» » ফেরাউনের গুপ্তধন

বর্ণাকার

বৃদ্ধের ঠোঁটে তিরস্কারের বিদ্রুপ, যার অন্তরে অর্থের লোভ আছে সম্পদের মোহ আছে তেমন প্রতিটি মানুষকেই আমরা তঙ্কর বা ডাকাত মনে করি। এই লোভ ও মোহ তাকে মিথ্যাবাদী ও প্রতারক বানায়। তোমাদের দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ এই তস্কর বা ডাকাত দলের। অর্থের জন্য, যেখানে তোমরা নিজের স্ত্রী কন্যাদের ইজ্জত বিসর্জন দিতে পারো, বন্ধুকে খুন করতে পারো, নিজের জীবন বিপন্ন করতে পারো সেখানে এই ওয়াদা বা অঙ্গীকারের কোন মূল্য নেই। তুমি সেই দুনিয়ার লোক, যেখানে অর্থের জন্য মানুষ নিজের ঈমান পর্যন্ত বিকিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের পক্ষে বেঈমানী করা সম্ভব নয়। ভয় বা লোভ কিছু দিয়েই তোমরা আমাদের কাবু করতে পারবে না। আমরা কিছুতেই তোমার অপকর্মের দোসর হবো না।’

‘এ কোন অপরাধ নয়। এ সম্পদ মিশরের। আমি সরকারী কর্মকর্তা আহমদ দরবেশের নির্দেশে এ অভিযানে এসেছি।”

“শোন আমার অচেনা বন্ধু! তুমি মিশরী নও। তোমার চোখে সমুদ্রের লোনা পানির চমক রয়েছে। নীল নদের পানির চমক নয়। তোমার শরীর থেকে সমুদ্র পারের গন্ধ আসছে।’

‘আমি কে সে পরিচয় নেয়ার দরকার নেই তোমার। আমি ফেরাউন রিম্যান্সের কবরের অনুসন্ধানে এসেছি। আমাকে সে কবর দেখিয়ে দাও।” মার্ক লী তার রূপ পাল্টে ফেলল, রাগত স্বরে বললো তাকে, ‘নইলে তোমার চোখের সামনে এ নারীদের আমি লাঞ্ছিত করবো।”

‘না, এ কাজ তুমি করতে যেয়ো না। এতে তোমার ক্ষতি হবে।”

‘আমার লাভ ক্ষতি আমি বুঝব, তুমি কবরের সন্ধান বলবে কি না বলো?”

‘ঠিক আছে, কবরের সন্ধান আমি তোমাকে দেবো।” বৃদ্ধ বলল, ‘কিন্তু তোমাকে বলতে চাই তুমি ওখানে গেলে জীবিত আর ফিরে আসতে পারবে না। এ কথা জানার পরও তুমি সেখানে যাবে কি না বলো।”

“তোমাদের লোকেরা কি ওখানে আমাকে হত্যা করার জন্য লুকিয়ে আছে?”

‘না।’ বৃদ্ধ বললো, “তোমাদের হত্যা করার মত আমার কাছে আর কোন লোক নেই। তোমার লোকেরাই তোমাকে হত্যা করবে এবং এটাও জেনে রেখো, তোমার লাশ এখান থেকে কেউ নিতে আসবে না।”

“কি আমার ভবিষ্যত বক্তারে!’ মার্ক লী ব্যঙ্গ করে বললো, “এতই যদি ভবিষ্যত জানো তবে নিজেদের বাঁচাতে পারলে না কেন?”

“না! আমি ভবিষ্যত বক্তা নই। তবে অভিজ্ঞতার যদি কোন দাম থাকে তাহলে আমার কথা তোমার বিশ্বাস করা উচিত। এ জীবনে এমন অনেক ঘটনা দেখেছি আমি, যে ঘটনাবলী মানুষের অন্তরদৃষ্টি খুলে দেয়। আমি দেখতে পাচ্ছি, মৃত্যু তোমার ঘাড়ে এসে বসে আছে।”

মার্ক লী হো হো করে হেসে উঠলো। বললো, “জংলী বুড়ো, আমার মৃত্যু একটু পরে দেখলেও চলবে। আগে বলে সে কবরটা কোথায়, যার সন্ধানে এই দুস্তর মরু পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি আমি।”

“ঠিক আছে, চলো তাহলে!’ বৃদ্ধ বলল, “সেটা কাছেই আছে, এসো আমার সঙ্গে।”

মার্ক লী বলল, “একটু অপেক্ষা করো।”

বুড়োকে অপেক্ষা করতে বলে সে সঙ্গীদের দিকে ফিরল এবং একটু চিন্তা করে ওদের বললো, “এই নারীদের কোন রকম অসম্মান করবে না। এই বৃদ্ধ ও তার সাথীদের প্রতি নজর রাখবে। যতটা সম্ভব এদের সঙ্গে গল্পগুজব করে বন্ধুত্ব করে নাও। আমি কস্তুরী ও ইসমাইলকে আনতে যাচ্ছি।” সে পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসার নতুন চেনা সোজা রাস্তায় যাত্রা করলো এবং গুহার ভেতর এসে প্ৰবেশ করলো।

গুহা অতিক্রম করে মার্ক লী বেরিয়ে এল বাইরে। চার পাশে ভাল করে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল, কন্তুরীদের সে কোন দিকে রেখে গিয়েছিল। তারপর আন্দাজের ওপর ভর করে হাঁটা দিল সে।

মাথার ওপর প্রচণ্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছে সূর্য। সে উত্তাপ মাথায় নিয়ে একাই হেঁটে চলেছে মার্ক লী। প্রায় মাইল দুই রাস্তা অতিক্রম করার পর সে জায়গাটা চিনতে পারল। ঠিক এখান থেকেই দলবল নিয়ে যাত্রা করেছিল সে। এবার সে নিশ্চিন্ত হয়ে পাহাড়ের খাঁজে তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেল।

ওখানে পৌঁছেই সে কস্তুরী ও ইসমাইলকে একই তাঁবুতে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখলো। তার চেহারার রঙ পাল্টে গেল। সে ধমকের স্বরে ইসমাইলকে বললো, “আমি তোমাকে বলে গিয়েছিলাম, তুমি ওর মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করে চলবে। তুমি কোন সাহসে ওর পাশে গিয়ে বসছে?”

“ওর কোন দোষ নেই।” বললো কস্তুরী, ‘আমিই ওকে ডেকে এনেছি। এই নিঃসঙ্গ নির্জন মরুভুমিতে একা একা বেশীক্ষণ থাকলে, যে কেউ পাগল হয়ে যাবে! একাকীত্ব অসহ্য হওয়ায় কথা বলার জন্য আমি নিজেই তাকে আমার কাছে ডেকে এনেছি।”

“তোমাকে এ সফরে সাথে এনেছি শুধু আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য।” মার্ক লী রাগের সাথে বললো, “এ জন্য চাহিদামত তোমাকে আমি মূল্য দিয়েছি। সে মূল্য পরিশোধ হওয়ার আগ পর্যন্ত তুমি আর কারো সাথে মিশতে পারো না। তোমার ঘরে তুমি শত জন বাদী রাখলেও এখানে তুমি আমার দাসী।’

গত রাতে ইসমাইল তার সরল মনে মার্ক লী সম্পর্কে যে ধারন দিয়েছিল মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার প্রমাণ পেল কস্তুরী। বিদায়ের আগে যে সব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে সে তার মন জয় করতে চেষ্টা করেছিল, সে সব মনে পড়ে গেল তার। ছি! এই কি সেই মার্ক লী! এখনো গুপ্তধন পায়নি, তার আগেই অহমিকার মগডালে উঠে বসে আছে! ঘৃণায় রি রি করে উঠল তার মন।

কস্তুরী মৰ্মে মৰ্মে অনুভব করল, মার্ক লীর কাছে এখন সে একজন গ্রাহক ছাড়া আর কিছু নয়। আর তাই মার্ক লী তাকে দাসী বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারল। মুহুর্তে কস্তুরীর রাণী হবার স্বপ্ন খান খান হয়ে গেল।

তার জীবন খুব দীর্ঘ নয়, তবু এতটুকু জীবনেই সে বহু মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছে। সে যে পরিমাণ লোকের সাথে মিশেছে, একজন নারী একশো বছর বেঁচে থেকেও এত লোকের দেখা পায় না। তার এ অভিজ্ঞতাই তাকে দিয়েছে ভালো-মন্দ মানুষ চেনার এক অদ্ভুত ক্ষমতা।

ইসমাইল তাকে একবারও বলেনি, সে ভাল লোক। বরং সে অকপটে স্বীকার করেছে, সে একজন ভাড়াটে খুনী। অর্থের বিনিময়ে মানুষ খুন করা তার পেশা। এই অকপটতাই প্রমাণ করে মার্ক লীর চাইতে মানুষ হিসাবে সে বেশী নির্ভরযোগ্য।

এদিকে মার্ক লীকেও উপেক্ষা করতে পারছে না কস্তুরী। উপযুক্ত মূল্য দিয়েই মার্ক লী তার সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। সে টাকা এখনো তার ঘরেই পড়ে আছে! এ টাকা ফেরত না দিয়ে মার্ক লীর অবাধ্য হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। গুপ্তধনের যে লোভ তাকে দেখানো হয়েছে মার্ক লী যদি তা নাও দেয়, তবু এখন সে মার্ক লীরই সম্পত্তি। কস্তুরী তাই আর কথা বাড়ালো না, চুপ করে রইল।

ইসমাইলও এতক্ষণ কোন কথা বলেনি, চুপচাপ দু’জনের কথা শুনছিল আর নিরবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল মার্ক লীকে।

দু’জনই চুপ করলে সে উঠে মার্ক লীর বাহু ধরে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে আস্তে করে বলল, “আহমদ দরবেশ মনে হয় তোমাকে আমার ব্যাপারে কিছুই বলেননি। আমার সম্পর্কে তুমি কিছুই জান না। কিন্তু আমি তোমাকে ভাল মতই জানি। তুমি আমার দেশের ও জাতির মূল কাটতে এসেছে। আমি এতবড় পাপী, ভাড়ার বিনিময়ে তোমার সাথে এসেছি। তার মানে এ নয় যে, আমি তোমাকে আমার বাদশা মানি; আমি আমার মূল্য ষোল আনা তো বুঝে নেবই, যদি গুপ্তধন উদ্ধার হয় তবে তার অংশও আদায় করে নেবো।”

“এসব কথা তুমি আমাকে নয়, আহমদ দরবেশের কাছেই বলবে।’ মার্ক লী তাকে কমান্ডারের ভঙ্গিতে বললো, “এখানে তুমি আমার অধীনস্ত কর্মচারী। গুপ্তধন যা বের হবে সেগুলো আমার তহবিলেই জমা থাকবে। আমি সেগুলো যেখানে চাইব সেখানেই নিয়ে যাব, কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে না।”

বললো, “আমি জানি তুমি মার্ক লী! সুলায়মান সিকান্দার নিও। আমি এক নাম করা অপরাধী তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, গোয়ার্তুমি করে তুমি আমাকে মিশরী মুসলমান বানিয়ে দিও না। আর তোমাকে আরও সাবধান করে দিচ্ছি, কোন মুসলমানের মধ্যে জাতীয় চেতনাবোধ জেগে উঠলে সে যদি লাশও হয়ে যায় তবু তার জাতীয় চেতনাবোধ বিসর্জন দেয় না। কোনঠাসা হয়ে পড়লে সে সিংহের চেয়েও সাহসী হয়ে যায়। তোমার ভালোর জন্যই বলছি, আমাকে অপরাধী হয়েই থাকতে দাও, বাড়াবাড়ি করো না।”

মার্ক লী বুঝতে পারলো, এ লোক গভীর জলের মাছ। একে শক্ৰ বানিয়ে নেয়া ভালো নয়। সে ইসমাইলের কাঁধের ওপর হাত রেখে বন্ধুর মত হেসে উঠে বললে, “তুমি অযথা ভুল ধারণা করছ, আমি চাই না, এক বিলাস সুন্দরী আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করুক। এ নারী ভয়ানক চালাক, সে আমাদের দু’জনের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে গুপ্তধনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। তুমি আমাকে আর শক্ৰ মনে করো না। আহমদ দরবেশ কি তোমাকে বলেনি, সে তোমার সম্পর্কে কি চিন্তা-ভাবনা করে রেখেছে?”

“তোমার কি বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত তুমি গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবে?”

“আরো পারবো কি! পেয়েই তো গেছি!” মার্ক লী উত্তর দিল।

“আমি তোমাদের দু’জনকে সেখানেই নিয়ে যেতে এসেছি।”

ইসমাইল তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। কস্তুরীও তাকে দেখতে লাগল। তার চেহারায় ঘূণা ও রাগের ভাব স্পষ্ট।

মার্ক লী তার লোককে ডাকলো, যাকে উটগুলোর দেখাশোনায় রেখে গিয়েছিল। সে তাকে বললো, “উটগুলো একটা অপরটার সাথে বেঁধে নিয়ে এসো, তাঁবুও গুটিয়ে নাও।”

মার্ক লী তাদের সেখানে নিয়ে গেল, যেখানে ফেরাউনের গোপন কবরের পাশে অন্যরা তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কস্তুরী কঠিন এই পাহাড়ের মাঝে এমন শস্য-শ্যামল উদ্যান ও মনোরম জায়গা দেখে খুবই বিস্মিত হলো। উঁচু এক পাহাড়ের তলদেশে ছোট ঝিলে টলমল করছে স্বচ্ছ পানি। পাহাড়ের বুক থেকে পানির ঝরনা ফুটে বেরুচ্ছে। সারি সারি খেজুর বৃক্ষের কচি পাতা দোল খাচ্ছে বাতাসে। কস্তুরী এই প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়লো।

সে ইসমাইলকে সাথে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো। একটু এগুতেই তার চোখে পড়ল একটি ছোট শিশুর লাশ। শিশুটির সমস্ত শরীর রক্তে ভেজা।

কস্তুরী ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো। আরেকটু এগিয়ে দেখল, সেখানে আরো দুটো লাশ একাসাথে জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। লাশ দুটি বড়দের। এদের বুকে এখনো বিধে আছে তীর।

সে ইসমাইলকে সাথে নিয়ে এক খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল। এখান থেকেই সে দেখতে পেল এক বিবস্ত্ৰ বৃদ্ধকে সাথে নিয়ে মার্ক লী উঁচু চূড়ার দিকে উঠে যাচ্ছে।

এখানে সে আরও কিছু লাশ দেখতে পেল। তার মধ্যে পাঁচ ছ’টি শিশুদের। লাশগুলোর খোলা চোখে মুখে কষ্ট ও যন্ত্রণার চিহ্ন।

কস্তুরী ছিল আনন্দ-ভুবনের বাসিন্দা। এমন বিভীষিকাময় দৃশ্য কোনদিন সে স্বপ্নেও দেখেনি। একটি ছোট শিশুর নিষ্পাপ ফুটফুটে লাশ দেখে কস্তুরীর দু’চোখ জলে ভরে উঠল। সে ডুকরে কেঁদে উঠল।

মার্ক লীর তিন চার জন সঙ্গী কস্তুরীর কান্না শুনে ছুটে এলো সেখানে। কস্তুরী মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল, ইসমাইল তাকে ধরে ফেললো। মার্ক লীর সঙ্গীদের বললো, ‘লাশ দেখে ওর মাথা ঘুরে গেছে।’

একজন পানি আনার জন্য ছুটে গেল। কস্তুরী আস্তে আস্তে সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে এল। সে জিজ্ঞেস করলো, “এদের কে হত্যা করেছে? কেন এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে?”

মার্ক লীর এক সঙ্গী তাকে সব ঘটনা খুলে বললো। কস্তুরী ইসমাইলের দিকে তাকালো, তার চেহারা ফ্যাকাশে।

ইসমাইল বললো, “আমাদের চেয়ে এ লোকগুলো কতই না ভালো ছিল! যাদের আমরা অসভ্য, উলঙ্গ ও মানুষ খেকো বলছি, এরা কতই না দায়িত্বশীল ও আমানতদার! এই গুপ্তধন রক্ষার জন্য এরা জীবন দিয়েছে তবুও গোপনীয়তা প্রকাশ করেনি। যদি এরা ফেরাউনের কবর খুঁড়ে সব মালামাল ও ধনরত্ন উঠিয়ে নিয়ে যেতো, তবে কে তাদেরকে ধরতো? এরা ছিল আমানতদার, দায়িত্ববান ও সরল মানুষ। আমরা নিজেদের সুসভ্য ও ভালো মানুষ বলি, অথচ এই খুনখারাবী ও ধ্বংসযজ্ঞ আমরাই চালিয়েছি। আমরা ডাকাত ও খুনী। এ সবই মার্কালীর কাজ।’

‘আমি এই গুপ্তধনের এক কপর্দকও গ্রহণ করবো না। এই নিষ্পাপ শিশু ও নিরপরাধ মানুষগুলোকে এমন নির্দয়ভাবে হত্যা করে আমরা যে অভিশাপ কুড়িয়েছি তার ভাগ আমি নেবো না।” কস্তুরী বলল, “বলতে পার এই সরল সোজা নিরস্ত্র মানুষগুলোকে অযথা কেন হত্যা করা হলো?”

মার্ক লী বৃদ্ধের সঙ্গে উপত্যকার ওপারে চলে গেল। মার্ক লী দেখতে পেল তার সামনে ছোট্ট একটি পাহাড় চূড়া। তার গায়ে রোদ লেগে স্ফটিকের মত চমকাচ্ছে।

বৃদ্ধ তাকে বললো, “উপরে চলো, সেখানে তোমাকে একটা মস্ত বড় পাথর দেখাবো, যেটি এখান থেকেও দেখা যায়। পাথর তো নয়, যেন ছোটখাট উপত্যকা। যদি তুমি ওটাকে সেখান থেকে সরাতে পার তবেই তুমি সেই দুনিয়ার দরজা দেখতে পাবে, যেখানে ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কফিন ও তার গুপ্তধন লুকোনো আছে। সেই উঠানের মত পাথরকে সেখান থেকে আজ অবধি কেউ সরায়নি। পনেরো শ’ বছরের মধ্যে এই পাথর কেউ স্পর্শও করেনি।

আমরা পনেরো শ’ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় এই কবরের দেখাশোনা করে আসছি। আমি তোমাকে ফেরাউন রিম্যান্সের মৃত্যু ঘটনা এমনভাবে শোনাচ্ছি যেন তিনি এই কাল-পরশু মারা গেছেন। এসব ঘটনা আমার বাপ-দাদা শুনিয়ে গেছেন। বাপ-দাদীকে তার বাপ-দাদা শুনিয়েছেন। এমনিভাবে পনেরো শ’ বছরের ইতিহাস আমাদের মনের মধ্যে গাথা রয়েছে। যে ইতিহাস আমি আমার কবিলার লোকদের শুনিয়ে থাকি।”

“আমি তোমার সে কথা পরে শুনবো।” মার্ক লী অস্থির হয়ে বললো, “এখন উপরে চলো?”

তারা মস্ত উঠানের মত সমতল পাথরের ওপর উঠে এল। বুড়ো বলল, “এই তোমার কাঙ্খিত দরজা। এই পাথরের নিচেই লুকানো আছে সমস্ত ধনরত্ন। মার্ক লী বিশ্বাসই করতে পারছিল না, এটা একটা পাথর। তার মনে হচ্ছিল, সে কোন প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। যে ছাদ পাথর, বালি ও সিমেন্ট দিয়ে মজবুতভাবে তৈরী করা হয়েছে। মার্ক লী ছাদের চারদিক ঘুরে দেখল। সেখান থেকে নিচে নেমে এদিক-ওদিক ঘুরে দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু নিরেট ছাদ ছাড়া একে আর কিছুই মনে হলো না। এমন কোন ফাঁক খুঁজে পাওয়া গেল না যাতে একে পৃথক মনে হয়। কিভাবে এই পাথর সরানো যাবে এ কথা ভাবতে ভাবতে সে নিচে নেমে এলো।

‘আমি জানি, এই পাথর এখানে আলাদাভাবে বসানো হয়েছে। এ কথা তোমার বিশ্বাস হবে না। এখান থেকে দেখলে তা কারোরই বিশ্বাস হবে না। তবে তুমি যদি এর উল্টো পাশে যাও তাহলে দেখতে পাবে ছাদের একটি ঝুল বারান্দা আছে। যেখানে পাহাড় ও ছাদের অংশ পৃথক বোঝা যায়। এটা মানুষের হাতেরই তৈরী। মানুষের কর্মকুশলতা ও নিপুণতার এ এক অপূর্ব নিদর্শন। এটাকে এমনভাবে বানানো হয়েছে যাতে এটাকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি বলে মনে হয়।

ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্স নিজের তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় এটা বানিয়েছিলেন। এর নিচে পাহাড়ের বুকের ভেতর যে দুনিয়া আবাদ রয়েছে সেটিও ফেরাউন রিম্যান্স তার জীবদ্দশাতেই তৈরী করেছিলেন।

এই জগতকে বাইরের দুনিয়া থেকে কিয়ামত পর্যন্ত গোপন রাখার জন্য এই কৃত্রিম পাথরের ছাদ বানিয়েছিলেন। মরার আগ পর্যন্ত এর কারিগরদের তিনি কারাগারে বন্দী করে রেখেছিলেন।

পরে ফেরাউনের মৃত্যুর পর তাঁর লাশের কফিন এখানে আনা হয়। প্রয়োজনীয় সামান ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়, ধনরত্ন রাখা হয়। তারপর তার কফিন ভেতরে রাখার পর কারিগরদের সবাইকে হত্যা করা হয়। ফেরাউনকে যারা খোদা মানতো এমন নিবেদিতপ্ৰাণ বারো জন যুবককে এনে এর পাহারাদার নিযুক্ত করা হয়। সে কালের মিশরের বারো জন সেরা সুন্দরী এনে সঙ্গিনী করে দেয়া হয় তাদের। সেদিন থেকেই তারা কবর ও সম্পদের পাহারা দেয়া শুরু করে। আজ তুমি যাদের হত্যা করেছে এবং এখনো আমরা যারা এখানে জীবিত আছি, ঐ বারো জন পুরুষ ও বারো জন নারীরই পরবতী বংশধর।”

“এই বিশাল পাথর কেমন করে সরানো যাবে?” মার্ক লী চিন্তিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো।

“এ পাথর সরাতে হবে এই চিন্তা করে এখানে তা রাখা হয়নি। তবে এটা যেহেতু প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়নি, মানুষই এখানে রেখেছে, তখন মানুষ চেষ্টা করে তা সরাতেও পারবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার দায়িত্ব আমি শেষ করেছি। গুপ্তধন উদ্ধারের অসম্ভব মিশন নিয়ে তুমি এতদূর ছুটে এসেছ, এখন এই দরজা খোলার দায়িত্ব তোমার। তোমাকেই এ পাথর সরানোর বুদ্ধি বের করতে হবে।’ বলল বৃদ্ধ।

মার্ক লী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কবরের মুখ মুক্ত করার জন্য অধীর ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। বলল, “এর সাথে রশি বেঁধে সবাই মিলে টানলে কেমন হয়?’

সে তাড়াতাড়ি তার লোকদের কাছে ছুটে গেল। তাদের ডেকে বলল, ‘জলদি রশি আনো’

তার লোকজন রশি নিয়ে ছুটে এল। তারপর তার নির্দেশ মত উপরের ছাদের এক প্রান্তের আংটার সাথে শক্ত করে বাধলো সেই মোটা রশি। একটা দুটো নয়, অনেকগুলো। এরপর সবাই নিচে নেমে এল।

মার্ক লী সবাইকে বললো, “এসো এবার নিচে থেকে রশি ধরে জোরে টানতে থাকি৷”

তার হুকুম পেয়ে চল্লিশ পঞ্চাশজন শক্তপোক্ত লোক সে রশি ধরে টানতে শুরু করল। কিন্তু তাতে পাথর বিন্দুমাত্র নড়লো না।

কিছুক্ষণ টানাটানির পর পাথরের নড়াচড়া বুঝতে না পেরে সে বলল, ‘দাঁড়াও, আমি এই ছাদের ওপর উঠে দাঁড়াই। তাতে করে সামান্যতম নড়াচড়া হলেও বুঝতে পারবো।’

সবাইকে নিচে রেখে মার্ক লী এবার উপরে উঠে এল। সে উঠে আসার পর নিচ থেকে সবাই আবার ‘হোঁইয়ো জোরে’ বলে হেচকা টানে চেষ্টা করতে লাগল পাথরটি সরানোর। সকলের মিলিত টানে এক সময় মার্ক লীর মনে হলো, পাথরটি নড়ছে। সে চিৎকার করে বলল, ‘সাবাস নওজোয়ান, পাথর নড়ছে। জোরে টানো, পারবে, তোমরা পারবে এ পাথর সরাতে। গুপ্তধন অবশ্যই তোমরা উদ্ধার করতে পারবে।” আনন্দে সে নাচছিল তখন।

যারা পাথর টানছিল তাদের মধ্যে নতুন জোশের জন্ম হল।

সেই উত্তেজনায় তারা এমনভাবে টান মারল যে পাথর কেবল নড়লেই না, সামান্য একটু সরেও গেল। তাতে চুল পরিমাণ হলেও একটু ফাঁক তৈরি হল। মনোবল বেড়ে গেল মার্ক লী ও তার সাথীদের তারা সবাই আনন্দ ধ্বনি দিতে শুরু করলো এবং আরো জোরে টানতে থাকল। পাথরটি আরও টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল লোকগুলো। এত টানাটানির পরও পাথরটি সামান্যই সরাতে পেরেছে তারা। কিন্তু সে জন্য কারো আফসোস নেই।

মার্ক লী নিচে নেমে এল এবং সবাইকে একটু আরাম ও বিশ্রামের জন্য ছুটি দিল।

সূর্য কালো পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে। মার্ক লীর কাছে শরাবের বিশাল মজুত ছিল। সে সেই শরাবের ভাণ্ডার খুলে দিয়ে বললো, “তোমরা প্ৰাণ ভরে পান কর, আর ওই পাথর টেনে নামিয়ে আনার শক্তি সঞ্চয় কর।”

সবাই মদের বোতল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মার্ক লী আনন্দ উত্তেজনায় নাচছিল তখন। দীলদারিয়া বাদশার মত সে আবেগদীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করল, “আমি আজ রাতে তোমাদেরকে দুটি উট জবাই করে শাহী ভোজ দেব।”

মদের প্রভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলের সারাদিনের ক্লান্তি ও কষ্ট দূর হয়ে গেল। তাদের মনে ফিরে এলো শক্তি ও সজীবতা।

এই আনন্দ কোলাহলের মধ্যেই সূর্য অস্ত গেল। পাহাড় থেকে একটু দূরে এক মাঠের মধ্যে কয়েকটি মশাল জ্বলিয়ে আনন্দ সাগরে ডুব দিল মার্ক লী ও তার সাথীরা। সন্ধ্যা রাত পার হলো খাওয়া দাওয়া আর বিশ্রামে।

রাতের দ্বিতীয় প্রহর।

মার্ক লী ডাকলো সবাইকে। এই রাতের আঁধারেও পাথর সরানোর কাজে নেমে পড়তে আগ্রহী সবাই। মার্ক লী বলল, ‘ঠিক আছে চলো তাহলে।” সকলে মিলে আর একবার জোরেশোরে রশি টানতে শুরু করলো। মার্ক লী উপরে দাঁড়িয়ে ছিল। মশালের টিম টিমে আলোয় কবরের মুখ থেকে অল্প অল্প করে পাথর সরে যেতে দেখল সবাই। তারা আরও জোরে নানা রকম উৎসাহব্যঞ্জক ধ্বনি দিয়ে বিরতিহীনভাবে টানতে থাকলো পাথরটি। একটু পরে তারা দেখতে পেল পাথরটি হেলে পড়ছে।

উৎসাহ আরো বেড়ে গেল তাদের। মার্ক লী নেমে এল নিচে। সে একপাশে সরে গিয়ে অভিযাত্রীদের উৎসাহ দিতে লািগল। লোকগুলোও প্ৰচণ্ড আবেগ ও উচ্ছাস নিয়ে রাশির প্রান্ত ধরে টেনে যেতে লাগল অব্যাহতভাবে।

সহসা বিকট আওয়াজ করে নিচের দিকে উল্টে পড়ল বিশাল ছাদ।

যেখানে দাঁড়িয়ে মার্ক লীর লোকেরা রশি টানছিল। সে জায়গাটা ছিল সংকীর্ণ। তাদের পিছনে ছিল আরেকটি খাঁড়া পাহাড়। ওপর থেকে ছাদটি এমন গজবের মত নোমে এল তাঁদের মাথায়, নিচের লোকগুলো সরে যাওয়ারও সময় পেল না। ছাদের তলে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেল সব ক’জন মানুষ।

যে সব মশাল জ্বেলে রাখা হয়েছিল আশেপাশে, কিছু পড়ল তার নিচে, কিছু নিভে গেল বাতাসের ঝাপটায়। মার্ক লীর পায়ের নিচের পাহাড় দুনিয়া কাপানো ভূমিকম্পের মত কেঁপে উঠল।

সে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। ছাদ ও নিচের পাথুরে জমিনের ভীষণ সংঘর্ষে এমন তীব্ৰ ও ভয়ংকর আওয়াজ হলো যে, স্তব্ধ হয়ে গেল মার্ক লী। সেই সংঘাতের তীব্ৰতা সইতে না পেরে ক্ষণিকের জন্য জ্ঞান হারালো সে।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে উঠে বসল, দূরে একটা মশাল টিমটিম করে জ্বলছিল তখনো, সে এগিয়ে গিয়ে সেই মশালটি তুলে আনল।

চারদিকে সুনসান নিরবতা। কোথাও কোন চিৎকার চেঁচামেচি নেই। নিস্তব্ধ নির্বাক ধ্বংসস্তুপের সামনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল মার্ক লী। তারপর মশাল নিয়ে এগিয়ে গেল সেই ধ্বংসস্তুপের কাছে। উল্টেপড়া ছাদের নিচ থেকে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পা বেরিয়ে আছে, কারো মাথার অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। এ সময় মার্ক লীর কানে হঠাৎ কয়েকজন মানুষের দৌড়ানোর শব্দ এল। মার্ক লী ভাবল, তাহলে কি কেউ কেউ বাঁচতে পেরেছে! ওরাই কি কোন সাহায্য নিয়ে ছুটে আসছে?

সে পায়ের আওয়াজ লক্ষ্য করে এক টিলার ওপর দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করল, কারা আসছে। ততোক্ষণে ছুটন্ত লোকগুলো টিলার কাছে পৌঁছে গেল। সে দেখতে পেল চার জন লোক ছুটে আসছে তার দিকে।

ওরা আরেকটু কাছে আসতেই সে চিনতে পারলো লোকগুলোকে। প্রথমেই আছে সেই বৃদ্ধ, যে তাকে গুপ্তধনের গুহামুখের সন্ধান দিয়েছিল। তার পিছনে ইসমাইল ও কস্তুরী, সবশেষে সেই সাথী যে তাদের তাঁবু ও পশুর পাহাড়ায় ছিল।

মার্ক লীর কাছে এসে থামল ওরা। সবাই খুব হাঁপাচ্ছে। কস্তুরীর দিকে তাকাল মার্ক লী। ভয়ে তার আপাদমস্তক থরথর করে কাপছিল! মার্ক লী নীরবে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।

চারজনই প্রথমে মার্ক লী ও পরে ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকাল। সকলেই হতবাক, কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।

প্রথমেই কথা বললো বৃদ্ধ, “আমি তোমাকে সাবধান করেছিলাম, বলেছিলাম তোমার চোখে আমি মৃত্যুর ছায়া দেখতে পাচ্ছি। তুমি এ অসম্ভব অভিযানের সংকল্প ত্যাগ করে ফিরে যাও। আমার কথায় তুমি কান দাওনি। তুমি আমাকে বাধ্য করেছ, ফেরাউন রিম্যান্সের কবর ও গুপ্তধন উদ্ধারের গোপন রহস্য উদ্ঘাটন করতে।

আমি জানতাম, এর পরিণতি কত মারাত্মক ও মর্মান্তিক। মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার নেই তোমাদের। ভাগ্যগুণে এখনো বেঁচে আছ তুমি। কিন্তু আরেকটু আগানোর চেষ্টা করলে খোদার গজব নামবে তোমার ওপরও। কেউ তোমাকে তার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। এখন বলো, তোমরা কি এখন ফিরে যাবে?”

‘না!’ মার্ক লী বলল, “আমার এই সাথীরাও আমার সাথে থাকবে। এরাই হবে এখন আমার সহযাত্রী।’ সে বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইলো, “আমার আর কোন সাথী কি বেঁচে নেই? কেউ কি পালাতে পারেনি?’

বৃদ্ধ বললে, “তোমার চার সাথী আমার লোকদের সাথে পালিয়ে গিয়েছে। আমার লোকরা তাদের পথ দেখাবে না। তাদের শেষ পর্যন্ত পথে পথে ঠোকর খেয়ে বেড়াতে হবে এবং দারুন কষ্ট করে মরতে হবে। তারচেয়ে যদি পাথর চাপা পড়ে মারা যেতো তবেই ভাল করতো। এই মৃত্যু অনেক সহজ ছিল।

আজ বন্ধ রাখ এই কাজ। ভিতরে যদি যেতেই চাও, আগামীকাল ভোরে তোমাদেরকে আমি ভেতরে নিয়ে যাব।”

মার্ক লীর উপর দুর্ঘটনার কোন প্রভাব পড়ল না। বৃদ্ধকে নিয়ে তাঁবুতে ফিরল। ইসমাইল বৃদ্ধকে একটি চাদর দিল। সে চাদর দিয়ে গা ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়ল। কস্তুরী তখনও নির্বাক। সে সেই নারীদেরও দেখেছে, যাদের মার্ক লী নিরাপত্তা বন্দি করেছিল। এখন তারা বন্দি নেই অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল।

“তোমরা আমাদের একজন সাথীকে পুড়িয়ে খেয়ে ফেলেছিলে। মার্ক লী জিজ্ঞেস করলো, এর আগেও তোমরা নরমাংশ খেয়েছ? তার মত তোমরা কতজনকে পেয়েছিলে এরকম ভোজ করার জন্য।”

‘যতজনকে আমরা ধরেছি সবাইকেই একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে,’ বৃদ্ধ উত্তরে বলল, ‘আমরা বলতে পারব না আমাদের পূর্ব পুরুষরা কবে থেকে মানুষের মাংশ খাওয়া শুরু করেছিল।”

“তোমরা তো ইচ্ছা করলে সব গুপ্তধন নিয়ে যেতে পারতে! সভ্য সমাজে গিয়ে শাহানশাহের মত জীবনযাপন করতে পারতে। যাওনি কেন?”

“একটি ভবিষ্যতবাণী আমাদেরকে এ ধরনের অপকর্ম থেকে রক্ষা করেছে। ভবিষ্যতবাণীটি হলো, যে ব্যক্তি রিম্যান্সের কবর হেফাজত করবে, তাকে মরুভূমিও শীতল ছায়া দান করবে। আহার, পানি ও ছায়া থেকে কোনদিন বঞ্চিত হবে না তারা। দুনিয়ার লোভ লালসার দরকার হবে না তাদের। তাদের দেহে আবরণের দরকার হবে না। তাদের অন্তরে থাকবে অফুরন্ত ভালবাসা, পরষ্পর প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থেকেই জীবন পার করে দেবে তারা। এই সুখী জীবন তারা ততদিন ভোগ করবে, যতদিন সোনা, রূপা ও মদের প্রতি তাদের আসক্তি না আসবে। যতদিন লোভ-লালসা তাদের আচ্ছন্ন না করবে। কারণ লোভই মানুষকে খুনী, ডাকাত, স্বার্থপর ও নীতিহীন বানিয়ে দেয়।’

“তুমি ঠিকই বলেছ লোভই সমাজ ও সভ্যতা ধ্বংসের কারণ। সে কখনো ধন-সম্পদের লালসা করে, কখনো নারীর লালসা করে, কখনো মদ ও নেশায় আসক্ত হয়ে মানব সমাজে ডেকে আনে বিপর্যয়। তাদের কোন ধর্ম থাকে না।”

“এই ভবিষ্যতবাণী আমাদেরকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। ভবিষ্যতবাণীতে আরও বলা হয়েছিল এমন সময় আসবে যখন রিম্যান্সের রক্ষীরা মানুষের মাংশ খাবে। প্রয়োজনে মানুষ শিকারের জন্য তারা বাইরেও যাবে। সভ্য সমাজের মানুষ যখন পশু স্বভাবে ক্রাকন্ত হবে তখন তারা মানুষকেও পশু জ্ঞান করবে এবং পশুর মতই তাদের শিকার করে খাবে। যদি না খায় তবে তাদের বংশধারা শেষ হয়ে যাবে।’ বলল বৃদ্ধ।

‘তোমরা কি আজও ফেরাউনকে খোদা মনে কর?’ কস্তুরী প্রশ্ন করলো বৃদ্ধকে।

‘মানুষ খুব দুর্বল প্রকৃতির। সে তাদের খোদা পরিবর্তন করে থাকে,’ বৃদ্ধ বললো, ‘আবার মানুষ কখনও নিজেই খোদা বনে যায়। এখন এই সময়ে তোমরাই আমাদের খোদা! কারণ আমাদের জীবন ও আমাদের মেয়েদের ইজ্জত-সন্ত্রম তোমাদের হাতে বন্দী। আমি তোমাদের কাছে শতাব্দী ধরে সংরক্ষিত গোপন রহস্য বলেছি তোমাদের প্রভুত্ত্ব স্বীকার করে। মানুষ মাত্রই মরণকে ভয় পায়, আমিও মৃত্যুর ভয়ে নারীদের ইজ্জত হারানোর ভয়ে তোমাদের প্রভুত্ব মেনে নিয়েছি।”

‘ফেরাউনও আমাদের মতই মানুষ ছিলেন। তিনি সে যুগের মানুষদের ওপর ক্ষুধা, দারিদ্র ও বেকারত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আমি তোমাদের খোদা! মানুষ বাধ্য হয়ে বলেছিল, ‘হ্যাঁ! তুমিই আমাদের খোদা! ক্ষুধা ও দারিদ্র মানুষকে সত্য থেকে সরিয়ে বহু দূরে নিয়ে যায়। তাকে দাসত্বের শিকলে বন্দী করে। প্ৰেমময় দরদী মানুষটি তখন মরে যায়।

মানুষের আসল খোদা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত বলেছেন। যখন মানুষের পেটে আগুন জ্বলতে থাকে, তখন সে তার এই মহত্বের কথা ভুলে যায়। সে সময় তার পেটের এই ক্ষুধা ও যন্ত্রণা যে দূর করতে পারে, মানুষ তার আনুগত্য কবুল করতে দ্বিধা করে না। মানুষের এই দুর্বলতাকে সম্বল করে জন্ম হয়েছে সম্রাট ও রাজার।

এই আনুগত্যলোভী যারা সম্রাট বা রাজা হতে পারে না, তারা হয় ডাকাত, সন্ত্রাসী, মহাজন। তারা তাদের শক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য শুরু করে অত্যাচার। ছলে বলে কৌশলে মানুষকে করে অসহায়। এভাবেই সমাজে সৃষ্টি হয় শাসক ও শাসিত, জালিম ও মজলুম। এই ক্ষুধাই মানুষকে পাপের সাগরে ডুবিয়ে দেয়।’ কস্তুরী তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরল বুড়োর সামনে।

বৃদ্ধ কস্তুরীর এই কথা মেনে নিল না, বলল, “না, তোমার এই কথা ভুল, মানুষকে অমানুষ বানিয়েছে অর্থ ও সম্পদ। অমানুষ বানিয়েছে সোনারূপা ও ধনরত্বের লোভ-লালসা।’

বৃদ্ধ এরই মধ্যে কস্তুরীর পরিচয় জেনে নিয়েছিল। সে জেনেছি, কস্তুরী মিশরের রাজধানী কায়রোর নামকরা নর্তকী। বৃদ্ধ তার যুক্তি প্রমান করার জন্য কস্তুরীকে বলল, ‘কে তুমি? তুমি কি কর? এদের মধ্যে তুমি কি কারো স্ত্রী? কিংবা এদের কেউ কি তোমার আপনজন হয়?’