ততক্ষণে মুসলিম কমান্ডোরা বর্শা হাতে আলীর নির্দেশিত জায়গায় গিয়ে ওঁত পেতে বসে পড়েছে। খৃস্টানরা যখন সেখানে গিয়ে আলিকে না পেয়ে হতভম্ব, তখন তারা এক যোগে তাদের ঘিরে ধরল এবং বন্দী করে নিয়ে এলো ক্যাম্পে।
‘বন্ধুগণ!’ আলী বিন সুফিয়ান তাদের বললেন, ‘গোয়েন্দা হিসেবে তোমরা খুবই কাঁচা। তোমাদের আরো প্রশিক্ষণের দরকার ছিল। গোয়েন্দারা কি এমন নির্জন রাস্তায় বেখেয়ালে হেঁটে বেড়ায়? গোয়েন্দাগিরি করতে হলে তার কলাকৌশল আমার কাছ থেকে শিখে নাও।’
‘আপনি আপনার কলাকৌশল নিজের লোকদের আগে ভাল করে শিখিয়ে দিন, তাতেই আপনার মঙ্গল হবে। আনাড়ী লোকদের সাথে নিয়ে গোয়েন্দাগিরিতে নামা আসলেই বিপদজনক।’ এক খৃস্টান বললো, ‘আপনার লোকদের কাছ থেকে আপনার সঠিক পরিচয় উদ্ধার করা, আপনার মিশনের খুটিনাটি খোঁজখবর আবিষ্কারের কৃতিত্বটুকু আমরা আমাদের যোগ্যতাবলেই করেছি। আপনার হাতে ধরা পড়েছি, এটা তো একটা ভাগ্যের খেলা। আপনি জিতে গেছেন, আর আমরা হেরে গেছি। যদি আমাদের লিডার মারা না পড়তো, তবে এর উল্টোটিও তো ঘটতে পারতো!’
‘আমাকে কি বলবে, কে তোমাদের কাছে আমাদের গোপন তথ্য ফাঁস করেছে?’ আলী বিন সুফিয়ান জিজ্ঞেস করলেন।
‘সে লোক এখন আমার তাঁবুতে ঘুমাচ্ছে।’ একটি মেয়ে তার তাঁবুর দিকে আঙ্গুল উচিয়ে বললো, ‘সে আমার ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল।’
কিন্তু আলী আলাপ আর দীর্ঘ করতে চাইলেন না। বললেন, ‘এসব কথা এখন থাক, কায়রো গিয়েই বাকি আলাপ হবে।’
উটের ওপর বাণিজ্য সামগ্রী বোঝাই করা। নানা রকম প্যাকেট, তাঁবুর বাণ্ডিল, কতকিছু। সেই বাণ্ডিলের মধ্যে আরো কয়েকটি বাণ্ডিল বাড়লো। আলী বিন সুফিয়ান ও তার গুটিকয় কমান্ডো ছাড়া অন্য কেউ জানতেও পারলো ন, জড়ানো তাঁবুর মধ্যে আছে মেয়ে-পুরুষ মিলে নয়জন খৃস্টান গোয়েন্দা। তাদের কি হাল হলো, তারা দমবন্ধ হয়ে মারা গেল, না বেঁচে আছে, এ নিয়েও যেনো কারো কোন চিন্তা নাই।
কাফেলা দামেস্ক ছেড়ে অনেক দুর চলে এসেছে। পিছনে তাকিয়ে দেখলেন আলী। না, শহরের চিহ্নও আর দেখা যায় না। আশেপাশে কোন লোকালয় চোখে পড়ে না।
আলী কাফেলাকে থামতে বললেন। খৃস্টানদেরকে তাঁবুর বাণ্ডিল থেকে মুক্ত কলে দেখা গেল সকলেই বেঁচে আছে। তিনি মেয়েদের উটের ওপর এবং পুরুষদেরকে ঘোড়ায় তুলে কাফেলাকে আবার রওনা হতে বললেন।
খৃস্টানরা তাদের মুক্তির জন্য আবেদন করে বললো, ‘আমাদের সমস্ত অর্থ সম্পদ, হীরা-জহরত, সোনার থলি, যেগুলো খলিফা ও আমীরদের উপহার দেয়ার জন্য এনেছিলাম, সব আপনাদের দিয়ে দেবো। বিনিময়ে আপনি শুধু আমাদের প্রাণ ভিক্ষা দিন।’
আলী বিন সুফিয়ান হেসে বললেন, ‘ওসব তো এমনিতেই আমাদের সাথে যাচ্ছে।’
সে সময় ত্রিপলীর সম্রাট ছিল দ্বিতীয় রিমেন্স। এখনকার লিবিয়ারই আগে নাম ছিল ত্রিপলী, বর্তমানে তা লিবিয়ার রাজধানী। নূরুদ্দিন জঙ্গীর ইন্তেকালে জেরুজালেম ও আশেপাশের শাসকদের মত দ্বিতীয় রিমেন্সও খুশী হয়েছিলেন। সেই খুশী উপভোগের জন্য তিনি বিভিন্ন দেশের সম্রাট ও খৃস্টান সেনাপ্রধানদের এক কনফারেন্স ডাকলেন।
সে সম্মেলনে কি সব গোপন পরিকল্পনা হয়েছিল বাইরের কেউ তা জানতে পারেনি। কিন্তু দেখা গেল সে বৈঠক থেকে ফিরে কয়েকদিন পরই সেরিজ নামে এক ইংরেজ কমান্ডার তার সামরিক বাহিনীকে হলব পর্যন্ত নিয়ে গেলো। সে সময় হলবের আমীর ছিলো শামসুদ্দিন। সেরিজ তাঁকে পয়গাম পাঠালো, ‘হয় হলব আমার হাতে তুলে দাও নতুবা আমার মোকাবেলা করার জন্য তৈরী হও।’
শামসুদ্দিন ভয়ে দামেস্ক ও মুসালের কাছে সাহায্য চাইলো। কিন্তু তারা সাহায্য করার পরিবর্তে নিজেরাই তা দখল করার উদ্দ্যোগ নিল। অবস্থা বেগতিক দেখে শামসুদ্দিন খৃস্টানদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে নিজের প্রাণ রক্ষা করলো। এভাবেই খৃস্টানরা নতুন করে সফলতার সূচনা করলো।
খৃস্টানদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, মুসলমান আমীররা একে অন্যকে সাহায্য করার পরিবর্তে অন্য রাজ্য আক্রমণ করতে চায়। সে কারণে তারা যুদ্ধ ছাড়াই কেবলভয় দেখিয়ে মুসলিম রাজ্যগুলো দখল করার পায়তারা করতে লাগল। তাদের ভয় শুধু একটি, সালাহউদ্দিন আইয়ূবী। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর শক্তি ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে তারা সজাগ ছিল। তাদের ভয়, যদি সুলতান আইয়ুবী তাদের মোকাবেলায় সমস্ত আমীরদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারে তবে তাদের আশায় গুড়ে বালি পড়বে। সে জন্য তারা তাদের অনুগত আমীরদের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি ও ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলো।
রিমেন্স খলিফাতুলমুলক আবু ছালেহ-এর কাছে উপঢৌকন ও দূত পাঠিয়ে জানালো, ‘যদি আপনি প্রয়োজন মনে করেন, তবে আমরা আপনাকে প্রয়োজনীয় সামরিক সাহায্যও দিতে প্রস্তুত আছি।’
সুলতান আইয়ুবী কায়রোতে বসে অধীর আগ্রহে আলী বিন সুফিয়ানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সময় যেন আর যায় না। ভেতরে ভেতরে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। আলী বিন সুফিয়ানের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করছে তার সমস্ত পরিকল্পনা। তিনি মানসিক ভাবে বাগদাদ, দামেস্ক ও ইয়েমেনে সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছেন। কিন্তু একসাথে তা সম্ভব নয়।
এদিকে মিশরের আভ্যন্তরীণ অবস্থা ভাল না। সৈন্য সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। অবস্থা যা তাতে তিনি মিশর থেকে খুব বেশি সৈন্য সঙ্গে নিতে পারবেন না। এটিই ছিল তার বড় ভয় ও শংকার কারণ। এত অল্প সৈন্য নিয়ে তিনি কি সফল হতে পারবেন? অথচ সামরিক অভিযান ছাড়া এ সমস্যার মোকাবেলায় তিনি দ্বিতীয় কোন পদক্ষেপের কথা চিন্তাই করতে পারছেন না।
অপেক্ষার প্রহর বড় যন্ত্রণাময়। প্রতিদিন তিনি দিনে একাধিকবার বাড়ীর ছাদে উঠে যান। দূর দিগন্তে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। আলী বিন সুফিয়ানের আসার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।
সেদিনও তিনি এমনিভাবে তাকিয়ে ছিলেন দূর দিগন্তে। হটাৎ তিনি বহু দূরে মেঘ দেখতে পেলেন। ভূমি থেকে ধূলির মেঘ উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। সুলতান আইয়ুবী সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন। ধূলির মেঘ ক্রমশঃ এগিয়ে আসতে লাগলো। এক সময় তার মধ্যে থেকে ঘোড়া ও উটের পাল দেখা গেল।
ওটাই ছিল আলী বিন সুফিয়ানের কাফেলা। তাঁরা রাস্তায় খুব কমই বিশ্রাম নিয়েছেন। তাঁদের দৃষ্টিতেও এবার ভেসে উঠলো কায়রোর মিনার। সাথে সাথে তাদের চলার গতি বেড়ে গেল। তীব্র গতিতে ঊট ও ঘোড়া ছুটিয়ে ছুটে আসতে লাগলেন তারা। তাঁরা জানতো, তাদের এ সফরে সময়ের মূল্য কত? সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তাঁদের অপেক্ষার কি অধীর প্রহর গুনছেন।
শেষ হলো প্রতীক্ষার প্রহর। ধূলোয় মলিন আলী বিন সুফিয়ান সুলতান আইয়ুবীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। সুলতান আইয়ুবী তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেলেন অফিস কক্ষে। তাকে কাপড় ছাড়ারও সুযোগ দিলেন না, অধীর আগ্রহে বললেন, ‘বলো, কি খবর নিয়ে এসেছো?’
আলী বিন সুফিয়ান বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করলেন সুলতানের সামনে। নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর আবেগভরা বক্তব্য শোনালেন। সেনাপতি তাওফীক জাওয়াদের সাথে যে আলোচনা হয়েছিল তা শোনালেন। শেষে তিনি বললেন, ‘দামেস্ক থেকে আপনার জন্য কিছু উপহার নিয়ে এসেছি। এ উপহার হচ্ছে, ঁচজন খৃস্টান পুরুষ ও চারজন মেয়ে। সন্ধ্যার আগেই তারা আপনার জন্য আরো মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করবে বলে আশা রাখি।’
‘তার মানে, আমাকে অভিযানে বেরুতেই হচ্ছে?’ বললেন সুলতান আইয়ুবী।
‘হ্যাঁ সুলতান, এ ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তবে আমি আশা করি গৃহযুদ্ধ হবে না।’
সুলতান আইয়ুবী আরো তাঁর দু’জন উপদেষ্টাকে ডাকলেন, যাদের ওপর তাঁর পূর্ণ আস্থা ছিল। তাঁরা এলে তিনি তাদের বললেন, ‘আমি তোমাদের এখন যে কথা বলবো, তা অন্তরে গেঁথে নেবে। তোমরা দু’জন ছাড়া যে এসব কথা আর জানবে শুধু আলী। এ ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ যেন এই গোপন কথা জানতে না পারে।’
তিনি তাঁদেরকে সামেস্ক ও অন্যান্য মুসলিম রাজ্যের আমীরদের অবস্থা ও বিলাসিতার কথা শোনালেন। আলী বিন সুফিয়ানের সংগৃহীত রিপোর্ট শুনালেন আর বললেন, ‘আল্লাহর সৈনিক আল্লাহর আদেশই পালন করে থাকে। খলিফার আদেশ মান্য করা আমাদের ওপর ততক্ষণ ফরজ যতক্ষণ তাঁরা আল্লাহর বিধানের অনুসারী থাকে। কিন্তু আমীর ও খলিফা যদি আল্লাহর মহান দ্বীন ও রাসূলের (সা.) সুন্নাহর পরিবর্তে নিজের খাহেশের গোলাম হয়ে যায়, তখন আল্লাহর সিপাহীর ওপর ফরজ হয়ে যায় তার বিরোধিতা করা।
যদি আমার অস্তিত্ব মিল্লাতের জন্য বিপদ ও কলংকের কারণ হয়, তোমাদের দায়িত্ব হবে আমার নেতৃত্ব ও ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া। প্রয়োজন হলে আমার পায়ে বেড়ী দিয়ে কয়েদখানায় আটকে রাখবে, প্রয়োজন হলে আমার শির ছিন্ন করবে দেহ থেকে, কিন্তু দেশ থেকে আল্লাহর আইন উৎখাত হতে দেবে না।
সমাজ ও রাষ্ট্রে আল্লাহর আইন বলবত ও জারি রাখা হলো আল্লাহর সৈনিকদের মূল দায়িত্ব। আল্লাহর সৈনিক তারাই, যারা আল্লাহকে মুনীব ও মালিক বলে স্বীকার করে। অর্থাৎ মুসলমান মাত্রই আল্লাহর সৈনিক, এ দায়িত্বও তাই প্রতিটি মুসলমানের কাঁধে ন্যস্ত।
একজন মুসলমান হিসেবে এ দায়িত্ব আমি এড়িয়ে যেতে পারিনা। যে খলিফা মিল্লাতের ইজ্জত, সম্মান ও গৌরববোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে শত্রুদের সাথে মিতালি করছে, শত্রুর কাছে সাহায্য ভিক্ষা করছে, তাদের গোয়েন্দাদের আশ্রয় দিচ্ছে, তার কবল থেকে মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষা করা আজ ফরজ হয়ে গেছে।
তার আমীররা আজ খৃস্টানদের আজ্ঞাবাহী, আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার গোলাম। তাদের সহায়তায় মুসলিম রাজ্যেগুলো আজ শত্রুদের অবাধ বিচরন ক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে। হালবের আমীর শামসুদ্দিন খৃস্টানদের কাছে অস্ত্র পর্যন্ত সমর্পন করে দিয়েছে। খলিফা এখন মুসলমান নয় খৃস্টান স্বার্থের রক্ষক। পুতুলের মত খলিফাকে চেয়ারে বসিয়ে মুসলিম মিল্লাতের ওপর আধিপত্য চালাচ্ছে খৃস্টানরা। এ অবস্থায় খলিফাকে গদিচ্যুত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা কি আমাদের ওপর ফরজ হয়ে যায়নি? ইসলামের সম্মান রক্ষায় সেনাবাহিনী নিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া কি আমাদের ঈমানের দাবী নয়?’
‘হ্যাঁ, এটা আমাদের ঈমানী দাবী। খলিফার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের ওপর।’ দু’জন উপদেষ্টা একই সঙ্গে বলে উঠলো।
‘তাহলে কিভাবে এগুনো যায় এসো সেই পরিকল্পনা করি। এ পরিকল্পনার গোপনীয়তার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। আমরা চারজন ছাড়া এ বিষয় আর কেউ জানবে না।’
সুলতান আইয়ুবী উপদেষ্টাদের নিয়ে যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে শুরু করলেন।
খৃস্টান গোয়েন্দা ও মেয়েদের আলী বিন সুফিয়ান এক অন্ধকার গোপন কক্ষে নিয়ে গেলেন। বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সচরাচর তিনি এ কক্ষটিই ব্যবহার করেন।
‘তোমরা এমন এক জাহান্নামে প্রবেশ করেছ, যেখানে তোমরা বাঁচার মত বাঁচতেও পারবে না, আর মরতেও পারবে না। তোমাদের দেহকে কংকালের আকৃতি বানানোর আগেই আমার কাছে সুস্থ অবস্থায় সত্য কথা বলে দাও, আর এই জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করো। আমি তোমাদের চিন্তা করার সুযোগ দিচ্ছি। একটু পরেই আমি আবার আসবো।’
আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে বেড়ী পরানোর আদেশ দিলেন। এক খৃস্টান চিৎকার করে বললো, ‘আমাদের শাস্তি দেওয়ার আগে আমাদের কথা শুনুন। আমরা বেতনভোগী কর্মচারী মাত্র। শাস্তি হওয়া উচিত আমাদের যারা এ কাজে পাঠিয়েছে তাদের। তাদের সম্পর্কে সব কথা আমরা আপনাদের বলে দেবো। দয়া করে আমাদের ওপর রহম করুন। অন্তত এই অবলা মেয়ে কয়টিকে শাস্তি থেকে রেহাই দিন।’
‘তাদের গায়ে কেউ হাতও দেবে না।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তোমরা আমাদের কাজ সহজ করে দাও, তোমাদের মেয়েরা তোমাদের কাছেই থাকবে। এই অন্ধকার কারাগার থেকে সকলকে মুক্তি দেয়া হবে। আমরা মিথ্যা ওয়াদা করি না, সব কথা খুলে বললে তোমাদেরকে বড়জোর সম্মানের সাথে নজরবন্দী রাখা হবে।’
নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পর খৃস্টানরা যেসব গোপন পরিকল্পনা করেছিল সন্ধ্যার আগেই আলী বিন সুফিয়ান সে সব তথ্য তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করে নিলেন। মৃত্যু ভয়ে ভীত খৃস্টান গোয়েন্দারা জানতো গুপ্তচরদের সাথে প্রতিপক্ষ কেমন ব্যবহার করে। আলীর আশ্বাসের ওপর আস্থা রেখে তারা সঠিক তথ্যই দিল আলীকে, যাতে সত্যতা যাচাই করতে গেলে তারা মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত না হয়। তারা আশা করলো এতে তারা কিছুটা হলেও অনুকম্পা চাওয়ার হকদার হবে।
তিন দিন পর। মিশরের সীমান্ত থেকে অনেক দূরে, উত্তর পশ্চিম দিকে মাটির উঁচু উঁচু টিলা ও গিরিপথ সমৃদ্ধ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল। টিলা ও গিরিপথের ফাঁকে মাঝে মাঝে রয়েছে সবুজ মাঠ ও পানির উৎস। সবুজের ছোঁয়া থাকার পরও ছোট বড় অসংখ্য টিলার কারণে অঞ্চলটি দুর্গম। সাধারণ মরু কাফেলা কখনো এ পথে পা বাড়ায় না ভয়ে এবং পথ হারানোর শংকায়।
এ অঞ্চলেই টিলার আড়ালে এক বড়সড় মাঠে দেখা গেল অসংক্য ঘোড়া। তাদের আরোহীরা শুয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, এক জায়গায় ছোট একটি তাঁবু টানানো। তাঁবুর ভেতর শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন এক লোক। এ লোকটি আর কেউ নন, স্বয়ং সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।
ছোট এক তাঁবুতে শুয়ে আছেন সুলতান আইয়ুবী। এখানে সেখানে শুয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে আইয়ুবীর অশ্বারোহীরা। তাদের সংখ্যা মাত্র সাতশো।
সুলতান আইয়ুবী অনেক চিন্তা-ভাবনা করার পর সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি দামেস্কে যাবেন খুব কম সৈন্য নিয়ে। যদি সুলতান হিসেবে মর্যাদা দিয়ে খলিফা তাকে আলোচনার সুযোগ দেন তবে ভাল, আর যদি বাঁধা দেয়, তবে এ সল্প সৈন্য নিয়েই তিনি মোকাবেলা করবেন তাদের।
তিনি তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর মধ্যে থেকে এমন সাতশো সৈন্য বাছাই করেছেন, যারা বহু যুদ্ধে বার বার বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। এর মধ্যে আছে গেরিলা বাহিনীর অশ্বারোহীরা, যারা শত্রুর ওপর ঝটিকা হামলায় পারদর্শী। এরা কেবল কুশলীই নয়, আবেগদীপ্ত, উচ্ছল, প্রাণময়। ক্রুসেডদের নাম শুনলেই এদের চোখ রাগে রক্তলাল হয়ে যায়। সেনাবাহিনীতে এরা ‘ক্রাকের বীর অশ্বারোহী’ গ্রুপ বলে পরিচিত।
অত্যন্ত গোপনে রাতের অন্ধকারে সুলতান আইয়ুবী এদেরকে কায়রো থেকে বের করে নিয়ে আসেন এই দুর্গম অঞ্চলে। সুলতানের নির্দেশ পেয়ে তাঁরা প্রত্যেকেই একা এবং বিচ্ছিন্নভাবে শহর থেকে বেরিয়ে সবার অলক্ষ্যে এখানে এসে সমবেত হয়। নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া পাশের সৈনিকটিও টের পায়নি তার সাথী গোপনে কোন অভিযানে চলে যাচ্ছে।
ওদেরকে এখানে এসে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সুলতান নিজেও কায়রো থেকে গোপনে বেরিয়ে আসেন। শুধু আলী বিন সুফিয়ান ও উপদেষ্টা দু’জন ছাড়া আর কেউ জানেন না সুলতান আইয়ুবী এখন কোথায়? সুলতানের রক্ষী বাহিনী যথারীতি কায়রোতে তার হেড কোয়ার্টার পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। তারাও জানে, সুলতান আইয়ুবী কায়রোতেই আছেন।
কায়রো এবং তার আশেপাশে খৃস্টান গোয়েন্দারা সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল সুলতানের গতিবিধির ওপর। খৃস্টান গোয়েন্দাদের মধ্যে মিশরের কিছু গাদ্দার মুসলমানও ছিল। এদের মধ্যে আবার কিছু ছিল সরকারী চাকুরে। কিন্তু ঘুর্ণাক্ষরেও ওরা কেউ জানতে পারলো না, সুলতান আইয়ুবী সাতশো বাছাইকৃত অশ্বারোহী নিয়ে কায়রো থেকে বেরিয়ে গেছেন।
তিন চারজন লোক টিলার উপরে টহল দিচ্ছে। চারজন পাহারা দিচ্ছে নিচে। সকলের অগোচরে এ বাহিনী রওনা দিয়েছে এক স্পর্শকাতর লড়াইয়ে। খৃস্টানদের তল্লীবাহক খলিফা ও গাদ্দার আমীরদের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করার ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা তাদের চোখে মুখে।
(সমাপ্ত)