এক মেয়ে আন নাসেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাত তুলে ঘোড়া দুটি দেখালো। বললো, ‘ঘোড়ার সাথে বাঁধা থলি খুলে নিয়ে এসো এবং তোমার সাথীদের তা থেকে কিছু খেতে দাও।’
আন নাসের ভয়ে ভয়ে ঘোড়ার জ্বীনের সাথে বাঁধা ব্যাগটা খুলে আনলো, যেন ঐ থলিটা কোন যাদুর ব্যাগ।
সে যখন ব্যাগটা খুললো, তখন দেখলো তার মধ্যে খেজুর ছাড়াও খাবারের আরও কিছু জিনিস আছে, যেসব কেবল ধনী লোকেরাই খায়। এ ছাড়াও তাতে ছিল উপাদেয় শুকনো গোস্ত।
সে মেয়েদের দিকে তাকালো। বড় মেয়েটি বললো, ‘খেয়ে নাও।’
আন নাসের এসব খাবার তার সঙ্গীদের মধ্যে ভাগ করে দিল। ওদের সবার পেট পিঠের সাথে লেগে গিয়েছিল। তারা খাওয়া শুরু করলো। কিন্তু খাদ্যের পরিমাণ তাদের সে ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। বড়জোর দু’জন স্বাভাবিক মানুষের একবেলার আহার হতে পারে। ওরা বিসমিল্লাহ বলে তাই খেতে শুরু করলো এবং আল্লাহর রহমে সবাই তৃপ্তি সহকারে খাওয়া শেষ করলো।
এই সামান্য খাবার তাদেরকে যেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনলো। নতুন করে তারা দেহে প্রাণের স্পন্দন অনুভব করলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে তারা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো এবং আশপাশে চারদিকে তাকিয়ে এলাকাটা দেখতে লাগলো। মেয়েদের দিকে চোখ পড়তেই তারা অনুভব করলো, কিছুক্ষণ আগেও তাদের দুর্বল চোখ যা দেখেছে, তা মোটেও ভুল নয়। যদিও এখন তাদেরকে আগের চেয়েও আকর্ষণীয় ও সুন্দরী মনে হচ্ছে।
‘তোমরা আমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবে?’ আন নাসের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো, জ্বীন ও মানুষের সাথে কোন প্রতিযােগিতা হয় না, তোমরা আগুন! আর আমরা মাটি ও পানি। কিন্তু আমাদের সবার স্রষ্টা এক আল্লাহ! আমাদেরকে তোমাদের সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি হিসেবে একটু দয়া করো। আমাদেরকে তুর্কমান এলাকার রাস্তাতে দিয়ে এসো। তোমরা ইচ্ছা করলে চোখের পলকে আমাদের তুর্কমান পৌঁছে দিতে পারো।’
‘তোমরা কি কোন নৈশ আক্রমণ চালাতে গিয়েছিলে?’ বড় মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো। সঙ্গে সঙ্গে আরো বললো, ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কমাণ্ডোরাও জ্বীনের মতই। আমাদেরকে বলো, তোমরা কোথায় গিয়েছিলে ও কি করে এসেছো?’
আন নাসের সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত তাদেরকে খুলে বললো। তার দল যে সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে রাতের আক্রমণ চালিয়েছিল তার পূর্ণ বর্ণনা দিয়ে বললো, আমরা তাদের বিপুল ক্ষতি সাধন করেছি। কিন্তু ফেরার পথে রাতের আঁধারে পথ হারিয়ে সারা রাত ঘুরে সকালে নিজেদেরকে আবিষ্কার করি মরুভূমিতে। আমাদের সাথে কোন খাবার বা পানি ছিল না, গত দুই দিন এই মরুভূমিতে টিকে আছি কেবল ঈমানের জোরে, নইলে অনেক আগেই আমাদের মরণের পরপারে পাড়ি জমাবার কথা ছিল।
‘তোমরা যে সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে তা সত্যি বিস্ময়কর।’ মেয়েটি বললো, ‘তোমাদের সব সৈন্যই কি এমন দুঃসাহসী ও বীর?’
‘হ্যাঁ।’ আন নাসের উত্তর দিল, ‘আমাদের সব সৈন্যই ঈমানের শক্তিতে আমাদের মতই বলীয়ান। তবে আমাদের চার জনকে এমন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, যা সব সৈনিককে দেয়া হয় না। দুঃখ কষ্ট ও বিপদ মুসীবত সহ্য করার যে ট্রেনিং আমাদের দেয়া হয়েছে, কেবল বাছাই করা কমাণ্ডারাই সে ট্রেনিং পায়। আমরা মরুভূমির হরিণের মত দৌঁড়াতে পারি, ঈগল পাখির মত আমরা বহু দূর পর্যন্ত দেখতে পারি এবং আমরা চিতা বাঘের মত আক্রমণ চালাতে পারি। আমাদের মধ্যে কেউ চিতা দেখেনি, কিন্তু চিতা কি জীব আমরা তা জানি! তারা কেমন করে হামলা করে, কেমন তাদের শারীরিক শক্তি ও তেজ, সবই আমাদের জানা।
অন্য সৈনিকরা যুদ্ধ করে সেনাপতির নির্দেশ মত, কিন্তু আমাদের যুদ্ধ করতে হয় আমাদের নিজস্ব জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়ে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অন্য সৈনিকদের তুলনায় আমরা একটু অন্যরকম। আমরা দ্রুত চিন্তা করতে পারি। আমাদের ওস্তাদরা আমাদের শিখিয়েছে কি করে দ্রুত চিন্তা করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয় তার কৌশল। শিখিয়েছে কি করে শত্রু এলাকায় গিয়ে সেখানকার ফৌজের সাথে মিশে যেতে হয়। আমরা পোষাক বদলে ফেলতে পারি, কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করতে পারি, পারি নিজের চেহারা সুরত পাল্টে ফেলতে। আমরা অন্ধ ও বধির সাজতে পারি। প্রয়োজন হলে আমরা অশ্রু বিসর্জন করতে পারি। আর ধরা পড়ার আশংকা থাকলে আমরা আত্মগোপন করতে পারি, প্রয়োজনে দ্বিধাহীন চিত্তে জীবনের আশা ত্যাগ করে যুদ্ধ করতে পারি। আমরা অকাতরে শত্রু নিধন করতে পারি এবং হাসতে হাসতে মরতে পারি। আমরা শুধু একটি কাজ পারি না, আর তা হলো, আমরা কখনও বন্দীত্ব বরণ করতে পারি না, হয় সফল হই নতুবা শাহাদাত বরণ করে পৌঁছে যাই আল্লাহর দরবারে।’
‘আমরা যদি জ্বীন না হয়ে মানুষ হতাম, তবে তোমরা আমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে?’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো।
‘তুমি হয়তো সে কথা বিশ্বাস করবে না।’
‘তবু বলো।’
আন নাসের বললো, ‘আমরা এমন পাথর, যে পাথরকে নারীর রূপ যৌবন দ্বারা ভাঙা যায় না। আমরা যদি জানতে পারি, তোমরা মানুষ এবং তোমরা আমাদের মতই পথ হারিয়ে এদিকে চলে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে আমরা তোমাদেরকে আমাদের আশ্রয়ে নিয়ে নেবো। যতক্ষণ তোমরা আমাদের জিম্মায় থাকবে ততক্ষণ তোমাদের জান-মাল ও ইজ্জতের মুহাফেজ থাকবো আমরা। এ জন্য আমরা জীবনের ঝুঁকি নিতেও পিছপা হবো না। আমাদের ঈমান যেমন মূল্যবান আমাদের কাছে তেমনি মূল্যবান তোমাদের জীবন ও ইজ্জত। অতএব তোমাদের জীবন ও ইজ্জত রক্ষার জন্য আমরা আমাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করবো। কিন্তু এসব বলে কি লাভ! তোমরা তো আর মানুষ নও। তোমাদের অবস্থা ও শঙ্কাহীন চেহারাই বলে দিচ্ছে, তোমরা মনুষ্য সমাজের কেউ নও। তোমাদের মত এমন অনিন্দ্য রূপসীরা কোনদিন এই মাটির পৃথিবীর বাসিন্দা হতে পারে না।’
‘যদি এটাই তোমাদের বিশ্বাস হয় তবে বলো, এখন আমরা তোমাদের জন্য কি করতে পারি। আমাদের কাছ থেকে কতটুকু কি আশা করো তোমরা?’
‘আমরা তোমাদেরকে অনুরোধ করছি, আমাদেরকে তোমাদের হেফাজতে নিয়ে নাও এবং আমাদেরকে কোন নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও।’
‘তুমি ঠিকই অনুমান করেছে। আমরা মানব সমাজের কেউ নই।’ মেয়েটি বললো, ‘আমরা জানতাম তোমরা কি করছো। তোমরা যে রাস্তা হারিয়ে বিভ্রান্ত পথিকের মত মরুভূমির গভীর বিস্তারে ধুকে ধুকে ফিরছো, আমরা সবই তা লক্ষ্য করছিলাম। তোমরা যদি গোনাহগার হতে তবে যে মরুভূমি তোমরা অতিক্রম করে এসেছে, সে মরুভূমি অতিক্রম করে এখানে আসার সাধ্য তোমাদের হতো না। তার আগেই মরুভূমি তোমাদের রক্ত পান করে, তোমাদের মাংস ও হাড্ডি শুটকি বানিয়ে বালির মধ্যে তোমাদের পুতে রাখতো। এই মরুভূমি কখনও পাপিষ্ঠদের ক্ষমা করে না। তোমাদের অবস্থা দেখে আমরা দু’জনই তোমাদের অনুসরণ করছিলাম। সারাক্ষণ আমরা তোমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ছিলাম। তোমাদের যে সব কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তা তোমাদের ওপর এ জন্যই চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা আল্লাহকে ভুলে না যাও, আর তোমাদের মন থেকে পাপ চিন্তা দূর হয়ে যায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে এ তোমাদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা ছিল। আল্লাহর শোকর, সে পরীক্ষায় তোমরা সাফল্যের সাথেই উত্তীর্ণ হয়েছে।
তোমাদের কষ্ট দেখে যখন বুঝলাম, তোমরা ধৈর্যের শেষ পরীক্ষা দিচ্ছো তখন আমরা তোমাদের সামনে মনুষ্যরূপে আবির্ভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু তখন আমাদের মনে একটা ভয় কাজ করছিল, আমরা ভাবছিলাম, আমাদের হুরপরীর মত চেহারা দেখে যদি তোমাদের সংযম ভেঙে যায়? যদি তোমরা সর্বশেষ পরীক্ষার মুখখামুখি হয়ে ভুলে যাও তোমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথা! যদি শয়তানের আছর পড়ে তোমাদের ওপর আর তার প্রভাবে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাও! কিন্তু আল্লাহ মেহেরবান, তিনি তোমাদের এ ধ্বংস হওয়া থেকেও রক্ষা করেছেন।’
আন নাসের ও তার সঙ্গীরা মেয়েটির কথা শুনে খুব অবাক হলো। বিস্ময় নিয়ে আন নাসের জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে তোমরা এতক্ষণ আমাদের সাথেই ছিলে? কিন্তু…..’
‘হ্যাঁ, দীর্ঘক্ষণ ধরে আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমাদেরকে তিনিই পাঠিয়েছেন, যিনি মরুভূমিতে পথ হারিয়ে ফেলা নেক বান্দাদের পথ দেখান।’ বড় মেয়েটি বললো, ‘তোমাদের ওপর আল্লাহ যে অপরিসীম রহমত বর্ষণ করেছেন, সে রহমতের পরিমাণ তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। পুরুষ মানুষ মুমূর্ষ অবস্থায়ও শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না। এমন অপবিত্র অবস্থা থেমে মুক্ত করার জন্য আল্লাহতায়ালা তোমাদেরকে কঠিন শাস্তিতে ফেলেছিলেন। পরীক্ষায় পাশ করার পর আমাদের ওপর আদেশ হলো, ওদের সামনে দেখা দিয়ে অভয় ও আশ্রয় দাও। আমরা জনতাম, তোমরা শয়তানদের কি বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধন করেছে।’
‘তবে কেন আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলে?’ আন নাসের প্রশ্ন করলো।
‘আমরা শুধু দেখতে চাইলাম, তোমরা মিথ্যা বলো কি না!’ মেয়েটি বললো, ‘দেখলাম, তোমরা সত্যি কথাই বলছো।’
‘আমরা কখনো মিথ্যা বলি না।’ আন নাসের বললো, ‘আইয়ুবীর বাহিনীর প্রতিটি সেনা নিজেকে মনে করে আল্লাহর সৈনিক। আমরা যারা কমাণ্ডো সৈনিক, যারা রাতের আঁধারে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি দুশমনের ওপর, আমাদের একমাত্র ভরসা থাকে আল্লাহর ওপর। তাঁকেই আমরা আমাদের মোহাফেজ ও রক্ষাকর্তা মনে করি। আমরা আমাদের বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, সেনাপতির নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়ে একমাত্র এই শক্তিবলেই জীবনের মায়াকে তুচ্ছজ্ঞান করি। আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ আমাদের সর্বক্ষণ দেখছেন ও দেখবেন। আমরা যেহেতু আল্লাহর দৃষ্টির বাইরে যেতে পারবো না তাই তার নাফরমানিরও কোন প্রশ্ন আসে না। এই বিশ্বাস ও শক্তিই আমাদেরকে সব পাপাচার থেকে রক্ষা করে।’
আন নাসের চুপ করলো। মেয়েরাও চুপ। একটু পর নীরবতা ভঙ্গ করলো আন নাসেরই, প্রশ্ন করলো, “তোমরা তো আমার এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিলে না যে, তোমরা আমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবে?’
‘আমাদের যে আদেশ করা হয়েছে, তার ব্যতিক্রম কিছু করার ক্ষমতা আমাদের নেই। মেয়েটি উত্তর দিল, তোমরা আশ্বস্ত থাকতে পারো, আমরা তোমাদের সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করবো না। আমি লক্ষ্য করছি, তোমরা কথা বলতে পারছে না। তুমি ও তোমার সঙ্গীদের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ঘুমে। কিন্তু ভয়ের কারণে তোমরা ঘুমাতে পারছে না। অন্তর থেকে ভয়ভীতি দূর করে দাও। এখন প্রশান্ত মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।’
‘তারপরে কি হবে?’ আন নাসের জানতে চাইলো।
‘যা আল্লাহর আদেশ হবে, তাই!’ মেয়েটি উত্তরে বললো, ‘তবে আমরা তোমাদের কোন ক্ষতি করবো না। কিন্তু যদি আমাদের এ আশ্বাসে আশ্বস্ত না হয়ে পালাতে চেষ্টা করো তবে ঐ বালির খুঁটি বা স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে থাকবে অনন্তকাল ধরে। এই বলে সে অদূরে দণ্ডায়মান কতগুলো বালির স্তম্ভের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললো, ‘তোমরা তো দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে ওই বালির স্তম্ভগুলো। এগুলোর ওপর যুগ যুগ ধরে কোন চালা নেই, তবু ওরা টিকে আছে পাপের সাক্ষী হয়ে। দেখতে ওগুলো স্তম্ভ বা ঢিবির মত দেখা গেলেও, আসলে এগুলো মানুষ! তোমাদেরকে দেখানোর কোন আদেশ নেই, যদি আদেশ থাকতো তবে যে কোন স্তম্ভের ওপর তলোয়ারের আঘাত করলে তোমরা দেখতে পেতে, তা থেকে রক্ত ঝরছে।’
আন নাসের ও তার সাথীদের ভয় আরও তীব্র হলো, ভীতিবিহব্বল চোখে তারা তাকিয়ে রইলো সেই স্তম্ভগুলোর দিকে। তাদের দিকে তাকালে যে কেউ বুঝবে, মেয়েটির কথা তারা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করেছে, যার কারণে তারা দম আটকে বসে আছে।
‘এই মরুভূমিকে বলতে পারো মাটির জাহান্নাম। মেয়েটি আবার বলতে শুরু করলো, সাধারণত পথ ভুলে এদিকে যারা আসে, তাদের পরিণতি হয় খুবই করুণ। তারা হয়ে যায় বিপথগামী ও পাপী। বিভ্রান্ত মুসাফিরকে পথ দেখানোর জন্য কখনও সুন্দর হরিণের রূপ ধরে, কখনও আমাদের মত জান্নাতের হুর-পরীর রূপ ধরে যারা তাদের পথ দেখাতে আসে, যারা সেই পিপাসার্ত পথিকদের পানি পান করায়, যারা জাহান্নামের এই কষ্ট থেকে তাদের উদ্ধার করে, মানুষ পরে তাদের ওপরই জুলুম শুরু করে দেয়। মানুষ পাপে এতই অভ্যস্ত যে, সুন্দর হরিণ সামনে দেখলে তারা তার ওপর তীর চালিয়ে তাকে হত্যা করে এবং তার মাংস ভক্ষণ করে। আর যখন আমাদের মত অপূর্ব সুন্দরী নারী দেখতে পায়, তখন তাকে একাকী অসহায় ভেবে আনন্দ-ফুর্তি ও ভোগের সামগ্রী বানাতে চেষ্টা করে। তারা এটা বোঝে না, জীবনের অন্তিম, সময় এসে গেছে তাদের।
সে তখন মেয়েটাকে বলে, এসো আমার সঙ্গিনী হও, বিয়ে করে তোমাকে আমার মহলের রাণী বানাবো। বালি ও মাটির এই যে বিশ্রী স্তম্ভগুলো এসবই এই ধরনের মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্য। তোমরা এদের মধ্যে গণ্য হবে না। শুয়ে পড়ো, যদি আমাদের দেখে তোমাদের মনে কোন পাপ চিন্তা এসে থাকে তবে তওবা করে ঘুমিয়ে পড়ো। নতুবা তোমাদের পরিণামও এমনিই হবে, যেমনটি দেখছে।
মানুষের এই স্বাদ ও তৃপ্তিই তার বড় দুর্বলতা। এই তৃপ্তির মোহে পড়ে মানুষ খুব কঠিন পরিণামের দিকে এগিয়ে যায়। মানুষের এই দুর্বলতা তার গৌরব ও সম্মানকে ধূলায় মিশিয়ে দেয়। জাতিগতভাবে কোন জাতি এই দুর্বলতায় জড়িয়ে পড়লে তাদের ভাগ্যেও নেমে আসে কঠিন পরিণতি।’
মেয়েটির বলার ভঙ্গিতে ছিল সম্মোহিত যাদুর প্রভাব। তা ছাড়া তারা তো ধরেই নিয়েছিল এরা এই জগতের কোন মেয়ে নয়, ফলে মেয়েটির কথা দারুণ প্রভাব ফেললো ওদের মধ্যে। তারা নিবিষ্ট মনে মেয়েটির কথা শুনে ভয়ে একেবারে জড়োসড়ো ও সংকুচিত হয়ে গেল। ওরা একে অন্যের মুখের দিকে চাইলো এবং মেয়েটির কথা মত সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিল! পাহাড়ের কোলে ছায়াঘন সেই পরিবেশে শুয়ে পড়লো আইয়ুবীর চার পথহারা কমান্তো এবং ধীরে ধীরে তারা গভীর নিদ্রায় ডুবে গেলো।
চার কমাণ্ডোর সেই ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে বড় মেয়েটির ঠোঁটে ফুটে উঠলো মুচকি হাসি। সে সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো এবং দুজনের ঠোঁটেই ধীরে ধীরে ফুটে উঠলো স্বস্তি ও তৃপ্তির হাসি।
❀ ❀ ❀
আন নাসের যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতো না। তাদের বিজয় হয়েছে এমন কোন সংবাদ তখনো পৌঁছেনি তার কাছে। সুলতান আইয়ুবী ও তার জানবাজ বাহিনী দুশমনের সম্মিলিত বাহিনীকে পর্যদুস্ত ও বিতাড়িত করেছেন, সম্মিলিত বাহিনীর হেড অব দ্যা কমাণ্ড সাইফুদ্দিন গাজী যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেছে, সুলতান আইয়ুবী এখন সাইফুদ্দিন গাজীর আরেক সেনাপতি মুজাফফরুদ্দিনের প্রতি-আক্রমণের অপেক্ষা করছেন, এসব কিছুই তার জানা ছিল না।
কিন্তু সুলতান আইয়ুবী ঠিকই জানেন, মুজাফফরুদ্দিন এমন এক গাদ্দার, যে সুলতান আইয়ুবীর সমর কৌশল সম্পর্কে জ্ঞাত। লোকটি একরোখা ও জেদী, কাল সাপের মত ছোবল হানার জন্য নিশ্চয়ই কোথাও ওঁৎ পেতে আছে, নইলে ময়দানে তার সাথে মোকাবেলা হতোই। মুজাফফরের প্রতি-আক্রমণের আশংকায় তিনি তাই অপেক্ষা করছেন।
সুলতান আইয়ুবীর ধারণা মোটেই অমূলক বা ভুল ছিল না। মুজাফফরুদ্দিন তখন ময়দানের কাছেই এক গোপন স্থানে আত্মগোপন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এলাকাটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এক নিম্নভূমি। সেখানে সে স্ব-সৈন্যে আত্মগোপন করেছিল। সম্মিলিত বাহিনীর মাত্র এক চতুর্থাংশ সৈন্য ছিল সে বাহিনীতে। এ সৈন্য নিয়ে সুলতান আইয়ুবীর সামনে টিকতে পারবে কিনা এই দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছিল তাকে। তার এ দুশ্চিন্তা কিছুটা লাঘব হয়েছিল, কিছু পরাজিত সৈন্য পালিয়ে যাওয়ার সময় তার দলে যোগ দেয়ায়।
সুলতান আইয়ুবী এ বাহিনীর পরিমাণ ও উপস্থিতির কোন সঠিক খবর জানতেন না। কিন্তু বিচক্ষণ সুলতানের কাছে এটা পরিষ্কার ছিল যে, সামনে বিপদ আছে। এ আশংকার কথা জানিয়ে তিনি তার গোয়েন্দা বাহিনীকে আশপাশে ও দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে রেখেছিলেন। তাদের ওপর হুকুম ছিল, ‘যদি কোথাও শত্রু সেনার সন্ধান পাও, তবে সে সংবাদ দ্রুত আমার কাছে পৌঁছে দেবে।’
কিন্তু আইয়ুবী ছাড়া তার বাহিনীর অন্যান্য সদস্যের ধারণা ছিল, সাইফুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাহিনী সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে গেছে এ যুদ্ধে। এ প্রশ্ন কারো মনে উদয়ই হয়নি যে, সম্মিলিত বাহিনীর কোন দল এখনো অক্ষত আছে এবং তারা আইয়ুবীর সৈন্যদের ওপর আবার হামলা করতে পারে। বরং তাদের অটুট বিশ্বাস ছিল, দুশমন বাহিনীর এখনো যারা জীবিত আছে তাদের অধিকাংশই বন্দী। খুব সামান্য সংখ্যক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে, মুজাফফরুদ্দিন যে অঞ্চলে অবস্থান করছিল, সেটা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ ও নিম্নভূমি। পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা পানি, পানির নালা, খাল ও পানি পাওয়ার কারণে গজিয়ে উঠা গাছগাছালিতে এলাকাটি ছিল এমন জঙ্গলাকীর্ণ যে, সেখানে মানুষের যাতায়াত ও আনাগোনা ছিল না। ফলে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা সেখানে কেউ শত্রু খুঁজতে যায়নি।
মুজাফফরুদ্দিনের এ অঞ্চলটা ছিল সমরাঙ্গণ থেকে দু’আড়াই মাইল দূরে। সেখানে পাহাড় ও জঙ্গল পরিবেষ্টিত নিরাপদ স্থানে বসে সে সুলতান আইয়ুবীর ওপর আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছিলো। সে উপলব্ধি করছিল, আর বিলম্ব করার অবকাশ নেই। অনতিবিলম্বে আক্রমণ না চালালে আইয়ুবী সুসংগঠিত হয়ে নিজের বাহিনী নিয়ে যে কোন দিকে অগ্রাভিযান চালাতে পারে।
মুজাফফরুদ্দিন যখন এসব ভাবছিল তখন তাঁবুতে প্রবেশ করলো তার এক সহ-সেনাপতি। তার সাথে আরও একজন লোক। ‘কি! নতুন কোন সংবাদ আছে?’ মুজাফফরুদ্দিন জিজ্ঞেস করলো।
‘সুলতান আইয়ুবীর সেনাবাহিনীর মাঝে কোন পরিবর্তন আসেনি!’ সহ-সেনাপতি বললো, ‘বিস্তারিত এই লোকের কাছে শুনুন! এ লোক স্বচক্ষে দেখে এসেছে!’
‘এ লোক কি আমাদের গোয়েন্দা?’
‘হ্যাঁ।’ সহ-সেনাপতি বললো।
‘বলো, তুমি কি দেখে এসেছো?’
সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যবাহিনী এখনও আমাদের ফেলে আসা মালসামান ভাগ-বাটোয়ারা করেনি। তারা শুধু আহতদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে। তারা লাশগুলো দাফন করার জন্য কবর খুঁড়ছে। তাদের লাশের সঙ্গে আমাদের লাশগুলোও পৃথকভাবে দাফন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ওরা।’
‘আমাকে তাদের কথা শোনাও, যারা এখনও জীবিত আছে।’ মুজাফফরুদ্দিন বললো, ‘যারা মরে গেছে, তাদের তো কবর দিতেই হবে। আমরা ময়দানে নেই, তাই আমাদের নিহত সৈন্যদের লাশগুলো তারাই কবর দেবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাকে বলো, সুলতান আইয়ুবী তার সেনাবাহিনীতে কোন রদবদল করেছেন কিনা? তার মূল বাহিনীর দু’পাশের বাহিনী কি আগের মতই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, নাকি তাদের এদিক-ওদিক সরিয়েছেন আইয়ুবী?’
‘সম্মানিত সেনাপতি!’ গোয়েন্দা বললো, ‘আমি শুধু সৈনিক নই কমাণ্ডারও। আমি যে সংবাদ দিচ্ছি তা একটু ভেবেচিন্তেই দিচ্ছি। আমার উদ্দেশ্য এ নয় যে, শুধু আপনাকে খুশী করি। আমার উদ্দেশ্য ঠিক আপনারই মতই। আমিও সুলতান আইয়ুবীর বিজয়কে পরাজয়ে রূপান্তর করার কথাই ভাবছি।
আপনাকে বিশেষভাবে জানানো দরকার, তারা কেউ তাদের অবস্থান ত্যাগ করেনি। আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনি তাড়াহুড়ো করবেন না।’
‘পরামর্শ পরে দিও, আগে সেখানকার সৈন্যদের রিপোর্ট দাও।’
‘মাননীয় সেনাপতি, দয়া করে আমাকে বাঁধা দিবেন না। আমি যা বলছি তা আমাকে বলতে দিন, দেখবেন ময়দান আপনার চোখের সামনে ভাসছে। আমি জানি, আপনার প্রথম টার্গেট সুলতান আইয়ুবীর ডানের বাহিনী। কারণ তারা আপনার সহজ আওতার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু আমি তার সেনাবাহিনীর অন্য দিকটাও দৃষ্টির সামনে রেখে দেখেছি, আমরা যখন তার ডানের বাহিনীর ওপর আক্রমণ করবো, তখন সুলতান আইয়ুবীব সৈন্যরা অপর দিকটা কিভাবে ব্যবহার করবে।’
‘তারা আমাদেরকে ঘেরাও করার চেষ্টা করবে।’ মুজাফফরুদ্দিন বললো, ‘তাদের ঘেরাও কর্মসূচী শুরু হবে অনেক দূর থেকে। তারপর আস্তে আস্তে অবরোধ খাটো করে আনবে। আমি তার যুদ্ধের চাল সম্পর্কে আগাম খবর বলতে পারি।’
‘সুলতান আইয়ুবী তার রিজার্ভ বাহিনী, যে বাহিনী দিয়ে আমাদের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেছেন, সে বাহিনীকে এক ক্রোশ পিছনে সরিয়ে নিয়ে আবার প্রস্তুত করে রেখেছেন। আপনি ঠিকই বুঝতে পেরেছেন, সুলতান আইয়ুবী আমাদের বাহিনীকে অবরোধ করে ফেলতে চেষ্টা করবেন।
আরও খবর আছে। সুলতান আইয়ুবীর ডানের বাহিনী থেকে দেড় ক্রোশ পিছনে আমাদের ও সুলতান আইয়ুবীর মৃত সৈন্যদের লাশের জন্য কবর খোদাই করা হয়েছে। কবরের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। কবরগুলো তারা করেছে পাশাপাশি এবং বিশেষ পদ্ধতিতে। দেড় হাজার কবর মানে দেড় হাজার গর্ত। আমি কবরের চওড়া, দিকটা লক্ষ্য করে বিস্মিত হয়েছি। আপনি যখন ডান দিক থেকে আক্রমণ চালাবেন, আইয়ুবীর সৈন্যরা পিছনে সরতে থাকবে। আপনি ধাওয়া করে তাদেরকে কবরের কাছে নিয়ে যাবেন। সামনা-সামনি আঘাত না করে আপনি এলোপাথাড়ী তীর বর্ষণ করবেন। তাদেরকে বাধ্য করবেন কবরের দিকে চলে যেতে। তারপর আপনি যখন তাদের অশ্বারোহী সৈন্যদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালাবেন, অশ্বসহ তারা তখন হুমড়ি খেয়ে পড়বে সেই কবরে। এ ছাড়া সেখানে অসংখ্য লাশ গাদা করে রাখা হয়েছে, তারা লাশের সঙ্গেও বাঁধা পাবে, ফলে যুদ্ধের গতি সহজেই চলে আসবে আমাদের অনুকূলে।’
‘সুলতান আইয়ুবীর ডান দিকের ব্যাটেলিয়ানকে কতটা শক্তিশালী মনে করো তুমি?’ মুজাফফরুদ্দিন জিজ্ঞেস করলো।
‘কমের পক্ষে এক হাজার অশ্বারোহী ও দেড় হাজার পদাতিক রয়েছে এ বাহিনীতে।’ গোয়েন্দা কমাণ্ডার উত্তরে বললো, ‘এই বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় আছে। আপনি তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করতে পারবেন না।’
মুজাফফরুদ্দিনের সামনে ময়দানের একটি নকশা পড়েছিল। সে সেই নকশার উপরে হাত রেখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো, এই হলো আইয়ুবীর ডানের বাহিনী। তাদের সামনের ময়দান কিছুটা অসমান। ছোট বড় নানা রকম গর্ত এবং উঁচু ঢিবিও আছে সেখানে। তার দক্ষিণ দিকটা পরিষ্কার। আক্রমণের জন্য এ রাস্তা অধিক উপযুক্ত মনে হয়। এ পথে সরাসরি প্রচণ্ড হামলা চালাতে পারলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হবে এবং কবরে গিয়ে পড়বে।’
‘হ্যাঁ, সেই কবরেই আমি ওদের দাফনের ব্যবস্থা করবো। আমার আক্রমণ সামনে থেকেও হবে এবং ডানের পরিষ্কার জায়গা দিয়েও হবে।’
মুজাফফরুদ্দিন তার সহ-সেনাপতিকে বললো, ‘এখান থেকে ময়দান পর্যন্ত এর মাঝখানে এখন থেকে কোন লোক দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে এনে বন্দী করবে এ আস্তানায়। এ অঞ্চল পুরোটাই এখন যুদ্ধের আওতার মধ্যে এসে গেছে। এদিক দিয়ে কোন যাত্রী আর চলাচল করতে পারবে না। এদিকের সারা পথে এখন থেকে থাকবে শুধু আমার গোয়েন্দা।’
❀ ❀ ❀
হতভাগা দুই মুসাফিরের জানা ছিল না, এ অঞ্চল এখন যুদ্ধের আওতার মধ্যে পড়ে আছে। তাদের একজন এক উটের ওপর সওয়ার ছিল। লোকটা খুব বৃদ্ধ। তার সমস্ত দাড়িই ধবধবে সাদা। উটের ওপর কিছু মালপত্রও আছে। অপর ব্যক্তি উটের লাগাম ধরে টানছিল।
তারা দু’জনই গ্রাম্য বেদুইনদের পোষাক পরিহিত। তারা এমন জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল, যেখান থেকে মুজাফফরুদ্দিনের লুকানো সৈন্য বাহিনী দেখা যাচ্ছিল।
এক সৈনিক তাদের ডাকলো। কিন্তু তারা দাঁড়ালো না, বরং যাত্রার গতি আরও বাড়িয়ে দিল। তারা না থামায় এবার এগিয়ে গেল এক অশ্বারোহী। দ্রুত তাদের সামনে গিয়ে তাদের পথরোধ করে দাঁড়ালো। বাধ্য হলো তারা থেমে যেতে।
অশ্বারোহী মুসাফিরদেরকে বললো, ‘ক্যাম্পে চলো। তোমাদের তল্লাশী নেয়া হবে।’
‘আমরা মুসাফির!’ উটের লাগামওয়ালা বললো, ‘আপনাদের কি ক্ষতি করেছি যে, আমাদের পথ চলতে দিচ্ছেন না?’
‘আমাদের ওপর আদেশ আছে, এদিক দিয়ে যে যাবে তাকেই ধরে নিয়ে যেতে হবে ক্যাম্পে। ব্যস, আর কোন কথা নয়, চলো।’ অশ্বারোহী ধমকে উঠলো।
ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে অশ্বারোহী ক্যাম্পে ফিরলো। এক তাঁবুর সামনে তাদেরকে দাঁড় করিয়ে তাঁবুর মধ্যে সংবাদ দেয়া হলো। কমাণ্ডার বেরিয়ে এলো তাঁবু থেকে। সে মুসাফিরদেরকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা কোত্থেকে আসছো এবং কোথায় যাবে?’
তারা যে উত্তর দিল তাতে কমাণ্ডার নিশ্চিত হলো, এরা কোন গোয়েন্দা নয়। কিন্তু তবু তাদের বলা হলো, ‘তোমাদেরকে এখন আর সামনে যেতে দেয়া যাবে না। কয়েদী করে নয় সসম্মানে রাখা হবে তোমাদের।’
‘এভাবে আমাদের কতদিন মেহমান রাখবেন?’ জানতে চাইলো বৃদ্ধ।
কিন্তু এ প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে সেন্ট্রির দিকে তাকিয়ে কমাণ্ডার বললো, ’এদের থাকার তাঁবু দেখিয়ে দাও।’
এ হুকুম জারি করে কমাণ্ডার আবার তার তাঁবুতে ঢুকে পড়লো। মুজাফফরুদ্দিনের আদেশে আটকাপড়া মুসাফির এই প্রথম।
মুসাফিররা সেন্ট্রিকে অনুরোধ করলে তাদের ছেড়ে দিতে। অনেক কাকুতি মিনতি করলো, কিন্তু তাদের অনুরোধ কেউ শুনলো না।
তাদের যে তাঁবুতে রাখা হলো, সেখানে পালাক্রমে দুই সিপাহী ডিউটি দিচ্ছিল।
রাত। ডিউটিরত দুই সিপাহী বসেছিল তাঁবুর সামনে। রাত ক্রমে গভীর হতে লাগলো। দুই সেন্ট্রি তাঁবুর সামনে বসে নিশ্চিন্ত মনে গল্প করছে। তাদের ধারনা, নিরীহ দুই বন্দী ঘুমিয়ে আছে তাঁবুর ভেতর। তাদের দিক থেকে কোন রকম বিপদ আসতে পারে, এমন কথা সেন্ট্রিদের কল্পনারও অতীত।
এক পাহারাদার তার সঙ্গীকে বললো, ‘দোস্ত, কি কপাল দেখ, বন্দী হয়েও বুড়ো আর তার খাদেম নিশ্চিন্তে তাঁবুর ভেতর আরামে ঘুমাচ্ছে, আমরা শত্রু নেই, যুদ্ধ নেই, তবু ঘুম হারাম করে পাহারা দিচ্ছি এক আজনবী বৃদ্ধকে।’
সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ তখনও জেগেই ছিল। সে তাঁবুর মধ্যে শুয়ে শুয়ে শুনছিল সেন্ট্রিদের আক্ষেপ ভরা কণ্ঠ। তাঁবুর ভেতর ঘন অন্ধকার।
একটু পর বৃদ্ধ তাঁবুর বাইরে নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেলো। বুঝলো, সিপাহী দুইজন জেগে থাকা নিরর্থক ভেবে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে তার খাদেমকে আস্তে করে টোকা দিল। হাতে মৃদু চাপ দিয়ে সাড়া দিল খাদেম। দু’জন নিঃশব্দে উঠে বসলো বিছানায়। বেড়ালের মত সন্তর্পনে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
দরজার কাছে পৌঁছে পর্দা ঈষৎ ফাঁক করে বাইরে মুখ বাড়ালো বৃদ্ধ, দেখলো কাছেই পাশাপাশি দুই সেন্ট্রি হাঁটুতে মাথাগুজে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। দ্রুত তাঁবুর বাইরে চলে এলো ওরা। বাইরে নীরবতা বিরাজ করছিল। তাঁবু থেকে কিছু দূরে গিয়ে বৃদ্ধ তার সাথীকে বললো, ‘তুমি পৃথক হয়ে যাও। দু’জন আলাদা থাকলে একজন ধরা পড়লেও আরেকজনের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে।’
দু’জন দুদিকে পৃথক হয়ে গেল। আলাদা হয়েই বুড়োর সঙ্গী তাঁবুর উল্টো দিক দিয়ে দ্রুত পা চালালো ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য।
তাদের ধারণা সঠিক ছিল না, পুরো ক্যাম্প ঘুমিয়ে থাকলেও ক্যাম্পের পাহারাদাররা ছিল সজাগ ও সতর্ক। তেমনি এক ক্যাম্প প্রহরীর চোখে অন্ধকারে কারো ছায়া নড়ার দৃশ্য ধরা পড়লো। সেও বসেছিল অন্ধকারেই, ফলে চলমান ছায়াটি তাকে দেখতে পেলো না। প্রহরী কোন রকম সাড়া শব্দ না করে ছায়াটিকে অনুসরণ করতে শুরু করলো। কিছুদূর যাওয়ার পর কিছুতে হোঁচট খেল প্রহরী, সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ তাকালো পিছন দিকে। তাকিয়েই দেখতে পেল এক প্রহরী তাকে অনুসরণ করছে। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো কাছেই কিছু আসবাবপত্র পড়ে আছে। সে কালবিলম্ব না করে তার আড়ালে গিয়ে লুকালো।
এরপর শুরু হলো লুকোচুরি খেলা। প্রহরী তাকে খুঁজতে লাগলো আর বৃদ্ধ এখানে ওখানে পালাতে লাগলো। ঠিক একইভাবে তার সাথীকেও দেখে ফেললো অন্য এক প্রহরী। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধের সাথীও লুকিয়ে পড়লো।
মুজাফফরুদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দাদের নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় ছিল। কারণ সে জানতো আইয়ুবীর গোয়েন্দারা কেমন তৎপর ও চৌকস। তাই দুশমনের গোয়েন্দাদের ওপর কড়া দৃষ্টি রাখার হুকুম ছিল তার। তার আরও নির্দেশ ছিল, গোয়েন্দাদের দেখা পেলে তাদের হত্যা না করে ধরতে চেষ্টা করবে।’
সুতরাং মুজাফফরুদ্দিনের প্রহরীরা গোয়েন্দাদের ধরার জন্য বিশেষ ভাবে সচেষ্ট হলো। এ কারণেই বৃদ্ধ ও তার সাথীকে দেখার পরও তাদেরকে ডাকেনি ওরা, অনুসরণ করে তাদের ধরার চেষ্টা করছিল।
বৃদ্ধ ও প্রহরীর লুকোচুরি খেলা তখনো চলছে। বৃদ্ধ এখান থেকে ওখানে ছুটছে লুকাতে, আর তাকে তালাশ করতে তার পিছু পিছু ছুটছে প্রহরী। এবার বৃদ্ধ লুকালো জড়ো করে রাখা কিছু কাঠের আড়ালে, ঘন অন্ধকারের মধ্যে। কাঠগুলো যেভাবে রাখা, তাতে তার এক হাত দূর দিয়ে গেলেও প্রহরী তাকে দেখতে পাবে না।