১১৭৪ খৃস্টাব্দ, মোতাবেক ৫৬১ হিজরী সাল।
সময়টা মুসলমানদের জন্য মোটেও অনুকূল ছিল না। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী নানারকম দুঃসংবাদ পাচ্ছিলেন বিভিন্ন দিক থেকে। একদিন আলী বিন সুফিয়ান একটি সংবাদ শোনালো তাকে, আক্রাতে আমাদের একজন গোয়েন্দা শহীদ হয়েছে এবং আরেক গোয়েন্দা ধরা পড়েছে। যে এই সংবাদ নিয়ে এসেছে সেও ওদের সাথেই ছিল। এই গোয়েন্দা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সংবাদ এনেছে।”
একজন গোয়েন্দার শাহাদাত ও অপরজনের গ্রেফতারীর খবর সুলতান আইয়ুবীকে অস্থির করে তুললো। আলী বিন বুঝতে পারলেন এ খবরে সুলতান আইয়ুবী একটু বেশীই পেরেশান হয়ে পড়েছেন। নিহত গোয়েন্দা আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বাহিনীর একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ সদস্য ছিল। আলী নিজেও তার মৃত্যুতে শোকাকুল ছিলেন, সুলতানের শোক দেখে তিনি আরো শোকার্ত হলেন। এই সদস্য সামরিক গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং এই তথ্যের সত্যতা নিরুপণে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন।
গোয়েন্দা বিভাগের একজন দক্ষ ব্যক্তির শাহাদাতে সুলতান যে পরিমাণ পেরেশান হলেন, নিয়মিত বাহিনীর শত শত সৈন্যের শাহাদাতেও তিনি এতটা আফসোস করেন না। আলী দেখেছে, সবসময়ই অন্য কোন দেশে পাঠানো গোয়েন্দা কর্মীর শাহাদাতে তিনি প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান। এ ধরনের খবর পেলেই তাঁর চেহারা মলিন ও বিষন্ন হয়ে যায়। এ ধরনের খবরে তিনি কতটা দুঃখ পান, তা তাকে কেউ না দেখলে উপলব্ধি করতে পারবে না।
একজন গোয়েন্দার শাহাদাত ও অপর একজনের গ্রেফতারীর সংবাদে আলী বিন সুফিয়ান সুলতান আইয়ুবীর মুখে দুঃখ ও বেদনার গভীর ছাপ দেখে বললেন, “আমীরে মুহতারাম! আপনার চেহারা যখন বিষন্ন হয়, তখন মনে হয় সমস্ত মুসলিম জাতটাই বিষন্ন হয়ে পড়েছে। ইসলামের সম্মান ও গৌরব জীবনের কুরবানী চায়। একদিন আমাদের দু’জনেরও শহীদ হতে হবে। আমাদের দুটি গোয়েন্দার ক্ষতি হয়েছে, আমি আরও দুজন গোয়েন্দাকে পাঠিয়ে দিব, এই ধারা তো আর বন্ধ থাকবে না।”
“এই ধারা বন্ধ হয়ে যাবে আমার মনে এমন কোন সন্দেহ বা আশংকা নেই আলী।”
গোয়েন্দার শাহাদাতে আমার মনে একই সাথে দুটি চিন্তার জন্ম হয়। ভাবি, দ্বীনের এমন একজন মুজাহিদ, আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেল, যে আমাদের ভাই হয়েও আমাদের কাছ থেকে ছিল বহু দূরে।
দ্বীনের জন্যই সে দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। দেশ থেকে দূরে, বিবি বাচ্চা থেকে দূরে, বোন-ভাই ও মা-বাবা থেকে দূরে।
সেই দূর বিজনে চারদিকে শক্ৰ পরিবেষ্টিত অবস্থায়ও সে তার দায়িত্বের কথা ভুলেনি। নিঃসঙ্গতার যাতনা সয়েছে, একাকীত্বের বেদনায় ভুগেছে, কিন্তু দায়িত্বে গাফলতি করেনি। আর এমন নিষ্ঠার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করেছে যে, দায়িত্বের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত কুরবানী দিয়েছে।
অথচ এ জাতিতেই আরেক শ্রেণীর মানুষ আছে যায় কেবল একটু আরাম আয়েশে জীবন যাপন করার জন্য নিজের ঈমান বিক্রি করে দেয়। এসব বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকরা সামান্য বিলাসিতার জন্য শত্রুর যড়যন্ত্রে পা দিয়ে ইসলামের মূল কাটে। অনেকে না বুঝে, আবার কেউ কেউ জেনে বুঝেই ইসলামের ধ্বংস সাধনে শক্রকে সহযোগিতা করে।”
“আপনি কি চান, সেনাবাহিনীর অফিসাররা এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করার কাজে নেমে পড়ুক?” আলী বিন সুফিয়ান বললো, “অথবা আপনি নিজে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্রুসেডদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে জনগনকে সচেতন করতে আত্মনিয়োগ করতে চান?
আমার মনে হয়, অনেকে ঝোঁকের বশে শক্ৰদের সহযোগিতা করে। এতে যে দেশ ও জাতির কি মারাত্মক ক্ষতি হয় তা তারা বুঝতে পারে না। অনেক সময়, এতে যে শক্ৰদের সহযোগিতা করা হয়, তাও তারা বুঝতে পারে না। বুঝতে পারলে হয়ত অনেকেরই চিন্তায় পরিবর্তন আসবে এবং তারা এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকবে।”
‘না’!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, “যখন মানুষ তার ঈমান বিক্রি করতে চায়, তখন তার সামনে কোরআন রাখলেও সে একদিকে কোরআন রেখে তার কাজ করে যেতে থাকবে। যখন কারো সামনে অর্থ-সম্পদ, নারী ও শরাব রাখা হয় তখন কথার ফুলঝুরিতে মন ভরে না তাদের। যারা অর্থ-সম্পদ, নারী ও শরাবের নেশায় আচ্ছন্ন হয়, সদুপদেশ তাদের মনে নেশা ধরাতে পারে না। ওরা হতে চায় সুখের রাজ কুমার, বিপ্লবের সৈনিক হওয়ার আকাঙ্খা থাকে না তাদের।
গাদ্দাররা শিশু নয়, মুর্খ, আহাম্মক বা অবুঝও নয়। এরা সবাই কোন না কোন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বা অফিসার। এরা শাসন ও সেনা বিভাগের উচ্চ পদের লোক! এরা সাধারণ সৈনিকও নয়।
শক্ৰদের সাথে যোগসাজশ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সামরিক অফিসাররাই করে থাকে। সৈনিকরা যুদ্ধ করে মরে, তারা গাদ্দার হয় না, বড়জোর ধোঁকায় পড়ে বিদ্রোহের পথে ধাবিত হয়। কেউ ধোঁকায় পড়লে তাকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়া যায়, কিন্তু গাদ্দাররা জেনেবুঝেই গাদ্দারী করে।
গাদ্দারদের সুপথে আনার জন্য আমি ওয়াজ নসিহত করে বৃথা সময় নষ্ট করতে চাই না। কোন শাসক দুর্বল বা দায়িত্বহীন হলে এ পথ অবলম্বন করে। শুধু কথা ও আবেগময় বক্তৃতায় সে জাতিকে ভুলিয়ে রাখতে চায়। প্রশাসনিক অদক্ষতা ঢাকা দেয়ার জন্য বাগাড়ম্বরকেই সে একমাত্ৰ হাতিয়ার বানিয়ে নেয়।
এ কথা কেবল সরকারের বেলায়ই প্রযোজ্য নয়, তুমি দেখবে, মানুষ যত বড় বিপদে পড়ে তত জোরে চিৎকার দেয়। বড় রকমের চিৎকার, সে যে বেশী রকম অসহায় তাই প্রমাণ করে।
প্রতিপক্ষের মোকাবেলা চিৎকার দিয়ে হয় না, উপযুক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে তার মোকাবেলা করতে হয়। ওরা কোন পথে কেমন করে কত জোরে আঘাত হানছে সে খবর নিয়ে প্রত্যাঘাত করে জবাব দিতে হয় তার।
আমি জাতির কাছে চিৎকার করে আমার অসহায়ত্ব ঘোষণা করতে চাই না। তাতে জনগণ আরো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। আমাদের অসহায় ভেবে তারা আমাদের দিক থেকে মুখও ফিরিয়ে নিতে পারে। আমি কাজের মধ্য দিয়েই অবস্থার পরিবর্তন করব। জাতি আমার কাছে খাদ্য চাইলে আমি তাদেরকে কথা ও উপদেশ দিয়ে পেট ভরাতে পারব না। গাদ্দারদের আমি তাদের পাওনা শান্তি থেকে বঞ্চিত করবো না। তুমি মনে রেখো, শক্ৰদের আগেই গাদ্দার তার বেঁচে থাকার অধিকার হারায়।
আলী বিন সুফিয়ান! আমাকে শাসনের কাজ রেখে ভাষণের কাজে ব্যস্ত হতে বলো না। যারা বেশী কথা বলে আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না। মনে রেখো, মিথ্যাবাদীরাই বেশী কথা বলে।”
মিশরে যে বিদ্রোহের আশংকা ছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। উচ্চপদস্থ কিছু অফিসার ও প্রশাসক ধরা পড়েছে। তাদের শাস্তিও দেয়া হয়েছে। দুজন নিজেরাই সুলতান আইয়ুবীর কাছে এসে তাদের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে। সুলতানও তাদের ক্ষমা করেছেন।
আইয়ুবীর কথাই সত্যি, গাদ্দার ও দেশে অশান্তি সৃষ্টিকারীরা প্ৰশাসন ও সামরিক বাহিনীর অফিসার পর্যায়ের লোকই ছিল। জাতিকে ও সামরিক বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য ওরাই গোপনে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছিল।
মিশরে ১১৭৪ খৃস্টাব্দের আগে সৈন্যদের মাঝে বিদ্রোহের নাম নিশানাও ছিল না। ক্রুসেডদের গোয়েন্দা সংস্থা ও দুষ্কৃতকারীদের তৎপরতার ফলেই মিশরে এ বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠেছিল। এখনও তাদের কার্যকলাপ অব্যাহত আছে, যদিও তা খুবই গোপনে চলছে।
সুলতান জানেন, সহজে এই ধারা বন্ধ করা যাবে না। এ জন্যই সুলতান আইয়ুবী তার গোয়েন্দাদের খৃস্টানদের দেশে নিয়োগ করে রেখেছেন, যেন ছোবলকারীদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়া যায়। এই সচেতনতা ও পাল্টা আঘাত হানার কৌশল প্রয়োগের ফলেই সুলতান আইয়ুবী বিশ্ব ইতিহাসের শ্ৰেষ্ঠতম ও নিপূণ যোদ্ধা হিসাবে আজো সমানভাবে স্বীকৃত।
আক্রা ফিলিস্তিন রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ, সেখানে ক্রুসেডদের সবচেয়ে বড় পাদ্রী, তাদের মহান রক্ষক থাকে। সেখান থেকেই ক্রুসেডার ও তাদের কমান্ডাররা নির্দেশনা, উৎসাহ ও প্রেরণা পেয়ে থাকে।
বলতে গেলে আক্রাই ছিল ক্রুসেডদের হাইকমান্ডের ঠিকানা। আক্রাকে হেড কোয়ার্টার বানিয়ে তারা মুকাদ্দাসকে সুলতান আইয়ুবী ও নূরুদ্দিন জঙ্গীর কবল থেকে রক্ষা করার পরিকল্পনা নিত।
সেখানকার অবস্থা জানার জন্য এবং শক্ৰদের পরিকল্পনা ও পরবর্তী পদক্ষেপের আগাম সংবাদ জানার জন্য সুলতান আইয়ুবী তিনজন ঝানু গোয়েন্দা প্রেরণ করে ছিলেন। তাদের কাজ ছিল আক্রার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য সংগ্রহ করে নূরুদ্দিন জঙ্গী ও সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছানো। এদের কমান্ডার ছিল ইমরান নামে এক নির্ভীক ও বুদ্ধিমান গোয়েন্দা। এই গোয়েন্দাকে আলী বিন সুফিয়ানই বাছাই করে পাঠিয়েছিল।
এই তিনজন খুব সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে আক্রাতে পৌঁছল। সুলতান আইয়ুবী সুবাক দূর্গ ও শহর জয় করায় সেখানকার অসংখ্য খৃস্টান ও ইহুদী ক্রাকে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। মুসলমানরা ক্রাকের ওপর আক্রমণ চালিয়ে এই দূর্গ ও শহর যখন জয় করে নিল, তখন সেখান থেকেও ইহুদী খৃস্টানরা বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে গেল। এই দুটি বিজিত শহর ও দূর্গের আশপাশের এলাকা থেকেই ইহুদী ও খৃস্টানরা পালিয়ে গিয়েছিল।
সৈন্যদের মধ্যেও সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগের লোক ছিল। আলী বিন সুফিয়ানের নির্দেশে তাদের মধ্য থেকে কিছু গোয়েন্দা খৃস্টানদের ছদ্মবেশ নিয়ে খৃস্টান এলাকায় চলে গেল। এর মধ্যে তিনজনকে দায়িত্ব দেয়া হল, তারা যেন আক্রা থেকে শক্ৰদের যুদ্ধ প্ৰস্তৃতির সংবাদ সংগ্রহ করে কায়রোতে পাঠায়।
তাদের বলা হলো, খৃস্টান ও ক্রুসেডদের সকল গতিবিধির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য জরুরীভাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। অমুসলিম নিয়ন্ত্রিত ওসব অঞ্চলে মুসলিম শক্তি ও সৈন্যরা এগিয়ে গেলে সেখানকার জনগণের মধ্যে তার কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং ওই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায় এসব ব্যাপারেও তাদের রিপোর্ট করতে বলা হল।
গোয়েন্দা তিনজন বাস্তুহারা খৃস্টানদের ছদ্মবেশে ক্রাকতে প্রবেশ করলো। সে সময় প্রতিদিনই বাস্তুহারা খৃস্টান ও ইহুদীরা লাইন ধরে আক্রাতে প্ৰবেশ করছিল।
তাদের চেহারায় ছিল নিরাশা ও হতাশার ছাপ। এসব উদ্বাস্তু আশ্রয় প্রার্থীদের নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য ছিল না। আয় উপার্জনের ব্যবস্থা ছিল না। দু’বেলা ঠিকমত খাবারও কোন সংস্থান ছিল না।
ইমরান ও তার দুই সাথী খৃষ্টান সেজে সেখানে আশ্রয় প্রার্থী হলো। তিনজনই খুব চালাক, সতর্ক ও শিক্ষিত ছিল।
ইমরান সোজা বড় পাদ্রীর কাছে চলে গেল। সে তার বাড়ি এমন এলাকায় বললো, যে এলাকা মুসলমানদের অধিকারে চলে গেছে। নিজেকে সে বিপন্ন ও অসহায় বলে প্ৰকাশ করলো। খৃষ্ট ধর্মের একনিষ্ঠ ভক্ত ও পাগল হিসাবে জাহির করলো নিজেকে।
সে পাদ্রীর সামনে কেঁদে কেঁদে বললো, “তার বিবি বাচ্চারা সবাই মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছে। তার এখন আর কোন-পিছু টান নেই। বিবি বাচ্চার জন্য পেরেশানী নেই। সে বলল, বাকি জীবন গির্জার সেবায় কাটিয়ে মরতে চাই।”
“তোমার নাম কি?” পাদ্রী প্রশ্ন করল।
সে তার নাম বললো, “জন গিন্থার।”
“গির্জায় থাকতে হলে যিশুর পুত্র হয়ে থাকতে হবে। দুনিয়ার প্রতি কোন টান থাকলে তো চলবে না।”
“আমি তো চিরকালই দেওয়ানা হয়ে জীবন কাটিয়েছি। দুনিয়ার প্রতি আমার কোন লোভ কোন কালেই ছিল না। বিবি বাচ্চাদের খোঁজ খবরও নিতাম না সব সময়। এ জন্য আমার বিবি ও শিশুরা কাদাকাটি করত, আর অভিযোগ করে বলতো, আমি নাকি কোন কাজকর্ম করি না। শুধু আত্মার শান্তির জন্য ছুটে বেড়াই।
একবার এ জন্য আমি খুব বিপদে পড়েছিলাম। আমাদের এলাকায় এক মৌলভী সাহেব ছিলেন। আমার দেওয়ানা হালত দেখে বললেন, “জন, খোদা তো মসজিদে থাকে, তুমি কোথায় তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?” তার কথাবার্তা শুনে খোদাকে পাওয়ার জন্য আমি তো প্ৰায় ইসলাম গ্রহণই করে ফেলেছিলাম।”
ইমরান পাদ্রী সাহেবকে আরো বললে, “আমার বিশ্বাস আমার স্ত্রী ও সন্তানরা মুসলমানদের হাতে নিহত হওয়ায়, খোদা তাদেরকে তার শান্তির আশ্রয়ে নিয়ে নিয়েছেন। কারন আমি এমন অপদার্থ স্বামী ও বাবা ছিলাম, তাদের কোন রুটি রুজির ব্যবস্থা করতে পারতাম না। খোদাই আমার পরিবারের দেখাশোনা করতেন। আমার সন্তানরা মাকে ছাড়া থাকতে পারতো না। আমি তাদের সম্পর্কে গাফেল ছিলাম বলে ওদের মা-ই ছিল ওদের একমাত্র আশ্রয়।
জন গিন্থার কেদে কেটে পাদ্রীকে বলল, মুসলমানরা আমার বিবি ও সন্তানদের হত্যা না করলে আমি হয়তো ইসলাম কবুল করেই ফেলতাম। তারা কেবল তাদেরই হত্যা করেনি আমার উপরেও অনেক অত্যাচার করেছে। এখন আমি জানি, এই খুনীদের অন্তরে খোদা থাকতে পারে না। মুসলমানদের অন্তরে খোদা নেই, আছে অন্য কোথাও, আছে এই গির্জায়।’
ইমরান সহসা পাদ্রীর কাঁধে হাত দিয়ে তাকে ঝাঁকুনী দিয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘পবিত্র বাবা! আমাকে বলো, আমি তো পাগল হয়ে যাইনি? বলো, আমি এখন সত্যকে চিনেছি, ঠিক বুঝেছি, বলো, না হলে আমি আমার জীবন নিজের হাতেই শেষ করে দেবো। আমি পরকালে খোদাকে বলবো, তুমি পথপ্রদর্শক ছিলে না, শুধু ধর্মের নামে ঢং করেছো, লোকদের ধোঁকা দিয়েছো!”
তার মানসিক অবস্থা দেখে ক্রুসেডের মহান রক্ষক চমকে উঠলেন। তিনি ইমরানের মাথায় হাত রেখে বললেন, “হে আমার বিপন্ন সন্তান! খোদা তোমার বুকের মধ্যেই আছেন। তিনি তোমাকে খোদার বেটার পুজারীদের মধ্যেই রাখবেন। তুমি খৃষ্টান, জন গিন্থর, তুমি এই ধর্মেই, এই সুরতেই খোদাকে পাবে। তুমি যাও, প্রতিদিন সকালে আমার সাথে দেখা করবে। আমি তোমাকে তোমার অন্তরের খোদার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।”
“আমি আর কোথাও যাব না মুকাদাস বাপ!” ইমরান বললো, “আমার কোন বাড়ী নেই। দুনিয়াতে আমার কেউ নেই। আপনি আমাকে আপনার কাছে রাখুন! আমি আপনার ও খোদার বেটার এই গির্জার এমন খেদমত করবো, যেমন আর কেউ করেনি।’
ইমরান ও তার সাথীরা খৃষ্টান ও ক্রুসেডদের গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য আলী বিন সুফিয়ানের কাছ থেকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়েই এই দুরূহ অভিযানে বেরিয়েছিল। সে জন্য খৃষ্টান ধর্ম সম্পর্কেও তাদেরকে পরিপূর্ণ শিক্ষা ও জ্ঞান দান করা হয়েছিল। গির্জার আদব, উপাসনার পদ্ধতি এসবের শুধু প্রশিক্ষণই দেয়া হয়নি বরং বারবার অভিনয় এবং রিহার্সালও দেয়া হয়েছিল।
ইমরান এমন নিপূণভাবে সেই শিক্ষা কাজে লাগোল যে, প্রধান পাদ্রী ও তার সাগরেদ দল তার আদবের পরাকাষ্ঠা দেখে তাকে আনন্দের সাথেই গির্জার মধ্যে থাকার অনুমতি দিয়ে দিল।
ইমরান পাদ্রীর খেদমতে নিজেকে এমনভাবে নিবেদন করলো যে, কয়েক দিনের মধ্যেই পাদ্রী তাকে খাস চাকর বানিয়ে নিল। তার বুদ্ধি ও সরলতা পাদ্রীর মন জয় করে নিয়েছিল।
পাদ্রী মনে মনে স্বীকার করল, এই ছেলে অসাধারণ বুদ্ধিমান এবং তার ওপর ধর্মের ভূত ভালভাবেই চেপে বসেছে। অতএব তাকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে।
পাদ্রী সাহেব তাকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য তার প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিজেই নিয়ে নিলেন।
ইমরানের এক সাথী এক খৃস্টান বণিকের কাছে গিয়ে।
নিজেকে ক্রাক থেকে পালিয়ে আসা খৃস্টান বলে পরিচয় দিল। সেখানে তার সমস্ত পরিবার মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছে। সে তার বেদনা ভরা কাহিনী এমন করুণ ভাবে বর্ণনা করলে যে, খৃষ্টান বণিক সদয় হয়ে তাকে তার কর্মচারী বানিয়ে নিলো।
সে ছিল সুদানী মুসলমান, নাম রহিম হাংগুরা। ইমরানের মতই সেও ছিল বুদ্ধিমান, সাহসী ও সুশ্ৰী যুবক। সে এ বণিকের এখানে চাকরী নিল, কারণ সে দেখেছে, এখানে ক্রুসেডদের সৈন্য ও অফিসাররা নিয়মিত আসা যাওয়া করে। এই বণিক সৈন্যদের খাদ্যশস্যও সরবরাহ করে।
কিছুদিন পর বণিক তার কাজে ও বিশ্বস্ততায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে গৃহ কাজেও লাগাতে শুরু করলো।
রহিম বণিকের কাছে তার নাম বলল, ইলিমোর। সে বণিকের পরিবারের সবার সাথেই অত্যন্ত ভাল ও মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলল। অচিরেই সবাই তার ব্যাপারে খুবই সহানুভূতিশীল হয়ে উঠল।
সে বণিকের স্ত্রী, কন্যা ও ছেলেদের কাছে এমন করুণ ভঙ্গিতে তার ধ্বংসের কাহিনী বর্ণনা করতো, যা শুনে ওদের চোখে অশ্রু এসে যেতো!
রহিম তাদের বলেছে, “আমার বাড়ীও এই বাড়ীর মতই ছিল। এমনি সাজানো গোছানো বাড়ী। এরকমই জৌলুসময় ছিল বাড়ীর আসবাবপত্র। আমার উন্নত জাতের দামী ঘোড়াও ছিল।
বণিকের মেয়ে আলিসাকে রহিম একদিন বলল, “তোমার মত দেখতে আমার এক বোন ছিল, তোমাকে দেখলেই আমার তার কথা মনে পড়ে যায়।”
সে আক্ষেপ করে আরো ৰলল, “একদিন আমার বাড়ীর চাকর তার ফাইফরমাশ খাটতো আমাদের কাজকর্ম করত। আর আজ কপাল দোষে আমি তোমাদের বাড়িতে কাজ করে খাই। অথচ এমনও দিন ছিল, ক্ষুধার্ত লোকদের আমি বিনা কাজেই খাবার দিতাম।’
বণিকের যুবতী মেয়ে এই সুশ্রী যুবকের প্রতি বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়লো। সে তার বোনের সম্পর্কে নানা রকম প্রশ্ন করতো।
রহিম বলতো, ‘সে প্রায় তোমার মতই দেখতে ছিল। যদি সে মরে যেত তবে কোন দুঃখ ছিল না আমার। আমার আসসোস মুসলমানরা তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আমি জানি না, এখন তার কি অবস্থা! হয়ত তুমি বুঝতে পারবে।’
‘তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা কর নি?’
“কেমন করে করবো? তেমন কোন সুযোগ তো ছিলনা! তবে তার পর থেকে প্রতিদিনই তাকে উদ্ধারের কথা মনে হয়েছে আমার। আজও আমি চিন্তা করি, তাকে মুসলমানের হাত থেকে কেমন করে উদ্ধার করা যায়।”
‘সত্যি খুবই দু:খজনক।” সমবেদনা ঝরে পড়ে আলিসার কণ্ঠ থেকে।
‘মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি পাগল হয়ে যাবো। ইচ্ছে করে আবার সেখানে ছুটে যাই, যেখানে আমি আমার প্রাণপ্রিয় বোনকে ফেলে এসেছি। বোনকে হয়তো আর পাব না, কিন্তু তার জন্য মরতে তো পারব। তার কথা মনে হলে আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।”
তার এ ধরনের কথা ও তার বেতাল অবস্থা দেখে মা ও বেটি তাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। এমন মায়াময় যুবকের চেহারায় সে কি বেদনার ছাপ! যৌবন বয়সেই এত বড় আঘাত পেয়ে দিন দিন সে আরো মনমরা হয়ে যাচ্ছে। তার চেহারা বলছে, যদি তার দুঃখ লাঘব না হয়, তবে সে পাগল হয়ে যাবে বা আত্মহত্যা করবে।
আলিসা বণিকের অবিবাহিত যুবতী মেয়ে। সে এই যুবকের ব্যথা বেদনা অন্তর দিয়ে অনুভব করে। এমন কি যখন রহিম যখন বাইরে যায় তখন আলিসাও কোন বাহানা করে বাইরে চলে যায়। সে রহিমকে রাস্তায় পাকড়াও করে বলে, “বাবাকে বলে তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ী চলে এসো।”
সে রহিমের সাথে কথা বলে আবেগমথিত স্বরে। ভাবে, যদি এতে তার দুঃখ কিছুটা হালকা হয়।
মা বণিককে বলে, “এই ছেলেটির দিকে একটু খেয়াল রেখো।’
রহিমের শরীর স্বাস্থ্য ও চেহারায় একটা আভিজাত্য ছিল। দেখলেই বুঝা যায়, কোন উচ্চ বংশের সচ্ছল পরিবারের ছেলে সে।
রহিম অনেক কসরত করে এমন চালচলন আয়ত্ব করেছিল। সবাইকে আকৃষ্ট করতে পারে এমন আদব কায়দা ও ভদ্রতা শেখা তার প্রশিক্ষণেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার কষ্ট করে শেখা বিদ্যা আজ কাজে লাগল। তার অভিনয় ও ভাষার মাধুর্যে সহজেই মুগ্ধ হয়ে যেত যে কোন লোক।
তিন চার দিন পর। সেদিন সে বণিকের পাশে বসেছিল। এমন সময় তার আরেক সঙ্গী গোয়েন্দা রেজাউল জাউওয়াকে দেখলো দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রহিম তার কাছে গেল এবং তার সাথে চলতে চলতে অনেক কথা হলো।
সে তাকে জিজ্ঞেস করলে, “তুমি কি করো।”
“এখনও কোন ঠিকান্ত হয়ে উঠেনি,” বলল রেজাউল।
রেজাউল একজন অশ্ব বিশেষজ্ঞ ছিল। সে ঘোড়া পালন ও পরিচর্যায় যেমন পারদর্শী ছিল তেমনি চৌকস অশ্বারোহী হিসাবেও তার খ্যাতি ছিল পরিচিত মহলে।
রহিম তাকে বণিকের কাছে নিয়ে এলো। সে তার নাম বলল ফ্রান্সিস। বণিককে সে জানাল, ‘এই খৃস্টান যুবক ক্রাকে সব কিছু হারিয়ে এখন বিপন্ন, সর্বহারা। একেও কোথাও একটা চাকরী দিয়ে দেন।”
“কিন্তু ওকে কি কাজে লাগাবো?” বলল বণিক।
রহিম বললো, “সে ঘোড়া লালন পালনের কাজ ভাল জানে। কোথাও ঘোড়ার রাখাল হিসাবে কাজ জুটিয়ে দিতে পারলে হয়।”
বণিক বললে, “ঠিক আছে, আমার কাছে বড় বড় ফৌজি অফিসাররা আসে, দেখি তাদের ওখানে তাকে ঢুকিয়ে দিতে পারি কিনা!’
দু-তিন দিন পর।
বণিকের মধ্যস্থতায় রেজাউল ফৌজি আস্তাবলে চাকুরী পেয়ে গেল। এখানে বিশেষ করে ফৌজি অফিসারদের ঘোড়াগুলোই থাকে।
বণিকের কাছে সবসময় সামরিক অফিসাররা কেন আসা যাওয়া করত। অল্প সময়ের মধ্যেই এর কারণ আবিষ্কার করে ফেলল রহিম।
সে জানতে পারলো, এই বণিক একজন ঝানু ব্যবসায়ী। সাধারণ, সওদাপাতি ছাড়াও তার কিছু গোপন ব্যবসা আছে। এই বণিক গোপনে এসব সামরিক অফিসারদের মদ ও মেয়ে সাপ্লাই করে। এ কারণে সব বড় বড় সামরিক অফিসাররা ছিল তার হাতের মুঠোয়।
রহিম বণিককে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করতো। কথায় কথায় সে তাদের অভিশাপ দিত এবং আশা প্ৰকাশ করতো, একদিন ক্রুসেড বাহিনী সমস্ত আরব ও মিশরের উপরে আধিপত্য বিস্তার করবে।
তার কথায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার চরম ঘূণা ও ক্ষোভ থাকতো। ক্রুসেড বাহিনী যেন একজন মুসলমানকেও বাঁচিয়ে না রাখে সে জন্য সুযোগ পেলেই অফিসারদের কাছে আবেদন করত।
কখনও কখনও সে এত বেশী অস্থির ও উত্তেজিত হয়ে উঠতো যা বলার মত নয়। সে লাগামহীনভাবে বিড়বিড় করে বলতো, আমি ক্রাকের মুসলমানদের রক্ত পান করব।
বণিক তাকে সান্তুনা দিয়ে বলতো, ‘তুমি শান্ত হও। ক্রুসেড বাহিনী তোমার আশা পূরণ করে দেবে।’
সে ক্রুসেড বাহিনীর সেইসব সামরিক অফিসারদের গালমন্দ করত, যারা ক্রাকে আরাম আয়েশে বসে আছে।
সে মুসলমানদের হত্যা করার পরিকল্পনা করতো এবং পরিকল্পনা ও নকশা তৈয়ারী করত, যা দেখে বণিক চমৎকৃত হয়ে যেতো।
বণিক সামরিক বাহিনীর অনেক গোপন তথ্য জানতো। মাঝে মাঝে রহিমের উদ্ভট ও নিত্যনতুন যুদ্ধ পরিকল্পনা দেখে তা সংশোধন করে দিত। তার পরিকল্পনায় কোথায় কি ভুলত্রুটি আছে ধরিয়ে দিত।
এই সব কথার ফাঁকে এমন অনেক সামরিক গোপন বিষয়ও বেরিয়ে আসতো, যে বিষয়গুলো সামরিক অফিসার ছাড়া অন্য কারো জানার কথা নয়।
দিন দিন আলিসা তার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। রহিম শুরু থেকেই তাকে তার দায়িত্ব পালনের অন্যতম হাতিয়ার ধরে রেখেছিল।
কিন্তু আলিসার হৃদয় উজাড় করা প্রেম রহিমের অন্তরেও ভালবাসার সৃষ্টি করে। রহিম সিদ্ধান্ত নেয়, দায়িত্ব পালন করে দেশে ফেরার সময় সে আলিসাকেও তার সঙ্গে কায়রো নিয়ে যাবে। তাকে মুসলমান বানিয়ে তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে।
কিন্তু তাদের কারো জানা ছিল না ক্রুসেড বাহিনীর একজন বড় অফিসার তাদের প্রতি কড়া দৃষ্টি রেখে চলেছে।
রেজাউল জাওয়াও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা ছিল। আস্তাবলে এক বড় অফিসারের ঘোড়া প্রতিপালনের দায়িত্ব পেল সে। সেই অফিসার অনুভব করলো, রেজাউল কোন সাধারণ সহিস বা রাখাল নয়, বরং ছেলেটি তার চেয়ে অনেক বেশী বুদ্ধিমান।
যখন অফিসার আস্তাবলে আসে সে তখন তাকে জিজ্ঞেস করে, “সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে কখন আপনারা পরাজিত করবেন?”
আবার হয়তো কখনো জিজ্ঞেস করে, “সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের মধ্যে, এমন কি গুণ আছে যা ক্রুসেড বাহিনীর নেই?
কেন ক্রুসেড বাহিনী মুসলমানদের শেষ করতে পারছে না?”