তুর্কমানে মুজাফফরুদ্দিনের আক্রমণকে ব্যর্থ করার পর সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের বললেন, ’এখন যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এবার তোমরা গনিমতের মাল জমা করো।’
গনিমতের মাল অপরিমেয়! গাজী সাইফুদ্দিনের আশ্রয় ক্যাম্পে প্রচুর সোনা ও নগদ অর্থ পাওয়া গেল। শত্রু সেনাদের লাশের পোষাকেও নগদ অর্থ ও সোনার আংটি ছিল। আর বিভিন্ন সাজ-সরঞ্জাম ও অস্ত্রপাতিও পাওয়া গেল বেশুমার।
সুলতান আইয়ুবী সৈন্যদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও অস্ত্রশস্ত্র তার সৈন্যদের মাঝে বন্টন করে দিলেন। অন্যান্য জিনিসপত্র দামেস্কে ও কায়রোতে পাঠিয়ে দিলেন গরীবদের মধ্যে বিলি বন্টনের জন্য। কারণ মিশর ও সিরিয়া তখন একই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।
তৃতীয় অংশ পাঠিয়ে দিলেন মাদরাসা নিজামুল মুলকের জন্য। ইউরোপের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক লেন পল বর্ণনা করেছেন, সুলতান আইয়ুবী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তিনি আরও লিখেছেন, বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ থেকে জানা যায়, সুলতান আইয়ুবী তার নিজের জন্য গনিমতের মালের কিছুই রাখতেন না।
গনিমতের মাল বন্টনের পর তিনি যুদ্ধবন্দীদের দিকে মনোযোগ দিলেন। এসব যুদ্ধবন্দীদের সবাই ছিল মুসলমান!
সুলতান আইয়ুবী তাদের সবাইকে এক জায়গায় একত্রিত করে বললেন, ‘তোমরা সবাই মুসলমান হয়েও মুসলমানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতে এসেছে। তোমাদের পরাজয়ের কারণ তো এটাই যে, এ যুদ্ধে তোমরা জেহাদী প্রেরণা থেকে বঞ্চিত ছিলে। তোমাদের শাসক ইসলামের জঘন্যতম শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। তাই তোমাদের ভাগ্যে দুনিয়াতে জুটেছে লাঞ্ছনা, পরকালে তোমাদের জন্য রয়েছে কঠিন আজাব ও শাস্তি। কিন্তু আল্লাহ বড় মেহেরবান। তিনি তার অপরাধী ও গোনাহগার বান্দাদের জন্য ক্ষমা ও মাগফেরাতের দুয়ার খোলা রেখেছেন। জানিনা তোমরা তওবা করে ইসলামের পথে ফিরে এলে সে ক্ষমা ও মাগফেরাত তোমাদের ভাগ্যে জুটবে কিনা। তবে আমি এটুকু বুঝি, যে পাপ তোমরা করেছে তার থেকে মুক্তির একটাই পথ খোলা আছে, আর তা হলো, তোমরা আবার ইসলামের সৈন্য হয়ে যাও এবং তোমাদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করার জেহাদে নিজেদের নাম লেখাও।
সুলতান আইয়ুবীর এই বক্ততা বন্দীদের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। এ বক্তৃতায় বন্দীদের জন্য শাস্তির পরিবর্তে কেবল মুক্তির ঘোষণাই ধ্বনিত হয়নি, সেই সাথে তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে তাদেরকে নিজের বাহিনীতে শামিল করার মহৎ প্রস্তাবও দিয়েছেন তিনি। সুলতানের এই ক্ষমাসুন্দর আহবানে সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলো। তাদের মধ্যে নতুন করে জেহাদের প্রেরণা সৃষ্টি হলো এবং তারা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখর করে তুললো পুরো এলাকা।
সুলতান আইয়ুবী ঘোষণা করলেন, ‘যারা জেহাদের উদ্দেশ্যে আমার বাহিনীতে শামিল হতে চাও তারা আমার সৈন্য দলে নাম লেখাও। আর যারা বাড়ি যেতে চাও মুচলেকা দিয়ে তারা চলে যেতে পারবে।’
কিন্তু দেখা গেল, কেউ বাড়ি যাওয়ার দরখাস্ত করলো না, বরং সবাই আইয়ুবীর সেনা দলে নাম লেখানোর জন্য ভীড় করলো।
এমনিভাবে সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য সংখ্যা বেড়ে গেল।
এরা সবাই ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক, ফলে নতুন করে সামরিক প্রশিক্ষণ দরকার ছিল না ওদের। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘ওদেরকে আমাদের বিশেষ যুদ্ধ কৌশল শিখাতে হবে এবং মানসিক দিক দিয়ে ওদেরকে জেহাদী জযবায় উজ্জীবিত করে তুলতে হবে।’
ফলে শুরু হয়ে গেল তাদের ট্রেনিং। এ জন্য সুলতান আইয়ুবী অভিযান বন্ধ রাখলেন। সৈন্য বাহিনীকে নতুন ভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার ফাকে তিনি, দামেস্ক ও কায়রোতে খবর পাঠালেন সামরিক সাহায্য পাঠানোর। মনোযোগ দিলেন আহত সৈন্যদের চিকিৎসার দিকে। মোটের ওপর মুজাফফরুদ্দিনের সাথে সংঘর্ষে তার যে সামরিক ক্ষতি হয়েছিল তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য তিনি সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিলেন।
❀ ❀ ❀
আছিয়াত দূর্গ বর্তমান লেবাননের সীমান্তবর্তী একটি স্থান। মিশরের লেখক মুহাম্মদ ফরিদ আবু হাদীদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, আছিয়াত দূর্গ ফেদাইন নেতা শেখ মান্নানের কেন্দ্রস্থল ছিল। ফেদাইন একটি গুপ্তঘাতক দল। এর মূল নেতা ছিল হাসান বিন সাব্বাহ। তার মৃত্যুর পর বিভিন্ন জন এর নেতৃত্ব দিয়েছে। এ ঘটনা যখন সংগঠিত হয় তখন এর নেতা ছিল শেখ মান্নান। ফেদাইন নেতা হিসাবে অছিয়াত দূর্গের একমাত্র কর্তৃত্ব ছিল শেখ মান্নানের হাতে। সে হাসান বিন সাব্বাহর গদীনশীন হিসাবে সারা দেশের ফেদাইন কর্মীদের পরিচালনা করতো।
গুপ্তঘাতকদের আশ্রয়স্থল এই আছিয়াত কেল্লার সুরক্ষার জন্য সে একদল সুশিক্ষিত সৈন্য মোতায়েন রেখেছিল। আছিয়াত তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দুর্গের চেয়ে সামান্য বড় ছিল। এই দুর্গের সন্নিকটে চারপাশে আরও চারটি ছোট দুর্গ ছিল, যেগুলোকে মূলত এই দুর্গেরই সম্প্রসারিত অংশ বলা যায়।
এই চার দুর্গে অবস্থান করতো শেখ মান্নানের চার ফেদাইন সহকারী। খৃস্টানরা এ কেল্লা তাদেরকে দান করেছিল সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে তাদের বার বার অভিযানের পুরস্কার হিসাবে।
খৃস্টানরা চাচ্ছিল, মুসলমান নেতাদের হত্যা করার জন্য, এবং মুসলিম জাতির চরিত্র হননের জন্য ফেদাইনরা যে কাজ করছে তা যেন আরও ভালভাবে করতে পারে। এই ফেদাইন গ্রুপ নিজেদেরকে ইসলামের একটি উপদল হিসেবে পরিচয় দিতো। কিন্তু খুন-খারাবীতে তারা এতটাই দক্ষতা দেখিয়েছিল যে, সমাজে তারা শুধু ভাড়াটে খুনীচক্র হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে।
ভাড়াটে খুনী হিসাবে খুনের ক্ষেত্রে তারা কোন বাছবিছার করতো না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, খৃস্টান নেতাদেরও তারা খুন করেছে। অগ্রিম অর্থ দিয়ে তাদেরকে এই কাজে ব্যবহার করতো লোকেরা।
সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করার জন্য এদের ভাড়া করেছিল খৃস্টানরা। একাধিকবার তারা সুলতানকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় প্রতিবারই তিনি বেঁচে গেছেন অল্পের জন্য। আইয়ুবীকে হত্যা করার জন্য খ্রিস্টানরা এদেরকে বহু রকম সুযোগ সুবিধা দিয়েছিল। এমনকি কেল্লাও দান করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, তারা নূরুদ্দিন জঙ্গী ও সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করবে।
নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আকবার খান বিভিন্ন ঐতিহাসিকের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পেছনে ফেদাইন দলের হাত ছিল। তারাই তাকে ধোকা দিয়ে সিরাপের সাথে এমন বিষ পান করিয়েছিল, যা ক্রমে ক্রমে তার জীবনী শক্তি নিঃশেষ করেছিল! লোকে জানে, তিনি কয়েকদিন গলার ব্যথায় ভুগে মারা যান। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, গলার ব্যথার যে ঔষধ তাকে দেয়া হয়েছিল, সেই ঔষধে গোপনে ফেদাইন গুপ্তঘাতকরা সেই বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। এখন খৃস্টান এবং খৃষ্টানদের দোসর সম্মিলিত বাহিনীর প্ররোচনায় তারা নতুন করে সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র শুরু করলো।
সেদিন সকাল বেলা। সূর্য তখনও উঠেনি। আন নাসের ও তার সঙ্গীদের নিয়ে দুই মেয়ে আছিয়াত দুর্গের দরোজায় এসে থামলো। বড় মেয়েটি সাংকেতিক ভাষায় কিছু বললো দুর্গ রক্ষীদের, ফটকের প্রহরীরা কেল্লার গেট খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে এই ছোট্ট কাফেলা ঢুকে গেল কেল্লার ভিতরে।
আন নাসের ও তার সাথীদেরকে কেল্লার প্রহরীদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে মেয়ে দুটি চলে গেল শেখ মান্নানের কাছে। শেখ মান্নান সব দিক থেকেই একজন বাদশাহর মত জীবন যাপন করতো। তার চলার ভঙ্গি, জাঁকজমক সম্পূর্ণ বাদশাহদের মতই ছিল। সে’যে বুড়ো হয়ে গেছে এমন কোন অনুভূতিই তার ছিল না।
বড় মেয়েটা তার কাছে উপস্থিত হয়ে বললো, ‘আমরা তুর্কমানের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এসেছি। আপনার বন্ধু সাইফুদ্দিনের ওপর কেয়ামত নেমে এসেছে।’
শেখ মান্নান মেয়েদের দিকে তাকালো। বড় মেয়েটিকে ছাপিয়ে ওর নজর পড়লো ছোট মেয়েটির দিকে। তার দিকে তাকিয়ে শেখ মান্নান বললো, ‘এখানে এসো! বসো আমার কাছে।’
শেখ মান্নান বড় মেয়েকে উপেক্ষা করে ছোট মেয়েকে কাছে ডাকায় ভেতরে ভেতরে মনক্ষুন্ন হলো বড় মেয়েটি। সে কথা বন্ধ করে তাকালো সঙ্গী মেয়েটির দিকে।
‘তুমি প্রয়োজনের চেয়েও বেশী সুন্দরী! আমার পাশে বসো। মেয়েটা তার কাছে গেলে সে তার বাহু ধরে টেনে নিজের পাশে বসাতে বসাতে বললো, তুমি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আজ আমার পাশেই আরাম করবে।’
মেয়েটা শেখ মান্নানের নাম শুনলেও এই প্রথম তাকে দেখলো। সে কি বলবে, কি করবে বুঝতে পারলো না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তার মত বুড়ো মানুষের কাছ থেকে সে এমন আচরণ আশা করেনি।
সে একবার বড় মেয়েটিকে আবার শেখ মান্নানকে দেখতে লাগলো। শেষে সেখান থেকে উঠে সরে যেতে চাইলো শেখ মান্নানের নাগালের বাইরে। শেখ মান্নান চট করে তাকে ধরে ফেলে ঝটকা টান দিয়ে একেবারে তার কোলের কাছে টেনে নিল।
শেখ মান্নানের এ আচরণে মেয়েটি যেমন অপমান বোধ করলো, তেমনি শেখ মান্নানও অপমান বোধ করলো, মেয়েটি তাকে এড়ানোর চেষ্টা করেছে দেখে। শেখ মান্নান বড় মেয়েটাকে বললো, ‘একে আমার সম্পর্কে কেউ কিছু বলেনি? সে জানে না, আমি কে? ও আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে আমাকে অপমান করেছে। ও কি জানে না আমাকে অপমান করা কত বড় অপরাধ?’
’আমি আপনার কেনা দাসী নই!’ ছোট মেয়েটি রেগে গিয়ে বললো, ‘এটা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না যে, যে কেউ আমাকে কাছে টানলেই তাতে আমাকে সাড়া দিতে হবে।’ সে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, ‘আমি একজন ক্রুসেডার। ক্রুশের সেবায় নিবেদিত এক দাসী। ক্রুশের জন্য আমি সব করতে পারি, কিন্তু আমি ফেদাইনদের কেনা দাসী নই যে, দায়িত্বহীনভাবে কেউ আমাকে কাছে টেনে নেবে!’
বড় মেয়েটা তাকে সাবধান করতে চাইলো। কিছুটা ধমকের সুরেই বললো, ‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল! কি সব আবোল তাবোল বকছিস?’
কিন্তু এ ধমকেও সে চুপ করলো না। বলতে লাগলো, ‘মুসলমানদের অন্দর মহলেও এমন লোক আমি দেখেছি। আমাকে সাইফুদ্দিন ও তার উপদেষ্টাদের বিবেকের উপর পর্দা দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, কিন্তু যে লোক আলাপ পরিচয়ের আগেই গায়ে হাত দেয়, তেমন অভদ্রের খায়েশ মেটানো আমার দায়িত্ব নয়। আর দায়িত্ব ছাড়া শুধু শুধু এক বুড়োর সাথে এক কামরায় থাকার কোন প্রয়োজন দেখি না আমি।’
‘যদি তুমি এতো বেশী সুন্দরী না হতে তবে আমি তোমার এই অপমান মোটেই সহ্য করতাম না। তোমাকে ক্ষমাও করতাম না।’ শেখ মান্নান বড় মেয়েটিকে হুকুম করলো, ‘এক নিয়ে যাও এবং আছিয়াত দুর্গের আদব কায়দা ওকে ভাল করে শিখিয়ে দাও। দ্বিতীয়বার আমাদের যখন মোলাকাত হবে তখন যেন এ মেয়ে এখানকার রেওয়াজ মত আচরণ করতে পারে।’
বড় মেয়েটা যে কথা বলতে শেখ মান্নানের কাছে এসেছিল তা আর বলতে পারলো না, ছোট মেয়েটাকে টানতে টানতে তাকে নিয়ে বাইরে চলে গেলো। বেরোবার সময়ও সে বেশ উচ্চস্বরে শেখ মান্নানকে বলছিলো, ‘আমার ওপর আপনার অসন্তুষ্ট হওয়া বৃথা। কারণ আমি আমার বসদের নির্দেশ ও অনুমতি ছাড়া অন্য কারো আদেশ মানতে বাধ্য নই।’
বাইরে এসে বড় মেয়েটির প্রশ্নের জবাবে সে বলতে লাগলো, ‘কেন, আমি কি ফুরিয়ে গিয়েছিলাম! আমরা এত বড় এক তুফান থেকে এলাম, সুদীর্ঘ ও দুঃসহ সফরের ক্লান্তি ভুলে তাকে বলতে গেলাম, আমরা আপনার জন্য মূল্যবান উপহার নিয়ে এসেছি। আইয়ুবীর চার জানবাজ কমান্ডোকে ফাঁসিয়ে এনে হাজির করেছি আপনার দরবারে। কোথায় তিনি আমাদের কাছে দেখতে চাইবেন সেই উপহার, তা না করে কাজের কথা ফেলে হাত বাড়ালেন আমার দিকে। তুমিই বলো, তিনি এটি ঠিক করেছেন?’
‘শান্ত হও। তুমি তাকে চেনো না, কিন্তু আমি চিনি। এই কেল্লায় আমি আগেও এসেছি। আমরা তার…’
মেয়েটির কথা শেষ হলো না, কামরা থেকে বেরিয়ে এলো শেখ মান্নান। বলল, ‘কি বললে? কি উপহার এনেছো তোমরা?’
বড় মেয়েটি জবাব দিল। বললো, ‘আপনার জন্য আমরা আইয়ুবীর চার কমান্ডো সেনা ধরে এনেছি।’
শেখ মান্নান আবার তাদেরকে ঘরে ডেকে নিল। বললো, ‘বলো, পুরো কাহিনী খুলে বলো আমাকে।’
বড় মেয়েটি সফরের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বললো, ‘আইয়ুবীর গোয়েন্দা বাহিনীর কমাণ্ডার আন নাসের ও তার তিন সাথীকে আমরা আপনার কাছে সোপর্দ করার জন্য নিয়ে এসেছি।’ সে আন নাসেরদের সম্পর্কে যা জানে বিস্তারিত শেখ মান্নানকে শোনালো।
শেখ মান্নানের দু’চোখে এবার জ্বলে উঠলো অন্য রকম আলো। সে আনন্দিত কণ্ঠে বললো, ‘আমি এই লোকগুলো দিয়ে এমন কাজ আদায় করে নেবো,এতদিন কেবল যার স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু সফল হতে পারিনি।’
ওরা শেখ মান্নানের কামরা থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসছিল, শেখ মান্নান বড় মেয়েটিকে ইঙ্গিতে কাছে ডেকে আস্তে করে বললো, ‘কিন্তু আমি এ মেয়েকে আমার কামরায় অবশ্যই চাই।’
‘এ বিষয়টি আমার উপরেই ছেড়ে দিন।’ বড় মেয়েটি জবাবে বললো, ‘দেখি, কত দূর কি করা যায়! আমাকে একটু সময় দিতে হবে। আমি তাকে রাজি করাতে চেষ্টা করবো, যাতে সে খুশী মনেই আপনার কাছে আসে। আশা করি আমি বিফল হব না।’
যদিও শিশুকাল থেকেই এসব মেয়েদের পাপ ও নোংরা কাজের ট্রেনিং দেয়া হয়, তার মধ্যেই দু’একজন বেরিয়ে আসে, যাদের এসব ভাল লাগে না। এ মেয়েটি সেই প্রকৃতির। যখনই পাপের প্রশ্ন আসে, বিবেক যেন তাকে চাবুকপেটা করতে থাকে। খৃস্টানদের সযত্ন প্রশিক্ষণের পরও কেন যেন সত্য ও সুন্দরের প্রতি তার আকর্ষণ নিঃশেষিত হয় না। ক্রুশের ব্যাপারে তার আগ্রহ কম নয়, কিন্তু এ জন্য ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে, এতে তার মন কিছুতেই সায় দেয় না।
লোকদের ভুলিয়ে ক্রুশের জালে আবদ্ধ করবে কি, এই কাজের প্রতি তার নিজেরই ঘৃণা ধরে গেছে। এই পেশাকে তার মনে হচ্ছে জঘন্যতম পেশা।
ওরা সারারাত সফর করেছে। নির্ঘুম রাত কেটেছে তাদের। ঘুমে তাদের চোখ বুজে আসছিল। শেখ মান্নানের কামরা থেকে বেরিয়ে নিজেদের কামরায় ফিরে ওরা ঘুমানোর চেষ্টা করলো। বড় মেয়েটি বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লো, কিন্তু ছোট মেয়েটির চোখে ঘুম এলো না। শেখ মান্নানের অভদ্র আচরণ এখনো তার মনটাকে বিষিয়ে রেখেছে। সে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে জানালার পাশে বসলো, তারপর দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল বাইরে।
বাইরে দৃষ্টি মেলে দিয়ে জীবনের তিক্ত কথাগুলোই ভাবছিল সে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে নিজের অজান্তেই দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করেছে, খেয়াল করেনি। তার এ কান্নার কারণ, এ পরিবেশকে সে যেমন মেনে নিতে পারছিল না, তেমনি আকাশ-পাতাল ভেবেও এর থেকে মুক্তির কোন পথও খুঁজে পাচ্ছিল না। এ বিশ্রি পরিবেশ থেকে পালিয়ে যাবে, পালানোর তেমন কোন জায়গাও ছিল না।
বড় মেয়েটি জেগে উঠলো। সঙ্গের মেয়েটিকে জানালার পাশে বসা দেখে উঠে তার কাছে এগিয়ে গেলো। তার চোখে অশ্রু দেখে পাশে বসে পড়ে বললো, ‘দেখ, প্রথম প্রথম মনের অবস্থা এমনটিই হয়। কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, আমরা যা কিছু করছি তা কেবল নিজেদের স্বার্থ বা বিলাসিতার জন্য নয়। আমাদের লক্ষ্য অনেক বড়, আমরা কাজ করছি ক্রুশের জন্য। ইসলামের নাম ও চিহ্ন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার আগ পর্যন্ত আমাদেরকে এ কাজ করে যেতে হবে। আমাদের সৈন্যেরা যুদ্ধের ময়দানে লড়ছে, আমাদেরকে লড়ে যেতে হবে আমাদের সেক্টরে। আবেগের ওপর নিজের বুদ্ধিকে জয়ী করো। দেহের অপবিত্রতা নিয়ে পেরেশান হয়ো আরে, দেহ তো অপবিত্র থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ গোসল না করো।’
‘মুসলমান তাদের মেয়েদেরকে কেন এমনভাবে ব্যবহার করে না, যেমন আমাদের করা হয়?’ ছোট মেয়েটা কান্না থামিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আমাদের সম্রাট, সৈন্য ও সেনাপতিরা কেন মুসলমান সৈনিকদের মত বীরত্বের সাথে লড়াই করতে পারে না? কাপুরুষের মত আমাদের কেন প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে। কেন চোরের মত গোপনে মুসলমানদের হত্যা করতে হবে? সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডোদের মত নিবেদিতপ্রাণ সৈন্য কেন খৃস্টানরা গঠন করে না? তাহলে কি বুঝবো, আমাদের জাতি কাপুরুষ ও ভীরু! শঠ ও প্রবঞ্চক?’
বড় মেয়েটা তাড়াতাড়ি তার মুখ চেপে ধরে অস্থির কণ্ঠে বললো, ‘ছি! এমন কথা আর কারো সামনে বলবে না। তাহলে তুমি খুন হয়ে যাবে। এখন আমরা শেখ মান্নানের কাছে আছি। সে গুপ্তঘাতক বাহিনীর নেতা। তাকে দিয়ে আমাদের বিরাট কাজ করিয়ে নিতে হবে। তাকে, অসন্তুষ্ট করলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না।’
‘এই লোকটাকে দেখেই আমার ঘৃণা ধরে গেছে। ছোট মেয়েটা বললো, এ লোক কোন বাদশাহ বা সম্রাট নয়, একজন ভাড়াটে খুনী মাত্র। বড়জোর বলতে পারো খুনীদের সরদার। এ রকম হিংস্র খুনীদের আমি ঘৃণা করি। তাকে আমি আমার গায়ে হাত দেয়ারও যোগ্য মনে করি না।’
বড় মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে তাকে বুঝালো, শেষে তাকে রাজী করালো শেখ মান্নানের সাথে ভাল ব্যবহার করতে। সে তাকে আরও বললো, ‘আরে, ভয়ের কিছু নেই। আমি তোকে শিখিয়ে দেবো, কি করে পুরুষদের শুধু লালসা ও লোভ দেখিয়ে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা যায়। তুমি তো আমার কৃতিত্ব দেখোনি? আমি বড় বড় বাদশাহ এবং সম্রাটদেরও মাটিতে বসিয়ে রাখতে পারি ঘন্টার পর ঘন্টা! শেখ মান্নান তো সে তুলনায় কিছুই না।’
‘তুমি কি এমন কোন উপায় বের করতে পারবে, যাতে আমরা তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারি?’ ছোট মেয়েটি বললো।
‘চেষ্টা করে দেখবো।’ বড় মেয়েটা বললো, ‘তবে শেখ মান্নানকে অসন্তুষ্ট করে কিছুই করা যাবে না।’
ইতিমধ্যে দু’জন লোক কামরায় প্রবেশ করলো। তারা আইয়ুবীর চার কমাণ্ডো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলো মেয়েদের কাছে। বড় মেয়েটা তাদের সম্বন্ধে সব কিছু খুলে বললো ওদের। তাদেরকে কি জন্য এখানে আনা হয়েছে তাও বললো। তারপর জানতে চাইলো, ‘তারা এখন কেমন আছে?’
‘এখনও ঘুমিয়ে আছে।’ একজন উত্তর দিল।
‘তাদেরকে কি কারাগারে পাঠাবে?’ ছোট মেয়েটি প্রশ্ন করলো।
‘কারাগারে পাঠানোর কোন প্রয়োজন নেই।’ লোকটি উত্তরে বললো, ‘এখান থেকে পালিয়ে ওরা যাবেই বা কোথায়?’
‘আমি কি তাদের সাথে দেখা করতে পারবো?’ ছোট মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো।
‘কেন পারবেনা।’ সে উত্তর দিল, ‘তারা তো তোমাদেরই শিকার। তাদের নিয়ে যেমন খুশী খেলা করার অধিকার তোমাদের অবশ্যই আছে। তাদের সাথে সাক্ষাৎ করো, তাদের কাছে বসে তাদেরকে আরো ভাল করে জালে আটকাও, কে মানা করছে তোমাদের।’ এ কথা বলেই তোক দু’জন বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
সফরের সময় পথে বড় মেয়েটিকে সে তার মনের কথা খুলে বলেছিল। যদিও তার গার্জিয়ানরা তাকে ক্রুশের সেবায় উৎসর্গ করেছে, কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল একটি সাজানো সংসার। এ পথে এসেছে সে অল্প কিছুদিন। বয়সে নবীন যুবতী। এখনো মনের আবেগ দমন করার কায়দা আয়ত্ব করে উঠতে পারেনি। আগ্রহ না থাকার কারণে অন্য মেয়েদের মত চালুও হয়ে উঠেনি। এই প্রথম তাকে পরীক্ষামূলকভাবে বাইরে পাঠানো হয়েছে। তার সাথে বড় মেয়েটিকে পাঠানো হয়েছে, যেন সে তাকে পারদর্শী করে তোলে।
বড় মেয়েটি এখন বড় বিপদে আছে ওকে নিয়ে। কারণ এ মেয়ের কাজ শেখার মোটেই আগ্রহ নেই, ফলে সে কোন কাজেই তেমন সফল হতে পারছে না। পুরুষকে আঙ্গুলের ওপর নাচানোর কায়দা কানুন এখনো তার রপ্ত হয়নি। হবে কি করে, সে নিজেই এ কাজকে জঘন্য মনে করে। বুড়ো সেনাপতিদের ভীমরতি দেখে নাকি তার ঘেন্না পায়।
সাইফুদ্দিন যে কয়দিন তাকে খেলার পুতুল বানিয়ে রেখেছিল, সে কয়দিন সে ভালই ছিল। তেমন কোন অভিযোগ শোনা যায়নি তার কাছ থেকে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে সাইফুদ্দিনের বিপর্যয় তাকেও এলোমেলো করে দিল। যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে দুঃসাহসিক ও দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে। রাতভর সফর করতে হয়েছে। সেই কষ্ট ও ক্লান্তি দূর করার আগেই অভদ্রের মত তার দিকে শেখ মান্নানের হাত বাড়ানোটা তার মনে হয়েছে অমানবিক ও বর্বর আচরণ। বড় মেয়েটি বুঝতে পারলো, এ নিয়ে শেখ মান্নানের সাথে তার বাদানুবাদের বিষয়টিই তাকে অস্থির করে তুলেছে।
কিছুক্ষণ পর ছোট মেয়েটি বড় জনের বাঁধা সত্ত্বেও সেই কমাণ্ডো সৈন্যদের কামরায় গেল। সেখানে আন নাসের ও তার সাথীদেরকে সে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো।
আন নাসের আসলে জেগেই ছিল। সে ছোট মেয়েটাকে কামরায় প্রবেশ করতে দেখে ঘুমের ভান করে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো, এখন তার কি করা উচিত। শেষে এই সিদ্ধান্তে এলো, মেয়েটির সাথে কথা বলা দরকার।
সে যেন হঠাৎ করেই তার ঘুম ভেঙ্গে গেল এমন ভাব করে জেগে উঠলো। জেগেই সামনে মেয়েটিকে দেখে কিছুটা অবাক হওয়ার ভান করে উঠে বসলো এবং জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাদের কোথায় নিয়ে এসেছো? সত্যি করে বলো তো, তোমরা কে বা কি? এটা কি ধরনের জায়গা? জ্বীনদের আবাস কি এমন দূর্গের মত হয়?’
ছোট মেয়েটা আন নাসেরের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কখনো সে দৃষ্টিতে ক্ষোভ, কখনো করুণা প্রকাশ পাচ্ছিল। মেয়েটা যে আবেগ ও উত্তেজনায় অধীর তাও প্রকাশ পাচ্ছিল সে দৃষ্টিতে। আন নাসের মেয়েটার এ উত্তেজনা ও অধীরতা দেখে অবাক হলো। আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কি, আমার প্রশ্নের কোন জবাব দিলে না যে!’
মেয়েটি আন নাসেরের একদম কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি বললো, ‘তোমরা কি পালাতে চাও?’
‘তোমরা কে তাইতো জানি না। তোমরা শত্রু না মিত্র তা জানলে আমরা কি করবো তা ঠিক করি কিভাবে? আগে বলো তোমরা কে? আমাদের নিয়ে তোমাদের পরিকল্পনা কি? তারপর আমি চিন্তা করে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করবো।’ আন নাসের উত্তর দিল।
মেয়েটা তার চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বললো ‘আমি জ্বীন নই, মানুষ! আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। পালাতে চাইলে বলো, আমি সহযোগিতা করবো।’
মেয়েটির এ অযাচিত আশ্বাস বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করলো না আন নাসের। বরং এতে তার প্রতি তার সন্দেহই বৃদ্ধি পেলো।
আন নাসের কোন জবাব দিচ্ছে না দেখে মেয়েটি এবার তার খাটের দিকে এগিয়ে গেল এবং খাটের ওপর পা তুলে বসে পড়লো।
আন নাসের ছিল সুঠাম সুন্দর দেহের অধিকারী এক সুদর্শন যুবক। যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি সাহসী। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কমাণ্ডো বাহিনীতে যোগ দেয়ার আগে লোকে তাকে বলতো ডানপিটে, বাহিনীতে শামিল হওয়ার পর বন্ধুরা তাকে জানে দুঃসাহসী বলে। মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারতো এ যুবক। সে এবং তার মত অন্যান্য কমান্ডোদের নিয়ে খৃস্টানদের মধ্যে প্রবাদ বাক্য সৃষ্টি হয়েছিল যে, সুলতান আইয়ুবীর এসব কমাণ্ডোদের দেখে মৃত্যুও ভয় পায়। মরুভূমির কঠিন জীবন, নদীর প্লাবন এবং কংকরময় পাহাড় ও প্রান্তর, এসব কোন বাঁধাই তাদের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারতো না। বিপদ মুসিবতের কোন পরোয়াই ছিল না এইসব জানবাজদের। তারা আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে ভয় পেতো না। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পিছপা হতো না।
যদি আন নাসের আছিয়াত কেল্লা পর্যন্ত নিজ ক্ষমতা বলে ও সজ্ঞানে সফর করতো, তবে এতটা ভীত হতো না। যদি তাদের বন্দী করে ধরে আনা হতো তবু ভয় তাদের কাবু করতে পারতো না বরং তারা পালানোর হাজারটা পথ খুঁজে বের করতো। কিন্তু তাদেরকে নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন সে নেশার ঘোর চলে গেলেও নেশার ঘোরে দেখা সবুজ মাঠ, ফলের বাগান, ঘাসের গালিচার কথা তারা ভুলেনি। তার মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীর কোন অঞ্চলে হয়তো এমন সবুজ মাঠ ও ফলের বাগান থাকতেও পারে। হয়তো সে অঞ্চলটাই তারা পেরিয়ে এসেছে। এখন তার খাটের ওপর যে মেয়েটি বসে আছে তাকে সে জ্বীনের মেয়েই মনে করেছিল। মেয়েটি তার কল্পনার চেয়েও বেশী সুন্দরী। আন নাসের এমন মেয়েকে মানুষ কন্যা মেনে নিতে পারে না।
মেয়েটি যখন তাকে বললো, তার ওপর সে ভরসা করতে পারে, তাতে সে আরও ভীত হয়ে পড়লো। সে শুনেছিল, পরীরা প্রলোভন দেখানোতে ওস্তাদ। মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সুবিধামত জায়গায় নিয়ে তারপর তাকে হত্যা করে ফেলে। এখন তার কাছে এই কেল্লাটা পরীদের প্রেতাত্মার কেল্লা বলে মনে হচ্ছিল। তার সাথীরা তখনও গভীর নিদ্রায় ডুবে ছিল আচ্ছন্ন হয়ে।
তারপরও সে মনকে বুঝালো, আমি কমাণ্ডার। আমাকে সাহস হারালে চলবে না। এভাবে নিজের মনকে প্রস্তুত করে সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি তোমার ওপর কেন ভরসা করবো? কি জন্য নির্ভর করবো তোমার আশ্বাসের ওপর? তুমি আমার ওপর এত দয়া দেখাচ্ছে কেন? কেনই বা আমাকে এখানে আনলে? এ স্থানটাই বা কোথায়?’
‘যদি তুমি আমাকে বিশ্বাস না করো, তবে তোমার পরিণাম খুবই খারাপ হবে।’ মেয়েটি বললো, ‘তোমার হাত তোমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হবে। তুমি সে রক্তকে ফুল মনে করে খুশী হবে। আমি এখনই তোমাকে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না যে, কেন আমি তোমার প্রতি দয়া বা অনুগ্রহ দেখাচ্ছি। তবে জেনে রেখো, আমি তোমার একজন শুভাকাঙ্খী।’
কথা কয়টি বলে সে আর সেখানে অপেক্ষা করলো না, দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে নিজের কামরায় ফিরে গেল।
❀ ❀ ❀
আন নাসের ও তার সঙ্গীদেরকে শেখ মান্নানের দুই প্রহরী তাদের হেফাজতে নিয়ে গিয়েছিল। তখনও তাদের নেশার ঘোর কাটেনি। সারা রাত পায়ে হেঁটে এসে তারা ঢলে পড়ছিল ক্লান্তির কোলে।
প্রহরীরা তাদেরকে এক কামরায় নিয়ে এলো। কামরাটি বেশ বড়োসড়ো। তাতে কয়েকটি খাট পাতা। এক প্রহরী বললো, ‘সারা রাত সফর করেছে, নিশ্চয়ই তোমাদের ঘুম পেয়েছে। নাও, এই খাটে শুয়ে পড়ো।’
বাধ্য ছেলের মত প্রহরীর হুকুম পালন করলো কমাণ্ডোরা। তারা পালংকের ওপর শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।
দুপুরের পর আন নাসেরের ঘুম ভাঙ্গলো। সে এদিকওদিক তাকিয়ে দেখলো। তার সাথীরা তখনও ঘুমাচ্ছে। সে তার আশপাশে তাকিয়ে চিনতে চেষ্টা করলো কোথায় আছে।
সে দেখতে পেল, কামরার দরজা বন্ধ, তবে সবকটি জানালা খোলা। ঘরে খাটের ওপর ঘুমিয়ে আছে তার সাথীরা।
তার মনে পড়ে গেল গত রাতের সেই স্বপ্নময়তার কথা। চারদিকে অবারিত সবুজ মাঠ, চাদের কোমল জোসনা, সুবাসিত ফুলের বাগান, বিভিন্ন রংয়ের পাখির কিচির মিচির, গালিচার মত ঘাসের কোমল স্পর্শের কথা তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে লাগলো। মনে পড়লো তার মেয়ে দু’টির কথা। মনে পড়লো মরুভূমি ও. মরুভূমির খরতাপের কথা। মরুভূমির নির্দয় আচরণ, সাথীদের স্মৃতিবিভ্রম, মরীচিকা ও সেই দুঃসহ কষ্টের কথা। এখন সেসব কথা তার দু:স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে।
সে বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল বাইরে। দেখতে পেলো, এটা একটা দুর্গ। সৈন্যরা আসা যাওয়া করছে। কিন্তু তাদের পোষাক আইয়ুবীর সৈন্যদের মত নয়।
সহসা সে পূর্ণ চৈতন্যে ফিরে এলো। অনুভব করলো, মরুভূমির বিপদসংকুল সফরটিই ছিল প্রকৃত সত্য ও বাস্তব। তারপর তার মেয়েদের সাথে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। মেয়েদেরকে তার জ্বীন বলে মনে হয়েছিল। তার পরের ঘটনা তার কাছে অস্পষ্ট। মধুর স্মৃতিগুলোকে নিছক স্বপ্ন ও কল্পনা বলে মনে হলো তার। কিন্তু সে এখন কোথায়? এই প্রশ্ন তাকে অস্থির করে তুললো। সে তার সঙ্গীদেরকে জাগালো না। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সৈন্যদের আসা যাওয়া দেখতে লাগলো। এরা কার বাহিনী? এটা কোথাকার দুর্গ, কেমন ধরনের দুর্গ? এসব নানা প্রশ্ন কিলবিল করতে লাগলো তার মাথায়। কিন্তু সে এ কথা কাউকে জিজ্ঞেস করাও সমীচিন মনে করলো না।
সে ধারন করলো, এটা নিশ্চয়ই কোন শত্রু বাহিনীর দুর্গ হবে। তবে কি সে তার সঙ্গীদের নিয়ে এখানে বন্দী হয়ে আছে। কিন্তু এ কামরাতো কয়েদখানার কামরা নয়!
সে এক গোয়েন্দা ও কমাণ্ডো সৈনিক! কাউকে জিজ্ঞেস করেই এই ধাধার সমাধান বের করা উচিত তার। তার বিবেক ও বুদ্ধি সক্রিয় হয়ে উঠলো। তখনি এক অজানা ভয় এসে ভর করলো তার ওপর।
সে জানালা থেকে সরে গিয়ে খাটের ওপর বসে পড়লো। এ সময় বাইরে কারো পদশব্দ শুনতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গে সে শুয়ে পড়ে ঘুমের ভান করে নাক ডাকতে লাগলো।
সে আড় চোখে দেখলো, যে দুই মেয়ের সাথে তারা রাতে সফর করেছে, এ তাদেরই একজন। সে মেয়েটির সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল এবং উঠে বসে তার কাছ থেকেই জানতে পারলো, তারা জ্বীনপরী কিছু নয়, তারা তাদের মতই মানুষ। মেয়েটি তাকে পালিয়ে যাওয়ার কথা বললো এবং এ ক্ষেত্রে তার পক্ষ থেকে সাহায্যেরও আশ্বাস দিল। কিন্তু, এ আশ্বাসে বিশ্বাস আনলো না আন নাসের।
মেয়েটি চলে যেতেই সে ভাবতে লাগলো, এর পিছনেও আবার কোন ষড়যন্ত্র নেই তো! যে মেয়ে তাকে ও তার
সাথীদের এখানে এনে বন্দী করেছে, সে কেন তাকে সহায়তা করতে যাবে। সে একটি বিষয়ে খুব চিন্তাগ্রস্ত হলো, মেয়েটি বলেছে, তাকে বিশ্বাস না করলে তার পরিণাম খুব খারাপ হবে। ভাইদের রক্তে রঞ্জিত হবে তার হাত। মেয়েটির এ হুমকি উড়িয়ে দেয়া যায় না। যে মেয়েরা তাদের নেশাগ্রস্ত করে ভুলিয়ে এনে বন্দী করতে পারে, তারা এমন নেশাও তাদেরকে পান করাতে পারবে, যার ঘোরে পড়ে ভাইদের হত্যা করতে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে ওরা। কারণ আন নাসের শুনেছিল, ফেদাইন গুপ্ত ঘাতকদের হাতে বিচিত্র ধরনের নেশা আছে। আচ্ছা! এরা ফেদাইন নয়তো? প্রশ্নটা মনে হতেই আন নাসের আরেকবার শিহরিত হলো।
মেয়েটি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর। আন নাসের তখন খাটের ওপর বসে বসে ভাবছে, এমন সময় বাইরে আবারও কারো পায়ের আওয়াজ পেলো। সঙ্গে সঙ্গে সে বিছানায় শুয়ে পড়ে নাক ডাকতে লাগলো। দু’জন লোক কামরার মধ্যে প্রবেশ করলো। একজন অন্যজনকে বললো, ‘কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়েছে।’
‘আচ্ছা, ওদের শুয়ে থাকতে দাও।’ অন্যজন বললো, ‘মনে হচ্ছে এদেরকে বেশী পান করানো হয়ে গেছে। এদের সম্পর্কে কি বলা হয়েছে?’
‘দুই খৃস্টান মেয়ে এদেরকে ফাঁসিয়ে নিয়ে এসেছে!’ আগের লোকটি বললো, ‘এরা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কমাণ্ডো ও গোয়েন্দা। শুনেছি এরা খুবই চালাক ও দুর্ধর্ষ হয়। এদেরকে ঠিক মত সম্মোহিত করতে পারলে অসাধ্য সাধন করা যাবে।’
লোক দু’টি চলে গেল। আন নাসেরের শরীরের প্রতিটি লোম শিউরে উঠলো। সে বুঝতে পারলো, ভয়ংকর এক চক্রের হাতে আটকা পড়েছে ওরা। মেয়ে দুটি তাদের ধোঁকা দিয়েছে। জ্বীন-পরী কিছু নয়, ওরা স্রেফ শিকার ধরার টোপ।
এখন তাকে জানতে হবে এটা কাদের কেল্লা, কি ধরনের কেল্লা! এ কেল্লা কোন এলাকায় অবস্থিত? তাকে ও তার সঙ্গীদেরকে কেন সম্মোহিত করা হবে? কি কাজ করানো হবে তাদের দিয়ে? সে আরো উপলব্ধি করলো, এটা একটা দূর্গ। এই কঠিন দূর্গ থেকে পালানো মোটেই সহজ ব্যাপার নয়! কিন্তু যত কঠিনই হোক, আন নাসের সিদ্ধান্ত নিল, এখান থেকে তাদের পালাতেই হবে। সে তার সঙ্গীদেরকে জাগিয়ে তুললো।
সমাপ্ত