিক বিভাগের উচ্চ ক্ষমতাধর এক অফিসার। মিশরের ক্ষমতায় তখন সামরিক শাসক। ফলে তার ক্ষমতার কাছে কস্তুরীর মত নর্তকীরা ছিল অসহায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কস্তুরী এই প্ৰস্তাবে সম্মতি দিতে বাধ্য হলো।

এবার মার্ক লী তাকে বললো তার মনের কথা। বলল, ‘ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছি আমি। সে সব ধনরত্ন, হীরা-জহরত উদ্ধার করতে যাচ্ছি আমরা। এ অভিযানে যারা থাকবে সেই সম্পদের ছিটেফোটা ভাগও যদি তারা পায় তবু একেকজন মস্ত ধনী হয়ে যাবে। এই সৌভাগ্যের অংশীদার করতে চাই আমি তোমাকে। এ জন্যই তোমাকে দলে নেয়ার প্রস্তাব করেছিলাম আমি। তুমি রাজী হয়েছে। দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি।”

গুপ্তধনের কথা শুনে লোভে চকচক করে উঠল কস্তুরীর চোখ। একটু আগেও যেখানে নিরাসক্ত একটি ভাব বিরাজ করছিল তার মধ্যে, সেখানে আগ্রহ ও উত্তেজনার টানটান অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। অভিযানে বেরিয়ে পড়ার জন্য আকুপাকু করে উঠল মন। গুপ্তধনের নেশা পেয়ে বসল তাকেও। সে উতলা কণ্ঠে জলদি অভিযানে বেরিয়ে পড়ার তাগাদা দিল মার্ক লীকে।

মার্ক লী ছিল ধুরন্ধর ও চালাক চতুর লোক। সে কস্তুরীর হৃদয়ে স্বপ্ন ও আশার ঝড় তুলতে সমর্থ হলো, রাণী ক্লিওপেট্রা বানিয়ে দিল তাকে। যতই বিখ্যাত হোক, কস্তুরী ছিল একজন নর্তকী। এরা শরীর ও সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন হয়, স্বর্ণালংকার এবং হীরা-জহুরতের উপর আকর্ষন অনুভব করে তবে সহজে আবেগতাড়িত হয় না। কিন্তু মার্কালী তার মনে গুপ্তধনের এমন নেশা ধরিয়ে দিল যে, কস্তুরী এই প্রথম সম্পদের আকর্ষণের সাথে সাথে প্ৰচণ্ড এক আবেগের স্রোত অনুভব করল তার হৃদয়সমুদ্রে।

তবে মার্ক লী ফেরাউনের অমূল্য সম্পদ কোথায় এবং কেন ব্যয় করবে, সে কথা তাকে বলেনি।

এ শক্ত সমর্থ, সাহসী ও কমাণ্ডো অভিযানে পারঙ্গম পঞ্চাশজন লোক খুঁজে বের করতে পনেরো-বিশ দিন লেগে গেল। এরা অধিকাংশই ছিল ক্রুসেড কমাণ্ডো। যে কজন মুসলমান ছিল, তারাও ছিল খৃষ্টানদের তল্পীবাহক। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর শুরু হল অভিযান। অভিযাত্রীরা যাত্রা করল নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

কায়রো থেকে তারা বেরোলো আলাদাভাবে। তিন-চার জনের একেকটি ক্ষুদ্র দল মুসাফিরের বেশে, ব্যবসায়ী বেশে কায়রো থেকে বের হয়ে গেল।

কন্তুরী রওনা হলো একজন পর্দােনশীল সম্মানিত মহিলা সেজে। মার্ক লী সাজলো তার স্বামী।

তাদের সাথে আছে দু’জন সফর সঙ্গী। একজন খৃষ্টান, অন্যজন ছিল মুসলমান। মুসলমান লোকটির নাম ইসমাইল। আহমদ দারবীশ তাকে এ দলে ঢুকিয়েছে। এ লোক অর্থের বিনিময়ে বা নিজের স্বার্থে যে কোন অন্যায় কাজ করতে পারতো। সে ভাড়াটে খুনী হিসাবেও কাজ করতো। সমাজের নিকৃষ্ট লোক হওয়ার পরও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তাকে ভয় করত।

মার্কালী তার স্বভাব চরিত্র ভাল করেই জানতো। কিন্তু এ মিশনে সে তাকে বিশ্বস্ত বলেই গণ্য করল। অভিযাত্রীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। তাদেরকে আঠারো মাইল দূরে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় একত্রিত হতে বলে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক দলই তীর, ধনুক ও তলোয়ার সাথে নিয়েছে। তাদের সাথে রশি এবং গর্ত খোড়ার সরঞ্জামও ছিল।

মার্ক লীদের দলই সবার আগে সেখানে গিয়ে পৌঁছলো।

মার্ক লী ওদেরকে পাহাড়ের এক নির্জন এলাকায় নিয়ে গেল। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই সেখানে তারা তাঁবু টানিয়ে ফেলল। তারা আশা করতে লাগল, রাতের মধ্যেই তাদের অন্যান্য সাথীরাও এসে পৌঁছে যাবে।

সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ আগে। এতক্ষণ ওরা তাঁবুর বাইরে বসে গল্পগুজব করছিল। মার্ক লী বলল, ‘এবার তাঁবুতে ফিরতে হয়। তোমাদের একজন সব সময় পাহারায় থাকবে, অন্যজন ঘুমোবে।”

কস্তুরীর হাত ধরে মার্ক লী উঠে দাঁড়াল। ইসমাইল তাকিয়ে রইল কস্তুরীর দিকে। কস্তুরীকে ও ভাল করেই চেনে, কিন্তু কস্তুরী জানে না ইসমাইল কি দুরন্ত ও ভয়ংকর লোক।

* * *

ক্রাকের রণাঙ্গণে নূরুদ্দিন জঙ্গীর জয় সুসম্পন্ন হলো। জয় লাভের পরপরই তিনি ক্রাক দূর্গ ও শহরের আইন-শৃংখলা ও শাসন ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করার দিকে মনযোগ দিলেন। তাঁর বাহিনী শহরের বাইরেও দূর দূরান্ত পর্যন্ত টহল দিয়ে বেড়াতে লাগল। এর ফলে খৃষ্টানরা আবার সংগঠিত হয়ে আক্রমণ করবে এ সুযোগ শেষ হয়ে গেল।

সুলতান খবর পেয়েছিলেন, পালিয়ে যাওয়া খৃস্টান সৈন্যদের কারো কারো মধ্যে পুনরায় সংগঠিত হয়ে অতর্কিতে রাতের আঁধারে হামলা করার চিন্তা কাজ করছে। এর প্রমাণও তিনি পেলেন। টহল বাহিনীর সাথে খৃস্টানদের এ ধরনের কয়েকটা ছোট ছোট দলের সংঘর্ষ হলো এবং তারা অল্পতেই পরাজয় বরণ করে পালিয়ে গেল।

সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী এমন এক রণাঙ্গণে যুদ্ধ করছিলেন মিশরে, যে রণাঙ্গণ খৃষ্টান ও তাদের দালালরা খুলে রেখেছিল। এই সেক্টর ছিল আরো ভয়াবহ, আরো ভয়ংকর ও জটিল।

সুলতান আইয়ুবী সশস্ত্র লড়াইয়ে যেমন পারঙ্গম, কুটনীতি ও ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায়ও তেমনি সজাগ, সচেতন ও সক্ষম ছিলেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সেক্টরে তিনি সফল আঘাত হেনেছেন এবং এখনো ক্রমাগত আঘাত হেনে চলেছেন। কিন্তু এমন কিছু সেক্টর তখনো ছিল যার খবর তাঁর জানা ছিল না।

ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবর ও গুপ্তধন অনুসন্ধানের অভিযান তার অন্যতম। নৈশভোজের পর সুলতান আইয়ুবী সেনাপতি ও অন্যান্য অফিসারদের নিয়ে এক গুরুত্বপূৰ্ণ বৈঠকে বসেছেন। সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা ছাড়াও এতে হাজির হয়েছেন গোয়েন্দা বাহিনী প্রধান আলী বিন সুফিয়ান এবং পুলিশ বাহিনী প্রধান গিয়াস বিলকিস।

সুলতান আইয়ুবী আজই ভোরে সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর এক দীর্ঘ পত্র পেয়েছেন। বৈঠকের শুরুতেই তিনি সেই দীর্ঘ চিঠির প্রয়োজনীয় অংশটুকু সবাইকে পাঠ করে শোনালেন।

জঙ্গী লিখেছেন, “প্রিয় সালাহউদ্দিন, আল্লাহ তোমাকে সুস্থ শরীরে সহিসালামতে বাঁচিয়ে রাখুন। ইসলামের হেফাজতের জন্য তোমার বিশেষ প্রয়োজন। ক্রাক ও আশেপাশের এলাকা এখন শক্ৰ মুক্ত। টহল বাহিনী দূর দূরান্ত পর্যন্ত পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমদিকে ক্রাকের বাইরে পালিয়ে যাওয়া ক্রুসেডারদের ছোটখাট দল আমাদের টহল বাহিনীর সাথে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষে লিপ্ত হলেও এখন অবশ্য সে সমস্যা নেই। তোমার কমাণ্ডো ও গোয়েন্দা বাহিনীর প্রশংসা না করে পারছি না। তারা দুৰ্দান্ত সাহসী, পরিশ্রমী এবং নিবেদিতপ্ৰাণ। তুমি তাদের গড়ে তুলতে যে পরিশ্রম ব্যয় করেছে, তারা এখন তার মূল্য দিচ্ছে। তোমার গোয়েন্দা বিভাগ তার চেয়েও বীর, সাহসী, হুশিয়ার এবং বিচক্ষণ। তাদের চোখ দিয়ে আমি এত দূরে বসে থেকেও শক্ৰদের প্রতিটি গতিবিধি স্পষ্ট দেখতে পাই।

তাদের কাছ থেকে যে তথ্য পাচ্ছি। তাতে আমার মনে হচ্ছে, খৃস্টানরা আবার আমাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছে। তারা উত্যক্ত করছে যেন আমরা অগ্রসর হয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালাই। তুমি জান, আমাদের প্রথম কেবল বায়তুল মুকাদাস আমাদের গন্তব্য স্থান। আমাদের সে লক্ষ্যস্থল এখনো অনেক দূর। আমি জানি, তুমি এই দূরত্ব ও লম্বা সফর নিয়ে ভীত হওয়ার লোক নও। আমিও দূরত্ব নিয়ে ভাবছি না, ভাবছি পথের নানা অসুবিধা ও বাধাবিঘ্ন নিয়ে। বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছতে, আমাদের অনেক দূর্গ জয় করতে হবে।

এইসব দূর্গের মধ্যে কয়েকটি খুবই মজবুত। ক্রুসেডাররা আমাদের প্রথম কেবল বায়তুল মোকাদ্দাসে পৌঁছার পথে অনেকগুলো প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে রেখেছে। তোমার গোয়েন্দা বিভাগ বলছে, ওরা আবার শক্তি সঞ্চায়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা গ্ৰীস ও ইটালীর নৌবাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করে মিশরের উপর আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওরা মিশরের উত্তরাঞ্চলে ভূমধ্যসাগর তীরে সৈন্য নামাবে। সে জন্য তোমাকে অবস্থার প্রেক্ষিতে সতর্ক থাকতে হবে।

আমার পরামর্শ হচ্ছে, তুমি এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্ৰহণ কর। বেশি করে দূরপাল্লার অগ্নিনিক্ষেপকারী ভারী মেনজানিকের মজুদ গড়ে তোল। উত্তরাঞ্চলের সমুদ্র তীরে শক্ৰদের যুদ্ধ জাহাজ এলে তাদের কোন বাঁধা দিও না। তাদেরকে কুলে ভিড়ার সুযোগ দিও। তারা যেন এই আনন্দেই মশগুল থাকে যে, তারা তোমার অজ্ঞাতেই এসে পৌঁছে গেছে। তাদের সৈন্যরা যখন জাহাজ থেকে নেমে যাবে তখন খালি জাহাজগুলোতে অগ্নিবর্ষণ করবে, আর ক্রুসেড বাহিনীকে তাদের পছন্দ মত জায়গায় আশ্রয় নেয়ার সুযোগ দেবে।

তোমার বর্তমান সমস্যা ও অসুবিধার কথা আমার অজানা নয়। তোমার কাসেদ সবই আমাকে বলেছে। কাবার প্রভুর কসম! ক্রুসেডদের সব সম্রাট যদি একত্র হয়ে তুফানের বেগে ধেয়ে আসে তবু রাসুল(সঃ) এর উম্মতের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। প্রতিটি ময়দান প্রমাণ করছে, মুসলিম জাতি কুরবানী দিতে জানে। এ জাতি আত্মত্যাগের বলে বলীয়ান জাতি।

কিন্তু আফসোস সালাউদ্দিন, কিছু ইমান বিকানো গাদ্দার মুসলিম জাতির পায়ে গোলামীর শিকল পরাতে ব্যস্ত। তাদের কারণেই আজ তুমি কায়রোতে আটকা পড়ে আছো। তাদের কারণেই বাগদাদ তোমাকে ডাকছে। এই গাদ্দাররা নারী, মদ ও অঢেল অর্থ ছড়িয়ে আমাদের মাঝে ফুটো তৈরী করছে। যদি আমাদের ঘরে শান্তি ও বিশ্বাস বিরাজ করতো, তবে আমরা দু’জন মিলে ক্রুসেডদের সঙ্গে সহজেই মোকাবেলা করতে পারতাম। কিন্তু কাফেররা এমন ভয়ানক চাল চেলেছে যে, মানুষের আচার আচরণ ও কাজ দেখে আজ আর চেনার উপায নেই, কে মুসলমান আর কে কাফের। মনে হয় যেন, মুসলমানরাই আজ কাফের হয়ে গেছে। এই অচেতন মুসলমানরা এতই নির্জীব যে, শক্ররা তাদের বোন ও কন্যাদের ইজ্জত-আবরু, মান-সন্ত্রম লুট করছে, এ দৃশ্য দেখার পরও তাদের চেতনায় কোন কাপন জাগে না, অনুভূতি নাড়া দেয় না।

ক্রাকের মুসলমানরা খুব দুরবস্থার মধ্যে ছিল। খৃষ্টানরা তাদের ওপর যে জুলুম অত্যাচার করেছে, সে সব কাহিনী যদি শোনো তবে তোমার চোখের অশ্রু রক্ত হয়ে ঝরবে। আমি আমার জাতির গাদ্দারদের কেমন করে বুঝাবো যে, শক্রদের সাথে বন্ধুত্ব শক্রতার চেয়েও ভয়ংকর!

তুমি আফসোস করে বলেছ, তোমার দ্বীনী ভাই, তোমার বিশ্বস্ত অফিসার, হাকিম এবং কমান্ডাররা তোমার বিচারে মৃত্যুদণ্ড পাচ্ছে। আইয়ুবী! আমার আফসোস শুধু এখানেই নয়, আমার আফসোস হচ্ছে এ জন্য যে, এইসব গাদ্দারদের খৃস্টান মুসলমানদের হাতে মুসলমানদের কেমন করে হত্যা করাচ্ছি। অথচ গাদ্দারদের কিছুতেই বুঝাতে পারছি না, কে তাদের বন্ধু আর কে তাদের শত্রু!

তুমি কখনও গাদ্দারদের ক্ষমা করবে না! মৃত্যুদন্ডই তাদের উপযুক্ত শাস্তি। এমন যেন না হয়, স্নেহ মমতা তোমাকে শরীয়তের বিধান পালনে গাফেল বানিয়ে ফেলে! আমি তোমার অপেক্ষায় থাকলাম।

তুমি যখন আসবে বেশী করে সৈন্য সঙ্গে আনবে। খৃস্টানরা তোমাকে এক জায়গায় আটকে রেখে যুদ্ধ করে তোমার শক্তি নষ্ট করতে চায়। এমন যেন না হয়, বায়তুল মুকাদাস আসার পথেই তুমি সব সৈন্য হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ো।

তুমি আসার আগে মিশরের আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে আসবে। সুদানীদের দিকে ভাল করে খেয়াল রাখতে বলবে গোয়েন্দাদের। আমি জানতে পেরেছি, তোমাকে অর্থনৈতিক সমস্যাও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে অচিরেই তোমার কাছে আমার সাহায্য পৌঁছে যাবে। যত শীঘ্ৰ পার কায়রো থেকে বেরিয়ে এসো। কিন্তু সাবধান! ভেতর ও বাইরের অবস্থা সব সামাল দিয়ে আসবে। আল্লাহ তোমার সহায় হউন।

* * *

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বৈঠকে উপস্থিত সকলকে এই চিঠি পড়ে শোনালেন। আরেকটি আশার খবর শোনালেন সবাইকে, এখন সেনাবিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য পল্লী এলাকা থেকেও যুবকরা আসতে শুরু করেছে। দুশমন ষড়যন্ত্রের যে জাল বিস্তার করে রেখেছিল এতদিন তা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দু’এক জায়গায় তার প্রভাব থাকলেও অচিরেই তাও নিঃশেষ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

যে ষড়যন্ত্র মসজিদের চার দেয়ালের মধ্যে শুরু হয়েছিল তারও মোকাবেলা করা হয়েছে। ভণ্ডপীরের ফেতনা নির্মুল পর খৃস্টানরা কয়েকজন ইমামকে টার্গেট করে তাদের দিয়ে নতুন এক ফেতনা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল। এই ইমামরা নিজ নিজ এলাকায় নিজেকে আল্লাহর দূত বলে দাবী করল। তাদের শিষ্যরা প্রচার করে বেড়াতে লাগল, আমাদের মধ্যে এমন হুজুর এসেছেন, যিনি বিপদের সময় সরাসরি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন।

এই ইমামরা খৃস্টানদের দেয়া অর্থ বিলিয়ে একদল এজেন্ট তৈরী করল। এই এজেন্টরা হয়ে গেল হুজুরের শিষ্য। এই শিষ্যরা হুজুরের নানা কেরামতি প্রচার করতে থাকল। তারা মানুষকে এই ধারণা দিতে লািগল যে, সাধারণ মানুষ কোন কিছুই খোদার কাছে চাইতে পারে না। আল্লাহও সরাসরি তাদের দাবী ও আবেদন শোনেন না।

সুলতান আইয়ুবী খবর পাওয়ার সাথে সাথেই সেই ইমামদের মসজিদ থেকে বহিষ্কার করলেন। সেখানে এমন ইমাম নিয়োগ করলেন যারা কোরআন হাদিসের সঠিক শিক্ষা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেন।

তারা জনগনকে বললেন মুসলমানদের আল্লাহ শিক্ষিত অশিক্ষিত সবার জন্য সমান। আমীর-গরীব, শাসক শাসিত সবারই আল্লাহ একজন। তিনি তার সব বান্দার আবেদন কাজের জন্য পুরষ্কার দেন এবং মন্দ কাজের জন্য শাস্তি দেন। কেবল গরীর-মিসকিন নয়, পীর-বুজুর্গ, আমীর-সওদাগর, এমনকি রাজা-বাদশাহও এই আইনের অধীন।

তিনি সবাইকে আলাদা ভাগ্য দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এবং মরার পর দুনিয়ায় ভাগ্যগুণে তার ওপর যে দায়িত্ব পড়েছিল সেই দায়িত্বের আলোকে তার কাজের হিসাব নেবেন। আপনার কাজের হিসাব নেবেন আপনার কাছ থেকে। একমাত্র হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) ছাড়া কোন নবী রাসূলও সেদিন কারো জন্য কোন সুপারিশ করবে না, পীর বুজুর্গ, ইমাম-হুজুর তো দূরের কথা।

সালাউদ্দিন আইয়ুবী বললেন, ‘বন্ধুগণ আমি আমার জাতির মধ্যে এই শক্তি, আবেগ ও প্রেরণা সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছি, যেন তারা নিজেকে ও আল্লাহকে জানার চেষ্টা করে। মানুষ যদি আল্লাহ ও তার মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে এবং এই সম্পর্কের কারণে পরষ্পরের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তা বুঝতে পারে তবে পৃথিবী কোন শক্তি তাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে না।

ক্রাক থেকে কায়রো এসে তোমরা বুঝতে পারছ শত্রু শুধু যুদ্ধের ময়দানেই যুদ্ধ করছে না, শয়তান যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল আল্লাহকে, সেই চ্যালেঞ্জই বাস্তবায়ন করছে ওরা। শয়তান বলেছিল, ‘আমি মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য তাদের সামনে থেকে, পেছন থেকে, ডাইনে থেকে, বায়ে থেকে অর্থাৎ চতুর্দিক থেকে হামলা চালাবো। ইহুদী ও খৃষ্টানরা এখন জোট বেঁধে সে দায়িত্বই পালন করছে। তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য, বিপথগামী করার জন্য চতুর্মুখী হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে তোমাদের, শয়তানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সেদিন আল্লাহ বলেছিলেন, যারা আমার খাঁটি বান্দা তাদেরকে তুমি কিছুতেই বিভ্রান্ত ও পরাজিত করতে পারবে না।

বন্ধুরা আমার! সেই দিন থেকে পৃথিবীর মানুষ দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়লো। একদল হয়ে গেল শয়তানের তাবেদার, আরেক দল হয়ে গেল আল্লাহর সৈনিক। আল্লাহর সৈনিকদের কাজ হল আল্লাহর সৃষ্টির হেফাজত করা, মানবতার পতাকা সমুন্নত রাখা। আর শয়তানের তাবেদারদের কাজ হলো মানুষের মাঝে পশুত্ব ও বর্বরতার বিস্তার ঘটানো। সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে হক ও বাতিলের চিরন্তন সংঘাত। সে সংঘাত অতীতেও চলেছে, ভবিষ্যতেও চলবে। পৃথিবীর ইতিহাস মূলত এই হক ও বাতিলের চিরন্তন সংঘাতের ইতিহাস।

এ লড়াইয়ে যুগে যুগে যারা আল্লাহর দলে নিজেদের নাম লিখিয়েছি, আমরাও সেই সৌভাগ্যবানদের কাতারে শামিল হয়েছি। আমাদের প্রথম কাজ সত্য ও মিথ্যাকে সনাক্ত করা এবং সত্যের স্বপক্ষে আল্লাহর সৈনিক হিসাবে আমাদের যথার্থ ভূমিকা পালন করা।

তোমরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ, দুশমনরা তোমাদের মনে নতুন আকিদা বিশ্বাস সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই মিশনে সর্বাধিক অগ্রগামী ইহুদীরা। এরা কখনো তোমাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে আসবে না। তোমাদের ঈমান দুর্বল-করার জন্য এরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের দোসর হিসাবে কাজ করছে খৃস্টানরা।

এই কাজে তারা এরই মধ্যে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছে। তোমরা সচেতন ও সচেষ্ট না হলে এমন এক সময় আসবে, যখন এই অভিশপ্ত জাতি মুসলমানদের ঈমানী শক্তি নিঃশেষ করে দেবে।

যদি নিজেদেরকে এই অধ:পতনের হাত থেকে উদ্ধার করতে চাও, তবে আর দেরী নয়, ছুটে যাও নিজের জাতির কাছে। তাদের দু:খ বেদনার সাথী হও। অহমিকা আর অহংকারের ময়লা মুছে ফেল নিজের শরীর থেকে। নিজেদেরকে শাসক ও জনগণকে শাসিত ভেবে তাদের সাথে অসদাচরণ করো না। তারা তোমাদের প্রজা এই চিন্তা ছেড়ে দাও। তুমি যেই খোদার বান্দা তারাও তারই গোলাম। তোমার মত তারাও আল্লাহর খলিফা, তারই প্রতিনিধি। নিজে এই বিশ্বাসে বলীয়ান হও এবং জাতির প্রতিটি ব্যক্তির মনে এই অনুভূতি তীব্রতর করো। সবার মধ্যে এমন মর্যাদাবোধ সৃষ্টি করো যেন তারাও জাতির শক্তি ও সম্মানের জন্য খুশী মনে নিজের জীবন কুরবানী করতে পারে।

সালাউদ্দিন আইয়ুবী আরো বললেন, ক্রুসেডারদের কাছে আছে নারী, অর্থ ও শরাব আর কমজোর ঈমানদারদের কাছে আছে এগুলোর জন্য লোভ ও লালসা। আমাদের এখন প্রয়োজন, মুসলমানরা যেন এই লালসার লাগাম টেনে ধরতে পারে সেই মিশনে ঝাপিয়ে পড়া। জাতির মন মানসিকতা থেকে অর্থ, মদ ও নারীর নেশা দূর করতে হবে। আর এর একমাত্র দাওয়াই হচ্ছে ঈমানের বলিষ্ঠতা।”

“আমীরে মুহতারাম!’ একজন সম্মানিত সেনাপতি বললেন, “আমাদের ধন-সম্পদের প্রয়োজন আছে। অর্থাভাবে আমাদের খরচ নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের বিভিন্ন কাজে অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে।’

‘ইনশাআল্লাহ, এই অসুবিধা দূর হয়ে যাবে।” সুলতান আইয়ুবী বললেন। ‘আমাদের এই বাস্তবতা স্বীকার করতেই হবে, মুসলমানদের কাছে অর্থ ও সৈন্য সবসময়ই কম ছিল এবং থাকবে। আমাদের রাসূল (সা.) তাঁর প্রথম যুদ্ধে মাত্র তিনশো তের জন মুজাহিদ নিয়ে ইসলামের সফলতার দ্বার উন্মোচন করেছিলেন। কেবল অর্থ নয়, জনবল, অস্ত্রবল সবকিছুই তাদের কম ছিল। কিন্তু তাতে ইসলামের অগ্রযাত্রা ব্যহত হয়নি।

এরপরও কাফেরদের সাথে মুসলমানদের যত যুদ্ধ হয়েছে তাতে মুসলমানরা কম শক্তি নিয়েই যুদ্ধ করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী এবং তাঁর সাহাবীগণ পেটে পাথর বেঁধে যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু আপোষ করেননি। এভাবেই রাসূলের সাহাবীরা আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আর মুসলমান যখন আল্লাহর পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হয় তখন তাদের অভাব মোচনের দায়িত্ব আল্লাহ নিজে বহন করেন। যে কারণে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আরবের মাটি থেকে অভাব অনটন এমনভাবে দূর হয় গিয়েছিল যে, আরবের মাটিতে যাকাত নেয়ার মত কোন লোক ছিল না, যাকাতের অর্থ তাদেরকে আরবের বাইরে পাঠাতে হতো।

আজ মুসলমানদের কাছে ধন-সম্পদ কম নেই। সমস্যা হচ্ছে, সেই সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে আছে মাত্র কয়েকজন লোকের কাছে। ছোট ছোট রাজ্যের রাজা ও সুলতানদের কাছে অর্থের পাহাড় জমে আছে।’

‘সম্পদের স্তুপ এখানেও পড়ে আছে সালারে আজম!” গিয়াস বিলকিস বললেন, ‘যদি আপনি আদেশ দেন তবে আমরা এক নতুন অভিযান শুরু করতে পারি। আপনি জানেন, মিশর ধন সম্পদের দেশ। অতীতের শাসক ফেরাউনরা সম্পদের পাহাড় নিয়ে গেছে। এই ধন-সম্পদ কাদের ছিল? এ সবই ছিল গরীব জনসাধারণের। জনগণকে ক্ষুধার্ত রেখে তাদের অর্থ সম্পদ সঙ্গে নিয়ে কবরে চলে যায় ফেরাউনরা। যুগের মানুষেরা তাদের খোদা মানতো। জনগণের ভাগ্য নির্ভর করতো ফেরাউনের হাতে।

পাহাড় কেটে ফেরাউনরা স্বপ্নের কবর বানিয়েছিল। কবর না বলে তাকে সুরম্য মহল বলাই ভাল। সেই মহলে তাদের সঞ্চিত ধনরত্ন আজো জমা আছে। যদি আপনি অনুমতি দেন তবে আমরা ফেরাউনের ভূগর্ভস্থ কবরের অনুসন্ধান চালিয়ে জনগণের সে অর্থ-সম্পদ উদ্ধার করে দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যবহার করতে পারি।”

গিয়াস বিলকিসের প্রস্তাব উপস্থিত লোকদের মধ্যে বেশ প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করল। অনেকেই তার প্রস্তাব সমর্থন করলো।

‘খুবই ভাল প্ৰস্তাব সম্মানিত আমীর! এ ব্যাপারে আমরা আগেই কেন চিন্তা-ভাবনা করিনি ভাবছি।”

‘আমরা এই মিশনে সৈন্যদের ব্যবহার করতে পারি।”

‘বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এ জন্য একটি জরিপ দল গঠন করা যেতে পারে।’

এভাবে একেকজন একেক মন্তব্য করতে লাগল। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু বলতে চাইলো এ ব্যাপারে। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী একদম চুপচাপ। কিছুই বলছেন না তিনি। সবাই যখন অনুভব করলো, আমীর সাহেব নীরর আছেন, তখনই কেবল তারা চুপ করল।

সবাই চুপ করলে সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘গিয়াস বিলকিস যে প্ৰস্তাব পেশ করেছে। আমি এমন কোন মিশনের অনুমতি দিতে পারি না।’

বৈঠকের সবাই আশাহত ও নিরব-হয়ে গেল। এমন একটি প্রস্তাব সুলতান নাকচ করে দেবেন। এটা কেউ আশা করেনি।

তিনি আবার বললেন, “আমি চাই না, আমার মরার পর ইতিহাস আমাকে ‘কবর চোরা’ বলে আখ্যায়িত করুক। এমনটি করলে, আমি এক নই, এ কলঙ্কের দায় তোমাদেরও বহন করতে হবে। ভবিষ্যত বংশধরেরা বলবে, সালাহউদ্দিনের পরামর্শদাতা উজির ও সেনাপতিরা সবাই কবর চোরা ছিল। আর ইহুদী খৃস্টানরা এই কলঙ্কের কথা আরও রঙ মিশিয়ে বেশী করে প্রচার করবে। তোমাদের এই কুরবানী, ইসলামের জন্য এত ত্যাগ, সব ডাকাতিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, ইসলামের গৌরব চির ম্লান হয়ে যাবে, ঘৃণিত হয়ে যাবে।”

“আমাদের ত্রুটি ক্ষমা করুন, সম্মানিত আমীরা’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন। ‘কিছুকালের জন্য মিশর খৃস্টানদের অধিকারে ছিল। তারা এসেই এখানে প্ৰথম গুপ্তধনের অনুসন্ধান শুরু করে। কায়রোর পুরাতন ধ্বংসাবশেষের মধ্য থেকে তারা এক ফেরাউনের কবর উদ্ধার করেছিল। সেখান থেকে তারা সব কিছু নিয়ে গেছে।

খৃস্টানদের শাসন এখানে বেশিদিন ছিল না। থাকলে তারা সব কবর খুঁজে বের করতো এবং ধনরত্ন সব নিয়ে যেতে। সম্মানিত গিয়াস বিলকিস ঠিকই বলেছেন, এই ধনভাণ্ডারের মালিক ফেরাউন নয়, দেশের জনগণ। দেশপ্রেমিক সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের সম্পদ জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেয়া। ফেরাউনের গুপ্তধন জনসাধারণের কল্যাণ, উন্নতি এবং জাতির সমৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করার মধ্যে আমি কোন অসততা ও অকল্যাণ দেখি না।’

‘কিন্তু আলী,’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এ ধনভান্ডার তোমাদের হাতে এলে তোমরা যে নিজেরাই ফেরাউন হয়ে যাবে। মানুষকে এই দুঃসাহস কে দিয়েছিল যে, সে নিজেকে খোদা বলে দাবী করে? ধন-সম্পদ ও অর্থের প্রাচুর্য মানুষকে এমন ক্ষমতাধর বানিয়ে দিল যে, সে তার পদতলে মানুষের সিজদা দাবী করে বসল। তুমি বলছ খৃস্টানরা একটা ফেরাউনের কবর লুট করেছে। কিন্তু তুমি জানো না, যখন প্রথম ফেরাউনের লাশ সমস্ত ধনরত্নসহ মাটির নিচে দাফন করা হয়, তখন থেকেই কবর চুরি শুরু হয়ে গিয়েছিল। যার কাছে নিজের পরিচয় স্পষ্ট নয়, সে মানুষ হিংস্র পশুর মত, লোভী কুত্তার মত।

প্রথম ফেরাউনের কবরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দ্বিতীয় ফেরাউন। দ্বিতীয় ফেরাউনের কবর লুট করেছিল তৃতীয় ফেরাউন। এভাবেই কবর চুরি কিছু মানুষের পেশা হয়ে যায়। তারপর প্রত্যেক ফেরাউন জীবদ্দশায়ই তার কবর এমন গুপ্ত স্থানে তৈরী করতো, যার খবর কেউ জানতো না! মৃত্যুর পর তার লোকেরা এমন ভাবে কবরের মুখ বন্ধ করত, যেন কেউ তা খুলতে না পারে এবং কেউ তার সন্ধান না পায়। এমনকি গোরখোদকসহ যারা তার খবর জানতো তাদেরকে হত্যা করা হতো।

তারপর যখন ফেরাউনের যুগ শেষ হয়ে গেল, তখনও ঐ গোপন ধনভান্ডারের অন্বেষণ অব্যাহত থাকে। আমি জানি ফেরাউনের এমন কবর আছে যার খবর কেউ জানে না। সে সব কবর মাটির তলায় এখনো রাজমহলের মত টিকে আছে। দুনিয়া প্ৰলয় হওয়ার আগ পর্যন্ত মিসরের শাসক ও আধিপত্য বিস্তারকারী শক্তি এই কবর খুঁজে বেড়াবে। ফেরাউনের সাম্রাজ্য কেন ধ্বংস হয়েছে, জানো? শুধু এই কারণে যে, তারা সম্পদের দাস হয়ে গিয়েছিল। দেশের জনগনকে তারা বুঝিয়েছিল তোমাদের সম্পদ আছে তো সম্মান আছে আছে। যদি তোমার পকেট শূন্য হয়, তবে তুমি ও তোমার বৌ-বেটি সম্পদওয়ালাদের সম্পদে পরিণত হবে। হে আমার বন্ধুগণ! তোমরা আমাকে সম্পদের দাসদের সারিতে দাঁড় করিও না। আমি আমার জাতিকে বলতে চাই, ধনরত্ন আসল সম্পদ নয়, আসল সম্পদ হল ইমান।

সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য মানুষের সৃষ্ট করা হয়নি। মানুষের ব্যবহারের জন্য সম্পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই সত্য যে সমাজ বুঝবে না, সে সমাজে মানুষ ও মানবতা নিরাপদ নয়। এই সত্য জনগণকে তখনই বুঝানো সম্ভব, যখন মুসলিম নেতৃবৃন্দ ধন-সম্পদের লালসা পরিত্যাগ করতে পারবে। সম্পদের মালিকানা যে আল্লাহর, আমাদের কাজ, আমাদের প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব সেই আল্লাহর হাতে তুলে দেয়া, সম্পদের মোহে নিজের ঈমান আমল বিক্রি করা নয়।”

“আমি ব্যক্তিগত লালসার বশে সে সম্পদ আহরণের কথা বলিনি। জাতীয় কল্যাণের প্রয়োজনকে সামনে রেখে উদ্যোগ নিতে বলেছি।’ বিনীত কণ্ঠে বলল আলী।

‘আমি বুঝতে পারছি, গুপ্তধন আহরণের লোভনীয় প্রস্তাব নাকচ করা তোমাদের কারো পছন্দ হচ্ছে না।” সুলতান আইয়ুবী বললেন, “আমার কথা বুঝার জন্য তোমাদের বুদ্ধির সাথে সাথে বিবেককেও একটু কাজে লাগাতে হবে। আমার বিবেক বলছে, সম্পদের অভিশাপ মানুষের ঈমানকে দুর্বল করে দেয়। অনাকাঙ্খিত খাত থেকে অঢেল সম্পদ হাতে পেলে মানুষ বেপরোয়া হয়ে উঠে। আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা কমে গিয়ে মানুষ তখন যে কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগে নিজের সামৰ্থ বিবেচনা করে। মুসলমানদের ঈমান ও একীনের এ পরিবর্তন কখনোই তাদের মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনি, বরং পদে পদে মুসিলমানদের পরাজয়ের কলঙ্ক লেপন করেছে।

যদি আমার কাছে যুদ্ধের ঘোড়া কেনার সামর্থ না থাকে তবে আমি পায়ে হৈঁটে সৈন্যদের সাথে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত যাব। মৃতের গায়ের কাফন খুলে ঘোড়া কেনার জন্য বসে থাকব না। আমার লক্ষ্য বায়তুল মোকাদ্দাস খৃস্টানদের হাত থেকে উদ্ধার করা, ঘোড়া খরিদ করার জন্য অর্থ সংগ্ৰহ করা আমার উদ্দেশ্য নয়।

এই সম্পদ তোমাদের হাতে এলে সম্ভাবনা আছে যে তোমরা একে অপরের দুশমন না হলেও একে অন্যকে সন্দেহের চোখে দেখবে। একদিকে তোমাদের হাতে এসে সম্পদ জমা হবে অন্যদিকে মানুষের প্রতি তোমাদের অন্তরে যে ভালবাসা ও সহমর্মিতা আছে তা নিঃশেষ হতে থাকবে। আমাদের মধ্যে হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল এবাদতের যে প্রেরণা আছে সেখানে পরিবর্তনের সূচনা হবে। বান্দার হক আদায়ের ব্যাপারে শৈথিল্য এলে তা আর তোমার কাছে অন্যায় মনে হবে না।

অর্থ-সম্পদ, বিত্ত-বৈভব, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি মানুষকে খোদা বানিয়ে দেয়। ফেরাউনরা সেই খোদায়ীর ঘোষণা দিয়েছিল, তোমরা হয়তো ঘোষণা না দিয়ে আচার আচরণে তার প্রকাশ ঘটাবে।

কিন্তু ফেরাউনের খোদায়িত্ব যেমন তাকে আকাশের উপরে তোলেনি, জমিনের উপরেও রাখেনি, বরং জমিনের নীচে অন্ধকার কবরে নিয়ে গেছে, তোমরাও সেখানে যাবে। শুধু প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহর কতটা প্রিয় বান্দা থেকে তোমরা সেখানে যেতে পারবে।

আমার সাথী ভাই ও বন্ধুরা! আমি আর এ অপরাধের দুনিয়া সৃষ্টি করতে চাই না। তোমরা গুপ্তধনের লালসা মুক্ত হও। গুপ্তধন মানুষের মাঝে এমন লালসার বিস্তার ঘটায় যা নেশার চেয়েও মারাত্মক এবং ভয়ংকর। এ নেশা মানুষকে পশুতে পরিণত করে, বন্ধুকে শত্রু বানায়।

এ পথে পা বাড়ালে তোমাদের মাঝে যে গাদ্দার আছে তার সংখ্যা আরও বাড়বে। তোমরা দু’জন গাদ্দার হত্যা করলে নতুন করে জন্ম নেবে চারজন।

সাধনা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তোমরা তোমাদের ভাগ্যকে গড়ে নাও! এমন কোন কাজে জড়িয়ে পড়োনা, যে কাজের ব্যস্ততা তোমার ঈমানকে দুর্বল করে দেবে। মনে রেখো, শয়তান তোমার বন্ধু নয়, শত্রু। সুযোগ পেলে সে তোমাকেও গাদ্দার বানিয়ে ফেলবে। এ জন্য যুক্তি তর্কের তার কোন অভাব হবে না। ফেরাউন কবরে আছে, তাকে মাটির নিচেই পড়ে থাকতে দাও।”

উপস্থিত লোকজনের মাথা থেকে গুপ্তধন আবিষ্কারের উচ্ছাস দূর হয়ে গেল। বৈঠকে নেমে এল প্রশান্তি। গিয়াস বিলকিস বলল, “সুলতান, আমি তো শুধু আমার মাথায় যে চিন্তা এসেছিল তা পেশ করেছি। অভিযানে যাওয়া না যাওয়া তো আপনার সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আপনার বিচক্ষণতা বরাবরই আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করেছে।’

সুলতান আইয়ুবী একটু হাসলেন। বললেন, ‘গিয়াস! হঠাৎ করে আজ তোমার মনে এই গুপ্তধন আবিস্কারের কথা জেগে উঠলো কেন? এখানে তো অনেক বছর ধরে আছো, কই, এর আগে তো এ নিয়ে তোমাকে চিন্তা-ভাবনা করতে দেখিনি?’

“সালারে আজম! আমি এসব নিয়ে, কখনও চিন্তা করিনি।’ গিয়াস বিলকিস বলল, ‘প্রায় দুইমাস আগে লাইব্রেরী ইনচার্জ আমাকে বললেন, পুরাতন কাগজপত্রের মধ্য থেকে কিছু কাগজ হারিয়ে গেছে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, এই কাগজগুলোতে কি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল? তিনি আমাকে বললেন, এ কাগজগুলোর এখন আর তেমন কোন গুরুত্ব নেই, এতে ফেরাউনের যুগের খুবই পুরাতন ও অস্পষ্ট কিছু নকশা ও লেখা ছিল। কাগজগুলো ছিল পোকায় খাওয়া।

তখন আমার মনে হলো, এই লেখা ও নকশা দিয়ে ফেরাউনের গোপন কবরের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। আমি সেই পুরাতন কাগজপত্রের তাক দেখলাম। দেখে বুঝলাম, ওই তাকের কোন লেখা পড়ার বা বুঝার মত লোক আজ আর কেউ বেঁচে নেই। ফলে বিষয়টি নিয়ে আমি আর আগে বাড়িনি।’

‘তুমি ঠিক চিন্তা করোনি গিয়াস!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, “মিশরে এখনও এমন লোক বর্তমান আছে যারা পুরাতন লেখা ও নকশা পড়তে ও বুঝতে পারে। এসব কাগজপত্র ও নকশা চুরি যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। গুপ্তধনলোভী কোন ব্যক্তিই এই চুরি করেছে। চুরি যাওয়া কাগজের প্রতি আমার কোন আগ্ৰহ নেই, তবে এই চোরদের ব্যাপারে আমার আগ্রহ রয়েছে। কে এই কাগজ চুরি করতে পারে অনুসন্ধান করে।’

“আমার আশংকা হচ্ছে, এই কাগজপত্রে অবশ্যই কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, “আমি সম্মানিত গিয়াস বিলকিসের সঙ্গে এ ব্যাপোর কথা বলেছি আমার কাছে এমন কিছু গোপন তথ্য আছে যার সুরাহা করতে পারছিলাম না আমি। মনে হয় এবার পারবো।’

উপস্থিত সবাই কান খাঁড়া করল, আলী বিন সুফিয়ান এরপর কি বলেন শোনার জন্য। তিনি বললেন, ‘কস্তুরী নামে এই শহরে নামকরা এক নর্তকী আছে। ধনীদের জলসার প্রদীপ শিখা বলা হয় তাকে। আমার গোয়েন্দারা তার ওপর নজর রাখতো। পাঁচ ছয় দিন যাবৎ সে নিখোঁজ। একটি নর্তকীর শহর থেকে নিখোঁজ হওয়া কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নয়। কিন্তু কস্তুরীর নিখোঁজ হওয়া আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। গুপ্তচররা বলেছে, তার কাছে কিছুদিন ধরে দু’জন সন্দেহভাজন অপরিচিত লোক আসা যাওয়া করছিল।

একদিন কস্তুরীর বাসা থেকে একটি পর্দানশীল মহিলাকে বের হতে দেখা গেল। সেই মহিলা সেই অচেনা বণিকের সাথে চলে গেল। এরপর থেকেই কস্তুরী নিখোঁজ। আমার মনে হয়, কস্তুরী তার লেবাস বদলে সেই লোকের সাথে শহর থেকে বের হয়ে গেছে। গোয়েন্দারা আরো খবর দিয়েছে, কয়েকটি ছোট ছোট দলকে উত্তর দিকে যেতে দেখা গেছে। তাদের চলাচল খুব সন্দেহজনক ছিল। আমার বিশ্বাস এদের সাথে ঐ হারানো কাগজপত্রের গভীর সম্পর্ক আছে। আরও সন্দেহ হয়, ক্রুসেড কমান্ডো ও গোয়েন্দারা এর সাথে জড়িত। যাই হোক, আমি এর সঠিক তথ্য নিচ্ছি।”

‘হ্যাঁ, ভাল করে খোঁজখবর নাও।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, “কিন্তু তোমরা ঐ গুপ্তধনের লোভ অন্তর থেকে দূর করো। আমি জানি, জাতির কল্যাণ, উন্নতি এবং ইহুদী-খৃষ্টান সম্মিলিত বাহিনীর সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য আমাদের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু আমি কারো সাহায্য চাই না। সম্মানিত নূরুদ্দিন জঙ্গী আমাকে অর্থ সাহায্য দিতে চেয়েছেন। আমি তার সাহায্যও গ্রহণ করবো না। অযাচিত সাহায্য যদি মায়ের পেটের ভাই থেকেও নেয়া হয় তবুও তা ব্যক্তিত্বের জন্য অপমানকর। পরিশ্রম করে আয় করা ও বিনাশ্রমের আয়ের মাঝে বিস্তর ফারাক। প্রথমটা মানুষকে পরিশ্রমী ও আত্মপ্রত্যয়ী বানায় আর দ্বিতীয় পথ মানুষকে অলস ও অকৰ্মন্য বানিয়ে ফেলে।

মিশরের মাটি অনুর্বর নয়। পরিশ্রম করলে এ মাটি তোমাকে নিরাশ করবে না। সরকারের কাছে জাতির যেমন চাওয়া পাওয়ার অধিকার আছে, তেমনি জাতির কাছেও সরকারের হক আছে। জাতি নিজ দায়িত্বে রক্ত পানি করে জমিতে চাষ করে বলেই সে জমি তাকে জোগায় বাঁচার ফসল, তেমনি দেশ ও জাতির সম্মান ও মর্যাদা অটুট রাখার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেললে এবং প্রয়োজনে বুকের রক্ত ঢাললেই কেবল সে দাবী করতে পারে সরকারের কাছে তার অধিকার ও নিরাপত্তা।

দেশ রেখে দেশের শাসকরা যদি গুপ্তধন সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে, তবে দেশ চলে যাবে দুশমনের হাতে আর তার জনগণ হবে দুশমনের গোলাম। দেশের জনগণের এমন দুৰ্গতি ডেকে আনার কোন অধিকার নেই আমার।”